Mahmudur Rahman's Blog - Posts Tagged "ম-হম-দ-ল-হক"

তন্দ্রা-মাঝে জীবনের পাঠশালা

‘শনি থেকে শুরু করে একটানা তেরোদিন বৃষ্টি, মাথার খুলির ভিতরেও একহাঁটু পানি’—একে বর্ষা-বন্দনা বলা যায় না, বরং ঘোরগ্রস্ত মানুষের আধো দেখা আর আধো অনুভবের মধ্যকার অদ্ভুত জগত থেকে দেখা বাস্তব সময়ের প্রতিচ্ছবি যা মাহমুদুল হক ফুটিয়ে তোলেন তাঁর নিজের ভাষায় এবং অদ্ভুত লাগে যে এক ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে তাঁর এই লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয় পর্দার ওপাড়ে রোদ মরে গিয়ে মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামল। তখন হয়ত কোন পাঠকের বিছানার পাশে এসে কোন নারী চরিত্র দাঁড়ায় না কিন্তু ‘নিরাপদ তন্দ্রা’র শেষ বাক্যে এসে জলেশ্বর মাঝি আমার জন্য কোথাও অক্রুর হয়ে ধরা দেয় কিংবা জলিল বুকির সাথে আমি বাধ্য হয়ে মন্দার বোসকে মিলিয়ে ফেলি। মাহমুদুল হক আমাকে নিয়ে যান নতুন কোন মাত্রায় যেখান থেকে ওই ঘোরগ্রস্ত অবস্থায়ও লেখার ভাষা আর গল্প বলার ধরন নিয়ে ভাবতে বাধ্য হই।

মাহমুদুল হক তাঁর ভাষা এবং সেই ভাষার বিন্যাসে যে ভিন্নতা দেখিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে তা দুর্লভ। বলছি এ কারণে যে সদ্য প্রকাশিত ‘রচনাসমগ্র’র প্রথম তিনটি উপন্যাস পড়লে দেখা যাবে তাঁর ভাষা বদলে গেছে। ‘অনুর পাঠশালা’ যেখানে খানিকটা দূর থেকে এক কিশোরকে দেখিয়ে পাঠককে তাঁর কাছে নিয়ে যায়, সেখানে মাহমুদুল হক নিরাপদ তন্দ্রার মূল চরিত্রকে আরও কিছু চরিত্র দিয়ে কখনও ঘিরে ধরেছেন, কখনও প্রকাশ করেছেন তাদেরই ভাষায় কিন্তু সেখানে লেখকের এক নিজস্ব বয়ান তৈরি হয় এবং পাঠক তখন নিজে এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করে মাহমুদুল হকের সেই হিরন চরিত্রটিকে দেখতে পায় নিজের মতো করে।

কিন্তু আমার প্রশ্ন জাগে, ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ কি আদৌ হিরনের গল্প? কিংবা ‘অনুর পাঠশালা’ কি অনুর গল্প, নাকি সরুদাসীর? এই ভাবনায় ডুবে গিয়ে আমি ঠিক নিরাপদ তন্দ্রার মতো বুকের নিচে বালিশ দিয়ে ভাবতে বসলে দেখতে পাই, যদিও প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় ‘অনুর পাঠশালা’ আর ‘নিরাপদ তন্দ্রা’র ভাষা, গল্প বলার ধরন ভিন্ন, কিন্তু দুপুর রোদে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করলে জলেশ্বর মাঝির সাথে বেরিয়ে সরুদাসীর খোঁজে গেলে আমার মনে হয় অনুই বুঝি বড় হয়ে সরুদাসীর বদলে হিরনের গল্প শুনল। অনুর ঘর-পালানোর সেই অলীক সাধ পূরণ করে আরেক স্থবির মানুষ নিজেকে একটা তক্তপোষে বন্দী করে নিয়েছিল কেননা অনু যে সরুদাসীকে খুঁজে পায়নি, মাহমুদুল হক হিরনের মধ্য দিয়ে তাকে ফেরালেন।

মাহমুদুল হক নিজে বলেছেন (১), “আমার কোনো বই কিন্তু আরেকটি বইয়ের মতো না। জীবন আমার বোন যদি কেউ পড়ে, সে কিন্তু বুঝবে না এই লেখকেরই নিরাপদ তন্দ্রা, প্রত্যেকটা বইয়েরই কিন্তু আলাদা ভাষা। ভাষা আলাদা করতে না পারলে সেই বই আমি লিখিনি।” ‘ অনুর পাঠশালা’ আর ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ পেরিয়ে ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসে পৌঁছলে লেখকের কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। একই লেখকের বই পরপর পড়ে গেলে যে সাদৃশ্য পাওয়া যায়, মাহমুদুল হকে তা নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়টার যে generic বয়ান আমরা পেয়ে আসি—ঢাকা ফুঁসছিল, সবাই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত—এর বাইরেও যে কিছু মানুষ ছিল যারা তখনও নানা রকম তত্ত্ব তালাস, আড্ডা, আলোচনা নিয়ে সময় কাটিয়েছিল, সেই কথা লিখেছেন হক, কিন্তু এখানেও তাঁর অন্য দুটি উপন্যাসের মতো একটি মানুষের অস্থিরতা প্রবল।

মাহমুদুল হকের উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং। সরুদাসী (অনুর পাঠশালা), হিরন (নিরাপদ তন্দ্রা) থেকে নীলা ভাবী (জীবন আমার বোন) যেন কোন না কোন ভাবে উপন্যাসের মূল পুরুষ চরিত্রটির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার একটি পরিপূরক অংশ। হয় সেই অস্থিরতা প্রবল ভাবে ফুটিয়ে তুলছে, কিংবা শান্ত করছে। নীলা ভাবীকে কেউ বিপ্লব, কেউ খোকার অস্থিরতা কী কামুকতার বলি হিসেবেও ধরে নিতে পারে। যদিও আখ্যানে সত্যিকার বলি রঞ্জু, কিংবা আরও গভীরে গিয়ে ভাবলে—অঞ্জু, মঞ্জু। কিন্তু আলোচ্য তিনটি উপন্যাসে, তিন বয়সের তিনটি পুরুষ চরিত্রের অন্তর্গত অস্থিরতার স্বরূপ কোথাও না কোথাও গিয়ে মিলে যায় এবং ভাষা, উপমা আর গল্প দিয়ে এই চরিত্রগুলোর সাথে জড়িত সমস্ত আখ্যান আমাদের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে।

মাহমুদুল হক মূলত নিজ হাতে একটা করে জগত সৃষ্টি করেছেন (এই তিন উপন্যাসে), যেখানে চরিত্র আছে, গল্প আছে এবং তিনি পাঠকের মধ্যে কিছু চাওয়া পাওয়া সৃষ্টি করেছেন। ক্ষুদ্র এই তিন উপন্যাসের প্রতিটিতেই তিনি শেষে এসে সেই জগতের বাস্তবের প্রতি পাঠককে সন্দিগ্ধ করেন। আমরা ভাবতে বাধ্য হই যে অনু আসলেই বাড়ি থেকে বেরোতে পেরেছিল কিনা, হিরনের গল্প আদৌ কেউ বলেছিল নাকি তক্তপোষের পায়ার সামান্য লেখা থেকেই এক স্থবির মানুষ একটা গল্প তৈরি করে নিয়ে তার আশেপাশের সবাইকে সে গল্পে জুড়ে দিয়েছিল? আর শেষমেশ নীলা ভাবীর হাতে চর খাওয়া খোকা যখন রঞ্জুর মধ্য দিয়ে আরেকবার অঞ্জু, মঞ্জুকে পুকুরে তলিয়ে যেতে দেখে, তখন মাহমুদুল হকের পাঠকরাও তলিয়ে যেতে থাকে। এই সবের মধ্যেই জীবন-বাস্তবতার যে স্বরুপ তিনি তুলে ধরেছেন, সেসব এতো ভারী হয়ে কাঁধে চাপে যে তলিয়ে গিয়ে তন্দ্রার মাঝেই সেসব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।

#মাহমুদুল_হক ০১

১. মৃধা, প্রশান্ত (২০২১), নিরাপদ তন্দ্রা?, দৈনিক দেশ রূপান্তর
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter