Sudeep Chatterjee's Blog, page 2

April 29, 2025

শাউন ট্যানের ওয়ার্ডলেস ক্লাসিক

 


এক যুগ পর শাউন ট্যানের ওয়ার্ডলেস ক্লাসিক কাজটা পড়া হল। মন্ত্রমুগ্ধ বললে কম বলা হয়। মাথা খারাপ করে দেওয়া ভাবনা। গ্রাফিক নভেলের যাবতীয় নিয়ম ভেঙে ফিল্মমেকিং প্রসেস অনুসরণ করে কাজটা করেছেন ট্যান, প্রতিটা সিকোয়েন্সের স্টোরিবোর্ড এঁকেছেন, সত্যিকারের মানুষদের মডেল করে চরিত্রগুলো এঁকেছেন।

কী নিয়ে এই গ্রাফিক নভেল?

খাতায় কলমে এক ইমিগ্র‍্যান্টের গল্প। সে এক কাল্পনিক দুনিয়ায় গিয়ে পড়েছে। সেখানে নিয়মকানুন আলাদা, ভাষা আলাদা। বাস্তবে একজন ইমিগ্র‍্যান্ট নতুন জায়গায় গিয়ে যেসব ঝামেলায় পড়ে, ফ্যামিলিকে নিয়ে আসার আগে কাজকর্ম জোগাড় করতে হবে, পরিচিতি বাড়াতে হবে, একাকীত্ব কাটিয়ে রোজ চেষ্টা করতে হবে ইন্টিগ্রেট করার।

আর্টওয়ার্ক নিয়ে কথা বলার আস্পর্ধা আমার নেই। গোটাটাই সিপিয়া টোনে পুরোনো ফোটোগ্রাফ স্টাইলে আঁকা, মাঝেমধ্যে পাতা জুড়ে একটাই ছবি। এবং, একটাও সংলাপ নেই।

আশ্চর্য কথা, এই গ্রাফিক নভেলটা আসলে ছোটদের জন্য লেখা। কিন্তু বড়দের জন্যও এই লেভেলের ক'টা কাজ হয়েছে, সেটা খুঁজে দেখতে হবে।

Arthur A. Levine Books

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 29, 2025 10:22

April 28, 2025

টোকিও আজকাল

 


তাইয়ো মাতুস্মোতো যে জিনিসে হাত দেন, তাই সোনা হয়ে যায়। শুধু শুধুই ভদ্রলোক একাধিকবার আইসনার অ্যাওয়ার্ড পাননি। ভিজ থেকে তিন খণ্ডে প্রকাশিত 'টোকিও দিজ ডেজ' কথাটা ফের মনে করিয়ে দিল।কাজুও সিওজাওয়া তিরিশ বছর ধরে মাংগা আঁকছেন। গ্রাফিক নভেলের শুরুতেই দেখা যায়, তিনি তার কর্মজীবন থেকে ইস্তফা নিচ্ছেন। স্বেচ্ছায়। তাঁর সহকর্মীরা, তাঁর জুনিয়াররা, সম্পাদক হিসেবে যাঁদের তিনি হাত ধরে সামনে নিয়ে এসেছেন, সবাই খানিকটা বিভ্রান্ত। সত্যি বলতে, সিওজাওয়া নিজেও খানিকটা কনফিউজড। তাঁর মাংগা জীবনের দীর্ঘ কেরিয়ার যেন গিয়েও আর যাচ্ছে না। তিনি জমিয়ে রাখা ঘরভর্তি মাংগা কমিকস বিক্রি করব করব করেও করতে পারছেন না, আঁকা ছেড়ে দেব বলেও ছাড়তে পারছেন না, অজান্তেই সেই কাফে বা টি হাউসের দিকে পা ঘুরে যাচ্ছে যেখানে তাঁর জুনিয়ার বা মেন্টাররা বসতেন, এখনও বসেন। বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরছেন। শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলছেন, আর্ট ফর্ম নিয়ে আলোচনা করছেন। মাঝে মাঝে হয়তো একজনকে বোঝাচ্ছেন, যে আগের মতো আর কাজে সেই স্পার্ক দেখা যাচ্ছে না। আবার কাউকে বলছেন, লেগে থাকো, তোমার মধ্যে আছে, শুধু হাল ছেড়ো না। এক সময় গল্প সিওজাওয়াকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর মাংগা জগতে ঢুকে পড়ে। কত কত শিল্পী। কেউ প্যাশনেট, কেউ হাল ছেড়ে দিয়েছে, কেউ লড়ে যাচ্ছে, কেউ অবসাদগ্রস্ত। তাদের রোজনামচা, তাদের আশা হতাশা আর... আর টোকিও শহর। ভালোয় মন্দে, রোদে বৃষ্টিতে, কাকাতুয়া আর বেড়ালের কথায়, ছাতা উড়ে যাওয়ায়, শেষ ট্রেন ধরায়, রাস্তা ক্রস করায়... শহর চলছে গল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সাদামাঠা। অলংকারহীন। আড়ম্বরহীন। কিন্তু জীবনের মতো বহমান। তিন খণ্ড ধরে শুধু এ-ই। শহর আজকাল। টোকিও দিজ ডেজ।এসব গল্প লেখা থুড়ি আঁকা সকলের কম্মো নয়, সাহসের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 28, 2025 10:20

April 22, 2025

রহস্য বাকি আছে (ভারতবর্ষ)

 


গত সপ্তাহে আফ্রিকায় কতরকম আবিষ্কার হচ্ছে, সেই নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। তার আগে মিশর নিয়েও একটা আপডেট দিয়েছি। অনেকের হয়তো ধারণা হতে পারে, আবিষ্কার- ফাবিষ্কার বুঝি দেশের বাইরেই সব হচ্ছে। পোস্ট ট্রুথ ইন্ডিয়ান সোসাইটিতে গবেষণা-ফবেষণা সব গোল্লায় গেছে, সবাই ফালতু বকতেই ব্যস্ত, তাঁদের মিষ্টি হাসি হেসে বলতে হয়, একশো চল্লিশ কোটির দেশে ও কথা ভাবাও পাপ। ভারতবর্ষে আজও এমন মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, যারা একের পর এক কামাল করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে সেই সব কথা পৌঁছতে পারে না, তাঁদের নিয়ে কেউ ব্রেকিং স্টোরি করে না, এইটুকুই যা দুঃখের। যাকগে, অন্তত পাঁচটা বিষয় নিয়ে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক আর আবিষ্কারকরা কী কী চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারছেন, সেই নিয়ে কয়েক লাইন করে লিখে দিলাম। বড় লেখা কেউ পড়েও না। কেউ আগ্রহী হলে বিস্তারিত পড়তেই পারেন খুঁজে।

১) প্রথমেই পুরাতত্ত্ববিদদের কাণ্ডকারখানা দেখা যাক। আমাদের দেশে আর্কিওলজিস্টদের নানা রকম ঝামেলায় পড়তে হয়, সেই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইতিহাস খুঁড়ে বের করা ঢের ঝক্কির কাজ, টাকাফাকাও লাগে, খোদ সরকারেরও ওতে বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সামান্য বাধানিষেধ পেলেই বড় বড় প্রজেক্ট তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে, এক্সক্যাভেশন সাইটে খাটিয়ে রাখা ত্রেপল নিজেই ফসিল হয়ে যায় আর কি! তবু ভারতীয় আর্কিওলজিস্টরা হাল ছাড়তে রাজি নয়। গত কয়েক বছরে তারা এমন সব রোমাঞ্চকর তথ্য জানতে পেরেছেন যে দুনিয়ায় হইচই পড়ে গেছে।

প্রথমেই বলতে হয় কিলাদি এক্সপিডিশনের কথা। তামিলনাডুর কিলাদি আর কাছাকাছি অবস্থিত অন্যান্য এক্সক্যাভেশন সাইট থেকে পাওয়া তথ্য এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে যে ইতিহাসবিদরা দাড়ি চুলকে পোকা বার করে ফেলছেন প্রায়। ব্যাপারটা ইতিহাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে৷ কিলাদিতে বহুদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, সেখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্রাফিতি-চিহ্নিত মৃৎপাত্রের টুকরো, খোদাই করা চাকা, সোনার অলংকার, হাতির দাঁতের পাশা, জীবজন্তুদের মূর্তি তো আছেই, কিন্তু আসল ঝামেলা বেধেছে সেখানে পাওয়া সঙ্গম টেক্সট নিয়ে। কিলাদি থেকে প্রচুর পরিমাণে পটারি আর অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে, তার ওপর তামিল ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা খোদাই করা আছে। পড়ে সকলের ঘুম উড়ে গেছে। এ যে সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে।

এখন সঙ্গম সাহিত্য আবার কী জিনিস? খুব ভাসাভাসা বলতে হলে বলতে হয় তামিল সাহিত্যে সঙ্গম সাহিত্যের টেক্সট প্রায় একটা লিজেন্ড। সঙ্গম সাহিত্য আসলে ব্যাকরণ গ্রন্থ কাব্যসংকলন (তোল্কাপ্পিয়াম) আর তা বাদেও আটটা গ্রেটার টেক্সট নিয়ে একটা প্রাচীন সাহিত্য জনরা, সেগুলো আবার দু ভাগে শ্রেণীভক্ত করা হয়েছে। অত ঝামেলায় না গেলে বলি, উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে আকানানুরু (৪০০ প্রেমের কবিতা), পুরানানুরু (৪০০টা বীরত্বপূর্ণ কবিতা), কুরুন্থোগাই (ছোট প্রেমের কবিতা) এবং নাত্রিনাই (পাঁচটা সিনসিনারি নিয়ে কবিতা) ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হল, সঙ্গম লিটারেচর দাবী করে তামিল সভ্যতা ৬০০ বিসিই-তেও, এমনকি তার আগেও যথেষ্ট উন্নত ছিল। সেখানে স্থাপত্যশিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভীষণ ভাবে এগিয়ে ছিল। এতদিন ভাবা হত উত্তর ভারতে জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে প্রথমে, দক্ষিণ ভারতে নয়। সঙ্গম সাহিত্যে যে বলা হয়েছিল তামিল সভ্যতা আরিয়ান আর বৈদিক সভ্যতার চেয়ে ভিন্ন আর তামিলরা প্রাচীনকাল থেকেই স্বতন্ত্র সভ্যতা বিকশিত করেছে, সেটা সত্যি। কোন্ডাগাই বিউরিয়াল সাইট থেকে পাওয়া আর্টেফ্যাক্টগুলোর লিপি পড়ে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।পাশাপাশি এনসিয়েন্ট তামিলরা যে এজুকেশন, ক্রাফটসম্যানশিপ আর ট্রেডিংয়ে ভীষণভাবে উন্নত ছিল বলে লেখা হয়েছিল, তা শুধুই কষ্টকল্পনা নয় বলেও প্রমাণ হয়েছে।

এসব জানার পর রাজনীতি গরম। তামিলনাডুর সিএম বলছেন সেন্টার থেকে ফান্ডিং বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিডিয়াতেও যেন এই নিয়ে বিশেষ কথা না হয়, সেইজন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে চারিদিক থেকে। তাঁদের ভয়, তামিলনাডুর ইতিহাস নিয়ে এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার রাজনীতিতেও পালাবদল ঘটাতে পারে। সে-সব সত্যিমিথ্যা জানি না, তবে কিলাদি অভিযান আর নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে সারা দুনিয়ার ইতিহাসকাররা উদগ্রীব হয়ে আছে।

২) তামিলনাড়ুর গাঙ্গাইকোন্ডাচোলাপুরমেও খননকার্য চালিয়ে চোল বংশের ইতিহাস, শিল্পকর্ম আর ঐতিহ্য নিয়ে অজানা সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে। গবেষকরা বিশ্বাস করছেন যে আয়ুধালাম আর কোল্লানকুঝিতে এক্সপিডিশন চালিয়ে গেলে আরো অনেক তথ্য জানা যেতে পারে, কিন্তু আপাতত বাজেট নেই সেই কাজটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পট্টরাইপেরেম্বুদুরেও টেরাকোটা শিল্প আর মৃত্তিকামূর্তি মিলিয়ে প্রায় দশহাজার আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া গিয়েছে।

৩) হরিয়াণার রাখিগরিতে একটা প্রাচীন জলাশয় বা রেজর্ভয়ের সিস্টেম পাওয়া গিয়েছে। হরপ্পান যুগে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য জানা গেছে। হাইড্রোলজিস্ট আর ত্রিমাত্রিক মডেল ডিজাইনারদের কথা বিশ্বাস করতে হলে বলতে হবে, এমন উদ্ভাবনী ওয়াটার সিস্টেম সম্পর্কে এখনও আমরা বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি।

৪) ওদিকে ইসরো যে একের পর এক ধামাকা করছে সে তো সবাই জানে। চাঁদের সাউথ পোলে চন্দ্রযান নামানোর কথা বেশ আলোরণ ফেলেছে, সূর্যের করোনা আর সোলার উইন্ড নিয়ে স্টাডি করার জন্য যে আদিত্য-এল১ বলে সোলার অবজারভেটারি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে তার চেয়েও বেশি লাফালাফি হচ্ছে একটা ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার নিয়ে। এক বিরল বিস্ফোরণের সময় সুইফট জে১৭২৭. ৮-১৬১৩ ব্ল্যাকহোল থেকে যে হাই এনার্জি এক্স রে পাওয়া গেছে, তাতে কিছু আনইউজুয়াল বিহেভিয়ার লক্ষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই অস্বাভাবিক আচরণের নাম 'অ্যাপিরিওডিক মড্যুলেশন'। এই আচরণের ফলে এক্স-রেতে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক প্যাটার্ন দেখা যায় যা কোয়াসি-পিরিওডিক অসিলেশন (QPO) নামে পরিচিত। ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত জোর গবেষণা চলছে।

৫) ওদিকে বনেজঙ্গলেও ধুমধাড়াক্কা চলছে। ২০২৩ সালেই জীববৈচিত্র্যে একের পর এক নতুন নাম যোগ হয়েছে, ভারতে ৬৪১টি নতুন প্রজাতির প্রাণী পাওয়া গিয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯৯টি প্রথমবার ভারতে পাওয়া গিয়েছে। প্রচুর প্রাণী এই প্রথম পাওয়া গেছে পৃথিবীর বুকে। নতুন আবিষ্কারের বেশিরভাগই ছিল অমেরুদণ্ডী প্রাণী (৫৬৪টি প্রজাতি), বিশেষ করে পোকামাকড় (৩৬৯টি প্রজাতি), যেখানে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে (৭৭টি প্রজাতি), মাছ (৪৭টি প্রজাতি) প্রাধান্য পেয়েছে, তারপরে সরীসৃপ, উভচর, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি রয়েছে। হিমালয়ে 'হিমালয়ান আইবেক্স' বলে একটা নতুন প্রজাতির আইবেক্স বা পাহাড়ি ছাগল পাওয়া গেছে, কর্নাটকের কুর্গে Miniopterus srinii বলে বাঁকানো ডানার চামচিকে মিলেছে, কেরালায় পাওয়া গেছে অ্যান্ট মিমিকিং স্পাইডার, ময়ুরভঞ্জে নতুন প্রজাতির গিরগিটির নাম খাতায় উঠেছে। সবচেয়ে বেশি প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে ওয়েস্টার্ন ঘাটে, বলাই বাহুল্য। তবে নর্থ ইস্টে হাজার রকম গাছড়া পাওয়া গেছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে।

এছাড়াও দেশজুড়ে আবিষ্কার চলছে। জাদুবিদ্যা নিয়ে, উপজাতির ইতিহাস আর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে, সামুদ্রিক জীবন ও পরিবেশ নিয়ে, জিওসায়েন্স নিয়ে, এমনকি ভূত প্রেত রাক্ষস নিয়েও নৃতত্ত্ববিদরা ডেঞ্জারাস সব কাজ করছেন। পড়তে গেলে রোমাঞ্চে গায়ের কাঁটা দাঁড়িয়ে যায়। মুশকিল হল, অধিকাংশ জনতা শুধু আলতু ফালতু নিউজ চ্যানেল আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়ে আছেন, বাকিরা রিল নিয়ে লাফাচ্ছেন। অনেকে তো ভেবেই নিয়েছেন এ দেশে কিছুই হয় না, কারণ এসবের বিশেষ প্রচার নেই। আসল কথা হল, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও কাজ হচ্ছে, আস্তে আস্তে করে হলেও নতুন আবিষ্কার চলছে। আমি নিশ্চিত, আমার বন্ধুবৃত্তেই এমন মানুষ আছেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। যদি তাঁরা মাঝেমধ্যে সে নিয়ে কিছু কিছু কথা জানান, আমার মতো আগ্রহী পাঠকরা উপকৃত হই আর কি!

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 22, 2025 10:18

April 21, 2025

বাংলার স্টেশন কথা

 


একটা বই কী করে হয়?

একটা বই করে কী হয়?

দুটো প্রশ্নের উত্তরই কেস স্পেসিফিক। একটা বই করে আসলে কিছুই হয় না হয়তো; শুধু শুধু মানসিক চাপ নেওয়া, ঘাড়ে পিঠে ব্যাথা হওয়া, কিংবা চোখের বারোটা বাজানো। আবার হয়তো, একটা বই করে একজন ভীষণ আনন্দ পায়। গোটা প্রসেসটার সময় তো বটেই, তার পরেও সেই বইটা তাঁর জীবনে ভ্যালু অ্যাড করে। ওদিকে, একটা বই তৈরি হওয়াও নানারকম। আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই রবিবার পান্ডুলিপি শুরু হয়ে পরের শনিবার জমা হলে আসছে সোমবার বই ছাপাইতে চলে যায়। আজকাল অ্যাসেম্বলি লাইনে ফেলে বই করা কোনও ব্যাপারই নয়। ওদিকে এমনও ঘটে, যে ভীষণ নাকমুখ কুঁচকে একটা বই নিয়ে বছর কাবার করে দেন লেখক/প্রকাশক, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান, অথচ বই হাতে নেওয়ার পর সেই যত্ন চোখে বা মনে ধরা পড়ে না।

কথাগুলো মনে পড়ল, এই বইটার কথা উঠতে। ট্রেন নিয়ে আমার বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ আছে বটে, কিন্তু বাংলার স্টেশন নিয়ে আমি ওই দু একটা বই পড়ে ভাসাভাসা যা জানা যায়, তার চেয়ে বেশি কিছু জানি না। তবু কেন জানি সম্পাদক জুটি আমাকে প্ল্যানিং টিমে রেখেছিলেন কে জানে? হয়তো ট্রেনের প্রতি আগ্রহের কথা জেনে গিয়েছিলেন বলেই! ফালতু বকা ছাড়া আমার কন্ট্রিবিউশান শুন্য। মাইনাসও বলা যায়। কিন্তু এই গোটা সময় ধরে আমি দেখলাম, একটা 'নট সো কমন' বিষয়বস্তুর বইটাকে একটা 'নট সো কমন' বই বানানোর জন্য দুজন মানুষ কী খাটুনিই না খাটলেন!

ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে যখন আমাকে গ্রুপে ঢোকানো হয়, তার সম্ভবত বছর খানেক আগে থেকেই বইয়ের খসড়া করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানে, বিষয়বস্তু সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করা, অন্যান্য বই গুলে খাওয়া, কে বা কারা লিখতে পারেন, কী নিয়ে লিখতে পারেন, তার একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ম্যানুস্ক্রিপ্টের যেমন ড্রাফট ১ থেকে ২০ হতে পারে, প্রাথমিক পরিকল্পনাও ফাইনাল হতে গিয়ে পঞ্চাশবার অদলবদল হয়।

একপর্ণিকা ছোট প্রকাশনী। ত্রিপুরা থেকে বই করে, প্রকাশক কলকাতায় আসেন না। মানে, আসেনই না। মুখ দেখাতেও না। জয়ঢাক প্রকাশন তাদের পরিবেশক, বই তাই সহজলভ্য। কিন্তু মূল প্রকাশকের বই করে কতটা প্রফিট হয়, কতজন পড়েন আমার জানা নেই। আন্দাজ করছি, সঙ্খ্যাটা মারাত্মক কিছু নয়! তবু, একটা বই নিয়ে এই লং টার্ম এফর্ট দেওয়া, এই আন্তরিক যত্ন আর নিজের দিক থেকে পরিশ্রমের ত্রুটি না রাখার প্রসেসটা আমি বেশ কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি।

তা সত্ত্বেও কি সব সময় বই একদম পারফেক্ট হয়? সব বইই কি বিষয়বস্তু, প্রোডাকশন বা প্রচ্ছদের দিক থেকে আমার চোখে দারুণ কিছু বলে মনে হয়?

না। হয় না।

এটাই সত্যি কথা। বানানের ভুল থাকতে পারে, প্রচ্ছদ আমার পছন্দ না হতে পারে, মেকিং বা প্রুফের ত্রুটিও কিছু থাকতে পারে মাঝেমধ্যে। থাকেও।

কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করে, তা হল একজন মানুষের প্রতিবার নাছোড়বান্দা পারফেকশন পাওয়ার জন্য করা এই চেষ্টাটা। প্রকাশনী বলতে তো একজন মাত্র মানুষ। বাজেটও নেই। লোকবলও নেই। শুধু ভালো বই করার জেদ আছে, ইচ্ছে আছে। আমি জানি, এমন প্রকাশনী আরো আছেন। অনেকেই আছেন, শূন্য লাভ নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন। একবার একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাংলা প্রকাশনা জগতে কী ভালো লাগে? আমি বলেছিলাম, হাজার অপেশাদারিত্ব আর বিতিকিচ্ছিরি রকম পলিটিক্স আর স্ট্রাকচারহীন জগতে থেকেও কয়েকজন মানুষ সব প্রফিট লসের হিসেব ভুলে ভালো বই করার জন্য খাটছে, বুদ্ধিসুদ্ধি শিকেয় তুলে প্যাশন নিয়ে বাঁচছে। ওইটুকুই ভালো লাগা। ওইটুকুই।

এইবার আমি একটা বই বানাতে দেখলাম, যেটার সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবেও হয়তো জড়িয়েও নেই। না আমার লেখা আছে, না আমি সম্পাদক, না বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেইজন্যই বুঝি আরো মন দিয়ে দেখতে পেলাম, অনুভব করতে পারলাম, এই বইটা ঠিক কতটা যত্ন নিয়ে তৈরি করা হল?

বাংলায় স্থানীয় স্টেশন নিয়ে একাধিক কাজকর্ম হয়েছে। কিন্তু সাবজেক্টটা এতটাই বড় যে প্রতিটা অঞ্চলের স্টেশন নিয়ে এক একটা সিরিজই হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, তুলনামূলক ভাবে অজানা বিষয় নিয়ে লেখা সংগ্রহ করার জন্য সম্পাদকরা কী কী করেছেন? বইটাকে ভালো করার জন্যই বা তাঁরা কী করেছেন? আমি বরং কয়েকটা পয়েন্ট লিখে দিই।

১) আই আর এফ সি এ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাব ফোরামের যাবতীয় লেখালিখি পড়ে দেখেছেন, দরকারে সেই লেখা নিয়ে অন্যান্য বইপত্র/লেখালিখি ঘেঁটে দেখেছেন। এই আমি বললাম হয়তো পার্থপ্রতিম বাবু ট্রৈনিকে রেল নিয়ে চমৎকার কাজ করছেন না ভারতীয় রেল হেরিটেজ নিয়ে দীপক রায়চৌধুরী বহুদিন ব্লগ লিখেছেন, রাজীববাবু ছুটলেন খবর নিতে। হয়তো বললাম আমার বন্ধু কাম দাদা Saugata Sengupta পুরো রেলপাগলা লোক, রাজীবদা ঝাঁপ মারলেন। আমি বলেই খালাস। যেখানে দেখো ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, সম্পাদক-জোড় কিছুই করতে বাকি রাখেননি।

২) বইয়ের স্ট্রাকচার নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছে। কী নিয়ে লেখা থাকবে আর কী নিয়ে থাকবে না, কোন বিষয়টা নিয়ে বইটা গড়ে উঠলে পাঠকটা নতুন কিছু পাবেন না পূর্ববর্তী বইগুলোর কোন লেখাগুলো নিয়ে কচলানোর দরকার নেই, সেই নিয়ে এমন গভীর, উত্তপ্ত, যুক্তিগ্রাহ্য আর দীর্ঘ আলোচনা চলেছে যে আমি মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেছি।

৩) বইতে কন্ট্রিবিউটার হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য কাকে কাকে অনুরোধ করা হবে, সেই নিয়েও প্রচুর মেল/মেসেজ চালাচালি হতে দেখেছি, ফোনও হয়েছে। বিষয়বস্তু নিয়ে অগাধ জ্ঞান কিন্তু লেখা তুলনায় শুষ্ক, আবার লেখার শৈলী অনবদ্য কিন্তু বিষয়বস্তুর নিরিখে সেই লেখা বিশেষ কোনও ভ্যালু অ্যাডিশন করছে না... এক্ষেত্রে কী করা যায়? এই ব্যাপারটা শুনতে যত সহজ মনে হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া ততোটাই কঠিন। বাংলা লেখালিখির জগতে কোনও কাজের মূল্য নির্ধারণ করা নেই, সবসময় ভালো লেখা পাওয়াও যায় না। আমি খুশি, অবশেষে একটা চমৎকার ব্যালেন্স করে নেওয়া যায় ভালো সম্পাদক পাওয়া গেলে। এখানেও দিব্যি কাজ হয়েছে।

৪) সম্পাদনার ক্ষেত্রে এমন সমস্ত ছোটখাটো সমস্যা দেখা যায়, সাধারণত যে সব নিয়ে কেউ মাথাই ঘামায়নি। এই ধরুন, একটা স্টেশনের নাম। বাংলায় একরকম, স্থানীয় ভাষায় একরকম, হিন্দিতে একরকম। কোনটা রাখা হবে? আপনি হয়তো ভাবছেন বাংলা বইয়ে বাংলা নাম, সিম্পল! কিন্তু ব্যাপারটা অমন নয়। একটা নামের ইতিহাস বা কালচারাল সিগ্নিফিকেন্স এক একটা লেখার এমন ভাবে ঢুকে থাকে, তখন সেটাকে বদলে দেওয়া মোটেও সহজ হয় না। সেই নামের ব্যাঞ্জনার সঙ্গে লেখা ও বিষয়ের যে সামঞ্জস্য আছে, সেটা ব্রেক করলে সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে। এমন হাজারও জিনিস, স্ট্রাকচারিং থেকে প্লেসমেন্ট, সূচিপত্রের অদলবদল, ভূমিকা ও ব্লার্ব, এক একটা শব্দের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা হতে দেখেছি। এক একটা সময় এমন হয়েছে, কাজ পনেরো আনা শেষ হয়ে আবার শুরু করতে হয়েছে, কারণ সামান্য একটা ভুল 'হয়তো' হলেও হতে পারে। এই অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য না সম্পাদক না প্রকাশক একবারের জন্যও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

৫) বইয়ের সঙ্গে যে জরুরি ছবি, নথি, অলংকরণ ইত্যাদি যাবে, সেই নিয়েও তুমুল আলোচনা আর মাঝেমধ্যে মতান্তর হয়েছে। কিন্তু অবশেষে দেখা গেছে, বইয়ের জন্য যা জরুরি, সেটাকেই প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে। কেউই ইগোবশত নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। পাশাপাশি আবার 'বই কে ওয়াস্তে সব মঞ্জুর' বলে কপিরাইটেড ছবি বা অন্য বইয়ের/শিল্পীর অলংকরণ/ফোটোগ্রাফ কিছুই ব্যবহার করেননি। এই বিশেষ কাজটা করার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে টুপি খুললাম।

৬) প্রচ্ছদ যে ঠিক কতবার বানানো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। একইভাবে কাজ হয়েছে ভিতরের ছবি নিয়েও। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ক্যালিগ্রাফি, স্টাইল থেকে রঙের ব্যবহার, দিনের পর দিন ধরে কাজ চলছে তো চলছেই। বইমেলা চলে এল, বই হল না। নববর্ষ দোরগোড়ায়, তবু দুজনে ঘাড় গুঁজে কাজ করছে। ইভেন্ট চলে গেলে বই আদৌ বিকোবে কিনা, সে নিয়ে কারো হেলদোল নেই। দুজনের সিদ্ধান্ত, বই পারফেক্ট না হলে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। মিথ্যে বলব না, মাঝেমধ্যে দু এক মুহুর্তের জন্য তো আমিই ভেবেছি, ওরে বাবা! এত বাড়াবাড়ি করে কী লাভ? কতজন আর পড়বে? তারপর দুই সম্পাদকের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হয়েছে। অবশেষে সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সেই বইয়ের প্রচ্ছদ প্রকাশ হল কাল। আন্তরিক যত্ন আর পরিশ্রমে করা একখান বই। হয়তো পারফেক্ট, হয়তো পারফেক্ট (পার্ফেক্ট বলে কিছু হয়ও না) নয়, কিন্তু পারফেক্ট করার ইনটেনশনটা, ইচ্ছেটা, পরিশ্রমটা ...সেটা অবশ্যই পারফেক্ট।

আমি বইটার সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নই। তবু মেকিং সম্পর্কে দু একটা কথা বললাম, সাধারণত 'বিহাইন্ড দ্য বুক' নিয়ে কথা হয়, অথচ সিনেমায় 'বিহাইন্ড দ্য সিনস' নিয়ে এক একটা ডকুমেন্টারি হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, ট্রেন নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের কাছে অনুরোধ, বইটা উল্টেপাল্টে দেখবেন। দেখে জানাবেন, যত্নটুকু চোখে আর মনে ধরা পড়ছে কিনা! যদি পড়ে, সম্পাদক জুটির সব কষ্ট সার্থক।

বাংলার স্টেশন কথা
একপর্ণিকা প্রকাশনী 

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 21, 2025 10:16

April 17, 2025

রহস্য বাকি আছে (আফ্রিকা)

 


পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য আর রহস্য নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমে কমতে দেখছি। ছোটবেলায় একটা নতুন প্রাণী বা প্রাকৃতিক বিস্ময়ের কথা জেনে গেলে আমি দিনরাত সেই চিন্তাই করতাম। আফ্রিকা, আমাজন বা তিব্বত আমাদের মনোজগতে এক রহস্যময় জায়গা হয়ে বেঁচেছিল। আমি ততোটাও বুড়ো হাবড়া নই, সেই যুগেও প্ৰযুক্তির যথেষ্ট অনুপ্ৰপবেশ ঘটেছে মানবজীবনে, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ আর রাজনৈতিক বিপর্যয় লেগেই থাকত গোটা দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা অবাক হওয়া ছিল, চমকে ওঠা ছিল, নতুন একটা তথ্য জেনে বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দে ডগমগ হওয়া ছিল। ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের যুগে তথ্য পাওয়া সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু 'বিস্ময়' জিনিসটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছে মানুষের মন থেকে। এখন আর আমরা কেউই অবাক হই না। অনেকের আবার ধারণা, পৃথিবীর সব রহস্যই আসলে আবিষ্কার করা হয়ে গেছে। অবাক হওয়ার মতো কিছুই আর বাকি নেই। অথচ সত্যি কথা হল, এখনও, এই যুগেও একের পর তাক লাগানো আবিষ্কার হচ্ছে। শুধু আফ্রিকার কথাই যদি ধরি, গত কুড়ি বছরে এমন সমস্ত প্রাণীদের খোঁজ পাওয়া গেছে, এমন সব প্রাকৃতিক ফেনোমেনার কথা জানা গেছে যে বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেছেন, বারবার। কয়েকটা বলা যাক।

গত এক দশকে চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার হল রুয়ান্ডার গোল্ডেন মাঙ্কিদের নিয়ে। তাদের সোনালি পশমের মতো লোম রোদ্দুরে ঝকঝক করে, দেখা গেছে তাদের এই লোমে আসলে ফিওমেলানিন পিগমেন্ট আছে বলেই এমনটা হয়। এই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতিকে রাখা হয়েছে cercopithecid গ্রূপে, অন্যান্য প্রাইমেট প্রজাতির সঙ্গে এদের যথেষ্ট ফারাক আছে। একদিকে গোল্ডেন মাঙ্কিদের নিয়ে উন্মাদনার ফলে রুয়ান্ডার পর্যটন ইন্ডাস্ট্রি বেশ অর্থলাভ করছে, অন্যদিকে কনজারভেশন বায়োলোজিস্টরা এদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। একের পর এক অভিযান হচ্ছে। গত বছর রুয়ান্ডায় সবচেয়ে বড় গোল্ডেন মাঙ্কিদের দলকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

তানজানিয়া চিরকাল গেম রিজার্ভ বলে খ্যাতিলাভ করেছে, সেরিংগেটিতে শ্বাপদরা হরিণ আর ওয়াইল্ড বিস্টদের ছুটিয়ে শিকার করছে, তানজানিয়া বললেই এই ছবি মাথায় আসে। কিন্তু এখানে বৈচিত্র্যেরও অভাব নেই। কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা সেখানে এমন এক প্রজাতির বায়োলুমিনিসেন্ট উদ্ভিদ খুঁজে বের করেছিলেন, যার পাতা থেকে নীল রঙের আলো বিচ্ছুরিত হয়। রিসেন্টলি Tessmannia princeps বলে এক নতুন প্রজাতির গাছ পাওয়া গেছে, সে প্রায় ৩০০০ বছর প্রাচীন। Udzungwa এলাকার Mngeta Valley নাকি অজানা গাছপালা খুঁজে পাওয়ার জন্য সেরা জায়গা। কিন্তু এখনও সেখানে অত অভিযান করা হয়ে ওঠেনি।

ইথিওপিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে এথনোবোটানিস্টরা এমন একটা উদ্ভিদ আবিষ্কার করেছেন যার পাতায় শক্তিশালী anti-inflammatory গুণ রয়েছে। স্থানীয় উপজাতির মানুষ নাকি যুগ যুগ ধরে এই গাছের পাতা ব্যবহার করে আসছে চোটজখম হলে। প্রিলিমিনারি ক্লিনিক্যাল স্ট্যাডিতে জানা গেছে অন্য anti-inflammatory উদ্ভিদের মতো এই গাছের পাতা সেবন করলে কোনও সাইড এফেক্টও হয় না।

ওদিকে ম্যাডাগাস্কারে ব্যাঙ পেয়ে জুলোজিস্টরা নাচ শুরু করেছেন। একের পর এক ব্যাঙ পাওয়া যাচ্ছে, সবাই নিজগুণে অনন্য। একটার নাম দেওয়া হয়েছে চাঁদের আলোর ব্যাঙ। সূর্যের আলো পড়লে ব্যাঙটার চামড়া স্বচ্ছ ট্রান্সপ্যারেন্ট হয়ে যায়, চাঁদের আলো পড়লে মনে হয় ব্যাঙের দেহের ভিতর একটা বেগুনি আলো জ্বলছে। ব্যাঙ বাবাজি এর ফলে দিনের বেলাও নিরাপদে থাকে, রাতের নিশাচর প্রাণীরাও কিছু করতে পারে না। সার্ভাইভালের জন্য এমন এভোলিউশনারি ইনোভেশন খুব কমই দেখা গেছে। এছাড়াও আছে এলিয়েন ব্যাঙ, মানে এই ব্যাঙগুলো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করলে মনে হয় স্টার ট্রেকের স্পেশাল সাউন্ড এফেক্ট চলছে। মাঝেমধ্যেই ডক্টর Mark Scherz লাইভ বা রেকর্ডেড অনুষ্ঠান করেন, সেখানে আরো বিশদে জানা যাবে।

এখানেই শেষ নয়, গোটা আফ্রিকা জুড়ে নেত্য চলছে আসলে। কঙ্গো ও পশ্চিম অঞ্চলের দুর্গম অরণ্যে গবেষকরা এমন একটা ফল আবিষ্কার করেছেন যা চিনির চেয়ে বহু গুণ বেশি মিষ্টি, কিন্তু কোনও ক্যালোরি নেই। এই ফলকে স্থানীয়রা 'মিষ্টি সাগরের তারা' বলে ডাকে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করছেন যে যে এই ফল থেকে একটি ন্যাচারাল সুইটনার তৈরি করা যেতে পারে যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হবে। এখন শুনছি এরকম আরো কিছু শিকড়বাকড় আর ফলের সন্ধান নাকি পাওয়া গেছে।

নামিবিয়ার মরুভূমিতে এমন একটা বিটল পোকা পাওয়া গেছে যা বাতাস থেকে জল সংগ্রহ করতে পারে। এই অদ্ভুত কীটের পিঠে বিশেষ একরকমের কাঁটা রয়েছে যা কুয়াশা থেকে জল নিয়ে ধরে রাখে, এবং তারপর সেই জল সরাসরি তার শরীরে অ্যাবসর্ব করে নেয়। আর এদিকে আমরা এতদিন সব ক্রেডিট ব্যাটাছেলে উটদের দিয়ে আসছি শুধু।

জিওকেমিস্টরাও কম যান না। তারা মালি ও অন্যান্য জায়গায় রিভারসাইড ডিপোজিট পরীক্ষা করে বিশেষ ধরনের মাটি বা montmorillonite clay পেয়েছেন, হেভি মেটাল আর বিষাক্ত টক্সিন শুষে নিতে এই মাটির জবাব নেই। স্থানীয় মহিলারা বারবার বলেছিলেন যে এই মাটি দিয়ে তাদের হাত ধোয়ার পর ত্বকের সমস্যা সেরে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা ঠিকই বলেছিলেন। বলাবলি চলছে, কসমেটিক্স আর ফার্মা ইন্ডাস্ট্রিতে এই মাটি বিপ্লব আনতে পারে।

কঙ্গো বেসিনের অরণ্যে গত বারো বছরে প্রায় সাড়ে সাতশোরও বেশি নতুন প্রজাতির জীব পাওয়া গিয়েছে। তাদের মধ্যে কুমির থেকে ইলেকট্রিক মাছ, পেঁচা থেকে অর্কিড সবই আছে। হুড়োহুড়ি পড়েছে De Winton's golden mole এর প্রত্যাবর্তনে, যে ব্যাটা বালিতে সাঁতার দেয়। Leaf-Mimic Frog এর কথাও বলতে হবে, এই ছোট ব্যাঙের ত্বকের টেক্সচার এবং রঙ জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা পচা পাতাকে প্রায় পুরোপুরি অনুকরণ করে। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেছে যে এই প্রজাতি সম্পর্কে আগে কিছুই জানা ছিল না। এদের ত্বকে এক বিশেষ কোষ রয়েছে যা তার তাৎক্ষণিক পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় টেক্সচার এবং বর্ণকে সূক্ষ্মভাবে বদলে দিয়ে লুকিয়ে পড়তে পারে। আমার ফেভারিট হল লেসুলা মাংকি, যারা একেবারে মানুষের মতো মুখভঙ্গি করে। দলে বসে থাকলে দেখে মনে হয়, সংসদের অধিবেশন… থাউক সে কথা!

ওদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালানোর সময় ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডেটিং কৌশল ব্যবহার করে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত মেগাফৌনা প্রজাতির গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ছবিগুলোতে অত্যাধুনিক পিগমেন্ট প্রিপারেশন দেখা যায়, রঙ চটে না যায় এইজন্য সেগুলো পশুর চর্বির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এই গুহাচিত্রে যে সব প্রাণী দেখা যাচ্ছে তাদের সঙ্গে মানুষদের কোনওদিন মোলাকাত হয়েছে বলে জানা ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, লেট প্লাইস্টোসিন এবং আর্লি হোমো-সেপিয়েন্সের মধ্যে কিছু ইন্টারেকশন হয়েও থাকতে পারে? কারণ প্লাইস্টোসিন যুগের ম্যামথের ছবিতে এই ধরনের কালারিং টেক পাওয়া যায়নি, মানে সেই যুগের শিল্পীদের মগজে তখনও ওঁৎ বুদ্ধি আসেনি। না এসেছিল? নাকি ম্যামথ জাতীয় জীবদের সঙ্গে হোমো সেপিয়েন্সদের সাক্ষাৎও হয়েছে? হেহে, ইটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল! যাই হোক, নানান প্রশ্ন আছে, আপাতত প্যালিও এনভায়োলেন্টমেট কন্ডিশন নিয়ে জোর গবেষণা চলছে সাউথ আফ্রিকায়। এছাড়াও নতুন হিউমিনয়েড প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে সাউথ আফ্রিকার আরেক গুহায়।

এখন, এই সব আবিষ্কারগুলোই হয়েছে গত এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে। কোনওটা চার বছর আগে, কোনওটা দশ বছর আগে। কিন্তু এই গবেষণা এখনও কন্টিনিউ হচ্ছে। এখন অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, মাত্র এই? এ আর এমন কি! বেশ, তাহলে আরো কয়েকটা লিস্টি করে দিলাম।

২০২৩ সালের শেষের দিকে তানজানিয়ার জাঞ্জিবারের উপকূলে একটা দুর্দান্ত আবিষ্কার হয়েছে। ম্যারিন বায়োলোজিস্টরা সেখানে একটি কোরাল রিফ সিস্টেম অর্থাৎ প্রবাল প্রাচীর ব্যবস্থা আবিষ্কার করেন যা উষ্ণ সমুদ্রের তাপমাত্রার প্রতি অস্বাভাবিক রেসিলিয়েন্সের পরিচয় দিতে পারে। সবাই জানে, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে কোরাল রিফের তাপ বাড়ছে, তারা কঙ্কালে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু এই প্রবাল প্রাচীন সেখানে অবস্থিত হিট রেজিস্টেন্ট অ্যালগির প্রকারের সঙ্গে চমৎকার একটা সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ ডেভেলাপ করেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে যে জলের তাপ বাড়লেই শৈবালগুলো এসে একটা প্রটেক্টেড লেয়ার তৈরি করে ফেলে। এই আবিষ্কারটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই গবেষণার ওপর নির্ভর করে গোটা দুনিয়াযা কোরাল রিফ সংরক্ষণের জন্য কাজ করা যায়, ইতিমধ্যেই বৈজ্ঞানিকরা এই ধরনের শৈবাল ট্র্যাক করে দুনিয়ায় অন্যান্য কিছু জায়গাতেও এইধরনের তাপরোধকারী কোরাল রিফ খুঁজে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা খুব বেশি মুখ খুলছেন না, কারণ ঘটনাটার একটা আর্থিক রাজনৈতিক দিকও আছে। তাই ঘটনাটা কতটা বাস্তব বোঝা এই মুহূর্তে মুশকিল। তবে হিট রেজিস্টেন্ট কোরাল রিফ সম্পর্কিত বড়সড় কিছু একটা যে পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

২০২৪ সালের শুরুতে ইথিওপিয়ার হাইল্যান্ডে বিজ্ঞানীরা একটা ভূগর্ভস্থ ছত্রাক নেটওয়ার্ককে চিহ্নিত করেন। আগেও পাওয়া গিয়েছিল কাছাকাছি একটা কলোনি, কিন্তু এইবার তারা আগের ডেটা বিশ্লেষণ করে আরো ব্যাপক ভাবে গবেষণা চালিয়েছে। এই ব্যাপক মাইসেলিয়াল ফাঙ্গাই সিস্টেম বিভিন্ন পরিবারের একাধিক বৃক্ষ প্রজাতিকে সংযুক্ত করে, পুষ্টি বিনিময়ের সুবিধা দেয়। আইসোটোপ ট্রেসিং কৌশল ব্যবহার করে দেখা গেছে যে ফাঙ্গাই নেটওয়ার্কটা স্ট্রেস কন্ডিশনে গাছেদের কাছে নিউট্রিশন পৌঁছে দেয়। এই প্ল্যান্ট-ফাঙ্গাই কমিউনিকেশন মেকানিজম ঠিক হলে উপস্থিত ইকলজি মডেলগুলো নিয়ে আবার করে ভাবতে হবে।

২০২৩ সালের মাঝামাঝি নামিবিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে কাজ করা উদ্ভিদবিদরা এক succulent প্রজাতির উদ্ভিদ খুঁজে বার করেছেন। এই উদ্ভিদ সোলার রেডিয়েশনের তীব্রতা অনুযায়ী ফোটোসিন্থেসিস পাথওয়েকে বদলে দিতে পারে। জটিল বিজ্ঞানে না ঢুকে বলি, ব্যাপারটা কাজে লাগালে সাহারাতেও সুন্দরবন হতে পারে, মানে খরা অঞ্চলে কৃষি করা বা গাছপালা বসানো অনেক সহজ হয়ে যাবে। একইভাবে কেনিয়ার হাইল্যান্ডসেও একটা উদ্ভিদ পাওয়া গেছে যাদের পাতায় বিশেষ ট্রাইকোম বিকশিত হয়েছে যেগুলো বায়বীয় আর্দ্রতা গ্রহণ করে সোজা হাইস্পিড ট্রেনে করে সেই জল শিকড়ের কাছে পৌঁছে দেয়। এমনকি আর্দ্রতা কম হলে, এই ট্রাইকোম উদ্ভিদকে বাঁচাতে বাতাস থেকে পর্যাপ্ত জলও বের করতে পারে। বায়োমিমিক্রি ইঞ্জিনিয়াররা এই নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। বলুন, এই ধরনের যুগান্তকারী একটা সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের নিউজ চ্যানেলরা দু এক কথা বলতেও তো পারে!

যাই হোক, ওদিকে মাদাগাস্কারেও গত বছর একটা পিঁপড়ে পাওয়া গেছে যে ব্যাটাচ্ছেলে তাদের কোষের মধ্যে ব্যাকটিরিয়া চাষ করছে, এই ব্যাকটিরিয়াগুলো কাজে লাগাতে পারলে ছত্রাকদের থেকে হওয়া সংক্রমণকে একেবারের জন্য নির্মূল করে দেওয়া যেতে পারে। এই খবরটা ইউটিউবে কোথাও দেখেছিলাম বলে সত্যতা প্রমাণিত করতে পারব না, তবে ম্যাডাগাস্কারে যে দুরন্ত সব আবিষ্কার আর গবেষণা চলছে তা সায়েন্স ডট ওআরজি সাইটে গিয়ে পড়লেই জানতে পারবেন।

২০২৩ সালের একদম শেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় স্পিলিওলজিস্টরা একটা ফাটাফাটি আবিষ্কার করেছেন। মাটির এক কিলোমিটার নিচে এমন একটা প্রকাণ্ড গুহার নেটওয়ার্ক পাওয়া গেছে যেখানে আগে যাওয়া সম্ভবই ছিল না। কিন্তু আসল কথা হল এই অসম্ভব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, যেখানে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন প্রাণ বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনাই নেই, সেখানে তারা মাইক্রোঅর্গ্যানিজমের একটা আইসোলেটেড ইকোসিস্টেম খুঁজে পেয়েছে। এই প্রবল অম্লীয় পরিস্থিতিতে কোনও অণুজীব থাকতে পারে তা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু এই পুঁচকে অণুজীবগুলো কোন একটা উপায়ে যেন মিনারেল মেটাবলাইজ করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এদের শরীরের কেমিক্যাল পাথওয়ে আর গঠন জানা গেলে মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাঁচিয়ে রাখার দিকে একটা নতুন পথ খুলে যাবে, স্পেস ট্রাভেল রেডিয়েশনের ঝুঁকিও অনেক কমে যাবে।

২০২৪ সালে, আরো কিছু জরুরি কাজ হয়েছে, সেগুলো সেই অর্থে আবিষ্কার নয়। প্রথমেই বলতে হয় Operation SAMA এর কথা, অবৈধ চোরাশিকার আর পোচিং আটকে ওয়াইল্ডলাইফ সমৃদ্ধ করার এই প্রজেক্ট উনিশটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আর উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। সিয়েরা লিওন আর লাইবেরিয়াতে রিফরেস্টেশন প্রোগ্রাম ভালো ফল দিয়েছে, শকুন আর অন্যান্য মাংসাশী পাখিদের সংখ্যা বেড়েছে। পোচিং কমেছে হাতি আর প্যাংগলিনের। জাম্বিয়াতে লেপার্ডের সংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে কমে গিয়েছিল, এখন তাদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কোপা ভের্দেতে সাস্টেনেবল ফিশিং শুরু হয়েছে, আশার কথা। হাজার হাজার হতাশাজনক খবরের মধ্যেও দেখে ভালো লাগে এখনও অনেকে প্রকৃতি নিয়ে ভাবে। এখনও আমাদের পৃথিবীতে প্রচুর অজানা রহস্য রয়ে গেছে।


 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 17, 2025 10:09

April 12, 2025

সেলুরিয়ান সি-এর দ্বীপের সেই বাড়িটা

 


জি কে চেস্টারটন বলেছিলেন, সাহিত্য পড়া আসলে লাক্সারি, গল্প পড়া হল প্রয়োজন। মাঝেমধ্যে এক একটা বই কথাটা মনে করিয়ে দেয়। এই অসম্ভব, অসম্ভব মিষ্টি বইটার কথা লিখে রাখলাম, কেউ পড়লে তাদের দু চারটে দিন অনেক বেশি মিষ্টি হয়ে উঠবে। ডায়াবিটিস থাকলেও সমস্যা নেই। একদম সুগারক্যান্ডি বই, যদিও মাঝেমধ্যে টকমিষ্টি লজেন্সের স্বাদও পাবেন। আর যদি স্টোরিটেল বা অন্য কোথাও অডিও স্টোরি শোনেন, তাহলে তো পোয়াবারো। এমন মালপো হালুয়া জিলিপি মার্কা রস গড়ানো বইকে সাহিত্য বলে গণ্য করে না অনেকেই, তারা ওইসব মোটামোটা জটিল বই নিয়ে বসে থাকুক গে! আমরা বরং ছোট করে সেলুরিয়ান ক্রনিকালসের প্রথম বইয়ের গল্পটা জেনে নিই।

লিনাস বেকার ডিপার্টমেন্ট অফ চার্জ ফর ম্যাজিকাল ইউথের জন্য কাজ করেন। কেরানি গোছের কাজ, তাঁর প্রধান দায়িত্ব হল ম্যাজিকাল চাইল্ডদের জন্য বরাদ্দ অনাথআশ্রমে গিয়ে দেখে আসা বাচ্চাগুলো যত্নে আছে কিনা! ঝামেলা থাকলে রিপোর্ট দেওয়া, সেই অরফেনেজ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এই কাজ করতে করতে তিনি চল্লিশের গোড়ায় পৌঁছেছেন, অন্য সবাই পদোন্নতি পেয়ে তাঁকে টপকে গেছে। লিনাস বেকার থেকে গেছেন। তিনি ভুঁড়ি থলথলে গোবেচারা মানুষ, একা থাকেন, সঙ্গী বলতে একজন বেড়াল মাত্র। গান শোনা ছাড়া তেমন কোনও শখ নেই। দজ্জাল বসের কাছে বকা খান, বাড়িওয়ালা রোজ টিটকিরি দেয়, তিনি বাস থেকে নেমে বৃষ্টিপ্রবণ শহরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের কথা ভাবেন, কিন্তু সমুদ্র দেখতে আর যাওয়া হয় না। তিনি নিজেও জানেন, আমার কিছু হওয়ার নয়।

এমন সময় একটা হাই ভোল্টেজ অ্যাসাইনমেন্ট এসে পড়ে তাঁর কাছে৷ হাইয়ার ম্যানেজমেন্ট তাঁর দীর্ঘ কেরিয়ার আর রিপোর্ট দেখে তাঁর সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে একটা গোপন মিশনে পাঠাবেন তাঁকে। কী সেই গোপন মিশন? একটা দ্বীপে অবস্থিত অনাথ আশ্রমে ছয়জন বিপজ্জনক বাচ্চা থাকে। নামে বাচ্চা হলেও তারা এক একটা জিনিস। বেকারকে গিয়ে একমাস থেকে রিপোর্ট করতে হবে, এই জায়গাটা থাকবে না বন্ধ করে দেওয়াই বেটার?

বেড়াল নিয়ে বেকার শেষমেশ ট্রেনে উঠে বসেন। তখনও তিনি জানেন না যে এই যাত্রায় তিনি প্রথম সমুদ্র দেখবেন, লোনা হাওয়া আর রোদের সঙ্গে তার মোলাকাত হবে জীবনে এই প্রথম। তিনি এও জানেন না যে ছয়জন বাচ্চার কথা তাকে বলা হয়নি, শুধু ফাইল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে পৌঁছে গিয়ে দেখতে হবে জানিয়ে, তাদের মধ্যে একজন খোদ শয়তানের ছেলে মানে অ্যান্টিক্রাইস্ট। অবশেষে, তিনি এও জানতেন না যে এই এক মাস তাঁর জীবন বদলে দেবে।

বেকার দ্বীপে গিয়ে পৌঁছান বটে, কিন্তু নিজে পৌঁছানোর সাধ্য ছিল না তাঁর। তাঁকে সেই অঞ্চলের বনদেবী (ইংরেজি নামটা থাক!) সেখানে নিয়ে আসেন৷ দেখা হয় অনাথ আশ্রমের প্রধান সঞ্চালক আর্থারের সঙ্গে। ছয়জন ছেলেমেয়ের সঙ্গেও, যাদের ভয়ে ডিপার্টমেন্টর লোক থরথর করে কাঁপছে।

এই এক মাস ধরে একের পর এক রহস্যোদঘাটন হয়। বেকার ভয় পান, তর্কাতর্কি করেন, অনেক কিছু বোঝেন, অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে চলি। একের পর এক চমৎকার ঘটনা, দমফাটা হাসির সিকোয়েন্স, আশ্চর্য রহস্য, চোখ ভিজিয়ে দেওয়া দৃশ্য। গল্পের সঙ্গে আমরাও তখন সেলুরিয়ান সি এর দ্বীপে থাকা সেই বাড়িটায় গিয়ে পৌঁছেছি।

টি জে ক্লুন সাহিত্য করতে পেরেছেন কিনা, ভাষা আর ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাজিমাত করেছেন কিনা, সে সব বলা এখানে বেকার! কারণ, এখানে গল্পটাই সব। এমন একটা মন্ত্রমুগ্ধ করা গল্প, যা পড়ে মনে হয় গরম রসগোল্লা খেলাম। নতুন বন্ধু পাতানো যায়, পিকনিকে যাওয়া যায় তাদের সঙ্গে, স্বপ্ন দেখা যায়, গান গাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি সাহিত্য আর কী হতে পারে?

কিছু কিছু বই নিজের জন্য পড়ে নিতে হয়। পড়ুন, ছেলেমেয়ে ভাইপো ভাইঝিদের উপহার দিন, রাত্রে স্টোরিটেলে একসঙ্গে বসে শুনুন। যদি ভালো না লাগে, মুখমিষ্টি না হয়, মন না ভরে, তাহলে মনের ডাক্টারের কাছে যাওয়ার ফিজটা আমিই দেব না হয়!

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 12, 2025 10:13

ছোট নৌকা আর একটা টেলিফোন

 


২০২১ সালে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় কার্দিশ রিফিউজিদের একটা নৌকা মানে ওই স্মল বোট ডুবতে শুরু করে। উপায় না দেখে তারা ব্রিটিশ হেল্পলাইনে ফোন করে। তারা বলে, মনে হয় তোমরা ফ্রেঞ্চ ওয়াটারে আছো, অমুক নম্বরে ফোন করো। ততক্ষণে জল ঢুকতে শুরু করেছে, উনত্রিশজন যাত্রীর মধ্যে নারীপুরুষ তো আছেই, একটা বাচ্চা মেয়েও আছে। মাঝ সমুদ্রে নেটওয়ার্ক পাওয়া চাপ। তবু একজন ফোন করে। ফ্রেঞ্চ হেল্পলাইন থেকে একজন বউ তুলে বলে, তোমরা মনে হয় ব্রিটিশ ওয়াটারে আছো। ওদের জানিয়ে দিচ্ছি! লোকেশন ভেজো! লোকেশন পাঠানোও মুশকিল। ওদিকে জল কোমর অব্দি এসে গেল প্রায়। ঠান্ডা হাওয়া, জলে ভিজে সবাই কাঁপছে। যাই হোক, হেল্পলাইন থেকে বলে, শান্ত থাকুন। দেখছি কী ব্যাপার। দেখতে দেখতে বোট প্রায় ডুবে যায় আর কি! অনেকে জলে পড়ে গেছে। বেগতিক দেখে বারবার তারা ফোন করতে চেষ্টা করছে, দু দশ মিনিট পর আর কিছু করার থাকবে না। বার বার ফোন আসায় মহিলা বলেন, ধৈর্য ধরুন, দেখছি তো! কিন্তু দেখছে আর কে? ব্রিটিশ রেস্কিউ বোট অনেক দূরে, ফরাসি বোট অন্য মিশনে ব্যস্ত। একদম জলে পড়ে যাওয়ার আগে নিরুপায় হয়ে আবার ফোন করে লোকটা। মহিলা বলেন, জ্বালিয়ে মারলি মাইরি! ইউ উইল নট বি সেভড, বোঝলা?

সাতাশজন মারা যায়। সকলের লাশ ভাসতে পাওয়া যায় সমুদ্রে। প্রতি বছর ওইটুকু সামুদ্রিক পথ, যা নব্বই মিনিটে ক্রস করে দেয় ফাস্ট বোট, সেখানে লোক মরছে। এদেশে হলে অবশ্য পাত্তা দিত না। জায়গাটা ইউরোপ বলেই সাড়া পড়ে, তদন্ত হয়। রেস্কিউ হেল্পলাইনের মহিলাকে ডেকে আনা হয় জেরা করার জন্য। তিনি বলেন, "আমি কী করব? আমি তো প্রোটোকল ফলো করেছি।"

প্রশ্ন ওঠে, আপনি সিচুয়েশন এর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি? ওরা রিফিউজি, মরে যাচ্ছিল, একটু সেন্সিটিভ হতে পারছিলেন না? উত্তর আসে, রিফিউজি না হলে মিলেনিয়ার হলে বুঝি বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না? আমি কেন দুজন মানুষের মধ্যে তফাত করব? আমার চোখে সবাই ভিক্টিম।

“I didn’t ask you to leave, I said. It was your idea, and if you didn’t want to get your feet wet, love, you shouldn’t have embarked. I didn’t push you into the water, I didn’t fetch you from your village or field or ruin of a suburb and put you in your wretched leaky boat, and now the water’s up to your ankles, I get it that you’re frightened, and you want me to save you and you’re impatient. You’re counting on me. But I didn’t ask you for any of that. So you’ll just have to grin and bear it and let me get on with my job. And apparently these thoughts were so strong that I actually spoke them out loud.”

আপনার ওপিনিয়ন কী রিফিউজি সমস্যা নিয়ে? পুলিশ জিগোয়। উত্তর আসে, আমার কোনোও ওপিনিয়ন নেই। ওপিনিয়ন দিয়ে রেস্কিউ চলে না। সাতাশজন মারা গেছে, সারা কেরিয়ারে আমি কত রিফিউজিকে বাঁচিয়েছি সেটা কে বলবে?

দুজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে। তাদের পরিচয় জানা কি তাদের রক্ষা করার জন্য জরুরি? হতে পারে একজন কোটিপতি, শখ করে নিজস্ব ইয়াটে করে মাছ ধরতে এসে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছেন, অন্যজন সিরিয়া বা ইরাক থেকে পালিয়ে এসেছে, তাদের ঘরবাড়ি বোমায় উড়ে গেছে, তারা যা হোক কিছু করে আইনি বা বেআইনি ভাবে নৌকা করে ইংল্যান্ডে যেতে গিয়ে নৌকাডুবির শিকার হয়েছেন। দুজনে একসঙ্গে ডুবছে? আমি একজনকে বাঁচাতে পারব। কাকে বাঁচাব? তাদের অতীত বা সিদ্ধান্ত বা গুডলাক/ব্যাডলাক জানার প্রয়োজন আমার আছে কি? একজন পেশাদার রেসকিউ অফিসারের কাছে কি দুজনেই সমান ভিকটিম নন? না সেখানেও আপনার সো কল্ড হিউম্যানিটির ভূমিকা থাকতে হবে? থাকা কি আদৌ উচিত? কে জানে? আমি তো বলতে পারছি না।

এই লেখক যে দার্শনিক বলে পরিচিত, সেটা বোঝাই যায়। তাই, স্মল বোটও ঠিক ফিকশন নয়, এটা একটা ফিলোসফিকাল প্রশ্নকে তুলে ধরেছে। সে প্রশ্ন কালেক্টিভ ডিসেন্সিটিজেশনের। উচিত অনুচিতের। মনুষ্যত্ব আর দায়িত্ববোধের মাঝে থাকা সূক্ষ্ম লাইনের। এই বই সাহিত্য হিসেবে পড়তে কেমন লাগবে জানি না, কিন্তু এই সময় আর এখনকার মানুষকে বুঝতে হলে বইটা আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

একটা জায়গা পড়ে সত্যি একটু নড়ে গেছিলাম।

There is no shipwreck without spectators. Even when there’s no one, when it’s far out at sea, at night, without witnesses, when there’s no living soul in sights for thousands of nautical miles, only waves and the viscous night, covering everything, swallowing everything; when there are no more eyes to see than there are arms to reach out, there are still spectators and the shore from which they are watching is never far away, even if, at the same time, it is infinitely distant.

কিন্তু সতর্ক করে দিচ্ছি, ইটস নট অ্যান ইজি রিড। ভালো লাগবে, তা জরুরি নয়।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 12, 2025 10:07

April 10, 2025

পিটার অ্যান্ড লিজা

 


কমিকসের দুনিয়ায় মার্ভেল আর ডিসি এখনও বেস্টসেলার তালিকায় সবচেয়ে ওপরে থাকে। তাদের সঙ্গে এসে জুড়েছে জাপানিজ মাংগা, নিউ ওয়ার্ল্ড হরার, ফিলগুড কলেজ রোমান্স বা বুদ্ধিদীপ্ত সাইফি ফ্যান্টাসি। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ফ্যান্টাগ্রাফিক্স, ড্রন অ্যান্ড কোয়ার্টারলি, জোনাথন কেপ বা ফেবারের মতো বহু প্রকাশনা নিয়মিত লিটারারি গ্রাফিক নভেল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। সেখানে সারা দুনিয়ার শিল্পীরা কাজ করেন, ভিন্ন ভিন্ন আর্ট স্টাইল আর মানসিকতার মেলবন্ধন হয়। এই কাজগুলো সাধারণত বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলে অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে এই বইটা আবিষ্কার করেছিলাম।

সত্যি বলতে, 'পিটার অ্যান্ড লিজা' তেমন এক্সক্লুসিভ কোনও কাহিনি বলতে চায়নি। শিল্পী ভূমিকাতে জানিয়েছেন, এখানে গল্প টল্প বিশেষ নেই। জীবনে যা হয়, তাই আছে। বিষণ্ণ অবস্থাতেও একটা শহরের বিষন্নতা কত সুন্দর হয়ে চোখে ধরা দিতে পারে, সেই কথা আছে। সাধারণ স্বার্থপর মানুষরাও সময় বিশেষে কত ভালো মুহূর্ত উপহার দেয়, আছে সে কথাও। বয়ে যাওয়া সময় আছে। বন্ধু বিচ্ছেদ, সম্পর্কের ভাঙাগড়া আছে, বোহেমিয়ান লাইফ আর অবসাদগ্ৰস্ততার মাঝে বেঁচে থাকা আছে। শীত আছে। পর্ণমোচী গাছের অপূর্ব সুন্দর সব নকশা আছে। বসন্ত আছে। বসন্তের ফুল আছে। ঋতুবদল আছে। প্রেম আছে। আর আছে জীবন।

পিটার কম্পালসারি আর্মি সার্ভিস শেষে শহরে ফিরেছে। কিন্তু এরপর সে কী করবে জানে না। তার সেনাবাহিনীর বন্ধুরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে, কিন্তু পিটার কনফিউজড। এই কনফিউশনের একটা বড় কারণ, সে কবিতা লেখে। হৃদয়বিদারক সে কবিতা। যুদ্ধে ক্ষয়ে পড়া তার শহর নিয়ে, শহরের মানুষ নিয়ে। অন্যদের চেয়ে সে বেশি সংবেদনশীল, বেশি ভাবে, আবার ভাবেও না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে যে যুদ্ধ বিপর্যস্ত শহরে ভেসে যায় পিটার।

লড়াই থেমে গেছে অনেকদিন, কিন্তু শহরের স্বাভাবিক চরিত্র ফিরে আসেনি। ভাড়াবাড়ির অবস্থা খারাপ, লোকজনের হাতে পয়সা কম। তবু বোহেমিয়ান পাড়ায় রোজ পার্টি হয়, হইহল্লা চলে, নাচানাচি হুল্লোড় চলে। উদ্দাম জীবনের এই ব্যাকরণ মেনে পিটারও বন্ধুদের সঙ্গে এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে ঘুরছে, কিন্তু শত মানুষের ভিড়েও তাঁর চোখ অন্যমনস্ক, সেখানে বিষাদের ছোঁয়া। এমন সময় লিজার সঙ্গে তার আলাপ। সে একজন ব্যালে ডান্সার। দুজনের সাক্ষাৎ হয়, সম্পর্ক গড়ায় লিভ ইনে। লিজার সঙ্গ পেয়ে পিটারের জীবন রঙিন হতে শুরু করে। তার ফ্যাকাসে জীবনের মরুভূমিতে সে একটা মরুদ্যান খুঁজে পেয়েছে। সময় কাটে, বছর গড়ায়। পিটার লিখতে চায়। কিন্তু কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। খুচরো কাজ করতে করতে, ফ্ল্যাটে হাউসপার্টি করতে করতে, ভাড়াবাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে আর লিজার সঙ্গে একইভাবে প্রেম করতে করতে দেখা যায়, পিটারের সেই অবসাদ আবার ফিরে আসছে। ক্রমে সেই বিষাদ বাড়তে থাকে, বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের সম্পর্ককে শেষ করে দেয়। কিন্তু ...জীবন থেমে থাকে না কারোরই। সময় কাটতে থাকে। দুজনেরই বয়স বাড়ছে। বহু বছর পর তাদের আবার দেখা হয়। ততদিনে তারা আলাদা মানুষ, কিন্তু কোথাও না কোথাও পিটার এখনও সেই পিটার, লিজা এখনও সেই লিজা।

ন্যারেটিভ এগিয়েছে একবার পিটার, একবার লিজার বয়ানে। তাড়াহুড়ো নেই। গল্প বলার চেষ্টা নেই। খালি ফ্ল্যাট আছে, সেখানে উড়ন্ত পর্দা আছে, বাইরে পত্রহীন গাছের সারি আছে। বেড়াল আছে, কুকুর আছে। মদের বোতলের গড়াগড়ি, সিংকে জমানো এঁটো বাসনের ডাঁই আছে। বিকল গাড়ির গোদাম আছে। মানুষও আছে তাদের হরেকরকম জীবন নিয়ে, জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা তাদের নীরব অলিখিত কবিতা নিয়ে। লিখিত কবিতাও আছে, সর্বত্র।

মিরোস্লাভ সেকুলিক-স্ট্রুজা প্রাণবন্ত ভাবে চরিত্রদের আর তাদের সময়টা ধরেছেন। gouache আর watercolor, দুই ঘরানার আঁকাকেই একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হল, যদিও আর্ট নিয়ে আমার জ্ঞান খুবই ভাসাভাসা। রঙের ছয়লাপ, কিন্তু মেজাজটা বিষন্ন, এমন বহু জায়গা আছে। আবার ফিকে প্যানেলে পর পর আঁকা, কিন্তু বেশ একটা হ্যাপি মোমেন্ট ধরা পড়ছে, এমন জায়গাও আছে। বোহেমিয়ান পাড়া, ডাইভ বার, ঘরের পিছনের ঘর এবং জনাকীর্ণ নগরীর দৃশ্যের বোহেমিয়ান পরিবেশকে জীবন্ত করে তুলেছে তাঁর আঁকা। গোটা ন্যারেটিভটাই 'ব্লিক', সেখানে মাঝেমধ্যে আশার আলো দেখা যায়।

সব নিয়ে মন্ত্রমুদ্ধ করে দেওয়া বই। গল্পের বদলে জীবন পড়ার/দেখার ইচ্ছে হলে এই কাজটা পড়তে পারেন।

পিটার অ্যান্ড লিজা
ফ্যান্টাগ্রাফিক্স

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 10, 2025 10:03

March 25, 2025

ব্ল্যাকহোলের ভিতর পিকনিক

 


মাঝে মাঝে এমন এক একটা কথা জানা যায় ভেবে মাথা একেবারে ভোম্বল হয়ে যায়। তার মধ্যেও লেভেল অফ ভোম্বলনেস সীমা ছাড়িয়ে যায় এমন খবর পেলে। সাম্প্রতিকতম ঘটনার কথাই বলছি। নাসার বিজ্ঞানীরা আভাস দিয়েছেন আমাদের পৃথিবী, ইনফ্যাক্ট গোটা মহাবিশ্ব একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে বসে থাকতে পারে। আশংকা করা হচ্ছে মহাবিশ্বের জন্মই হয়েছিল একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে। সিসিন লিউয়ের গল্প? আজ্ঞে না। একবর্ণও বানিয়ে বলছি না। বরং রিপোর্টটা ছোট করে জানিয়ে দিচ্ছি।সন্দেহ নেই, JWST মানে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ লঞ্চ হওয়ার পর থেকেই একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে। মহাবিশ্বকে দেখার আর বোঝার পদ্ধতিতে বিপ্লব এসেছে বলা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিকতম ফাইন্ডিং দেখে বৈজ্ঞানিকদের ঘিলু নড়ে গেছে। দশ বিলিয়ন ডলারের এই টেলিস্কোপ ২০২২ সাল থেকে কসমস অবজার্ভ করা শুরু করেছিল৷ এতদিন ধরে ডিপ স্পেস আর গ্যালাক্সিদের অবজার্ভেশন করে যে রিডিং পাওয়া গিয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, ডিপ স্পেস আর আর্লি গ্যালাক্সির অধিকাংশই একদিকে রোটেট করছে। বারো আনা গ্যালাক্সি ঘুরছে ক্লকওয়াইজ, বাকিরা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরছে।একটা র‍্যান্ডম মহাবিশ্বের ধারণা যদি করা হয়, ফিজিক্সের নিয়ম মেনে বৈজ্ঞানিকরা প্রত্যাশা করেন যে ৫০% ক্লকওয়াইজ ঘুরবে, বাকি ৫০% অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে গ্যালাক্টিক রোটেশনেরও একটা প্রেফারড ডিরেকশন আছে, পছন্দ অপছন্দ আছে। যে ২৬৩টা গ্যালাক্সি অবজার্ভ করে এই কসমিক ডান্সের নির্ভুল ফাইন্ডিং পাওয়া গিয়েছে, তা JADES মানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ অ্যাডভান্সড ডিপ এক্সট্রাগ্যালাক্টিক সার্ভের একটা উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট। বহু সায়েন্টিস্ট রাতদিন কাজ করে রিডিংগুলো বারবার ভেরিফাই করেছেন, তাই ভুল হওয়ার চান্স প্রায় নেইই।এখন এই অদ্ভুত অ্যানামলির পিছনের কারণ কী, সেই ভেবে সবাই মাথার চুল ছিঁড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কারণ যা হতে পারে, তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েই দিয়েছেন প্রজেক্টের টিম লিডার লিওর শামির। তিনি বলেছেন, "আমরা ঠিক নিশ্চিত নই কেন এমন হচ্ছে? কিন্তু একটা কারণ হতে পারে যে ইউনিভার্স ওয়াজ বর্ন রোটেটিং। (ল্যাও ঠেলা) ব্ল্যাক হোল কসমোজলিও এই ধারণাকে সাপোর্ট করে।"এখন ব্ল্যাকহোল কসমোলজি কী? Schwarzschild cosmology বলেও অনেকে, এই ধারণার জনক রাজ কুমার রাজ কুমার পাথরিয়া আর আই জে গুড। তারা বলেছিলেন, Schwarzchild radius বা ইভেন্ট হরাইজন বলে যা প্রচলিত, যেখান থেকে আলোও ফিরতে পারে না, সেটাও আসলে ভিসিবল ইউনিভার্সের একটা দিগন্ত।এককালে 'সাইলেন্টিয়াম' বলে একখান বই লিখেছিলাম বলে খানিকটা মাথা ঘামাতে হয়েছিল এসব নিয়ে, তাই মনে আছে, ইনফ্যাক্ট গল্পে এর ভূমিকাও ছিল। সত্যি বলতে ব্যাপারটা জটিল। সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় এই ধারণা বলছে (১) একটা ব্ল্যাকহোল যত এনার্জি আর ম্যাটারকে গিলে খাচ্ছে তা ব্ল্যাকহোলের অন্যপ্রান্তে নির্মিত হোয়াইট হোল দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু অন্য দিকে যে ইউনিভার্সটা হবে, সেটা হবে ভিন্ন। সেক্ষেত্রে এই ব্ল্যাকহোল আইস্টাইন রোসেন ব্রিজ বা ওয়ার্মহোল হিসেবে কাজ করবে। (২) যখন একটি মৃত নক্ষত্র কোলাপ্স হওয়ার ফলে একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, তখন একই সময়ে ওয়ার্মহোলের অপর প্রান্তে অবস্থিত হোয়াইট হোল থেকে একটা অন্য ইউনিভার্স বা মহাবিশ্বের জন্ম হয়। (৩) তার মানে দাঁড়াল, একটা ইউনিভার্সে একটা ব্ল্যাকহোল আছে আর সেই ব্ল্যাকহোলের ভিতরে আরেকটা ইউনিভার্স তৈরি হচ্ছে। আমাদের ইউনিভার্সও আসলে সেইভাবে একটা ব্ল্যাকহোলের ভিতরে অবস্থিত থাকতে পারে। (৪) নেস্টেড ইউনিভার্সের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল এই বলে যে সূর্যের মতো একটা নক্ষত্র কোলাপ্স করলে যে ব্ল্যাকহোল হবে তাতে তার দৈর্ঘ্য হবে দু মাইলের মতো, তার ভিতর এত বড় ইউনিভার্স তৈরি হবে কী করে? তাতে অঙ্ক কষে বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে থিওরিটিকাল ফিজিসিস্ট নিকোদাম পাপোলাস্কি বলেছিলেন, বাইরে থেকে ছোট মনে হলেও ব্ল্যাকহোলের ভিতরে দূরত্ব আর সময় অন্য ভাবে কাজ করে, অর্থাৎ একটা পুঁচকে ব্ল্যাকহোলের ভিতর গোটা ব্রহ্মাণ্ড থাকতে পারে, মাখন চুরি করে খাওয়া কৃষ্ণের মুখের মতোই। এই কন্সেপ্ট পুরোপুরি গৃহীত হয়নি, যদিও ফান্ডামেন্টালি সব ঠিকই আছে। কিন্তু এতদিনের সায়েন্টিফিক কন্ডিশানিং থেকে অত সহজে কেউ বেরোতে পারে না। এখন এই জেডস এর বৈপ্লবিক ফাইন্ডিংসের পর সবাই নড়েচড়ে বসেছে। লিওর শামির বলেছেন, "যদি সত্যিই তাই হয় যে আমাদের ইউনিভার্স জন্মেছিলই রোটেটিং অবস্থায়, আর আমরা সত্যিই এক ব্ল্যাকহোলের ভিতরে বসে আছি, তাহলে কসমসের সমস্ত নিয়ম নতুন করে ভাবতে হবে।"এখন এর মধ্যে স্পেসটাইম টরশন আর পাস্ট ফিউচার সিমেট্রির অনেক জটিলতা আছে, ব্ল্যাক হোল কসমোলজি হলে গ্যালাক্সির প্রেফারড রোটেশন কীভাবে বদলায়, সেসব জটিল অঙ্ক আছে, সেই সব আর লিখলাম না। নাসা বা স্পেসের সাইটে ডিটেলস পাওয়া যাবে। আপাতত আক্কেল গুড়ুম করার জন্য খবরটাই যথেষ্ট।
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on March 25, 2025 05:41

March 24, 2025

মিশরে আর্কিওলজিকাল বোনাঞ্জা

 


মিশর নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের তো এই বছর পোয়াবারো। তিন মাস কাটেনি, এর মধ্যেই বিভিন্ন সাইটে এমন সব মাথা খারাপ করা আবিষ্কার হয়েছে যে আর্কিওলজিস্ট আর ইজিপ্টোলজিস্টদের মাথা ঘুরে গেছে। প্রাচীন মিশরের লোকজন আমাদের জন্য গাদা গাদা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে গিয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু এমন পরপর মাইন্ডব্লোইং ডিসকভারি এর আগে কোনওদিন হয়েছে কিনা সন্দেহ! যাকে বলে আর্কিওলজিকাল বোনাঞ্জা! তা ঠিক কী কী হয়েছে মিশরে? চটপট দু চারটে দেখে নেওয়া যাক।

প্রথমেই বলতে হয় গিজা গিগা ডিসকভারির কথা। যেই মুহুর্তে আমরা সবাই ভাবতে শুরু করেছি যে গিজার পিরামিডের সমস্ত রহস্য খতম, এখন শুধু ওই জায়গাটা টুরিস্ট সাইট আর সিজ্জিতদার সিনেমার শুটিংয়ের জন্যই কাজে লাগানো হবে, গবেষকরা এমন একটা বম্বশেল ফেলেছে বেচারি ইন্ডিয়ানা জোনসও টুপি খুলে ঘাম মুছবেন। স্কটিশ আর ইতালিয়ান স্কলারদের একটা টিম গিজার পিরামিডের তলায় একটা বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড শহর আবিষ্কার করছে। হ্যাঁ, শহর, চেম্বার ফেম্বার নয়, আস্ত একটা সাবটেরেনিয়ায় সিটি। এই দলের দায়িত্বে ছিলেন পিসা ইউনিভার্সিটির কোরাদো মালাঙ্গা আর স্ট্রাথক্লাইড ইউনিভার্সিটির ফিলিপো বিওন্দি, তারা অত্যাধুনিক SAR মানে সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাফরে পিরামিডের ভিতরে জরিপের কাজ চালাচ্ছিল। এমন সময় তারা সেখানে একটা ঘরের মতো ফর্মেশন দেখতে পায়। আরো ভালো করে খোঁজাখুঁজি করে দেখা যায় একটা বা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা ঘর, সেগুলো ভূমিগত পথ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আজকাল সিমস বলে একটা ভিডিও গেম বেরিয়েছে, সেটার আবার একটা পিরামিড এডিশন আছে, সেখানে হেঁয়ালি সলভ করে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার আর শহর বানাতে হয়। দেখা যাচ্ছে সাড়ে চার হাজার বছর আগে ইজিপ্টের লোকজন বাস্তবেই সেই গেম খেলছিল। এখন রেডার প্রযুক্তির রিডিং ঠিক হলে এই আন্ডারগ্রাউড চেম্বারগুলো বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। মানে, একটা শহর যত বড় হতে পারে আর কি! রেডারে তোলা ছবিতে ভার্টিকাল শ্যাফট, সর্পিল সিড়ি, ওয়াটার পাইপলাইনের চিহ্ন অব্দি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিতর্কও কম হচ্ছে না। ইজিপ্টের বৈজ্ঞানিকরা ভূমিগত শহরের ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন এই বলে যে ওই রেডারের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এই নিয়ে তুমুল শোরগোল পড়েছে। অন্যদিকে রিসার্চাররা অবশ্য সেখানেই থেমে নেই, তারা ক্লেম করেছেন খুব সম্ভবত এই চেম্বারগুলো হলস অফ আমেনতি হতে পারে। এখন আমেনতি মিশরীয় লোককথায় একটা ভয়ানক কন্সেপ্ট, এই নিয়ে একগাদা মিথ আছে। সহজ ভাষায়  হলস অফ আমেনতি বাস্তব দুনিয়া আর অতিলৌকিক দুনিয়ার মাঝের সেই জায়গা যেখানে নশ্বর বা কায়িক শরীর ছেড়ে আত্মিক অস্তিত্ব অর্জন করা যায়। সাধারণ মানুষ জীবিত অবস্থায় সেখানে গেলে সেখানে অবস্থিত পোর্টাল ইউজ করে মৃতদের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারে, অতিলৌকিক ক্ষমতাও অর্জন করতে পারে। দশকের পর দশক ধরে পূরাতত্ববিদরা মিশরের এই মিথিকাল চেম্বার খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এই বছর রিসার্চারদের দাবী শুনে তারা এমন জোরে মাথা চুলকোতে শুরু করেছে যেন মাথায় উকুন হয়েছে। সত্যি মিথ্যে যাই হোক, আমাদের এই সব জেনে রোমাঞ্চিত হতে কোনও বাধা নেই। তবে থামুন, আবিষ্কারের ফিরিস্তি এই সবে শুরু হল।

যেই সময় একদল আর্কিওলজিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় এমন একটা ভীষণ আবিষ্কার হল যে ইজিপ্ট প্রেমীরা চেয়ার থেকে পড়ে যায় আর কি! বলা হচ্ছে, তুতানখামের সমাধি পাওয়ার পর এত বড় কোনও আবিষ্কার হয়নি। কথা হচ্ছে ফারানো থুতমোস দ্বিতীয়র ( Thutmose II)  প্রায় এক শতাব্দী ধরে ইনি ইতিহাসবিদ আর আর্কিওলজিস্টদের ঘোল খাইয়ে খাইয়ে ঘুরিয়ে মেরেছেন। কত বছর ধরে ভদ্রলোকের সমাধি খোঁজা হচ্ছে তার হিসেব নেই। 'পেল পেল' করে রব উঠেছে বহুবার, কিন্তু পায়নি কেউই। থুতমোস বাবু আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন প্রায় এক শতাব্দী ধরে। ভদ্রলোক এমনিতেই দুর্ভাগা, তার দজ্জাল বউ রানি হাপশেটশুত সব লাইমলাইট নিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, কিন্তু জানা যায় না বলেই মারা যাওয়ার এতদিন পর তিনি ইজিপ্টোলজিস্টদের দুনিয়ায় উচ্চস্থান অর্জন করেছেন। প্রসঙ্গত তার মমি পাওয়া গিয়েছিল বহু আগে, শুধু টুম্বটার খোঁজ চলছে দেড়শো বছর ধরে। যাই হোক, ইজিপ্ট আর ব্রিটেনের আর্কিওলজিস্টরা ভ্যালি অফ দ্য কিংসের পাশেই থেবস অঞ্চলে তাঁর সমাধি আবিষ্কার করেছে। অবশ্য জায়গাটা আড়াই বছর আগে জানা ছিল, কিন্তু হায়েরোগ্লিফগুলো প্রায় মুছে গিয়েছিল, টুম্বের অবস্থাও ভালো ছিল না, সব রিঅ্যানিমেট করে কনফার্ম করতে করতেই এতদিন কেটে গেল। এই আবিষ্কারের সবচেয়ে স্পেশাল পয়েন্ট হল, এই প্রথম কোনও ফারাওয়ের সমাধিতে রাখা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জিনিসপত্র পাওয়া গেল। সে এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে সেটা যে কোনও ফারাওয়ের সেটা আগে কেউ অনুমান করেনি, সবাই ভেবেছিল, সুয়োরানি দুয়োরানি কারো হবে। ওয়েল, জেন্ডার সোয়্যাপের ধারণা আজকের নয়। দেখা গেল, আসলে সেটাই রাজামশাইয়ের টুম্ব। এখন এই সমাধির হিয়েরোগ্লিফ লিপি আর উদ্ধার করা জিনিসপত্র যে আগামীতে কী খেল দেখাবে সেটা ভবিষ্যত বলবে, আপাতত একশো বছরের লুকোচুরি শেষ হল।

আরো আছে। সাক্কারার কথা তো অনেকেই জানেন। মিশরের প্রাচীনতম পিরামিড এবং নেক্রোপলিস, এই বিশাল এক্সক্যাভেশন সাইটে সবসময় কিছু না কিছু আবিষ্কার হচ্ছেই। রহস্য আর শেষ হয় না। সাক্কারার ভূমি দেবতাও দু হাত খুলে কিছু না কিছু দিয়েই যাচ্ছেন। একবারের জন্যও বলছেন না, যতই দাও ততোই চাই। খিল্লি বাদ দিয়ে বলি, জানুয়ারি মাসে জাপান আর ইজিপ্টের একটা জয়েন্ট আর্কিওলজিকাল মিশনের কর্তারা ঘোষণা করলেন, তারা প্রাচীন মাস্তাবা, মানে কফিনই কিন্তু চারটে হাতি ঢুকে যাবে এমন রেক্টাঙ্গুলার সুপারস্ট্রাকচার, আবিষ্কার করেছেন। সঙ্গে সেকেন্ড আর থার্ড ডাইনেস্টির প্রচুর মূল্যবান বস্তু পাওয়া গিয়েছে। সেসব ২৬৫০ বিসির জিনিস। এছাড়াও ১৫৫০-১২৯২ বিসি, মানে যে সময়টা ইজিপ্টে এইটিন্থ ডাইনেস্টি অফ অফ দ্য নিউ কিংডম বলে পরিচিত, সেই সময়ের দশটারও বেশি সমাধির খোঁজ পেয়েছেন। এখানেই শেষ হলেও হত, কিন্তু সাক্কারাতে সেসব হয় না। একটা চাইলে চারটে পাতুরি ঢেলে দেয়। এই দলের লোক এর পাশাপাশি দুটো মাটির ইট দিয়ে নির্মিত মাস্তাবা, দুটো পাথর দিয়ে কুঁদে বানানো সমাধিও খুঁজে বের করেছে, আর সঙ্গে একটা চুনাপাথর দিয়ে সিল করা শ্যাফটও পাওয়া গেছে যেটা একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সমাধিক্ষেত্রতে যাচ্ছে। প্রায় রোজই সেখানে নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে। কয়েক মাস পর দেখা যাক এই নতুন আবিষ্কারগুলো কী বোমা ফাটায়!

কিন্তু দাঁড়ান। এই বছর আর্কিওলজিকাল জ্যাকপট যখন চলছেই, লাক্সর পিছনে থাকবে তা কেমন করে হয়? ফারাওদের রাজধানী বলে কতা! সেখানে কিছু পাওয়া যাবে না তা হয়?জানুয়ারি মাসেই ইজিপ্টের রিসার্চাররা জানালেন এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা, যা পাওয়া গিয়েছে দেইর-এল-বেহরিতে রানি হাপশেটসুতের মন্দিরের একদম কাছেই। রানির অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য নির্মিত কমপ্লেক্স থেকে দেড় হাজারেরও বেশি লাইমস্টোন ব্লক পাওয়া গিয়েছে, প্রতিটাই চমৎকার ভাবে মেন্টেন্ড আছে। রঙটঙ চটে যায়নি, হায়েরোগ্লিফে একদম ঠাসা। এখন প্রথম কয়েকটার অর্থ উদ্ধার করে জানা গিয়েছে এ এক বিশাল জিগশ পাজল, কিন্তু অসম্ভব গোপনীয় আর মাথা খারাপ করা কিছু। হায়েরোগ্লিফ এক্সপার্টরা আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, কিন্তু বাকিরা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে। এক্সক্যাভেশনে অবশ্য একগাদা রাজকীয় উপাদানও পাওয়া গিয়েছে, এই ধরনের আর্টেফ্যাক্টও তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর থেকে আর পাওয়া যায়নি, সে একশো তিন বছর হয়ে গেল। যা বুঝলাম, রানি হাপশেটসুত পণ করেছিলেন, মৃত্যুর পরেও তিনি বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন, গার্ল পাওয়ার কাকে বলে। জাস্ট কিডিং!

এইবার আসল মজা। এতসবের মধ্যে এমন একটা ভয়ংকর আবিষ্কার হয়েছে যে সকলের রাতের ঘুম উড়ে গেছে, ঘেমেনেয়ে গেছে সারা দুনিয়ার মিশর এক্সপার্টরা। আবাইদোসে মাউন্ট আনুবিস নেক্রোপলিসে একজন ফারাওয়ের সমাধি পাওয়া গিয়েছে, এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব এক মার্কিন-ইজিপশিয়ান টিমের। মুশকিল হচ্ছে এই ফারাও কে, কেউ জানে না। মানে, কিছুই জানে না। কোত্থেকে ইনি উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, তাঁর বংশ পরিচয় কী, তিনি কোন রাজত্বে ছিলেন, কিছুই জানা যায় না। খোদাই করা লিপি পড়ে অনুমান করা হচ্ছে এই রহস্যময়ী ফারাও এমন এক নতুন বংশ বা ইতিহাসের কথা জানাতে পারে যে সম্পর্কে এখনও কেউ কিচ্ছুটি জানে না। তেমন হলে মিশরের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।

এছাড়াও প্রায় নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে এ বছর। মিশর নিয়ে যারা উৎসাহী, তাদের জন্য রোমাঞ্চিত হওয়ার সুবর্ণ সুয়োগ। এ-ই লেখায় কিছু কিছু আলগা টার্ম আছে, মিশর নিয়ে ক্র‍্যাশ কোর্স চাইলে অনির্বাণ ঘোষের 'হায়েরোগ্লিফের দেশে' পড়ে ফেলুন।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on March 24, 2025 05:38