জয় জ্যাসনের জয়

 


নরওয়েন শিল্পী জ্যাসন-- আসলে যা ছদ্মনাম-- বেশ কয়েক দশক ধরে গ্রাফিক নভেল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তাঁর বিশেষত্ব হল, তিনি সচরাচর মানুষদের আঁকেন না। হিউম্যান ওয়ার্ল্ডের গল্প বলতে হলেও তাঁর চরিত্ররা অ্যান্থ্রপোমরফিক মানে কুকুর, বেড়াল, হাঁস, কাক, শেয়াল হয়ে গল্পে আসে। তবে তা শুধু চেহারাতেই। পোশাক পরিচ্ছদ থেকে সংলাপ, প্রেম থেকে অবসাদ, সব কিছু একেবারে মানুষের মতোই থাকে। দ্বিতীয়ত, জ্যাসন  হাইব্রিড আর্ট ফর্মকে নানাভাবে তাঁর কাজে ব্যবহার করে থাকেন। সিনেমা, উপন্যাস বা কবিতা অথবা সমসাময়িক ঘটনা আর পপ কালচার ব্লেন্ড করে তিনি একটা তুখোড় গল্পের প্লট নিয়ে হাজির হন প্রত্যেকবার আর পাঠক ও সমালোচকরা প্রতিবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। ক্লিয়ার লাইন স্টাইল ব্যবহার করলেও তাঁর কালার প্যালেট আর গল্প বলার ধরন এতটাই অদ্ভুত যে সকলে একবাক্যে ভালো বা মন্দ বলতে পারে না। কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে, কেউ কেউ আবার একটু হতাশ হয়, কিন্তু তারাও পরের বইটা পড়তে ছাড়েন না। জ্যাসনের কোন বই যে কোন পাঠককে ঘায়েল করে ফেলবে, আগে থেকে বোঝা বড়ই মুশকিল। যেমন, 'পকেট ফুল অফ রেইন' পড়ে আমার খুব গভীর আর সেন্সিটিভ মনে হয়েছিল, কিন্তু 'হোয়াই আর ইউ ডুইং দিস' এর শেষে গিয়ে আমি ধরতেই পারিনি কী হল? গল্পটা অবশ্য জব্বর ছিল। একদম হিচককিয়ান স্টাইল মার্ডার মিস্ট্রি, জিম জার্মুশের ফিল্মমেকিং এর আস্বাদ নেওয়া গল্প। তবে ওই, প্রথমবারে আমি মাথা চুলকোতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে থাক, যে দুটো নতুন বই পড়ে এই পোস্টটা করার ইচ্ছে হল, সেগুলো নিয়েই কথা বলা যাক।


১) আই কিল্ড অ্যাডলফ হিটলার


অল্টারনেট হিস্ট্রি নিয়ে কত গল্পই না হয়েছে! কিন্তু মাত্র আটচল্লিশ পেজে এমন ভীষণ অল্ট হিস্ট কাম গ্রাফিক নভেল কোনোদিন কেউ লিখেছে বলে জানা নেই। এমন একটা দুনিয়া, যেখানে কন্ট্র‍্যাক্ট কিলিং এর পেশাটা ডাক্টার উকিল বা ইঞ্জিনিয়ারের মতোই। চেম্বার খুলে বসে থাকো, ক্লায়েন্টের কমতি নেই। কারো বাড়িওয়ালা ঝামেলা করছে, কারো বস প্রোমোশন দিচ্ছে না, কারো গার্লফ্রেন্ড ব্রেক করার ভয় দেখাচ্ছে, মাল ফেললেই পেশাদারভাবে কাজ হাসিল হয়ে যাবে। রাস্তাঘাটে আকছার লোকে গুলি চালিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ কেয়ার করছে না। এমন সময় আমাদের প্রোটাগনিস্ট, যিনি নিজেই এই কাজটা করে থাকেন, তাঁকে হিটলারকে মারার কন্ট্র‍্যাক্ট দেওয়া হল! কী করে, সে সব ব্যাপার নয়! আসল ঘটনা হল, কাজটা ভণ্ডুল হয়ে গেল আর হিটলারকে মারতে গিয়ে আমাদের হিরোর জীবন বেমালুম পাল্টে গেল। কোথা থেকে এই সাই ফাই কাম স্পেকুলেটিভ ফিকশন কাম লাভ স্টোরি মহৎ সাহিত্য হয়ে উঠবে, তাও আটচল্লিশ পাতার মধ্যে, আপনি ধরতেও পারবেন না। একটাই কথা বলা যায়। স্যাভেজ। 


২)লেফট ব্যাংক গ্যাঙ


ক্রিয়েটিভ জিনিয়াসের আরেক নমুনা। জ্যাসনের এই গল্পে ১৯২০-র দশকের প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারকে জীবন্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। আইসনার অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এই গ্রাফিক নভেল নিয়ে লোকে এইসা নাচানাচি করেছে যে বলার নয়! কেন করেছে? কারণ আছে যে! এই কমিক্সের চরিত্ররাও যথারীতি অ্যান্থ্রপোমরফিক, কিন্তু তাঁদের আমরা সবাই চিনি। স্কট ফিটজেরাল্ড, এজরা পাউন্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস তো আছেনই, জেলডা ফিটজেরাল্ড, সাঁত্রে, গের্টুড সহ আরো অনেকেই এসেছেন। তা এই দুনিয়ায় এই কালজয়ী সাহিত্যিকরা সবাই আসলে গ্রাফিক নভেলিস্ট, প্যারিসে তারা নতুন কমিক্স নিয়ে কাজ করতে এসেছেন। তবে সমসাময়িক সময়ে অন্যদের কাজ নিয়েও কাফেতে বসে বিস্তর চর্চা হয় বইকি! ফকনার বা টলস্টয়ের লেখা থুড়ি আঁকা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ! কোন কমিক্সে হোয়াইট স্পেস নেই, কার আঁকা চরিত্ররা একইরকম দেখতে লাগে, সব কিছুই চলছে। পাশাপাশি জীবনের নানান ঝামেলা তো আছেই! সে সময় আর এই সমস্ত সাহিত্যিকদের জীবন সম্পর্কে জানা থাকলে এই গ্রাফিক নভেল আপনার মাথা খারাপ করে দেবে। স্কট আর জেল্ডার বিয়ের ঝামেলা, তাদের চরিত্রের বিশ্লেষণ, জেমস জয়েসের উদাসীনতা, হেমিংওয়ের ডেয়ারডেভিল অবতার... সব আছে। আর আছে একটা ট্যারান্টিনো স্টাইল মানি হাইস্টের অসামান্য বর্ণনা।  স্রেফ, ওই আটচল্লিশ পেজে! ফ্যান্টাবুলাস, আই মাস্ট সে! রেমো স্যারের ভাষায়, নাউ দ্যাটস হোয়াট আই কল আ পারফর্ম্যান্স!

জ্যাসনের জয়! প্রকাশক ফ্যান্টাগ্রাফিক্স। 

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 14, 2023 07:02
No comments have been added yet.