কিছু হয়নি তো!
মৃদুমন্দ হাওয়ায় হারিকেনের কমলা রঙের আভায় মনে হচ্ছিলো রাতটা যেন পার হতে চাইছে না। টিনের চালে হঠাৎ একটা ডাল পড়ার শব্দে বাবার ঘুম ভেঙে যায়। পাশের রুম থেকে দাদীর শুষ্ক কাশির শব্দকে বৃষ্টির ছন্দময়ী শব্দের সাথে বেমানান লাগে। একটা মোটা কম্বলের নিচে বসে আমি গল্পের বই পড়ছি। বইয়ের মলাটে বড় বড় অক্ষরে লেখা-“সেরা ভূতের গল্প”।
বাবা বিরক্তির চোখে আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকায় খাট থেকে। আমি ঠিক খাটের পাশেই একটা মাদুর পাতিয়ে শুয়ে আছি। বই হাতে নিয়ে আমার খানিকক্ষণ পর পর ঝিমুনি আসে। হঠাৎ করে তন্দ্রাঘোরে চলে যাই। ঠিক মধ্যরাতে, আনুমানিক তিনটা তেত্রিশ মিনিটে অদ্ভুৎ এক স্বপ্নে আমার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নে দেখলাম একটা হিন্দু বিয়ে খেতে এসেছি অজপাড়া এক গাঁয়ে। সেখানেই পরিচিত একজনের দেখা পেয়ে যাই। স্বপ্নে তাকে মনে হলো সে আমার খুব আপন। তবে তার অবয়ব একেবারেই ঝাপসা লাগলো! শাড়ি সামলাতে কষ্ট হচ্ছিলো। শাড়ির আচলে বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই আমার বাঁ হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো সে।
বিয়ের লগ্ন রাত দশটায়। উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছি কয়েকজন। সময়টা আঁচ করতে পারলাম। বেশ ঠান্ডা। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি হবে। রাত বিশেষত লম্বা। কুয়াশার কারণে আশেপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে শুধু উলুধ্বনির আওয়াজ আসছে।
হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে পড়ার মত কান্নার আওয়াজে উঠানের সবাই লাফ দিয়ে উঠলাম। সবার মধ্যে কৌতুহলের প্রতিযোগিতা। দক্ষিণ পাশের একটা ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এসে বললো এ বাড়িতে কেউ একজন মারা গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে শবদাহ করা হবে। আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলা হলো। ঘড়িতে নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। শুনেছি হিন্দু বিয়ে বেশ লম্বা একটা সময় ধরে, কিছুটা জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেখানে মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিটে কিভাবে শবদাহ করে এসে আবার বিয়ের কাজে হাত দিবে এরা! এত তাড়াহুড়োই বা কিসের! সবকিছু মিলিয়ে হ জ ব র ল এর মত একটা অবস্থা।
কিছুই বুঝতে উঠতে পারলাম না। এদিকে সেই ঝাপসা চেহারার পরিচিত লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে সায় দিলো উঠে পড়ার জন্য। সবার সাথে তাল মিলিয়ে তাদের পেছনে পেছনে হাঁটছি। অদ্ভুৎ একটা ঘ্রাণ। এ প্রথম দেখলাম কান্নার কোনো ছিটেফোঁটা নেই কারোর মধ্যে। ভাবলেশহীন চাহনি। চিন চিন করে শব্দ আসছে পাখির কিচিরমিচিরের। তাও আবার এই অসময়ে? এদিকে যতদূর এগোচ্ছি ঠান্ডা যেন বাড়ছে। কোনো গরম কাপড় সাথে না আনার জন্য নিজেকেই দোষারোপ করছি। পাশের সেই পরিচিত মানুষটাকে আর দেখতে পেলাম না। নিমেষেই যেন হাওয়া হয়ে গেল। খেয়াল করলাম সামনের মানুষগুলো আর আমার মাঝে বেশ লম্বা একটা গ্যাপ। ফোনের ফ্লাশলাইটটা জ্বালিয়ে পেছনে দেখলাম লোকটা আছে কিনা! না, পেছনে আমি আর আমার ছায়া ছাড়া কিছুই নেই। এবার দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। মেয়ে হিসেবে অনেকটা সাহসী আমি কিন্তু কোনো এক অজানা ভয় ভর করলো আমার ভেতরে। কোথায় যাচ্ছি? কেনো যাচ্ছি? কোনো প্রশ্নের উত্তর মিললো না যেন!
আচমকা আমাকে চমকে দিয়ে লোকটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। মনে মনে রাগ করলেও একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এবার দুজনে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বাকিদের দলে যোগ দিলাম। সমস্ত যোগাড়যন্ত্র হয়ে গেল খুব দ্রুত। ওদিকে বিয়েতে কন্যার লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার শঙ্কা। মাত্র পনেরো মিনিট বাকি আছে দশটা বাজতে। যেন চিন্তাটা একাই আমার! সব কিছুর জটলা মাথা থেকে নামিয়ে শ্বশানঘাটের ভেতরে প্রবেশ করলাম। চিতার আগুন জ্বলজ্বল করবে একটু পরেই। নিষ্পলক দৃষ্টি একেকটা অবয়বের চোখে। যেন কঠিন শোকে পাথর হয়ে গেছে সবাই। এবার মৃতদেহ চিতায় ওঠানোর পালা। প্রক্রিয়াটা খুব কাছ থেকে দেখার জন্য আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো!
স্পষ্ট দেখতে পেলাম তাকে। যাকে কিছুক্ষণ আগেই বিয়ের কন্যার পোশাকে মুড়িয়ে থাকতে দেখেছি। খেয়াল করলাম কাছে যেতে যেতে এতটাই কাছে গিয়ে পৌঁছেছি যে তার মুখটা ঠিক আমার মুখের সামনে। অদৃশ্য কতগুলো হাত যেন পেছন থেকে তাকে শূন্যে ভাসিয়ে রেখেছে। তার চোখ জোড়া বন্ধ অথচ মুচকি হাসির ঢেউ ঠোঁট জুড়ে। পেছন থেকে দৌড়ে পালাতে গেলাম। চোরাবালির মত ডুবে যেতে থাকলাম আস্তে আস্তে। প্রচন্ডভাবে কেউ আমাকে পেছন থেকে ঢাক্কা দিলো। পেছনে দাঁড়িয়ে আমার সাথে থাকা সেই লোকটা খিলখিল করে হাসছে। তার অকস্মাৎ আগমনে আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেল। আবার ও আরেক ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ঠিক মেয়েটার মুখের উপর। মুচকি হাসি যেন নিমেষেই পরিবর্তিত হলো অসম্ভব রাগে, অপমানে আর বিস্ময়ে। মেয়েটা আমাকে তখনই কিছু একটা বলতে চাইলো। তার চোখের ধারালো দৃষ্টিতে লাঞ্চনা আর কিছু বলতে না পারার করুণ আভাস পেলাম। আমি পালাতে চেষ্টা করলাম। আমাকে আরো জাপ্টে ধরলো সে। যেন শুনতেই হবে সে কি বলতে চায়! কেউ যেন বুকের উপর পাহাড়সম ভারী কিছু দিয়ে চেপে ধরলো আমাকে। চিল্লানো শুরু করলাম। ‘কি হয়েছে তোর?’
চোখ খুলে দেখলাম সেই মাদুরেই শুয়ে আছি, হাতে গল্পের বইটা মুঠ করে ধরা। বাবা, মা আর ছোটভাই আমার দিকে কৌতুহলী চেহারা বেশে তাকিয়ে আছে। সেমিকোলনের মত লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘কিছু হয়নি তো!’
Shoroli Shilon's Blog
- Shoroli Shilon's profile
- 8 followers
