হেলো বিউটিফুল

অ্যান ন্যাপোলিটানোর নতুন বই 'হ্যালো বিউটিফুল' নিয়ে পাঠকরা উচ্ছ্বসিত। জটায়ুর কথায় বইখান একদম গরম খাস্তা কচুরির মতো বাজার থেকে উড়ে যাচ্ছে। তাঁর আগের বই 'ডিয়ার এডোয়ার্ড' নিয়েও প্রায় এই লেভেলের পাগলামি দেখা গিয়েছিল, অ্যাপল টিভি ঝটপট সিরিজও বানিয়ে ফেলে। কিন্তু 'হ্যালো বিউটিফুল' যেন সেই বইটাকেও ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু তবু এতদিন বইটা পড়িনি, কারণ সার সংক্ষেপ দেখে পড়ার আগ্রহ বোধ করিনি। ইয়ে, খানিকটা হামবড়া ভাব বলা যেতে পারে, কিন্তু এত এত বই যেখানে না পড়া আছে, সেখানে নতুন একটা বই ঠিক কেন পড়ব, সেখানে নানা ধরনের ফিল্টার লাগাতেই হয়। 

প্রতি বছর বাংলায় (এবং অন্যান্য ভাষায়) এরকম বহু লেখা প্রকাশিত হয়, যেগুলো আসলে 'লাইফ হ্যাপেন্স' গোত্রের লেখা। সাধারণ মানুষের জীবন, সম্পর্ক, প্রেম, বিচ্ছেদ নিয়ে লেখা গল্প, স্টোরিলাইন বা প্রেক্ষাপটে বিশেষ নতুনত্ব কিছুই থাকে না। পড়তে বসে দিব্যি পড়া হয়ে যায়, আবার ভুলে যেতেও সময় লাগে না। এই লেখাগুলো কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে না আজকাল, হয়তো বয়স বেড়েছে বলেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, লেখকের লেখার হাতটি তো বেশ, লিখতে জানেন, গল্প বলতে জানেন, তবু কেন সেই একই চর্বিতচর্বণ ঘটনা আর প্লট নিয়ে লিখছেন? এখন সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার সে কী লিখতে চায়, তাতে আমার কী বলার থাকতে পারে? কিন্তু মোদ্দা কথা, এই লেখাগুলো পড়তে আর বিশেষ আগ্রহ বোধ করি না, সে যতই বেস্টসেলার তকমা পাক না কেন! ওই যে বললাম, সময় কম! আর পাঠকের রুচি যে ভিন্ন ভিন্ন হবে সে কথাও নতুন নয়। ফলে, ফিল্টার না লাগিয়ে উপায় নেই। কিন্তু এরই মধ্যে এক একটা বই ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে, ভাব, ভাষার ব্যবহার বা ক্রাফট সাধারণ গল্পগুলোকে অসাধারণ করে তোলে, তখন বোকা হয়ে যেতে হয়। বাংলায় সমসাময়িক কিছু কলম সেটা বার বার করে থাকেন। 

তাই শেষমেশ হ্যালো বিউটিফুল পড়তে শুরু করেছিলাম। যদি তেমন কোনো এক্সপেরিমেন্ট থাকে! ভাষা বা লেখনীর মধ্যে এমন কিছু নতুনত্ব থাকে, যা আগে দেখিনি! কারণ, গল্পে তো কিস্যু নেই। মানে, গল্প একটা আছে বটে, ওই লাইফ হ্যাপেন্স টাইপ গল্প, প্রেম বিচ্ছেদ বোকামি অবসাদ মন কেমন উপলব্ধি... জীবন যেমন বয়ে যায়...ইত্যাদি ইত্যাদি, সে সব নিয়েই উপন্যাস। এক্সক্লুসিভ বলতে কিচ্ছু নেই। এ বাদে কী আছে কী নেই, সেটা অবশ্য পড়া শুরু করার পর বোঝার উপায় রইল না, কারণ আমি টানা সাড়ে তিনশো পাতা পড়ে বই বন্ধ করলাম। এমন গোবেচারা কোন উপন্যাস (যেখানে কিছুই নেই আসলে) আমি একটানা পড়েছি মনে করতে পারলাম না। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, অ্যান ন্যাপোলিটানোর লেখায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, ভাষার ব্যবহার বা ট্রিটমেন্টে বিশাল কিছু এক্সপেরিমেন্ট নেই, নন লিনিয়ার ন্যারেটিভও তেমন নেই, কল্পনার সঙ্গে বাস্তব মিশিয়ে বিশাল কোনো চমক দেওয়ার চেষ্টাও তিনি করেননি (একবার অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বইটা 'লিটল উমেন' এর আধুনিক অ্যাডাপ্টাশন হতে পারে, সেটা তেমন কিছু নয়) তবু হ্যালো বিউটিফুল আমাক্ব উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি প্রায় সবগুলো চরিত্রকে ভালোবেসে ফেললাম। তিনদিনে বই শেষ করে আমি অ্যান ন্যাপোলিটানের আগের বইটা পড়ব বলে তুলে ফেলেছি। এরই মাঝে বোঝার চেষ্টা করলাম, বইটা আমার ঠিক কেন ভালো লাগল?

যা বুঝলুম, হ্যালো বিউটিফুল বইখানায় শুধু একটাই জিনিস আছে, সেটা হল যত্ন। ভালোবাসা বা মমতাও বলা যায়। এমন মমতা দিয়ে গড়া গল্প যে পড়ে মনে হয় কেউ নিজের জীবনের কথাই বলছে। কিন্তু যে কথাটা আসলে মনে পড়ছে, সেটা হল 'টেন্ডার'। এই মাধুর্য, এই টেন্ডারনেসটা গোটা বই জুড়ে ছড়িয়ে আছে। চরিত্রদের সংলাপে, ব্যবহারে, রাগ বা বিষন্নতায়... আর এই টেন্ডারনেসের ম্যাজিকেই পাঠক গলে যায়, ভুলে যায় অন্য সব কিছু। এই গল্পে কোনও ভিলেন নেই। সবাই সাধারণ মানুষ, একটু বেশিই ভালো তারা। ভালো বন্ধু, ভালো বোন, ভালো দম্পতি, এক দুসরে সে কারতে হ্যায় পেয়ার হম মার্কা ফ্যামিলি! কিন্তু কিছুতেই ব্যাপারটা ন্যাকামি বলে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। এমন একটা ফ্যামিলি ভ্যালু আর বন্ধুত্বের গল্প দিয়ে আজকালকাল দিনে বেস্টসেলার হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অ্যান সেটা পেরেছেন। কী করে যদি বুঝতে চান, বইটা পড়ে ফেলুন।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 14, 2023 07:13
No comments have been added yet.