দুই বন্ধুর কিসসা

 


দুই বন্ধু। দুই শিল্পী। রাম কুমার আর হুসেন। ছয়ের দশকের প্রথম দিকে এই জুটি রঙ তুলির বোঁচকা নিয়ে বেনারসে এসে উপস্থিত হয়েছিল। দুজনেই তখন আঁকা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে। সবাই শুধু বলে, বেনারসে গেলেই নাকি আঁকার সাবজেক্ট পাওয়া যায়। তাই এই যাত্রা! তার আগে অবশ্য এলাহাবাদে গিয়েছেন দুজনেই, মুনশি প্রেমচন্দের ছেলে শ্রীপত রাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেখানেই, ফলে বেনারসে থাকার ব্যবস্থা হল প্রেমচন্দের বাড়িতেই। সেখানে সর্বক্ষণ সাহিত্যিকদের আনাগোনা। একে তো সাহিত্যিক, তারপর আবার বেনারসের! কথার তোড়ে দুই বন্ধুর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। ভয়ানক বিপদ। ঠিক হল, রোজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে। দুজনে যাবেন দু দিকে, যদি কিছু পাওয়া যায় কাজের জিনিস।

সেই 'সিলসিলা' চলল। হুসেন একদিকে যান, রাম কুমার অন্যদিকে। গরুর গুঁতো, রিকশার ঠেলাঠেলি, দোকানিদের ভিড় কাটিয়ে নির্জন গলিতে গিয়ে পড়েন, কাশীনরেশের পরিত্যাক্ত হাভেলিতে গিয়ে বসে থাকেন। সন্ধ্যার সময় পায়রার দল উড়ে যায়, বিষন্নতার রঙ ধরা দেয় মাঝি মাল্লাহদের উজ্জল মুখের আড়ালে। দুই শিল্পী নিজের মতো করে দেখতে চান সে সব। তাঁদের পিছু নেয় শহরের ধুলো, মসলিনের আবরণের মতো সে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ঘুরে বেড়ান দুজনে। নৌকায় বসে থাকেন, ঘাটের সিড়িতে বসে চা খান, গল্প জুড়ে দেন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে।  রাত ঘনালে বাড়ি ফেরেন, কোনোদিন আবার গঙ্গার ঘাটেই রাত কেটে যায়। রাতের অন্ধকারে, ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় বুঝতে চেষ্টা করেন বেনারসের চরিত্র। কখনও পারেন, কখনও পারেন না। এই শহর সবাইকে একভাবে ধরা দেয় না।

হুসেনের চঞ্চল মন বেনারসের সঙ্গে ভাব জমাতে পারেনি। পনেরো দিনের মাথায় তিনি বোরিয়াবস্তা তুলে ফিরে যান, পালিয়ে বাঁচেন বলা যায়। রাম কুমার থেকে যান। সপ্তাহ কাটে, মাস কাটে, বছর কাটে। এক বছর, দু বছর... রাম কুমার বেনারস ছেড়ে নড়েন না। কত সময় কাটল, ক'টা ছবি আঁকলেন, কতটা দূরত্ব অতিক্রম হল এ জীবনে, সে সব তখন অবান্তর। তখন তিনি রমতা যোগী। এই শহরের ভিতর যে আরেকটা শহর বয়ে যায়, তার সন্ধান খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি, সেই শহরের নেশা ধরে গিয়েছিল রাম কুমারের। পরবর্তীতে বলেছিলেন, তাঁর সমস্ত শিক্ষার মূলে আছে এই শহর। বারাণসী।

ভারতবর্ষে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট আর ফিগারেটিভ শৈলি নিয়ে যে কাজ করে গিয়েছেন রাম কুমার, সে নিয়ে জীবনকালে দেশে তেমন আলোচনাও হয়নি। তিনি ফাইন আর্টস নিয়ে গতানুগতিক পড়াশোনা করেননি, দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স থেকে ইকোনমিক্স নিয়ে পোস্ট  গ্র‍্যাজুয়েশন করেছিলেন। সেলেব আর্টিস্ট হওয়ার বাসনাও তাঁর ছিল না। আজীবন প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপের সদস্য ছিলেন, যা মনে এসেছেন তাই এঁকেছেন। কী আঁকলে নাম হবে, প্রদর্শনী হবে, পয়সা হবে, সে সব নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তাই ছিল না। 

ভিয়েনার একটা অকশন হাউসের পোস্ট দেখার সময় জানতে পারলাম, রাম কুমারের আঁকা নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি তাঁর আঁকা পেইন্টিং 'ভ্যাগাবন্ড' এক মিলিয়ান ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। তাঁর 'মেলোফি' স্টাইল মানে মেলানকলিক লোনলি ফিগার্স এর চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে ইউরোপের নিলামঘরগুলো হন্য হয়ে তাঁর পুরোনো ছবি খুঁজতে শুরু করেছে। কেউ খুঁজে দিলে পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকছে। যতদূর মনে পড়ছে, ছোটবেলায় তাঁর আঁকা ছোট ছোট বেশ কিছু ছবি দেখেছিলাম লোকাল একজিবিশনে। নামমাত্র দামে বিক্রি হত সেগুলো। যদি... যাকগে! প্রথম ছবিটা রিচার্ড বার্থেলোমিউর তোলা। দুর্লভই বলা চলে।






 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 14, 2023 07:25
No comments have been added yet.