Saifuddin Rajib's Blog
March 22, 2018
শুদ্ধ রিভিউ - পাঠক সমালোচকের সততা!
আন্তর্জালের প্রসারিত ধারায় পাঠক কাগজ পড়ে কম। লেখাপড়ার এহেন সহজলভ্যতা ও উন্নয়নে সামগ্রিক অগ্রযাত্রা যেমন প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি মানসম্মত শিক্ষা ও চেতনায় সন্দেহ থেকে যায়। দিন শেষে কি দেখছি, কতটা শিখছি সেটা বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আসে চোখের সামনে। বইমেলা হচ্ছে, বই বাড়ছে। পাঠকও বাড়ছে। আশার কথার সাথে সাথে কিছু হতাশা হল শেখার জন্য যে বই তা থেকে কতটা জানতে পারছি, শিখতে পারছি!
পড়া আর জানার পরে যে বিষয় থাকে তা হল শিক্ষা। শিক্ষার ক্ষেত্রটা খুব বেশি পরিষ্কার হয় তখন যখন ক্ষেত্র নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়, ভুলগুলো নিয়ে সমালোচনা হয়। এতে লেখক ও পাঠক দুই পক্ষই শিক্ষা চেতনায় নিজেকে শানিত করতে পারে। সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু বর্তমান ভেসে বেড়ানো সমালোচনায় সেগুলোর দেখা মেলে যথাকিঞ্চিৎ। এহেন সমালোচনা কখনো নিন্দার আকার ধারণ করে সৃষ্টিকে অপমানিত করে। আবার অহেতুক প্রশংসাও শিক্ষাকে ছিটকে ফেলে, জানার পথকে সংকির্ণ করে। তাই সমালোচকদের হতে হয় স্পষ্ট ও দীপ্ত। কালে কালে বহু গুণী লেখকগণও সাহিত্য সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছেন। নির্মোহ সমালোচক হয়েছেন, দোষ গুন নিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর আলোচনা করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'পথের পাঁচালী' নিয়ে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা রিভিউ লিখেছিলেন। জীবনের শেষ বয়সে বিভূতিবাবু পত্রমারফৎ রবিঠাকুরকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন তার বইটি নিয়ে কিছু লেখেন। অর্থাৎ সমালোচনা। পরে স্থূল সমালোচনার সাথে চমৎকার প্রশংসাসহ পরিচয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো সেই রিভিউ।
বুঝতে পারা যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বই পাঠাবার পরেও তার অসাধারণ সৃষ্টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি স্থূল সমালোচনা করেছেন।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ধারাবাহিকভাবে ‘পালামৌ লিখছিলেন হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওনাকে চিঠি লিখে বসলেন। চিঠিটি খুব গভীরভাবে নেড়ে চেড়ে দেখলেন, হ্যাঁ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চিঠি! পড়ার পরে সঞ্জীবচন্দ্র দুটো বিষয় ভেবেছিলেন, এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা পড়েন। এবং শুধু আনন্দ নিতে পড়েন না বরং তিনি তার বিস্তীর্ণ লেখালেখির ফাঁকে ‘পালামৌ' পড়ার সময়ও বিশ্লেষণ করেই পড়েছেন এবং পরে লেখাটির সমালোচনা করেছেন। সঞ্জীবচন্দ্র তারপরে আর লেখাটি থামাননি। রবীন্দ্রনাথ পরে আবারও চিঠি দিয়েছেন, সঞ্জীব তাও শোনেননি। এরপরে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও চিঠি দিয়েছিলেন ভাই সঞ্জীবের পালামৌ সম্পর্কে। তাতেও কাজ হয়নি, অগত্যা কী আর করার। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘পালামৌ’ উপন্যাসের প্রতি পর্বের একটা একটা সমালোচনা বা রিভিউ ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশ করতে শুরু করেন। তবে কোথাও তিনি ব্যক্তি সঞ্জীবচন্দ্রের সমালোচনা করেননি বরং প্রশংসা করেছিলেন।
সঞ্জীবচন্দ্রকে তখনো খুব বেশি পাঠক চিনত না। কিন্তু সেই সমালোচনার পরে তার ঈর্ষনীয় লেখনশৈলী নিয়ে মন্তব্য করেছেন ওই সময়কার বাংলা সাহিত্যের দিকপালগণ।
তখনো পুরোদস্তুর লেখক হয়ে ওঠেননি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে তার কবিতায় ধার ছিল, সাহিত্য পাড়ায় তার যে কিঞ্চিৎ পদচারনা শুরু হয়েছে তা বেশ প্রশংসিত ছিল। আনন্দ পত্রিকার মালিকের ছেলে ডেকে বললেন, সাহিত্য সমালোচনা করতে। কঠিন বিষয়, তবে সুনীল রাজি হয়েছিলেন কারণ তখনো তার নামডাক শুরু হয়নি। শুরু করলেন প্রতিষ্ঠিতি লেখকদের সাহিত্য সমালোচনা, কারও গল্পতো কারও কবিতার। দেখা গেল আনন্দতে লেখেন এমন এক লেখকের গল্পের পরের সপ্তাহেই সুনীলের সমালোচনা ছেপেছে আনন্দ পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত ওই লেখক পরে হুমকি দিলেন আনন্দ পত্রিকায় তিনি আর লিখবেনইনা। কোথাকার এক পুঁচকে ছেলে তার লেখার ভুল ধরছে। সুনীল মনে মনে হাসেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন নিজের লেখা ধার হচ্ছে, ওই লেখক তার সমালোচনার উত্তর দেয়নি, বরং রাগ হয়েছে! অর্থাৎ তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।
আবার একজন লেখক সুনীলের বন্ধু মহলে বলেছেন, ঐ বাঙালের হাত পচে যাবে। কুষ্ঠ রোগ হবে। সুনীল তখনও খেয়াল করলেন তার সমালোচনার যৌক্তিক উত্তর নেই। এসময়য়ে তিনি একটা খিদে অনুভব করলেন, নিজেকে শাণ দেবার খিদে। নিজের লেখার অনাহূত কোন ভুল না আসে; লোকে তার লেখালেখি নিয়ে সমালোচনার সুযোগ না পায়। সুনীলের লেখা যে তার পরেও সমালোচিত হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু নিজে যেভাবে ক্ষুরধার সমালোচনা করেছেন তেমন সুযোগ ছিল না। পেশাদার লেখক হবার পরে নিজেকে ছাড়িয়েছেন বারে বারে।
একজন লেখক যখন লেখেন তখন নিজের সেরা দিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। ঠিক ওই মুহূর্তে সেটা তার নিজের কাছে সেরা লেখা বলে বিবেচিত হয়। বলা চলে, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই তিনি ছাপার জন্য প্রেসে পাঠান। লেখালেখি শুরু করাটা সাহসের ব্যাপার, ধৈর্য ও একটা বিষয় আছে। যিনি সত্যিকারের লেখক তাকে অনেক পড়তে হয়। যত বেশি পড়েন লেখায় তত বেশি ধার হয়। অনেকে হয়ত তরতর করে লিখে যেতে পারেন, অনেকে আবার বছরের পরে বছর ধরে একটা উপন্যাস শেষ করেন। এরপরে প্রকাশিত লেখা নিয়ে কাটাছেড়া হয়। এটা অবশ্য অন্যায় কিছুনা, পাঠক আপন মনে প্রিয় লেখকের লেখা নিয়ে মতামত জানাবেন সেটাই স্বাভাবিক। বরং অস্বাভাবিক হল মতামত না জানানো! মতামতের পন্থা আলাদা হতে পারে, এই ধরুন অনেকে বিষদ রিভিউ লেখেন আবার অনেকে প্রিয় বন্ধুর কানে কানে বলেন, 'দোস্ত, অমুক লেখকের লেখা পড়ছ! জোস লেখেন...' দিন শেষে কানে কানে ভেসে ভাল লেখাগুলো আলো ছড়ায়, আর যেগুলো আসলে লেখা হয়ে ওঠেনি সেগুলো ডুবে যায়।
বিষদ রিভিউ বা সাহিত্য সমালোচনা করতে হলে যে আপনাকে দারুণ লেখার ক্ষমতা থাকতে হবে অথবা সাহিত্যিক হতে হবে তা নয়! বরং বই আলোচনার জন্যেও কিছু নিয়ম রয়েছে, মোটামুটি সেগুলো রপ্ত করলেই চলে। যেমন যেমন ধরুন কুইন্টাস হোরেসিয়াস ফ্ল্যাককাস। প্রায় একুশ'শ বছর আগে জন্ম নেওয়া হোরেস ছিলেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমালোচনায় তিনি ছিলেন তৎকালীন সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ। তিনি বলেছেন,
এখানে খেয়াল করলে বোঝা যায়, সমালোচক শুধু পাঠকের জন্য নয় বরং তিনি লেখকের জন্য বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। তার লেখার মাঝে লেখকের দুর্বলতাগুলো যেন লেখকের উদ্দেশ্যে হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
হোরেস নিজেকে সমালোচকের ভূমিকায় উপস্থাপন করে বলেছেন,-
হোরেসের মতে সমালোচক শান পাথরের মত। পাথর যেমন নিজে কাটতে পারেনা কিন্তু কাটার অস্ত্রকে ধারালো করতে পারে; তেমনি সমালোচক কবিকে সার্থকতা অর্জনে সহায়তা করবেন, কবির কবিত্বকে শানিত করবেন। সমালোচক কবির কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেবে, উপকরণের উৎস বলে দেবে, কবির কবিত্ব শক্তিকে সমৃদ্ধ করার উপায় বলে দেবে। কবির কোন কাজটি প্রথম করনীয় তা বলে দেবে। কোন পথে চললে কবি সঠিক লক্ষ্যে পৌছতে পারবেন, ইত্যাদি।
উপরক্ত সব আলোচনা থেকে একজন সমালোচক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, সততা ও নিষ্ঠার সাথে ছড়িয়ে দিতেও পারেন। সমালোচকের মৌলিক চোখে লেখার যে দুর্বলতা বইয়ের মূল বার্তাকে নষ্ট করে না তার অনর্থক আলোচনা নতুন পাঠককে বই থেকে ছিটকে ফেলতে পারে। খেয়াল রাখা দরকার, দুর্বলতা থাকার পরেও লেখকের উদ্দেশ্যকে প্রকাশে কিঞ্চিৎ অনিহা সমালোচকের সততা নিয়ে যেন প্রশ্ন না তোলে। আবার মূল প্রাত্যহিক অর্থও বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ নষ্ট করতে পারে, সুতারং সমালোচক যেন সততা ও সাবধানতার পরীক্ষণপূর্বক মন্তব্য প্রকাশ করেন।
পড়া আর জানার পরে যে বিষয় থাকে তা হল শিক্ষা। শিক্ষার ক্ষেত্রটা খুব বেশি পরিষ্কার হয় তখন যখন ক্ষেত্র নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়, ভুলগুলো নিয়ে সমালোচনা হয়। এতে লেখক ও পাঠক দুই পক্ষই শিক্ষা চেতনায় নিজেকে শানিত করতে পারে। সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু বর্তমান ভেসে বেড়ানো সমালোচনায় সেগুলোর দেখা মেলে যথাকিঞ্চিৎ। এহেন সমালোচনা কখনো নিন্দার আকার ধারণ করে সৃষ্টিকে অপমানিত করে। আবার অহেতুক প্রশংসাও শিক্ষাকে ছিটকে ফেলে, জানার পথকে সংকির্ণ করে। তাই সমালোচকদের হতে হয় স্পষ্ট ও দীপ্ত। কালে কালে বহু গুণী লেখকগণও সাহিত্য সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছেন। নির্মোহ সমালোচক হয়েছেন, দোষ গুন নিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর আলোচনা করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'পথের পাঁচালী' নিয়ে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা রিভিউ লিখেছিলেন। জীবনের শেষ বয়সে বিভূতিবাবু পত্রমারফৎ রবিঠাকুরকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন তার বইটি নিয়ে কিছু লেখেন। অর্থাৎ সমালোচনা। পরে স্থূল সমালোচনার সাথে চমৎকার প্রশংসাসহ পরিচয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো সেই রিভিউ।
.পথের পাঁচালী’র আখ্যানটি অত্যান্ত দেশি। কিন্তু কাছের জিনিসেরও অনেক পরিচয় বাকী থাকে। যেখানে আজন্মকাল আছি, সেখানেও সব মানুষ সব জায়গায় প্রবেশ ঘটেনা। 'পথের পাঁচালী' যে বাংলা পাড়া-গায়ের কথা সেও অজানা রাস্তায় নতুন করে দেখতে হয়। লেখার গুণ এই-যে নতুন জিনিস ঝাঁপসা হয়নি। মনে-হয় খুব খাঁটি ও উচুদরের কথায় মন ভোলানোর জন্যে সস্তা দরের রাঙতার সাঁচ পরাবার চেষ্টা নেই। বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে। এই বইখানাতে পেয়েছি যথার্থ গল্পের স্বাদ। এর থেকে শিক্ষা হয়নি কিছুই, দেখা হয়েছে অনেক যা পুর্বে এমন করে দেখিনি। এইগল্পে গাছ-পালা, পথ-ঘাট, মেয়ে-পুরুষ, সুখ-দুঃখ সমস্তকে আমাদের আধুনিক অভিজ্ঞতার প্রাত্যহিক পরিবেষ্টনের থেকে দূরে প্রক্ষিপ্ত করে দেখানো হয়েছে। সাহিত্যে একটা নতুন জিনিস পাওয়া গেল, অথচ পুরাতন পরিচিত জিনিসের মত সে সুস্পষ্ট।
বুঝতে পারা যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বই পাঠাবার পরেও তার অসাধারণ সৃষ্টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি স্থূল সমালোচনা করেছেন।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ধারাবাহিকভাবে ‘পালামৌ লিখছিলেন হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওনাকে চিঠি লিখে বসলেন। চিঠিটি খুব গভীরভাবে নেড়ে চেড়ে দেখলেন, হ্যাঁ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চিঠি! পড়ার পরে সঞ্জীবচন্দ্র দুটো বিষয় ভেবেছিলেন, এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা পড়েন। এবং শুধু আনন্দ নিতে পড়েন না বরং তিনি তার বিস্তীর্ণ লেখালেখির ফাঁকে ‘পালামৌ' পড়ার সময়ও বিশ্লেষণ করেই পড়েছেন এবং পরে লেখাটির সমালোচনা করেছেন। সঞ্জীবচন্দ্র তারপরে আর লেখাটি থামাননি। রবীন্দ্রনাথ পরে আবারও চিঠি দিয়েছেন, সঞ্জীব তাও শোনেননি। এরপরে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও চিঠি দিয়েছিলেন ভাই সঞ্জীবের পালামৌ সম্পর্কে। তাতেও কাজ হয়নি, অগত্যা কী আর করার। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘পালামৌ’ উপন্যাসের প্রতি পর্বের একটা একটা সমালোচনা বা রিভিউ ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশ করতে শুরু করেন। তবে কোথাও তিনি ব্যক্তি সঞ্জীবচন্দ্রের সমালোচনা করেননি বরং প্রশংসা করেছিলেন।
সঞ্জীবচন্দ্রকে তখনো খুব বেশি পাঠক চিনত না। কিন্তু সেই সমালোচনার পরে তার ঈর্ষনীয় লেখনশৈলী নিয়ে মন্তব্য করেছেন ওই সময়কার বাংলা সাহিত্যের দিকপালগণ।
তখনো পুরোদস্তুর লেখক হয়ে ওঠেননি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে তার কবিতায় ধার ছিল, সাহিত্য পাড়ায় তার যে কিঞ্চিৎ পদচারনা শুরু হয়েছে তা বেশ প্রশংসিত ছিল। আনন্দ পত্রিকার মালিকের ছেলে ডেকে বললেন, সাহিত্য সমালোচনা করতে। কঠিন বিষয়, তবে সুনীল রাজি হয়েছিলেন কারণ তখনো তার নামডাক শুরু হয়নি। শুরু করলেন প্রতিষ্ঠিতি লেখকদের সাহিত্য সমালোচনা, কারও গল্পতো কারও কবিতার। দেখা গেল আনন্দতে লেখেন এমন এক লেখকের গল্পের পরের সপ্তাহেই সুনীলের সমালোচনা ছেপেছে আনন্দ পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত ওই লেখক পরে হুমকি দিলেন আনন্দ পত্রিকায় তিনি আর লিখবেনইনা। কোথাকার এক পুঁচকে ছেলে তার লেখার ভুল ধরছে। সুনীল মনে মনে হাসেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন নিজের লেখা ধার হচ্ছে, ওই লেখক তার সমালোচনার উত্তর দেয়নি, বরং রাগ হয়েছে! অর্থাৎ তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।
আবার একজন লেখক সুনীলের বন্ধু মহলে বলেছেন, ঐ বাঙালের হাত পচে যাবে। কুষ্ঠ রোগ হবে। সুনীল তখনও খেয়াল করলেন তার সমালোচনার যৌক্তিক উত্তর নেই। এসময়য়ে তিনি একটা খিদে অনুভব করলেন, নিজেকে শাণ দেবার খিদে। নিজের লেখার অনাহূত কোন ভুল না আসে; লোকে তার লেখালেখি নিয়ে সমালোচনার সুযোগ না পায়। সুনীলের লেখা যে তার পরেও সমালোচিত হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু নিজে যেভাবে ক্ষুরধার সমালোচনা করেছেন তেমন সুযোগ ছিল না। পেশাদার লেখক হবার পরে নিজেকে ছাড়িয়েছেন বারে বারে।
একজন লেখক যখন লেখেন তখন নিজের সেরা দিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। ঠিক ওই মুহূর্তে সেটা তার নিজের কাছে সেরা লেখা বলে বিবেচিত হয়। বলা চলে, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই তিনি ছাপার জন্য প্রেসে পাঠান। লেখালেখি শুরু করাটা সাহসের ব্যাপার, ধৈর্য ও একটা বিষয় আছে। যিনি সত্যিকারের লেখক তাকে অনেক পড়তে হয়। যত বেশি পড়েন লেখায় তত বেশি ধার হয়। অনেকে হয়ত তরতর করে লিখে যেতে পারেন, অনেকে আবার বছরের পরে বছর ধরে একটা উপন্যাস শেষ করেন। এরপরে প্রকাশিত লেখা নিয়ে কাটাছেড়া হয়। এটা অবশ্য অন্যায় কিছুনা, পাঠক আপন মনে প্রিয় লেখকের লেখা নিয়ে মতামত জানাবেন সেটাই স্বাভাবিক। বরং অস্বাভাবিক হল মতামত না জানানো! মতামতের পন্থা আলাদা হতে পারে, এই ধরুন অনেকে বিষদ রিভিউ লেখেন আবার অনেকে প্রিয় বন্ধুর কানে কানে বলেন, 'দোস্ত, অমুক লেখকের লেখা পড়ছ! জোস লেখেন...' দিন শেষে কানে কানে ভেসে ভাল লেখাগুলো আলো ছড়ায়, আর যেগুলো আসলে লেখা হয়ে ওঠেনি সেগুলো ডুবে যায়।
বিষদ রিভিউ বা সাহিত্য সমালোচনা করতে হলে যে আপনাকে দারুণ লেখার ক্ষমতা থাকতে হবে অথবা সাহিত্যিক হতে হবে তা নয়! বরং বই আলোচনার জন্যেও কিছু নিয়ম রয়েছে, মোটামুটি সেগুলো রপ্ত করলেই চলে। যেমন যেমন ধরুন কুইন্টাস হোরেসিয়াস ফ্ল্যাককাস। প্রায় একুশ'শ বছর আগে জন্ম নেওয়া হোরেস ছিলেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমালোচনায় তিনি ছিলেন তৎকালীন সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ। তিনি বলেছেন,
সমালোচককে হতে হবে নিরপেক্ষ ও সৎ। সমালোচক অবশ্যই সত্য ও মিথ্যের প্রভেদ লেখককে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। অহেতুক নিন্দা ও স্তুতি শিষ্ট সমালোচনা গ্রহনীয় নয়।লেখককে সত্য সন্ধানে সহায়তা করতে পারেন, এমন পণ্ডিত ও নিষ্ঠাবান সমালোচকই হোরেসের প্রত্যাশা।
এখানে খেয়াল করলে বোঝা যায়, সমালোচক শুধু পাঠকের জন্য নয় বরং তিনি লেখকের জন্য বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। তার লেখার মাঝে লেখকের দুর্বলতাগুলো যেন লেখকের উদ্দেশ্যে হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
হোরেস নিজেকে সমালোচকের ভূমিকায় উপস্থাপন করে বলেছেন,-
'আমি শান পাথরের ভূমিকা পালন করবো। যা নিজে কাটতে পারেনা, কিন্তু অস্ত্রকে ধারালো করতে পারে ঠিকই। যদিও আমি নিজে কিছু লিখি না।
হোরেসের মতে সমালোচক শান পাথরের মত। পাথর যেমন নিজে কাটতে পারেনা কিন্তু কাটার অস্ত্রকে ধারালো করতে পারে; তেমনি সমালোচক কবিকে সার্থকতা অর্জনে সহায়তা করবেন, কবির কবিত্বকে শানিত করবেন। সমালোচক কবির কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেবে, উপকরণের উৎস বলে দেবে, কবির কবিত্ব শক্তিকে সমৃদ্ধ করার উপায় বলে দেবে। কবির কোন কাজটি প্রথম করনীয় তা বলে দেবে। কোন পথে চললে কবি সঠিক লক্ষ্যে পৌছতে পারবেন, ইত্যাদি।
উপরক্ত সব আলোচনা থেকে একজন সমালোচক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, সততা ও নিষ্ঠার সাথে ছড়িয়ে দিতেও পারেন। সমালোচকের মৌলিক চোখে লেখার যে দুর্বলতা বইয়ের মূল বার্তাকে নষ্ট করে না তার অনর্থক আলোচনা নতুন পাঠককে বই থেকে ছিটকে ফেলতে পারে। খেয়াল রাখা দরকার, দুর্বলতা থাকার পরেও লেখকের উদ্দেশ্যকে প্রকাশে কিঞ্চিৎ অনিহা সমালোচকের সততা নিয়ে যেন প্রশ্ন না তোলে। আবার মূল প্রাত্যহিক অর্থও বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ নষ্ট করতে পারে, সুতারং সমালোচক যেন সততা ও সাবধানতার পরীক্ষণপূর্বক মন্তব্য প্রকাশ করেন।
January 11, 2018
যে রূপকল্পের গল্প গেঁথেছিলাম 'নিঃশব্দ' উপন্যাসে।
স্রোতস্বতী ইছামতী।
অদৃশ্য কাঁটাতারে আঁটকা দুই তীরের মানুষ। বিবর্ণ মুখশ্রী আকাশের মেঘ খোঁজে। ভুভুক্ষের মত বিস্ময়ে চেয়ে আছে ওপারে। যেন ডানা থাকলেই এই মুহুর্তে উড়ে যাবে। তাদের চেয়ে থাকাটা যতটা পেটের খিদেয়, তার চেয়ে আঁটকে পড়ায় অথবা নিজেকে পরাধীনতায় আঁটকে রাখায়। সেই আঁটকে থাকার নানা কারণ থাকতে পারে। তবুও কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে শত বছরের ভিটে ছেড়ে যে মানুষ নির্বাসিত হয় জীবনের খোঁজে, সে জীবনের অন্তরালে নিশ্চই কিছু কষ্ট থাকে, চাপা দুঃখ থাকে। না পাওয়া অথবা আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ থাকে, নিদেনপক্ষে নতুন জায়গায় বেঁচে থাকার আশা থাকে। যা প্রত্যেকটাই একএকটা হাসিকান্নার গল্প। নিঃশব্দ সেইসব গল্পেরই সুতোয় বোনা উপন্যাস।
দুটি দেশকে কলমের খোচায় ভাগ করার সময় সিরিল র্যাডক্লিফ কি বুঝেছিলেন একটা দেহ ভাগ হয়ে যাচ্ছে! যার ক্ষত প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়াবে। সেই কলমের দাগেরই একটি অংশ ইছামতী। নিঃশব্দ উপন্যাসটির চিত্রপটের যে ভাগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা একঅর্থে এই নদীতীরের জনপদের গল্পকে ঘিরেই। ইছামতীকে ঘিরে যখন 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটির প্লট ঘুরছিল তখনো বিভূতিভূষণ রচনা নিয়ে কিঞ্চিৎ আগ্রহও জমেনি। অথচ বিস্ময়ের কথা হল, এই গল্পটা ছাপার অক্ষরে লেখা হয়ে ওঠা উচিৎ, সেই ভাবনা প্রথম আসে সেদিন আমি পশ্চিমবঙ্গের বনগা'র অদুরে গোপালনগরে বিভূতিভূষণ স্মৃতি জাদুঘরে। সংকীর্ণ ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখেছি বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিভূতিভূষণের সেই ইছামতীর ছোট্ট শাখাটির স্রোতহীন মৃত্যুপ্রায় চিত্র। যদিও তখন আমার মাঝে বসিরহাট, হাসনাবাদ জনপদের চিত্র ভাসছে।
লেখনশৈলী কেমন সেটা সময় বলুক। কিন্তু 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটি যে চিত্রপটের শব্দযোগে একত্র হয়েছে তা কি বলতে চেয়েছে?
ষাটোর্ধ ভারতী দেবী যখন বাঁচার জন্য মাত্র একবেলা হলেও খেয়ে থাকার প্রয়াসে সংগ্রাম করেছেন, তখনই শুরু হয়েছিলো সেই গল্প। যে গল্পে, স্বামী হারিয়েছেন। বিকলাঙ্গ ভাই ও তার স্ত্রী'কে দেখেছেন অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করতে। নিজের তিন সন্তানের একে একে দূরে সরে যাওয়া দেখেছেন অশ্রুশূন্য চোখে! যে অভাবকে জয় করার তাগিদে সংগ্রাম করেছিলেন তা কখনো থামাতে পারেননি। নিঃশব্দ' উপন্যাস একজন ভারতী দেবীর কথা বলেছে ঠিক, কিন্তু সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতে নির্বাসিত এমন বহু হিন্দু-মুসলিম সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সংগ্রাম করে চলেছেন। জাতিসত্ত্বা ত্যাগ করে গিয়েও হয়ে আছেন পরিচয়হীন।
ভারতী দেবীর বাকী গল্প নাহয় 'নিঃশব্দ' উপন্যাসই করুক।
আশির দশকের শেষ সময়, এবড়েথেবড়ো কলুষিত রাজনীতির মাঝেও অনিন্দ্য সুন্দর সবুজাভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রিমঝিম বরষার প্রতিটা ফোঁটার একটা অর্থ, সেই অর্থ যেন একটি একটি গল্প রচনা করে। সেই গল্প কখনো প্রেম কখনো সামাজিক ধর্মীয় অবক্ষয় উত্তরণের চিত্র। প্রাণের ক্যাম্পাস, প্রতিটা হল থেকে তখন নতুন সাজানো গোছানো দেশের স্বপ্ন দেখে একএকজন তরুণ। সোমনাথ তেমনই কেউ, কোটালিপাড়ার প্রায় সারাবছর পানিতে ডুবে থাকা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল দেশসেরা বিদ্যাপিঠে শিক্ষা নিয়ে দেশ সেবার প্রয়াস নিয়ে। কিন্তু কতটা পেরেছিল সে? যে দেশ থেকে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, সেখানেই আপন বিশ্বাসে মা মাটিকে ছেড়ে নিজ সন্তানকে নিয়ে দেশ ছাড়েননি বাবা সৌমেন বিশ্বাস। সব গল্পেরই দুটো দিক থাকে, নিঃশব্দে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষদের ভিড়ে এমনসব মানুষের গল্পও করা হয়েছে যারা বাপ-দাদার ভিটেকে অস্বীকার করেনি। বরং গর্বের সাথে মাথা উচু করে আছে।
নিঃশব্দ একটা পরিবার দেখিয়েছে, বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রাম। ধর্মীয় সম্প্রীতির রূপক কবিরাজি টোটকা যেন মোজাফফর সরদারের পরিবার। যে পরিবারে সৌমেন বিশ্বাস হয়ে উঠেছিলেন রক্তের সম্পর্কের উপরের কোন রূপরেখায়। কিন্তু নিঃশ্বাস তাকে থামিয়ে দিয়েছে মাঝ পথেই। দিশেহারা পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো সৌমেন তনয় সোমনাথ। যে রক্ত সৌমেনকে মিশিয়েছিল আত্মিক বন্ধনে সেখানেই যেন পরিবার নামের আসল অর্থ বুঝতে পারে বাবা-মা'হীন সোমনাথ। সব গল্পেই থাকে বিচিত্র মানুষের পদচারণা, এই গল্পে সেটা ছিল ভরপুর!
তারপর?
মানুষের সব চাওয়া যেন পূরণ হবার নয়, কিন্তু নাসিমার যে সেটা পূরণ করতেই চাই! যে মানুষটাকে একটা সময় সে পছন্দই করেনি, এমনকী মানুষটা কখনো তাকে ভাবনার আবেশে বাধার ইঙ্গিত পর্যন্ত দেয়নি তাকেই কিনা জয় করেছে জোর করে! কিছু জোর টিকে যায় সম্মানে, শ্রদ্ধায় সোমনাথ যে ঠেলে ফেলতে পারেনি! আর এভাবেইতো গল্প হয়, জয় করার গল্প। নিজেকে মিশিয়ে নেবার গল্প। নিঃশব্দ উপন্যাস সেইগল্পকে বলেছে ধীরে ধীরে। নিঃশব্দ গল্পের সেই প্রধানচরিত্র অপুর জন্ম হয়েছিলো, দিনকয়েকের মাঝেই বন্যায় ডুবে যায় ঢাকা শহরসহ সারা দেশ। তাহলে কি অপু এমন কিছু নিয়ে এসেছিল যা হবার নয়? কিন্তু যে শিশুর চোখ এত মায়াবী, চেহারায় যেন নির্ভার হাঁসি তার তরে এমন কেন হবে! তবে হয়েছিলো, হারিয়েছে সবকিছু, এক অদৃশ্য ঝড় একে একে আলাদা করেছে নাসিমা-সোমনাথকে। শিশুটিকে বাঁচানোর তাগিদে দেশ ছারটে বাধ্য হয় সোমনাথ।
বলেছিলাম দেশ ছাড়ার গল্প, এমনও বহু কারণেই কোটি কোটি মানুষ দেশ ছেড়েছে। সোমনাথ যেমন আটমাসের শিশুসন্তানকে কলা গাছের ভেলায় চড়ে ইছামতী পার হয়েছে শীতের রাতের অন্ধকারে, তেমনি সুকুমার সদ্য প্রয়াত স্কুল শিক্ষক বাবার অর্জিত সমস্ত অর্থসহ নিয়ে মা'কে সাথে নিয়ে দেশ ছেড়েছে সমৃদ্ধির আসায়, অথচ দেশ তার পরিবারকে কম কিছু দেয়নি। অর্থ সম্মান সব। মায়ের ইচ্ছেতে দেশ ছেড়েও সুকুমার মাথা নিচু করেই দিন কাটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাটে।
গল্পের মাঝের কোন চরিত্র নিধি, পিরোজপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মেয়ে নিধি ছিল কবিতার পাগল। যখন অপ্রাপ্ত বয়সেই আশেপাশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, নিধি কলুষিত সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে এসেছিল ঢাকায়। তবে হেরে যায় সেই সমাজের কাছে। সোমনাথের সাথে বৃষ্টিময় ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে উঠতে তা যেন হারিয়ে যায়। হিন্দু ধর্মের জাতপাত ভেঙে যে মানুষদুটো ভবিষ্যতের রুপকল্প এঁকেছিল তা থমকে যায় রক্তের বন্ধনের দায়বদ্ধতায়। তারপর? বেশ কয়েক বছর পরেই নিধির খোঁজ মেলে খুলনার ডুমুরিয়াতে। কিছু ভুল হয় ক্ষমা নামক শব্দটাকে চেনাতে, কিছু ভুল সমাজকে এমন কিছু বার্তা দিয়ে যায়, যা হয় অনুকরণীয়। নিধি সেই শিল্পী যে নিজের মত এঁকেছেন দায়বদ্ধতার সামাজিক শিল্পকর্ম।
কেন হল, 'নিঃশব্দ' নামকরণ। নব্বইয়ের দশকে হটাত হটাত অজানা রোগ এসে হানা দেয়। অপু যেন সবকিছু ডেকে এনেছিল, বাবা-মায়ের অবর্তমানে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। অতঃপর, হারিয়ে ফেলে কথা বলার শক্তি। শুরু হয় আড়াই বছর বয়সের শিশুর উপর কলুষিত সমাজের অত্যাচারের রূপপদ্য। সেই কথা বলতে না পারা শিশুটিকে ঘিরেইতো উপন্যাস। কোন না কোন ভাবে প্রত্যেক চরিত্র জড়িয়ে আছে তার সাথে, অথবা জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এত এত চরিত্রের ভিড়ে এমন কিছু মানুষের গল্প উপন্যাসে উঠে এসেছে মুহুর্তেই মনে হবে, এইতো এটা আমি। সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চরিত্রগুলোকে একত্র করে নির্মিত উপন্যাসটিতে কোন অপ্রয়োজনীয় চরিত্রর খোঁজ মিলবে না। আমি দৃশ্যপটের কথা বলতে চেয়েছি। চরিত্রের কথা বলতে চেয়েছি, সমাজের কথা বলেছি, সেখানে সাহিত্য কতটা উজ্জবিত ছিল জানিনা, তবে চারপাশের সমাজের সেই সকল গল্প যেন আমাদের জানা উচিৎ, সে গল্পে অন্তর্দন্দ্ব যেমন থাকে, থাকে সমস্যা অতঃপর সমাধানের রূপ চিত্র। প্রতিটা চরিত্র কিছু বলতে চেয়েছে, কিছু বোঝাতে চেয়েছে। ভুল করেছে অতঃপর সুধরে নিয়েছে।
নিঃশব্দ পাঠক হৃদয়ে কেমন সাড়া ফেলবে জানিনা, তবে যে চরিত্রগুলো উপন্যাসে কথা বলেছে তা যেন পাঠক বুঝতে চেষ্টা করে। নিঃশব্দ যেন একবার নয় বরং বারবার পড়ার মত উপন্যাস হয়ে ওঠে সেই প্রয়াস ছিল।
অদৃশ্য কাঁটাতারে আঁটকা দুই তীরের মানুষ। বিবর্ণ মুখশ্রী আকাশের মেঘ খোঁজে। ভুভুক্ষের মত বিস্ময়ে চেয়ে আছে ওপারে। যেন ডানা থাকলেই এই মুহুর্তে উড়ে যাবে। তাদের চেয়ে থাকাটা যতটা পেটের খিদেয়, তার চেয়ে আঁটকে পড়ায় অথবা নিজেকে পরাধীনতায় আঁটকে রাখায়। সেই আঁটকে থাকার নানা কারণ থাকতে পারে। তবুও কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে শত বছরের ভিটে ছেড়ে যে মানুষ নির্বাসিত হয় জীবনের খোঁজে, সে জীবনের অন্তরালে নিশ্চই কিছু কষ্ট থাকে, চাপা দুঃখ থাকে। না পাওয়া অথবা আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ থাকে, নিদেনপক্ষে নতুন জায়গায় বেঁচে থাকার আশা থাকে। যা প্রত্যেকটাই একএকটা হাসিকান্নার গল্প। নিঃশব্দ সেইসব গল্পেরই সুতোয় বোনা উপন্যাস।
দুটি দেশকে কলমের খোচায় ভাগ করার সময় সিরিল র্যাডক্লিফ কি বুঝেছিলেন একটা দেহ ভাগ হয়ে যাচ্ছে! যার ক্ষত প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়াবে। সেই কলমের দাগেরই একটি অংশ ইছামতী। নিঃশব্দ উপন্যাসটির চিত্রপটের যে ভাগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা একঅর্থে এই নদীতীরের জনপদের গল্পকে ঘিরেই। ইছামতীকে ঘিরে যখন 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটির প্লট ঘুরছিল তখনো বিভূতিভূষণ রচনা নিয়ে কিঞ্চিৎ আগ্রহও জমেনি। অথচ বিস্ময়ের কথা হল, এই গল্পটা ছাপার অক্ষরে লেখা হয়ে ওঠা উচিৎ, সেই ভাবনা প্রথম আসে সেদিন আমি পশ্চিমবঙ্গের বনগা'র অদুরে গোপালনগরে বিভূতিভূষণ স্মৃতি জাদুঘরে। সংকীর্ণ ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখেছি বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিভূতিভূষণের সেই ইছামতীর ছোট্ট শাখাটির স্রোতহীন মৃত্যুপ্রায় চিত্র। যদিও তখন আমার মাঝে বসিরহাট, হাসনাবাদ জনপদের চিত্র ভাসছে।
লেখনশৈলী কেমন সেটা সময় বলুক। কিন্তু 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটি যে চিত্রপটের শব্দযোগে একত্র হয়েছে তা কি বলতে চেয়েছে?
ষাটোর্ধ ভারতী দেবী যখন বাঁচার জন্য মাত্র একবেলা হলেও খেয়ে থাকার প্রয়াসে সংগ্রাম করেছেন, তখনই শুরু হয়েছিলো সেই গল্প। যে গল্পে, স্বামী হারিয়েছেন। বিকলাঙ্গ ভাই ও তার স্ত্রী'কে দেখেছেন অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করতে। নিজের তিন সন্তানের একে একে দূরে সরে যাওয়া দেখেছেন অশ্রুশূন্য চোখে! যে অভাবকে জয় করার তাগিদে সংগ্রাম করেছিলেন তা কখনো থামাতে পারেননি। নিঃশব্দ' উপন্যাস একজন ভারতী দেবীর কথা বলেছে ঠিক, কিন্তু সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতে নির্বাসিত এমন বহু হিন্দু-মুসলিম সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সংগ্রাম করে চলেছেন। জাতিসত্ত্বা ত্যাগ করে গিয়েও হয়ে আছেন পরিচয়হীন।
ভারতী দেবীর বাকী গল্প নাহয় 'নিঃশব্দ' উপন্যাসই করুক।
আশির দশকের শেষ সময়, এবড়েথেবড়ো কলুষিত রাজনীতির মাঝেও অনিন্দ্য সুন্দর সবুজাভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রিমঝিম বরষার প্রতিটা ফোঁটার একটা অর্থ, সেই অর্থ যেন একটি একটি গল্প রচনা করে। সেই গল্প কখনো প্রেম কখনো সামাজিক ধর্মীয় অবক্ষয় উত্তরণের চিত্র। প্রাণের ক্যাম্পাস, প্রতিটা হল থেকে তখন নতুন সাজানো গোছানো দেশের স্বপ্ন দেখে একএকজন তরুণ। সোমনাথ তেমনই কেউ, কোটালিপাড়ার প্রায় সারাবছর পানিতে ডুবে থাকা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল দেশসেরা বিদ্যাপিঠে শিক্ষা নিয়ে দেশ সেবার প্রয়াস নিয়ে। কিন্তু কতটা পেরেছিল সে? যে দেশ থেকে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, সেখানেই আপন বিশ্বাসে মা মাটিকে ছেড়ে নিজ সন্তানকে নিয়ে দেশ ছাড়েননি বাবা সৌমেন বিশ্বাস। সব গল্পেরই দুটো দিক থাকে, নিঃশব্দে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষদের ভিড়ে এমনসব মানুষের গল্পও করা হয়েছে যারা বাপ-দাদার ভিটেকে অস্বীকার করেনি। বরং গর্বের সাথে মাথা উচু করে আছে।
নিঃশব্দ একটা পরিবার দেখিয়েছে, বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রাম। ধর্মীয় সম্প্রীতির রূপক কবিরাজি টোটকা যেন মোজাফফর সরদারের পরিবার। যে পরিবারে সৌমেন বিশ্বাস হয়ে উঠেছিলেন রক্তের সম্পর্কের উপরের কোন রূপরেখায়। কিন্তু নিঃশ্বাস তাকে থামিয়ে দিয়েছে মাঝ পথেই। দিশেহারা পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো সৌমেন তনয় সোমনাথ। যে রক্ত সৌমেনকে মিশিয়েছিল আত্মিক বন্ধনে সেখানেই যেন পরিবার নামের আসল অর্থ বুঝতে পারে বাবা-মা'হীন সোমনাথ। সব গল্পেই থাকে বিচিত্র মানুষের পদচারণা, এই গল্পে সেটা ছিল ভরপুর!
তারপর?
মানুষের সব চাওয়া যেন পূরণ হবার নয়, কিন্তু নাসিমার যে সেটা পূরণ করতেই চাই! যে মানুষটাকে একটা সময় সে পছন্দই করেনি, এমনকী মানুষটা কখনো তাকে ভাবনার আবেশে বাধার ইঙ্গিত পর্যন্ত দেয়নি তাকেই কিনা জয় করেছে জোর করে! কিছু জোর টিকে যায় সম্মানে, শ্রদ্ধায় সোমনাথ যে ঠেলে ফেলতে পারেনি! আর এভাবেইতো গল্প হয়, জয় করার গল্প। নিজেকে মিশিয়ে নেবার গল্প। নিঃশব্দ উপন্যাস সেইগল্পকে বলেছে ধীরে ধীরে। নিঃশব্দ গল্পের সেই প্রধানচরিত্র অপুর জন্ম হয়েছিলো, দিনকয়েকের মাঝেই বন্যায় ডুবে যায় ঢাকা শহরসহ সারা দেশ। তাহলে কি অপু এমন কিছু নিয়ে এসেছিল যা হবার নয়? কিন্তু যে শিশুর চোখ এত মায়াবী, চেহারায় যেন নির্ভার হাঁসি তার তরে এমন কেন হবে! তবে হয়েছিলো, হারিয়েছে সবকিছু, এক অদৃশ্য ঝড় একে একে আলাদা করেছে নাসিমা-সোমনাথকে। শিশুটিকে বাঁচানোর তাগিদে দেশ ছারটে বাধ্য হয় সোমনাথ।
বলেছিলাম দেশ ছাড়ার গল্প, এমনও বহু কারণেই কোটি কোটি মানুষ দেশ ছেড়েছে। সোমনাথ যেমন আটমাসের শিশুসন্তানকে কলা গাছের ভেলায় চড়ে ইছামতী পার হয়েছে শীতের রাতের অন্ধকারে, তেমনি সুকুমার সদ্য প্রয়াত স্কুল শিক্ষক বাবার অর্জিত সমস্ত অর্থসহ নিয়ে মা'কে সাথে নিয়ে দেশ ছেড়েছে সমৃদ্ধির আসায়, অথচ দেশ তার পরিবারকে কম কিছু দেয়নি। অর্থ সম্মান সব। মায়ের ইচ্ছেতে দেশ ছেড়েও সুকুমার মাথা নিচু করেই দিন কাটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাটে।
গল্পের মাঝের কোন চরিত্র নিধি, পিরোজপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মেয়ে নিধি ছিল কবিতার পাগল। যখন অপ্রাপ্ত বয়সেই আশেপাশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, নিধি কলুষিত সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে এসেছিল ঢাকায়। তবে হেরে যায় সেই সমাজের কাছে। সোমনাথের সাথে বৃষ্টিময় ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে উঠতে তা যেন হারিয়ে যায়। হিন্দু ধর্মের জাতপাত ভেঙে যে মানুষদুটো ভবিষ্যতের রুপকল্প এঁকেছিল তা থমকে যায় রক্তের বন্ধনের দায়বদ্ধতায়। তারপর? বেশ কয়েক বছর পরেই নিধির খোঁজ মেলে খুলনার ডুমুরিয়াতে। কিছু ভুল হয় ক্ষমা নামক শব্দটাকে চেনাতে, কিছু ভুল সমাজকে এমন কিছু বার্তা দিয়ে যায়, যা হয় অনুকরণীয়। নিধি সেই শিল্পী যে নিজের মত এঁকেছেন দায়বদ্ধতার সামাজিক শিল্পকর্ম।
কেন হল, 'নিঃশব্দ' নামকরণ। নব্বইয়ের দশকে হটাত হটাত অজানা রোগ এসে হানা দেয়। অপু যেন সবকিছু ডেকে এনেছিল, বাবা-মায়ের অবর্তমানে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। অতঃপর, হারিয়ে ফেলে কথা বলার শক্তি। শুরু হয় আড়াই বছর বয়সের শিশুর উপর কলুষিত সমাজের অত্যাচারের রূপপদ্য। সেই কথা বলতে না পারা শিশুটিকে ঘিরেইতো উপন্যাস। কোন না কোন ভাবে প্রত্যেক চরিত্র জড়িয়ে আছে তার সাথে, অথবা জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এত এত চরিত্রের ভিড়ে এমন কিছু মানুষের গল্প উপন্যাসে উঠে এসেছে মুহুর্তেই মনে হবে, এইতো এটা আমি। সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চরিত্রগুলোকে একত্র করে নির্মিত উপন্যাসটিতে কোন অপ্রয়োজনীয় চরিত্রর খোঁজ মিলবে না। আমি দৃশ্যপটের কথা বলতে চেয়েছি। চরিত্রের কথা বলতে চেয়েছি, সমাজের কথা বলেছি, সেখানে সাহিত্য কতটা উজ্জবিত ছিল জানিনা, তবে চারপাশের সমাজের সেই সকল গল্প যেন আমাদের জানা উচিৎ, সে গল্পে অন্তর্দন্দ্ব যেমন থাকে, থাকে সমস্যা অতঃপর সমাধানের রূপ চিত্র। প্রতিটা চরিত্র কিছু বলতে চেয়েছে, কিছু বোঝাতে চেয়েছে। ভুল করেছে অতঃপর সুধরে নিয়েছে।
নিঃশব্দ পাঠক হৃদয়ে কেমন সাড়া ফেলবে জানিনা, তবে যে চরিত্রগুলো উপন্যাসে কথা বলেছে তা যেন পাঠক বুঝতে চেষ্টা করে। নিঃশব্দ যেন একবার নয় বরং বারবার পড়ার মত উপন্যাস হয়ে ওঠে সেই প্রয়াস ছিল।