অক্সফোর্ডলন্ডন থেকে অক্সফোর্ডে যেতে গেলে বিনা দ্বিধায় চড়ে...

অক্সফোর্ড
লন্ডন থেকে অক্সফোর্ডে যেতে গেলে বিনা দ্বিধায় চড়ে পড়া যায় অক্সফোর্ড টিউবে,চমৎকার ইন্টারসিটি বাস সার্ভিস।সাত পাউন্ড করে টিকিট।চোদ্দ পাউন্ডে দিব্যি ডে ট্রিপ করে নেওয়া যায়।কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।আমার হাতে শুধু একটা খালি উইকেন্ড।এতো জায়গা আছে লন্ডনের আশেপাশে,কোথায় যাবো আর কোনটা বাদ দেব?কেমব্রিজ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ষোলআনা কিন্তু টিকিটের দাম একটু বেশিই পড়ে যাচ্ছে।স্টোনহেঞ্জ গেলে অন্য কিছু দেখা হবে না।বাক আর উইন্ডসর ক্যাসলও দেখা হয়নি।শেষমেশ অক্সফোর্ড যাওয়াই ঠিক হলো।রবিবার সকালে ভিক্টরিয়া অব্দি টিউবে গিয়ে নির্দিষ্ট বাস স্টপ থেকে উঠে চড়ে বসলাম বাসে।দিনে প্রায় দশ পনেরোটা করে বাস ছাড়ে অক্সফোর্ডের জন্যে।শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস।ভালো ব্যবস্থা।কিন্তু সর্বসাকুল্যে লোক মাত্র পাঁচজন।এতো কম লোক নিয়ে এতো বিলাসবহুল বাস চালিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে কি করে সেটা আমার মাথায় ঢুকলো না।
লন্ডন ছাড়াতেই চারদিকে চোখে পড়তে লাগলো সবুজের মেলা।যেখানে দেখো পাহাড়ের মত উঁচুনিচু জমিতে দিগন্ত অব্দি ছড়ানো সবুজ ভেলভেটের চাদর।তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছিমছাম ঘর,ফার্মহাউস,গ্রাম চোখে পড়ে।শান্ত জীবনযাত্রা।হাইওয়ে দিয়ে বাস চলেছে হু হু করে একের পর এক কিন্তু কোনো রকম শব্দ নেই।শেফার্ড বুশ পেরোনোর পর থেকেই রাস্তার দু ধারে সারি সারি হাওয়াকল বা উইন্ডমিল দেখতে পেলাম।সাঁই সাঁই করে হাওয়াকলের পাখাগুলো ঘুরছে।জোরে হাওয়া দিচ্ছে বাইরে।এমনিতেই যা শীত পড়েছে এরকম হাওয়া দিলে অক্সফোর্ডে কোনো ক্যাফেতে ঢুকে হি হি করতে করতে বসে থাকতে হবে।হেঁটে হেঁটে ঘোরার সাধ সাধই থেকে যাবে। হিলিংটন আসতে আসতে আমার চোখ  ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগলো।চারিদিকে এতো ভালো ভালো দৃশ্য,তা না দেখে ঘুমোনো মোটেও কাজের কাজ নয়।কিন্তু সাতসকালে উঠে আসতে হয়েছে,তার ওপর এমন আরামদায়ক বসার জায়গা।অতঃপর ঘুম না আসাই আশ্চর্য।যাই হোক,বেশিক্ষণ দিবানিদ্রা দেওয়ার সুযোগ হলো না।প্রায় একশো কিলোমিটার বেগে চালিয়ে দেড় ঘন্টার মধ্যেই অক্সফোর্ডের বাড়িঘর,নদী,খাল,খামার চোখে পড়তে লাগলো।বাস থেকে নেমে যখনা দাঁড়ালাম তখন ঘড়িতে পৌনে এগারোটা। 
অক্সফোর্ড শহরের পত্তন হয় অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি,কিন্তু প্রায় চারশো বছর পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তৈরী হওয়ার পর থেকেই এর খ্যাতি ছড়াতে থাকে আস্তে আস্তে।কেমব্রিজের মতন এখানেও কোনো সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং নেই বরং চল্লিশের ওপর কলেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা শহর জুড়ে।প্রতিটা কলেজেই আসলে স্থাপত্যের এক একটা নির্দেশন।আগেই আমরা চললাম অ্যাশমলিয়ান মিউজিয়াম দেখতে।মিউজিয়াম হলেও আসলে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের নিবিড় যোগাযোগ আছে।আর্ট আর আর্কিওলজির ছাত্ররা মিউজিয়ামে এসে প্রজেক্ট তৈরী করে,নোটস নেয়।







১৬৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও প্রত্নতত্ত্বের যাদুঘর হিসেবে অ্যাশমলিয়ানের সুখ্যাতি সারা পৃথিবী জুড়ে।মিশরীয় মমি থেকে সমসাময়িক শিল্প অব্দি নানা জিনিস সভ্যতা ও সংস্কৃতির গল্প বলে চলেছে অ্যাশমলিয়ান মিউজিয়াম।এই সংগ্রহ বিশেষভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ।ব্রিটেনের একমাত্র এইখানে দেখতে পাওয়া যায় কায়রোর বাইরে  মিশরীয় প্রাক-রাজবংশের ভাস্কর্য।এছাড়া এংলো স্যাক্সন আর্ট,আধুনিক চীনা আর্ট এবং সিরামিকের এতো বড় সংগ্রহ আর কোথাও নেই।ঘন্টাদুয়েক দেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।একদিনে সব কিছু দেখে ফেলতে হবে।বিকেল সাতটার সময়ে ফেরার বাস ঠিক করা আছে।ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও পড়ছে টুপ টুপ করে।তাতে অবশ্য মাথা ভেজে না।

 Ashmolean Museum  Radcliff Camera
অক্সফোর্ডের বেশিরভাগটাই হেঁটে ঘুরে ফেলা যায়।ছোট শহর।বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী সাইকেল নিয়ে চলাফেরা করে।অনেক রাস্তাতেই গাড়ি চলে না।এই পুরোনো শহরের বাড়ি ঘর এত সুন্দর যে মনে হয় সিনেমার মধ্যে চলে এসেছি।পাঁচশো বছরের আগের আর্কিটেকচার এর সঙ্গে নতুন যুগের দোকানপত্র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এখানে হাঁটতে হাঁটতেই সময় কেটে যায় দিব্যি।অক্সফোর্ডের প্রধান দ্রষ্টব্য হলো এর কলেজগুলো ভিতর থেকে দেখা কিন্তু সে অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার।তাই আমরা বাইরে থেকেই দেখে নিলাম একে একে ক্রাইস্ট কলেজ,এক্সেটার কলেজ,কুইন্স কলেজ,অল সোলস কলেজ,অর্কেস্টার কলেজ।ক্রাইস্ট কলেজের ক্যাম্পাস দেখতে লম্বা লাইন পড়েছে রবিবারের দুপুরে।এই কলেজের অনেক জায়গাতেই হ্যারি পটারের শুটিং হয়েছে।হগওয়ার্টসের একটা মেজাজ ঠিকই বুঝতে পৰ যায় এখানে এলে।সেই উঁচু উঁচু পেল্লায় চিমনি,ক্যাম্পাসের মধ্যে সবুজ ঘাসের বাগান আর ইতিহাসের ছোঁয়া।একসময় আমরা গিয়ে পৌঁছলাম কভার্ড মার্কেটে।সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বাজার।অনেক রকম ফুলের দোকান সামনেই,তার সঙ্গে নানা ধরণের খাবার,ফল,ফ্যাশনের জিনিসপত্র।এটা খাবো সেটা খাবো করে কিছুই ঠিক হলো না,তাই শেষ মেশ আবার ম্যাকডোনাল্ডে গিয়েই লাঞ্চ সারতে হলো। 
লাঞ্চের পর চললুম বোডালিয়েন লাইব্রেরি দেখতে।এতো বিশাল লাইব্রেরি খুব কমই আছে।
Bodleian library১৬০০ শতাব্দীতে তৈরী করা এই লাইব্রেরি আসলে শুরু হয়ে থেমস বোডালিয়েনের নিজের সংগ্রহের বই দিয়ে।একজন মানুষের কাছে কত বই থাকলে এরকম একটা লাইব্রেরি শুরু করা যায় এই কথাটাই আমার মাথায় ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো।এরপর ব্রড স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে চলে এলাম হার্টফোর্ড ব্রিজের কাছে। অনেকে বলে থাকে ভেনিসে থাকা ব্রিজ অফ সাইস এর সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে,তা যদিও ঠিক নয়।১৯১৪ সালে এই ব্রিজ তৈরী হয়েছিল হার্টফোর্ড কলেজের নতুন আর পুরোনো দুটো সেকশনের মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরী করার জন্যে।অনেক লোকে এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায়।আমরাও কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে নিলাম। Bridge of Sighsসামনেই আছে সেলডোনিয়ান থিয়েটার যেখানে ইউনিভার্সিটি সব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।এই সেলডোনিয়ান থিয়েটার নিয়েও একটা গল্প আছে।ষষ্টদশ শতাব্দীর এই থিয়েটার তৈরী হয় রোমের মার্সেলাস থিয়েটারের অনুকরণে,কিন্তু সেই সময়ে রোমের কোনো থিয়েটারেই ছাদের ব্যবস্থা থাকতো না।সকলকে বৃষ্টিতে ভিজে,রোদে পুড়েই অনুষ্ঠান দেখতে হত।কিন্তু প্রথম শতাব্দীর রোম আর  ষষ্টদশ শতাব্দীর অক্সফোর্ড তো এক নয়,এটা হলো গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।ছাত্ররা বললো ছাদ বানাতেই হবে।একদল লোক তার বিরোধিতা করলো নানা ছুতো দেখিয়ে।অনেক কাণ্ডের পর শেষ পর্যন্ত ছাদের ব্যবস্থা করা হলো।আর্কিটেক্ট ক্রিস্টোফার রেন অক্সফোর্ডের প্রফেসর জন ওয়েলসের 'জিওমেট্রিক ফ্ল্যাট রুফ' এর ওপর ভিত্তি করে এমন এক গোথিক ডিজাইন তৈরী করলেন যে নিন্দুকরা ধন্য ধন্য করতে লাগলো।যারা বলেছিলো ছাদ ভেঙে যাওয়ার ভয় আমরা বেলেডোনিয়ান থিয়েটারে পা রাখবো না,তারা ছাদের অপূর্ব ফ্রেস্কো দেখতেই বার বার আসতে লাগলেন। 
Sheldonian Theatreসামনেই রেডক্লিফ স্কয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল রেডক্লিফ ক্যামেরা।যা দেখছি তার থেকেই চোখ সরছে না।এতো সুন্দর আর প্রাচীন ঐতিহ্যের একের পর এক বিল্ডিং কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।খানিকটা হেঁটে গেলেই পরে সেন্ট ম্যারিস চার্চ।হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখে নিলাম ম্যাগডালেন কলেজ,বোট হাউস,অক্সফোর্ড বোটানিক্যাল গ্রাউন্ড।এখানে কেমব্রিজের মতনই  'পান্টিং' করার চল আছে।ছোট ছোট নৌকোতে অনেকেই পান্টিং করতে বেরিয়ে পরে সময় পেলেই টেমস(অনেকে আইসিস ও বলে) নদীতে।সময় দ্রুত পেরোচ্ছে।বিকেল শেষের দিকে। 


Puntingঅবশেষে হাঁটতে হাঁটতে আমরা হাজির হলাম পিট রিভার মিউজিয়ামে।ভিক্টরিয়া স্টাইলে তৈরী করা এই মিউজিয়ামে ঢুকলে একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়।অন্যান্য মিউজিয়ামের মত একদমই নয়।ছবিগুলো দেখলে খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।একসময় যখন আমরা লন্ডন গামী বসে উঠে বসেছি,মাথার মধ্যে অক্সফোর্ড গিজগিজ করছে।এতো কিছু কি একদিনে দেখা যায়!পরের বার এসে এখানে ঘাঁটি গাড়তে হবে।প্রিসন হোস্টেলে এসে উঠব,পান্টিং করবো আর কভার্ড মার্কেটে গিয়ে ব্রেকফাস্ট খাব।তারপর বিকেলে অনুষ্ঠান শুনতে যাবো সেলেডোনিয়ান থিয়েটারে।এই সব ভাবতে ভাবতে বাস ছেড়ে দিলো।শহরের বুকে আলো জ্বলে উঠেছে কিন্তু লন্ডনের মত আলোর রোশনাই আর বাড়াবাড়ি নেই।দিনের শেষে অক্সফোর্ড মনে করিয়ে দিলো আদপে এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে আজও তিরিশ হাজার ছাত্র ছাত্রী শিক্ষালাভ করছে।      All souls College

Pitt River Museum
Magdelene College
Christ College





 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on June 20, 2017 07:18
No comments have been added yet.