Saifuddin Rajib's Blog - Posts Tagged "উপন-য-স"

যে রূপকল্পের গল্প গেঁথেছিলাম 'নিঃশব্দ' উপন্যাসে।

স্রোতস্বতী ইছামতী।
অদৃশ্য কাঁটাতারে আঁটকা দুই তীরের মানুষ। বিবর্ণ মুখশ্রী আকাশের মেঘ খোঁজে। ভুভুক্ষের মত বিস্ময়ে চেয়ে আছে ওপারে। যেন ডানা থাকলেই এই মুহুর্তে উড়ে যাবে। তাদের চেয়ে থাকাটা যতটা পেটের খিদেয়, তার চেয়ে আঁটকে পড়ায় অথবা নিজেকে পরাধীনতায় আঁটকে রাখায়। সেই আঁটকে থাকার নানা কারণ থাকতে পারে। তবুও কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে শত বছরের ভিটে ছেড়ে যে মানুষ নির্বাসিত হয় জীবনের খোঁজে, সে জীবনের অন্তরালে নিশ্চই কিছু কষ্ট থাকে, চাপা দুঃখ থাকে। না পাওয়া অথবা আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ থাকে, নিদেনপক্ষে নতুন জায়গায় বেঁচে থাকার আশা থাকে। যা প্রত্যেকটাই একএকটা হাসিকান্নার গল্প। নিঃশব্দ সেইসব গল্পেরই সুতোয় বোনা উপন্যাস।

দুটি দেশকে কলমের খোচায় ভাগ করার সময় সিরিল র‌্যাডক্লিফ কি বুঝেছিলেন একটা দেহ ভাগ হয়ে যাচ্ছে! যার ক্ষত প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়াবে। সেই কলমের দাগেরই একটি অংশ ইছামতী। নিঃশব্দ উপন্যাসটির চিত্রপটের যে ভাগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা একঅর্থে এই নদীতীরের জনপদের গল্পকে ঘিরেই। ইছামতীকে ঘিরে যখন 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটির প্লট ঘুরছিল তখনো বিভূতিভূষণ রচনা নিয়ে কিঞ্চিৎ আগ্রহও জমেনি। অথচ বিস্ময়ের কথা হল, এই গল্পটা ছাপার অক্ষরে লেখা হয়ে ওঠা উচিৎ, সেই ভাবনা প্রথম আসে সেদিন আমি পশ্চিমবঙ্গের বনগা'র অদুরে গোপালনগরে বিভূতিভূষণ স্মৃতি জাদুঘরে। সংকীর্ণ ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখেছি বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিভূতিভূষণের সেই ইছামতীর ছোট্ট শাখাটির স্রোতহীন মৃত্যুপ্রায় চিত্র। যদিও তখন আমার মাঝে বসিরহাট, হাসনাবাদ জনপদের চিত্র ভাসছে।

লেখনশৈলী কেমন সেটা সময় বলুক। কিন্তু 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটি যে চিত্রপটের শব্দযোগে একত্র হয়েছে তা কি বলতে চেয়েছে?
ষাটোর্ধ ভারতী দেবী যখন বাঁচার জন্য মাত্র একবেলা হলেও খেয়ে থাকার প্রয়াসে সংগ্রাম করেছেন, তখনই শুরু হয়েছিলো সেই গল্প। যে গল্পে, স্বামী হারিয়েছেন। বিকলাঙ্গ ভাই ও তার স্ত্রী'কে দেখেছেন অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করতে। নিজের তিন সন্তানের একে একে দূরে সরে যাওয়া দেখেছেন অশ্রুশূন্য চোখে! যে অভাবকে জয় করার তাগিদে সংগ্রাম করেছিলেন তা কখনো থামাতে পারেননি। নিঃশব্দ' উপন্যাস একজন ভারতী দেবীর কথা বলেছে ঠিক, কিন্তু সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতে নির্বাসিত এমন বহু হিন্দু-মুসলিম সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সংগ্রাম করে চলেছেন। জাতিসত্ত্বা ত্যাগ করে গিয়েও হয়ে আছেন পরিচয়হীন।

ভারতী দেবীর বাকী গল্প নাহয় 'নিঃশব্দ' উপন্যাসই করুক।
আশির দশকের শেষ সময়, এবড়েথেবড়ো কলুষিত রাজনীতির মাঝেও অনিন্দ্য সুন্দর সবুজাভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রিমঝিম বরষার প্রতিটা ফোঁটার একটা অর্থ, সেই অর্থ যেন একটি একটি গল্প রচনা করে। সেই গল্প কখনো প্রেম কখনো সামাজিক ধর্মীয় অবক্ষয় উত্তরণের চিত্র। প্রাণের ক্যাম্পাস, প্রতিটা হল থেকে তখন নতুন সাজানো গোছানো দেশের স্বপ্ন দেখে একএকজন তরুণ। সোমনাথ তেমনই কেউ, কোটালিপাড়ার প্রায় সারাবছর পানিতে ডুবে থাকা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল দেশসেরা বিদ্যাপিঠে শিক্ষা নিয়ে দেশ সেবার প্রয়াস নিয়ে। কিন্তু কতটা পেরেছিল সে? যে দেশ থেকে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, সেখানেই আপন বিশ্বাসে মা মাটিকে ছেড়ে নিজ সন্তানকে নিয়ে দেশ ছাড়েননি বাবা সৌমেন বিশ্বাস। সব গল্পেরই দুটো দিক থাকে, নিঃশব্দে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষদের ভিড়ে এমনসব মানুষের গল্পও করা হয়েছে যারা বাপ-দাদার ভিটেকে অস্বীকার করেনি। বরং গর্বের সাথে মাথা উচু করে আছে।

নিঃশব্দ একটা পরিবার দেখিয়েছে, বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রাম। ধর্মীয় সম্প্রীতির রূপক কবিরাজি টোটকা যেন মোজাফফর সরদারের পরিবার। যে পরিবারে সৌমেন বিশ্বাস হয়ে উঠেছিলেন রক্তের সম্পর্কের উপরের কোন রূপরেখায়। কিন্তু নিঃশ্বাস তাকে থামিয়ে দিয়েছে মাঝ পথেই। দিশেহারা পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো সৌমেন তনয় সোমনাথ। যে রক্ত সৌমেনকে মিশিয়েছিল আত্মিক বন্ধনে সেখানেই যেন পরিবার নামের আসল অর্থ বুঝতে পারে বাবা-মা'হীন সোমনাথ। সব গল্পেই থাকে বিচিত্র মানুষের পদচারণা, এই গল্পে সেটা ছিল ভরপুর!

তারপর?
মানুষের সব চাওয়া যেন পূরণ হবার নয়, কিন্তু নাসিমার যে সেটা পূরণ করতেই চাই! যে মানুষটাকে একটা সময় সে পছন্দই করেনি, এমনকী মানুষটা কখনো তাকে ভাবনার আবেশে বাধার ইঙ্গিত পর্যন্ত দেয়নি তাকেই কিনা জয় করেছে জোর করে! কিছু জোর টিকে যায় সম্মানে, শ্রদ্ধায় সোমনাথ যে ঠেলে ফেলতে পারেনি! আর এভাবেইতো গল্প হয়, জয় করার গল্প। নিজেকে মিশিয়ে নেবার গল্প। নিঃশব্দ উপন্যাস সেইগল্পকে বলেছে ধীরে ধীরে। নিঃশব্দ গল্পের সেই প্রধানচরিত্র অপুর জন্ম হয়েছিলো, দিনকয়েকের মাঝেই বন্যায় ডুবে যায় ঢাকা শহরসহ সারা দেশ। তাহলে কি অপু এমন কিছু নিয়ে এসেছিল যা হবার নয়? কিন্তু যে শিশুর চোখ এত মায়াবী, চেহারায় যেন নির্ভার হাঁসি তার তরে এমন কেন হবে! তবে হয়েছিলো, হারিয়েছে সবকিছু, এক অদৃশ্য ঝড় একে একে আলাদা করেছে নাসিমা-সোমনাথকে। শিশুটিকে বাঁচানোর তাগিদে দেশ ছারটে বাধ্য হয় সোমনাথ।

বলেছিলাম দেশ ছাড়ার গল্প, এমনও বহু কারণেই কোটি কোটি মানুষ দেশ ছেড়েছে। সোমনাথ যেমন আটমাসের শিশুসন্তানকে কলা গাছের ভেলায় চড়ে ইছামতী পার হয়েছে শীতের রাতের অন্ধকারে, তেমনি সুকুমার সদ্য প্রয়াত স্কুল শিক্ষক বাবার অর্জিত সমস্ত অর্থসহ নিয়ে মা'কে সাথে নিয়ে দেশ ছেড়েছে সমৃদ্ধির আসায়, অথচ দেশ তার পরিবারকে কম কিছু দেয়নি। অর্থ সম্মান সব। মায়ের ইচ্ছেতে দেশ ছেড়েও সুকুমার মাথা নিচু করেই দিন কাটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাটে।

গল্পের মাঝের কোন চরিত্র নিধি, পিরোজপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মেয়ে নিধি ছিল কবিতার পাগল। যখন অপ্রাপ্ত বয়সেই আশেপাশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, নিধি কলুষিত সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে এসেছিল ঢাকায়। তবে হেরে যায় সেই সমাজের কাছে। সোমনাথের সাথে বৃষ্টিময় ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে উঠতে তা যেন হারিয়ে যায়। হিন্দু ধর্মের জাতপাত ভেঙে যে মানুষদুটো ভবিষ্যতের রুপকল্প এঁকেছিল তা থমকে যায় রক্তের বন্ধনের দায়বদ্ধতায়। তারপর? বেশ কয়েক বছর পরেই নিধির খোঁজ মেলে খুলনার ডুমুরিয়াতে। কিছু ভুল হয় ক্ষমা নামক শব্দটাকে চেনাতে, কিছু ভুল সমাজকে এমন কিছু বার্তা দিয়ে যায়, যা হয় অনুকরণীয়। নিধি সেই শিল্পী যে নিজের মত এঁকেছেন দায়বদ্ধতার সামাজিক শিল্পকর্ম।

কেন হল, 'নিঃশব্দ' নামকরণ। নব্বইয়ের দশকে হটাত হটাত অজানা রোগ এসে হানা দেয়। অপু যেন সবকিছু ডেকে এনেছিল, বাবা-মায়ের অবর্তমানে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। অতঃপর, হারিয়ে ফেলে কথা বলার শক্তি। শুরু হয় আড়াই বছর বয়সের শিশুর উপর কলুষিত সমাজের অত্যাচারের রূপপদ্য। সেই কথা বলতে না পারা শিশুটিকে ঘিরেইতো উপন্যাস। কোন না কোন ভাবে প্রত্যেক চরিত্র জড়িয়ে আছে তার সাথে, অথবা জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এত এত চরিত্রের ভিড়ে এমন কিছু মানুষের গল্প উপন্যাসে উঠে এসেছে মুহুর্তেই মনে হবে, এইতো এটা আমি। সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চরিত্রগুলোকে একত্র করে নির্মিত উপন্যাসটিতে কোন অপ্রয়োজনীয় চরিত্রর খোঁজ মিলবে না। আমি দৃশ্যপটের কথা বলতে চেয়েছি। চরিত্রের কথা বলতে চেয়েছি, সমাজের কথা বলেছি, সেখানে সাহিত্য কতটা উজ্জবিত ছিল জানিনা, তবে চারপাশের সমাজের সেই সকল গল্প যেন আমাদের জানা উচিৎ, সে গল্পে অন্তর্দন্দ্ব যেমন থাকে, থাকে সমস্যা অতঃপর সমাধানের রূপ চিত্র। প্রতিটা চরিত্র কিছু বলতে চেয়েছে, কিছু বোঝাতে চেয়েছে। ভুল করেছে অতঃপর সুধরে নিয়েছে।
নিঃশব্দ পাঠক হৃদয়ে কেমন সাড়া ফেলবে জানিনা, তবে যে চরিত্রগুলো উপন্যাসে কথা বলেছে তা যেন পাঠক বুঝতে চেষ্টা করে। নিঃশব্দ যেন একবার নয় বরং বারবার পড়ার মত উপন্যাস হয়ে ওঠে সেই প্রয়াস ছিল।
1 like ·   •  2 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on January 11, 2018 16:25 Tags: উপন-য-স, ন-শব-দ, ব-ল, স-হ-ত-য