আল-কুর্‌আন: সংক্ষিপ্ত পরিচয় [The Qur’an: An Introduction]

এই পৃথিবীর ইতিহাসে জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর তালিকায় শীর্ষে অবস্থানকারী গ্রন্থটি হলো আল-কুর্‌আন। প্রায় ১৪৫০ বছর আগে ধূসর-কর্কশ মরুর বুকে বসবাসকারী যুদ্ধবাজ, বর্বর, স্বার্থপর, প্রাণপিপাসু, স্বাক্ষরতাহীন মানুষদের ‘পড়া’র আহ্বান দিয়ে এর যাত্রার শুভসূচনা ঘটে। তারপর এই গ্রন্থ ও একে বুকে ধারণকারী মানুষেরা সৃষ্টি করে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব, যার নজির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। এই গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে এক জ্বাজল্যমান সভ্যতা, মরুর বর্বরেরা হয়ে উঠে নতুন দিনের বার্তাবাহক।





Embed from Getty Images



মাত্র ২৩ বছরে এই গ্রন্থ বদলে দেয় মানব ইতিহাসের ধারা। পৃথিবীর বুকে আর কোনো গ্রন্থ নেই যা এতো বেশি সংখ্যক মানুষ মস্তিষ্কের নিউরনে হুবহু ছেপে রেখেছে। লক্ষ-লক্ষ মানুষ, ছোট বা বড়, নারী বা পুরুষ, সাদা বা কালো; নিজের স্মৃতির খাতায় এই গ্রন্থকে সযতনে লিখে রেখেছে। প্রতিটি মুহূর্তে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এই গ্রন্থ পঠিত হচ্ছে। আমেরিকান সাহিত্যিক জেমস এ. মিশেনার বলেন,





“পৃথিবীতে কুর্‌আনই সম্ভবত একমাত্র গ্রন্থ যা সবচেয়ে বেশী পাঠ করা হয় এবং নি:সন্দেহে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক লোক তা মুখস্থ রেখেছে।… আকারে বাইবেলের নতুন নিয়মের মত তত দীর্ঘ নয়, অপূর্ব ভাষায় রচিত এ গ্রন্থ কবিতা নয়, নয় কোন সাধারণ গদ্য; অথচ শ্রোতার হৃদয়কে বিশ্বাসের ভাবাবেগে উদ্বেলিত করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে এর।”

James A. Michener, Islam: The Misunderstood Religion; p. 70. The Reader’s Digest, May 1955




মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী পবিত্র আল-কুর্‌আন হলো পরম স্রষ্টা প্রেরিত আখেরি পয়গাম। এই বাণীকে তিনি একজন মনোনীত দূতের মাধ্যমে পুরো মানবজাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কুর্‌আন (ক্রিয়া বিশেষ্য) শব্দটির উৎস ‘আরবি মূলশব্দ (قرأ – يقرأ) যার শাব্দিক অর্থ “একত্রিত করা (To collect, To put Together)”। কিন্তু পরবর্তীতে এর অর্থ দাঁড়ায় “পড়া, আবৃত্তি করা” কারণ কিছু পড়ার সময় শব্দ ও বর্ণকে একত্রিত করা হয়। (1) আল-কুরআনের সুপরিচিত ও সর্বজনবিদিত সজ্ঞাটি প্রদান করেন বিশিষ্ট ইসলামি মনিষী আল্লামা যারকানি, যার অর্থ:





আল-কুর্‌আন হল আরবি ভাষায় (পরম স্রষ্টা) মহান আল্লাহর বাণী। যা তিনি অবতীর্ণ করেছেন (সর্বশেষ বার্তাবাহক) মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর – শব্দে ও অর্থে। এটি সংরক্ষিত রয়েছে ‘মুসহাফে’ (2) এবং আমাদের নিকট পৌঁছেছে ‘মুতাওয়াতির’ বর্ণনা পরম্পরায়। মানবজাতির প্রতি এটি চ্যালেঞ্জ জানায় এর সমতুল্য কিছু রচনা করার।

মুহাম্মাদ আব্দুল আজিম আয-যারকানি, মানাহিল আল-ইরফান ফি ‘উলুম আল-কুর্‌আন; খণ্ড ১, পৃ. ২১ (কায়রো, দারুল কুর্‌আন)




Embed from Getty Images



প্রত্যাদেশ মৌখিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রচারের দ্বারা ক্রমান্বয়ে তা দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পবিত্র কুর্‌আন মৌলিক এবং লৈখিক পদ্ধতির পাশাপাশি এক অভিনব পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হয়েছে, যাকে বলা হয় মুতাওয়াতির বর্ণনা পরম্পরা। মুতাওয়াতির বর্ণনা পরম্পরা বলতে বুঝায় – কোন বিষয় বিভিন্ন প্রজন্মে (যুগে) অসংখ্য মানুষ স্বতন্ত্রভাবে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন যারা একে অপরের সাক্ষাত পাননি; এবং এসকল বর্ণনাও অভিন্ন। এক্ষেত্রে তাদের পক্ষে সম্মিলিতভাবে ভুল করা বা মিথ্যা রচনা করা সম্ভব নয়। তাই এমন তথ্যের গ্রহনযোগ্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। (3) ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী সুপরিচিত পশ্চিমা দার্শনিক স্কটিশ সংশয়বাদী (Skeptic) ডেভিড হিউম-ও স্বয়ং এমন বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতার যৌক্তিকতার সমর্থন দিয়েছেন। (4) 





পবিত্র কদরের রাতে সমগ্র কুর্‌আন সংরক্ষিত ফলক (লাওহে মাহফুয) থেকে পৃথিবীর নিকটবর্তী “বাইতুল ‘ইযযাহ”তে অবতীর্ণ হয়। পরবর্তীতে ২৩ বছর সময়ব্যাপী তা প্রয়োজন অনুসারে মহান স্রষ্টার সর্বশেষ বার্তাবাহক মুহাম্মাদ (স) এর প্রতি অবতীর্ণ করা হয়। কুর্‌আন যখন অবতীর্ণ হয় তখন ‘আরবি ভাষা ও সাহিত্য উৎকর্ষতার শীর্ষে অবস্থান করছিল। (5) আরবরা ছিল অত্যন্ত কাব্য অনুরাগী। আধুনিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম জনক ইবনে খালদুন আরব জীবনে কাব্যের গুরুত্ব সম্পর্কে তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুকাদ্দিমা’য় বলেন:





… এভাবে প্রস্তুত তাদের কাব্যসম্ভার তাদের ইতিহাস ও বিচক্ষণতার ভান্ডার এবং তাদের দুঃখ-বেদনার গাঁথা হয়ে উঠেছিল …

ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা; খণ্ড ২, পৃ. ৯২ (অনুবাদ-গোলাম সামদানী কোরায়শী; ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ৩য় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)




তখন কবিদের কোনো গোত্রের মুখপাত্র গণ্য করা হতো। বর্তমান সময়ের মিডিয়া যেমন ব্যাপক প্রভাব ছড়িয়ে আছে আমাদের উপর, আরবে সেসময় কবি ও কাব্যের প্রভাব ছিল তেমন। আরবের বাৎসরিক সাহিত্য মেলা ওকায ও মুযান্নায় অনুষ্ঠিত কবিতা প্রতিযোগিতায় মুখে মুখে কাব্য রচনা ছিল তাদের প্রাণের উৎসব। ঐতিহাসিক বসওয়ার্থ স্মিথ বলেন,





“… সেই অজ্ঞতার যুগেও প্রতিটি গোত্র থেকে একজন করে প্রতিভাবান কবি অংশগ্রহণ করত। এদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ কবি নির্বাচিত হত, তার কবিতা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হত অথবা কা’বার দরজায় প্রদর্শনীর জন্য ঝুলিয়ে রাখা হত। যাতে করে পবিত্র ভূমিতে (মক্কা) আগত তীর্থযাত্রীরা সবাই সেই কবিতা পড়ার সুযোগ পায় …”

Bosworth Smith, Mohammed and Mohammedanism; p. 67 (London
Smith, Elder, & Co., 1874)




এমন প্রেক্ষাপটে নিরক্ষর (উম্মী) এবং কাব্যে অভিজ্ঞতাহীন মুহাম্মাদ (স) এক অমীয় বাণী প্রচার শুরু করেন যা আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তিতে রচিত, কোনো মানুষ আগে তা শোনে নি ! (6) এই বাণীর অমীয় সৌন্দর্য ও মাধুর্য বিজ্ঞ আরব কবিদের হতভম্ব ও বাকহীন করে দেয়। তারা এর সমতুল্য কিছু রচনায় ব্যর্থ হয়ে একে “যাদু” বলে অভিহিত করে। প্রফেসর এম এ দ্রায লিখেন,





“… আরব বাগ্মীতার স্বর্ণযুগে ভাষা যখন বিশুদ্ধতা ও প্রেরণার শীর্ষে আরোহণ করেছিল, এবং বার্ষিক উৎসবে মহাসমারোহে কবি ও বাগ্মীদের প্রতি সম্মানের উপাধি অর্পিত হত; তখন কুর্‌আন কাব্য বা গদ্যের প্রতি সমস্ত উদ্দীপনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। কা’বার দরজায় ঝুলে থাকা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত কবিতাগুলো তারা নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সকলেই নতমস্তকে আরবি অভিব্যক্তির এই অলৌকিকের (কুরআনের) প্রতি কান পেতে দিয়েছিল…

M.A. Draz, Introduction to the Qur’an; p. 90 (I.B. Tauris 2000)




Embed from Getty Images



আল-কুর্‌আন যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনার দ্বারা মানুষকে এক ন্যায়ভিত্তিক শাশ্বত জীবন ব্যবস্থার দিকে আহ্বান করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্মরণিকা, পথনির্দেশ ও সংবিধান প্রদান করে। কেন এই মহাবিশ্ব, কেন আমরা এই পৃথিবীতে আর মৃত্যুর পর আমাদের গন্তব্য কোথায় – মানুষের এই চিরাচরিত মৌলিক প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক ও চিন্তা-উদ্দীপক উত্তর প্রদান করে।





এই উত্তর আহরণে খোলামন নিয়ে কুর্‌আন পড়তে হবে আমাদের। কোনো ভরা গ্লাসে নতুন করে কিছু দেওয়া তো সম্ভব না, তাই না? তাই বস্তুবাদী – সেক্যুলার – পশ্চিমা চোখে নয়, বরং বিনয়, জ্ঞান ও পথনির্দেশ গ্রহণের মানসিকতা নিয়ে কুর্‌আনের নিকট আসতে হবে। আমরা যারা আরবি ভাষী নই, তাদের জন্য অনুবাদই ভরসা। কিন্তু এতে মূল ভাষার মিষ্টতা ও অনন্যতা বোঝা দুষ্কর। প্রাচ্যবিদ আলফ্রেড গাইলাম ঠিকই বলেছেন:





কুর্‌আন বিশ্বসাহিত্যে এমন একটি রচনা যার মূল আবেদনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে অনুবাদ করা সম্ভব নয়। এতে আছে এমন সৌন্দর্যময় ছন্দ এবং সুরের মূর্ছনা যা কর্ণকুহরকে মোহিত করে। … এ কথা অনস্বীকার্য যে উচুমানের পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রণে রচিত এ গ্রন্থ আরবি সাহিত্যে অতুলনীয়… 

Alfred Guillaume, Islam; p. 73-74 (Penguin Books, Reprinted 1990)




তাই অনুবাদ পড়ার সময় প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত সে যা পড়ছে তা স্বয়ং কুর্‌আন নয় বরং তা হলো অন্য ভাষায় রূপান্তরিত একটি ব্যখ্যা মাত্র; যা অনুবাদকের ব্যক্তিগত অনুধাবন। কুর্‌আনের পাঠক যদি অমূলক সংশয় ও অস্পষ্টতা এড়িয়ে চলতে চান তাহলে তাকে চারটি মূলনীতি মনে রাখতে হবে (7) :





১। এমন গ্রন্থ পৃথিবীতে মাত্র একটিই আছে। (8)
২। এর সাহিত্যশৈলী অন্য সকল গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন
৩। এর প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন।
৪। গ্রন্থ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার উপর ভিত্তি করে কুর্‌আন বুঝতে চেষ্টা করলে তা কেবল প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করবে।









রেফারেন্স:
(1) Edward William Lane, An Arabic-English Lexicon; Vol. 7, Book I, p. 2502 (Lebanon, LIBRAIRIE DU LIBAN, 1968); Justice Mufti Muhammad Taqi Usmani, An approach to the Quranic Sciences; p. 28 (Karachi, DARUL-ISHAAT, 1sr edition 2000)
(2) মুসহাফ এর শাব্দিক অর্থ লিখিত পৃষ্টার সংকলন; তবে এর দ্বারা সাধারণত পৃষ্টায় লিখিত কুরআনের সংকলনকে বুঝানো হয়, দেখুন: Edward William Lane, An Arabic-English Lexicon; Vol. 4, Book I, p. 1655
(3) A.A. Yasir Qadhi, An Introduction to the Sciences of the Qur’aan; p. 29 (Birmingham UK, Al-Hidaayah Publishing and Distribution, 1st edition 1999)
(4) “… তাই, যদি সকল ভাষার লেখকগণ একমত হন যে ১৬০০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে আট দিন সারা পৃথিবী পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে ছিলঃ যদি এই বিস্ময়কর ঘটনার বর্ণনা মানুষের মাঝে আজও স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত যে সকল ভ্রমণকারী যারা বিদেশ থেকে ফিরেছেন তারাও একই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন সামান্যতম পরিবর্তন বা অসংগতি ছাড়াইঃ এটা অনস্বীকার্য যে, আমাদের বর্তমান দার্শনিকগণ এই বর্ণনাকে সন্দেহের বদলে নিশ্চিতরূপে গ্রহণ করবেন এবং এর উৎসের কারণ অনুসন্ধান করবেন … ”, দেখুন : David Hume, An Enquiry Concerning Human Understanding; Sec. I/99, p. 88-89
(5) The Sacred Books and Early Literature of the East with Historical Surveys of the Chief Writings of Each Nation, vol. v (Ancient Arabia), p. 14-16 ( Parke, Austin, and Lipscomb, Inc., 1917)
(6) Dr. Laura Veccia Vaglieri, An Interpretation of Islam, p. 43 (New Delhi, Goodword Books Pvt. Ltd., 1st Published 2004); ক্যারেন আর্মস্ট্রং, মুহাম্মাদ: মহানবী (স:) জীবনী; পৃ. ১০০, ১৭৮ (বঙ্গানুবাদ-ঢাকা, সন্দেশ প্রকাশনী, চতুর্থ প্রকাশ: মে ২০১১)
(7) ড. আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস, কুর্‌আন বুঝার মূলনীতি; পৃ. ৮৯, ৯৬ (বঙ্গানুবাদ; ঢাকা, সিয়ান পাবলিকেশন, ১ম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)





(8) Dr. Bassam Saeh, The Miraculous Language of the Qur’an: Evidence of Divine Origin (London: IIIT, 2015)





© 2019. No part of this article can be published in print form without prior approval from author.

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on September 15, 2019 09:39
No comments have been added yet.