টেলিফোন রিং, ক্রিং ক্রিং ক্রিং

১৯৯৮ সাল। একটা টেলিফোন রিং। ক্রিং ক্রিং ক্রিং…
নাফিসা কেবল চুলায় চা বসিয়েছে। ভাবছে চুলাটা বন্ধ করে টেলিফোনটা ধরতে যাবে কিনা! যেতে যেতে একবার কল বেজে বন্ধ হয়ে দ্বিতীয়বারের মতন টেলিফোনটা বাজছে।
হ্যালো! কে বলছেন?
ওপাশ থেকে কেউ কথা বলছে না। তবে আশেপাশের শব্দ ভেসে ভেসে আসছে। এই নিয়ে কয়েক ডজন কল এসেছে দু’সপ্তাহ ধরে। প্রতিদিন কম করে তিন-চারবার কল আসে অথচ কেউ কথা বলে না। নাফিসা কয়েকবার ভেবেছে টেলিফোনের লাইনটা কেটে দেওয়ার জন্য কিন্তু এটাই তার পরিবার, অফিসের সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম।
তবে এর এক একটা সমাধান করতে হবে শীঘ্রই। এভাবে এমন জালাতন সহ্য করে আর কতদিন?
দ্রুত চা শেষ করে বাজারের উদ্দেশ্যে যায়। ফ্লাটে সে একাই থাকে। তবে এমন একা থাকাটা বাসা থেকে মানতে পারেনা তার বাবা মা। বিয়ের জন্য বাসা তাড়া দেয় হরহামেশা। অফিসের টুকটাক ঝামেলা তো আছেই সাথে রোজ রোজ ও বাদে সবার ওর বিয়ের জন্য কনসার্ন ভালোলাগেনা।

ফর্সা, পাতলা, লম্বা গড়নের নাফিসা। একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কল্পনা কর‍তে থাকে একজন গ্রীক দেবতার পাশে। তীক্ষ্ণ কলার বোন ছুঁয়ে সে ডাকছে তাকে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গিয়ে গ্রীক দেবতা টিপের বেশে আয়নার লেপ্টে থাকে। সেখান থেকে ছোট একটা লাল টিপ কপালে পড়ে তারাহুরো করে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ে।

ফার্মগেটে এসে সে বিশাল জ্যামে আটকা পড়ে। থামা বাসে উঠে আসে একজন মধ্য বয়স্ক লোক, দুইজন হিজরা। হিজরা দু’জন ধেই ধেই নেচে এর ওর কাছ থেকে টাকা চাইতে থাকে। নাফিসার কাছে আসলে একটা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে ঝামেলার ভয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দেয়। তবুও তাদের মুখে শুষ্কতার রেশ কাটেনা। এদিকে মধ্যবয়স্ক লোকটা ইতিমধ্যে ওর ডানপাশের সিটটায় বসা। খুব সতর্কতার সাথে চেষ্টা করছে যেন তার কনুই তার গা স্পর্শ করে। নাফিসা এবার ড্যাবড্যাব করে লোকটার দিকে ফিরে তাকিয়েই থাকে। উনি এবার একরকম ভয়ে পেয়ে একটু সরে বসে। ও ভাবতে থাকে কোথায় গেলে মেয়েরা নিজেদেরকে একটু নিরাপদ মনে করবে। যেখানে এইসমস্ত লোকদের লেজ গুটিয়ে পালানোর কথা সেখানে এক-একটা মেয়ে প্রতিদিন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে কোনো না কোনো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে পড়ে। এত এত নিরাশা ভীড় করে ওর মাথায়। ভাবতে থাকে কোথায় গিয়ে এসব ভাবন থেকে মুক্তি পাবে। কোত্থেকে হঠাৎ একটা লাইন হঠাৎ মাথায় ঢুকে যায়। সারাদিন কানে বাজতেই থাকে ভুভুজেলার মত।
“সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা
আশা তার একমাত্র ভেলা”
ও ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে রক্ত বের করে ফেলে। চিন্তা করে এবার ভেলা হিসেবে কি আশা করা যায়। যে আশা ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম।

অক্টোবরের শেষে শীতের একটা আমেজ আসে। সেটা সবাই লক্ষ্য করে। লক্ষ্য করে না যেটা সেটা হচ্ছে ঠিক লেইট সেপ্টেম্বরে দিনে ভ্যাপসা গরমের পরে রাতে যে এক ধরনের মৃদুমন্দ হাওয়া বয়-সে সময়টা। কেমন জানি শীত আসবে আসবে একটা ভাব। জানিয়ে রেখে যায় সে আসবে কিন্তু খানিকটা পরে। অনেকটা শীতের এই আগাম বার্তার মত নাফিসাকে কেউ জানিয়ে রাখেনা সে আসবে তার জন্য। কিন্তু ও অপেক্ষা করে, করতেই থাকে। ছোটবেলায় দেখেছিলো দাদীকে উল দিয়ে সোয়েটার বুনতে। কত যত্নই না লুকিয়ে থাকে শুকনো চামড়ার ঐ দুই হাত জুড়ে! এমন উষ্ণতা পেটে মোচড় দিলে মনে হয় অপেক্ষাও বুঝি এত মধুর হয়! মাঝেমধ্যে নাফিসার চোখে ভেসে ওঠে পুরনো এক অবয়ব। প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করাতে হয়েছে। যেমনঃ কি যেন জানতে চাই জানতে চাই একটা ভাব! বিনিময় করা বাক্যের লেজে ঝুলতে ঝুলতে সেটাকে টেনে ইলাস্টিকের মতন লম্বা করতে ইচ্ছে করতো। আফসোস! একতরফা টানলে সেটা আবার তার নিজের দিকেই ফিরে যায়। এক সময় আবেশ এর মঞ্চে প্রবেশ, কাগজের টুকরোও চিরুনী বেয়ে উঠে এসেছিলো! কৌতুহল এর উপর মুগ্ধতা নামক পরগাছা জন্মাতে শুরু করে। আস্ত গাছটাকেই না উপড়ে ফেলতে হয়!

হঠাৎ করে টেলিফোন বেজে ওঠে প্রতিদিনের মত। এবার আর ও ধরতে যায় না। বেজে বেজে একটা সময় থেমে যায়। সন্ধ্যার পরে আবারও টেলিফোনটা বাজে। ‘কি ব্যাপার আপনাকে এতবার ফোন করলাম ফোন ধরলেন না। প্রায়ই এরকম করেন। আপনি আদৌ চান তো কাজটা ঠিকঠাক করতে? নাকি আপনার বদলে নতুন রিক্রুমেন্ট এর জন্য আমাদের ভাবতে হবে?’
নাফিসা এবার জিহবায় কামড় বসিয়ে গড়গড় করে স্যরি স্যার, স্যরি স্যার আওরাতে থাকে। ওপাশ থেকে খট করে লাইনটা কেটে দেয়। এবার ও সারারাত ধরে ভাবতে থাকে কাল অফিসে গিয়ে স্যারকে কি বলবে! কিসের অজুহাত দিলে এবারের মতন অন্তত রক্ষা পাওয়া যাবে। এই চাকরিটা ওর খুবই দরকার। এতটা স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে না যদি ওকে কুমিল্লায় বাবা-মার সঙ্গে থাকতে হয়!

ভাগ্য ভালো এবারের মতন তেমন কিছুই শুনতে হয় না নাফিসার। দু-য়েকবার হলেও হয় কিন্তু প্রায়ই প্রয়োজনের সময় ওকে ফোনে পাওয়া যায় না। এ নিয়ে অফিসের বস কিংবা বাবা-মায়ের অভিযোগের সীমা নেই। সাথে যুক্ত হয়েছে অসভ্য কারোর ফোন করে ডিস্টার্ব করা! আরে এত যখন জালাতন করার ইচ্ছা, সামনে এসে জালাতন কর। এভাবে তো মুখ না দেখে কাউকে দুটো গালি দিয়েও শান্তি পাওয়া যায় না। ও অফিসের এক কলিগকে জানায় এই অবস্থার কথা। সে ওকে নতুন টেলিফোন আনার উপদেশ দেয়। নাফিসা সেটা করতে চায় না একটা কারণে। ওর ধারণা একটা কল আসবে। টেলিফোনের তার বেয়ে সমস্ত উষ্ণতা তার কান থেকে পেট অব্দি পৌছাবে। সবকিছু পাল্টে যাবে সিনেমার মতন।

এভাবে চলতে চলতে সময়ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে ঘড়ির কাটার মতন। কিন্তু নাফিসা ক্লান্ত হয় না। প্রতিদিন যে নামহীন ব্যাক্তির কল আসে ও চিন্তা করতে থাকে কে হতে পারে সে! সন্দেহ করে কাউকে। সন্দেহ করা ব্যাক্তিই যদি হয় কেনো সে কথা বলে না? কি অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে গলার স্বরটুকুকে সে পরাধীন করে ফেলেছে!

একসময় সে মানুষটা কথা বললে মনে হত চারপাশে বেহালা বাজছে। ঘোর নামক অতল গহব্বর সমস্ত অস্তিত্বকে চুম্বকের মতন টানছে। যে অন্ধকার অর্ধেক ডুবন্ত জাহাজের একজন নাবিকের চোখের জ্যোতিতে ধরা পরে সে অন্ধকারে নিলীন হয়ে যাওয়াটাও নিছক কোনো ভ্রম নয়। তবে ধোয়া-ছোঁয়ার বাইরের মানুষকে আর কতটুকুই বা ধরে রাখা যায়! ধরতে পারলে মানুষ ছেঁড়ে দেওয়ার ঝুঁকি নেয়। আর যে ধরতে গেলেই সব পিছলে যায়, তার কথা লিখতে গেলে শুধুশুধু কালির অপচয়।
ভয় হত নাফিসার। সেজন্য এ ভয়কে একটা বৈয়াম এ ভরে আটকে রেখেছে ও। সেদিন ভয় কেটে যাবে সেদিন বৈয়াম এর মুখ খুলে দিবে। আলাদিনের দৈত্যের মত সব ভয় বৈয়াম থেকে বেরিয়ে আসবে। আর ভয় কেটে না যাওয়ার শঙ্কা থাকলে বৈয়ামটাকে একটা মৃত নদীতে ফেলে দেবে। কোনক্রমেই ভাসতে দেওয়া যাবে না আর।

আবার ও সেই টেলিফোন রিং। ক্রিং ক্রিং ক্রিং…
পিন পতন নিরবতা। নাফিসা ফোনটা কানে ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। যেন ওর সিক্সথ সেন্স বলে, অপেক্ষা করো আর কিছুক্ষণ। ও চোখ বন্ধ করে মিটমিটিয়ে হাসে। জানালা থেকে তীর্যক কমলা আলো ওর কপালে চিকচিক করে নিখাঁদ স্বর্ণের মত। সেমিকোলন এর মতন দীর্ঘ নিশ্বাস সমস্ত নিরবতার ইতি টানে। অবশেষে ওপাশ থেকে বাজতে থাকে,
‘আই ওয়ান্স হ্যাড আ গার্ল
অর শ্যুড আই সে, সি ওয়ান্স হ্যাড মি?
সি শো’ড মি হার রুম
ইজ’ন্ট ইট গুড, নরওয়েজিয়ান উড?’

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on August 10, 2023 08:12
No comments have been added yet.


Shoroli Shilon's Blog

Shoroli Shilon
Shoroli Shilon isn't a Goodreads Author (yet), but they do have a blog, so here are some recent posts imported from their feed.
Follow Shoroli Shilon's blog with rss.