Nabila Tabassum Chowdhury > Recent Status Updates

"What you need to know is that my life is split in two, cleaved not so neatly. There is the before and the after. Before I gained weight. After I gained weight. Before I was raped. After I was raped."

সুতরাং অসুস্থ শরীরে জার্নাল লিখতে লিখতে ভাবছি পরের সংখ্যায় পাতাটি যদি না থাকে, তাহলে জানবেল, আর একটি কমনম্যান বাঙালীর অবলুপ্তি বা আত্মবিসর্জন ঘটল।

প্রথমে ইতিহাস এবং পরিচয়ের নিপাতন – তারপরে পরমান্দ পারষ্পারিক বিঘাতন।

“মহামতি গোখলে (অথবা গোখেল) যেরূপ বলিয়াছিলেন” – ভারতের ‘অগ্রগামী’ বাঙালী আত্মধ্বংসের পথে আজো পায়োনীয়র হয়েছে।

বাঙ্গালী ছেলদের চরিত্রে একটা স্বাভাবিক মাধুর্য আছে। কিন্তু বাইরে এলেই অতি চাতুর্য, অতি প্রগল্‌ভতা এবং ঔদ্ধত্যে তা এমন কটু হয়ে যায় কেন?

কলকাতা শহরে দহি-বড়া-ইডিলি ও বড়োবাজারের লাড্ডুতে যার সমদর্শিতা- সে কলকয়াতা থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে সে কী করে আশা রাখে যে এখানে হোটেলে বাংলা দেশের দই ইলিশ কিংবা লাউ-চিংড়ি তার জন্য পরিবেশন করা হবে! ফুচকাতে যে পরম পুলকিত, কেন সে এতদ্দেশীয় আলু-মটরে কিংবা ঢ্যাঁড়শ-ভাজিতে নাক কুঁচকোয়- অশোভন মন্তব্য করে! কেন এই সহজ কথাটা সে ভাবে না যে কলকাতার ‘কক্‌নি’ এ দেশের বোধগম্য না হলেও অপমানটা যে-কেউই বুঝতে পারে?

তবু অস্বীকার করব না – বাংলা দেশের বাইরে, কখনো কখনো – এখন মনে না হয়েই যায় না – আমাদের এই যৌবল পাঞ্চ্‌ কথিত সেই ইংরেজটির মতো একটু বেশি মাত্রায় বাঙালী হয়ে ওঠে। কেমন যেন ধারণা জন্মে যায় তার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, অনেকখানি উর্ধ্ধলোক থেকে সে অবতীর্ণ, চারদিকের মানুষগুলোকে উপেক্ষা করবার একটি মৌলিক অধিকার নিয়েই সে এসেছে।

ভালো হোক, মন্দ হোক, বাঙালীর ইতিহাস এক কথাই বলে। তার চরিত্রের আর একটা দিক হল সহাবস্থানে তার চিরকালের সহিষ্ণুতা – নিজের দেশে সকলের সঙ্গে সে মানিয়ে চলে, দক্ষিনী দোসার সঙ্গেস চপ সুয়ে – সবই তার উপাদেয় খাদ্য, সোন হালয়া কিংবা দো-পেঁয়াজি কিছুতেই তার অরুচি নেই। শিক্ষা দীক্ষায়, রুচিতে, জীবনচর্যায়- বাঙালী একই সঙ্গে আন্তঃপ্রাদেশিক এবং আন্তর্জাতিক।

বাঙালী হয়ে জন্মানো সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য জানি না, কিন্তু বাঙালীর গায়ে যে রঙই লাগুক – পাকা হয়ে বসে না, দু’দিন পরেই তা ধুয়ে মুছে গিয় তার আদিম বাঙালীত্ব বেরিয়ে আসে। তা যদি না হত, তাহলে আধুনিক ভারতবর্ষের স্বাদেশিকতার জন্ম বাংলাদেশেই জন্ম নিতো না।

যখন অক্ষর-পরিচয় পর্যন্ত হয়নি, তখনো একটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বই দেখেছি বাড়িতে। বড়দির সম্পত্তি ছিল হয়তোঃ আমরা বড়ো হতে আর একখান এল, সেটা ছিঁড়ল, ছোট বোনেরা বড়ো হল, আর একখানা। এ ঠিক বাঙালীর ঘরের ‘সঞ্চয়িতা’র মতো – একটি খোয়া গেলে অবিলম্বে আর একটি সংগ্রহ করতে হয়। এই বয়সেও বছর কয়েক আগে আমি নতুন একখানা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ কিনেছি – মা কিনে উপায়ই ছিল না। বাঙালীর সংসারে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ নেই – কল্পনা করা যায়?

সভয়ে আর একটা কথা বলি। বিপ্লবের উপাদানকে নৈরাজ্যের আতসবাজি করলে সেই অপচয়ের আনন্দের একটা কঠিন নিষ্ঠুর মূল্য দিতেই হয়। ইতিহাস কোনোদিন, কাউকে ক্ষমা করে না।

আমরা সাধারণ মানুষ, সহজ বুদ্ধিতে এ সবের থই পাই না। তরুণদের আমি বুঝি, তাঁদের অনেক যন্ত্রণা জমেছে, সেই জ্বলার অভিব্যাক্তি সর্বদা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না, হিসেবী পা ফেলে বিপ্লবও আসে না। কিন্তু যাঁরা নেতৃত্ব দেন, দায়িত্ব তাঁদের ওপরেই বর্তায়, তাঁদেরই লক্ষ রাখতে হয় কী থাকবে, কী যাবে। লেনিনের এই শতবর্ষে মনে পড়েছে বিপ্লবকালে এ দায় কিভাবে তিনি তার তাঁর সহযোদ্ধারা গ্রহণ করেছিলেন।

যে আদিম পিতামাতার ভুল থেকেই আমাদের জন্ম। আর এই ভুলের আলোছায়াতেই জীবন এত বিচিত্র-মানুষ এমন অপরূপ। নইলে কী করে আসত সাহিত্য, দেখা দিত দার্শনিত তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিকরা কী করে এগিয়ে যেতেন? ‘সাদা-কালোর দ্বন্দের যে ছন্দে নতুন রঙ লাগে’।

আমি ভুল করি, ভুল স্বীকার করি, আদর্শের বাণী শোনাই না – রাজনীতিকদের মতো অম্লান মুখে ভুলকে স্ট্র্যাটেজির চ্যানেলে চালান করে দিই না।

দুর্বলের ভুলে তোমরা খড়্গহস্ত, আর প্রবলের ভুল তোমাদের কাছে আর্ষপ্রয়োগ?

একদল গিয়ে আর একদলের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। মই দিয়েছে ক্ষেতে। আঠারো বিশটি খুন এবং কী অবলীলাক্রম! পাঁচজন নিরুদ্দেশ, খুব সম্ভবত তারাও-

তখন বকরূপী ধর্ম আমার কানে বললেন, “হে বৎস, তোমাদ দ্বরে বিক্রেতা উপস্থিত। অতি সুলভে অমরত্ব বিক্রয় হইতেছে। কিছু না- মাত্র নশ্বর জীবটি মূল্যরূপে দান করিলেই চলিবে।”

হঠাৎ আমার হুমায়ুনের কথা মনে পড়লো। শের শাহের তাড়া খেয়ে পারস্য সম্রাট শাহ তমাস্‌পের আশ্রয় চাইছেন। শাহ তমাস্‌প জবাবে লিখেছেন, ‘কিমাশ্চর্যম্‌!রাজা- সম্রাটেরা আশ্রয় চায় ‘হুমা’ (ফার্সীতে স্ফিংসকে ‘হুমা’ বলে)-এর কাছে, আর সেই ‘হুমা’ কিনা এখন রাজার শরণ চাইছেন!’

রাজনীতিতে সব দলই নির্ভুল, তাই অন্য দলের ভুল-ভ্রান্তিতে তাঁদের গর্জিত এবং কখনো কখনো সহিংস প্রতিবাদ। কিন্তু এই শিশুরা কোন দলের – আমার তাই জানতে ইচ্ছা করে।

আর রক্তের মধ্যে এই ধারাটা থাকে বলেই লন্ডনে দুর্গাপুজোর উৎসব, আমেরিকাতে বিজয়া সম্মেলন, কানাডায় বাংলা নাটক। এ শুধু দূর বিদেশে থেকে স্বদেশকে স্মরণ করা নয়, এ আমাদের সেই উত্তরাধিকার, সেই মৌলিক চরিত্র। ওপরের স্তরে আমরা যত খুশি আন্তর্জাতিক হতে পারি, কিন্তু এই ভিত্তিটা কি সহজে বদলায়, বদলাতে পারে?

আজ মনে হল, কোথায় যেন থেকে যায় পিতৃ-পুরুষের একটা ধারা –ইচ্ছে করলেই নিজেদের আমরা বদলাতে পারি না। তখন দেড় কেজি নকল খোঁপাটা মায়া, মিস্টার টিপটপও তখন সেই পুরোনো কাস্তে, সেই নদী, সেই গোরুর গাড়ির পথ, মেথি ফোড়নের সেই গন্ধ টের পান নিজের ভেতর। অতঃপর প্রশ্নঃ খাজুর গুড কত কইরা?’

এমন কি টাইম্‌স্‌ লিটারারী সাপলিমেন্ট – যা তখন প্রধানভাবে আমাদের ইংরিজি আর ইয়োরোপীয় সাহিত্যের খবর দিত – সেখানে সমালোচনা বেরবার আগেই হয়তো ফেবার অ্যান্ড ফেবার, চ্যাটো অ্যান্ড উইন্‌ডাস কিংবা কনস্টেবল কোম্পানীর বই আমরা পড়ে ফেলতুম।

ইংরেজ নয় ইংরিজি আমলের কলকাতাতে অন্তত দিন কয়েকের জন্য দিরে পেতে চাইছি এই কারণে। বেশিদিন নয়। এই সপ্তাহখানেক হলেই চলবে। তা হলে আবার আশ মিটিয়ে কিছু বই কিনতে পারি।

আমাদের তখন ছাত্র জীবন, বলা বাহুল্য পকেটে পকেটে পয়সার প্রাচুর্য থাকত না; কিন্তু মাসে একটা টাকা বাঁচাতে পারলে পেঙ্গুয়িন, পেলিক্যানের তিনখানা বই আমরা দুর্লভ রত্নের মতো আহরণ করতে পারতুম; ডলারের সমস্যা ছিল না – ইমপোর্ট রেস্‌ট্রিক্‌শন ছিল না- বিদেশে কোনো নতুন বই বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে কলেজ স্ট্রীটের শো কেসে তারা ঝকঝক করে উঠত;

তা হলে ক্রিকেট যদি একান্তই ইংরাজী খেলা হয় আর ‘আংগ্রেজী হটাও’রা বা তাকে লাঠি হাতে তাড়া করেন, হকিও কি পরিত্রাণ পাবে? নাকি ধ্যানচাঁদ-রূপ সিংয়ের একদা ঘৃত ভোজনের প্রাগৈতিহাসিক নজীর টেনে আমরা খাঁট ইংরেজি হলেও হকিকে পঞ্চগব্যে শোধন করে নেব। আর যেহেতু ক্রিকেটে আমরা ‘কিউয়ি’দের ঠাঙানি খেয়েছি (অবশ্য ‘অসি’দের কাছ থেকে সম্মান পুনরুদ্ধার কবে কিনা তা ক্রমশ প্রকাশ্য) তাই আংগ্রেজী ক্রিকেট হটাও?

কিন্তু তত্ত্ব- দিয়ে কে কবে কবিতাকে ভালোবেসেছে? ছবি, কবিতা, কোনো বিশেষ সুর – এসবই তো ব্যক্তি –সাপেক্ষ।

আমি ভাবি, এই বিশ্ববিদ্যালয় চিরকাল চিন্তায় অগ্রণী বলেই দুঃখ দুর্বিপাকের তরঙ্গ এরই ওপর সকলের আগে আছড়ে পড়ে। যে বনষ্পতি ওপরে মাথা তোলে – ঝড়ের আঘাত তাকেই তো সইতে হয় সর্বাগ্রে। এককালের তরুনতা যদি অন্তর্জ্বালায় বিকৃত হয়, তার মাশুল্ল দিতে হয় এই প্রতিষ্ঠানকেই; যদি কোনো নতুন সত্য উদ্ভাসিত হয়- তার বিচ্ছুরিণ সর্বোজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় এখানেই।

স্ট্যাটিউ – বাংলা মতে স্ট্যাচু, পরিভাষায় যা প্রতিমূর্তি – তার একটা আভিধানিক সংজ্ঞা আছে। তাতে বলা আছে মূর্তিটি মার্বেল কিংবা ব্রোন্‌জ যাতেই তৈরী হোক, সেটি জীবন্তবৎ হওয়া দরকার, জীবন্তবৎ কথাটি অবশ্য তর্ক সাপেক্ষ। আমি জনৈক পরিচিত ব্যক্তিকে দেখলেই খ্যাঁকশেয়ালের কথা ভাবি – সুতরাং আমি যদি কখনও ভাস্কর হয়ে তার মূর্তি গড়তুম, তা হলে শেয়ালরূপেই তিনি জীবন্ত হয়ে উঠতেন।

মানুষের কোন চেহারাটা স্বাভাবিক আর কোন্‌টা অস্বাভাবিক আমরা কেউ কি তা জোর করে বলতে পারি? তত্ত্ব-জিজ্ঞাসায় একটু গূঢ় অনুপ্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন, জৈবিক উপাদানে আমরা – আদিম সন্তান – সন্ততিতা সকলেই এক, হস্তপদাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সার্বজনীন ঐক্য বিধৃত। আদিম মানসিকতাগুলোও একই ছিল।

না –সেই আদিম আহ্বানকে ভোলা যায় না। তাই মার্কিনী কালো মানুষেরাও অপমানিত মানবতার সব গ্লানির ভেতরে থেকে থেকে চকিত হয়, তার কানে আসে অপার অরণ্য থেকে ঢাকের শব্দ, তার বন্য পিতৃপুরুষের শিকারের কলরোল, শুনতে পায় তৃণভূমিতে আকাশফাটা সিঙ্ঘের গর্জন – সেই গর্জনের সঙ্গে মিশে যায় ঝাম্বেসি প্রপাতের বজ্রধ্বনি, তার মাথার ভেতরে হিসহিস করে ব্ল্যাক-মাম্বা। তখন আমেরিকার আকাশেও আফ্রিকার কালো মেঘ বিদ্যুৎ চমকায়।

যে দেশকে পর করে দিয়েছি, যার পদ্মা-মেঘনা-মধুমতী-আড়িয়াল খাঁ-ইলশা-কালাবদর একখ স্বপ্নের নদী, যার মাইলের পর মেইল সুপুরিবনের মাথার ওপর বর্ষার মেঘ নুয়ে পড়েছে, সে এখন রূপকথা। কী হবে সেই স্মৃতিচর্চায় – যা শুধু দুঃখই দেবে?

স্বয়ং সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় চোখে পড়লো, তাঁরা মানুষের মনে দুটি চেম্বারকে পাশাপাশি দেখেছেন। একদিকে বিজ্ঞান-টেক্‌নলজির চূড়ান্ত প্রকর্ষ; আর একদিনে এখনো আদিম অন্ধকার থমথম করছে – তার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে সেই বন্য মুখটা –যার হাতে কাঠের মুগুর, যার দাঁত থেকে গড়িয়ে পড়ছে কাঁচা রক্ত। এই দ্বিতীয় উত্তরাধিকার থেকে আমাদের পরিত্রান কবে- কত দিনে?