কয়েকটা মাছ এবং সব এলোমেলো
একটা পঁচা পুকুরে কিছু মানুষ বড়শি পেতে বসে আছে। খুব বেশি মাছ নেই পুকুরে। সবার ভেতর টানটান উত্তেজনা। দক্ষতা আর ভাগ্য মিলে বিশাল এক প্রতিযোগিতা। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। কারো বড়শিতে মাছ ধরা পড়ছে না। লোকে বলাবলি করছে দু’দিন আগে নাকি কারা এসে সমস্ত পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। তবুও কিঞ্চিত আশায় সামান্য অর্জনের জন্য সারাটাদিন ধরে এখানে পড়ে আছে সবাই। বহু প্রতীক্ষার পরে হঠাৎ একজনের বড়শিতে একটা মাছ উঠলো। হুলুস্তুল কান্ড বেঁধে গেলো সবার মধ্যে। চরম হিংসা থেকে শুরু তর্কাতর্কির এক পর্যায় রুপ নিলো ধস্তাধস্তিতে। শেষমেশ ওই লোকের কপালে মাছ তো রইলোই না বরং পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা তাকে আবিষ্কার করলো মাছ হয়ে পুকুরে ভাসতে।
এক লাফে ঘুম থকে উঠে বসলো নাহিদ। নিজের শরীর ভালোমত ছুঁয়ে দেখছে। মাছ নয়তো সে! এমন বিদ্ঘুটে স্বপ্ন ও আগেও দেখেছে। এমন সব স্বপ্নের ব্যাখ্যা কি আদৌ আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে ওর। অসময়ে ঘুমানোর এই একটা অসুবিধা! কিছুই ভালোলাগেনা এ সময়ে। নিজেকে নবজাতক শিশুর মত মনে হয়। আশেপাশের সবকিছু অচেনা-অজানা লাগে। বিশ্রী এক ফ্যাকাশে অনুভূতি!
নাহিদরা দুই ভাই-বোন। ছয় বছর বয়সে বড় বোন এখন শশুরবাড়িতে কলুর বলুদ খাটছে। মাও বাসায় নেই আজ। ছোট খালার বাসায় গিয়েছে। আর বাবা অনেক আগেই জ্ঞাত হয়েছেন।
ঘড়িতে আটটা বেজে দশ মিনিট। বাসি ভাত আর একটা ডিম ভাজা দিয়ে রাতের খাবার শেষে ছাদে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। আজকের রাতটা নিস্তব্ধ আর তারা গুলো অন্যান্য রাতের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল। পুরো আকাশটা আজ বেশ আড়ম্বর করে সেজেছে। তারা গুনতে গুনতে এখন আকাশকুসুম কল্পনা করছে নাহিদ। অনেক টাকা দরকার ওর। টাকার বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওসব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতেও আরাম লাগার কথা! ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলে এজন্য ভাবনা-চিন্তাও বাদ দিয়ে দিয়েছে। একটা সস্তা চাকরি পেতে গেলেও যে হাড়ভাঙাখাটুনি চাই!
পরেরদিন সকালে খুব তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হয়।উদ্দেশ্য, টিউশনির টাকা আনতে যাবে। ছাত্রের মা বলে দিয়েছে এরপর থেকে আর পড়াতে যেতে হবে না। কেনো যেতে হবে না ও জানতে চায়নি। যার যা ইচ্ছা করুক! এটা নতুন কিছু নয়!
বাসায় ফিরে টের ও পেলো মা চলে এসেছে। রান্নাঘর থেকে লাউ এর তরকারির মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। কিছু টাকা রেখে বাকিটা মায়ের কাছে দিয়ে দিলো সে। স্বামীর পেনশনের টাকা আর টুকটাক বুটিক এর কাজ করে সংসার চালান নাহার বেগম।
দুপুরের খাবার সেরে বিশাল এক ঘুম দিয়ে নাহিদ দেখলো বাসায় কেউ নেই। একটা কল আসলো আননোন নাম্বার থেকে। রিসিভ করে জানতে পারে একটা ফার্ম থেকে কলটা এসেছে। দু’মাস আগে যে চাকরির জন্য ও এপ্লাই করেছিলো সেখান থেকে ওকে ডেকেছে। ধুর! স্ক্যাম ছাড়া আর কিহ! পরে মেইল চেক করে দেখলো ঠিকই তো ও এপ্লাই করেছিলো সাথে সাথে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার ও এসেছে। বলে দিয়েছে কবে কি করতে হবে। স্বপ্ন না বাস্তব বুঝতে পারছে না সে। সবকিছু একটা ঘোর মনে হচ্ছে। পাশে মায়ের ঘরে গিয়ে বুঝতে পারলো মা নেই। কোথায় গিয়েছে জানেনা। খালাকে ফোন দিলে উনি বললেন, ‘এই বোকা তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নাকি আমার সাথে ফাজলামি করছিস? তোর মা কোত্থেকে আসবে?’ কিছু বোঝার বাকি রইলো না। সব কেমন গোলমেলে, ধোঁয়াশা লাগলো!
এর মাঝে কিছু সময় পার হলো। বিশাল বড় ধাক্কা আর ঘোর কিছুতেই কাটছে না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে কি হয়ে গেলো!
এক মাস পর নাহিদ চলে গেলো ফার্মটাতে। এখানে আরো অদ্ভুৎ কান্ড যেটা ঘটলো সেটা হচ্ছে, তার পোস্টে আরো দুজনকে ডাকা হয়েছে। তিনজন একই সারির পরপর তিনটা চেয়ারে তিনজন বসা। পর্যায়ক্রমেঃ নীল, লাল, হলুদ। ফার্মের কেউ একজন তাদের তিনজনকে ৩ টা খাম দিয়ে গেলো। এবং সাথে বলা হলো যে খামে ছোট একটা লাল কাগজ মিলবে তাকে এই পোস্টটা দেওয়া হবে। নাহিদ খামটা খোলার আগে ওর বাম ও ডানে বসা দু’জনের খামের দিকে চোখ বুলালো। ফলাফলঃ তারা নিরাশ। তার খামেই যে কাগজটা আছে তা বুঝতে আর বাকি রইলো না। চরম উত্তেজনায় লোকটার কাছে কাগজ সহ খামটা ফিরিয়ে দিলো। ‘কংগ্রাচুলেশনস, ইউ আর জয়েনিং ফ্রম টুমরো।’ পেছন ফিরে দেখলো বাকি দুইজন লোক নেই। এক মিনিটে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। এবার পাশের করিডোর এ দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো নাহিদ। গ্যাসলাইটে আগুন জ্বালালো, সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎটাও চলে গেলো। ধারাম করে একটা শব্দ, নিজেকে আবিষ্কার করলো মেঝেতে। পেছনে সেই দুজন। ঝাপসা চোখে দু’জন কে চারজন দেখাচ্ছে। হাতে রডের মত কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে আরেকটা বারি দিলো ঠিক বুকের উপর। এবার তার হাত-পা, চোখ বেধে একটা বস্তায় ভরে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নাহিদ সব ভেতর থেকে সব টের পাচ্ছে কিন্তু ওর মুখ থেকে এক ফোঁটাও শব্দ বের করতে পারছে না। এ কেমন ধূম্রজাল এ পড়েছে ও? বারবার নিজের কাছে প্রশ্ন ছুড়ছে। হঠাৎ ভেতর থেকে রুক্ষ কন্ঠস্বর ভাসছে। ‘মালডারে এই পঁচা ডোবায় ফালায় দে। হালায় আমাগোর চাকরি খাইয়া ফালাইসে। ফালা অরে।’
নাহিদের হৃদ স্পন্দন শঙ্কিত অবস্থায়। মাছ হয়ে ভেসে না ওঠার করুণ আকুতি মিনতি জানাচ্ছে। হাতুড়ি পেটানোর মত করে ভারী কিছু বুকের উপর চেপে রাখা হয়েছে। উঠতে পারছে না। উঠতে গেলে আরো চেপে ধরছে। হঠাৎ তীব্র বজ্রপাতের সাথে বৃষ্টি শুরু হলো, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা চোখের কাপড়কে আরো পুরু করে দিলো। অদ্ভুত এক অদৃশ্য শক্তি এসে কাপড়ের গিট আলগা করে দিতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো তার ঘরের মেঝেতে। ঘামে ভেজা সমস্ত শরীর হাঁসফাঁস করছে।সেমিকোলন এর মত দীর্ঘ এক শ্বাস নিলো। আশেপাশে কেউ নেই। রান্নাঘর থেকে প্রেশার কুকারের উইসেল এর শব্দ আসছে।
এতক্ষণ যা যা ঘটেছে তার সবই কি স্বপ্ন দেখেছে নাহিদ? স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন এবং সে স্বপ্নের ভেতরেও স্বপ্ন! নিজের গায়ে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো ঝড় থেমে গিয়েছে।
Shoroli Shilon's Blog
- Shoroli Shilon's profile
- 8 followers
