“দুঃখের নিশীথে তাহার প্রাণের আকাশে সত্যের যে নক্ষত্ররাজি উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে- তা সে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া যাইবে… আজিকার দিন হইতে অনেকদিন পরে—হয়ত শত শত বৎসর পরে তাহার নাম যখন এ-বছরে-ফোঁটা-শালফুলের মঞ্জরীর-মত-কোথায় মিলাইয়া যাইবে,… তখন তাহার কত অনাগত বংশধর কত সকলে, সন্ধ্যায়, মাঠে, গ্রাম্য নদীতীরে, দুঃখের দিনে, শীতের সন্ধ্যায় অথবা অন্ধকার গহন নিস্তব্ধ দুপুর-রাত্রে, শিশির-ভেজা ঘাসের উপর তারার আলোর নিচে শুইয়া শুইয়া তাহার বই পড়িবে— যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়-লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকদের দেশ, অদৃশ্য ঈথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত –সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে… কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণ, কত দুর্গ দিদি-জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরূপ অভিযান... শুধু আনন্দে, যৌবনে, জীবনে, পুণ্যে ও দুঃখে, শোকে ও শাস্তিতে। …এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন–পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র… সে জীবনের অধিকার হইতে কাহারও বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই—তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয়—এটুকু শেষ নয়, এখানে আরম্ভও নয়। সে জন্ম-জন্মান্তরের পথিক-আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগণ্য জ্যোতিলোক, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ছায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ বহির্ষদ পিতৃলোক—এই শত সহস্ৰ শতাব্দী তার পায়ে-চলার পথ—তাঁর ও সকলের মৃত্যু দ্বারা অস্পষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মত সকলেরই পুরোভাগে অক্ষুন্নভাবে বর্তমান-নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানবের যুগে যুগে বাধাহীন হউক।…”
―
অপরাজিত - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়