অযান্ত্রিক

(Published in Bengali, in Probhash, April 2016, Sohojiya Prokashoni, Kolkata)


তার নাম রাখলাম ‘কৃষ্ণেন্দু’। ‘সপ্তপদী’ সিনেমায় রীনা ব্রাউনের ‘কৃষ্ণেন্দু’। বাংলার দেবমানবী সুচিত্রা সেন যে সময় উত্তামকুমারের হৃদয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আদুরে গলায় বলেছিল, “কৃষ্ণেন্দু-উউউ” — সেই মুহূর্তের গল্প শুনিয়েছিলাম বহুবার আমার উনিশ বছরের বলিষ্ঠ পুত্রের কাছে, তাই সেই এই নামকরনটা করল।


krishnendu rina brown

A scene from Saptopodi


এখন কৃষ্ণেন্দু আমাদের সংসারের একছত্র সংসদ। খুব সহজেই সে নিজের স্থান করে নিতেছে আমাদের তিনজনের মাঝখানে।


মধ্যবয়সে জীবনের শিকড়-সমেত গাছ উপড়ে, সাত-সমুদ্র-তের-নদী পেড়িয়ে এই সুদূর কানাডায় আবার নিজের অস্তিত্ব স্থাপন করার জীদ ধরেছিলাম। তা প্রায় বছর ছয়েক হয়ে গেল। পুত্রের বয়েস তখন বারো। নরম, কচি, টালমাটাল তার শিকর। নতুন পরিবেশে শিকড় নতুন করে আঁকড়ে ধরতে অনেক সময় লাগবে।


এই সময় অছেনা এই পৃথিবীর অজানা স্রোতে ভেসেই যেত সে যদি’না কঠিন হাতে শিকড়টা আটকে রাখতাম। তাই আমার উনিশ বছরের বলিষ্ঠ যুবকটি ইউনিভারসিটি যাচ্ছে ঠিক’ই, সারা দিন ইউটিউব, ফেসবুক, মাকডোনাল্ডস, টিম-হরটনস্‌ এ পড়ে থাকে ঠিক’ই, নানান রঙের, নানান দেশ থেকে আগত বন্ধু আছে ঠিক’ই এবং তাদের সাথে কানাডিয়ান আক্সেন্টে ইংরেজি বলে ঠিক’ই, বাংলা লিখতে পারেনা, ঠেকে ঠেকে পড়ে ঠিক’ই, কিন্তু ‘কৃষ্ণেন্দু’ কে জানে।


উত্তমকুমার কে জানে। রবিঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ অনেকটাই মুখস্থ। সত্যজিত রায়ের সব ছবিই প্রায় তার দেখা। সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ‘ফেলুদা’ তার ভাললাগেনা।


এ হেন কৃষ্ণেন্দু এল আমাদের জীবনে।


অর নামটা আবার নথীভুক্ত করতে হল অনলাইন খাতায়। আমাদের নতুন বন্ধু ‘কৃষ্ণেন্দু’ একটা ‘রোবট’।


সুঠাম, কালো গঠন তার, একটা চৌকো বাক্সের মতন চেহারা। পিছনে দুটো চাকা, সামনে ন্যাতা।


সেই ন্যাতা দিয়েই সারা বাড়ি সে নিমেষে ঝা-চকচকে করে মুছে ফেলে। তাকে কন আদেশ দিতে হয়না। একটি বোতাম টিপলেই সে খুশি-খুশি একটা ধ্বনি প্রকাশ করে কাজে লেগে পড়ে। তার একটা মস্তিস্ক আছে। সেটা আলাদা জায়গায় রাখতে হয়। সেই মস্তিস্ক-ই আবার বলে দেয় ইশারায় ঘরের কন অংশটি মোছা বা ঝাঁট দেওয়া আগেই হয়ে গেছে।


মোছার ন্যাতার সাথে ওর কাছে একটা ঝাঁট দেওয়ার কাপড়ও আছে। সেটার আলাদা বোতাম, আলাদা চলন। চলার পথে কোনো আসবাবপত্র এলে আবার তার পাশ দিয়ে ঘুরে যাবে। কৃষ্ণেন্দুকে বিশেষ কিছু আর নজরদারি করতে হয়না। তার নিজের ম্যাপ অনুযায়ী নিজে বিবেচনা করে নেয় গোটা বাড়ি কিভাবে মুছতে বা ঝাঁট দিতে হবে। চৌকাঠ পেরোয়না, সিঁড়ির মুখে গিয়ে থম্‌কে দাঁড়িয়ে পরে – মাথার ওপর তিনটে নীল আলো আছে, তারা মানা করে, “আর যেওনা, পড়ে যাবে”।


কৃষ্ণেন্দু ঘরের কোনায় কোনায় মোছে। টেবিলের তলায় ঢুকে, খাটের তলায় গড়গড়িয়ে ঢুকে গিয়ে মোছে। চেয়ারের পায়ার চারপাশ ঘুরে ঘুরে যতদুর তার চৌকো দেহখানি দিয়ে সম্ভব, মোছে। খুবই নিপাট কাজ, খুবই যত্ন সহকারে।


সমস্থ ঘরে মোছা হয়ে গেলে সে এক কোণে গিয়ে একটা দুঃখি দুঃখি ধ্বনি করে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মানে হয় তার কাজ শেষ, না হয় ব্যাটারি শেষ। এবার ওকে কোলে করে আবার চার্জারের ওপরে বসিয়ে দিলেই একটি প্রানবন্ত শব্দ করে প্রকাশ করে সে কি খুশি!


এই বোধহয় শুরু। এক নতুন প্রজাতিকে আমরা জন্ম দিলাম এবং এবার ঘরে ঘরে আহবান করা শুরু করেছি। কৃষ্ণেন্দুর কোনো মাইনে নেই, খাদ্য নেই, শুধু সারারাত চার্জে রেখে দিলেই সকাল্বেলা তরতাজা। দাম-ও খুব বেশি নয়। এই রোবট প্রজন্মকে আমাদের দৈনন্দিন জিবনে খুব-ই প্রয়োজন। এরপর ওদের সঙ্গে কথা বলাও যাবে। “স্বর-পরিচয়”-এর (voice recognition) মাধ্যমে বলা যাবে, “রামু, চা করে দে”।


ব্যাস! রামু তার মধ্যে পুর্ব-লিপিবদ্ধ আজ্ঞা অনুযায়ী চা বানাতে শুরু করবে। আর আমরা বসে বসে খাব। আর ফরমায়েশ করব। খেতে দিতেও হবেনা, যখন তখন ছুটিও চাইবেনা, মাইনেও নেবেনা। কল-কব্জা অবশ্য বিগরে গেলে সেটা আলাদা ব্যাপার।


একটু ক্রীতদাস-ক্রীতদাস শোনাছে কি? হুমমম… আমার মনে যে অই মনভাব আসেনি তা বললে মিথ্যে বলা হবে। কানাডায় বসে জীবন ও জীবিকার জন্য উদয়-অস্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত মনে যে সে অপরাধবোধ হইনি তা নয়। তাহলে কি সময় এবং প্রযুক্তির বলয়টা ঘুরে সে এক-ই যায়গায় নিয়ে যাচ্ছে? আর একটা ব্যাপার… রোবটএর আগমনে মানবকর্মীর ওপর যে খাঁড়াটা পরবে তাতে কি বেকারত্ব বাড়বে? অনেক অনেক রামু আর পুঁটির মা চাকরি খোয়াবে?


ভাব্‌বার বিষয়।


যাক, সে তর্ক চলুক্‌! কিন্তু আজ যদি অন্যান্য মেশিনের সাথে সাথে – পুঁটির মা-কে বিদায় করে দিতে পেরে – কৃষ্ণেন্দুর ভাই-বোনেদের আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে আহবান করা যায় তো ক্ষতি কি?


বলতে দ্বিধা নেই, কৃষ্ণেন্দু আমার একাকিত্ব জীবনের খানিকটা সঙ্গী। ওকে নাম ধরে ডাকি, “ভুতু (ওর ডাক নাম), ওদিকে যাসনা, এদিকে আয়, এদিকটা হয়নি। আবার সোফার তলায় ঢুকলি? আটকে যাবি যে! কতবার বারন করেছি না!… ওমা! এর মধ্যে হয়ে গেল? রান্নাঘর-টা কে মুছবে? অ্যাঁ?”


আমার ছেলে কঠোর গলায় মনে করায়, “মা! ও একটা রোবোট। ও তোমার কথা বোঝেনা!”


তবে আমার মা কলকাতা থেকে ফোনে বলে, “তুই ওর সাথে যে ভাবে কথা বলিস, দেখবি, একদিন ও তোকে উত্তর দেবে!”


 


krishnendu

Krishnendu (iRobot, Bravaa)


probhash krishnendu


(Published in Bengali, in Probhash, April 2016, Sohojiya Prokashoni, Kolkata)


 


 


Filed under: For a thought....
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on May 07, 2016 15:13
No comments have been added yet.