দিনযাপন (বসন্ত ২০২৪) -৩


নতুন বছরের আসে, চলেও যায়। এতই তাড়াতাড়ি চলে যায়, যে বছরটা যে আদৌ এসেছিল কিনা, সেই নিয়েই মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় আমার। যাই হোক, নতুন বছর আসছে, আজকাল এই কথাটা দু একদিন আগে কেউ না কেউ আমাকে মনে করিয়ে দেয় বলে জানতে পারি। আগে ভাবতাম, যাহ, আরেকটা বছর জলে গেল! 

এখন ভাবনা বা দুর্ভাবনা কিছুই হয় না, শুধু মনে হয়, অ, নতুন বছর এসে গেছে! শারদীয় আনন্দমেলার বিজ্ঞাপন এল বলে!

তা আমি নতুন বছরের উইকেন্ড কী করে কাটালাম! শনিবার দেখলাম, কাউচসার্ফিং এর ছেলেমেয়েরা সিটি হাইক করছে, তিন নম্বর রুট শহরের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বন জঙ্গল পাহাড়পর্বত চড়াই-উৎরাই  দিগন্তজোড়া সবুজ বিস্তারের ভিউপয়েন্ট দেখিয়ে আবার সেই একই জায়গায় ফিরে আসবে, ম্যাপ অনুয়ায়ী আট নয় কিলোমিটার পথ। একটা থেকে ছটা, চড়াইয়ের পর অবশ্য রেস্টপয়েন্টও পাওয়া যাবে! চললুম দুজনে কোমর বেঁধে। অনেকেই এসেছে। এদেশীয় মানুষ, এদেশীয় কেন, ইউরোপ আমেরিকার অধিকাংশ মানুষের জীবনেই আউটডোর অ্যাক্টিভিটিটা একটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার, ঘরে বসে থাকা এদের স্বভাবেই নেই। কেউ ছুটছে, কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ কায়াক নিয়ে নদীতে নেমে পড়ছে, শীত পড়লে স্কি করতে  চলল, গরম পড়লে সাঁতার কাটতে নামল... অনেকটা বাঙালির চৈত্র সেলে গিয়ে বইপত্র জামা জুতো কেনার মতোই ব্যাপার। হাইকিং তো বারোমাসই চলছে, আর হাইকিং ট্রেলও বানিয়েছে বটে! গোটা ইউরোপ জুড়ে হাঁটতে থাকো সারাজীবন, শেষ হবে না। যাই হোক, এই যাত্রায় বেশ কয়েকজন চমৎকার বন্ধু হল। ফিনল্যান্ডের এক ছেলে এসেছে, সে পাখিপাগল, টিটি পাখির ডাক শুনে পাখির বাপ ঠাকুরদার নামও বলে দিতে পারে। আর একটা ছেলে অ্যালেক্স, তাকে দেখতে গ্যারি ওল্ডম্যানের মতো, সে স্কেটিং আর সাইকেল নিয়ে পড়ে থাকে। ইউনিভার্সিটি থেকেও একটা দল এসে যোগ দিয়েছে, অঙ্কুশ বলে একটা ঢাকার ছেলের সঙ্গে পরিচয় হল, টেলিকম নিয়ে পড়ছে, চরকির সিনেমার কথা বলতে বলল সিনেমা নিয়ে ইন্টারেস্ট নেই, বই পড়ে মাঝেমাঝে। আমি ফুলে ফুচকা হয়ে জিগোলাম কী পড়েছে শেষ? তাতে সে বলল মানিক বন্দোপাধ্যায় আর হুমায়ুন আহমেদ, নতুনদের লেখা বিশেষ পোষায় না! হুমম!

মরিয়ম বলে একটা আরবের মেয়েও চলেছে, তাকে দুজন মিলে ক্রমাগত হাবিবি হাবিবি করে ভেঙাচ্ছে, মেয়েটাও ব্যাপারটা বেশ এনজয় করছে মনে হল। আরেক ভারতীয় ছেলে ছিল, নাম নরেশ, থাকে কোপেনহেগেনে। প্রায় কুড়ি পঁচিশজন ছেলেমেয়ে, সবাইকে একাট্টা করে নিয়ে চলেছে আমাদের লিডার মার্টিন, সে ব্যাটা ভিয়েনার সিএস অ্যাম্বাসাডর, প্রতি সপ্তাহে লুক চেঞ্জ করে ফেলে। এই সপ্তাহে একটা গাব্দা গোঁফ রেখেছে।

তবে সবচেয়ে ভালো লাগল, এই হাইকে একটা অন্ধ ছেলেও ছিল, মূলত পলিশ, চড়াই-উতরাই গোটা রাস্তাটাই অ্যালেক্সের হাত ধরে চলল সে, বাড়তি কোনও সাহায্য চাইল না, কেউ আগ বাড়িয়ে বাড়তি সাহায্য করার কথা ভাবলও না। ছেলেটা একবারে লেভেলের ইন্টেলিজেন্ট, কথাবার্তা শুনে যা বুঝলাম, তাতে মনে হল ভাষাবিজ্ঞান থেকে টেকনলজি, সব কিছুতেই সে বাকিদের টেক্কা দিতে পারে। বাদাম চিবুতে চিবুতে মনে হল, ছুটির দিনগুলো এইভাবে হাইল করলে মন্দ হত না! ব্যাঙ্গালোরে থাকতে যত ফালতু লেখালিখি করে সময় নষ্ট করেছি, ওসব মিডিওকার লেখা লেখার চেয়ে শনিবার রবিবার ট্রেক করলে হত! অবশ্য ট্রাফিকের জ্বালায় বাইরে বেরোতে ভয় হত, সে কথাও সত্যি।

ঝকঝকে রোদ উঠেছিল, চমৎকার আবহাওয়া, চার পাঁচ ঘণ্টা গল্পগুজব করে হাঁটতে হাঁটতেই কেটে গেল, মাঝে একটা খোলা মাঠে ঘাসের ওপর বসে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া হল। ছ'টা নাগাদ ফিরে দেখি, গা অব্দি ঘামেনি।  নববর্ষ উৎসব হোক না হোক, অন্যান্য উৎসব চলতেই থাকে এ শহরে। ফ্লি মার্কেট, আর্ট এক্সিবিশন, সিনেমা... ফেরার সময়ে দেখি বালকান ফুড ফেস্টিভ্যাল চলছে। হুড়ুমদুড়ুম গান, বিয়ারের ফোয়ারা, মাংস গ্রিল হওয়ার গন্ধে মাথা গরম হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়! এসব জায়গায় গিয়ে আমি পিপল ওয়াচিং করি! জনজোয়ার, ঠিক হুজুগে বাঙালির মতোই মেলাত গিয়ে বেশি দাম দিয়ে রোল চাউমিন খাওয়ার লোক, এখানে দুরুম পরোটা আলুভাজা খায় আর কি! আর আইসক্রিম। আইসক্রিম না খেলে বলে বসন্ত পালন হয়  না, এমন পাপ করলে ঠাকুর গোঁসা হয়। আমি এদিকে ঘাসের জাজিমে বসে বসে লোকজনকে দেখে যাই। কোন ছোঁড়া দুষ্টুমি করছে, কোন জুটি নতুন প্রেমে পড়েছে, কোন ছেলে একমনে আলুভাজা খাচ্ছে বা সাইকেল চালাচ্ছে, মাঝেমধ্যে ব্র‍্যাড পিট বা জেনিফার কনেলিরও দেখা পাওয়া যায়। একা বসে আছে। তখন মনে হয়, ধুস, বছর পনেরো আগে হলে আমি নিজেই একটা বিফোর দ্য সানরাইজ বানিয়ে ফেলতে পারতাম। 

রবিবার আমাদের বাঁধা প্রোগ্রাম। গুরুদ্বারা গিয়ে ভুরিভোজ। সেখানেও অবশ্যি পিপল ওয়াচিং কম হয় না। তবে মাঝেমধ্যে খানিক ডিটোর নিয়ে টুলিপ গার্ডেন বা বার্ড পার্কে ঢুকে পড়ি। গত সপ্তাহে একটা প্রকাণ্ড গ্লাসহাউজে ঢুকে পড়েছিলাম না জেনেই। গিয়ে দেখি, কৃত্তিমভাবে ট্রপিকাল ক্লাইমেট তৈরি করে রেখেছে। ৩৫ ডিগ্রি গরম, ক্রান্তীয় এলাকার গাছপালা, ফুল, নানারকম পাখি, গিরগিটি, ফড়িং নাচানাচি করছে। এত পাখি দেখে এমন লাফালাফি করলাম, ভুলেই গেছি যে অন্য বাচ্চারাও সেখানে ঘুরতে এসেছে। তাদের অনেকেই আমাদের দেখে ভুরু কুঁচকে ভাবছে, আদেখলাপনা দেখো! শালোরা আগে কোনোদিন পাখি দেখেনি! কে বোঝাবে, সত্ত্যিই তো দেখিনি! দেখি না! কোথায় পাখি? কাক চড়ুই পায়রা বাদে বিশেষ কিছু চোখে পড়ত না দেশে থাকতে, কেরলে প্রথম লেজ ঝোলা পাখি দেখতে গিয়ে আমি প্রায় খাদে পড়ে যাচ্ছিলাম। এই সব করে দিন কাটাতে কাটাতে মনে হয়, মন্দ কি! নতুন বছর ভালোই তো কাটল! তারপর এ-ও মনে হল, শুভনন্দন কথাটা তো শুনতে ভালোই!

















 

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 15, 2024 04:33
No comments have been added yet.