বাড়ি থেকে পালিয়ে 'বাড়ি'

Matera view

বেশ কিছুদিন ধরে আমার দক্ষিণ ইতালির ফেজ চলছে। 'দ্য হাউস অন ভিয়া জেমিতো' নেপলসের গল্প, নেটফ্লিক্সে 'রিপলি' দেখে মুগ্ধ, সেখানেও গল্প আতরানি নেপলস পালেরমো আর দক্ষিণ ইতালি জুড়ে এগিয়েছে। এইসবের মধ্যে আচমকা একটা ঝটিকা সফর প্ল্যান করা হল। পড়বি তো পড়, সেই যাত্রাও আমরা দক্ষিণ ইতালিতে গিয়েই পড়লাম। তবে নেপলস বা আমালফি নয়, ওইদিকে আগে যাওয়া হয়েছে, ভেবেচিন্তে আমরা চলে গেলাম বাড়ি। বাড়িই বটে, আবার বারি, বাডি, বাড়ীও হতে পারে, তবে কিনা আমাদের বাড়ি নয়, ইতালির বাড়ি। (ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখি, ইতালিয়ানে সঠিক উচ্চারণ এই লেখায় না থাকাই স্বাভাবিক।) পুগলিয়া অঞ্চলের এই শহর নেপসের পর দক্ষিণ ইতালির সবচেয়ে বড় শহর, এখনও ততোটা নাম করেনি, যদিও লাগোয়া টাউনগুলো গত কয়েকবছর ধরে অনেকেরই ভ্রমণতালিকায় উঠে এসেছে বলে বাড়িতে থাকার জায়গা হেবি দাম, খোঁজাখুজি করে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া গেছে ভাগ্য ভালো।
যাই হোক, আমরা গরিব পাবলিক, পয়সাকড়ির টানাটানি লেগেই থাকে। ভিয়েনায় থেকেও অপেরা যাওয়ার মুরোদ নেই,  কফিহাউসের ঠান্ডা কফি (এ ব্যাটারা ফ্রথ নিয়েই পাগল, কফিতে ঠান্ডা দুধ মিশিয়ে হট ড্রিংককে কোল্ড ড্রিংক বানিয়ে ফেলে, গোটা ইউরোপ জুড়ে এই ঝামেলা। মুই কালিয়েন্তে, ভেরি হট, জের হাইস না বললে কোনও কফিই মুখে তোলা যায় না, তা সে কফির দোকানে ফ্রয়েড এসে থাকুন বা বেটোফেন) চলে না বলে বাড়িতে কফি করেই দিন কাটে। সিগারেট ফিগারেটও খাওয়ার স্বভাব নেই (টাকা নেই) মদ্যপানের শখও নেই (টাকাও নেই), বিলাসিতার ইচ্ছেও নেই (ধ্যার, বললেই হয় টাকা নেই) তবু আমাদের দেশ দেখার শখ, সব সঞ্চয় জমে গুগল ম্যাপের কোর্ডিনেটে। তা আমাদের মতো হাড়হাভাতের জন্য রায়ান এয়ারই ভরসা, লোকে যতোই গালাগালি দিক না কেন। ভোরবেলায় ভিয়েনা থেকে একঘণ্টা উড়েই বাড়ি চলে এলাম, তখনও আমার ঘুম কাটেনি। 
ইতালিতে পা রাখতেই বেশ আপন আপন লাগে, কারণ এ দেশে কিছুই ঠিক করে কাজ করে না। সে নিয়ে ল্যাদারুগুলোর কোনও হেলদোলও নেই। ট্রেনের স্টেশনেই বাসের টিকিট কাটার মেশিন আছে, সব লেখা আছে পরিষ্কার, কিন্তু সেখান থেকে কিছুতেই টিকিট কাটতে দিল না। বাসে টিকিট কাটা যাবে শুনে কাটতে গিয়ে দেখি চালক টিকিট দেবেন না, মেশিনে কেটে নাও। বহুত সেহি। মেশিন এদিকে দেহ রেখেছে, সবাই কার্ড ধরে বসে আছে, ভ্যালিডেট আর হয় না। যদি বা হয়, টিকিট কিন্তু বেরোবে না। টাকা কাটা গেল, মানে ভেবে নাও টিকিট কেটে নিয়েছ। সব কিছুই অল্পবিস্তর ঢিকিয়ে ঢুকিয়ে চলবে, ন'টা পাঁচের ট্রেন ন'টা পনেরোতেও পেতে পারেন, লাইনে গড়বল হলে ট্রেন বন্ধও হতে পারে। ছোট কাপ মানে এস্প্রেসো, বড় কাপ হলে কাফেচিনো, বড় কাপে এস্প্রেসো উইথ মিল্ক চাইলে দোকানদাররা বুদ্ধুর মতো তাকিয়েই থাকে, তারপর আবার একই কথা বলে যায়। ছোট কাপ ইকোয়াল টু এসপ্রেসো, বড় কাপ ইকোয়াল টু কাফেচিনো! ধুরছাই!
আমাদের এয়ারবিএনবির টোনি হেসেকেঁদে মাথাচাপড়ে বলল, সমুদ্র খাবার আর কালচার না থাকলে এই দেশটা উড়ে যেত এতদিন। এমন ডিজাস্টারাস নিয়মকানুন কোনো জায়গায় নেই। ঘরে টিভি থাকলেও ট্যাক্স দিতে হবে, তাই নয়, কম্পিউটার স্ক্রিনকে টিভি বলে কেউ রিপোর্ট করলে লম্বা চিঠি আসবে টাকা চেয়ে। তারপর বোঝাতে থাকো ফোন করে, ইতালিয়ান বিউরোক্রেসির বয়ে গেছে বুঝতে। বাড়িতে বালকনি থাকলে ভেঙে দেওয়াই ভালো, নাহলে ট্যক্স দিতে হবে। রিজন স্পেসিফিক আইনও আছে, সে সব শুনলে চোখ উল্টে বেহুঁশ হতে ইচ্ছে করে। এক জায়গার নিয়ম, কবরখানায় জায়গা না নিয়ে মরে গেলে ফাইন হবে। তোয়ালে পেতে সমুদ্রসৈকতে জায়গা দখল করতে গেলে ফাইন হবে। জুতো ফটফট করে শব্দ করলে ফাইন হবে। আর পাবলিক প্লেসে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে নিজের আলুবোখরা চুলকানোর অভ্যেস থাকলে 'সাধু সাবধান', হেভি ফাইন এর নিয়ম আছে ওসব জায়গায় হাত দিলে! 
তবু ইতালি নিয়ে লোকজন পাগল, কারণ ইউরোপে এমন ডাইভার্স ডেমোগ্রাফিক কালচারাল ল্যান্ডস্কেপ আর কোথাও নেই। আর আইন ফাইনের কথা বলে আমাদের ভয় পাওয়ানো যায় না, কেউ ওসব বললে আমরা তাচ্ছিল্যের ভাব করে বলি, অপন ইন্ডিয়া সে হ্যায় ব্রো। আমাদের দেশের নিয়ম আরো জোরদার।
যাই হোক, বাড়িটা, মানে বাড়ি শহরটা বেশ ছিমছাম। একটা ওল্ড টাউন আছে নিয়ম মেনে,)  গির্জা থিয়েটার সাজানো রেস্তোরাঁ সবই আছে, কিন্তু ওই ভড়কে দেওয়া চাকচিক্য নেই। বেশ একটা ল্যাদ খাওয়া অ্যাম্বিয়েন্স চারিদিকে, অর্ধেক দোকানপাট বন্ধ, যখন ইচ্ছে খুলবে, নিয়ম-ফিয়ম কেউ পরোয়া করে না। পাথুরে দেওয়াল, ফুলেরা টবের ঝুলুবারান্দা, বেড়াল বেঞ্চি আর বেচাল পাবলিকদের দেখতে দেখতে কয়েক চক্কর পাক দিলাম। বিকেলবেলায় সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটা যাবে, আপাতত আমাদের গন্তব্য ঘণ্টাখানেক দূরের এক মফস্বলি গ্রাম, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়ার ফলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই জায়গাটির নাম হল আরবেলোবেল্লো। এইবার যত সহজে নামটা লিখে ফেললাম, ততোটা সহজে নামটা মুখে দূর, পেটেও আসে না। মহা ভজঘট্ট নাম, উলুবুল্লিবুল্লো, ওরেপালাপেল্লো, উরিবাবাভাল্লু, ওল্লোবেড়ালবেল্লো সহ কত কিছু যে বললাম, দু একবারের বেশি সঠিক নামটা উচ্চারণ করা গেল না। তবে নাম না জানলেও এইটুকু জানি যে এই কমিউন ক্যাপিটাল অফ ট্রুল্লি (Trulli) বলে ফেমাস, আর ট্রুল্লি হল এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্যশৈলী। এর বিশেষত্ব হল কুঁড়ে ঘরের মতো দেখতে সাদাপাথড়ের বাড়িগুলোর ছাদটা শঙ্কু মানে কোনিকাল স্ট্রাকচারে থাকে, সেরকম অন্য কোথাও দেখা যায় না। এই ট্রুল্লিহাউসগুলো আগে অস্থায়ী কাজেই ব্যবহার হত, ফসলপত্র রাখার জন্য, শস্য আনাজ ঝাড়াই বাছাই বা কাজকর্ম সেরে একটু তামাক খাওয়ার জন্য, কিন্তু একটা সময় পাবলিক বেকারি, মিল, ওয়াটার ট্যাংক ইত্যাদিতেও এইরকম নির্মাণ শুরু হয়, বাড়িঘরও তৈরি হতে থাকে ট্রুল্লি স্থাপত্য মেনে। গোটা অপুলিয়া রিজন, বিশেষ করে মুর্জিয়া মালভূমি জুড়ে এরকম ট্রুল্লি ছড়িয়ে আছে, কিন্তু ট্রুল্লির বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে বা দেখতে হলে অরবেলবেল্লোই বেস্ট। আইয়া পিকোলা আর অন্যান্য কিছু গ্রামেও ট্রুল্লির নিদর্শন আছে বটে, তবে কিনা স্কেল আর শিল্পমাহাত্ম্য বুঝতে হলে এখানে আসাই বেটার। 
শয়ে শয়ে ট্রুল্লি হাউস মিলে এমন একটা রূপকথার গ্রাম তৈরি করেছে, দেখে বিজাতীয় বলেই মনে হয়। ট্রুল্লিগুলোর অধিকাংশই কাফে রেস্তোরাঁ বি এন্ড বি হয়ে গেছে, তবে এখনও কিছু স্থানীয় মানুষ এই বাড়িগুলোতে থাকেন। একটা সহজ ভুল হয় যে ট্রুল্লির চোঙামার্কা ছাদ দেখে সবাই ভাবে শুধু একতলা কুঁড়েঘর ছাড়া এগুলো কিছুই নয়, আসলে তা নয়, বেশ কিছু ট্রুল্লি তিনতলা বা চারতলা, ভিতরে আধুনিক আসবাবপত্র সব কিছুই আছে। তবে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, ঘিবলি মুভিজের দুনিয়ায় এসে গেছি। বাসে করে আসার সময় চোখ লেগে গেছিল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, প্রতিটা ট্রুল্লির বাইরে একটা করে ঝাবড়ুগোঁফ বেড়াল বসে আছে (এই বেড়ালটাকেই আমি রিপলি সিরিজে দেখেছিলাম, রোমের অ্যাপার্টমেন্টের নীচে বসে সে সব লক্ষ করত) আর ঢুকতে গেলেই বলছে, "ওই ব্যাটা! আমার নাম বেগড়বাই বিল্লো। এই রাজ্য আমাদের। আমাদের মাছভাজা না খাইয়ে ঢোকার চেষ্টা করলে পিছনে কামড়ে গোলগপ্পা বানিয়ে দেব।" মাইরি, সত্যিই এই স্বপ্নটা দেখলাম। যাই হোক, আসলে অমন হুমদো বেড়াল ছিল না। বেশ টুরিস্টি শহর, যদিও অন্যান্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের চেয়ে লোকজন অনেক কম, ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যেই ঘোরা হয়ে যায়। এখন যতোই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি না কেন, সামনাসামনি এমন একটা অদ্ভুত জায়গা দেখলে মুগ্ধ তো হতেই হয়। মানুষ যে কী কী বানিয়েছে, এখনও দেখলে বিস্মিত হতে হয়!
আরবেলোবেল্লো থেকে ফিরে এসেও অনেকটা সময় ছিল হাতে। মে মাসেই একদম ঘোর গরমকাল পড়ে গেছে, এই রোদ্দুরের তেজ সাতটা সাড়ে সাতটার আগে কমবে না। আমি কিছুতেই 'সানস্ক্রিন মনস্ক' হতে পারছি না, তাই কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেই পোড়া বেগুনির মতো মুখ হয়ে যায়। ঘুমও পেয়েছে। সাতসকালে উঠে উড়েছি, মানুষের গতরে কী এত সয়! ভাবলাম একটু কফি খেয়ে গায়ে জোর করি, তা আবার সেই মুখপোড়া ইতালিয়ানদের সঙ্গে ঝামেলা! বড় কাপ হলে কাফেচিনোই হবে, 'কাফে কোন লাত্তে' নয়! এদিকে আমি কাফেচুনোর ফেনা থুড়ি ফ্রথ মোটেও সহ্য করতে পারি না। শেষমেশ সেই কফিই নেওয়া হল আর আরেকপ্রস্থ ভেবলে গিয়ে দেখলাম যে ব্যাটারা কফি আর দুধই দিচ্ছে, শুধু নাম বলছে কাফেচিনো। যাচ্চলে! আ মোলো যা বলে কফিতে চুমুক দিলাম! কিছুক্ষণ কাটাতে হবে। 
আসল কথা হল, দক্ষিণ ইতালির অর্থনীতি চিরকাল দুর্বল। মিলান আর রোমে যত পয়সা ঢোকে, আর কস্মোপলিটান কালচারের সুবাদে যত ডেভেলপমেন্ট হয়, সাউথ ইতালিতে তার কিছুই প্রায় হয় না। এসব জায়গা বহুদিন ধরে মাস টুরিজমের বাইরে ছিল, আমেরিকান বা ব্রিটিশ বড়লোকরা এসে মাস পর মাস থাকত, স্লো ট্রাভেল যাকে বলে। কিন্তু এখানকার মানুষের মধ্যে কোনোদিনই সেই 'করব লড়ব জিতব রে' মনোভাব নেই। অন্য অঞ্চলেও যে খুব বেশি আছে তা নয়, তবে তাদের মধ্যেও দক্ষিণের ব্যাপার আলাদাই। কিন্তু এই লেডব্যাক অ্যাটিটিউডটাই আবার এদের স্ট্রং পয়েন্টও বটে, না হলে সিসিলি আর পুগলিয়ার ইতালিয়ান জ্যাজ আর পপ মিউজিক যেভাবে সঙ্গীত দুনিয়ায় ঝড় তুলেছে, সেটাও হত না। ডোমেনিকো মোদুগনো বাড়ির ছেলে, তাকে ইউরোপের সঙ্গীতপ্রেমীরা একডাকে চেনে, এখানে তিনি প্রায় দেবতার আসন পেয়েছেন। কিন্তু এ যুগেও কাপারেজা, এরিকা মৌ, তারান্তেলা প্রভৃতিরা বেশ নাম করেছেন। কবি লেখকদের যশখ্যাতিও কিছু কম নেই। নিকোলা লাগিওয়িয়া, আলেজেন্দ্রো লিওগ্রান্দে, জয়নকার্লো ভিস্তিল্লি আজকাল দারুণ জনপ্রিয়, কিন্তু এখানকার টেবিল ভাঙা লেখক হলেন জিয়ানরিকো কারাফিগিলিও। একের পর এক ফাটাফাটি গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন, তাঁর চরিত্র গুইদো গুইয়েরিয়েরি ভদ্রলোকটি অবশ্য পেশায় ডিফেন্স লইয়ার। মজার কথা হল, লেখক মহাশয় নিজে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, একসময় তিনি নিজেই অ্যান্টি মাফিয়া ডিপার্টমেন্টে লইয়ার অ্যাডভাইসার হিসেবে কাজ করেছেন, অর্গানাইজড ক্রাইম নিয়ে তাঁর অন হ্যান্ড অভিজ্ঞতাও আছে। কেউ পড়ে থাকলে জানাবেন বইগুলো কেমন? 
কফি মফি খেয়ে, একটু গুলতানি মেরে, হাঁটা দিলাম ওল্ড টাউনের দিকে। গন্তব্য সমুদ্রের ধার৷ অ্যাড্রিয়াটিক সি মানে এখানকার সমুদ্র পূর্ব দিকে বলে সানসেট সেভাবে দেখা যাবে না, তবে জলের ধারে সন্ধ্যের সময় থাকতে ভালোই লাগে। সমুদ্রের ধার দিয়ে বাঁধানো রাস্তা বহুদূর চলে গেছে ওল্ড টাউনকে বাঁদিকে রেখে, ডানদিকে তাকালেই অকুল সমুদ্রের জলরাশি। এই সমুদ্রের ওপারেই সম্ভবত ক্রোয়েশিয়া আর মন্টেনেগ্রো, চমৎকার সব জায়গা। আগেরবার ঘুরে এসেছি, আলবানিয়া অবশ্য যাওয়া হয়নি। হাঁটতে থাকো সমুদ্রের পাশ দিয়ে। ঐতিহাসিক বাড়ি আর আধুনিক বিল্ডিং হাত-ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে, বন্দর এলাকায় নোঙরবন্দী বোটের মেলা। ফিশিং বোটগুলো দেখে চেনা যায়, কিন্তু বেশিরভাগই প্রাইভেট নৌকা, মার্সেই বা গ্রিসের মতো অত যত্নআত্তি অবশ্য নেই। সমুদ্রটা প্রায় মেরিন ড্রাইভের মতো ঘুরে গেছে, কিছুটা জায়গা ঘুরে একটা নতুন ওয়াকওয়ের কাজও চলছে। তরুণ তরুণীদের দল, গাঁজাখোর গুণ্ডা, পিকনিকরত প্রেমিক যুগল... সব মিলেগা! সবাইয়ের দেখাদেখি আমরাও বিয়ার খাব বলে দুটো বোতল নিয়ে এসেছিলাম, চা তো জুটবে না, তা সেই লেবু বিয়ারে বিয়ারের ব নেই, কফি খেয়ে বেশ একটা নেশা নেশা আমেজ হয়েছিল, পুরো চটকে চড়চড়ি হয়ে গেল। খেতে অবশ্য ভালোই, তবে কিনা.. অস্ট্রিয়ার লেমন ফ্লেভারড বিয়ার এর চেয়ে ঢের ভালো। 

The Beach Life Here comes the summer Competition? NAAH!
The cliff-hanger Random shot of Matera Streets  Boat Life Dominico the Singer  কীসব বানিয়ে রেখেছে?  Pollignano a mar train station  The hidden 'Sassi'
Sassi of Matera Polignano a Mare old town  Trulli models 🤗 Carbonera cum Pasta The usual decorations Trullis of Arbelobello

সকাল থেকে টো টো করছি, ব্যাগও সঙ্গে সঙ্গে চলছে। এদিকে দেখলাম যে এয়ারবিএনবি যেতে হলে দশটার ট্রেন লাস্ট, ঘণ্টায় একটাই ট্রেন। এদিকে টোনি ওরফে বি এন বি হোস্ট বারবার বলে দিয়েছে, রাতে বাস না নেওয়াই ভালো, যত গুণ্ডা আর ক্রিমিনালদের আড্ডা। আমি যদিও পাত্তা দিইনি, ওরকম গুণ্ডা অনেক দেখা আছে, (সিসিলিয়ান মাফিয়া হলে হত, এ তো পাশের 'বাড়ির' গুণ্ডা) তবে কিনা ট্রেনে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়, তাই হুড়মুড়িয়ে খেতে যেতেই হল। সাউথ পুগলিয়ার ছ্যাকরা দোকান, খাবার বলতে নোকি/নুচি (লুচি না, আলু ময়দা দিয়ে তৈরি পাস্তা) আর এই সেই পাস্তা ছাড়া সব শেষ। ওইসব খেয়েই ছুটলাম। গিয়ে দেখি গাড়িবাবাজি দশ মিনিট দেরি করেও আড়মোড়া ভাঙছে। দুটো স্টেশন দশ মিনিট। শহরতলির যে পাড়ায় দুই রাত্তির এর ব্যবস্থা, সে জায়গাটা বেশ পছন্দই হল। টোনির সঙ্গে সামান্য গল্পগাছাও হল, তবে বেশি নয়, দ্বিতীয় দিন অবশ্য আড্ডা গড়িয়েছিল দু ঘণ্টা ধরে।

পরদিন সকাল সকাল উঠেই ট্রেন ধরে পোলিগনানো (পলিয়ানো) আ মারের দিকে রওনা দিলাম। ছোট্ট এই শহরটির একদম সমুদ্রের ধারে ক্লিফের ওপর অবস্থিত, বেশি দূরও নয়। ডোমেনিকো মোদুগনোর একটা চমৎকার প্রতিমা আছে এখানে, আর আছে স্বচ্ছ সবুজ নীল রঙের সমুদ্র, সেই সমুদ্রের ধারে গ্রীষ্মের সময় মেলাই বসে যায়। এখন ভিড় ততো নেই, পাথরের ওপর বসে বসে দেখি কে কতদূরে সাঁতার কাটছে? এতদিন সাঁতারটা কিছুটা রপ্ত হয়েছে, তবে ওয়াটার ট্রেডিং এর ব্যাপারটা ঠিক কব্জা করা যায়নি। এদের দেখি উইদাউট এফর্ট জলকেলি করতে করতে মাঝসমুদ্রে চলে যায়, তখন বড্ড হিংসে হয়। ইউরোপের অনেক জায়গাতেই সরকার বিনামূল্যে ছোটদের সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করে, এদিকে আমি সাঁতার শিখতে গেছি শুনে বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড হয়েছিল। শেষমেশ শিখলাম, কিন্তু ছোটবেলার সেই ফ্রি ফ্লো নেচারটা চলে গেল। সাঁতার না শিখে, খেলাধুলো না করে, গিটার ফিটার না বাজনো শিখে যা করলাম, সে সব কোনো কাজেই লাগল না। যাকগে!

পোলিগনানো আ মারে টিপিকাল ল্যাদ খাওয়ার শহর। ছোট ছোট জিলিপি গলি, পিকচার পার্ফেক্ট লোকেশন, সাজানো বাড়িঘর রেস্তোরাঁ। খানিকটা পরপরই ক্লিফ লাগোয়া এক একটা ভিউপয়েন্ট, সেখান থেকে নড়তে ইচ্ছে করে না। সমুদ্রে অনেকে নৌকা নিয়ে এক্সকার্শনে বেরিয়েছে, সিগালরা ওড়াউড়ি করছে। রোদের তেজ অত বেশি নয়, ফুরফুরে বাতাসও বইছিল। ভালোই লাগে। একবার করে ভিউ পয়েন্টে দাঁড়াও, ফের হাঁটো। হাঁটতে গেলে এক একটা পিয়াজ্জা পড়ে, প্রায় প্রতিটায় কেউ না কেউ বসে গিটার বাজাচ্ছে। এই বাস্কার শিল্পীগুলোর মিউজিক টেস্ট অসামান্য, আমি খেয়াল করে দেখেছি। এরা অনেকেই নিজেরাই গান কম্পোজ করে, না করলেও একের পর ওকএমন সব চমৎকার গানের সুর তোলে যে নড়তে ইচ্ছে করে না, আমি মাঝেমধ্যে এদের ইন্সটাগ্রামে ফলো করে বেশ ভালো ভালো গানের খোঁজ পাই। 

বিকেলের আগেই ফিরতে হল, কারণ আমাদের মাতেরা যাওয়ার টিকিট কাটা আছে। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, তারপর ব্যাক টু বাড়ি। পরদিন বাড়ি টু বাড়ি। (যদিও আমার বাড়িঘর কিছুই নেই) 

এইবার স্বীকার করতেই হচ্ছে, মাতেরা সম্পর্কে আমার আগে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না। জেমস বন্ডের 'নো টাইম টু ডাই' এর ওপেনিং সিকোয়েন্স আর কতগুলো ছবি দেখা ছাড়া আমি শুধু জানতাম, এই জায়গাটা বাড়ি থেকে কাছেই।  কিন্তু মাতেরা যে ঠিক কী জিনিস, সেটা জানা থাকলে এখানে আর একটু সময় নিয়ে আসা যেত। 

মাতেরা বাসিলিসাতা রিজনে অবস্থিত, মাতারা প্রভিন্সের রাজধানী। প্যালিওলিথিক যুগ থেকেই এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটা নিয়ে যুদ্ধ চলছে। কতবার যে হাতবদল হয়েছে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। এই শহরটা আসলে এতটাই অদ্ভুত ভাবে বানানো যে লিখে বোঝানো মুশকিল। এখানকার মূল শহর বা সাসি যা কয়েক হাজার বছর ধরে একই রকম আছে, সেগুলো আসলে ক্যালকারেনাইট রক বা পাথর কেটে বানানো গুহারূপী বাড়ি, যা শহরের দুই প্রান্তে অবস্থিত। গুহা বলেছি বলে হামাগুড়ি দেওয়া গুহা ভাবতে হবে না, আসলে এই বাড়িগুলো পুরোপুরি বাড়িই, কিন্তু স্থাপত্যশৈলীটা ভিন্ন। গ্রাভিনা নদী বয়ে গিয়েছে এই শহরের পাশ দিয়েই, আর সেই নদীর দু পাশের র‍্যাভাইনে ভলক্যানিক রক অ্যাসেম্বল হয়ে হয়ে এইরকম রক ফর্মেশন বানিয়ে ফেলেছে যে চাক্ষুষ না দেখলে বোঝার উপায় নেই। এই র‍্যাভাইনের জন্য একটা প্রাকৃতিক সীমানা তৈরি হয়ে গিয়েছে মাতেরার সাসির সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার,  তার মানে এই যে কেউ না জানলে পাঁচশো মিটার দূরে দাঁড়িয়েও বুঝতেও পারবে না এখানে এমন একটা শহর আছে। এমনকি, বাস আমাদের যে শহরে পৌঁছে দিল, সেই সমতল ভূমির আধুনিক শহরটা দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে মিনিট চল্লিশ হাঁটলেই এমন একটা অন্য দুনিয়া অপেক্ষা করে আছে। মাতেরর সাসির কাছাকাছি হাজারটা ওপেন রক, গুহাশিল্প ইত্যাদি দেখা যায়, বাসিলাসাতা রিজনের আদিগন্ত সবুজ বিস্তারও চোখে পড়ে। একগাদা হাইকিং ট্রেল চলে গিয়েছে পাহাড়ের মধ্যে, সময় নিয়ে এলে জায়গাটা একেবারেই অন্য ভাবে ধরা দেবে। ব্যাটা বন্ড আগে থেকেই জানত, নাহলে সুন্দরী লিয়া সিদুঁকে নিয়ে এখানে ছুটি কাটাতে থোড়াই না আসত। কোই নেহি, জানা রইল। হুড়মুড়িয়ে মাতেরা ভ্রমণ সেরে বাসে করে ফেরার সময় দেখি, বাইরে সানসেট হচ্ছে। সোনালি আলোয় রশ্মি ঢুকে পড়েছে বাসের জানলা দিয়ে।

বাদবাকি যা রইল, তা থাক! আসা যাওয়ার মাঝে অনেক কথাই না বলা থেকে যায়, সে সব থেকে যাওয়াই ভালো।


 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on May 23, 2024 14:36
No comments have been added yet.