Hamida Mubasshera's Blog, page 2
April 8, 2022
অনুতাপ

১.
ঘুমঘুম চোখ মেলে চাইতেই ট্রে হাতে আরিফকে রুমে ঢুকতে দেখলো সায়মা। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে আৎকে উঠে বললো-“সরি !কখন যে এত বেলা হয়ে গেছে, টেরই পাইনি”!
“তাতে কী!আজ আমিই নাস্তা বানিয়ে এনেছি,দেখো!” দু’গাল প্রশস্ত করে বিশ্বজয়ের হাসি হেসে বললো আরিফ।
সায়মাকে ঘুমোতে দেখে সকাল সকাল নিজেই পরোটা, সবজি ভাজি আর গরম চা করে নিয়ে এসেছে। সায়মা ফ্রেশ হয়ে এলে দু’জন নাস্তা করতে বসলো।আরিফ রান্নাবান্নায় তেমন পটু নয়।তবু আজ তার রান্নার প্রশংসা না করলে পারলো না সায়মা।
খেতে খেতেই বললো, “বাহ!বেশ মজা হয়েছে তো! পরোটা-সবজি একদম পারফেক্ট।”
আরিফ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,“সত্যি! ভালো লেগেছে? এখন থেকে কিন্তু ইউটিউব দেখে নতুন নতুন রেসিপি বানিয়ে তোমাকে খাওয়াবো।খাদেমা খালা নেই,আমিও যেহেতু ঘরে আছি ,তোমাকে হেল্প করবো।”
“বাব্বাহ! এতো ভালো হলে কবে থেকে? “ফোঁড়ন কাটল সায়মা।
আরিফ হেসে বললো, “ঘরের কাজে সাহায্য করা নবীজীর সুন্নাহ। সুন্নাহ পালন করব। আর ডাক্তার তো বলেছেই,তোমাকে কিছু দিন বেড রেস্ট নিতে! তাই আমি থাকতে কোন প্যারা নিও না!
আরিফের কথা শুনে ভালো লাগে সায়মার। তার এতদিনের ক্ষোভ ছিল আরিফ ঘরের কোন কাজে হাত লাগায় না। এ নিয়ে দুজনের মনোমালিন্যও কম হতো না। আজ সে নিজে থেকেই এসব কথা বলায় সায়মা খুব খুশি হল।
২.
নাস্তা শেষে এঁটো প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই সায়মার প্রফুল্ল মন নিমিষেই বিষিয়ে গেলো! সামান্ এটুকু কাজ করতে যেয়ে আরিফ যেন রান্নাঘরের সেটআপ টাই চেইঞ্জ করে ফেলেছে! মেঝেতে আটার গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে,সবজির ছোকলা যেখানে সেখানে পড়ে আছে,মসলার বৈয়ামগুলো ওলট-পালট করে রাখা ,মিটসেফের এক একটা তাকে গুছিয়ে রাখা জিনিস সব এলোমেলো! চেঁচিয়ে আরিফকে ডাকতে যেয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলো সায়মা। বেচারা এত শখ করে করেছে..ভেবে শান্ত হয়ে সব পরিষ্কার করা শুরু করলো সে।
৩.
মাছওয়ালার আওয়াজ পেয়ে আরিফ সায়মাকে ভীতকণ্ঠে বললো, “বউ,আধা কেজি ছোট মাছ নিয়ে আসি?”
সায়মা তেড়ে উঠে ,“পাগল! এসব কুটবে কে ? আমার শরীরটাও খারাপ লাগছে! –
“আররে! আমি আছি তো ,টেনশন নাও কেন? নিয়ে আসি, প্লিজ? _
“ওকে। তুমি কুটতে পারলে আনো,আমি কিন্তু পারবো না।”
ঘরের বাকি কাজ গুছিয়ে নিয়ে আরিফের ছোট মাছ কুটা দেখতে এলো সায়মা।দেখে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না । ছুরি দিয়ে পুঁটি মাছ কাটতে যেয়ে মাছের ভর্তা বানাচ্ছে আরিফ! –
“এভাবে কেউ মাছ কুটে? হয়েছে,আর কাজ দেখাতে হবে না।.জানতাম আমাকেই সব করতে হবে! চোখ রাঙ্গিয়ে বললো সে।
বাধ্য ছেলের মত হাত পরষ্কার করে গুটিগুটি পায়ে রুমে চলে গেলো আরিফ।তাকে বকতে বকতেই মাছ কুটতে বসলো সায়মা।
.
৪.
দিনদিন আরিফের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে সায়মা। তার কথা হলো,আরিফ কাজের চেয়ে অকাজ করে বেশি।গুছিয়ে কিছুই করতে জানে না!উল্টো সায়মার কষ্ট বাড়ে।সেদিন সাদা মশারিটা আরিফ ধুয়ে দিলো,যেমন কালো ময়লা ছিল তেমনই রয়ে গেছে।হাড়ি-পাতিলসহ যা-ই সে ধোয়,সব আবার সায়মাকে পরিষ্কার করতে হয়।রান্নাঘরে আরিফকে এখন আর সহ্যই করতে পারছে না ও।
এদিকে আরিফের কথা হলো,সায়মার শরীর খারাপ থাকে,সেজন্যইতো হেল্প করে।সে জানে এসময় মুড সুইং একটু বেশিই হয়।তাই বকাবাদ্যিগুলো কানে নেয় না।আরিফের ধারণা সে চমৎকার কাজ পারে,সায়মা একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের হওয়ায় পছন্দ করে না! তবে আজকে সায়মা এসব নিয়ে অনেক বকাঝকা করেছে তাকে।আরিফ তাই মন খারাপ করে ড্রইংরুমে আশ্রয় নিয়েছে।সে বুঝতে পারছে না তার ভুলটা কোথায়!এতদিন সায়মার অভিযোগ ছিল সাহায্য করে না দেখে আর আজ যখন করছে তাতেও তার সমস্যা!
৫.
মায়ের কাছে আরিফের নামে অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো বকা খেল সায়মা। মা বললেন,“ আরিফ তো একমাত্র ছেলে, ঘরে মা-বোন থাকায় ছোটবেলা থেকে ঘরের কোনো কাজ করতে হয়নি।
এখন যে বড়বেলায় অনভ্যস্ত হাতে তোকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে তাতে তো তোর খুশি হওয়ার কথা!!
তুই ওর ভুলগুলোকে হাইলাইট না করে ওকে উৎসাহ দে, সুন্দর করে বুঝিয়ে বল, দেখবি আস্তে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। অবুঝের মতো রাগারাগি করিস না,মা।”
মায়ের কথাগুলো শুনে অনুতাপবোধে আচ্ছন্ন হলো সায়মা। আসলেই তা এভাবে ভেবে দেখেনি ও।
৬.
ড্রইংরুমে এসে সায়মা দেখলো আরিফ ঘুমিয়ে পড়েছে । সোফায় বসে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হলো সায়মার! ধীরে ধীরে মনে পড়লো অতীতের স্মৃতি। প্রথম গ্রাম থেকে যখন শহরে এসছিল তখন!কত বোকা বোকা প্রশ্ন করতো সায়মা। অথচ আরিফ একটুও বিরক্ত না হয়ে হাসিমুখে সব উত্তর দিত। লিফটের ম্যাকানিজম শেখা,শপিং মলের এক্সিলেটর ব্যবহার করা, ব্যস্ত রাস্তা পার হওয়া,ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেওয়া, এটিএম কার্ড এর ব্যবহারশিখিয়ে দেওয়া-এমনই কত ছোট বড় কাজে সে যখন আনাড়ি ছিল,আরিফ কখনো সেসব নিয়ে ব্যাকডেটেড বলে বিদ্রুপ করেনি,বরং সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে।এখনো বাহিরের কত কাজেই আরিফকে পাশে প্রয়োজন হয়…এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের আচরণের জন্য প্রচন্ড অনুশোচনা হলো সায়মার।নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু নামলো।
“এই বউ! কি হয়েছে ? কাঁদছো কেন ? “আরিফের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো সায়মা।
বিব্রত হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো, “তুমি না ঘুমাচ্ছিলে?”
“আরে নাহ! ঘুমের ভান ধরে দেখছিলাম আমার বউটা কি করে! “দুষ্টুমির স্বরে বললো আরিফ।
“আমি সরি”—বলতেই গলাটা ধরে এলো সায়মার।
আরিফ শোয়া থেকে উঠে সায়মার চোখ মুছে দিতে দিতে বললো, “হয়েছে ,এখন আর শোক পালন করো না। বাইরে দেখেছো কী সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে!! খিচুড়ি-ইলিশ রান্না করে তোমাকে খাওয়াতে চাই,মহারানীর অনুমতি কি মিলবে?”
অশ্রুসজল চোখে হেসে ফেলে সায়মা। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
বিষমবাহু ত্রিভূজ

দৃশ্যপট-১
রুনা একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় ‘নারীর অধিকার ‘ নিয়ে কাজ করতো। শিক্ষাজীবন থেকেই তার স্বপ্ন ছিল সমাজের নির্যাতিত নারীদের জন্য কিছু একটা করবে সে।। পড়াশোনা শেষে তাই সে তার পছন্দের পেশায় যোগ দেয়। দুই বছর বেশ আনন্দ নিয়েই কাজ করছিল রুনা। এর মধ্যে ওর ফেসবুকে পরিচয় হয় ব্যবসায়ী মারুফের সাথে। আধুনিকমনস্ক মারুফ কথা দিয়েছিল ,বিয়ের পরও চাকুরী করতে কোন সমস্যা হবে না রুনার। তাই পারিবারিক সম্মতি নিয়ে বিয়ে করে ওরা। বিয়ের পর চাকুরী, সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু বিয়ের দুই বছরের মাথায় রুনা যখন সন্তানের মা হয় তখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় সে। ওদের অফিসে ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। এদিকে রুনা’র মা নিজেই চাকুরীজীবী, দীর্ঘদিনের চাকুরীজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন, এখন চকিুরী ছাড়ার সুযোগ নেই।। রুনার নিজের শ্বাশুড়ীও বেঁচে নেই। গৃহকর্মীর কাছে বাচ্চা রেখে বড় করলে সেই বাচ্চার সুস্থ মানসিক গঠন কতটা ব্যহত হয় কলিগদের কাছে এরকম উদাহরণ বহুবার শুনেছে সে। তাই সব দিক বিবেচনা করে সন্তানের স্বার্থে চাকুরীটা ছেড়েই দিল রুনা। নারী হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য দুজন নারীর (মা এবং মেয়ে) অধিকার হরণ করতে চাইল না সে । বরং নিজে আত্মত্যাগ করে নিজের ক্যারিয়ারটা বিসর্জন দিল।
এরপর আট বছর কেটে গেছে। রুনার সন্তান এখন স্কুলে যায়। সন্তানকে একাডেমিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত শিক্ষা সব নিজেই দেয় রুনা। চেষ্টা করছে নিজের শিক্ষিত হওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সন্তানকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। এর মধ্যে রুনার ছোট বোন মিনা ডাক্তারী পাশ করে একটি হাসপাতালে জয়েন করেছে। ডাক্তার হয়ে সে চায় মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে নারীদের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখতে। কিন্তু বিয়ের পর মিনা নিজেই এখন সন্তানসম্ভবা। ওর স্বামী নিজেও ডাক্তার। শ্বাশুড়ি থাকেন গ্রামে, রুনা-মিনার মা’র বয়স হয়েছে। ছোট বাচ্চার সার্বক্ষণিক যত্ন নেয়ার অবস্থা নেই তার। এই অবস্থায় ক্যারিয়ার না সন্তান কোনটাকে বেছে নিবে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে মিনা।
বোনের এই অবস্থা দেখে নিজের আট বছর আগের কথা মনে পড়ে যায় রুনার। ও নিজেও তো এরকম দোটানায় পড়ে নিজের ক্যারিয়ারটাকে বিসর্জন দিয়েছিল। আজ ছোট বোনও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন । কিন্তু ও চায় না বোনের জীবনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। তাই বোনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল রুনা। বোনকে বলল, “তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোর বাচ্চার দেখাশোনা আমি করবো। আমার বাচ্চা তো এখন মোটামুটি বড় হয়ে গেছে। আমার বিল্ডিং এ তোর জন্য বাসা দেখবো। একই বিল্ডিং এ থাকলে তোর বেবিকে আমার কাছে রেখে নিশ্চিন্তে হসপিটালে যেতে পারবি ,তোর সার্ভিস পেয়ে সমাজের অনেক নারীও উপকৃত হবে।”
বড় বোনের কাছ থেকে এই আশ্বাস পেয়ে মিনার বুক থেকে যেন দুশ্চিন্তার একটি ভারী পাথর নেমে গেল! মা চাকুরীজীবী হওয়ার সুবাদে এই বড় বোনের তদারকিতেই বড় হয়েছে সে, বিয়ের আগ পযন্ত বোনই ছিল তার সকল ভরসার জায়গা। তাই বোন যখন তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে রাজী হয়েছে তখন আর কোন চিন্তা নেই ওর। আপু যে নিজের সন্তানের মতোই যত্ন করবে ওর সন্তানেরও এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই মিনার। নিশ্চিন্তে তাই একটা ঘুম দিল ও। এদিকে ছোট বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুনা ভাবল, “ ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয়ার যে কি কষ্ট তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমি না পারলেও আমার বোন যেন পারে তার কাজ দিয়ে সমাজের জন্য অবদান রাখতে।”
দৃশ্যপট-২
স্বামী, দুই সন্তান আর বিধবা শ্বাশুড়িকে নিয়ে ইরার সুখের সংসার। ইরার স্বামী জনি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকুরী করে। দেশের একটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো একটি বিষয়ে মাস্টার্স করলেও ইচ্ছা করেই চাকুরি করেনি ইরা। নিজের শিক্ষাকে সুসন্তান তৈরিতে কাজে লাগাবে এটাই ইচ্ছে ছিল ওর। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জনি হঠাৎ অফিসে ব্রেন স্ট্রোক করলো। অফিসের সহকর্মীরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের এক পাশ প্যারালাইসিস হয়ে গেল জনির। এক মাস থাকার পর হাসপাতাল থেকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হলো জনিকে। সপ্তাহে দু’দিন রেগুলার ফিজিওথেরাপি করাতে হবে, তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে আবার সুস্থ হবে জনি। কিন্তু সেজন্য ঠিক কতদিন লাগতে পারে এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারল না ডাক্তাররা।
এভাবে প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দেয়ার ফলে জনির শারীরিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো। বিছানায় শুয়ে থাকলেও কথা বলতে পারে, হাত-পা নাড়াতে পারে। তবে সুস্থ হয়ে আবার কবে অফিসে যেতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। এদিকে ছয় মাস যাবৎ চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে জমানো টাকা সব শেষ। চাকুরীটা থাকলেও অফিসে জয়েন না করা পর্যন্ত আর বেতন পাবে না জনি। সংসারের নিয়মিত খরচ, জনির চিকিৎসার খরচ কিভাবে চালাবে এই চিন্তায় দিশেহারা হয়ে গেল ইরা। আত্মীয়, বন্ধুদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীর জন্য CV দেয়া শুরু করল সে। অভিজ্ঞতা নাই বলে entry level এ চাকুরী করতেও সমস্যা নেই এটা CV তে উল্লেখ করল সে। অবশেষে ছাত্রজীবনের এক বান্ধবীর সহায়তায় ওর অফিসেই কাজ পেল ইরা। বেতন যদিও আশানুরূপ নয়, তবু বিপদের দিনে এখন এটাই ভরসা।
চাকুরী শুরু করার পর জীবনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো ইরা। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া- আসার পথে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করা, রাস্তায় যানজটে সময় নষ্ট, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বসের কাছে নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দেয়া, পুরুষ সহকর্মীদের অতিরিক্ত সহানুভূতিকে উপেক্ষা করা , নারী সহকর্মীদের মেয়েলী গল্পের সাথে তাল মিলাতে না পারা —এরকম বহুমুখী সমস্যার সাথে মোকাবেলা করতে করতে ইরা ইদানীং অনুভব করে , ঘরে ছিল বলে বাইরের কর্মজীবনের কত বিচিত্র রূপ এতদিন অজানা ছিল ওর কাছে! জীবনের রূঢ় বাস্তবতা আজ তাকে বুঝিয়েছে,চাকুরি মানে শুধু ক্যারিয়ার বা অর্থ উপার্জন নয় বরং অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও থাকতে হয় একজন কর্মজীবী নারীকে। প্রতিদিনের দৌড়-ঝাঁপে ক্লান্ত ইরা তাই মাঝে মাঝেই ভাবে, নিজের সাজানো সংসারে ঘরকন্না করে এতদিন কতই না ভালো ছিল সে। নিজের বস ছিল সে নিজেই। নিজের বানানো রুটিনে স্বাধীনভাবে নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারত সে। পুরনো সেই সুখী দিনগুলোর কথা ভেবে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর।
দৃশ্যপট-৩
মারিয়া ও ফয়সাল আপাতদৃষ্টিতে একটি সুখী দম্পতি। তবে বিয়ের ১০ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও কোনো সন্তান হয়নি ওদের। দেশে-বিদেশে বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হয়নি। দুজনের কারোরই কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলেও কেন সন্তান হচ্ছে না এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি ডাক্তাররা। এখন আল্লাহর কাছে দুআ করাটাই একমাত্র চিকিৎসা ওদের জন্য।
ফয়সাল নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে রাতঅবধি ব্যস্ত থাকে। এদিকে দুপুরের পর থেকে তেমন কোন কাজই থাকে না মারিয়ার। দুজনের সংসারের অল্প কাজগুলো শেষ হয়ে গেলে দিনের বাকীটা সময় যেন কাটতেই চায় না। বিকেল বেলা বারান্দায় একা বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রাস্তার অপর পাড়ের বস্তির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোর খেলা দেখে ও । খেলতে খেলতে প্রায়ই মারামারি করে ওরা আর সাথে চলে অসভ্য ভাষায় গালাগালি। এত অল্প বয়সেই এত বাজে ভাষা কোথায় শেখে ওরা ভেবে অবাক হয়ে যায় মারিয়া। অবশ্য ওদেরই বা দোষ কোথায়? ওদের অধিকাংশের বাবাই হয় রিক্সা চালক বা দিনমজুর । আর মায়েরা হয় গার্মেন্টসে না হয় ছুটা বুয়ার কাজ করে বিভিন্ন বাসায়। সারদিন জীবিকার সন্ধানে ছুটতে থাকা এই বাবা-মা গুলোর সময় কোথায় ওদের সুশিক্ষা দেয়ার!! সারাদিন নোংরা পোশাক, উস্কখুস্ক চুলে ঘুরতে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর শৈশব তাই কেটে যাচ্ছে সুশিক্ষার স্পর্শ ছাড়াই। বড় হয়ে এরাও হয়তো আবার এসব পেশাই বেছে নিবে, এভাবে শিক্ষাহীন দারিদ্রের বৃত্তে আবর্তিত হতে থাকবে ওদের জীবন!!
সেদিন রাতে ফয়সালের সাথে এই বিষয়টা নিয়েই আলাপ করছিল মারিয়া। আফসোস করে বলছিল, “আমার হাতে অফুরন্ত সময় অথচ বস্তির ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখার কেউ নাই।“ ফয়সাল তখন বলল, “তুমি তো চাইলেই পারো তোমার উদ্বৃত্ত সময়টাকে ওদের জন্য কাজে লাগাতে। দেখো, তোমার জন্য এই বাড়তি সময়টা আল্লাহর একটা নিয়ামত। তোমার উচিত এই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। তুমি বিকাল বেলা এই ছেলে-মেয়ে গুলোকে পড়াও ।আমাদের ছুটা বুয়াও তো ঐ বস্তিতেই থাকে, বুয়াকে বলে বুয়ার মেয়েটাকে পাঠাতে বলো , সাথে অন্য বাচ্চার বাবা-মা দেরও রাজি করার দায়িত্ব বুয়াকেই দাও। ফয়সালের কথায় যেন নতুন এক আলোর দিশা পেল মারিয়া ।
এখন মারিয়ার বিকেলগুলো দারুণ কাটে । বস্তির প্রায় দশ টা ছেলে-মেয়ে বিকেল বেলা পড়তে আসে ওর কাছে।সপ্তাহে দুই দিন আরবি, একদিন ড্রয়িং আর বাকি তিন দিন অন্যান্য বিষয় পড়ায় ওদের। বাচ্চাদের সবাইকে একই রকমের ড্রেস ,জুতা আর বই, খাতা, কলম কিনে দিয়েছে মারিয়া। সবাইকে বলে দিয়েছে পরিষ্কার- পরিছন্ন হয়ে আসতে হবে আর শুদ্ধ ভাষায়ে কথা বলতে হবে। গেস্ট রুম টাকে ক্লাস রুম এর মতো সাজিয়ে নিয়েছে । প্রতিদিন বিকেলে বাচ্চাগুলো যখন একসাথে পরিপাটি হয়ে বসে পড়ে তখন মনে হয় ওর ঘরটা যেন এক টুকরো বাগান হয়ে গেছে। তবে সেই বাগানের ফুলগুলোর মাঝে নিজের একটা ফুল নেই ভেবে মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়া ।
উপরের ঘটনাগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রের নারীদের কেউ হোমমেকার ( রুনা), কেউ কর্মজীবী (ইরা) কেউ বা সমাজকর্মী ( মারিয়া) । আর এই তিন ধরনের নারীর অবদানই কিন্তু সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ যদি হয় একটি ত্রিভূজ তবে এই তিন role এর নারীরা হলেন সমাজের তিনটি বাহু। হয়তো বিষমবাহু ত্রিভূজের মতো সব বাহুর দৈর্ঘ্য সমান নয় অর্থ্যাৎ সব role এর নারীদের কর্মের মূল্যায়ন
( আর্থিকভাবে বা মর্যাদার দিক দিয়ে) সমাজে সমানভাবে করা হয় না তবু এই তিন ভূমিকার নারীরা যার যার অবস্থানে কাজ করছেন বলেই কিন্তু সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
কেউ ঘরে থেকে সংসার সামলাচ্ছে বলেই কেউ তার সহায়তায় বাইরে কাজ করছে , কেউ বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জন করছে বলেই সেই অর্থ দিয়ে কারও সংসার চলছে আবার কেউ “ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে’ অর্থ্যাৎ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে বলেই তার দ্বারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো উপকৃত হচ্ছে। তাই নারীরা যে যেই role paly করুক না কেন তাদের উচিত নিজের কাজকে নিজে সম্মান করা এবং নিজের অবস্থানের জন্য দীর্ঘশ্বাস না ফেলে সর্বাবস্থাতেই আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। সব নারীরই মনে রাখা দরকার যে, Allah is the best planner and he has designed everyone’s individual life in the best possible way .May be his design is beyond our understanding, but our best goodness lies in this design.
তাছাড়া এই পৃথিবীটা তো সবার জন্য একটি পরীক্ষাকেন্দ্র মাত্র। পরীক্ষার হলে যেমন কেউ science ,কেউ arts , কেউ বা commerce এর প্রশ্নে পরীক্ষা দেয় তেমনি মহান আল্লাহ তায়ালাও এই পৃথিবীতে নারীদের এক একজনকে এক এক role play করতে দিয়ে পরীক্ষা করেন। তাই আমাদের উচিত প্রশ্নপত্র যেই বিভাগেরই হোক না কেন ,সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করে যাওয়া । অর্থ্যাৎ ইহকালে আমাদের পরিচয় (হোমমেকার , কর্মজীবী বা সমাজকর্মী ) যাই হোক না কেন পরকালে আমাদের পরিচয় যেন হয় একটাই—‘জান্নাতী নারী’ সেই চেষ্টা করে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে আমাদের রোল মডেল হতে পারেন ফাতিমা (রা:), কিংবা খাদিজা (রা:) কিংবা আয়েশা (রা;)। ইহকালে উনাদের সবার role একরকম না থাকলেও পরকালে উনারা সবাই যে জান্নাতী হবেন তা তো আমরা সবাই জানি।
তাই সব নারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সবার উচিত দুনিয়াবী এবং ইসলামিক উভয় ধরনের শিক্ষায় নূন্যতম দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে জীবনের যে কোনও বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা। দুনিয়াবী শিক্ষা যেমন নারীকে যুগোপযোগী পরবর্তী প্রজন্ম তৈরিতে / অর্থ উপার্জনে কিংবা অন্যের কল্যাণ সাধনে সহায়তা করবে তেমনি ইসলামিক জ্ঞান তাকে শেখাবে ঘরে কিংবা বাইরে যেখানেই কাজ করুক না কেন কিভাবে একজন নারী ধর্মীয় অনুশাসন মেনে এবং নিয়্যত পরিশুদ্ধ রেখে কাজ করে তার ইহকালীন কাজগুলোকেও ইবাদতে পরিণত করতে পারে। এভাবে একজন নারী দুনিয়াবী এবং ইসলামিক উভয় ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রস্তুত রাখলে ভাগ্যের গতিপথ তাকে জীবনের যে মোড়ে এনেই দাঁড় করাক না কেন,সে পথ হারিয়ে না ফেলে বরং ঘুরে দাঁড়াবে এবং একসময় চূড়ান্ত গন্তব্যে পোঁছাতে পারবে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইহকালে নিজ নিজ ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করার এবং এই কাজগুলোর উসিলায় পরকালে জান্নাত লাভ করার তৌফিক দিন। আমিন।
দৃষ্টির অন্তরালে

ভূমিকা:
প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইহকালের জীবন একটি পরীক্ষা মাত্র। এই পরীক্ষার পারফম্যান্সের উপর নির্ভর করে পরকালের জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা।। পরীক্ষার সময় যেমন বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় তেমনি মহান আল্লাহতায়ালাও ইহকালের জীবনে মুসলিমদের বিভিন্ন সমস্যায় নিপতিত করে পরীক্ষা নেন। কাউকে রোগ-ব্যাধি, কাউকে চাকুরি বা ব্যবসা ক্ষেত্রে বিফলতা, কাউকে সন্তানহীনতা, কাউকে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি– এরকম বহুবিধ সমস্যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের ঈমান পরীক্ষা করেন ।
আমরা যদি নবী-রাসূলদের জীবনী পড়ি তবে দেখতে পাবো যে, তাঁরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া স্বত্তেও তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর তাঁরা মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল রেখে , ধৈর্য্য ধরে আ্ল্লাহর কাছে দুআ করেছেন। আল্লাহর কাছেই সমস্যা সমাধানের জন্য ইবাদতের মাধ্যমে নিজেদের সমপর্ণ করেছেন।অথচ বর্তমান যুগের অস্থির সময়ে আমরা যে কোনো সমস্যায় পড়লে বিচলিত হয়ে যাই, তা থেকে দ্রুত উদ্ধার পাওয়ার জন্য শর্টকাট উপায় খুঁজতে থাকি। নিজেরা দুআ ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো সময় ও মানসিকতা আমাদের নেই। সেই সাথে রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক ইসলামিক জ্ঞানের অভাব এবং শয়তানের প্ররোচনা।
আর এসব কিছুর ফলাফল হলো এই যে——পরীক্ষার প্রশ্ন যিনি করেছেন , যথাসময়ে সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান প্রদানের মালিকও তিনি’- এই সহজ সমীকরণে না গিয়ে আমরা পরীক্ষক ও পরীক্ষার্থীর মাঝে তথা মহান আল্লাহ ও বান্দার মাঝে ‘মিডিয়াম বা মাধ্যমের’ অনুপ্রবেশ ঘটাই। এই মিডিয়াম বা মাধ্যম হলো কখনও পীর, হুজুর, কখনও কবিরাজ, কখনও তান্ত্রিক, কখনও মেডিটেশনকারী কখনও বা জ্যোতিষি প্রভৃতি প্রভৃতি……..। আমাদের দুর্বল ইমান এবং কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এসব তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা কখনও আমাদের অতীত বা বর্তমানের অজানা তথ্য দিয়ে চমকে দেন, কখনও অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে তথ্য দিয়ে অভিভূত করেন। কখনও বা সাময়িকভাবে সমস্যা থেকে মুক্ত করে এমন বিশ্বস্ততা অর্জন করেন যে পরবর্তীতে জীবনের যে কোনো সমস্যায় পরলে আবার সেই তাদের কাছেই ফিরে অদৃশ্য আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর এ সব ধরনের কাজই তারা করেন গোপন বা অপ্রকাশ্য উপায় ও উপকরণ ব্যবহার করে।
কি সেই গোপন পদ্ধতি?
কি ঘটে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে?
আদৌ কি তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে?
কিভাবে তারা অপরিচিত ব্যক্তিদের অতীত বা বর্তমান বলে দিতে পারেন?
কিভাবে তাদের বলা ভবিষ্যত বাণী অনেক সময় সত্য হয়ে যায়?
এসব ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য কি?
‘দৃষ্টির অন্তরালে’ সিরিজে আমরা এই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করবো।
পর্ব- ১
প্রায় ১৫ বছর পর বিদেশ থেকে গ্রামে ফিরেছে হায়দার। বিগত বছরগুলোতে গ্রামের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে দেখে বেশ ভালো লাগছে ওর। রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ বেড়েছে, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট তৈরি হয়েছে, গ্রামের অধিকাংশ শিশুই স্কুলে যায়, বাল্যবিবাহ কমেছে, নবজাতক শিশু ও প্রসূতি মায়ের মৃত্যুও কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন বোধহয় হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। গ্রামের তরুণদের হাতে হাতে মোবাইল, তাতে আবার ইন্টারনেট সংযোগ। সারা বিশ্বের সাথে তাদের কানেকশনের প্রভাব তাদের পোশাকের ডিজাইন, চুলের কাটিং, চালচলন আর কথার ফাঁকের শব্দচয়নে স্পষ্ট ।
যাক, গ্রামটা তাহলে সবদিক দিয়েই অনেক এগিয়ে গেছে। বিদেশে আর ফিরে না গিয়ে এবার দেশেই থেকে যাবে কিনা ভাবছিল হায়দার। বাজারের মধ্যে চায়ের দোকানে বসে পুরনো বন্ধুদের সাথে এই বিষয় নিয়েই আলাপ করছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলো নারী, পুরুষ, শিশু, তরুণ, বৃদ্ধের একটি দল বিভিন্ন সাইজের বোতল হাতে নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তের দিকে ছুটছে।
“কি ব্যাপার, সবাই এভাবে বোতল হাতে কোথায় যাচ্ছে?” অবাক কন্ঠে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল হায়দার।
সুজন নামে ওর এক বন্ধু বলল, “গ্রামের শেষ প্রান্তে পুরানো বট গাছের নিচে একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি এসেছেন ১৫ দিন আগে। তার কাছেই যাচ্ছে সবাই। উনার ফুঁ দেয়া পানি খেলে সবরকম সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই বোতল নিয়ে যাচ্ছে ফুঁ দেয়া পানি নিতে।”
“অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি!!!! ধুর কি যে বলিস তোরা? এই যুগে আবার কেউ এসব বিশ্বাস করে নাকি? গ্রামের অবকাঠামোর এত উন্নতি হলেও তোদের মন-মানসিকতার কোনোই পরিবর্তন হয়নি দেখছি।” ব্যঙ্গ করে বলল, হায়দার।
মিলন নামের আরেক বন্ধু বলল, “এসব উন্নয়নের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সম্পর্ক বের করতে চাইছিস কেন তুই? উনি আল্লাহর অনেক বড় ওলী। উনার যা ধর্মীয় জ্ঞান আছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তা আছে নাকি? উনার উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে বলেই তো উনি অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন এবং এমন সব সমস্যার সমাধান দিতে পারেন যা এত বছর কেউ পারেনি।”
“কী এমন অলৌকিক ক্ষমতা আছে উনার ??” অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরেই জানতে চাইল হায়দার।
সুজন উৎসাহের সাথে বলল, “উনি শূণ্যে ভেসে থাকতে পারেন ,পাথরকে স্বর্ণে পরিণত করতে পারেন……আরও এমন অনেক কিছু। উনার এসব অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলেই তো গ্রামের মানুষ উনার কাছে যাচ্ছে । শুনেছি সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে উনার জন্য একটা ভালো থাকার ব্যবস্থাও করে দিবে যেন উনি এই এলাকাতেই রয়ে যান।”
“আসলে তুই-ই অনেকদিন বিদেশে থেকে নাস্তিক হয়ে গেছিস, তাই উনাকে অবিশ্বাস করছিস। ”মিলন বলল হায়দারকে উদ্দেশ্য করে।
আর হায়দার মনে মনে ভাবতে লাগলো, আসলেই কি ঐ ওলীর অলৌকিক ক্ষমতা আছে ? নাকি লোক ঠকানোর জন্য স্রেফ ভাওতাবাজি ? কিন্তু এই ধোঁকাবাজিটাই বা সে করছে কিভাবে? এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর খঁুজে পেল না হায়দার।
উপরের কাহিনীর হায়দার ও তার বন্ধুদের মতো আমরাও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যাপারে দুটি প্রান্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হই। একদল অন্ধভাবে তাদের বিশ্বাস করে তাদের মাধ্যমে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই ,আরেক দল তাদের সবকিছুই ধোঁকাবাজি, কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চাই।
অথচ সত্যিটা হল –এসব তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ লেভেলে গিয়ে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে– ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বরং এসব কিছুই তারা করে জ্বীনদের সাহায্য নিয়ে।
সমস্যা হচ্ছে আমরা অনেকেই মুসলিম হওয়া স্বত্ত্বেও জ্বীনের অস্তিত্বের বিষয়টা ভুত-প্রেতের সাথে মিলিয়ে ফেলি এবং এগুলোকেও কুসংস্কার বা অবৈজ্ঞানিক হিসেবে অস্বীকার করে বসি। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে জ্বীনজগতে বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অংশ, কারণ পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বহু জায়গায় এদের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে সবার প্রথমে বলা যায় সূরা নাসের কথা। ছোট্ট এই সূরাটি আমাদের অধিকাংশের হয়তো মুখস্থ আছে, নিয়মিত নামাযে পড়েও থাকি হয়তো বা। কিন্তু অর্থ না বুঝে পড়ি বলে জানিও না যে এখানে আল্লাহ আমাদেরকে আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন কুমন্ত্রণা দানকারী মানুষ ও জ্বীনের অনিষ্ট থেকে! সুতরাং জ্বীনদের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
হাদীস ও কুরআন থেকে আমরা জ্বীনদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও জানতে পারি। যেমন- তারা দ্রততম সময়ে অধিক দুরত্ব অতিক্রম করতে পারে (২৭:৩৯-৪০), বিবিধ রূপ ধারণ করতে পারে, মানুষের ধমনীর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ তাদেরকে তাদের মূল আকৃতিতে দেখতে না পেলেও তারা মানুষকে দেখতে পারে(৭:২৭)।
জ্বীনদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়েই তথাকথিত অলৌকিক ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। একটা খুব সাধারণ উদাহরণ হলো- কেউ শূন্যের উপর ভেসে আছে দেখে সাধারণ মানুষ হয়তো তাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভেবে অভিভূত হয় অথচ আসল ব্যাপারটা হচ্ছে তাকে সাহায্যকারী জ্বীন হয়তো তাকে হাত দিয়ে তুলে রেখেছে । যেহেতু জ্বীনদের মানুষ দেখতে পায় না তাই সাধারণ মানুষ সেই শূণ্যে ভাসতে সক্ষম মানুষটিকেই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ভেবে বিভ্রান্ত হয় । এভাবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে জ্বীনদের বিভিন্নমুখী সহায়তায় তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা তাদের বিশেষত্ব জাহির করে।
পর্ব-২
ফুয়াদ ও সীমান্ত একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। সহকর্মী হলেও সমবয়সী হওয়ায় ওদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতোই। ফুয়াদের বাবা দিন তিনেক আগে চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছেন। কিন্তু পৌঁছানোর পর থেকে কোনো রকম যোগাযোগ করেননি পরিবারের সাথে। বয়স্ক মানুষ প্রথমবার দেশের বাইরে একা গিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই ফুয়াদের পরিবার খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আজ সকালেও অফিসে বাবাকে নিয়ে টেনশনের কথা বলছিল ফুয়াদ।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সীমান্ত তাই একবার ফুয়াদকে ফোন দিল ওর বাবার খবর নেয়ার জন্য।
ফোন ধরার পর ফুয়াদের কন্ঠ অবশ্য নিশ্চিন্তই শোনা গেল। বলল,“কিছুক্ষণ আগে বাবার সাথে কথা হয়েছে। ফোনের সিম কিনতে দেরী হওয়ায় এই কয়দিন যোগাযোগ করতে পারেননি। ”
একথা শুনে সীমান্ত বললো, “যাক অবশেষে তোমাদের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। “
”হুম, তবে আমরা অবশ্য বাবার ফোন পাওয়ার আগে সন্ধ্যাবেলাতেই জানতে পেরেছিলাম বাবা নিরাপদে আছেন “ ফুয়াদের এই কথায় চমকে গেল সীমান্ত।
“কিভাবে, কার মাধ্যমে জানলে?” অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো সীমান্ত।
“আমার বাবার চাচাতো ভাই কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। উনি কমান্ড সেন্টারে বসে মেডিটেশন করে বাবার অবস্থান দেখতে পেয়েছেন, তারপর আমাদের জানিয়েছেন।” রহস্যময় কন্ঠে বলল ফুয়াদ।
“বাংলাদেশে বসে ভারতে তোমার বাবার অবস্থান বলেছেন, এটা কি আদৌ সম্ভব?” সীমান্তের কন্ঠে স্পষ্টতই অবিশ্বাসের সুর।
“যারা কোয়ন্টাম গ্রাজুয়েট হয়ে যান তারা আধ্যাত্মিকতার এমন পর্যায়ে পৌঁছে যান যে ,তারা তখন মেডিটেশনের মাধ্যমে যে কারও অতীত বা বর্তমানের দৃশ্য দেখতে পারেন। আমার চাচাও একজন কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। “ অনেকটা গর্বভরেই কথাগুলো বলল ফুয়াদ।
“অতীতও দেখতে পান? আমার অতীতও চাইলে দেখতে পারবেন তোমার চাচা ?” সীমান্ত জানতে চাইল।
“কিছু তথ্য যেমন তোমার নাম, মায়ের নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি জানালে অবশ্যই পারবেন। অথবা তোমার ছবি দিলেও কাজ হবে।” ফুয়াদের কন্ঠে যেন আত্মবিশ্বাস ঝরে পরছে।
আমার কোনো সিঙ্গেল ছবি তো নেই তোমার কাছে, সব অফিসের গ্রুপ ফটো। আমি বরং আমার তথ্যগুলো মেসেজ করে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি উনার কাছে জানতে চেয়ো তো আমার অতীতের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে। দেখি বলতে পারেন কিনা!!” সীমান্ত বলল।
“আচ্ছা, ফুয়াদ বললো, “রবিবার অফিসে এসে তোমাকে জানাবো তোমার অতীতের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা।”
রবিবার সকালে বেশ উত্তেজনা নিয়ে অফিসে গেল সীমান্ত। ফুয়াদের আসার অপেক্ষায় সময় যেন কাটতেই চাইছে না। অবশেষে ফুয়াদ এসে হাসিমুখে সীমান্তকে বললো, “৫বছর বয়সে নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিলে তুমি। তোমার মামা এসে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করায় সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলে । কি ঠিক বলেছি তো?”’
বিস্মিত সীমান্ত কোনো মতে বললো, “তোমার চাচা বলেছেন এই ঘটনা? ঘটনা তো আসলেই সত্যি!
ফুয়াদ আরও জানালো ওর চাচা নাকি বলেছেন, সীমান্ত ইদানীং খুব দুশ্চিন্তার মাঝে আছে। কারণটাও নাকি উনি জানতে পেরেছেন, তবে ফুয়াদকে তা বলেন নি।
একথা শুনে একদম চমকে গেলো সীমান্ত।
একটু তোঁতলানোর মত করে বলল, “ আ আ আমাকে না দেখে, না জেনে শুধু মেডিটেশন করেই এত কিছু বলে দিলেন!! স্বীকার করতেই হচ্ছে উনি অনেক বড় আধ্যাত্মিক ব্যক্তি।”
সেদিন সারা দিন অফিসে একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করলো সীমান্ত। বার বার ভাবতে লাগলো একবার কি যাবে নাকি ফুয়াদের চাচার কাছে? যদিও ট্র্যাডিশনাল পীর , হুজুরদের উপর আস্থা নেই ওর। তবে ফুয়াদের ফ্যামিলি তো শিক্ষিত, ওর চাচা একজন শিক্ষক। এমন কামেল একজন ব্যক্তিই তো ও খুঁজছিল এতদিন মনে মনে।
বেশ কদিন ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলো সীমান্ত, ফুয়াদের সাথে ওর চাচার কাছে যাবে একবার। বর্তমান ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে উনিই হয়তো ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন!
উপরোক্ত কাহিনীর চরিত্র সীমান্তের মতো আমরাও অনেক সময় কাউকে অতীতের ঘটনা বলে দিতে দেখলে কিংবা বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে খুঁজে দিতে দেখলে তার অলৌকিক ক্ষমতা আছে ভেবে চমৎকৃত হয়ে যাই। সেটা হতে পারে আয়না পরা, চাল পরা, বাটি চালান দেয়া, হিপনোটিজম কিংবা মেডিটেশন প্রভৃতি বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে। কিন্তু আসলে এসব অলৌকিক ঘটনার নেপথ্যের রহস্য কি?
কি ঘটে আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে?
বস্তুত: পৃথিবীতে কোনও মানুষেরই এমন কোন বিশেষ ক্ষমতা নেই যে, সে স্থান-কালের ঊর্দ্ধে যেতে পারে এবং অপরিচিত মানুষের অতীত বা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা এসব কিছু করেন জ্বীনদের সহায়তা নিয়ে। তাদের সাথে খারাপ জ্বীনদের যোগাযোগ থাকে।
তাদের কাছে কেউ যখন কোনো ব্যক্তির অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জানতে চায় তখন তারা তার ‘সাহায্যকারী জ্বীন’কে উক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য জানায়। ‘সাহায্যকারী জ্বীন’ তখন এসব তথ্যের ভিত্তিতে ঐ ব্যক্তির সঙ্গী ‘ক্বারিন জ্বীনে’র সাথে যোগাযোগ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিটি মানুষের সাথেই একজন জ্বীন থাকে যার নাম ক্বারিন। রাসূল (সা:) বলেছেন- “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার সহচর জ্বীন নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি। “ (সহীহ মুসলিম:২৮২৪)
তো এই ক্বারিনের কাজই হলো মানুষকে পথভ্রষ্ট করা, অন্যায়, অশ্লীল ও কুকর্মে প্ররোচিত করা ,,বিপথগামী করা। তাছাড়া সার্বক্ষনিক সঙ্গী হবার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেকের ক্বারিন তার সঙ্গীর অতীত এবং বর্তমান জীবনের সব খুটিনাটি সম্পর্কে জানে।
ক্বারিন তার সঙ্গী ব্যক্তির এসব তথ্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তির ‘সাহায্যকারী জ্বীনকে’ সরবরাহ করে । এভাবে ’সাহায্যকারী জ্বীন’ এবং প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গী ’ক্বারিনের’ কাছ থেকে অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জেনে নিয়ে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে।
এভাবে অপরিচিত ব্যক্তির অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জানতে চাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান কি?
কোনো মানুষ আধ্যাত্মিকতার একটা লেভেলে পৌঁছে অপরিচিত ব্যক্তির অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জানতে পারে-এমন বিশ্বাস আমাদের শিরকের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এসব অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা,এতে কারো অংশীদার নেই। (সূরা হাশর: ২২) । তাই এভাবে অদৃশ্য জ্ঞানের বিষয়ে জানার চেষ্টা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এর মাঝে রয়েছে অতীত, ভবিষ্যৎ সবই।
অনেক সময় তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের ভবিষ্যত বাণীও সত্যি হয়ে যায়। সেটা কিভাবে?
ব্যক্তির সঙ্গী ক্বারিন জ্বীন কি তার ভবিষ্যতও বলে দিতে পারে?
না , পারে না। তাহলে কিভাবে সম্ভব ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা?
পর্ব- ৩
তিথিদের পাশের ফ্ল্যাটে এই মাসে নতুন প্রতিবেশী এসেছে। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা, তাঁর এক মেয়ে আর এক ছেলে। মহিলার স্বামী নাকি দেশের বাইরে থাকেন। তিথি স্বভাবগতভাবেই খুব একটা মিশুক নয়। তাই যেচে আলাপ করতে গেল না ওদের সাথে। ভদ্রমহিলাকেও কেমন যেন অন্যরকম মনে হলো তিথির কাছে।
প্রায় মাস দুয়েক পর তিথির বাসার ছুটা বুয়া বলল, সে নাকি পাশের ফ্ল্যাটেও কাজ নিয়েছে। ওদের বাসায় প্রায় প্রতিদিন বিকালেই অনেক অতিথি আসে, তাই বিকাল বেলা অতিরিক্ত কাজের চাপ সামলাতে এক ঘন্টার জন্য বুয়াকে আসতে বলেছে। বুয়ার কথায় খুব একটা পাত্তা না দিলেও সেদিন বিকালে মার্কেটে যাওয়ার সময় তিথি লক্ষ্য করে দেখল, আসলেই পাশের ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে অনেক মানুষের জুতা,স্যান্ডেলের সমারোহ। এর মধ্যে বেশির ভাগই অবার মহিলাদের স্যান্ডেল। হয়তো কোনো ধর্মীয় আলোচনার আসর বসে— এই ভেবে তিথি চলে গলে।
মার্কেট থেকে ফেরার পর বাসার নিচে তিথির দেখা হলো কলেজ জীবনের বান্ধবী রিমার সাথে। এখানে কার বাসায় এসেছে জিজ্ঞেস করতেই রিমা বলল, “এই বিল্ডিং এর তিনতলায় একজন মহিলা জ্যোতিষী থাকেন ”,উনার কাছেই এসেছিল রিমা।
তিথি বুঝতে পারল, ওর পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার কথা বলছে রিমা। কিন্তু উনার কাছে কেন এসেছিল জানতে চাইল তিথি।
তখন রিমা উৎসাহ নিয়ে বলা শুরু করলো, ”এই মহিলার তো বিশেষ ক্ষমতা আছে। আমার শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়-স্বজনরা নিয়মিত আসেন উনার কাছে। আমার ননদের বছর দুয়েক আগে এক বখাটে ছেলের সাথে প্রেম ছিল, আমার শ্বাশুড়ি তো চিন্তায় অস্থির। এক আত্মীয় তখন ইনার খোঁজ দিলেন। ইনি আমার শ্বাশুড়িকে একটা বাদামী রংয়ের পাথর দিয়ে বলেছিলেন এই পাথর দিয়ে লকেট বানিয়ে ননদের গলায় পরিয়ে রাখতে। ৬ মাস পর ওর জন্য একটা প্রবাসী ছেলের বিয়ের প্রস্তাব আসবে, তখন নাকি ননদ নিজে থেকেই বিয়েতে রাজী হয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই আমার ননদের এক প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে আর এখন ও স্বামীর সাথে বিদেশে সুখে সংসার করছে।”
রিমার কথায় তিথি অবাক হলেও তা চেহারায় প্রকাশ করলো না। নিরুত্তাপ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “তুই আবার আজ কেন এসেছিলি উনার কাছে?”
রিমা বললো, ”আমার হাজব্যান্ড ওর বন্ধুর সাথে পার্টনারশীপে নতুন একটা বিজনেস শুরু করতে চাইছে । তো বিজনেসটা শুরু করা সেইফ হবে কিনা, এটা নিয়ে কনফিউশনে আছি আমরা সবাই। আমার শ্বাশুড়ির শরীরটা ভালো না, তাই আমাকে পাঠিয়েছিলেন, জ্যোতিষ আপার কাছে।”
”তো কি বললো তোদের জ্যোতিষ আপাা?” তিথি জানতে চাইলো।
রিমা খুব খুশী গলায় বললো, “উনি বললেন , এই ব্যবসায় ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তারপরও সতর্কতা হিসেবে একটা পাথর দিয়ে বললেন , এটা দিয়ে অংটি বানিয়ে পরে থাকলে আমার হাসব্যান্ডের সাথে আর কেউ চিট করতে পারবে না। ”
রিমা এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো বললো যে, তিথিরও কেমন জানি একটা ভক্তি চলে এল, এই না দেখা জ্যোতিষ মহিলার প্রতি। রিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে তিথি ভাবতে লাগল, আসলেই কি সম্ভব এভাবে বিয়ে বা রিজিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্ভূল ভবিষ্যত বাণী করা?
উপরোক্ত কাহিনীর চরিত্র তিথির মতো আমরাও অনেক সময় হাতের রেখা দেখে , টিয়া পাখি/বানরের মাধ্যমে কিংবা গ্রহ-ন্ক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করে অনেককেই ভবিষ্যত বাণী করতে দেখি এবং কখনও কখনও তা মিলে গেলে ঐ ব্যক্তির অলৌকিক ক্ষমতা আছে ভেবে চমৎকৃত হয়ে যাই। আসলে কি ঘটে দৃষ্টির অন্তরালে ?
চলুন, জানার চেষ্টা করি।
বস্তুত পৃথিবীতে কোনও মানুষের এমন কোন বিশেষ ক্ষমতা নেই যে, সে কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যত বলতে পারে। আসলে এসব কিছুই করা হয় জ্বীনদের সহায়তা নিয়ে। এসব তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সাথে যোগাযোগ থাকে। তবে এই জ্বীনরা কোনও ব্যক্তির ভবিষ্যত জানে না। এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গী জ্বীন ক্বারিনও ঐ ব্যক্তির ভবিষ্যত জানে না।
এসব অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর সৃষ্টির কোন অংশকে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন। যেহেতু ফেরেশতারা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষের রিযিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত কাজগুলোর দায়িত্ব পালন করেন তাই তিনি যখন স্বেচ্ছায় ফেরেশতাগণের নিকট কোনো মানুষের ভবিষ্যতের রিযিক সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেন তখন ফেরেশতারা তা জানতে পারেন। আর জ্বীনরা এই সুযোগটাই গ্রহণ করে।
হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর নবুয়্যতের পূর্বে জ্বীনরা আকাশের সীমানায় অবাধে বিচরণ করতে পারতো। আল্লাহ তায়ালা যখন ফেরেশতাদেরকে মানুষের রিজিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত তথ্য জানাতেন তখন শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা সহজেই এসব তথ্য জানতে পারতো। অত:পর তারা এগুলো জ্যোতিষ বা ভাগ্য গণকদের কাছে জানিয়ে দিত। এভাবে শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সহায়তায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জ্যোতিষরা যে ভবিষ্যতবাণী করতো তা অনেকাংশেই সঠিক হতো। একারণে কুরাইশদের কাছে জ্যোতিষদের অনেক কদর ছিল। অগ্রিম খবর বলে দিতে পারতো বলে তারা অনেক শ্রদ্ধাভাজন ছিল।
কিন্তু কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে জীন দের প্রথম আসমান পার হওয়ার ক্ষমতা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং আকাশে প্রহরী ফেরেস্তা নিযুক্ত করা হয়। ফলে শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা অাল্লাহ কর্তৃক ফেরেশতাদের প্রদত্ত নির্দেশগুলো জানতে পারছিল না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
“আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করছি, অতঃপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে জলন্ত উল্কাপিন্ড ওঁৎ পেতে থাকতে দেখে।” (সূরা জ্বীন, ৮-৯)
হঠাত করেই এই রকম পরিবর্তনে অবাক হয়ে শয়তান তার অধীনস্থ সকল জ্বীনদের পৃথিবীর আনাচে-কোনাচে পাঠিয়ে দিল মূল খবর বের করার জন্য- কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে উর্ধ্বাকাশ থেকে কোন খবর আনা যাচ্ছে না?
খবরের সন্ধানে জ্বীনদের একদল যখন নাখালা নামের জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, রাসুল (সঃ) তখন সেই পথে ‘উকাজ’ নামের বাজারে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাচ্ছিলেন। জ্বীনদের দল যখন সেখানে পৌঁছল, রাসুল (সঃ) তখন সাহাবীদের নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ছিলেন। রাসুল (সঃ) এর মুখে কুরআনের তেলাওয়াত শুনেই জ্বীনদের সেই দল বুঝতে পারল কুরআন নাজিল হয়েছে এবং তারা এই সংবাদ নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফেরত যায়।
এরপর থেকে প্রথম আকাশে অবস্থানরত ফেরেস্তারা যখন আল্লাহর নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকে শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা আঁড়ি পেতে টুকরো টুকরো তথ্য সংগ্রহ করে এবং তার সাথে আরও মিথ্যা কথা মিশিয়ে তা জ্যোতিষিদের জানিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল ( সা:) বলেন-
”ফেরেশতারা এরপর আকাশের সীমানায় নেমে আসমানে মীমাংসা হওয়া বিষয়ের উল্লেখ করলে জ্বীনরা তা চুরি করে শোনে এবং পরবর্তীতে তার সাথে আরও কিছু কাল্পনিক কথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তা জ্যোতিষীদের কাছে জানিয়ে দেয়। কোন কোন সময় কথা পৌঁছানোর আগে তার উপর অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হয় আবার অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে সে কথা পৌঁছিয়ে দেয় । (সহীহ বুখারী: ৪৮০০)
এভাবেই জ্যোতিষি , ভাগ্য গণকরা নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার কারণে নয় বরং শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সহায়তায় ভবিষ্যত বলে দিতে পারে।
কেউ যদি নিজে জ্বীনদের সাথে সম্পর্ক না রাখে, কিন্তু নিজের বা অন্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে ভবিষ্যত বক্তার কাছে যায় ,তবে তার সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কি?
রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভবিষ্যত বক্তার কাছে যাবে এবং তাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করবে ৪০ দিন তার সালাত কবুল করা হবে না ।”(মুসলিম ২২৩০)
আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে,
“যে ব্যক্তি ভবিষ্যত বক্তার কাছে আসে এবং সে যা বলে তাকে সত্য বলে স্বীকার করে সে মুহাম্মদ (সা:) এর উপর যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি কুফরী করল।” (আহমদ)
অর্থ্যাৎ একথা স্পষ্ট যে, অতীত বা বর্তমানের মতো ভবিষ্যতও যেহেতু অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত এবং তাওহীদের অন্যতম মূলনীতি অনুযায়ী আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও এতে অংশীদার নেই তাই কোন ব্যক্তির কাছে অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে জানতে চাওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
জ্বীনরা কেন তথাকথিত অলৌকিক ব্যক্তিদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে? জ্বীনরা কি তাদের পোষ্য হয়ে যায়?
উত্তর হলো –না। তাহলে জ্বীনদের প্রাপ্তি কি?
পর্ব -৪
পীর, হুজুর, কবিরাজ, তান্ত্রিক, মেডিটেশনকারী কিংবা জ্যোতিষী —-এদের কারোরই নিজস্ব কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, তারা সবকিছুই করে জ্বীনদের সহায়তা নিয়ে।
তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সাহায্যকারী জ্বীন এবং ব্যক্তির সার্বক্ষণিক সঙ্গী ক্বারিন জ্বীনের সহয়তায় অপরিচিত ব্যক্তির অতীত, বর্তমান ,ভবিষ্যত তথ্য জানা সম্ভব হয়।
এখন প্রশ্ন হলো জ্বীনরা কেন এসব তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সহায়তা করে? এটা কি একতরফা কিছু? বা তারা কি এতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে যান যে, জ্বীনরা তাদের বাধ্য বা পোষা হয়ে যায়? তাই তাদের কথামতো কাজ করে?
উত্তর হচ্ছে –না।
সুলায়মান (আ:) ব্যতীত আর কোনো মানুষকে মহান আল্লাহতায়ালা জ্বীনদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেননি। তাই এইসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা যতই অপপ্রচার করুক যে, তাদের বাধ্য বা পোষা জ্বীন আছে তা সত্যি নয়। বরং জ্বীনদের সাথে এইসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সম্পর্কের স্বরূপ হচ্ছে ‘পারষ্পরিক সমঝোতার’, বলা যায় এক ধরণের চুক্তি ।
এই চুক্তির ভিত্তি কি? চলুন, জানার চেষ্টা করি।
মানুষের মাঝে যেমন মুসলিম ও কাফির আছে, জ্বীনদের মাঝেও তেমন আছে।(৭২:১৪) যারা ইবলীসের অনুসারী জ্বীন তারাই মূলত মানুষকে বিপথগামী করার জন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করে, তাদেরকে অর্থ, ক্ষমতা ও খ্যাতির প্রলোভন দেখায়। মানুষের মাঝে একদল স্থূলবুদ্ধি সম্পন্নরা তাদের এই প্রলোভনে সাড়া দেয় এবং জ্বীনদের সাথে সমঝোতার চুক্তি করে।
এই চুক্তি অনুসারে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের শিরকপূর্ণ ও কুফরি কাজ করে। যেমন- কুরআনের মুসহাফের উপর বাথরুম করা, সেটা দিয়ে শৌচকাজ করা, অন্য মানুষ বা পশুপাখির রক্ত পান, বিশিষ্ট কোনো মানুষের রক্ত হাজির করা (ফলে তারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, অনেক সময় করে), জ্বীনদের সিজদাহ করা, তাদের কাছে বিপদে আশ্রয় চাওয়া, তাদের নামে প্রাণী উৎসর্গ করা ইত্যাদি। তখন এসব শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের উপর সন্তুষ্ট হয় এবং বিভিন্নভাবে তাদের সহায়তা করে।
এভাবে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সহায়তা করে জ্বীনদের প্রাপ্তি কী?
জ্বীনদের পুরস্কারটা আসে ইবলিসের পক্ষ থেকে। ইবলিসের মিশনই হচ্ছে যত বেশী সংখ্যায় সম্ভব আদম সন্তানকে তার সাথে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া। আর এই মিশনে সে তার অনুসারী জ্বীনদেরও ব্যবহার করে। তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সাহায্য করার বিনিময়ে তারা যখন তাদেরকে দিয়ে শিরক ও কুফরি কাজ করাতে সমর্থ হয়, তখন তারা তাদের লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে যায়। সাথে বোনাস হিসেবে তারা পায় সেইসব সাধারণ মানুষ যারা এসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিভ্রান্ত হয়ে তাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসে এবং নিজেদের অজান্তেই নানারকম শিরকপূর্ণ ও কুফরি কাজে লিপ্ত হয়।
এভাবে আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও তাদের কাছে আসা সাহায্যপ্রার্থী –এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বিপথগামী করার পুরষ্কারস্বরূপ জ্বীনরা ইবলিসের কাছ থেকে বাহবা পায়। রসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :
ইবলিস সমুদ্রের পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য সেখান থেকে তার বাহিনী চারদিকে প্রেরণ করে। এদের মধ্যে সেই তার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে মানুষকে সবচেয়ে বেশী ফিতনায় নিপতিত করতে পারে। (সহীহ মুসলিম ২৮১৩)
ইবলিশ শুধু যে তার কাজে সহায়তাকারী জ্বীনদের সাময়িকভাবে পুরস্কৃত করে তাই নয় বরং তাদের অনন্তকালের জীবনে ক্ষমতা এবং রাজত্বের প্রলোভনও দেখায়। যদিও শয়তানের কোনোই সাধ্য নেই তাদেরকে চিরস্থায়ী পুরস্কার দেয়ার। তাই কিয়ামতের দিন সে নিজের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কথা স্বীকার করে নিয়ে বলবে-
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। অতএব তোমরা আমাকে ভৎর্সনা করো না এবং নিজেদেরকেই ভৎর্সনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্যকারী নই। এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতোপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি। নিশ্চয় যারা জালেম তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (১৪:২২)
এভাবে শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সাথে সমঝোতায় যাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
দুনিয়াবী স্বার্থসিদ্ধির জন্য জ্বীনদের সাথে এই ধরনের সমঝোতায় যাওয়া মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এসব কিছুর পরিণাম হলো জাহান্নাম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে—
“আর যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে সমবেত করবেন সেদিন বলবেন, হে জ্বীনের দল, তোমরা অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিলে এবং মানুষদের মধ্যে থেকে জ্বীনদের সঙ্গীরা বলবে, হে আমাদের রব, আমরা এক অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং আমরা পৌঁছে গিয়েছি সেই সময়ে, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ বলবেন, আগুন তোমাদের ঠিকানা,তোমরা সেখানে স্থায়ী হবে। (সূরা আল-আনঅম: ১২৮)
অতএব মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক ইসলামিক জ্ঞান আহরণ করা এবং মহান আল্লাহ ছাড়া তাঁর যে কোন সৃষ্টির কাছে ( জ্বীন অথবা তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ) সাহায্য চাওয়ার মানসিকতা পরিহার করা।
তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সাহায্য নিতে গিয়ে মুসলিমরা কিভাবে নিজের অজান্তেই শিরকে জড়িয়ে পড়ে?
পর্ব -৫
গ্রীষ্মের ছুটির দীর্ঘ এক মাস পরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। প্রথম দিন বন্ধুরা সবাই এক অপরের সাথে কুশল বিনিময় করছে। রায়হান ও সিয়াম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই ভালো ছাত্র। ১৫ দিন পর ওদের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। তাই বন্ধের মধ্যেও পড়ার চিন্তা মাথায় ছিল ওদের।
“ কিরে পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন নিলি?” রায়হান জিজ্ঞেস করলো সিয়ামকে।
সিয়াম বললো, “ভালোই আলহামদুল্লিাহ। দিনের বেলা ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলেও রাতের বেলা নিয়ম করে পড়েছি। সিলেবাস প্রায় কমপ্লিট। তোর কি অবস্থা?”
রায়হান বিমর্ষ স্বরে বলল, “আমার পড়া তেমন কিছুই আগায়নি। ছুটির একটা মাস তো অসুস্থ অবস্থায় বিছানাতেই কেটে গেল। পড়তে আর পারলাম কই?”
“কেন, কি হয়েছিল তোর?” উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সিয়াম।
রায়হান বললো, “বাড়ি ফেরার দুই-তিন দিন পর থেকেই সারা শরীরে ব্যথা, মাথা ঘুরে, বমি বমি ভাব আর খাওয়ায় অরুচি।”
“ডাক্তার দেখাসনি?” সিয়াম জানতে চাইলো।
“হুম, গ্রামের ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। উনি বললেন, গরমে গ্যাস ফর্ম করে শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে। গ্যাসের ওষুধও দিলেন। কিন্তু ওষুধ খেয়ে তেমন কোনো কাজ হলো না।”
“বলিস কি? এজন্যই তোর চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কালই চল, আমার মামার কাছে নিয়ে যাই। উনি ভালো ডাক্তার। ”
“নারে, আপাতত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আমার সমস্যা ডাক্তার সমাধান করতে পারবে না। ডাক্তারের ওষধে কাজ না হওয়ায় মার সাথে গ্রামের হুজুরের কাছে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, আমার এটা সাধারণ অসুস্থতা না। আমার নাকি বদনজর লেগেছে।”
“কি বলিস!! তোকে কে বদনজর দিতে যাবে??” অবাক কন্ঠে বলল সিয়াম।
“কার বদনজর লেগেছে তা অবশ্য হুজুর বলেননি। তবে আমরা আন্দাজ করতে পেরেছি। জানিসই তো, আমি বাবার একমাত্র ছেলে। বাবার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আমি। আমার অন্য চাচাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া আমাদের গ্রামের মধ্যে আমিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, ভালো ফলাফলও করছি , তাই আমাকে হিংসা করার লোকের অভাব নেই গ্রামে। যাই হোক, আপাতত আর চিন্তা নেই। হুজুর আমাকে তাবিজ দিয়ে দিয়েছে।” নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলল রায়হান।
“তাবিজ?? তুই এ
February 20, 2022
দুনিয়াবী শিক্ষাকে ইবাদতে পরিণত করা

পর্ব ১
কথা বলছিলাম মাতৃস্থানীয়া একজন মুরুব্বীর সাথে। প্রায় জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এই নারীর গভীর জীবনবোধ আমাকে প্রায়ই চমৎকৃত করে। অথচ ঊনি পড়াশোনা করেছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। তাই জীবন নিয়ে ঊনার উপলব্ধিগুলো আমাকে ভাবিয়ে তোলে ‘উচ্চশিক্ষিত’ এই বিশেষণের প্রকৃত অর্থ নিয়ে। আমার প্রায়ই মনে হয় আমরা এক অদ্ভূত সময়ে বাস করছি। আমাদের নামের পাশে বিশাল বিশাল ডিগ্রীর তকমা ঝুলছে, পড়াশোনাকে আমরা জীবনের ধ্যান জ্ঞান বানিয়ে ফেলেছি অথচ এই আমাদেরই জীবনের খুব ছোট ছোট ব্যাপারে ‘কমন সেন্সের’ খুব অভাব। পিএইচডি ডিগ্রীধারী মা-বাবাকে আপনি দেখবেন পরীক্ষার আগে টাকা দিয়ে সন্তানের জন্য প্রশ্ন কিনতে। এটা যে কত ভয়ংকর আত্মঘাতী একটা কাজ এই সামান্য বোধটুকু আমাদের ডিগ্রীগুলো আমাদের দিতে পারছে না।
ঠিক একইভাবে জীবনের একটা বিশাল অংশ অনেক ডিগ্রী অর্জনের পিছনে ব্যয় করে হঠাৎ করে কেউ যখন নিজের ‘মুসলিম’ আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে, তখন অবাক হয়ে উপলব্ধি করে যে ইসলামের নুন্যতম ব্যাসিক জ্ঞানটুকুও তার নেই। সে জানে না কিসে অযু ভংগ হয় কিংবা কিসে ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই তখন এক অজানা আক্রোশে মনটা ছেয়ে যায়। রাগ হয় নিজের উপর, আশেপাশের মানুষগুলোর উপর, এই সিস্টেমের উপর। যা কিছু পড়েছি, যা কিছু পড়ছি সব কিছুকে ‘দুনিয়াবী শিক্ষা’ মনে হয়। ‘দুনিয়াবী’, কারণ এটা আমার পরকালে কোনো উপকারেই আসছে না। ইসলামের বুঝ আসার পর তাই আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়-“দুনিয়াবী পড়া ছেড়ে দিয়ে দ্বীনের পড়াশোনায় ব্যাপৃত হব”। এর পিছনে প্রভাবক হিসেবে আরো কাজ করে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজমান পরিবেশ যা কিনা ইসলাম পালনের জন্য খুবই প্রতিকূল।
কিন্তু এই যে ইসলাম প্র্যাক্টিস শুরু করার পরই আমরা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাই এটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত? যে উম্মাহর নবীর উপর প্রথম নির্দেশ ছিলো ‘পড়ো’, তাদের জন্য পড়াশোনাকে এইভাবে দুনিয়াবী আর দ্বীনী এই দু’ভাগে ভাগ করার চিন্তাটা কি ইসলাম সম্মত?
আমাদের আজকের আলোচনা মূলত এটা নিয়েই। আমি নিজে যেহেতু অর্থনীতি নিয়ে পড়ছি এবং আমি একজন মেয়ে, তাই আমি প্রচুর মেয়ের কাছ থেকে এই টপিক নিয়ে প্রশ্ন পাই। তাদেরকে আমার মতামত জানাতে গিয়েই এই টপিকের উপর একটা সিরিজ লেখার চিন্তা মাথায় আসে।
তবে আমি শুরুতেই স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমি কোনো স্কলার নই। আমি এখানে যা বলবো তা সম্পূর্ণ রূপে আমার নিজস্ব মতামত, বলা যেতে পারে জীবন থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা। তাই দয়া করে কেউ মনে করবেন না যে আমি ফতওয়া দেয়া শুরু করেছি। তা করার প্রশ্নই ওঠে না।
আমি বিভিন্ন ফিল্ডে অধ্যয়নরত মেয়েদের থেকে প্রশ্ন পাই যারা পড়াশোনা চালিয়ে নেয়া নিয়ে দ্বিধান্বিত। আলোচনার সুবিধার্থে আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি –
“আপু আমি অনার্সে ‘ল‘ নিয়ে পড়েছি । আমি কর্পোরেট জবে আগ্রহী না, লিগ্যাল প্র্যাকটিসও করবো না। আমি শিক্ষকতা পেশাতে যেতে চাই, সেটার জন্য আমার মাস্টার্স করা জরুরী। কিন্তু আমি যেহেতু মেয়ে, অর্থ উপার্জন করা আমার জন্য জরুরী না, তাহলে মাস্টার্স করার জন্য কো এডুকেশনে পড়তে যাওয়া কি আমার জন্য উচিৎ হবে?”
আমি যখন এসব ব্যাপারে আমার মতামত দিতে চাই, আমি প্রথমেই বলে নেই যে অন্য কেউ আপনার জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে দেবে না, এটা কোনো কাজের কথাও না যে আপনি অন্যের কথা শুনে নিজের জীবনের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারাটা একটা অপরিহার্য দক্ষতা যেটা আমাদের সবার অর্জন করতে পারা উচিৎ। আমি মোটা দাগে সবাইকেই তাহাজ্জুদ পরে আল্লাহর সাথে কন্সাল্ট করতে বলি। তারপর নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ ঊনাদের সাথে শেয়ার করি।
আমি প্রথমেই জানতে চাই যে ঊনি বিবাহিত কী না, হলে বাচ্চা আছে নাকি। এগুলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন, সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু আমি করি কারণ এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো অনেকটা নির্ভর করে আমি প্রাপ্ত বয়স্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত নাকি নই। যদি আমার বাচ্চা থাকে তাহলে সমীকরণ এক রকম, যদি না থাকে তাহলে আরেক রকম। কারণ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে একটা মেয়ে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বশীল তার পরিবারের ব্যাপারে। একটা মেয়ে লম্বা সময়ে বাইরে থাকলে আজকের সময়ে বেশ কিছু সমস্যা হয় বাচ্চার দেখভাল করা নিয়ে। আবারো বলছি, আজকের সময়ে………যখন আমরা যৌথ ফ্যামিলিতে থাকি না বললেই চলে। আর Sexual Abuse এর ব্যাপারটা মহামারী আকার ধারণ করাতে বাইরের কাউকে বাচ্চার দেখভালের জন্য বিশ্বাস করা খুব কঠিন এখন।
তাই আমার আজকের লেখা মূলত তাদের জন্য যাদের ছোট বাবু নেই। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ Disclaimer.
এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনায় যাওয়ার আগে সবার আগে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার সেটা হল ‘ফ্রিমিক্সিং’। কো এডুকেশন হারাম এটা আমরা হর হামেশা বলে থাকি। কিন্তু ফ্রি মিক্সিং আর কো এডুকেশন কি সমার্থক? ফ্রি মিক্সিং এর পরিবেশে যাওয়ার প্রশ্ন যখন আসে, তখন প্রথমেই আমাদের কাজ হওয়া উচিৎ ফ্রি মিক্সিং বলতে আমি কি বুঝাচ্ছি সেটা বোঝা।
অবশ্যই ফ্রি মিক্সিং বলতে আমরা ছেলে ও মেয়ের একই জায়গায় অবস্থানকে বুঝাই না। তাহলে দুনিয়ার সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে, মাসজিদেও। ফ্রি মিক্সিং বলতে আসলে আমরা বুঝাই ‘Intermingling among cross gender’, অর্থ্যাৎ ‘বিপরীত লিঙ্গের মাঝে অসঙ্গত আচরণ।’
এখানে এটা বোঝা খুব জরুরী যে আজকের ইন্টারনেটের যুগে ‘অসঙ্গত আচরণের’ ব্যাপ্তিটা একটু বিশাল বৈ কি। আপনি যদি আপনার পুরুষ সহকর্মীকে চোখ টিপ দেয়ার ইমো পাঠান, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে অসঙ্গত আচরণ। লক্ষ্য করুন, এখানে আপনি ঘরে বসেই অসঙ্গত আচরণের গুনাহ করতে পারছেন, আপনাকে বাইরে যেতে হচ্ছে না। তাই আজকের সময়ে অসঙ্গত আচরণের গুনাহ আপনি ঘরে থেকেই এড়াতে পারছেন না। সময়ের এই পরিবর্তনটা আমাদের বুঝতে হবে।
কো এডুকেশনের পরিবেশে থেকে কি অসঙ্গত আচরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব? আল্লাহ ভালো জানেন, কিন্তু আমার মনে হয় সম্ভব। কিভাবে?
ক. যদি আপনার শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা হালালভাবে মেটে। লক্ষ্য করুন, আমি এখানে শুধু শারিরীক চাহিদার কথা বলিনি, ইমোশোনাল চাহিদার কথাও বলেছি। আপনার দাম্পত্য জীবনের অতৃপ্তি, হতাশা এগুলো যদি আপনি আপনার পুরুষ কলিগ কিংবা ক্লাসমেটের সাথে শেয়ার করেন, তাহলে সেটা আপনাকে এক পিচ্ছিল পথে নিয়ে যাবে, সেটা পরকীয়ার পথ।
খ. আপনার ড্রেস পোশাক যদি ইসলামিক কোড মেনে চলা হয়। আমি আশা করি যে প্রোপার ইসলামিক ড্রেস কোড বলতে কী বুঝায় এটা এই লেখার পাঠকেরা জানেন। না জানলে উপযুক্ত উৎস থেকে জেনে নিবেন। আমি এই লেখার ফোকাস হারাতে চাই না।
গ. আপনার Non-Verbal communication যেন কোনো ভুল সিগন্যাল না পাঠায়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বোরকা পরে ছেলেদের সাথে হা হা হিহি করা টাইপের মেয়ে হন তাহলে ছেলেরা বুঝবে যে পোশাকের মাধ্যমে আপনার সাথে যোগাযোগে যে বাঁধা সৃষ্টি হয়েছে এটা দুর্ভেদ্য কিছু না। তখন ছেলেরা আপনাকে সহজলভ্য ভাববে।
ঘ .বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে প্রয়োজনীয় ইন্টার্যাকশনের আগে চিন্তা করুন যে এই কাজটার জন্য কোনো মেয়ে বিকল্প আছে কী না। যদি থাকে তাহলে তার কাছে যান। নিজেকে প্রশ্ন করুন যে এই Interaction আদতে আমার জন্য খুবই জরুরী কী না। লাভ ক্ষতির মাঝে তুলনামূলক পর্যালোচনা করুন।
ঙ. বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে Interaction করার সময়ে মাথায় রাখুন যে ‘প্র্যাক্টিসিং’ কেউ যদি এই কথাবার্তা দেখতো, তাহলে সে কি ভাবতো। সে কি এটাকে নিছক সাধারণ কথাবার্তা ভাবতো নাকি অন্য কিছু? যদি সম্ভব হয় যে কোনো এক পক্ষের মাহরামের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।
চ. বিপরীত লিঙ্গের কারো কাছ থেকে অযাচিত সুবিধা নেয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনি যদি কারো প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যান, তাহলে সে সেটার সুযোগ নেবে এটা মাথায় রাখবেন।
ছ. নিজেকে পরকীয়া থেকে নিরাপদ ভাববেন না। এটা একটা ভয়ংকর পাপ। কখনো ভাববেন না অমুক আমার ছোট, তমুক চার বাচ্চার বাপ, তমুকের বউ এর সাথে আমার সুসম্পর্ক, তমুক তো বিদেশী ইত্যাদি। মনে রাখবেন শয়তান অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল এবং সে আমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া- প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য, ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত গুনাহ থেকে। আল্লাহর সাথে নিয়মিত কথোপকথনের কোনো বিকল্প নেই। নিশ্চয়ই বান্দা কোনো গুনাহ থেকে আপ্রাণভাবে বাঁচতে চাইলে আল্লাহ তাঁকে নিরাশ করেন না। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে শয়তানের চক্রান্ত বিশ্বাসীদের জন্য দুর্বল। আমরা যেন নিজেকে খুব নাজুক না ভাবি। আস্থা রাখতে হবে আল্লাহর সাহায্যের উপর।
আশা করি ,উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলিতে সতর্ক হলে এবং আল্লাহর সাহায্য পেলে মেয়েরা কো-এডুকেশনে পড়েও Intermingling Avoid করতে পারবে ইনশাআল্লাহ ।
এখন এ কথা অনস্বীকার্য যে অনেকেই এইভাবে এইসব নির্দেশনা মেনে চলার মত অবস্থায় থাকেন না। সব মেয়ের মাহরাম থাকে না, কেউ অবিবাহিত কিংবা ডিভোর্সী হতেই পারেন। তখন কী হবে? ফ্রি মিক্সিং এর ফিতনায় পরে যাবো এটা ভেবে পড়াশোনা ছেড়ে দিবো?
আমি মনে করি-না, দিবো না। কারণ এভাবে আমরা অবস্থার উত্তরণে কোনো ভূমিকা রাখার কথা ভাবছি না।
৪.
আজকাল অনেক বিখ্যাত মানুষদেরই মেয়ে ঘটিত নানা পদ স্খলনের খবর শোনা যায়। সেগুলার কত অংশ গুজব আর কত অংশ সত্যি সেটা আল্লাহই ভালো জানেন কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এগুলোর একটা মেজর কারণ সব ক্ষেত্রে মেয়ে বিকল্প না থাকা। একটা সামান্য ফিকহের জ্ঞান অথবা কাউন্সেলিং এর জন্য যদি মেয়েদের ছেলের কাছে যাওয়া লাগে আর একটা ছেলে স্কলার যদি এইভাবে শত শত Vulnerable মেয়ের(যেমন ডিভোর্সড, নও-মুসলিম, পরিবারে নির্যাতনের স্বীকার ইত্যাদি) মুখোমুখি হয় তাহলে তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
আমি বিশ্বাস করি যে ইসলামে ফ্রি মিক্সিং হারাম বলেই একটা প্রজন্মকে ফিতনার ভয় জয় করে দৃঢ়পদ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। অর্থ্যাৎ যে ময়লা পরিষ্কার করবে, তাকে ময়লার মাঝে নামতে হবে।
একজন মেয়ে যখন কো-এডুকেশনে পড়ে একটা রিসোর্স পারসন হবে, তখন সে তার ফিল্ডে কমপক্ষে ১০০টা মেয়ের ফ্রি মিক্সিং এর দরজা বন্ধ করছে, কারণ তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এখন একজন ‘মহিলা বিকল্প’ আছে। এবং এটার একটা Dom-inno effect আছে কারণ তার কাছ থেকে শিখে আরো ১০টা মেয়ে রিসোর্স পারসন হতে পারবে ইনশাল্লাহ।
তাই আমি এমন একটা সময়ের স্বপ্ন দেখি যখন শরীয়াহ, আইন, অর্থনীতি, সাইকোল্যোজি, এডুকেশন সব ফিল্ডে মেয়ে রিসোর্স পারসন থাকবে যেন মেয়েরা কোনো প্রশ্ন বা দরকারে একটা মেয়ের কাছেই যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি মনে করে যে সে ময়লা পরিষ্কার করতে পারবে না, বরং ময়লার দুর্বিপাকে হারিয়ে যাবে, এই কাজ অবশ্যই তাদের জন্য না।
আমি যে পথের কথা বলছি সেটা নিঃসন্দেহে একটা দুর্গম পথ। কারণ এই পথে হাঁটার অনেক সামাজিক উপকারিতা আছে- স্ট্যাটাস, টাকা পয়সা ইত্যাদি। তাই নিয়্যতটা কলুষিত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন পরিবারকে ফুল টাইম দেয়াকে ‘কিছু না করে’ ‘ঘরে বসে থাকা’ হিসেবে অবহেলা করা হয় তাই হয়তো আমরা দাবী করি যে উম্মাহর জন্য বড় কিছু করতে চাই বলে পড়ছি, অথচ নিজের অজান্তেই হয়ত মূল কারণটা থাকে সমাজের চোখে ‘ভ্যালুলেস’ হিসেবে গণ্য না হওয়া। এই কাজে নিয়্যতের পরিশুদ্ধতা বজায় রাখা তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
পর্ব ২
আজকের পর্বে আমি একদম সুনির্দিষ্ট করে পয়েন্ট আকারে বলবো আইন বিষয়ে পড়ে একজন মেয়ে কিভাবে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখতে পারে। এখানে আবারো বলে রাখা ভালো যে, এটা আমার উর্বর মস্তিষ্কজাত চিন্তা, অনেক ডিসিপ্লিন নিয়েই আমার এরকম নিজস্ব চিন্তা আছে।
আইন পেশা ছেলে ও মেয়েদের উভয়ের জন্য দারুণ একটা পেশা যার মাধ্যমে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখার বিশাল সুযোগ আছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য ন্যায্য বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বলে বুঝানোর কিছু নেই। একটি জাতিকে ধ্বংসের জন্য আইন ও শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়াই যথেষ্ট- খুব সম্ভবত এটা লর্ড ক্লাইভের একটা উক্তি। তাই একজন মুসলিম একজন সৎ ও নিরপেক্ষ আইনজীবি, বিচারক হওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
এত গেল একটা আদর্শ পরিস্থিতি। বর্তমান বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আমরা যেহেতু এখন মানব রচিত আইন ব্যবস্থার মাঝে বাস করছি তাই ইসলামপন্থীরা নানা ধরণের জুলুমের শিকার। প্রচলিত আইন ব্যবস্থার মাঝেই যতটুকু সম্ভব তাদেরকে ন্যায় বিচার দেয়াটা যেন সম্ভব হয় (অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হলে ইত্যাদি) সেজন্য আমাদের প্রচুর প্র্যাক্টিসিং আইনজীবী দরকার যারা প্রচলিত সিস্টেমের ব্যাপারে খুবই দক্ষ।
কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে বর্তমানে কোর্টের যে পরিবেশ তা একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম মেয়ের জন্য মারাত্মক বৈরী। কিন্তু তা হলে কি একটা মেয়ে আইন নিয়ে পড়বে না?
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি পড়বে, পড়া উচিৎ। আসুন দেখা যাক কিভাবে সে এই বিষয় নিয়ে পড়ে অবদান রাখতে পারে। যখন একটা মেয়ে ‘আইন’ একটা শাস্ত্র হিসেবে পড়বে তখন সে শরীয়াহ আইন গুলোকে একটা অন্য আলোয় দেখার সুযোগ পাবে। আমরা খেয়াল করলে দেখবো যে ইসলাম নিয়ে যত আক্রমণ, বিতর্ক হয় সেগুলোর অধিকাংশেরই উৎস হচ্ছে শরীয়াহ আইন।
একটা খুব কমন উদাহরণ হচ্ছে- হিল্লা বিয়ের আইনটা। ছোট বেলায় দেখা নাটক সিনেমার একটা কমন দৃশ্য ছিলো যে স্বামী এসে ভাত চেয়েছে, বউ বলেছে ভাত হয় নাই, স্বামী রেগে গিয়ে “যাহ তোরে আমি তালাক্ব দিলাম বলে” তিন তালাক্ব দিয়ে দিলো। আর মেয়েটা “আল্লাগো” বলে একটা চিৎকার দিলো। তারপর তাদের হিল্লা বিয়ে হল ইত্যাদি নানা কিছু। আসলে কি তালাক্বের ব্যাপারটা এমন? IOU তে Fiqh of Marriage কোর্সে যখন বিয়ে এবং তালাক্বের নিয়ম বিস্তারিত পড়েছিলাম, আমার এত অবাক হয়েছিলাম যে বলার মত না! নিয়মটা কী, আর আমরা জানিটা কী!
এতো গেলো জাস্ট একটা উদাহরণ। আরো শত সহস্র দেয়া যায়। যেমন এটা খুব কমন কথা যে ইসলামে চোরের শাস্তি হাত কাটা। এটাকে বর্বর প্রথা হিসেবে আখ্যায়িত করে ইসলামকে পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আমার মনে আছে যে হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটাতে কোনো বাচ্চা ছেলে গাছের নিচে পরে থাকা ফল না বলে কুড়িয়ে নিয়েছিল বলে তার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল এমন কিছু ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই?
আমাদের বিবিএ সিলেবাসে Business law একটা কোর্স ছিলো। সেখানে আমার প্রথম ‘আইন’ বিষয়টার সাথে পরিচয় হয়। তখন আমি সেখানে পড়েছিলাম যে কখনই কোনো একটা বিষয়ে ‘আইন বা শাস্তি অমুক’ এভাবে এক কথায় বলা যায় না। বিশেষ করে ‘ক্রিমিন্যাল ল’ এর ক্ষেত্রে। বিষয়টা জটিল এবং সূক্ষ্ম। যে কোনো কাজের শাস্তি অমুক সেটা বলার আগে কোন প্রেক্ষিতে, কোন শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এটার প্রয়োগ করা যাবে আর কখন যাবে না এরকম বহু কিছু বলা থাকে। ঠিক এই ব্যাপারটা ইসলামী আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরে যখন IOU তে ইসলামী আইন ব্যবস্থার উপর কোর্স করেছি তখন এই হাত কাটার শাস্তি প্রয়োগের শর্ত, পরিস্থিতি এরকম সব কিছু বিস্তারিত পড়েছি। যেমন একটা শর্ত হচ্ছে যে চুরিকৃত মালটার মূল্য ন্যুনতম চল্লিশ দিরহামের সমমানের হতে হবে। তাহলে এখন আপনারাই বলেন গাছের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া ফলের ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে?
পরবর্তীতে আমি ইসলামী শাস্তি আইন নামে একটা বই পড়েছিলাম (কেউ আগ্রহী হলে এই লিংকে গিয়ে পড়তে পারেন http://www.islameralobd.com/2015/11/b... যেখানে ইসলামের শাস্তি আইনের ব্যাপারগুলো অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরা হয়েছিলো। বলাই বাহুল্য বইয়ের লেখক একজন আইনের অধ্যাপক।
তাই আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের এমন দক্ষ মানব সম্পদ দরকার যারা প্রচলিত আইন নিয়ে গভীরভাবে জানবে, সাথে শরীয়াহ আইন নিয়ে জানবে। তারপর ইসলামের তথাকথিত বিতর্কিত শরীয়াহ আইনগুলোর প্রজ্ঞা সাধারণ জনগণের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরবে প্রচলিত আইনের সাথে তুলনার মাধ্যমে।
কেউ যদি এমনিতে শুধু শরীয়াহ নিয়ে পড়ে তাহলে তার অ্যাপ্রোচ, আর যে প্রচলিত আইন নিয়ে পড়েছে, তারপর শরীয়াহ আইন নিয়ে পড়েছে তার অ্যাপ্রোচ স্বাভাবিকভাবেই আলাদা হবে। ২য় গ্রুপের অ্যাপ্রোচ তুলনামূলকভাবে বেশী Effective হবে বলে আমার কাছে মনে হয়। (আল্লাহই ভালো জানেন)। যে ‘ল’ ফিল্ডটা নিয়ে পড়েছে সে খুব ভালো বুঝবে ফতওয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য। আমার ইদানিং মনে হয় প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের মাঝে মহামারীর মত ছড়িয়ে যাওয়া একটা সমস্যা হল ফতওয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য বুঝতে না পারা। ফতওয়া By definition একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট একজন মানুষকে দেয়া স্কলারের মতামত। এখন একজনকে দেয়া ফতওয়া আরেকজনের উপকারে লাগতে পারে ঠিকই, ঠিক যেমন আগে কোনো এক সময়ে কোনো কোর্টে দেয়া রায় পরবর্তীতে বিচার করার সময় আইনের একটা উৎস হতে পারে। কিন্তু সেটার সাথে তুলনা করে আজকে রায় দেয়ার সময় অবশ্যই সময়, পরিস্থিতির পরিবর্তন, সাথে আগের কেসের সাথে এই কেসের পার্থক্য বিবেচনা করতে হয়।একইভাবে একটি ফতওয়া আরেকজন মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে নাকি সেটা বুঝতে হলে চেক করতে হবে দুজন মানুষের পরিস্থিতি, সময়, দেশ ইত্যাদি একই নাকি। এগুলো চিন্তা না করেই আমরা একটা ফতোয়ার ওয়েবসাইট থেকে ফতওয়া কোট করে দিয়ে দেই। আমি নিজে Islam QA থেকে প্রচুর ফতওয়া উর্দ্ধৃতি দেই, কিন্তু সেটাকে ঐশী বাণীর মর্যাদা দেই না, মানে সেটা মন দিয়ে পড়ি এবং আমি যে পরিস্থিতিতে আছি আর প্রশ্নকর্তার পরিস্থিতির মাঝে বিশাল কোনো পার্থক্য আছে নাকি সেটা বোঝার চেষ্টা করি। ফতওয়া শপিং করছি নাকি সেটাও খেয়াল রাখার চেষ্টা করি।
কো এডুকেশন নিয়ে Islam QA এর ফতওয়ার কথাই চিন্তা করুন। এখানে কিন্তু ছেলে এবং মেয়ের উভয়ের জন্যই কোএডুকেশনে পড়া হারাম বলা হয়েছে, তারপর বেশ কিছু ব্যতিক্রমও দেয়া হয়েছে। ( https://islamqa.info/en/45883 ) আমরা এই ব্যতিক্রম গুলার কথা বলিনা, আমরা এই বিধান শুধু মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেই এটা বলে যে ছেলেদের জন্য আয় করা ফরয। অথচ এই ব্যতিক্রমের কথা কিন্তু ফতয়াতে বলা নাই।
আমরা যদি এই ফতওয়াটার পক্ষে দেয়া শরীয়াতের দলীলগুলো চিন্তা করি তাহলে দেখবো এখানে Intermingling নিষেধ এমন প্রমাণগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ কো এডুকেশন তখনই হারাম হবে যখন সেটা ফ্রি মিক্সিং এর কারণ হবে। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা শুরুতেই তুলে ধরেছি।
Intermingling এর বিপক্ষে উপস্থাপিত প্রধান প্রমাণ সম্ভবত সেই হাদীসটি যেখানে বলা হয়েছে যে মেয়েরা ছেলেদের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীসের ব্যাপারে আমার মনে কোনো ধরনের দ্বিধা, ক্ষোভ নাই আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় যে এটা একটা misquoted হাদীস। আকর্ষণীয় কণ্ঠে নন-মাহরামদের সাথে কথা না বলার নির্দেশ সরাসরি কুরআনে এসেছে। আমি বলছি স্বাভাবিক স্বরে প্রয়োজনীয় কথার ব্যাপারে। সেটাতে কী সমস্যা আমার জানা নেই। মেয়েরা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে পূর্ণ পর্দা করেও (এমনকি চেহারা না দেখিয়েও বা নিক্বাব করেও) উপস্থিত হতে পারবেন না এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তাদের পক্ষে কী প্রমাণ আছে সেটা আমার জানা নেই। শুধু তাই না কোনো মেয়ে কোনো বিষয়ে পাবলিকলি শিক্ষা দিচ্ছে এই ব্যাপারটিতেও তারা আঁতকে ওঠেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যে কত মুসলিম মহিলা স্কলারের কাছ থেকে কত বড় বড় আলিম তৈরি হয়েছে।
যাই হোক, কথা বলছিলাম কো এডুকেশন নিয়ে Islam QA এর ফতওয়া নিয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে কো এডুকেশনে পড়া নিষেধ মর্মে যখন একটা ছেলেকে ফতওয়া দেয়া হচ্ছে তখন ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হচ্ছে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে- There is no need for mixing. Studying in this school is not essential; so long as a woman can read and write and knows the teachings of her religion, that is sufficient, because she was created for that, i.e., to worship Allaah. Anything beyond that is not essential. (https://islamqa.info/en/8827 )
এটা পড়ে মনে হচ্ছে যে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুলে যাওয়ার কোনো দরকার নেই যদি Co-education ছাড়া কিছু পাওয়া না যায়। অক্ষর জ্ঞানই যথেষ্ট। এই মতটা আমাদের সময়ের জন্য কতটুকু উপযুক্ত তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে নিঃসন্দেহে এটা ফতওয়া যিনি দিয়েছেন তার ব্যক্তিগত অভিমত। এখন এই সাইটে যারা ফতওয়া দেন আমি তাদের পায়ের নখের যোগ্য নই, কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্যি যে ইসলামে কোনো পুরোহিত তন্ত্র নেই। তাই কোনো স্কলারের কোনো ব্যক্তিগত মত, যেটার পক্ষে ঊনি কোনো দলীল উপস্থাপন করেন নি, সেটার সাথে দ্বিমত পোষণ করতেই পারি। এতে স্কলারদেরকে অসম্মান করা হয় না, বরং নিজেরা জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট না থেকে স্কলারদেরকে অন্ধ আনুগত্যের কালচারকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
যাই হোক, যখন একজন মেয়ে আইন নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করবে তখন সে ফতওয়া ও শরীয়াহর মাঝে সহজেই পার্থক্য করতে পারবে ইনশাল্লাহ। সেইসাথে একটি ফতওয়া পড়ে সে বুঝতে পারবে যে এটার কোন অংশটুকু একজন স্কলারের মত আর কোন অংশটুকু কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি আসছে অর্থ্যাৎ কোনো অংশটি মানতে আমরা বাধ্য আর কোন অংশটা না। বেশ কিছু ব্যাপারে ইসলামী আইনের প্রজ্ঞা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাই কেন ইসলামী আইন কোনো একটা কিছুর বিধান দিয়েছে সেটা প্রচলিত আইনের সাথে তুলনা করে ইসলামী আইনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা যায়। যেমন ধরুন মৃত্যু দণ্ড প্রথাটা বর্বর মনে করে অনেক দেশই এখন এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে চিন্তা করলে এবং অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে মৃত্যু দণ্ড বেশী কার্যকরী পন্থা। আমার ইউনিভার্সিটির ইকোনোমেট্রিক্স এর প্রফেসরের রিসার্চ পেপার আছে ২টা এটার উপর। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটা নিয়ে পেপার নাই বললেই চলে। মুসলিমদের তো প্রশ্নই উঠে না, নন-মুসলিমদের মাঝেও নাই। একজন মুসলিম এ ধরণের কাজ করতে পারে।
‘ল’ ফিল্ডটার ক্রম বিকাশ/ বিবর্তন নিয়ে কাজ করতে পারেন কেউ। দেখাতে পারেন যে আজকে যত মানব রচিত আইন আছে সেটার উৎস কোনো না কোনোভাবে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থের (যেমন বাইবেলের 10 commandments) সাথে সম্পর্কিত। তাই আজকে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, মানুষের পক্ষে একদম শূন্য থেকে শুরু করা আসলে সম্ভব না।
আরো দেখানো যেতে পারে যে ‘আইন’ করে সমাজের সব বিপর্যয় প্রতিরোধ করা যায় না, নৈতিকতার প্রসার অপরিহার্য আর সেটা ধর্মীয় প্রভাব ছাড়া সম্ভব না। ‘ল’ ফিল্ডটাতে একটা খুব কমন কন্সেপ্ট হচ্ছে letter of the law and spirit of the law এর মাঝে পার্থক্য করা। আমাদের বর্তমান সময়েও আমরা ইস্লামিস্টরা letter of the law কে spirit of the law এর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেই বলে মনে হয় আমার কাছে।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে মনে হয়। একবার আমার এক পরিচিত আপুর আব্বা হঠাৎ করে মারা গেলেন কানাডার একটা শহরে যেখানে শুধু ঊনারা স্বামী স্ত্রী থাকতেন। এখন একা বাসায় আপুর আম্মা একদমই থাকতে পারছিলেন না, ঊনি চাচ্ছিলেন যে দেশে চলে আসবেন। তো আমি পণ্ডিত ভাবছিলাম যে এইভাবে ইদ্দতকাল চলা অবস্থায় একা মাহরাম ছাড়া ঊনার Travel করা উচিৎ হবে নাকি। আমি এইটা নিয়ে IOU এর ফিকহ এর একজন টিচারের সাথে কথা বললাম। উনি বললেন অবশ্যই উচিৎ হবে কারণ একজন মহিলা একা একটা শহরে এভাবে থাকার চেয়ে Travel করে হলেও উনার দেশে মাহরামদের মাঝে থাকাটা বেশী শরীয়াহ সম্মত কারণ সেটাই Maqasid (objective) of Shariah র বেশী কাছাকাছি- মেয়েদের একটা নিরাপদ পরিবেশ দেয়া। তখন আমার মনে হয়েছিল যে এটা হচ্ছে letter of the law এর চেয়ে spirit of the law কে বেশী গুরুত্ব দেয়া।
ইসলামিক ইকোনমিক্সেও এটা একটা বিশাল সমস্যা। এটা নিয়ে আমার গত ৫ বছরের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা থেকে আমি এটাই বুঝেছি যে আমরা আজকের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাতে letter of the law কে spirit of the law এর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেই। তাই হয়তো পণ্যগুলোর বাহ্যিক রূপটা শারিয়াহ সম্মত হয়েছে কিন্তু সেটা সুদ নিষিদ্ধ করার যে উদ্দেশ্য, সেই উদ্দেশ্য সাধনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।
আমি আশা করি যে একজন আইনের শিক্ষার্থী আইন নিয়ে তার Diversified, গভীর পড়াশোনা থেকে ইসলামী আইনের এমন প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করতে পারেন ইনশাল্লাহ যেখানে প্রাধান্য পাবে Spirit of law.
আমি নিজে রিসার্চ করতে ভালোবাসি বলে নিজের অজান্তেই হয়তো উপরের পয়েন্টগুলো সবই রিসার্চের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। ধরুন আপনার এমন দিকে ঝোঁক নাই। তাইলে শুধু ইসলামী আইনগুলো নিয়ে ভালোভাবে জানুন, সাথে সেই সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইনগুলো। এই আইনগুলা না জানার কারণে কত মেয়ে যে Domestic Abuse এর স্বীকার হচ্ছে আমাদের ধারণাও নাই। আজকাল প্রচুর ডিভোর্স হচ্ছে দ্বীনী সার্কেলেও এবং কারণগুলো অনেক সময়েই সঙ্গত। সেখানেও মেয়েদের অনেক হেল্প দরকার। মানুষের যে কী সীমাহীন অজ্ঞতা এসব ব্যাসিক ব্যাপারে তা মানুষের সাথে কথা না বললে বোঝা যায় না। শুধু ইসলামী আইন নিয়ে পড়লে আপনার যে প্রজ্ঞা তৈরি হবে তা অনেকাংশে বাড়বে যদি আপনি ঠিক মত প্রচলিত আইন নিয়ে পড়েন এবং তারপর ইসলামী আইন নিয়ে পড়েন। উত্তরাধিকার আইন নিয়ে পড়াশোনা থাকলে মানুষকে অনেক হেল্প করা যায়……The list can go on and on. এই সাহায্য করার জন্য আপনার পিএইচডি করতে হবে না, কোথাও চাকরি করতে হবে না……ছোট্ট বাচ্চার মা হলেও সমস্যা নেই। সপ্তাহে কিছুটা সময় দিবেন বোনদের সাথে স্কাইপে কিংবা অনলাইনে বা বাসাতে।মূল কথা হচ্ছে Let’s try to be people of impact. নিজে খাইলাম, ঘুমাইলাম, ক্যারিয়ার গড়লাম, মা-বাবা হইলাম, বাড়ি করলাম, গাড়ি করলাম, নাতি নাত্নীর মুখ দেখলাম তারপর বুড়া বয়সে হাজ্জ করলাম, দাড়ি রাখলাম, বোরখা পরলাম আর এমন বাচ্চা রেখে গেলাম যারা আমি মারা যাওয়ার পর হুজুর ডেকে কুরআন খতম দিলো আর এতিম খাওয়ায় দিলো- এই যে একটা বৃত্ত আমরা আমাদের চারপাশে অহরহ দেখি, সেটা থেকে আসুন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি, যেভাবে পারি।
পর্ব ৩
আমি যখন উচ্চশিক্ষার কথা বলেছি তখন ইচ্ছা করেই উদাহরণ হিসেবে আইন বিষয়টিকে রেখেছি। কারণ যারা মেয়েদের কো-এডুকেশনে পড়া এককথায় হারাম হিসেবে সাব্যস্ত করেন, তারা একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করেন মেয়েদের ডাক্তারী পড়া। তবে এক্ষেত্রেও আমি এক অদ্ভূত সাইকোলজি দেখতে পাই। দেখা যায় আমরা নিজের মেয়েকে ডাক্তারী পড়তে দিতে চাই না কিন্তু মেয়ে বা বউ এর জন্য ঠিকই মেয়ে ডাক্তার খুঁজি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে সেক্যুলার বা অন্য ধর্মের মেয়েরা যদি ডাক্তার হয় তাহলেই ঊনারা প্রয়োজনীয় সার্ভিসটা পেতে পারেন। এই যুক্তি শুনলে আমার মনে হয় যে আমরা মুসলিমরা এক অদ্ভূত সুপারিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগি। আমি যা নিজের জন্য পছন্দ করি না, তা সেক্যুলার/ নন-মুসলিম মেয়েদের জন্য চাই? আমি কি তাহলে কখনো চাই না যে তারা ইসলামের ছায়াতলে আসুক? সবচাইতে বড় কথা আমরা কি জানি যে ইসলামিক বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ‘প্র্যাক্টিসিং ডাক্তারদের’ মতামত লাগে? ধরুন আপনি একজন মেয়ে, আপনি দেখাচ্ছেন মেয়ে ডাক্তার, নন মুসলিম। এখন আপনার শারীরিক সমস্যায় আপনি রোযা রাখতে পারবেন কী না এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আপনার শুধু মুসলিম না বরং প্র্যাক্টিসিং ডাক্তারদের মতামত লাগবে। এটা Islam QA র ফতওয়া। আমি আমার নিজের জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, আমি জানি এই সময়ে কেমন অসহায় লাগে যদি ডাক্তার মুসলিম/ দ্বীন বোঝা না হয়।
যাই হোক, ডাক্তারী পেশার ব্যাপারে এই ভিন্ন চিন্তার কারণটা আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার না। কারণ গুনাহের দিক থেকে চিন্তা করলে মেডিক্যাল কারণে পরপুরুষ কোনো মেয়েকে স্পর্শ করবে, তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ দেখবে এর চেয়ে বহু গুণে বড় গুনাহ হচ্ছে সুদে লিপ্ত হওয়ার গুনাহ।আমার যুক্তি হচ্ছে মেয়েদের পর্দা রক্ষার নিয়্যতে কো-এডুকেশনে হলেও মেডিক্যালে পড়া যদি জায়েজ হয়, তাহলে মানুষকে/মেয়েদেরকে সুদের গুনাহ থেকে বাঁচানোর জন্য একজন মেয়ের অর্থনীতিতে পড়া জায়েজ হবে না কেন?
হয়তো বা পাল্টা যুক্তি আসবে যে মেয়েদের যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার দরকার নাই, তাই ওদের এই ব্যাপারে জানা অর্থহীন। ছেলেরা পড়বে এবং ছেলেরা ছেলেদের কাছ থেকে জানবে। আমি বিনয়ের সাথে এই যুক্তির সাথে দ্বিমত পোষণ করি কারণ সেটা বর্তমান বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। সুদের ব্যাপারে মেয়েদের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে সুদ ভিত্তিক সিস্টেম আমাদের দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তাছাড়া প্রতিটা ছেলে মাত্রই জানে যে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে মেয়েরা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে যদি ঠিকমত, সহজ ভাষায় এই সুদ ভিত্তিক সিস্টেমের রক্তচোষা রুপটা মেয়েদের কাছে বুঝানো যায় তাহলে ইসলামের বুঝ থাকুক বা না থাকুক, অধিকাংশ মেয়ে এটাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখবে। তাদের ঘৃণা ছেলেদের সুদভিত্তিক লেনদেন থেকে বিরত থাকার পথে এক বিশাল প্রেরণা হবে ইনশাল্লাহ। কল্পনা করুন একটি প্রজন্মের যেখানে মেয়েরা সুদী ব্যাংকে চাকরী করা ছেলেদের বিয়ের জন্য গণহারে প্রত্যাখ্যান করছে, ছেলের আয়ে যদি সুদ থাকে তাহলে মায়েরা তাঁকে দেয়া উপহার ফিরিয়ে দিচ্ছে, মেয়েরা বাবাকে ক্রমাগত বলছে বাবা সুদ থেকে ফিরে আসো। আমাদের মা, বোন, স্ত্রীরা যদি সুদ কোনটা সেটাই না চিনে, তাহলে কিভাবে তারা এই সামাজিক বিপ্লবটা ঘটাবে?
কিংবা ধরুন আপনি চরম মাত্রায় প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তখন কার কাছে যাবেন? পুরুষ কাউন্সেলরের কাছে? সে কি কোনোদিনও এই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে গেছেন? চিকিৎসার মনস্তাত্বিক দিকটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন নারী কাউন্সেলর যদি আপনার হাত ধরে মোলায়েম স্বরে বলে আমি নিজে জানি এই সময়টা কী তীব্র কষ্টের তখন রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা যে কতটা ত্বরান্বিত হবে তা কি আমরা বুঝি? সেক্যুলার নারী কাউন্সেলরদের দিয়েও কি এই সার্ভিস পাওয়া সম্ভব? সে আপনাকে কোনোদিনও বলবে যে মন খুব খারাপ থাকলে একটু কুরআন শুনেন? নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে বলবে?
প্রত্যেকটা ফিল্ডের ব্যাপারে আসলে এমন উদাহরণ দেয়া যায়। সাইক্যোলজি, এডুকেশন, মার্কেটিং, ডাটা সাইন্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি। ইসলামের একটা সৌন্দর্য্য হচ্ছে যে মোটামুটি সব ফিল্ডের জ্ঞানকেই ইবাদাতে পরিণত করার সুযোগ আছে। একটা উদাহরণ দেই। সাহাবীদের উপরে একটা লেকচার সিরিজে শুনছিলাম যে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তৎকালীন আরবদের মাঝে সবচেয়ে বড় genealogist ছিলেন। Genealogy is the study of lineage. বংশ নিয়ে, সোজা বাংলায় চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে পড়াশোনা। বক্তা সেখানে বলছিলেন যে এই সাব্জেক্টটা সেক্যুলার এবং ইসলামিক দুই ক্ষেত্রেই একটা মিসিং ব্রাঞ্চ এখন। শুনে আমি একটু অবাক হইসিলাম। ইসলামিক এত শাখা থাকতে Genealogy নিয়ে পড়ার কি দরকার? আমাদেরতো এখন আরবদের মত এত গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা না যে গোত্রের ইতিহাস দাওয়াতী কাজে লাগবে। ২দিনের মাঝেই উত্তর পেলাম একটা ফেসবুক পোস্ট থেকে যাতে মুহাম্মাদ আসাদ (বিখ্যাত Road to Mecca বইটার লেখক) এর সাথে Dr Chaim Weizmann (ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট) এর একটা কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। মুহাম্মাদ আসাদ সেখানে প্যালেস্টাইনের উপর ইহুদীদের অধিকারের হাস্যকর যুক্তি খণ্ডন করেছেন ইহুদীদের বংশ লতিকার উপর জ্ঞান দিয়ে। চিন্তা করুন, Genealogy র মত একটা বিষয়কে আজকের সময়ে ইসলামের খেদমতে কাজে লাগানো সম্ভব।
তাহলে আগে যেগুলোর কথা উল্লেখ করলাম সেগুলো কত দারুণ ভাবে সম্ভব! সত্যি কথা বলতে কী দুনিয়াবী শিক্ষার সংজ্ঞাই আমার কাছে ক্লিয়ার না। আম
February 13, 2022
সেতু বন্ধনের গল্প- ৫ম পর্ব

৫ম পর্বের অতিথি পরিচিতি
এবারের পর্বের ১ম অতিথি, সুমাইয়া, আমাদের সমাজের তথাকথিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী স্রেফ ‘HSC pass’. অথচ যে কোনো একটা বিষয় বিভিন্ন angle থেকে দেখে একটা wholistic perspective দিতে পারার দারুণ ক্ষমতা তার।
সুমাইয়ার জীবনের গল্প একদিক দেখতে গেলে কিছুটা হতাশাজনক। এত ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে, অথচ তার কিনা এখনও ইউনিভার্সিটি লেভেলের কোনো ডিগ্রি নাই, তিন বাচ্চা নিয়ে ‘ঘরে বসে ‘ আছে! ঠিক আরেক লেন্স দিয়ে দেখলেই সুমাইয়ার জীবন দারুণ fascinating একটা অভিজ্ঞতা। সেই লেন্সটাই promote করতে চেয়েছি আমরা।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। সুমাইয়ার তিন বাচ্চাকেই দুনিয়াতে আনার জন্য ওকে রীতিমত বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রেগন্যান্সিতে ওর Hyperemesis gravidarum হয়, মানে তীব্র বমি (দিনে সর্বোচ্চ ৩০বারের অভিজ্ঞতা আছে), ওজন কমে যাওয়া ( ১ম Trimester এ ১৩ কেজি পর্যন্ত)। ও প্রথম ৫ মাস বিছানায় পরে যায় একদম। হসপিটালে ভর্তি হওয়া, বাসায় IV ফ্লুইড নেয়া এগুলো ওর গর্ভকালীন সময়ের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। সাথে ছিল আরেক শারীরিক অসুস্থতা যাতে কিছুদিন পরপরই ওর গলা বন্ধ হয়ে যেত, চিকিৎসা ছিল ভয়েস রেস্ট। সেই মেয়েটা যখন একজন উস্তাদের কাছ থেকে Ijaazah নিয়েছে Riwaayah of Hafs from Aasim, tareeq Shaatibi এর উপর, Variant readings of the Qur’aan ( 10টা) এর উপর কোর্স শেষ করছে, এখন আবার এক দশকের বেশি সময় পরে arabic এ অনার্স শুরু করেছে তখন ওর passion টা কি অনুভব করতে পারছি আমরা?
সুমাইয়া ওর জীবনের নিয়ামত, ওর আগ্রহের ফিল্ড এগুলো চিনতে একটু দেরিই করে ফেলেছিল। ওর সেই ভুলগুলোর সুবিধাভোগী হতে চাই আমরা। ওর জীবনের গল্প থেকে শিখতে চাই যে কিভাবে কৃতজ্ঞ চিত্তে নিজের ভুলগুলো নিয়ে কথা বলতে হয়। মানে যা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, তবে….অমুক অমুক বিষয়গুলো আগে বুঝলে হয়তো চলার পথে হোচট আরও কম খেতাম। সেই গল্প শুনে কিছু বোনের জীবন যদি মসৃণ হয় তবেই সেটাই বা কম পাওয়া কী!
এই পর্বের ২য় অতিথি মাহসিনা মমতাজ মারিয়া ’এডুকেশন এবং ট্রেনিং কনসালট্যান্ট’ হিসেবে অনলাইনে ও অফলাইনে মেয়েদের মাঝে কাজ করেন আলহামদুলিল্লাহ। এর আগে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে।
সুমাইয়ার মতো মারিয়া আপুরও এইচএসসি পরীক্ষার পর পরই সংসার জীবন শুরু। কিন্তু বিয়ের পরের গল্পটা দুইজনের দুই রকম। মারিয়া আপুর পড়াশোনা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নাই আলহামদুলিল্লাহ, এ ব্যাপারে জীবন সঙ্গীর অবদান নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন আপু। কিন্তু মাতৃত্ব? সেটার স্বাদ পেতে আপুকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বিয়ের পর দীর্ঘ ১১ বছর, আলহামদুলিল্লাহ!
আপুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম সেই সময়ের অনুভূতি। আপুর বক্তব্য কী ছিল শুনবেন?
”বড়দের কথা শুনে মনে হতো খুব দুশ্চিন্তা মনে হয় করা উচিত, কিন্তু আমাদের কোনো দুশিন্তা আসতো না। পারিবারিক চাপে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, তারপর সব যখন বন্ধ করেছি, তারও ৫ বছর পর মা হতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর এক বিশেষ মিরাক্যল সেটা আমার জন্য। মানুষের কথা শুনে হয়তো মাঝে মাঝে কান্নাকাটি করেছি, কিন্তু ঐটুকুই। তারপর ডুবে গেছি নিজের কাজে।”
জীবনটা এমনই। কিছু প্রাপ্তি, কিছু অপ্রাপ্তি। জীবনে পাওয়া, না পাওয়ার হিসাব যদি মিলাতে চাই, হিসাব মিলাতে মিলাতেই মালাকুল মওত (মৃত্যুর ফেরেশতা) চলে আসবে, কিছু আর করা হবে না। জীবনটা আসলে একটা ডেডলাইন। টিক টিক করে সময় চলে যাচ্ছে। সঞ্চয় গড়তে হবে আখিরাত এর জন্য। এখনই।
মারিয়া আপুর নিজের জীবনের গল্প ছাড়াও ভান্ডারে আছে দারুণ দারুণ সব কেস স্টাডি। আমরা উনার অভিজ্ঞতা থেকে সমৃদ্ধ হতে চেয়েছি।
আমরা মেয়েরা আজকাল নানা ধরনের স্ট্রাগল এর মধ্যে দিয়ে যাই। কেউ সন্তান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, কেউ বাচ্চা হচ্ছে না বলে। কেউ ঘরে থাকা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে, কেউ ঘর, বাহির সামলাতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলছে। আমরা– যে জীবনের যেই অবস্থানেই আছি না কেন, আমার মনে হয় যে আমাদের দরকার একটা Empathatic Ear যে আমাদের ইতিবাচক কথা বলবে, আমাদের দুর্বলতা গুলো নয়, বরং শক্তিগুলোর উপর ফোকাস করবে। একজন ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে মারিয়া আপু এই কাজাটই করেন।
সেতু বন্ধনের গল্প- ৪র্থ পর্ব
৪র্থ পর্বের অতিথি পরিচিতি
এবারের অতিথি দুইজনেরই ব্যাচেলর করেছেন কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ। কিন্তু বরাবরের মতোই তাদের এখনকার পথ আলাদা, তাই তাদেরকে একসাথে আনা।
উম্মে ইব্রাহিম আপু কিছুদিন উনার ফিল্ডে চাকরি করলেও পরে উপলব্ধি করেন যে ওটাতে মন টানছে না আর। ফিল্ড বদলিয়ে Higher Education কে বেছে নেন, International Open University (IOU) থেকে দ্রুততম সময়ে Bachelor of Arts in Islamic Studies (BAIS) ও Master of Arts in Islamic Studies (MAIS) সম্পন্ন করেন। সমসাময়িক সময়ে ড: আকরাম নদভী পরিচালিত কেমব্রিজ ইসলামিক কলেজ থেকে দুটো ডিপ্লোমাও শেষ করেন আলহামদুলিল্লাহ।
IOU তে ব্যাচেলর করার সময়ই সেখানে ভলান্টিয়ার হিসেবে বিভিন্ন কাজে যোগ দেন, সেটার মাধ্যমেই IOU Global এর সাথে কাজ করার সুযোগ মেলে। সেখানে Higher Education Administration এ আসলে কী ধরনের কাজ হয়, আরো কী কী কাজের সুযোগ আছে সেগুলোও আপু ব্যাখ্যা করেন ওয়েবিনারের সময়। সে এক এক অজানা অধ্যায় আমাদের অনেকের জন্য।
আমরা যখন একটা ইউনিভার্সিটির কথা ভাবি সবার আগে ফ্যাকাল্টিদের কথাই মনে হয় শুধু। কিন্তু তারা আসলে বিশাল কর্মযজ্ঞের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। Admission, Credit Transfer, Graduation, Student Counseling, Proctoring, Help Desk এ নানা তথ্য দেয়া, Payment Processing, Accreditation, Exemption Portal দেখা কত ধরনের যে কাজ!
IOU তে কাজ করার সময়ই আপু আবিষ্কার করেন যে Higher Education Management, Policy, Quality Assurance, Governance এগুলোতে দারুন আগ্রহ পাচ্ছেন। এই ফিল্ডে মাস্টার্স এর সুযোগ খুঁজছিলেন,মনমত পাচ্ছিলেন না। আল্লাহ, আল ফাত্তাহ (The opener of the door) সুযোগ করে দিলেন। ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ন, যেটা তখন বিশ্ব রাঙ্কিং এ শীর্ষ পাঁচ এ অবস্থান করছিল, সেখানে Tertiary Education Management (খুব দূর্লভ একটা সাবজেক্ট) এ প্রথমে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন, তারপর মাস্টার্স সম্পন্ন করলেন সম্পূর্ন অনলাইনে (প্রোগ্রামটা অফারই করা হয় এভাবে), আলহামদুলিল্লাহ।
উম্ম ইব্রাহিম আপুর এই ফিল্ডে রিসার্চেরও আগ্রহ আছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পেপার উপস্থাপনা করেছেন।
আচ্ছা এইটুকু পড়ে কি মনে হচ্ছে যে আপুর জীবনে সব কিছু ঠিকঠাক ছিল তাই এত কিছু করার সুযোগ পেয়েছেন? নাহ, এই সব কাজের অনেক কিছুই ছিলো বিয়ের পর, back to back 2টা বাচ্চাকে নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ। এসব রেগুলার চ্যালেঞ্জ ছাড়াও আপুর জীবনের বহু উত্থান পতন রয়েছে। আপু বরং পড়া, কাজ এইসব কিছুকে coping mechanism হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জীবনে যখন আর কোনো কিছু ঠিকমত যাচ্ছিল না, তখনও পড়াটা যেন ঠিক থাকে সেই চেষ্টা করেছেন। যা কিছু করেন, তীব্র ভালোবাসা নিয়ে করেন বলেই প্রতিদিনের জীবনের অসংখ্য ব্যর্থতা, চ্যালেঞ্জ, হতাশাকে অতিক্রম করে ফিনিক্স পাখির মত ধ্বংসাবশেষ থেকে বারবার উঠে দাঁড়াতে পারেন আলহামদুলিল্লাহ, বারাকাল্লাহু ফী হা।
আপুর কাছ থেকে এইসব diverse অভিজ্ঞতা, প্রোডাক্টিভিটি টিপস, একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠানে এত বছর ধরে কাজ করে পাওয়া উপলব্ধি সব কিছু জেনেছি এই পর্ব থেকে।
আরেকজন অতিথি উম্ম মারইয়াম। আমাদের অধিকাংশের মত ওর বেড়ে ওঠাও মধ্যবিত্ত, রক্ষণশীল পরিবারে। একসময় ভার্সিটিতে প্র্যাক্টিসিং এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে সত্যিকারের ইসলামের রূপের সাথে পরিচিত হলো, সেই অভিজ্ঞতায় রীতিমত অবাক হবার পালা।নতুন আবিষ্কৃত জগতে একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগল সে।
ইসলাম নিয়ে যেসব প্রশ্ন ছিল যেগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য ও বেছে নিয়েছিল একটা অসাধারণ বিশ্লেষণী মেথড – proof by contradiction। যেমন ফ্রি মিক্সিং কেন হারাম।চিন্তা আসলো হারাম না হলে কী হত। ইসলামের বিধান ছাড়া অন্য কোনভাবে কি যেকোন সমস্যার সমাধান করা যায় ? চিন্তা করত…… কিছুতেই মিলাতে পারতনা।একসময় উম্ম মারইয়াম নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে মেনে চলি আর না চলি, ইসলামই সত্য। এই প্রক্রিয়ার মাঝেই নামাজে রেগুলার হয়ে গেল, শুরু হল পর্দা করে চলা। এভাবেই ইসলামের পথে চলা শুরু
।
ভালো ছাত্রী হিসেবে, মা-বাবার অনুগত সন্তান হিসেবে দারুন সুনাম ছিল পরিবারে। তাই তার ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে পরিবারের সাপোর্ট মোটামুটি পেয়েছে বলা যায়।
খুব ভালো রেজাল্ট করে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে উম্ম মারইয়াম। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ দ্বীন পালনের জন্য অনুকূল মনে হচ্ছিল না,তাই সরে আসে, বেছে নেয় একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি যেটাতে ঘরে বসেই কাজ করা সম্ভব।
ঠিক এইসময়েই জীবনে কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। সরলরেখায় চলা জীবনটাতে ঘটে হঠাৎ ছন্দপতন। সমাজের চোখে ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত এমন কিছু অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যাওয়ার পর উম্ম মারইয়াম টের পেলো তাকে নিয়ে সবার মাঝে তীব্র অসন্তোষ, অথচ একসময় সে ছিল সবার আশার আলো! দ্বীনের পথে থেকে কিভাবে পরিবারকে বোঝানো যায় যে তার জীবনে সব শেষ না!?
সিদ্ধান্ত নিলো জব এর পাশাপাশি রিসার্চ শুরু করার কারণ এটাই একমাত্র কাজ যা ঘরে বসে জবের পাশাপাশিও করা সম্ভব। ডিপার্টমেন্টের একজন বেশ রিলিজিয়াস প্রফেসর যিনি কিনা হাজ্জ সম্পর্কিত কিছু কাজ করেছেন বলে শুনেছিল, তার সাথে যোগাযোগ করল। কথা প্রসঙ্গে সে জানাল যে ওর নিজের ফোকাস দ্বীন পালনে, কিন্তু সবাই আশা করে ক্যারিয়ারগত সাফল্য। প্রফেসর ওকে একটা জীবন বদলে দেয়া প্রশ্ন করলেন – কেন তুমি তোমার দ্বীন পালন এবং পেশাগত দক্ষতাকে মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছ? এরা কি একে অন্যের পরিপূরক হতে পারে না? (Why are you making your deen and career orthogonal? Align them! )
আলহামদুলিল্লাহ, একটা বাক্য, একজন শিক্ষকের মুখে, ব্যস শুরু হয়ে গেলো জীবনের একটা সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের, আমরা পেয়ে গেলাম এমন একজনকে যার মাথায় এখন সারাক্ষণ কিলবিল করতে থাকে অজস্র আইডিয়া আলহামদুলিল্লাহ। উম্ম মারইয়াম যেসব প্রজেক্ট কাজ করছে এবং করতে চায় কিন্তু উপযুক্ত সময় আর লোকবলের অভাবে করতে পারছে না সেগুলো সত্যি অসাধারণ।
নুসাইবা বিনতে কা’আব (রাঃ): ইসলামের প্রথম নারী যোদ্ধা

নুসাইবা বিনতে কা’আব (রাঃ) ছিলেন ইসলামের প্রথম নারী যোদ্ধা, যিনি নবী করিম (সাঃ) এর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন। মাত্র দু’জন নারী ব্যক্তিগতভাবে রাসূল (সাঃ) এর নিকট থেকে সরাসরি কালিমার শপথ গ্রহণ করেন। নুসাইবা ( রা:)ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি সম্ভ্রান্ত, সাহসী ও ছকে বাঁধা চিন্তাধারা থেকে মুক্ত একজন সপ্রতিভ নারী ছিলেন যিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, নতুন একটি ধর্মকে রক্ষা করার জন্যে মুসলিম নারীদেরও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তাই তিনি বিভিন্ন যুদ্ধের ময়দানে সশরীরে উপস্থিত থাকতেন। তিনি উহুদ, আক্বাবাহ্, আল-হুদাইবিয়্যাহ, খায়বার, হুনাইন, ইয়ামামার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে উহুদের যুদ্ধে তিনি যেভাবে মানব বর্মের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা:)কে রক্ষা করেন তা ছিল নারীদের জন্য একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।
উহুদের যুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি অন্যান্য নারীদের মতো তৃষ্ণার্ত সৈন্যদের জন্যে পানি আনা-নেওয়া এবং আহতদের সেবাযত্ন করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধের ফলাফল যখন মুসলিমদের অনুকুলে আসতে শুরু করে তখন সৈন্যরা নবীজির নির্দেশ অমান্য করে বসলো। ফলে কাঙ্খিত জয় পরাজয়ে রূপ নিতে লাগল। লোকজন নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো। এমনকি মহানবী (সা:) অরক্ষিত হয়ে পড়লেন। এমন সময়ে নুসাইবা (রা:) এক হাতে উন্মুক্ত তরবারি আর অন্য হাতে ঢাল নিয়ে এগিয়ে এলেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে কাফেরদের তীরের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্যে লড়াই করতে থাকা ছোট দলটির সাথে তিনি যোগ দিলেন। নুসাইবা একজন শত্রুর দ্বারা ঘাড়ে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পরও যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলেন না। বরং যতবার যতদিক থেকে নবীজির ওপর আক্রমণ এসেছে তিনি সেদিকেই তরবারি হাতে তা প্রতিহত করতে ছুটে গিয়েছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিষয়টি লক্ষ করেন এবং পরবর্তীতে বলেন, “ডানে, বামে যেদিকেই আমি তাকিয়েছি, দেখেছি নুসাইবা আমার জন্যে লড়াই করে চলেছেন। তিনি অনেক পুরুষ যোদ্ধাদের থেকেও ভালো লড়াই করেছেন।” শুধু তাই নয়, তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দুআ করে বলেন, “হে আল্লাহ, তুমি নুসাইবা ও তাঁর পরিবারকে আমার জান্নাতের সঙ্গী বানিয়ে দাও।”
এই দুআ শুনে নুসাইবা (রা;) বলে উঠলেন, “দুনিয়ার আর কোনো কিছুতে আমার কিছু যায় আসে না।” এভাবেই ইসলাম এবং তাঁর নবীকে রক্ষা করার বিনিময়ে তিনি ইহলৌকিক কোন কিছু প্রত্যাশা করেননি বরং পারলৌকিক লাভকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
উহুদের যুদ্ধে তিনি মোট ১৩টি স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং তাঁর ঘাড়ের ক্ষত সারতে প্রায় ১ বছর সময় লাগে। এরপরও তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে বিরত ছিলেন না। ইয়ামামার যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি ১১টি স্থানে আঘাত পান এবং একটি হাত হারান।
নুসাইবা (রা:) উমার বিন আল খাত্তাবের খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সাহাবীরা সবাই তাঁকে তাঁর সাহসিকতার জন্য অত্যন্ত সম্মান করতেন। একবার উমার (রাঃ) এর নিকট বাইরের দেশ থেকে একটি উপহার আসে। উপহারটি ছিল মূলত অত্যন্ত মূল্যবান রেশমের তৈরি এক টুকরো কাপড় । উপস্থিত সাহাবীরা উপহারটি খলিফার কন্যা বা পুত্রবধূকে পাঠিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। উমার ( রা:)দুইটি প্রস্তাব-ই নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, এই উপহারটির দাবিদার কেবল একজন নারী এবং তিনি হলেন নুসাইবা (রা;)। এরপর তিনি তা নুসাইবাকে পাঠিয়ে দেন।
নুসাইবা (রা:)কোনো সৌন্দর্য সর্বস্ব বা দুর্বল ব্যক্তিত্বের নারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ক্ষীপ্রতার সাথে তরবারি চালাতে সক্ষম একজন অকুতোভয় যোদ্ধা, যিনি মাথা উঁচু করে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন যুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। তাঁর এই অবদান তাঁকে আজও ইসলামের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র মর্যাদার আসনে আসীন করে রেখেছে।
অনুবাদক: শারিকা হাসান
তথ্যসূত্র: https://hamariweb.com/articles/120426
https://sunnahonline.com/library/history-of-islam/357-umm-umara-the-prophets-shield-at-uhud
Hamida Mubasshera's Blog
- Hamida Mubasshera's profile
- 16 followers
