পিটার অ্যান্ড লিজা

 


কমিকসের দুনিয়ায় মার্ভেল আর ডিসি এখনও বেস্টসেলার তালিকায় সবচেয়ে ওপরে থাকে। তাদের সঙ্গে এসে জুড়েছে জাপানিজ মাংগা, নিউ ওয়ার্ল্ড হরার, ফিলগুড কলেজ রোমান্স বা বুদ্ধিদীপ্ত সাইফি ফ্যান্টাসি। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ফ্যান্টাগ্রাফিক্স, ড্রন অ্যান্ড কোয়ার্টারলি, জোনাথন কেপ বা ফেবারের মতো বহু প্রকাশনা নিয়মিত লিটারারি গ্রাফিক নভেল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। সেখানে সারা দুনিয়ার শিল্পীরা কাজ করেন, ভিন্ন ভিন্ন আর্ট স্টাইল আর মানসিকতার মেলবন্ধন হয়। এই কাজগুলো সাধারণত বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলে অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে এই বইটা আবিষ্কার করেছিলাম।

সত্যি বলতে, 'পিটার অ্যান্ড লিজা' তেমন এক্সক্লুসিভ কোনও কাহিনি বলতে চায়নি। শিল্পী ভূমিকাতে জানিয়েছেন, এখানে গল্প টল্প বিশেষ নেই। জীবনে যা হয়, তাই আছে। বিষণ্ণ অবস্থাতেও একটা শহরের বিষন্নতা কত সুন্দর হয়ে চোখে ধরা দিতে পারে, সেই কথা আছে। সাধারণ স্বার্থপর মানুষরাও সময় বিশেষে কত ভালো মুহূর্ত উপহার দেয়, আছে সে কথাও। বয়ে যাওয়া সময় আছে। বন্ধু বিচ্ছেদ, সম্পর্কের ভাঙাগড়া আছে, বোহেমিয়ান লাইফ আর অবসাদগ্ৰস্ততার মাঝে বেঁচে থাকা আছে। শীত আছে। পর্ণমোচী গাছের অপূর্ব সুন্দর সব নকশা আছে। বসন্ত আছে। বসন্তের ফুল আছে। ঋতুবদল আছে। প্রেম আছে। আর আছে জীবন।

পিটার কম্পালসারি আর্মি সার্ভিস শেষে শহরে ফিরেছে। কিন্তু এরপর সে কী করবে জানে না। তার সেনাবাহিনীর বন্ধুরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে, কিন্তু পিটার কনফিউজড। এই কনফিউশনের একটা বড় কারণ, সে কবিতা লেখে। হৃদয়বিদারক সে কবিতা। যুদ্ধে ক্ষয়ে পড়া তার শহর নিয়ে, শহরের মানুষ নিয়ে। অন্যদের চেয়ে সে বেশি সংবেদনশীল, বেশি ভাবে, আবার ভাবেও না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে যে যুদ্ধ বিপর্যস্ত শহরে ভেসে যায় পিটার।

লড়াই থেমে গেছে অনেকদিন, কিন্তু শহরের স্বাভাবিক চরিত্র ফিরে আসেনি। ভাড়াবাড়ির অবস্থা খারাপ, লোকজনের হাতে পয়সা কম। তবু বোহেমিয়ান পাড়ায় রোজ পার্টি হয়, হইহল্লা চলে, নাচানাচি হুল্লোড় চলে। উদ্দাম জীবনের এই ব্যাকরণ মেনে পিটারও বন্ধুদের সঙ্গে এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে ঘুরছে, কিন্তু শত মানুষের ভিড়েও তাঁর চোখ অন্যমনস্ক, সেখানে বিষাদের ছোঁয়া। এমন সময় লিজার সঙ্গে তার আলাপ। সে একজন ব্যালে ডান্সার। দুজনের সাক্ষাৎ হয়, সম্পর্ক গড়ায় লিভ ইনে। লিজার সঙ্গ পেয়ে পিটারের জীবন রঙিন হতে শুরু করে। তার ফ্যাকাসে জীবনের মরুভূমিতে সে একটা মরুদ্যান খুঁজে পেয়েছে। সময় কাটে, বছর গড়ায়। পিটার লিখতে চায়। কিন্তু কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। খুচরো কাজ করতে করতে, ফ্ল্যাটে হাউসপার্টি করতে করতে, ভাড়াবাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে আর লিজার সঙ্গে একইভাবে প্রেম করতে করতে দেখা যায়, পিটারের সেই অবসাদ আবার ফিরে আসছে। ক্রমে সেই বিষাদ বাড়তে থাকে, বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের সম্পর্ককে শেষ করে দেয়। কিন্তু ...জীবন থেমে থাকে না কারোরই। সময় কাটতে থাকে। দুজনেরই বয়স বাড়ছে। বহু বছর পর তাদের আবার দেখা হয়। ততদিনে তারা আলাদা মানুষ, কিন্তু কোথাও না কোথাও পিটার এখনও সেই পিটার, লিজা এখনও সেই লিজা।

ন্যারেটিভ এগিয়েছে একবার পিটার, একবার লিজার বয়ানে। তাড়াহুড়ো নেই। গল্প বলার চেষ্টা নেই। খালি ফ্ল্যাট আছে, সেখানে উড়ন্ত পর্দা আছে, বাইরে পত্রহীন গাছের সারি আছে। বেড়াল আছে, কুকুর আছে। মদের বোতলের গড়াগড়ি, সিংকে জমানো এঁটো বাসনের ডাঁই আছে। বিকল গাড়ির গোদাম আছে। মানুষও আছে তাদের হরেকরকম জীবন নিয়ে, জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা তাদের নীরব অলিখিত কবিতা নিয়ে। লিখিত কবিতাও আছে, সর্বত্র।

মিরোস্লাভ সেকুলিক-স্ট্রুজা প্রাণবন্ত ভাবে চরিত্রদের আর তাদের সময়টা ধরেছেন। gouache আর watercolor, দুই ঘরানার আঁকাকেই একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হল, যদিও আর্ট নিয়ে আমার জ্ঞান খুবই ভাসাভাসা। রঙের ছয়লাপ, কিন্তু মেজাজটা বিষন্ন, এমন বহু জায়গা আছে। আবার ফিকে প্যানেলে পর পর আঁকা, কিন্তু বেশ একটা হ্যাপি মোমেন্ট ধরা পড়ছে, এমন জায়গাও আছে। বোহেমিয়ান পাড়া, ডাইভ বার, ঘরের পিছনের ঘর এবং জনাকীর্ণ নগরীর দৃশ্যের বোহেমিয়ান পরিবেশকে জীবন্ত করে তুলেছে তাঁর আঁকা। গোটা ন্যারেটিভটাই 'ব্লিক', সেখানে মাঝেমধ্যে আশার আলো দেখা যায়।

সব নিয়ে মন্ত্রমুদ্ধ করে দেওয়া বই। গল্পের বদলে জীবন পড়ার/দেখার ইচ্ছে হলে এই কাজটা পড়তে পারেন।

পিটার অ্যান্ড লিজা
ফ্যান্টাগ্রাফিক্স

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 10, 2025 10:03
No comments have been added yet.