কিছু এর রেখে যাই | আলী আহমাদ রুশদী


স্মৃতিকথা পড়তে ভালো লাগে বলে এক দুপুরে বইটা পড়া শুরু করেছিলাম। বারোটায় শুরু করে মাঝে কেবল খাওয়ার বিরতি ছাড়া উঠতে পারিনি, রাত নয়টায় পুরো বই শেষ করে তবে থেমেছি। সময়ের বিচারে অনেক বিস্তৃত এই স্মৃতিকথা, স্থানের বিচারেও। ৪/৫টি দেশে কাটানো সময় আর প্রায় সাত দশকের কথা...। প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠায় একটা কর্মমুখর জীবনের বিবরণ পড়ে গেলাম গোগ্রাসে, আর মুগ্ধ হলাম। তবে আমার হয়তো বেশি ভালো লেগেছে কিছু কিছু স্মৃতি মিলে যাওয়ায়। গ্রামের কোন্দা চালানো, জাল ফেলে মাছ ধরা আর সুপারি গাছে ওঠার স্মৃতি, অথবা ডাকাতিয়া নদী। আবার কুমিল্লা, ঢাকা, টাংগাইল, মেলবোর্ন, এক জায়গায় এক সাথে এই পরিচিত চারটে শহরকে পাওয়াও হয়তো আরেকটা কারণ।

গ্রামের মাদ্রাসা থেকে পাশ করা একজন তরুণ পড়তে চান অর্থনীতি নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তীব্র ইচ্ছাও ছিলো তাঁর, কিন্তু এখানে এসে শুনলেন ভালো ফলাফল থাকা সত্বেও অর্থনীতি পড়ার সুযোগ পাবেন না, শিক্ষকেরা তাঁকে ভর্তি হতে বললেন ইসলামিক স্টাডিজে। তিনি ভাবলেন, ইসলামিক স্টাডিজ নতুন কিছু শেখাতে পারবে না তাঁকে, তিনি অর্থনীতিই পড়বেন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছায় মুলতুবি দিয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়ার জন্যে তিনি ভর্তি হয়ে গেলেন ঢাকা কলেজে।

এর পরেও এরকম দৃঢ়তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায় তাঁকে। পড়াশোনা শেষে চাকরিজীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছে, কিন্তু কোথাও শর্টকাট রাস্তায় হাঁটেননি, বরং সততার সাথে সেগুলো পেরিয়ে এসেছেন।

প্রথম সন্তানের মৃত্যু অথবা মায়ের চলে যাওয়ার বিবরণ পড়তে গিয়ে বিষণ্ণতায় ডুবে গেছি। টাংগাইল সাদাত কলেজের প্রিন্সিপাল থাকার সময় যেভাবে ছাত্র, শিক্ষক এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপ সামলেছেন, সেসবের বর্ণনা কোনো থ্রিলারের চেয়ে কম নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন দেশ গড়তে লন্ডন থেকে এক কথায় চলে আসা, দেশে ফিরে স্বপ্নভঙ্গ, এসবই যেন ইতিহাসের পৌনপুনিকতার কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। চরম সিরিয়াস সময়ে, বাইরে ছাত্রদের 'মুজিবের গদিতে আগুন জ্বালো এক সাথে' শুনে, তাজউদ্দীন আহমেদ যখন তাঁকে নিচুস্বরে বলেন, 'গদি পুড়িয়ে কী লাভ, না পোড়ালে বরং পরে যারা আসবে তারা বসতে পারবে'-- এই জায়গাটা পড়ে খুব হেসেছি।

বিদেশের পড়াশোনা ও কাজ করার অভিজ্ঞতাকে শুধু নিজের জীবনের সিঁড়ি হিসেবে নয়, বাংলাদেশের কাজে লাগানো যায় কিনা তা নিয়ে ভেবেছেন সারা জীবন, বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের জন্যে অস্ট্রেলিয়ায় প্রচলিত হেক্স প্রকল্পের একটা রূপ বাংলাদেশে নেয়া গেলে খুব ভালো হতো, এরকমটা প্রায়ই ভাবি আমি, এই বইয়ে তার উল্লেখ দেখে ভালো লাগলো। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, অথবা রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে এরকম বেশ কিছু মণি-মুক্তা ছড়ানো আছে এই বইয়ে। এ কারণেই আমার মনে হলো, বাংলাভাষী তরুণ-তরুণীদের কাছে 'কিছু এর রেখে যাই' ঠিকমতো পৌঁছে দিতে পারলে খুব ভালো হতো। আমি অন্তত আমার পরিচিতদের এই বইটি রেকমেন্ড করবো।

একটা পরিপূর্ণ জীবনের ছবি যেন দেখতে পেলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে, পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিলো সুলিখিত কোনো ফিকশন পড়ছি। অন্য অনেক সুখপাঠ্য স্মৃতিকথা পড়েছি, ভালোও লেগেছে। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, আলী আহমাদ রুশদীর 'কিছু এর রেখে যাই'কে আরও বেশি আপনার, আরও বেশি কাছের মনে হলো আমার কাছে।
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on November 05, 2024 04:23
No comments have been added yet.


Tareq Nurul Hasan's Blog

Tareq Nurul Hasan
Tareq Nurul Hasan isn't a Goodreads Author (yet), but they do have a blog, so here are some recent posts imported from their feed.
Follow Tareq Nurul Hasan's blog with rss.