Nazim Ud Daula's Blog: গুডরিডস ব্লগ, page 2
September 16, 2013
অনিঃশেষ অবয়ব
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চারপাশ। শত্রুপক্ষের মর্টারের আঘাতে সৈন্যদের ব্যারিকেডের এক অংশ ধ্বসে পড়েছে। কতজন হতাহত হয়েছে বোঝার উপায় নেই। তবে খানিক বাদেই ব্যারিকেডের এক পাশে লেফটেন্যান্ট বেনকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যাক, ছেলেটা বেঁচে আছে! লেফটেন্যান্ট বেন আর তার কিছু সাথি হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকল। আমরা শুয়ে আছি ফেলে রাখা বেশ কিছু পাইন গাছের গুড়ির আড়ালে। প্রচণ্ড বন্দুকযুদ্ধ চলছে এদিকটাতে।
আমার সাথে আছে মিত্রবাহিনীর কিছু অকুতোভয় যোদ্ধা। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে খুব দ্রুত আমাদের লোকবল কমে যাচ্ছে। ব্যাকআপ না পৌঁছালে আজ মৃত্যু নিশ্চিত। লেফটেন্যান্ট বেন কাছে চলে এসেছে। আমার উদ্দেশ্যে বলল, “ক্যাপ্টেন, উই আর ইন ক্রাইং নিড অফ ব্যাক আপ”।
আমি উত্তর দিলাম না। তবে একটা বিষয় লক্ষ করে আতঙ্কের ঢেউ নামল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমাদের অ্যামুনিশন প্রায় ফুরনোর পথে। ব্যাকআপ আসা পর্যন্ত টিকব বলে মনে হচ্ছেনা।
লেফটেন্যান্ট চিৎকার করছে, “ক্যাপ্টেন, ফর গডস সেক! কিছু একটা তো বলুন! এভাবে পরে থাকলে সবাই মারা পড়ব। আমরা কি অল আঊট এটাকে যাব?”
আমি বললাম, “অলআউট অ্যাটাকে যাওয়টা হবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। ওদের ভারী অস্ত্রের মুখে আমরা দু মিনিটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। আমাদের পিছু হটতে হবে”।
“তাহলে নির্দেশ দিন ক্যাপ্টেন, চুপ করে আছেন কেন?”
“সবাই একসাথে পিছিয়ে গেলে ওরা বুঝে ফেলবে লেফটেন্যান্ট। আমাদের কিছু সৈন্য এখানে থাকতে হবে কভার ফায়ার করার জন্য”।
“আমি থাকছি ক্যাপ্টেন”। দৃঢ় কণ্ঠে বলল বেন। “আপনার দ্রুত পিছু হটুন”।
“না লেফটেন্যান্ট, আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে আপনি পিছু হটতে থাকুন, আমরা কভার ফায়ার করছি”।
“না স্যার। আপনাকে এভাবে রেখে আমি পালাতে পারব না”।
“আহ! অযথা কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করবেন না লেফটেন্যান্ট। এই যায়গাটা আপনি আমার চেয়ে অনেক ভাল চেনেন। খুব সহজেই সবার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবেন। সময়মত ব্যাকআপ নিয়ে হাজির হতে পারবেন”।
“কিন্তু স্যার........”
আমি বিরক্তির সাথে বললাম, “ইটস অ্যান অর্ডার!!”
“ইয়েস স্যার” বলে ঘুরল লেফটেন্যান্ট বেন। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, “অ্যাটেনশন এভরিওয়ান। উই আর রিট্রিটিং, ফলো মি। আই রিপিট- ফলো মি”।
কিছুক্ষন তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে ওদের সাথে আর দেখা হবে না! আমি আবার শত্রুদের সম্ভাব্য অবস্থান লক্ষ করে গুলিবর্ষণে মনযোগী হলাম। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা। সামান্য অমনোযোগ মৃত্যুর কারন হতে পারে।
কতটা সময় এভাবে পেরিয়ে গেল জানিনা, হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। আওজায়টা পেলাম দু সেকেন্ড পর। মর্টারের শেল আঘাত করেছে। বুকের ভেতর থেকে সমস্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেছে যেন। উফ! কি ভীষণ কষ্ট। শরীরের অংগ প্রত্যঙ্গগুলো থেকে কোন সাড়া মিলছে না। ঘুম আসছে! সহস্র বছরের ঘুম...
***
এই মুহূর্তে একবার নুবির সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু জানি নুবি বিজ্ঞান কাউন্সিলের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যাস্ত। তার সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। তারপরও একবার চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি কি?
আমি বেডের পাশে একটা সুইচে চাপ দিলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একজন সুন্দরী তরুণীর হলগ্রাফিক মূর্তি ভেসে উঠল। ও হচ্ছে কিটি, আমার ব্যাক্তিগত কম্পিউটার।
কিটি সুন্দর করে হাসল। “সুপ্রভাত রিমন? কেমন আছ তুমি?”
কিটির এই ফালতু কুশল বিনিময় অংশটা আমার জন্য খুব বিরক্তিকর। যে পোগ্রামার ওর পোগ্রামিং করেছে তার মাথায় কি ঘিলু বলে কিছু ছিলনা? একটা যন্ত্রের সাথে মানুষের কুশল বিনময়ের অর্থ কি? বিরক্তি গোপন করে বললাম, “ভাল আছি কিটি। তোমাকে ডেকেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে”।
“সানন্দে প্রয়োজনটি জানাও রিমন”।
“আমি এই মুহূর্তে নুবির সাথে একটু কথা বলতে চাই”।
“সেটা তো সম্ভব নয় রিমন। নুবি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টে ব্যাস্ত। তার সাথে এখন যোগাযোগ করা যাবেনা”।
“আমি জানি। তারপরও তুমি একবার বিজ্ঞান কাউন্সিলের জীববিজ্ঞান অনুষদের সাথে যোগাযোগ করে দেখ”।
“ঠিক আছে রিমন” বলে কিটির মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিরল আবার মিনিট খানেক বাদেই। “আমি দুঃখিত রিমন। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি”।
আমি হতাশ হয়ে গেলাম। নুবি খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ইদানিং। দেখা পাওয়াতো যাচ্ছেই না, কথা বলাও মুশকিল হয়ে পরেছে।
“তবে আমি তোমার জন্য একটা কাজ করেছি রিমন”।
“কি করেছ তুমি?” আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কিটি প্রায়ই আমার অনুমতি ব্যাতিত বিভিন্ন কাজ করে বসে যা আমার জন্য পরবর্তীতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
“আমি জীববিজ্ঞান অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগের সময় জানিয়ে এসেছি, যখনই নুবির অবসর হয় একমুহূর্ত দেরি না করে যেন তোমার সাথে যোগাযোগ করে!”
“ওহ হ! কেন করেছ তুমি এটা? নুবি জানতে পারলে চিন্তিত হয়ে পরবে। কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না!”
“আমি তোমার কণ্ঠের অস্থিরতাটুকু টের পাই রিমন। তুমি তো জান আমাকে সেভাবেই পোগ্রাম করা হয়েছে”।
“হ্যা, তুমি উদ্ধার করেছ আমাকে!” এবার আর বিরক্তি গোপন থাকল না। “এখন দয়া করে আমার ব্যাক্তিগত সাইক্রিয়াটিস্ট রিগের সাথে যোগাযোগ কর”।
কিটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষন বাদে ঘরের মাঝখানে ভেসে উঠল রিগের মূর্তি। “কেমন আছ রিমন?”
“ভাল থাকলে কি তোমাকে ডাকতাম, রিগ?”
“কেন কি হয়েছে?”
“আজ আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছি”।
“কি দেখলে আজ?”
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর একজন সৈন্যের ভুমিকায় দেখলাম নিজেকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের মর্টারের আঘাতে ছিটকে পড়লাম। সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা! আর ঘুম ভেঙে গেল তখনই”।
“নতুন কিছু নয়”।
“হ্যা, কিন্তু স্বপ্নগুলোকে এত জীবন্ত মনে হয় কেন? মনে হয় যেন এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো আমার জীবনেরই অংশ”।
“এটা খুব হাস্যকর ধারনা, রিমন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেড় হাজার বছর পূর্বের ঘটনা। তোমার বয়স মাত্র ত্রিশ”।
“কিন্তু বিষয়টা লজিক্যাল নয় রিগ। আমি নিশ্চয়ই স্বপ্নে এমন কোন ঘটনা দেখতে পারিনা যার অংশ আমি নই। যে ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখিনি, শুনিনি বা কখনো ভাবিনি তা আমার কল্পনায় কেমন করে আসে?”
“আমাদের অবচেতন মন লজিক মানেনা। তুমি কি আমার নির্দেশগুলো মেনে চলছ?”
“হ্যা, রাতে শোয়ার আগে কম খাচ্ছি, হালকা ব্যায়াম করছি। অন্যান্য নিয়মগুলো সব মেনে চলছি কিন্তু তারপরও লাভ হচ্ছেনা”।
“হুম... বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবতে হবে রিমন। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলব। এখন বিদায় দাও”।
“বিদায় রিগ”।
রিগ চলে যেতেই আবার কিটির ছবি ভেসে উঠল। “আর কিভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি রিমন.........”
আমি সুইচ টিপে কিটিকে নিষ্ক্রিয় করে দিলাম।
বাবার সাথে অনেক দিন ধরে দেখা হচ্ছেনা। তার সাথে একটু কথা বলতে পারলেও মনটা হালকা হত।
****
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে আমার পিছু নিল দুটি বিদঘুটে চেহারার রোবট। এই রোবটগুলোর দেহের গরন মানুষের মত। হাত পা আছে ঠিক ঠাক কিন্তু যেখানে মস্তিস্ক থাকার কথা সেখানে আছে বিশাল আকৃতির একটা চোঙ। তার ভেতর বসান আছে কপরটন। প্রতিটি প্রতিরক্ষা রোবট একটি ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। এই ফ্রিকয়েন্সির সাহায্যে এদেরকে প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রন করা হয়।
এরা আমার ব্যাক্তিগত বডিগার্ড। প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে এই রোবট দুটো আমার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আমার বাবা বিজ্ঞানী ইরিদ বিজ্ঞান কাউন্সিল কতৃক ঘোষিত বর্তমান পৃথিবীর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের মাঝে একজন। গত কয়েক দশকে পদার্থ বিজ্ঞানের নানান শাখায় বাবার সৃষ্টি কিছু ফর্মুলা আর আবিস্কার পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কয়েক ধাপ। তার পুত্র হওয়ার সুবাদে আমিও নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করি, না চাইলেও এ সুবিধা আমাকে নিতে হয়।
আমার রুমের বাইরে ডানদিক বরাবর লম্বা একটা করিডোর। এই করিডোরের শেষ মাথায় বাবার ব্যাক্তিগত ল্যাবরেটরি। গত কয়েকদিন যাবত বাবা কাজে মশগুল হয়ে আছে, ল্যাব ছেড়ে আর বেরোচ্ছে না। বাবা সময় পরিভ্রমনের উপর কাজ করছে। আমি বিস্তারিত জানিনা, বিজ্ঞান কখনোই আমার আগ্রহের বিষয় ছিলনা।
বাবার ল্যাবের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজার মাথায় সবুজ বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাবা খুব বেশি ব্যাস্ত না, যোগাযোগ করা যাবে। আমি ভয়েজ সেন্সরের বাটন চেপে বললাম, “বাবা আমি রিমন। তোমার সাথে কথা বলা যাবে এখন?”
ইন্টারকমে বাবার গমগমে আওয়াজ ভেসে এল, “অবশ্যই রিমন। ভেতরে এসো”।
স্বয়ংক্রিয় ভাবে দরজা খুলে গেল। আমি ভেতরে পা দিলাম, রোবট দুটো আর ফলো করছে না। ওদের এখানে আসার অনুমতি নেই।
বাবা বসে ছিলেন একটা কিম্ভুতকিমাকার যন্ত্রের আড়ালে। আমাকে দেখে উঠে এলেন। “কেমন আছ রিমন?”
“ভাল আছি। তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“ভালনা”। বাবাকে চিন্তিত দেখাল। “আমার ফর্মুলাতে কিছু একটা গলদ আছে, যুগান্তকারী এক আবিস্কারের দ্বারপ্রান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি”।
আমি হাসলাম।
“তুমি হাসছ রিমন? তুমি আসলে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারছ না। আমি সফল হলে বদলে যেতে পারে পৃথিবীর ইতিহাস। যেকোনো সময় আমরা অতিত অথবা ভবিষ্যতে পরিভ্রমন করতে পারব! যে টাইম মেশিনের কথা এতদিন কল্পকাহিনীতে পরেছ তা আজ বাস্তব হতে চলেছে! কি উত্তেজনাকর বিষয় একবার ভেবে দেখ!”
আমি বললাম, “আমি বুঝতে পারছি বাবা। আসলে বিজ্ঞান নিয়ে আমি খুব বেশি আগ্রহী নই তা তো জানই”।
“এটা খুব লজ্জাজনক! আমার পুত্র হয়ে তুমি বিজ্ঞান ভালবাসনা!” বাবা আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “তুমি বলেছিলে আমার সাথে কথা বলতে চাও। কি বিষয়ে?”
“আমার দুঃস্বপ্ন দেখা নিয়ে। সমস্যাটা তো যাচ্ছে না। দিন দিন বাড়ছে”।
“তোমার ব্যাক্তিগত সাইক্রিয়াটিস্ট রিগের সাথে কথা বলেছ?”
“হ্যা, তার দেওয়া নিয়মগুলো সব মেনে চলছি কিন্তু লাভ হচ্ছেনা”।
বাবা যেন আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। “বিষয়টা ভাবনায় ফেলে দিল রিমন! আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলে যোগাযোগ করে তোমার সমস্যার কথা বলব”।
“আর একটা কথা বলতে চাই বাবা”।
“কি?”
আমি খানিক ইতস্তত করে বললাম, “বলতো আমার বয়স কত?”
বাবা হাসলেন, “আমি তো তোমার বয়সের হিসেব রাখিনি। ২৮-২৯ হবে বোধহয়”।
“ত্রিশ”।
“কাছাকাছি অনুমান করেছি”। বাবার হাসিটা প্রসারিত হল।
“কিন্তু আমাকে দেখলে মনে হয়না ২৫-২৬ বছরের যুবক?”
“সেটা কোন সমস্যা না রিমন। বয়সের সাথে সাথে সবার গ্রোথ তো এক হয়না!”
“কিন্তু বাবা, আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে যখন আমার বয়স ছিল ২০ তখনো আমাকে ২৫ বছর বয়সী মনে হত!”
“সেটা হরমনজনিত কোন সমস্যা হতে পারে! আমি এ বিষয়টা নিয়েও ওদের সাথে কথা বলব”।
“কিন্তু বাবা.......”
বাবা হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল, “আমি বুঝেছি বিষয়টা রিমন। তোমার সাথে এ বিষয়ে পরে আরও কথা হবে। আমি এখন একা একা একটু কাজ করব, ফর্মুলার সমস্যাটা মনে হয় ধরতে পেরেছি। তুমি যাও”।
আমি বেরিয়ে এলাম ল্যাব থেকে। স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথে লাল বাতিটি জ্বলে উঠল। এর মানে হচ্ছে বাবা এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তার সাথে কথা বলা যাবেনা। আমি জানি এখন তিনি কি করবেন। বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধানের সাথে সরাসরি কথা বলবেন যোগাযোগ মডিউলের সাহায্যে। পকেট থেকে একটা এয়ারবাড বের করে কানে প্রবেশ করালাম। আজকের কথোপকথনটুকু আমিও শুনতে পাব। বাবা টের পায়নি, তার অলক্ষ্যে একটা ছোট্ট বাগ লাগিয়ে রেখে এসেছি ঐ অদ্ভুত যন্ত্রের গায়ে। প্রতিপদার্থের তৈরি এই বাগ, নির্দিষ্ট সময় পর নিজ থেকে মিশে যাবে যন্ত্রের গায়ে। বাবা ঘুণাক্ষরেও সেটা জানতে পাবে না।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, “মহামান্য সভাপতি আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ”।
অপর প্রান্ত থেকে কিছু বলা হল।
বাবা আবার বলল, “আমার মনে হয় আবার সময় চলে এসেছে। ওর মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে চাইছে”।
আবার নিরবতা। অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা বলা হচ্ছে।
“না, এসবে কাজ হবেনা। আমার মনে হয় চুরান্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক!”
আবার নিরবতা।
“ঠিক আছে, দ্রুত ব্যবস্থা করুন”।
কথোপকথন শেষ হয়েছে। আমি কান থেকে এয়ারবাড খুলে নিলাম। আমি আজ এমন কিছু জেনে ফেলেছি যা আমার জানার কথা নয়!
****
“রিমন, তুমি কি সুস্থ মস্তিষ্কে কথা গুলো বলছ?”
কফির কাপে চুমুক দেয়ার ফাকে দেখে নিলাম আমার বডিগার্ড রোবট দুটি মোটামোটি দূরে আছে। এইমাত্র নুবি আমাকে কেলভার মেটালের তৈরি একটা লকেট উপহার দিয়েছে। লকেট থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি নুবির দিকে তাকালাম। “হ্যা, নুবি”।
“কিন্তু এটা কিকরে সম্ভব?”
“আমি জানিনা কিভাবে সম্ভব। কিন্তু এটাই সত্যি। আমার বয়সের সাথে সাথে দৈহিক বৃদ্ধি হচ্ছেনা। তোমার সাথে আমার পরিচয় দু বছর আগে একটা বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনারে। তোমার কি মনে হয় গত দু বছরে আমার শরীরে একটুও পরিবর্তন এসেছে?”
“দু বছর খুব অল্প সময়, রিমন”।
“কিন্তু ১০ বছর অল্প নয় নুবি। ব্যাপারটা সিরিয়াস। গত দশ বছরে আমার শারীরিক বৃদ্ধি হয়নি একচুলও”।
“এটা কোন হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে”।
“ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু আর একটা বিষয় দেখানো দরকার তোমাকে”। আমি একটা চাকু হাতে তুলে নিলাম ডান হাতের তালুতে একটা পোঁচ দিলাম। সাথে সাথে গভীরভাবে কেটে রক্ত বেরিয়ে এল।
“রিমন তুমি কি করলে এটা?” আঁতকে উঠল নুবি।
“রিল্যাক্স! কিচ্ছু হবেনা”।
নুবি অবাক চোখে দেখল আমার হাতের ক্ষতচিহ্নটি আপনা থেকেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল, “মাই গড! ইউ ক্যান হিল”!!
“ইয়েস, আই ক্যান”।
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, রিমন। এটা কিভাবে সম্ভব?”
“আমি জানিনা নুবি। তবে এমন উত্তর না জানা আরও হাজারো প্রশ্ন আছে। গতকাল আমি আড়ি পেতে বাবাকে কথা বলতে শুনেছি বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধানের সাথে। বাবা বলেছেন আমি কিছু একটা সন্দেহ করছি। খুব তাড়াতাড়ি সত্য জেনে ফেলব। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে বলেছে দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে”।
নুবির চোখে উদ্বেগ, “কেন রিমন, কেন হচ্ছে এসব তোমার সাথে?”
“কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে আমার মাঝে নুবি। আমার বাবা বা বিজ্ঞান কাউন্সিল চায়না আমি সেই রহস্যের সন্ধান পাই”।
নুবি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বলে চলেছি, “তবে আমার কি মনে হয় জান? আমি সম্ভবত এই রহস্যের উত্তর জানি। অন্তত আমার অবচেতন মন জানে। সেজন্যই আমি প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। এই দুঃস্বপ্নের মাঝেই সব উত্তর লুকিয়ে আছে”।
“কিন্তু তুমি তো এই দুঃস্বপ্ন খুব বেশিদিন যাবত দেখছ না!”
“হ্যা। আমার যখন ২০ বছর বয়স তখন আমার মা মারা যায় এবং তারপর থেকেই আমার দুঃস্বপ্ন দেখার শুরু। প্রায় একই সময় থেকে আমার দৈহিক বৃদ্ধি গেছে থেমে। আমার কেন যেন মনে হয় আমার দুঃস্বপ্নগুলো আসলে কল্পনা নয়, খুব বেশি জীবন্ত। আমার স্মৃতি নিয়ে কেউ খেলছে নুবি। মনে হচ্ছে আমার যে স্মৃতি আছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। কিছু স্মৃতি ভুলে গেছি আমি”।
“সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব”।
“কিভাবে?”
“মেডিকেল সায়েন্স বিভাগ মানসিক সমস্যা গ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটা বিশেষ সিমুলেশন টেকনিক আবিস্কার করেছে। এর সাহায্যে মানুষকে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করা হয়। তুমি যদি সত্যিই কোন স্মৃতি হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এই জন্য কিছু ইকুইপমেন্ট আর খুব রেয়ার একধরনের ইঞ্জেকশন প্রয়োজন”।
“তুমি কিভাবে এগুলো যোগাড় করবে?”
নুবি ঠোঁট টিপে হাসল। “ভুলে যাচ্ছ কেন? আমি একজন জীববিজ্ঞানী, গবেষণার কাজে প্রয়োজন বলে নিজের আইডি দেখিয়ে ওগুলো যোগাড় করা খুব বেশি সমস্যা হবেনা”।
“কিন্তু ওরা যদি ধরে ফেলে তোমার এগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্য গবেষণার জন্য নয়?”
“সেটা বুঝতে ওদের অন্তত দুদিন সময় লাগবে। ততদিনে আমাদের কাজ হয়ে যাবে”।
“কিন্তু একদিন তো ওরা জানবেই, তোমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে নুবি”।
“তোমার চাইতে ক্যারিয়ার বড় নয় আমার কাছে”।
হাত বাড়িয়ে নুবির একটা হাত দুহাতের মাঝে তুলে নিলাম আমি। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। নুবি আছে বলেই তো বেঁচে আছি, ও না থাকলে এই একঘেয়ে বেঁচে থাকার আশা আমার অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে যেত।
****
আমার পায়ের নিচে পাহাড়ের চুড়ো, সম্মুখে বিশাল সাগর। আমি প্রস্তুত হচ্ছি, এক মুহূর্ত পরেই আলিঙ্গন করে নেব মৃত্যুকে। আরও একটি শেষ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হবে সকল জাগতিক যন্ত্রণার অবসান। শেষবারের মত চিরচেনা পৃথিবীকে একনজর দেখে নিয়ে আমি ঝাপ দিলাম, আপন করে নিলাম ভীষণ শূন্যতাকে। পতনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সামুদ্রিক বাতাস কানের দুপাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে “আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তোমার মুক্তি”।
যেন একযুগ পরে আমার দেহ লবণাক্ত পানির স্পর্শ পেল। কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা! শরীরে কাপন ধরে যাওয়ার এক তীব্র অনুভূতি। আমি হারিয়ে যাচ্ছি অতলে, গভীর থেকে গভীরে। প্রশ্বাসের সাথে বুক ভরে যাচ্ছে লোনা পানিতে। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, পুরে যাচ্ছে অক্সিজেনের অভাবে। মুক্তি এত কঠিন কেন?
কোথায় সমুদ্র? এতো দেখছি ব্যাস্ততম এক সড়ক। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করছি? গায়ের পাশ ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে দূরপাল্লার ভারী যানবাহন। নাহ, ওরা যানবাহন কেন হতে যাবে? ওরা আমার মুক্তির দূত। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা যাত্রীবাহী বাস। আমার মুক্তির পয়গাম নিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে। আমি দু হাত প্রাসারিত করে করে চেয়ে আছি সেই বিশাল মুক্তিকে গ্রহন করার জন্য।
একমুহূর্ত বাদেই লক্ষ করলাম জাহাজের নির্জন ডেকে বসে সমুদ্রের ঢেউ অবলোকন করছি। মৃদু ঢেউয়ের ধাক্কায় দোদুল্যমান অনুভূতি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র ডাকছে আমায়, কোন অপ্রতুল মাদকের প্রতি আসক্ত ভবঘুরের মত আমি এগিয়ে গেলাম ডেকের কিনারে। ঝাপ দেব বলে প্রস্তুত, আরও একবার মুক্তির দ্বারপ্রান্তে আমি। দেহটা পানি স্পর্শ করতেই আবার সেই তীব্র অনুভূতি! এই অনুভূতি আমার অনেক দিনের চেনা। মুক্তির নেশায় আসক্ত ক্রীতদাসের প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনছি সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে।
কিন্তু এটা কি হচ্ছে? আমার প্রসারিত দুহাতে অস্ত্র কেন? আর কোথায় গেল ব্যাস্ত সড়ক? এতো এক যুদ্ধের ময়দান। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। আমি অনবরত গুলি করে চলেছি আর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি সম্মুখে শত্রুর অবস্থান বরাবর। আমার মনে ভয় ডর বলে কিছু নেই। আমি স্বাধীনতার নেশায় বুঁদ। হঠাৎ বুকে ভারী বুলেটের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। সমস্ত দম বেরিয়ে গেছে বুক থেকে। বার কয়েক কেশে উঠলাম। তবে কি এই আমার মুক্তি?
নাহ! ওটা মুক্তির নামে ছিল প্রহসন। নইলে আমি এখন একটা চলন্ত মহাকাশযানে কেন? ওজনের তারতম্যের ঝক্কি সামলে মহাকাশযানটির হ্যাচ বরাবর দাঁড়িয়ে যেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলনা। হ্যাচ ধরে টান দিতেই সম্মুখে দেখলাম বিশাল শুন্যতা। এই শূন্যতার ভিড়ে কোথাও হারিয়ে যাব আমি আজ। নাহয় এটাই হোক আমার মুক্তির নামান্তর। বিশাল শূন্যতাকে গ্রহন করে নিলাম অনায়াসেই। শরীরের ওপর আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই, ভেসে চলেছি অজানার উদ্দেশ্যে। অনেক দূরে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে যাচ্ছে। তার উজ্জ্বল আভা যেন প্রশ্ন করে চলেছে “তুমি মুক্তি চাও নাকি মৃত্যু চাও”। এই প্রশ্ন আমাকে করা অবান্তর। আমার কাছে মুক্তি বা মৃত্যু ভিন্ন কিছু নয়।
ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। নক্ষত্রের অবয়বটি ক্রমশ কোন মানব মূর্তির আঁকার ধারন করছে। এই মুখশ্রী আমার অনেক দিনের চেনা, অনেক বেশি আপন। এটা নুবি, আমার নুবি। নক্ষত্র মিলিয়ে গিয়ে সেখানে নুবির মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার চোখ দুটো আমাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে, “তুমি কি মুক্তি চাও, তুমি কি মৃত্যু চাও?”
“না, নুবি আমি মৃত্যু চাই না। অন্তত তুমি যতক্ষণ পাশে আছ ততক্ষন নয়! আমার মুক্তি তোমার মাঝে, মৃত্যু আমার মুক্তি নয়”।
“কি আবল তাবল বলছ তুমি, রিমন?”
নুবির কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। আমি শুয়ে আছি বিছানায়। মাথা হাত বুক ও শরীরের অন্যান্য অংশে নানান ইকুইপমেন্টের সংযোগ। আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। নুবি বাধা দিল “আস্তে! ওষুধের প্রভাব কাটতে কিছুক্ষন সময় লাগবে”। সে ব্যাস্ত হাতে আমার শরীর থেকে ইকুইপমেন্টগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় মনযোগী হল। বলল, “কি কিছু উপকার হল”।
“হ্যা”। আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কি জানতে পারলে?”
“বিজ্ঞানী ইরিদ আমার বাবা নন। আমার ২০ বছর বয়সে আমার মা মারা যাননি। সমস্ত স্মৃতি মিথ্যে। আমার মাথায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের অসংখ্য স্মৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যার পুরোটাই মিথ্যে”।
“তাহলে সত্যি কি?”
“আমার জন্ম দেড় হাজার বছর পূর্বের পৃথিবীতে। আমার আসল বাবা ছিলেন কৃষক। আমার বাবা মার মৃত্যু হয়েছে আমার সামনে। তখন আমি ২৫ বছরের যুবক। এর পর আরও অসংখ্য পরিবারের সাথে থেকেছি আমি, সবাই বুড়ো হয়ে একসময় মরে গেছে কিন্তু আমি মরিনি, আমি মরিনা, আমার বয়স বাড়েনা। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তির নেশায় আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি। অসংখ্যবার চেষ্টা করেছি মরে যেতে। পানিতে ডুবেছি, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছি, পাহারের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, গুলি খেয়েছি- কিন্তু আমি মরতে পারিনি, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে”।
নুবিকে একটুও বিচলিত মনে হচ্ছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার নুবি? তুমি অবাক হচ্ছনা একথা শুনে?”
“না, আমি পুরো বিষয়টা আন্দাজ করতে পারছিলাম”।
“কিভাবে?”
“এখানে আসার আগে আমি আমাদের বিজ্ঞান কাউন্সিলে ডাটাবেজে খোঁজ নিয়েছি। তুমি তো জানই বিজ্ঞান কাউন্সিলের ডাটাবেজে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সম্পর্কে তথ্য রাখা আছে। তোমারটাও আছে। একজন সদস্য হিসেবে সে তথ্য জানার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমাকে সেই তথ্য জানতে দেওয়া হচ্ছেনা। বলা হচ্ছে তুমি সম্পর্কে সকল তথ্য ক্লাসিফাইড। শুধুমাত্র প্রধান বিজ্ঞানী সভার সদস্য না হলে এই তথ্য জানা যাবেনা। তারপর আমি একজন প্রধান বিজ্ঞানী সভার সদস্যের পাস চুরি করে তথ্যটুকু বের করে এনেছি। সেখানে শুধু দুটো বাক্য বলা তোমার সম্পর্কে বলা আছে, ১. তুমি একজন অমর মানুষ ২. বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হল তোমাকে রক্ষা করা। এর চেয়ে বেশি তথ্য জানার অধিকার একমাত্র বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধান ছাড়া কারো নেই”।
“তুমি এত বড় ঝুকি নিয়েছ কেন?”
“তোমার জন্য রিমন... আমি যেকোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবনা”।
“কিন্তু এখন কি হবে? ধরা পরলে ওরা তো আমাদের কঠিন শাস্তি দিবে!”
“আমরা পালিয়ে যাব, তুমি প্রস্তুত থেক। কেউ কিছু জানার আগেই আজ রাতে পালাব আমরা”। নুবির চোখে মুখে দৃঢ়তা।
“কিন্তু প্রতিরক্ষা রোবটগুলো আমাদের ঠিকই ধরে আনবে। ওরা ওদের ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে যেকোনো জিনিসের সন্ধান পেয়ে যায়। পৃথিবীর কোন প্রান্তই আমাদের জন্য নিরাপদ নয়”।
“সেটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও”। নুবির ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস। “ তুমি তো জানই প্রতিটি প্রতিরক্ষা রোবট ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা একটি অন্যটির সাথে কানেক্টেড। আমি ওদের ফ্রিকোয়েন্সিতে একটা ভাইরাস আপলোড করে দিয়েছি। ওদের পক্ষে এখন আর তোমাকে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব নয়। আমরা পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের কোন বিরান অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে পরিচয় গোপন করে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারব।”
আমি নুবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি আমার পাশে থাকবে তো?”
নুবি হাসল। “কথাটা উলটো করে বললে ভাল হবে রিমন। তোমার নয়, আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমার পাশে থাকব”।
আমিও হাসলাম। নুবির কথাই ঠিক। আমাদের সংসার হবে, সন্তান হবে, ভালবাসার মেয়েটি ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যাবে, একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু আমি থাকব একই রকম। তাতে কি? একটা জীবন এই মেয়েটির সাথে পার করে দিতে পারলে আমার আর কিছুই না পাওয়া থাকবেনা। এই মৃত্যুহীন অস্তিত্ব নিয়ে সারাজীবন আমার যে আক্ষেপ ছিল তা এক পলকেই দূর হয়ে গেল। নিজের এই বেঁচে থাকাটা সার্থক হয়েছে নুবির জন্য। দেড় হাজার বছর পর জীবনে এসেছে সত্যিকারের ভালবাসা ।
নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর আমরা তখনও জানতাম না যে পালানোর সুযোগ আমাদের হবেনা। ইতিমধ্যে নুবির পাসওয়ার্ড চুরি আর ইলিগাল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইস্যু করার খবর জানাজানি হয়ে গেছে। একটু পরেই কিছু প্রতিরক্ষা রোবট আসবে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক দিয়ে ওরা আমাদের অজ্ঞান করে দেবে।
***
বার কয়েক চোখ মিট মিট করতেই চোখের সামনে পৃথিবীটা পরিষ্কার হয়ে এল। এই যায়গা আমার অনেক দিনের পরিচিত। এটা বাবার ল্যাব। আমি বসে আছি একটা চেয়ারে। হাত-পা চেয়ারের সাথে শক্ত ইলাস্টিক রোপ দিয়ে বাধা। সামনেই বসে আছে বাবা। তার চোখে মুখে কৌতূহল। নুবিকে কোথাও দেখছি না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নুবি কোথায়?”
বাবা হাসল, “নুবি ফিরে গেছে তার আপন ভুবনে, তার কর্মক্ষেত্রে”।
“নুবি আমাকে ফেলে কাজে ফিরে গেছে! এটা অসম্ভব”।
“সম্ভব, কারন ও এখন আর তোমাকে চেনেনা। নুবির মস্তিস্ক থেকে তোমার সকল স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়েছে।
তীব্র এক হতাশার অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই ভাবতে পারলাম না। তারপর আস্তে ধীরে বললাম, “আমাকে বাদ রাখা হল কেন? আমাকেও সব কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছ না কেন তোমরা?”
“হুম.. বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। তোমার সমস্ত স্মৃতি মুছে দিয়ে নতুন স্মৃতি প্রবেশ করান হবে, দেওয়া হবে নতুন পরিচয়। এখনও কাজটা করা হয়নি আমার অনুরোধে। আমি চাইছিলাম সব কিছু ভুলে যাওয়ার আগে তুমি সবটুকু জেনে নাও”।
“সর্বমোট কতবার আমাকে এভাবে স্মৃতি ভুলিয়ে নতুন স্মৃতি দেওয়া হয়েছে?”
“আমার অধীনে মোট তিন বার তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে। এর আগে আমার শিক্ষকের অধীনে ছিলে তুমি। আমার পরে অন্য কারো অধীনে নেওয়া হবে। প্রতিবার ঠিক ১০ থেকে ১২ বছরের মাথায় তুমি নিজ সম্পর্কে সবটুকু জেনে যাও। আর জানার পর পরই খুব ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠো, আত্মঘাতী কাজ কর, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা কর। তাই তোমার কাছ থেকে তোমাকে রক্ষা করতেই প্রতি ১০ বছর পর পর তোমার স্মৃতি রিবুট করতে হয়”।
“কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? আমার বয়স বাড়েনা কেন? আমি অমর হলাম কিকরে?” একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
“এই সব প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই। তোমার সম্পর্কে সব তথ্য জানার অধিকার একমাত্র বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধান ছাড়া আর কারো নেই। অনুমান নির্ভর হয়ে বলতে পাড়ি, সম্ভবত তুমি গোপন কোন প্রজেক্টের অংশ, কিন্তু এই প্রজেক্টের কি উদ্দেশ্য তা আমি জানিনা”।
আমি চুপ করে থাকলাম।
বাবা প্রশ্ন করলেন, “আর কিছু জানতে চাও তুমি?”
“না”
“ব্যাস! প্রতিবার তো তুমি অসংখ্য প্রশ্ন কর। এইবার আর কিছু জানতে চাইছ না কেন?”
“যত দ্রুত সম্ভব আমাকে আমার স্মৃতি ভুলিয়ে দাও”। নুবির কথা মনে হচ্ছে বার বার। নুবিহীন বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে।
“একটু অপেক্ষা কর। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে সরঞ্জাম এলেই ব্যবস্থা নেব”।
আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। বাবা উঠে ল্যাবের অপর প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল তার সেই কিম্ভূতকিমাকার টাইম মেশিনের কাছে। ঝুঁকে পরে কাজ শুরু করল।
কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। আমার তন্দ্রামত এসছিল, হঠাৎ মাথার অভ্যন্তরে তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। “রিমন!! রিমন!!”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “কে? কে ডাকে?”
আমার মাথার ভেতরে থেকে উত্তর এল, “আমরা”।
“কোথথেকে কথা বলছ তোমরা?”
“আমরা কথা বলছি অনেক ভবিষ্যতের এক পৃথিবী থেকে। এ এমন এক পৃথিবী যেখানে সব কিছুই আছে, শুধু মানুষ বলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। সমস্ত মানবজাতি হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে”।
বিষয়টা আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, এটা কোন কল্পনা নয়ত? আমি কোন স্বপ্ন দেখহি না তো? জিজ্ঞেস করলাম, “কারা তোমরা?”
“আমাদেরকে বোঝার সাধ্য তোমার নেই রিমন। আমরা মানবজাতির হিতাকাঙ্খি। আমরাই তোমাকে এতদিন বাচিয়ে রেখেছি। প্রতিবার মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার পর আমরা তোমাকে ফিরিয়ে আনি। আমরাই তোমার জিনে খুব সুক্ষ কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে বয়সটা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে আঁটকে রেখেছি”।
“কিন্তু কেন করেছ তোমরা এটা?” আমি অস্থির কণ্ঠে বললাম।
“মানবজাতিকে রক্ষার করার জন্য, রিমন। মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার হাতে। তুমিই শুধু পার মানবজাতিকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে”।
“আমি কীভাবে মানবজাতিকে রক্ষা করব?” এতক্ষনে আমি একটু ধাতস্থ হতে পেরেছি।
“বিজ্ঞানী ইরিদ, যাকে তুমি বাবা বলে ডাক সে আর কিছুক্ষন বাদেই তার টাইম মেশিন তৈরির কাজে সফল হবে। তার আগেই তোমাকে যন্ত্রটা ধ্বংস করে দিতে হবে রিমন। তাহলেই মানুষ রক্ষা পাবে”।
“আমি কিছু বুঝতে পারছিনা”। অসহায় কণ্ঠে বললাম আমি।
“রিমন, মানবজাতীকে সময় পরিভ্রমনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কারন এই ক্ষমতা তোমাদের টাইম লাইন ভেদে সাহায্য করবে। তোমরা নিজেদের খেয়াল খুশি মত অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ পালটে দিয়ে গিয়ে সৃষ্টি করবে একটা বিশাল টাইম প্যারাডক্স। তাতে সমগ্র মানবজাতি হারিয়ে যাবে এক মহাজাগতিক গহ্বরে। পৃথিবী থেকে বিলিন হয়ে যাবে একটি বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব”।
“কিন্তু তোমরা আমাকেই কেন বেছে নিলে? আর কেউ নয় কেন?”
“কারন তুমি হচ্ছ জেনেটিকেলি পারফেক্ট একজন মানুষ। তুমি যে যুগ থেকে এসেছ তার পরবর্তী সময় থেকেই মানুষ জেনেটিকাল পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের স্বাভাবিক চিন্তা ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা প্রযুক্তির দাস হয়ে গেছে, এরা কখনোই আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কাররুপে বুঝতে পারবেনা। সময় পরিভ্রমনের সুযোগ কেউ নষ্ট করতে চাইবেনা। কিন্তু তুম দেখে এসেছ প্রযুক্তি শুধু উপকার করে তা নয়, কখনো কখনো বিশাল ধ্বংস ডেকে আনে”।
“একজন মানুষকে কেন বেছে নিতে হল? তোমরা যখন মানবজাতির হিতাকাঙ্খি, তাহলে নিজেরাই কেন বাবার যন্ত্রটা ধ্বংস করে দিচ্ছনা?”
“আমরা একটা সিমুলেশন প্রসেস সৃষ্টি করতে পারি। সেই সিমুলেশন প্রসেসে চাইলে এক বা একাধিক নতুন প্রান জুড়ে দেওয়া যায় কিন্তু একটা ঘটে যাওয়া ঘটনা পরিবর্তন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। ঘটনাটা যারা ঘটিয়েছে, তাদেরকেই সেটা পরিবর্তন করতে হবে। তাই তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এ কাজের জন্য”।
“আমাকে কি করতে হবে?”
“ভালকরে তাকিয়ে দেখ, বিজ্ঞানী ইরিদের তৈরি যন্ত্রের সাথে একটা ক্যাপসুল রয়েছে একজন মানুষ প্রবেশ করার মত। তার পাশেই দন্ডায়মান কাচে ঘেরা মোচক আকৃতির জারের ভেতর বেশ কিছু কেমিকেল ভর্তি টেস্ট টিউব রাখা আছে। তুমি শুধু এই টেস্ট টিউবগুলো ভেঙে দিলেই চলবে। এতে যে পরিমান ক্ষতি হবে তাতে বিজ্ঞানী ইরিদ তার জীবদ্দশায় আর সময় পরিভ্রমনের যন্ত্র তৈরি করতে পারবেনা। মানবজাতি রক্ষা প্পাবে সম্ভাব্য ধংসের হাত থেকে”।
কিন্তু আমি বাধন থেকে মুক্ত হব কীভাবে? ভাবতে ভাবত
আমার সাথে আছে মিত্রবাহিনীর কিছু অকুতোভয় যোদ্ধা। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে খুব দ্রুত আমাদের লোকবল কমে যাচ্ছে। ব্যাকআপ না পৌঁছালে আজ মৃত্যু নিশ্চিত। লেফটেন্যান্ট বেন কাছে চলে এসেছে। আমার উদ্দেশ্যে বলল, “ক্যাপ্টেন, উই আর ইন ক্রাইং নিড অফ ব্যাক আপ”।
আমি উত্তর দিলাম না। তবে একটা বিষয় লক্ষ করে আতঙ্কের ঢেউ নামল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমাদের অ্যামুনিশন প্রায় ফুরনোর পথে। ব্যাকআপ আসা পর্যন্ত টিকব বলে মনে হচ্ছেনা।
লেফটেন্যান্ট চিৎকার করছে, “ক্যাপ্টেন, ফর গডস সেক! কিছু একটা তো বলুন! এভাবে পরে থাকলে সবাই মারা পড়ব। আমরা কি অল আঊট এটাকে যাব?”
আমি বললাম, “অলআউট অ্যাটাকে যাওয়টা হবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। ওদের ভারী অস্ত্রের মুখে আমরা দু মিনিটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। আমাদের পিছু হটতে হবে”।
“তাহলে নির্দেশ দিন ক্যাপ্টেন, চুপ করে আছেন কেন?”
“সবাই একসাথে পিছিয়ে গেলে ওরা বুঝে ফেলবে লেফটেন্যান্ট। আমাদের কিছু সৈন্য এখানে থাকতে হবে কভার ফায়ার করার জন্য”।
“আমি থাকছি ক্যাপ্টেন”। দৃঢ় কণ্ঠে বলল বেন। “আপনার দ্রুত পিছু হটুন”।
“না লেফটেন্যান্ট, আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে আপনি পিছু হটতে থাকুন, আমরা কভার ফায়ার করছি”।
“না স্যার। আপনাকে এভাবে রেখে আমি পালাতে পারব না”।
“আহ! অযথা কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করবেন না লেফটেন্যান্ট। এই যায়গাটা আপনি আমার চেয়ে অনেক ভাল চেনেন। খুব সহজেই সবার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবেন। সময়মত ব্যাকআপ নিয়ে হাজির হতে পারবেন”।
“কিন্তু স্যার........”
আমি বিরক্তির সাথে বললাম, “ইটস অ্যান অর্ডার!!”
“ইয়েস স্যার” বলে ঘুরল লেফটেন্যান্ট বেন। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, “অ্যাটেনশন এভরিওয়ান। উই আর রিট্রিটিং, ফলো মি। আই রিপিট- ফলো মি”।
কিছুক্ষন তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে ওদের সাথে আর দেখা হবে না! আমি আবার শত্রুদের সম্ভাব্য অবস্থান লক্ষ করে গুলিবর্ষণে মনযোগী হলাম। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা। সামান্য অমনোযোগ মৃত্যুর কারন হতে পারে।
কতটা সময় এভাবে পেরিয়ে গেল জানিনা, হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। আওজায়টা পেলাম দু সেকেন্ড পর। মর্টারের শেল আঘাত করেছে। বুকের ভেতর থেকে সমস্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেছে যেন। উফ! কি ভীষণ কষ্ট। শরীরের অংগ প্রত্যঙ্গগুলো থেকে কোন সাড়া মিলছে না। ঘুম আসছে! সহস্র বছরের ঘুম...
***
এই মুহূর্তে একবার নুবির সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু জানি নুবি বিজ্ঞান কাউন্সিলের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যাস্ত। তার সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। তারপরও একবার চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি কি?
আমি বেডের পাশে একটা সুইচে চাপ দিলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একজন সুন্দরী তরুণীর হলগ্রাফিক মূর্তি ভেসে উঠল। ও হচ্ছে কিটি, আমার ব্যাক্তিগত কম্পিউটার।
কিটি সুন্দর করে হাসল। “সুপ্রভাত রিমন? কেমন আছ তুমি?”
কিটির এই ফালতু কুশল বিনিময় অংশটা আমার জন্য খুব বিরক্তিকর। যে পোগ্রামার ওর পোগ্রামিং করেছে তার মাথায় কি ঘিলু বলে কিছু ছিলনা? একটা যন্ত্রের সাথে মানুষের কুশল বিনময়ের অর্থ কি? বিরক্তি গোপন করে বললাম, “ভাল আছি কিটি। তোমাকে ডেকেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে”।
“সানন্দে প্রয়োজনটি জানাও রিমন”।
“আমি এই মুহূর্তে নুবির সাথে একটু কথা বলতে চাই”।
“সেটা তো সম্ভব নয় রিমন। নুবি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টে ব্যাস্ত। তার সাথে এখন যোগাযোগ করা যাবেনা”।
“আমি জানি। তারপরও তুমি একবার বিজ্ঞান কাউন্সিলের জীববিজ্ঞান অনুষদের সাথে যোগাযোগ করে দেখ”।
“ঠিক আছে রিমন” বলে কিটির মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিরল আবার মিনিট খানেক বাদেই। “আমি দুঃখিত রিমন। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি”।
আমি হতাশ হয়ে গেলাম। নুবি খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ইদানিং। দেখা পাওয়াতো যাচ্ছেই না, কথা বলাও মুশকিল হয়ে পরেছে।
“তবে আমি তোমার জন্য একটা কাজ করেছি রিমন”।
“কি করেছ তুমি?” আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কিটি প্রায়ই আমার অনুমতি ব্যাতিত বিভিন্ন কাজ করে বসে যা আমার জন্য পরবর্তীতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
“আমি জীববিজ্ঞান অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগের সময় জানিয়ে এসেছি, যখনই নুবির অবসর হয় একমুহূর্ত দেরি না করে যেন তোমার সাথে যোগাযোগ করে!”
“ওহ হ! কেন করেছ তুমি এটা? নুবি জানতে পারলে চিন্তিত হয়ে পরবে। কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না!”
“আমি তোমার কণ্ঠের অস্থিরতাটুকু টের পাই রিমন। তুমি তো জান আমাকে সেভাবেই পোগ্রাম করা হয়েছে”।
“হ্যা, তুমি উদ্ধার করেছ আমাকে!” এবার আর বিরক্তি গোপন থাকল না। “এখন দয়া করে আমার ব্যাক্তিগত সাইক্রিয়াটিস্ট রিগের সাথে যোগাযোগ কর”।
কিটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষন বাদে ঘরের মাঝখানে ভেসে উঠল রিগের মূর্তি। “কেমন আছ রিমন?”
“ভাল থাকলে কি তোমাকে ডাকতাম, রিগ?”
“কেন কি হয়েছে?”
“আজ আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছি”।
“কি দেখলে আজ?”
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর একজন সৈন্যের ভুমিকায় দেখলাম নিজেকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের মর্টারের আঘাতে ছিটকে পড়লাম। সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা! আর ঘুম ভেঙে গেল তখনই”।
“নতুন কিছু নয়”।
“হ্যা, কিন্তু স্বপ্নগুলোকে এত জীবন্ত মনে হয় কেন? মনে হয় যেন এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো আমার জীবনেরই অংশ”।
“এটা খুব হাস্যকর ধারনা, রিমন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেড় হাজার বছর পূর্বের ঘটনা। তোমার বয়স মাত্র ত্রিশ”।
“কিন্তু বিষয়টা লজিক্যাল নয় রিগ। আমি নিশ্চয়ই স্বপ্নে এমন কোন ঘটনা দেখতে পারিনা যার অংশ আমি নই। যে ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখিনি, শুনিনি বা কখনো ভাবিনি তা আমার কল্পনায় কেমন করে আসে?”
“আমাদের অবচেতন মন লজিক মানেনা। তুমি কি আমার নির্দেশগুলো মেনে চলছ?”
“হ্যা, রাতে শোয়ার আগে কম খাচ্ছি, হালকা ব্যায়াম করছি। অন্যান্য নিয়মগুলো সব মেনে চলছি কিন্তু তারপরও লাভ হচ্ছেনা”।
“হুম... বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবতে হবে রিমন। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলব। এখন বিদায় দাও”।
“বিদায় রিগ”।
রিগ চলে যেতেই আবার কিটির ছবি ভেসে উঠল। “আর কিভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি রিমন.........”
আমি সুইচ টিপে কিটিকে নিষ্ক্রিয় করে দিলাম।
বাবার সাথে অনেক দিন ধরে দেখা হচ্ছেনা। তার সাথে একটু কথা বলতে পারলেও মনটা হালকা হত।
****
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে আমার পিছু নিল দুটি বিদঘুটে চেহারার রোবট। এই রোবটগুলোর দেহের গরন মানুষের মত। হাত পা আছে ঠিক ঠাক কিন্তু যেখানে মস্তিস্ক থাকার কথা সেখানে আছে বিশাল আকৃতির একটা চোঙ। তার ভেতর বসান আছে কপরটন। প্রতিটি প্রতিরক্ষা রোবট একটি ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। এই ফ্রিকয়েন্সির সাহায্যে এদেরকে প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রন করা হয়।
এরা আমার ব্যাক্তিগত বডিগার্ড। প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে এই রোবট দুটো আমার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আমার বাবা বিজ্ঞানী ইরিদ বিজ্ঞান কাউন্সিল কতৃক ঘোষিত বর্তমান পৃথিবীর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের মাঝে একজন। গত কয়েক দশকে পদার্থ বিজ্ঞানের নানান শাখায় বাবার সৃষ্টি কিছু ফর্মুলা আর আবিস্কার পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কয়েক ধাপ। তার পুত্র হওয়ার সুবাদে আমিও নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করি, না চাইলেও এ সুবিধা আমাকে নিতে হয়।
আমার রুমের বাইরে ডানদিক বরাবর লম্বা একটা করিডোর। এই করিডোরের শেষ মাথায় বাবার ব্যাক্তিগত ল্যাবরেটরি। গত কয়েকদিন যাবত বাবা কাজে মশগুল হয়ে আছে, ল্যাব ছেড়ে আর বেরোচ্ছে না। বাবা সময় পরিভ্রমনের উপর কাজ করছে। আমি বিস্তারিত জানিনা, বিজ্ঞান কখনোই আমার আগ্রহের বিষয় ছিলনা।
বাবার ল্যাবের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজার মাথায় সবুজ বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাবা খুব বেশি ব্যাস্ত না, যোগাযোগ করা যাবে। আমি ভয়েজ সেন্সরের বাটন চেপে বললাম, “বাবা আমি রিমন। তোমার সাথে কথা বলা যাবে এখন?”
ইন্টারকমে বাবার গমগমে আওয়াজ ভেসে এল, “অবশ্যই রিমন। ভেতরে এসো”।
স্বয়ংক্রিয় ভাবে দরজা খুলে গেল। আমি ভেতরে পা দিলাম, রোবট দুটো আর ফলো করছে না। ওদের এখানে আসার অনুমতি নেই।
বাবা বসে ছিলেন একটা কিম্ভুতকিমাকার যন্ত্রের আড়ালে। আমাকে দেখে উঠে এলেন। “কেমন আছ রিমন?”
“ভাল আছি। তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“ভালনা”। বাবাকে চিন্তিত দেখাল। “আমার ফর্মুলাতে কিছু একটা গলদ আছে, যুগান্তকারী এক আবিস্কারের দ্বারপ্রান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি”।
আমি হাসলাম।
“তুমি হাসছ রিমন? তুমি আসলে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারছ না। আমি সফল হলে বদলে যেতে পারে পৃথিবীর ইতিহাস। যেকোনো সময় আমরা অতিত অথবা ভবিষ্যতে পরিভ্রমন করতে পারব! যে টাইম মেশিনের কথা এতদিন কল্পকাহিনীতে পরেছ তা আজ বাস্তব হতে চলেছে! কি উত্তেজনাকর বিষয় একবার ভেবে দেখ!”
আমি বললাম, “আমি বুঝতে পারছি বাবা। আসলে বিজ্ঞান নিয়ে আমি খুব বেশি আগ্রহী নই তা তো জানই”।
“এটা খুব লজ্জাজনক! আমার পুত্র হয়ে তুমি বিজ্ঞান ভালবাসনা!” বাবা আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “তুমি বলেছিলে আমার সাথে কথা বলতে চাও। কি বিষয়ে?”
“আমার দুঃস্বপ্ন দেখা নিয়ে। সমস্যাটা তো যাচ্ছে না। দিন দিন বাড়ছে”।
“তোমার ব্যাক্তিগত সাইক্রিয়াটিস্ট রিগের সাথে কথা বলেছ?”
“হ্যা, তার দেওয়া নিয়মগুলো সব মেনে চলছি কিন্তু লাভ হচ্ছেনা”।
বাবা যেন আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। “বিষয়টা ভাবনায় ফেলে দিল রিমন! আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলে যোগাযোগ করে তোমার সমস্যার কথা বলব”।
“আর একটা কথা বলতে চাই বাবা”।
“কি?”
আমি খানিক ইতস্তত করে বললাম, “বলতো আমার বয়স কত?”
বাবা হাসলেন, “আমি তো তোমার বয়সের হিসেব রাখিনি। ২৮-২৯ হবে বোধহয়”।
“ত্রিশ”।
“কাছাকাছি অনুমান করেছি”। বাবার হাসিটা প্রসারিত হল।
“কিন্তু আমাকে দেখলে মনে হয়না ২৫-২৬ বছরের যুবক?”
“সেটা কোন সমস্যা না রিমন। বয়সের সাথে সাথে সবার গ্রোথ তো এক হয়না!”
“কিন্তু বাবা, আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে যখন আমার বয়স ছিল ২০ তখনো আমাকে ২৫ বছর বয়সী মনে হত!”
“সেটা হরমনজনিত কোন সমস্যা হতে পারে! আমি এ বিষয়টা নিয়েও ওদের সাথে কথা বলব”।
“কিন্তু বাবা.......”
বাবা হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল, “আমি বুঝেছি বিষয়টা রিমন। তোমার সাথে এ বিষয়ে পরে আরও কথা হবে। আমি এখন একা একা একটু কাজ করব, ফর্মুলার সমস্যাটা মনে হয় ধরতে পেরেছি। তুমি যাও”।
আমি বেরিয়ে এলাম ল্যাব থেকে। স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথে লাল বাতিটি জ্বলে উঠল। এর মানে হচ্ছে বাবা এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তার সাথে কথা বলা যাবেনা। আমি জানি এখন তিনি কি করবেন। বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধানের সাথে সরাসরি কথা বলবেন যোগাযোগ মডিউলের সাহায্যে। পকেট থেকে একটা এয়ারবাড বের করে কানে প্রবেশ করালাম। আজকের কথোপকথনটুকু আমিও শুনতে পাব। বাবা টের পায়নি, তার অলক্ষ্যে একটা ছোট্ট বাগ লাগিয়ে রেখে এসেছি ঐ অদ্ভুত যন্ত্রের গায়ে। প্রতিপদার্থের তৈরি এই বাগ, নির্দিষ্ট সময় পর নিজ থেকে মিশে যাবে যন্ত্রের গায়ে। বাবা ঘুণাক্ষরেও সেটা জানতে পাবে না।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, “মহামান্য সভাপতি আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ”।
অপর প্রান্ত থেকে কিছু বলা হল।
বাবা আবার বলল, “আমার মনে হয় আবার সময় চলে এসেছে। ওর মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে চাইছে”।
আবার নিরবতা। অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা বলা হচ্ছে।
“না, এসবে কাজ হবেনা। আমার মনে হয় চুরান্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক!”
আবার নিরবতা।
“ঠিক আছে, দ্রুত ব্যবস্থা করুন”।
কথোপকথন শেষ হয়েছে। আমি কান থেকে এয়ারবাড খুলে নিলাম। আমি আজ এমন কিছু জেনে ফেলেছি যা আমার জানার কথা নয়!
****
“রিমন, তুমি কি সুস্থ মস্তিষ্কে কথা গুলো বলছ?”
কফির কাপে চুমুক দেয়ার ফাকে দেখে নিলাম আমার বডিগার্ড রোবট দুটি মোটামোটি দূরে আছে। এইমাত্র নুবি আমাকে কেলভার মেটালের তৈরি একটা লকেট উপহার দিয়েছে। লকেট থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি নুবির দিকে তাকালাম। “হ্যা, নুবি”।
“কিন্তু এটা কিকরে সম্ভব?”
“আমি জানিনা কিভাবে সম্ভব। কিন্তু এটাই সত্যি। আমার বয়সের সাথে সাথে দৈহিক বৃদ্ধি হচ্ছেনা। তোমার সাথে আমার পরিচয় দু বছর আগে একটা বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনারে। তোমার কি মনে হয় গত দু বছরে আমার শরীরে একটুও পরিবর্তন এসেছে?”
“দু বছর খুব অল্প সময়, রিমন”।
“কিন্তু ১০ বছর অল্প নয় নুবি। ব্যাপারটা সিরিয়াস। গত দশ বছরে আমার শারীরিক বৃদ্ধি হয়নি একচুলও”।
“এটা কোন হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে”।
“ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু আর একটা বিষয় দেখানো দরকার তোমাকে”। আমি একটা চাকু হাতে তুলে নিলাম ডান হাতের তালুতে একটা পোঁচ দিলাম। সাথে সাথে গভীরভাবে কেটে রক্ত বেরিয়ে এল।
“রিমন তুমি কি করলে এটা?” আঁতকে উঠল নুবি।
“রিল্যাক্স! কিচ্ছু হবেনা”।
নুবি অবাক চোখে দেখল আমার হাতের ক্ষতচিহ্নটি আপনা থেকেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল, “মাই গড! ইউ ক্যান হিল”!!
“ইয়েস, আই ক্যান”।
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, রিমন। এটা কিভাবে সম্ভব?”
“আমি জানিনা নুবি। তবে এমন উত্তর না জানা আরও হাজারো প্রশ্ন আছে। গতকাল আমি আড়ি পেতে বাবাকে কথা বলতে শুনেছি বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধানের সাথে। বাবা বলেছেন আমি কিছু একটা সন্দেহ করছি। খুব তাড়াতাড়ি সত্য জেনে ফেলব। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে বলেছে দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে”।
নুবির চোখে উদ্বেগ, “কেন রিমন, কেন হচ্ছে এসব তোমার সাথে?”
“কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে আমার মাঝে নুবি। আমার বাবা বা বিজ্ঞান কাউন্সিল চায়না আমি সেই রহস্যের সন্ধান পাই”।
নুবি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বলে চলেছি, “তবে আমার কি মনে হয় জান? আমি সম্ভবত এই রহস্যের উত্তর জানি। অন্তত আমার অবচেতন মন জানে। সেজন্যই আমি প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। এই দুঃস্বপ্নের মাঝেই সব উত্তর লুকিয়ে আছে”।
“কিন্তু তুমি তো এই দুঃস্বপ্ন খুব বেশিদিন যাবত দেখছ না!”
“হ্যা। আমার যখন ২০ বছর বয়স তখন আমার মা মারা যায় এবং তারপর থেকেই আমার দুঃস্বপ্ন দেখার শুরু। প্রায় একই সময় থেকে আমার দৈহিক বৃদ্ধি গেছে থেমে। আমার কেন যেন মনে হয় আমার দুঃস্বপ্নগুলো আসলে কল্পনা নয়, খুব বেশি জীবন্ত। আমার স্মৃতি নিয়ে কেউ খেলছে নুবি। মনে হচ্ছে আমার যে স্মৃতি আছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। কিছু স্মৃতি ভুলে গেছি আমি”।
“সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব”।
“কিভাবে?”
“মেডিকেল সায়েন্স বিভাগ মানসিক সমস্যা গ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটা বিশেষ সিমুলেশন টেকনিক আবিস্কার করেছে। এর সাহায্যে মানুষকে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করা হয়। তুমি যদি সত্যিই কোন স্মৃতি হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এই জন্য কিছু ইকুইপমেন্ট আর খুব রেয়ার একধরনের ইঞ্জেকশন প্রয়োজন”।
“তুমি কিভাবে এগুলো যোগাড় করবে?”
নুবি ঠোঁট টিপে হাসল। “ভুলে যাচ্ছ কেন? আমি একজন জীববিজ্ঞানী, গবেষণার কাজে প্রয়োজন বলে নিজের আইডি দেখিয়ে ওগুলো যোগাড় করা খুব বেশি সমস্যা হবেনা”।
“কিন্তু ওরা যদি ধরে ফেলে তোমার এগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্য গবেষণার জন্য নয়?”
“সেটা বুঝতে ওদের অন্তত দুদিন সময় লাগবে। ততদিনে আমাদের কাজ হয়ে যাবে”।
“কিন্তু একদিন তো ওরা জানবেই, তোমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে নুবি”।
“তোমার চাইতে ক্যারিয়ার বড় নয় আমার কাছে”।
হাত বাড়িয়ে নুবির একটা হাত দুহাতের মাঝে তুলে নিলাম আমি। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। নুবি আছে বলেই তো বেঁচে আছি, ও না থাকলে এই একঘেয়ে বেঁচে থাকার আশা আমার অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে যেত।
****
আমার পায়ের নিচে পাহাড়ের চুড়ো, সম্মুখে বিশাল সাগর। আমি প্রস্তুত হচ্ছি, এক মুহূর্ত পরেই আলিঙ্গন করে নেব মৃত্যুকে। আরও একটি শেষ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হবে সকল জাগতিক যন্ত্রণার অবসান। শেষবারের মত চিরচেনা পৃথিবীকে একনজর দেখে নিয়ে আমি ঝাপ দিলাম, আপন করে নিলাম ভীষণ শূন্যতাকে। পতনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সামুদ্রিক বাতাস কানের দুপাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে “আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তোমার মুক্তি”।
যেন একযুগ পরে আমার দেহ লবণাক্ত পানির স্পর্শ পেল। কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা! শরীরে কাপন ধরে যাওয়ার এক তীব্র অনুভূতি। আমি হারিয়ে যাচ্ছি অতলে, গভীর থেকে গভীরে। প্রশ্বাসের সাথে বুক ভরে যাচ্ছে লোনা পানিতে। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, পুরে যাচ্ছে অক্সিজেনের অভাবে। মুক্তি এত কঠিন কেন?
কোথায় সমুদ্র? এতো দেখছি ব্যাস্ততম এক সড়ক। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করছি? গায়ের পাশ ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে দূরপাল্লার ভারী যানবাহন। নাহ, ওরা যানবাহন কেন হতে যাবে? ওরা আমার মুক্তির দূত। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা যাত্রীবাহী বাস। আমার মুক্তির পয়গাম নিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে। আমি দু হাত প্রাসারিত করে করে চেয়ে আছি সেই বিশাল মুক্তিকে গ্রহন করার জন্য।
একমুহূর্ত বাদেই লক্ষ করলাম জাহাজের নির্জন ডেকে বসে সমুদ্রের ঢেউ অবলোকন করছি। মৃদু ঢেউয়ের ধাক্কায় দোদুল্যমান অনুভূতি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র ডাকছে আমায়, কোন অপ্রতুল মাদকের প্রতি আসক্ত ভবঘুরের মত আমি এগিয়ে গেলাম ডেকের কিনারে। ঝাপ দেব বলে প্রস্তুত, আরও একবার মুক্তির দ্বারপ্রান্তে আমি। দেহটা পানি স্পর্শ করতেই আবার সেই তীব্র অনুভূতি! এই অনুভূতি আমার অনেক দিনের চেনা। মুক্তির নেশায় আসক্ত ক্রীতদাসের প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনছি সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে।
কিন্তু এটা কি হচ্ছে? আমার প্রসারিত দুহাতে অস্ত্র কেন? আর কোথায় গেল ব্যাস্ত সড়ক? এতো এক যুদ্ধের ময়দান। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। আমি অনবরত গুলি করে চলেছি আর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি সম্মুখে শত্রুর অবস্থান বরাবর। আমার মনে ভয় ডর বলে কিছু নেই। আমি স্বাধীনতার নেশায় বুঁদ। হঠাৎ বুকে ভারী বুলেটের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। সমস্ত দম বেরিয়ে গেছে বুক থেকে। বার কয়েক কেশে উঠলাম। তবে কি এই আমার মুক্তি?
নাহ! ওটা মুক্তির নামে ছিল প্রহসন। নইলে আমি এখন একটা চলন্ত মহাকাশযানে কেন? ওজনের তারতম্যের ঝক্কি সামলে মহাকাশযানটির হ্যাচ বরাবর দাঁড়িয়ে যেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলনা। হ্যাচ ধরে টান দিতেই সম্মুখে দেখলাম বিশাল শুন্যতা। এই শূন্যতার ভিড়ে কোথাও হারিয়ে যাব আমি আজ। নাহয় এটাই হোক আমার মুক্তির নামান্তর। বিশাল শূন্যতাকে গ্রহন করে নিলাম অনায়াসেই। শরীরের ওপর আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই, ভেসে চলেছি অজানার উদ্দেশ্যে। অনেক দূরে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে যাচ্ছে। তার উজ্জ্বল আভা যেন প্রশ্ন করে চলেছে “তুমি মুক্তি চাও নাকি মৃত্যু চাও”। এই প্রশ্ন আমাকে করা অবান্তর। আমার কাছে মুক্তি বা মৃত্যু ভিন্ন কিছু নয়।
ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। নক্ষত্রের অবয়বটি ক্রমশ কোন মানব মূর্তির আঁকার ধারন করছে। এই মুখশ্রী আমার অনেক দিনের চেনা, অনেক বেশি আপন। এটা নুবি, আমার নুবি। নক্ষত্র মিলিয়ে গিয়ে সেখানে নুবির মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার চোখ দুটো আমাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে, “তুমি কি মুক্তি চাও, তুমি কি মৃত্যু চাও?”
“না, নুবি আমি মৃত্যু চাই না। অন্তত তুমি যতক্ষণ পাশে আছ ততক্ষন নয়! আমার মুক্তি তোমার মাঝে, মৃত্যু আমার মুক্তি নয়”।
“কি আবল তাবল বলছ তুমি, রিমন?”
নুবির কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। আমি শুয়ে আছি বিছানায়। মাথা হাত বুক ও শরীরের অন্যান্য অংশে নানান ইকুইপমেন্টের সংযোগ। আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। নুবি বাধা দিল “আস্তে! ওষুধের প্রভাব কাটতে কিছুক্ষন সময় লাগবে”। সে ব্যাস্ত হাতে আমার শরীর থেকে ইকুইপমেন্টগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় মনযোগী হল। বলল, “কি কিছু উপকার হল”।
“হ্যা”। আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কি জানতে পারলে?”
“বিজ্ঞানী ইরিদ আমার বাবা নন। আমার ২০ বছর বয়সে আমার মা মারা যাননি। সমস্ত স্মৃতি মিথ্যে। আমার মাথায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের অসংখ্য স্মৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যার পুরোটাই মিথ্যে”।
“তাহলে সত্যি কি?”
“আমার জন্ম দেড় হাজার বছর পূর্বের পৃথিবীতে। আমার আসল বাবা ছিলেন কৃষক। আমার বাবা মার মৃত্যু হয়েছে আমার সামনে। তখন আমি ২৫ বছরের যুবক। এর পর আরও অসংখ্য পরিবারের সাথে থেকেছি আমি, সবাই বুড়ো হয়ে একসময় মরে গেছে কিন্তু আমি মরিনি, আমি মরিনা, আমার বয়স বাড়েনা। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তির নেশায় আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি। অসংখ্যবার চেষ্টা করেছি মরে যেতে। পানিতে ডুবেছি, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছি, পাহারের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, গুলি খেয়েছি- কিন্তু আমি মরতে পারিনি, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে”।
নুবিকে একটুও বিচলিত মনে হচ্ছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার নুবি? তুমি অবাক হচ্ছনা একথা শুনে?”
“না, আমি পুরো বিষয়টা আন্দাজ করতে পারছিলাম”।
“কিভাবে?”
“এখানে আসার আগে আমি আমাদের বিজ্ঞান কাউন্সিলে ডাটাবেজে খোঁজ নিয়েছি। তুমি তো জানই বিজ্ঞান কাউন্সিলের ডাটাবেজে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সম্পর্কে তথ্য রাখা আছে। তোমারটাও আছে। একজন সদস্য হিসেবে সে তথ্য জানার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমাকে সেই তথ্য জানতে দেওয়া হচ্ছেনা। বলা হচ্ছে তুমি সম্পর্কে সকল তথ্য ক্লাসিফাইড। শুধুমাত্র প্রধান বিজ্ঞানী সভার সদস্য না হলে এই তথ্য জানা যাবেনা। তারপর আমি একজন প্রধান বিজ্ঞানী সভার সদস্যের পাস চুরি করে তথ্যটুকু বের করে এনেছি। সেখানে শুধু দুটো বাক্য বলা তোমার সম্পর্কে বলা আছে, ১. তুমি একজন অমর মানুষ ২. বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হল তোমাকে রক্ষা করা। এর চেয়ে বেশি তথ্য জানার অধিকার একমাত্র বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধান ছাড়া কারো নেই”।
“তুমি এত বড় ঝুকি নিয়েছ কেন?”
“তোমার জন্য রিমন... আমি যেকোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবনা”।
“কিন্তু এখন কি হবে? ধরা পরলে ওরা তো আমাদের কঠিন শাস্তি দিবে!”
“আমরা পালিয়ে যাব, তুমি প্রস্তুত থেক। কেউ কিছু জানার আগেই আজ রাতে পালাব আমরা”। নুবির চোখে মুখে দৃঢ়তা।
“কিন্তু প্রতিরক্ষা রোবটগুলো আমাদের ঠিকই ধরে আনবে। ওরা ওদের ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে যেকোনো জিনিসের সন্ধান পেয়ে যায়। পৃথিবীর কোন প্রান্তই আমাদের জন্য নিরাপদ নয়”।
“সেটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও”। নুবির ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস। “ তুমি তো জানই প্রতিটি প্রতিরক্ষা রোবট ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা একটি অন্যটির সাথে কানেক্টেড। আমি ওদের ফ্রিকোয়েন্সিতে একটা ভাইরাস আপলোড করে দিয়েছি। ওদের পক্ষে এখন আর তোমাকে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব নয়। আমরা পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের কোন বিরান অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে পরিচয় গোপন করে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারব।”
আমি নুবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি আমার পাশে থাকবে তো?”
নুবি হাসল। “কথাটা উলটো করে বললে ভাল হবে রিমন। তোমার নয়, আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমার পাশে থাকব”।
আমিও হাসলাম। নুবির কথাই ঠিক। আমাদের সংসার হবে, সন্তান হবে, ভালবাসার মেয়েটি ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যাবে, একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু আমি থাকব একই রকম। তাতে কি? একটা জীবন এই মেয়েটির সাথে পার করে দিতে পারলে আমার আর কিছুই না পাওয়া থাকবেনা। এই মৃত্যুহীন অস্তিত্ব নিয়ে সারাজীবন আমার যে আক্ষেপ ছিল তা এক পলকেই দূর হয়ে গেল। নিজের এই বেঁচে থাকাটা সার্থক হয়েছে নুবির জন্য। দেড় হাজার বছর পর জীবনে এসেছে সত্যিকারের ভালবাসা ।
নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর আমরা তখনও জানতাম না যে পালানোর সুযোগ আমাদের হবেনা। ইতিমধ্যে নুবির পাসওয়ার্ড চুরি আর ইলিগাল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইস্যু করার খবর জানাজানি হয়ে গেছে। একটু পরেই কিছু প্রতিরক্ষা রোবট আসবে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক দিয়ে ওরা আমাদের অজ্ঞান করে দেবে।
***
বার কয়েক চোখ মিট মিট করতেই চোখের সামনে পৃথিবীটা পরিষ্কার হয়ে এল। এই যায়গা আমার অনেক দিনের পরিচিত। এটা বাবার ল্যাব। আমি বসে আছি একটা চেয়ারে। হাত-পা চেয়ারের সাথে শক্ত ইলাস্টিক রোপ দিয়ে বাধা। সামনেই বসে আছে বাবা। তার চোখে মুখে কৌতূহল। নুবিকে কোথাও দেখছি না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নুবি কোথায়?”
বাবা হাসল, “নুবি ফিরে গেছে তার আপন ভুবনে, তার কর্মক্ষেত্রে”।
“নুবি আমাকে ফেলে কাজে ফিরে গেছে! এটা অসম্ভব”।
“সম্ভব, কারন ও এখন আর তোমাকে চেনেনা। নুবির মস্তিস্ক থেকে তোমার সকল স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়েছে।
তীব্র এক হতাশার অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই ভাবতে পারলাম না। তারপর আস্তে ধীরে বললাম, “আমাকে বাদ রাখা হল কেন? আমাকেও সব কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছ না কেন তোমরা?”
“হুম.. বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। তোমার সমস্ত স্মৃতি মুছে দিয়ে নতুন স্মৃতি প্রবেশ করান হবে, দেওয়া হবে নতুন পরিচয়। এখনও কাজটা করা হয়নি আমার অনুরোধে। আমি চাইছিলাম সব কিছু ভুলে যাওয়ার আগে তুমি সবটুকু জেনে নাও”।
“সর্বমোট কতবার আমাকে এভাবে স্মৃতি ভুলিয়ে নতুন স্মৃতি দেওয়া হয়েছে?”
“আমার অধীনে মোট তিন বার তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে। এর আগে আমার শিক্ষকের অধীনে ছিলে তুমি। আমার পরে অন্য কারো অধীনে নেওয়া হবে। প্রতিবার ঠিক ১০ থেকে ১২ বছরের মাথায় তুমি নিজ সম্পর্কে সবটুকু জেনে যাও। আর জানার পর পরই খুব ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠো, আত্মঘাতী কাজ কর, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা কর। তাই তোমার কাছ থেকে তোমাকে রক্ষা করতেই প্রতি ১০ বছর পর পর তোমার স্মৃতি রিবুট করতে হয়”।
“কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? আমার বয়স বাড়েনা কেন? আমি অমর হলাম কিকরে?” একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
“এই সব প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই। তোমার সম্পর্কে সব তথ্য জানার অধিকার একমাত্র বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধান ছাড়া আর কারো নেই। অনুমান নির্ভর হয়ে বলতে পাড়ি, সম্ভবত তুমি গোপন কোন প্রজেক্টের অংশ, কিন্তু এই প্রজেক্টের কি উদ্দেশ্য তা আমি জানিনা”।
আমি চুপ করে থাকলাম।
বাবা প্রশ্ন করলেন, “আর কিছু জানতে চাও তুমি?”
“না”
“ব্যাস! প্রতিবার তো তুমি অসংখ্য প্রশ্ন কর। এইবার আর কিছু জানতে চাইছ না কেন?”
“যত দ্রুত সম্ভব আমাকে আমার স্মৃতি ভুলিয়ে দাও”। নুবির কথা মনে হচ্ছে বার বার। নুবিহীন বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে।
“একটু অপেক্ষা কর। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে সরঞ্জাম এলেই ব্যবস্থা নেব”।
আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। বাবা উঠে ল্যাবের অপর প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল তার সেই কিম্ভূতকিমাকার টাইম মেশিনের কাছে। ঝুঁকে পরে কাজ শুরু করল।
কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। আমার তন্দ্রামত এসছিল, হঠাৎ মাথার অভ্যন্তরে তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। “রিমন!! রিমন!!”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “কে? কে ডাকে?”
আমার মাথার ভেতরে থেকে উত্তর এল, “আমরা”।
“কোথথেকে কথা বলছ তোমরা?”
“আমরা কথা বলছি অনেক ভবিষ্যতের এক পৃথিবী থেকে। এ এমন এক পৃথিবী যেখানে সব কিছুই আছে, শুধু মানুষ বলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। সমস্ত মানবজাতি হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে”।
বিষয়টা আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, এটা কোন কল্পনা নয়ত? আমি কোন স্বপ্ন দেখহি না তো? জিজ্ঞেস করলাম, “কারা তোমরা?”
“আমাদেরকে বোঝার সাধ্য তোমার নেই রিমন। আমরা মানবজাতির হিতাকাঙ্খি। আমরাই তোমাকে এতদিন বাচিয়ে রেখেছি। প্রতিবার মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার পর আমরা তোমাকে ফিরিয়ে আনি। আমরাই তোমার জিনে খুব সুক্ষ কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে বয়সটা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে আঁটকে রেখেছি”।
“কিন্তু কেন করেছ তোমরা এটা?” আমি অস্থির কণ্ঠে বললাম।
“মানবজাতিকে রক্ষার করার জন্য, রিমন। মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার হাতে। তুমিই শুধু পার মানবজাতিকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে”।
“আমি কীভাবে মানবজাতিকে রক্ষা করব?” এতক্ষনে আমি একটু ধাতস্থ হতে পেরেছি।
“বিজ্ঞানী ইরিদ, যাকে তুমি বাবা বলে ডাক সে আর কিছুক্ষন বাদেই তার টাইম মেশিন তৈরির কাজে সফল হবে। তার আগেই তোমাকে যন্ত্রটা ধ্বংস করে দিতে হবে রিমন। তাহলেই মানুষ রক্ষা পাবে”।
“আমি কিছু বুঝতে পারছিনা”। অসহায় কণ্ঠে বললাম আমি।
“রিমন, মানবজাতীকে সময় পরিভ্রমনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কারন এই ক্ষমতা তোমাদের টাইম লাইন ভেদে সাহায্য করবে। তোমরা নিজেদের খেয়াল খুশি মত অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ পালটে দিয়ে গিয়ে সৃষ্টি করবে একটা বিশাল টাইম প্যারাডক্স। তাতে সমগ্র মানবজাতি হারিয়ে যাবে এক মহাজাগতিক গহ্বরে। পৃথিবী থেকে বিলিন হয়ে যাবে একটি বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব”।
“কিন্তু তোমরা আমাকেই কেন বেছে নিলে? আর কেউ নয় কেন?”
“কারন তুমি হচ্ছ জেনেটিকেলি পারফেক্ট একজন মানুষ। তুমি যে যুগ থেকে এসেছ তার পরবর্তী সময় থেকেই মানুষ জেনেটিকাল পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের স্বাভাবিক চিন্তা ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা প্রযুক্তির দাস হয়ে গেছে, এরা কখনোই আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কাররুপে বুঝতে পারবেনা। সময় পরিভ্রমনের সুযোগ কেউ নষ্ট করতে চাইবেনা। কিন্তু তুম দেখে এসেছ প্রযুক্তি শুধু উপকার করে তা নয়, কখনো কখনো বিশাল ধ্বংস ডেকে আনে”।
“একজন মানুষকে কেন বেছে নিতে হল? তোমরা যখন মানবজাতির হিতাকাঙ্খি, তাহলে নিজেরাই কেন বাবার যন্ত্রটা ধ্বংস করে দিচ্ছনা?”
“আমরা একটা সিমুলেশন প্রসেস সৃষ্টি করতে পারি। সেই সিমুলেশন প্রসেসে চাইলে এক বা একাধিক নতুন প্রান জুড়ে দেওয়া যায় কিন্তু একটা ঘটে যাওয়া ঘটনা পরিবর্তন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। ঘটনাটা যারা ঘটিয়েছে, তাদেরকেই সেটা পরিবর্তন করতে হবে। তাই তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এ কাজের জন্য”।
“আমাকে কি করতে হবে?”
“ভালকরে তাকিয়ে দেখ, বিজ্ঞানী ইরিদের তৈরি যন্ত্রের সাথে একটা ক্যাপসুল রয়েছে একজন মানুষ প্রবেশ করার মত। তার পাশেই দন্ডায়মান কাচে ঘেরা মোচক আকৃতির জারের ভেতর বেশ কিছু কেমিকেল ভর্তি টেস্ট টিউব রাখা আছে। তুমি শুধু এই টেস্ট টিউবগুলো ভেঙে দিলেই চলবে। এতে যে পরিমান ক্ষতি হবে তাতে বিজ্ঞানী ইরিদ তার জীবদ্দশায় আর সময় পরিভ্রমনের যন্ত্র তৈরি করতে পারবেনা। মানবজাতি রক্ষা প্পাবে সম্ভাব্য ধংসের হাত থেকে”।
কিন্তু আমি বাধন থেকে মুক্ত হব কীভাবে? ভাবতে ভাবত
Published on September 16, 2013 22:08
September 6, 2013
এবার আমার পালা
ভুলটা আসলে আমারই। আরও ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল। অল্প বয়সে মা হারানো ছেলেটা সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে দেখে ভাবলাম কোন একটা কাজে তাকে ইনভল্ভড রাখতে পারলে খারাপ হয় না! অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মায়ের অভাববোধটুকু ভুলে থাকতে পারবে।
নিষাদের মা অর্থাৎ আমার স্ত্রী নিলুফার মারা গেছে একটা দুর্ঘটনায়। অদ্ভুত সে দুর্ঘটনা! আমাদের বাড়ির ছাদটা বর্ষাকালে শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে থাকে। ছাদের রেলিং এর একটা অংশ ভাঙা। কতবার নিলুফারকে বলেছি, ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়ার সময় সাবধান থাকবে। কিন্তু সাবধান নিলুফার হয়নি, তারই প্রমান দিয়েছে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে।
নিষাদকে অন্য কি কাজে ব্যস্ত রাখা যায় ভাবতে ভাবতে প্রথমেই মাথায় এল ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার প্রশিক্ষন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। কিন্তু ছেলের খেলাধুলার প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ নেই। আর মায়ের মৃত্যুর পর তো সেটা আরও কমেছে। ভেবে ভেবে ঠিক করলাম ছেলেকে মুভি দেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। কিন্তু সে কেমন মুভি দেখতে পছন্দ করবে?
নিষাদের বয়স তখন ১২, বয়ঃসন্ধিকাল দোরগোড়ায়। এ বয়সী একটা ছেলের কি ধরনের মুভি দেখতে ভাল লাগবে? ঠিক করলাম বেশি বেশি এনিমেটেড মুভি দেখাব তাকে।
কিন্তু অফিস কলিগ সানাউল্লাহ ভাই বললেন, “আপনার ছেলেকে হরর মুভি দেখান হাসান ভাই। এ বয়সী বাচ্চাদের ভূত প্রেত টাইপের মুভি দেখতে বেশি লাগে” সানাউলাহ ভাই আমাকে একটা হিন্দি হরর মুভির নাম সাজেস্ট করে দিলেন। মুভির নামঃ ছায়া। হিট করা মুভি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই ছেলে মুভিটা পছন্দ করবে তো? প্রথম মুভিই যদি ভাল না লাগে তাহলে হয়ত আর দেখতে নাও চাইতে পারে”।
সানা ভাই বললেন বললেন, “সেইটা মাথায় রেখেই তো বলতেছি। দেখান নিয়ে গিয়ে। দেখবেন, ছেলে আপনার হরর মুভির ভক্ত হয়ে যাবে”।
আমার বাড়ির কাছেই একটা ডিভিডি স্টোর আছে। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু ঢু মারলাম। দোকানের নামটাও ভারী অদ্ভুত। স্ক্র্যাচ ভিডিও সেন্টার। আমরা সাধারণত ডিভিডি বা সিডি ক্যাসেটে দাগ পড়ে গেলে বলি স্ক্র্যাচ পড়েছে। কিন্তু ডিভিডির দোকানের নাম স্ক্র্যাচ হবে কেন? এই দোকানের সব সিডি নিশ্চয়ই স্ক্যাচ পড়া নয়! নামের ব্যাক গ্রাউন্ড স্টোরিটা জানা দরকার, একদিন দোকানের মালিকের সাথে কথা বলতে হবে।
আমি ছবির নাম বলার পর এক কর্মচারী মুভিটা খুজে দিল। অবশ্য খুজে পেতে একটু সময় লাগল। ২০০৩ সালের মুভি, মোটামুটি পুরনো বলা যায়। ইয়াং জেনারেশন নতুনের পূজারী, পুরাতন নিয়ে মেতে থাকার সময় কই ওদের?
ডিভিডি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। নিষাদের রুমে উকি দিয়ে দেখি নিষাদ গালে হাত দিয়ে তার পড়ার টেবিলে বসে আছে। সামনে বই খোলা। তবে যে কেউ দেখেই বলতে পারবে তার মানসিক অবস্থান এখন অন্য জগতে, বইয়ের ভেতর নয়। আমি ডাকলাম, "নিষাদ"।
নিষাদ জবাব দিলনা। আমার দিকে তাকাল না। তবে এর মানে এই নয় যে সে আমার ডাক শুনতে পায়নি। আমার ধারনা দুই তিন বার ডাকার আগে সে ইচ্ছে করেই জবাব দেয়না। আরেক বার ডাকলাম, "নিষাদ"!
এবার উত্তর দিলনা, কিন্তু আমার দিকে ঘুরে তাকাল।
আমি মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম, "তোমার জন্য আমি একটা হরর মুভি এনেছি নিষাদ' আজ থেকে আমরা একসাথে বসে মুভি দেখব।
নিষাদ নির্বিকার। সে হালকা করে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার বইয়ের দিকে নজর দিল।
রাতে খাওয়ার পর দুজনে বসে গেলাম ড্রয়িং রুমে ডিভিডি প্লেয়ার এর সামনে। মুভির শুরুর ১০ মিনিট না যেতেই নায়ক জন আব্রাহাম আর নায়িকা তারা শর্মার উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়ে গেল। বাবা-ছেলে একসাথে বসে দেখার মোটেও উপযোগী নয়। সানাউল্লাহ ভাইয়ের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? তিনি এই মুভি দেখতে রিকমেন্ড করলেন কী করে? অবশ্য আরও মিনিট দশেক পর মুভির ক্লাইমেক্স শুরু হতেই মজা পাওয়া শুরু করলাম।
একটা গ্রামে মানুষ কোন একটা রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের সাহায্য করার কেউ নেই। নায়িকা তারা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও গেল সেখানে। এবং দুদিন বাদের নায়ক খবর পেল নায়িকা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এইবার আমি কিছুটা আঁচ করতে পারলাম কেন সানাভাই আমাকে বলেছেন এই মুভিটা দেখতে বলেছেন!
এর পরের ঘটনা গুলো রীতিমত গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়ার মত। নায়িকা তারা শর্মা এখন তার স্বামীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। নায়ক জন আব্রাহাম একজন ডাক্তার। নায়িকা হাসপাতালের মৃতপ্রায় রোগীদের শরীরে প্রবেশ করে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।
মুভিটা খুব একটা ভাল লাগেনি আমার কাছে, নিষাদের কাছেও লাগেনি। কিন্তু দেখলাম নিষাদ হরর বিষয়টা বেশ ফিল করতে শুরু করেছে।
পরদিন যখন আমি "নায়না' নামে আর একটা হরর মুভি নিয়ে হাজির হলাম দেখলাম নিষাদের চেহারা অনুভূতিহীন হলেও চোখদুটো চক চক করে উঠেছে। বুঝলাম কাজ হয়েছে! এভাবে ভূত, ১৯২০, ডরনা মানা হ্যায় সহ বেশ কিছু হরর হিন্দি মুভি দেখা হয়ে গেল। এবার শুরু করলাম ইংলিশ মুভি দেখা। একসময় ঝুকে পড়লাম ফ্রেঞ্চ মুভির প্রতি। ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা দুজনের জন্যই নেশায় পরিনত হল।
কোনদিন একটা হরর মুভি দেখা না হলে দুজনেরই আর ঘুম আসে না। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি এই হরর মুভি দেখার অভ্যাসটা আমার জন্য মানসিক বিপর্যয়ের বীজ হয়ে দাঁড়াবে।
***
৩ বছর পর একদিন...
গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছিল অফিসে, ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিজে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছি আজ। ড্রাইভারটা ছুটি নিয়েছে কিছুদিনের জন্য। ভাবছি ব্যাটাকে ছাঁটাই করে দেব। দুদিন পর পর এই সমস্যা- সেই সমস্যার কথা বলে ছুটি নেয়। বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়ার কোন অর্থ হয় না।
আজ আমি আর নিষাদ "হাই টেনশন' নামের একটা ফ্রেঞ্চ মুভি দেখব। এটাও যথারীতি কলিগ সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাজেশন। মুভিতে কিছু যায়গায় অতিরিক্ত ভায়োলেন্স আছে। নিষাদের ভাল না লাগলে টেনে দিতে বলেছেন উনি। আমি মনে মনে হাসলাম। নিষাদের ভায়োলেন্স দেখার ক্ষমতা সম্পর্কে সানাউল্লাহ ভাইয়ের কোন ধারনাই নেই। জম্বি মুভিগুলোতে হাড় মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমি যখন ভয়ে শিউরে উঠি, তখন দেখি নিষাদ আশ্চর্য এক কৌতূহল নিয়ে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
স্ক্র্যাচ ভিডিও সেন্টার এর সামনে গাড়ি থামিয়ে হাই টেনশনের একটা ডিভিডি কিনে নিলাম। ভিডিও সেন্টারের ঠিক পাশ দিয়েই একটা সরু রাস্তা আছে। ডিভিডি হাতে এসে গাড়িতে উঠতে যাব তখন রাস্তার দিকে নজর গেল। একটা মেয়েকে দেখছি সরু রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজ। কে ওটা? মমতা না?
মমতা আমার বাড়ির সামনের বাড়িতে থাকে। সম্ভবত অনার্স পড়ছে মেয়েটা, নিলুফারের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। নিলুফারের ছাঁদ থেকে পরে যাওয়ার দৃশ্যটা সে দেখে ফেলেছিল। সেই থেকে একটা মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে। অ্যাবনরমাল আচার আচরন করছে।
কিন্তু মেয়েটি ওদিকে কোথায় যাচ্ছে? এদিকটাতে মানুষজন যায় কম। পরিত্যক্ত নিচু এলাকা, বর্ষা এলেই পানি ওঠে, তেমন কোন বসতিও নেই। একটা বড় জলাশয় আর পুরনো একটা কবরস্থান আছে। আজেবাজে নেশাখোর ছেলেপিলে সব আড্ডা দেয়। মমতাকে পেলে ওরা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে খাবে। আমি পা বাড়ালাম। মেয়েটিকে থামান দরকার!
মমতা হাটার গতি বাড়িয়ে দিল। আমি দু তিন বার নাম ধরে ডাকলাম। সে ফিরে তাকাচ্ছে না। সামনেই একটা ডোবা, মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পরে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে না তো? আমি আরও দ্রুত পা চালালাম। মমতা হঠাৎ দৌড় লাগাল। আমি বুঝতে পারছিনা কী করা উচিত। রাত হয়ে যাচ্ছে, এদিকে মানুষের চলাচল একেবারেই কম। মনে হচ্ছে আজ নেশাখোর ছেলেগুলোও আড্ডা দিচ্ছেনা। মেয়েটিকে এভাবে এখানে ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? মমতার আকর্ষণীয় ফিগার ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। চকিতে একটা সম্ভাবনা খেলে গেল মাথায়। বিরান এলাকা, কাছে ধারে কেউ নেই। মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন, কিছু একটা ঘটে গেলে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবেনা। আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আবিস্কার করলাম, পশুর শক্তি। প্রতিটি পুরুষের মাঝে একটা পশুর বাস, আমার ভেতরের পশুটা জেগে উঠেছে। আমিও দৌড় লাগালাম মমতার পেছন পেছন।
মেঘের আড়ালে চাঁদ হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জোনাকীরা সব এক সাথে জ্বলে উঠে পৃথিবীকে আলোকিত করার বৃথা প্রয়াস চালাচ্ছে । দূর থেকে ভেসে আসা নৈঃশব্দ্য রজনীর নিঃসঙ্গতার করুণ বিলাপ মনে ভয় ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। তবুও মমতার পেছনে পেছনে আমি এমন ভাবে দৌড়াচ্ছি, যেন আবেগহীন, অনুভূতিহীন পাথরের এক মূর্তি। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি? কেন মমতা একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না? ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই আমার মনে জাগছে না! দৌড়ে চলেছি দ্বিধাহীন চিত্তে অজানার উদ্দেশ্যে। আমাকে এক নেশায় পেয়ে বসেছে, অন্যরকম নেশা।
মমতা হঠাৎ দাঁড়াল। তার ঠিক দুই কদম পেছনে আমিও থমকে দাড়ালাম। ভাসমান কালো মেঘের ফাঁক গলে একটু আধটু জ্যোৎস্না গলে পড়ছিল। সেই আলোয় দেখলাম আমরা পুরনো কবর স্থানে এসে পরেছি। কবরস্থানের পাশেই একটা ছোট বাঁশঝাড়। বাঁশগাছগুলোর ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে উঠছে। অনেকদিন পর দৌড়েছি, হাঁপাচ্ছি কুকুরের মত।
মেঘ ফুঁড়ে হঠাৎ চাঁদটা বেরিয়ে এল। পাতলা কামিজ পড়েছে মমতা, বুকের ওড়নাটা দৌড়ানোর সময় গায়েব হয়েছে। চাঁদের আলোয় মেয়েটির অপরুপ দেহসৌষ্ঠব সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। আমার শরীর শিহরিত হল । মনে হচ্ছে অপার্থিব কোন এক অনুভূতি শক্তি জমা হচ্ছে আমার মাঝে! ভেতরে ভেতরে ক্ষীণ কম্পন শুরু হয়েছে। হঠাৎ মমতা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ঠোঁট টিপে হাসছে। ওকি আহবানের হাসি? আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। ঝাঁপিয়ে পরলাম ওর উপর। মমতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে।
পিঠের নিচে আলগা মাটির মত লাগছে। সেদিকে তখন খেয়াল করার মত ধৈর্য আমার নেই। দুহাত চলে গেছে প্রয়োজনের খোঁজে, নাকে মুখে গোগ্রাসে গ্রহন করছি নারীমাংসের স্বাদ। মাতালের খেলায় মত্ত আমি। মমতা বাধা দিচ্ছেনা মোটেও। বিকারগ্রস্ত একটা মেয়ে জানেনা এই খেলার পরিনাম। হঠাৎ পিঠের কাছে নরম কিছু একটার স্পর্শ পেয়ে থমকে গেলাম আমি। মনে হচ্ছে মানুষের হাত, কি ভীষণ ঠাণ্ডা! পিঠের নিচে কি কবর ফুঁড়ে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে নাকি! ভয়ের একটা অনুভূতি নামল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমি মমতাকে ছেড়ে উঠে বসলাম।
কোথায় হাত? আমার মনের ভুল হবে হয়ত। অবশ্য কাছাকাছি একটা নতুন ঝকঝকে একটি কবর দেখতে পারছি! একেবারেই নতুন কবর! মনে হচ্ছে কয়েক দিন আগেই কাউকে দাফন করা হয়েছে আমি যতদূর জানি এদিকটাতে এখন আর কাউকে কবর দেওয়া হয়না। তাহলে এটা কার কবর? আরও সামনে তাকাতেই দেখলাম ছোট একটা গর্ত। কবরে কেউ গর্ত করে রেখেছে! গর্তের কাছে গিয়ে উকি দিতেই দেখলাম দুটো কুকুর কিছু একটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে । মানুষের পা-এর মতো লাগছে! সেই পা থেকে মাংস ছিড়ে মজা করে চিবোচ্ছে লাশ খেকো কুকুরদুটো।
এমন সময় প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল–সেই আলোয় দেখলাম কবরের অন্ধকারে এক সুন্দরী নারী শায়িত, তার গালদুটি সুডৌল, ঠোঁটদুটি লাল! নিলুফার! তাকিয়ে আছে আমার দিকেই! তার চোখ দুটোতে কষ্ট! আচমকা মৃত নিলুফার যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল!
আমি আতংকে শিউড়ে উঠে দু পা পিছিয়ে এলাম! হঠাৎ বাতাস ছাড়াই কবরের পাশের বাশের ঝোপটি এলোমেলোভাবে দুলতে শুরু করল! ভয়ে আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে । ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্বস্তি! মমতার দিকে ফিরে তাকালাম। কী আশ্চার্য! মমতা কোথাও নেই! সে যেখানে দাড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে একটি কুৎসিত দর্শন কুকুর দাড়িয়ে আছে । আদমখোর সেই কুকুর বড় বড় চোখে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! কুকুরটাকে আগে কখনো না দেখলেও তার ভয়ংকর চোখ দুটো আমার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে । ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে । আমি ঝেড়ে দৌড় দিলাম । কুকুরটিও আমার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে ! আমি সর্ব শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি অথচ কেন যেন মনে হচ্ছে একচুলও এগুতে পারছি না।
হঠাৎ আমার কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল! চমকে দেখি আমার পাশে নিষাদ দৌড়াচ্ছে! নিষাদ এখানে এল কেমন করে?
“আমাকে বাঁচাও নিষাদ” আমি অনুনয় করলাম ছেলের কাছে।
নিষাদ কিছু বলছে না। ভালভাবে খেয়াল করতেই দেখলাম আসলে এটা নিষাদ নয়! নিষাদের শরীর কিন্তু মুখটা দেখতে কুকুরের মত। নিষাদরুপী একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে! কুকুরটা আমার কাধ ধরে ঝাঁকাল, “কি হয়েছে ড্যাড!”
আমি প্রানপনে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। নিষাদ আবার জিজ্ঞেস করল, “ড্যাড, কি হয়েছে? এমন করছ কেন?”
আমার ঘোর কেটে গেল। নিজেকে আবিস্কার করলাম ড্রয়িংরুমে, টিভি স্ক্রিনের সামনে। সিনেমা চলছে "হাই টেনশন', একটা খুব ভায়লেন্সের দৃশ্য দেখাচ্ছে!
একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “কি হয়েছিল আমার?”
“তুমি সিনেমা দেখতে দেখতে হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরন শুরু করেছিলে! উল্টা পাল্টা বকছিলে!” নিষাদ বলল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে আসলাম। শরীরটা ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। ডাক্তার দেখানো দরকার। আর হরর মুভি দেখাও বন্ধ করতে হবে। মনের উপর খুব বেশি চাপ ফেলছে!
বেডে শুয়ে খেয়াল করলাম নিষাদ এসে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ভঙ্গীটা আমার খুব পরিচিত। এটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সে। এর মানে হচ্ছে নিষাদ কিছু একটা বলতে চায়, অনুমতি দরকার!
অনুমতি দিলাম, “কি বলবে বল, নিষাদ!”
“আমি একটা কবিতা লিখেছি ড্যাড। ইংলিশ পোয়েম”।
আমি হাসলাম। আমিও স্টুডেন্ট লাইফে ভাল ইংরেজি কবিতা লিখতাম। এই প্রতিভা নিষাদ জেনেটিকেলি পেয়েছে। বললাম, “তুমি পড়ে শোনাবে নাকি আমি পড়ব?”
“আমিই পড়ে শুনাই?”
“শুনাও!”
নিষাদ শুরু করল...
My Mother seems so far away from me,
On that beautiful white shore across the sea.
Yet I remember love’s soft glow upon her face,
And the feel of her touch and tender embrace.
When I am weary from the burdens I’ve borne,
And the path is unclear and I feel so forlorn,
I remember her loving support was always near,
And her advice made the path ahead seem clear.
When I feel there is no one who seems to care,
Or when the heartache seems too hard to bear,
I remember how she always stood by my side,
And would tenderly wipe away the tears I cried.
When there are moments of great joy and pride,
And I wish my Mother was standing at my side,
I remember she saw more than I thought I could be,
And know I owe my triumphs to her belief in me.
When I reminisce about the things she used to say,
And I miss her and think she is so far away,
I remember what she gave lives on through me,
And one day I’ll see her on the shore across the sea.
কবিতা শেষ করে নিষাদ আর দাঁড়াল না। ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এই কবিতা কেন লিখেছ তুমি?”
নিষাদ জবাব দিলনা। রুমের দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল।
জেনির সাথে একবার কথা বলা দরকার। নিষাদকে নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। জেনি আর আমার বিয়েটা আটকে আছে ওর কারনেই। নিষাদ ব্যাপারটা কীভাবে নেবে সেটা না বুঝে আমি ফাইনাল কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা।
জেনিকে ফোন দিলাম। সে রিসিভ করতেই বললাম, “জেনি একটা সমস্যা হয়েছে”।
জেনি বলল, “কি সমস্যা?”
“মনে হচ্ছে নিষাদ তার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানে!”
“মানে? অসম্ভব!” জেনির কণ্ঠে অবিশ্বাস টের পেলাম।
“হ্যা... সে আজ একটা কবিতা লিখেছে তার মাকে নিয়ে। কবিতার ভাষা সন্দেহজনক!”
দুজনে এ বিষয়ে মিনিট পাঁচেক কথা বলে ফোন রাখতে যাচ্ছি তখন দরজায় নকের শব্দ হল।
আমি বললাম, “ভেতরে এস নিষাদ”।
নিষাদ ভেতরে এলনা, দরজা একটু ফাঁক করে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে “কবিতাটা আমি লিখিনি ড্যাড, বেলিন্ডা স্টলার নামে একজন মহিলা লিখেছেন” বলেই চলে যেতে উদ্যত হল।
আমি ডাকলাম, “নিষাদ! দাড়াও”।
নিষাদ দাঁড়াল।
ভেবেছিলাম কেন মিথ্যে বলেছে তা জিজ্ঞেস করব। কিন্তু জানি জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পাওয়া যাবেনা! এইধরনের আচরন নিষাদ হরর মুভি দেখে দেখে শিখেছে। আমি বললাম, “কাল বিকালে তোমার কোন কাজ আছে?”
নিষাদ ঘুরে তাকাল, “না কাজ নেই। কেন?”
“কাল আমি আগে আগে অফিস থেকে ফিরব”।
“নতুন মুভি দেখার জন্য?”
“নাহ! কালকে লং ড্রাইভে যাব। অনেক দূরের পথে!”
নিষাদকে খুব একটা আগ্রহী মনে হচ্ছে না। সে বিনা বাক্যব্যয়ে আমার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ছেলেটাকে আর হরর মুভি দেখানো যাবেনা! অন্য কিছুতে আগ্রহী করে তুলতে হবে!
***
আমি সাধারণত কাউকে কথা দিলে সেটা রাখার আপ্রান চেষ্টা করি। অফিস থেকে তাই আজ আগেই ফিরেছি। নিষাদকে নিয়ে লাঞ্চ সেরেই বেরিয়ে গেছি লং ড্রাইভে। আমরা যাচ্ছি ময়মনসিংহের হোতাপাড়ার দিকে। উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছাকাছি কিছুটা সময় কাঁটিয়ে আসা। এতে করে মাথাটা একটু হালকা হবে। নিষাদকে ঘুরাঘুরি করা, বাইরের জিনিস দেখা- এসবের প্রতি আগ্রহী করে তোলা গেলে হয়ত হরর মুভি দেখার নেশাটা একটু কাটানো যাবে।
বিকেলের নরম রোদ পড়েছে রাস্তায়। দুধারে ঘন জঙ্গল। এদিকটাতে জনবসতি খুব একটা নেই। জঙ্গলের একপাশে দেখলাম একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। মনে হচ্ছে এই রাস্তায় লোক-চলাচল বিশেষ হয় না। খুব ভাল লাগল আমার। ড্রাইভারকে বললাম রাস্তার ধারে সাইড করে গাড়িটা থামাতে।
“এখানে থামাচ্ছ কেন ড্যাড?” নিষাদের প্রশ্ন।
“দেখছ না কি সুন্দর জায়গা। চল একটু নেমে ঘুরে দেখি”।
ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে দুজনে নেমে এলাম। মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে এলাম বেশ খানিকটা পথ। এখান থেকে জঙ্গলটা ক্রমশ ঘন হয়েছে। রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে রাখা গাড়িটা আর চোখে পড়ছে না।
“তোমার ভাল লাগছে না যায়গাটা, নিষাদ?”
“না” নিষাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কেন নিষাদ?”
“আমার ভয় করছে”।
দিনরাত হরর মুভি দেখা নিষাদের মুখে ভয় পাওয়ার কথা শুনে আমার হাসি পেল। আরও কিছুদূর হেঁটে এলাম দুজনে। হঠাৎ কুকুরের কান্নার মতো একটা ডাক শুনতে পেলাম। দূর থেকে আসছিল আওয়াজটা। নিষাদ সতর্ক হয়ে দাড়িয়ে গেল।
“কি হল?” এস আর কিছুক্ষন হাটি!
“আমার মনে হচ্ছে ওটা নেকড়ের ডাক”।
আমার হাসি পেল। হাসি আটকে রেখে বললাম, “কি আবল তাবল বলছ নিষাদ? হরর মুভি দেখে মাথা গেছে তোমার! ঢাকা শহরে নেকড়ে আসবে কোত্থেকে?”
“আমি ফিরব বাবা?”
আমার তখন একটা পুরনো একটা রাস্তা চোখে পড়েছে। “যাব তো অবশ্যই, তার আগে চল ঐ রাস্তাটা কোথায় গেছে সেটা একটু দেখে আসি। মনে হচ্ছে কাছে ধারে একটা গ্রাম আছে”।
“আমি আর যাবনা” গোঁ ধরল নিষাদ।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “ঠিক আছে আমি তোমাকে জোর করছি না। তুমি গাড়িতে গিয়ে বস। আমি খানিক বাদেই আসছি”।
নিষাদ যেন হতাশ হয়েছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে গাড়ির দিকে ফিরে চলল। আমি কিছুক্ষন তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার রাস্তাটা ধরলাম নিশ্চিন্ত মনে। নিষাদের আপত্তির কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছি না। রাস্তার শেষটা কোথায় সেটা দেখার জন্য আমার মনে একটা জেদ চেপেছে।
কতক্ষন যাবত হাঁটছি বলতে পারব না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই রাস্তা আর কখনো শেষ হবেনা। বাড়িঘর বা লোকজন কিছুই চোখে পড়ল না। নির্জন পরিত্যক্ত গোছের জায়গা। এই ব্যাপারটা আগে খেয়াল হয়নি। রাস্তার বাঁকে এসে যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করছিল, তা এই জায়গাটার পরিত্যক্ত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অবচেতন মন বারবার তাগাদা দিচ্ছে ফিরে যাওয়ার জন্য। একদিনের জন্য ঘুরাঘুরি যথেষ্ট হয়েছে। আমি ফিরতি পথ ধরলাম। এতক্ষন দূর থেকে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা দুরপাল্লার যানবাহনের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এখন তাও শুনছি না। আরও একটা বিষয় হচ্ছে, ফেরার পথে জঙ্গলটা একটু বেশি ঘন মনে হচ্ছে।
আরও কিছুদূর হাটার পর বুঝলাম পথ হারিয়েছি। গাজীপুর অঞ্চলের এই জঙ্গল সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি আমি। এখানে রাত বিরাতে ডাকাতি হয়, আর মানুষ মেরে ফেলে যাওয়াটা নতুন কোন বিষয় না। এতক্ষনে ভয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছি আমি। দাঁড়িয়ে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করছি কোন দিক দিয়ে এসেছিলাম। এখানে সেখানে ঝোপঝাড় আর গর্ত দেখছি। একটা রাস্তা দেখলাম এঁকেবেঁকে একটা ঘন ঝোপের দিকে এগিয়ে গেছে, তারপর তার পিছনে গিয়ে হারিয়ে গেছে। একটা গা-ছমছমে অনুভূতি হল। হাত পা অবশ হয়ে এল। এই প্রথম বারের মত মনে হল, নিষাদের সাথে ফিরে গেলেই ভাল করতাম।
ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাথার উপর মেঘও ঘনীভূত হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে গম্ভীর মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে। সেই গর্জনকে ভেদ করে আবার মধ্যে মধ্যে রহস্যজনক এক চিৎকার শোনা যাচ্ছে– যেটাকে নিষাদ ভেবেছিল নেকড়ের চিৎকার। সেদিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় কনকনে ঠান্ডা বাতাস লাগল গায়ে।
হাঁটছি আমি। মনে হচ্ছে যেন পেরিয়ে এসেছি অন্তবিহীন পথ। মাঝে মধ্যেই আকাশ বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে এক ঘন জঙ্গল যার শুরু বা শেষ খুজে পাওয়া সম্ভব হবেনা। জায়গাটা তুলনামূলকভাবে নিস্তব্ধ। মাথার অনেক উপরে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ঝড়ের অন্ধকার যেন মিশে গেছে রাতের অন্ধকারে। এই অবস্থায় সেই নেকড়ের অদ্ভুত শব্দটা আমার চারপাশের নানা শব্দের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
আমার মাঝে একটা ঘোরলাগা অনুভূতি সৃষ্টি হল। এই অর্ধ চৈতন্যাবস্থা স্থায়ী ছিল অনেকক্ষণ। হঠাৎ একটা গা-ঘিনঘিনে বমি বমি ভাব হল। প্রকাণ্ড স্থবিরতা গ্রাস করল আমাকে। মনে হল, সারা পৃথিবীটা হয় ঘুমাচ্ছে, নয় মরে গেছে– শুধু আমার কাছে বসে থাকা কতগুলো জানোয়ারের নিঃশ্বাসের আওয়াজ সেই নৈঃশব্দের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। গলার কাছে একটু উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম। তারপর ব্যাপারটা টের পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিণ্ডটা ঠান্ডা হয়ে এল ভয়ে। একটা বিরাট জন্তু আমার উপর শুয়ে আমার গলাটা চাটছে। ভয়ে নড়তে পারলাম না। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আমার উপর এক দৈত্যাকার নেকড়ের দুটো বড়ো বড়ো চোখ জ্বল জ্বল করছে। ফাঁক হয়ে থাকা বিরাট মুখের মধ্যে চকচক করছে ধারালো সাদা দাঁত। তার গরম জান্তব ক্ষুরধার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার উপর।
হঠাৎ আমার চোখ দুটো নেকড়েটাকে ছেড়ে গেল। দূরে কিছু একটার নড়াচড়া টের পাচ্ছি আমি। মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কে ওটা? অবয়বটা খুব বেশি পরিচিত। আরও কাছে এগিয়ে এল সেই ছায়ামূর্তি। এবার আর চিনতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। নিষাদ! আমার ছেলে। নিষাদের চোখদুটো নেকড়ের মতই জ্বলজ্বল করছে, মুখের ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে ভয়ংকরদর্শন দাঁত। আমি একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
হুঁশ ফেরার পর দেখলাম কোথায় জঙ্গল, কোথায় নেকড়ে, আমি বাড়িতেই বসে আছি। প্রথমে খানিকক্ষণ কিছু মনে ছিল না। তারপর মনে পড়তেই গোঙানির মত একটা আওয়াজ করে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। দেখলাম নিষাদ বসে আছে কাছেই। ডিভিডি প্লেয়ারে মুভি চলছে।
“কি হল ড্যাড?”
“কি ব্যাপার নিষাদ? আমরা এখানে এলাম কখন? আমরা কি লং ড্রাইভে যাইনি?”
“নাহ ড্যাড”।
“কেন?”
“তুমিই তো অফিস থেকে ফিরে বললে আজ শরীরটা ভাল লাগছেনা। আজ লং ড্রাইভে যাবেনা!”
“তাহলে মুভি দেখছি কেন?”
“নতুন কোন মুভি বাসায় নেই বলে তুমিই তো বললে ড্রাকুলাস গেস্ট মুভিটা ছাড়ার জন্য। আমি তাই করলাম!”
আমি মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। এতক্ষনে সবটা মনে পড়েছে। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোন সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারে ভুগছি আমি। নইলে কোনটা স্বপ্ন, কোনটা বাস্তব- তা প্রায়ই গুলিয়ে যাচ্ছে কেন?
বিছানায় শুয়ে পরলাম আমি। সিলিঙের ফ্যানটা কি আস্তে ঘুরছে নাকি? বাতাস এত কম লাগছে কেন? নিষাদের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, “বাবা, ডিনার করবেনা?”
নিষাদ আমার বেডরুমের দরজায় দাঁড়ানো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “না, তুমি খেয়ে নাও”।
নিষাদ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকল।
“কি ব্যাপার কিছু বলবে?”
“আমি একটা কবিতা লিখেছি ড্যাড। ইংলিশ পয়েম”।
“আবার একটা কবিতা নকল করেছ?”
“না ড্যাড, আমি নিজে লিখেছি এবার” নিষাদ তার শার্টের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলতে লাগল।
আমি বললাম, “রেখে যাও। পরে পড়ব”।
“তুমি ভুলে যাবে ড্যাড, আমি তোমাকে পড়ে শুনাই?” নিষাদ আমার মাথার কাছে চলে এসেছে।
আমি কিছু বললাম না।
নিষাদ শুরু করল...
A face that is always on my mind,
A smile I have seen a million times,
Two eyes that would light up the sky at night,
One last battle you could not fight,
The day was long, then night then morn.
I knew that soon you would be gone,
I clasped your hand so warm in mine,
Soon we would be out of time,
To stay with us you fought so hard,
A million pieces went my heart,
Now a photo I look at to see your smile,
I keep your number on my speed dial,
A video I watch to hear your voice,
This I do.... I have no choice.,
But great memories I will always keep with me,
Your love in my heart for eternity,
I never got to say goodbye,
To understand why, I can but try,
Waiting in heaven from this moment on,
'Till god asks you to bring me home....
কবিতা শেষ হতেই বললাম, “অনেক ভাল লিখেছ নিষাদ। কিন্তু এই একই থিম নিয়ে খুব বেশি লেখার দরকার আছে কি? অন্য কিছু নিয়ে লেখার চেষ্টা কর”।
নিষাদ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। আমি শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। হঠাৎ আবার মাথার কাছে নিষাদের কণ্ঠস্বর শুনলাম। “ড্যাড, একটা কথা বলব”।
আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললাম, “আবার কি বলবে?”
“ড্যাড, এই কবিতাটা!”
“হুম”
“এটাও আমি লিখি নাই। লিখেছে লরনা ফারগুসন নামে বাইরের এক মহিলা কবি”।
আমি নিষাদের কথা শুনছিনা। আমার ঘুম দরকার! ঘুমিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি অতলে..
***
আজ জেনির সাথে ডেট ছিল। অফিস শেষে সরাসরি জেনির সাথে গিয়ে মিট করলাম। তারপর গেলাম বেইলি রোডে। থার্টি থ্রি তে বসে দুজনে খেলাম। জেনির পছন্দের একটা শাড়ি কিনে দিলাম। ঘুরাঘুরি করতে করতে ৮টা বেজে গেল। জেনিকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার পথে নির্জন রাস্তা দেখে দুজনে একটা লং কিস করলাম । মেজাজটা তাই খুব ফুরফুরে লাগছে।
বাড়ির কাছের ডিভিডির দোকানটা ছাড়িয়ে এলাম। আজ থেকে আর কোন হরর মুভি দেখব না। যদিও নিষাদ দুই তিন বার অনুরোধ করেছে আনডিভাইডেড মুভিটার ডিভিডি আনার জন্য। তার কোন এক ক্লাসমেট মুভিটা দেখে ভাল বলেছে। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হরর মুভি। কিন্তু আমি আর হরর মুভি দেখব না বলে ঠিক করেছি। এই হরর মুভি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে এক একটা দুঃস্বপ্নে পরিনত করেছে। আমি আর নিষাদের এই খেলার গুঁটি হবনা।
নিষাদ চুপচাপ ড্রয়িং রুমের এক কোনায় বসে ছিল। আমাকে দেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। সম্ভবত বুঝতে পেরেছে আমি মুভিটা আনিনি। আমি চেহারায় কাঠিন্য ধরে রেখে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলাম। কাপড় পালটাচ্ছি, দেখলাম নিষাদ নিঃশব্দে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
"কিছু বলবে?'
নিষাদ নিচু কণ্ঠে বলল, "একটা জিনিস দেখাব তোমাকে'।
মুভি এনেছি কিনা জিজ্ঞেস না করায় আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিষাদের সামনে মিথ্যে বলা কঠিন। আমি বললাম, "কি দেখাবে?'
"আগে ডিনার সেরে নাও। তারপর দেখাচ্ছি'।
আমি রাতের খাবার খেতে খেতেই আর একবার জিজ্ঞেস করলাম, "কি দেখাতে চাও নিষাদ?'
নিষাদ বলল, "বললাম তো খাওয়ার পর দেখাব'।
"খাওয়ার পরই দেখব। আপাতত কি দেখাতে চাও, সেটা তো বলতে পার!'
"তুমি গতকাল রাতে একটা কবিতা লিখেছ' নিষাদ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল।
আমি মুখের ভেতরে ভাত চিবান বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলাম।
নিষাদ আবার বলল, "ইংরেজি কবিতা'।
"আমি কবিতা লিখেছি! অসম্ভব! কখন লিখলাম?' মুখের ভেতরে ভাত থাকায় কথাগুলো অস্পষ্ট শোনাল।
নিষাদ বলল, "খেয়ে নাও ড্যাড, তারপর দেখাচ্ছি'।
আমি আর খেতে পারলাম না। মুখের ভেতরে খাবার স্বাদহীন মনে হচ্ছে। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। আমি কবিতা লিখলাম কখন? ঘুমের ঘোরে? কিন্তু কেন লিখব? কি নিয়ে লিখব?
এঁটো ভাত ফেলে রেখে উঠে পড়লাম। বেসিনে হাত ধুয়ে আমি নিষাদের পেছন পেছন তার রুমে ঢুকলাম। নিষাদ তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা হাতে লেখা কাগজ বের করে দিল। ইংরেজিতে লেখা কবিতা। ঠিক যেমনটি নিষাদ এর আগে দুবার দেখিয়েছে আমাকে।
Alone with the raging in my soul,
I know not where to turn.
I have opened up to some,
But this raging makes me burn.
My heart and soul are screaming,
But I try to hold it in,
For, they make me feel I'm wrong,
That my hurt is like a sin.
I am fighting for a way,
To be not weak and small.
But my pain is not subsiding,
Please someone hear my call!
I've done what they have asked,
Tried going down their path.
But they know not why I'm hurting,
They haven't felt the wrath.
I look to them sincerely,
I TRY to help them SEE,
But, they just don't understand it,
So they choose to leave me be.
I long to just be normal,
Then maybe they'll accept,
The reasons why I need them,
The reason why I've wept.
The demons they hold strong,
As, they've broken my life down.
Are they afraid of these monsters?
Is that why they seem to frown?
I'm afraid to admit,
The help that I need.
I don't want them to know,
That in my pai I BLEED.
Because he was unkind,
So many years before,
I think her death, they want me,
To move on and IGNORE.
Nilufar, can you hear me?
Can you please let them know,
That special part of you
That I just can't let go?
Is anybody listening?
Does anybody SEE?
Help me to set myself in rest
Please help to set me free!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কাগজের দিকে। এই কবিতা আমি লিখেছি! নিষাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, "তুমি মিথ্যে বলছ নিষাদ! এটা আমি লিখিনি'।
নিষাদ বলল, হাতের লেখাটা দেখ ড্যাড। কি মনে হয়? ওটা কার লেখা।
মনে হওয়ার কিছু নেই। নিজের হাতের লেখা চিনতে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। আমি এক দৃষ্টিতে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ করে মাথাটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে।
"ড্যাড, মুভি এনেছ?'
"না'
"আমি জানতাম তুমি মুভিটা আনবেনা'।
আমি কিছু বললাম না। আমার হাটুর নিচ থেকে শরীরটা কেমন অবশ লাগছে।
"ড্যাড, এখন থেকে তোমাকে আর মুভি আনতে হবেনা'।
"আচ্ছা' আমি বুঝতে পারছি আমার এখনি শুয়ে পরা দরকার। শরীর খারাপ করবে বুঝা যাচ্ছে। আমি পা বাড়ালাম নিজের রুমে দিকে।
"কেন আনতে হবেনা সেটা জিজ্ঞেস করলেনা?'
আমি নিষাদের রুম থেকে বেরতে বেরতে বললাম, "তুমি আর মুভি দেখবেনা'।
"না ড্যাড। এখন আরও বেশি করে দেখতে পারব'।
আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, "কীভাবে?'
"আমার কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়েছি, ড্যাড। এখন থেকে ভাল ভাল মুভি ডাউনলোড করে নেব যাবে খুব সহজেই'।
আমি তিক্ত ভঙ্গিতে একটু হাসলাম।
রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। মাথা ঝিম ঝিম করছে, হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু কোন শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। মানসিক সমস্যাটাই বেশি ভোগাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে নিজের অজান্তে কবিতা লিখা শুরু করেছি। আমার জীবনে গোপন করার মত অনেক কিছুই আছে। এভাবে ঘোরের মধ্যে থাকা অবস্থায়, কখন কোন বেফাঁস বিষয় বেরিয়ে আসে তার ঠিক নেই। সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হওয়া কম্পালসরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশের রুম থেকে স্পিকারের আওয়াজ আসছে। নিষাদ সিনেমা ছেড়েছে। এত জোরে আওয়াজ দিয়েছ কেন? সিনেমায় বোধহয় ভায়োলেন্স অনেক বেশি। খুব বেশি চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে। আমি বার কয়েক এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলাম। নিষাদকে ভলিউম কমাতে বলে আসা দরকার।
নিষাদের রুমের সামনে গিয়ে দাড়াতেই চমকে উঠলাম। "ভেতরে এস বাবা। মুভি মাত্র শুরু হয়েছে'।
আমি মুভি দেখতে আসিনি। এসেছি ভলিউম কমাতে বলার জন্য। কিন্তু কিছু একটা আমাকে তা বলা থেকে বিরত রাখল। মুভিটা আমাকে চুম্বকের মত টানছে, নিষাদের পাশে গিয়ে বসে পরলাম।
মুভির প্রধান চরিত্র একটি অল্প বয়সী মেয়ে- অ্যানা। অগ্নিকান্ডে মায়ের মৃত্যু দেখার পর থেকে ক্রমাগত আত্মহত্যার চেষ্টা করার কারনে তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। প্রায় ১০ মাসে পর সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। অ্যানার বাবা ডেভিড একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ডেভিড তাকে সমুদ্রতীরের একটা নির্জন কটেজে নিয়ে আসল। বাড়িতে ফিরেই আনা দেখল তার মায়ের সেবাদান কারী নার্স এলিজাবেথ এখন তার সৎ মা। মুভি কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল অ্যানা মাঝে মাঝে তার মৃত মায়ের আত্মাকে দেখতে পাচ্ছে! ছোটবোন এলেক্স আর সে মিলে আলোচনা করে নিশ্চিত হল র্যাচেলই তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী। র্যাচেল আর ডেভিড মিলে তাদের মাকে মেরে ফেলেছে নিজেদের পথের কাটা দূর করার জন্য। অ্যানা উঠে পরে লাগল তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। প্রয়োজনে সে তার বাবাকে
নিষাদের মা অর্থাৎ আমার স্ত্রী নিলুফার মারা গেছে একটা দুর্ঘটনায়। অদ্ভুত সে দুর্ঘটনা! আমাদের বাড়ির ছাদটা বর্ষাকালে শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে থাকে। ছাদের রেলিং এর একটা অংশ ভাঙা। কতবার নিলুফারকে বলেছি, ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়ার সময় সাবধান থাকবে। কিন্তু সাবধান নিলুফার হয়নি, তারই প্রমান দিয়েছে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে।
নিষাদকে অন্য কি কাজে ব্যস্ত রাখা যায় ভাবতে ভাবতে প্রথমেই মাথায় এল ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার প্রশিক্ষন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। কিন্তু ছেলের খেলাধুলার প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ নেই। আর মায়ের মৃত্যুর পর তো সেটা আরও কমেছে। ভেবে ভেবে ঠিক করলাম ছেলেকে মুভি দেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। কিন্তু সে কেমন মুভি দেখতে পছন্দ করবে?
নিষাদের বয়স তখন ১২, বয়ঃসন্ধিকাল দোরগোড়ায়। এ বয়সী একটা ছেলের কি ধরনের মুভি দেখতে ভাল লাগবে? ঠিক করলাম বেশি বেশি এনিমেটেড মুভি দেখাব তাকে।
কিন্তু অফিস কলিগ সানাউল্লাহ ভাই বললেন, “আপনার ছেলেকে হরর মুভি দেখান হাসান ভাই। এ বয়সী বাচ্চাদের ভূত প্রেত টাইপের মুভি দেখতে বেশি লাগে” সানাউলাহ ভাই আমাকে একটা হিন্দি হরর মুভির নাম সাজেস্ট করে দিলেন। মুভির নামঃ ছায়া। হিট করা মুভি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই ছেলে মুভিটা পছন্দ করবে তো? প্রথম মুভিই যদি ভাল না লাগে তাহলে হয়ত আর দেখতে নাও চাইতে পারে”।
সানা ভাই বললেন বললেন, “সেইটা মাথায় রেখেই তো বলতেছি। দেখান নিয়ে গিয়ে। দেখবেন, ছেলে আপনার হরর মুভির ভক্ত হয়ে যাবে”।
আমার বাড়ির কাছেই একটা ডিভিডি স্টোর আছে। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু ঢু মারলাম। দোকানের নামটাও ভারী অদ্ভুত। স্ক্র্যাচ ভিডিও সেন্টার। আমরা সাধারণত ডিভিডি বা সিডি ক্যাসেটে দাগ পড়ে গেলে বলি স্ক্র্যাচ পড়েছে। কিন্তু ডিভিডির দোকানের নাম স্ক্র্যাচ হবে কেন? এই দোকানের সব সিডি নিশ্চয়ই স্ক্যাচ পড়া নয়! নামের ব্যাক গ্রাউন্ড স্টোরিটা জানা দরকার, একদিন দোকানের মালিকের সাথে কথা বলতে হবে।
আমি ছবির নাম বলার পর এক কর্মচারী মুভিটা খুজে দিল। অবশ্য খুজে পেতে একটু সময় লাগল। ২০০৩ সালের মুভি, মোটামুটি পুরনো বলা যায়। ইয়াং জেনারেশন নতুনের পূজারী, পুরাতন নিয়ে মেতে থাকার সময় কই ওদের?
ডিভিডি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। নিষাদের রুমে উকি দিয়ে দেখি নিষাদ গালে হাত দিয়ে তার পড়ার টেবিলে বসে আছে। সামনে বই খোলা। তবে যে কেউ দেখেই বলতে পারবে তার মানসিক অবস্থান এখন অন্য জগতে, বইয়ের ভেতর নয়। আমি ডাকলাম, "নিষাদ"।
নিষাদ জবাব দিলনা। আমার দিকে তাকাল না। তবে এর মানে এই নয় যে সে আমার ডাক শুনতে পায়নি। আমার ধারনা দুই তিন বার ডাকার আগে সে ইচ্ছে করেই জবাব দেয়না। আরেক বার ডাকলাম, "নিষাদ"!
এবার উত্তর দিলনা, কিন্তু আমার দিকে ঘুরে তাকাল।
আমি মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম, "তোমার জন্য আমি একটা হরর মুভি এনেছি নিষাদ' আজ থেকে আমরা একসাথে বসে মুভি দেখব।
নিষাদ নির্বিকার। সে হালকা করে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার বইয়ের দিকে নজর দিল।
রাতে খাওয়ার পর দুজনে বসে গেলাম ড্রয়িং রুমে ডিভিডি প্লেয়ার এর সামনে। মুভির শুরুর ১০ মিনিট না যেতেই নায়ক জন আব্রাহাম আর নায়িকা তারা শর্মার উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়ে গেল। বাবা-ছেলে একসাথে বসে দেখার মোটেও উপযোগী নয়। সানাউল্লাহ ভাইয়ের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? তিনি এই মুভি দেখতে রিকমেন্ড করলেন কী করে? অবশ্য আরও মিনিট দশেক পর মুভির ক্লাইমেক্স শুরু হতেই মজা পাওয়া শুরু করলাম।
একটা গ্রামে মানুষ কোন একটা রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের সাহায্য করার কেউ নেই। নায়িকা তারা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও গেল সেখানে। এবং দুদিন বাদের নায়ক খবর পেল নায়িকা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এইবার আমি কিছুটা আঁচ করতে পারলাম কেন সানাভাই আমাকে বলেছেন এই মুভিটা দেখতে বলেছেন!
এর পরের ঘটনা গুলো রীতিমত গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়ার মত। নায়িকা তারা শর্মা এখন তার স্বামীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। নায়ক জন আব্রাহাম একজন ডাক্তার। নায়িকা হাসপাতালের মৃতপ্রায় রোগীদের শরীরে প্রবেশ করে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।
মুভিটা খুব একটা ভাল লাগেনি আমার কাছে, নিষাদের কাছেও লাগেনি। কিন্তু দেখলাম নিষাদ হরর বিষয়টা বেশ ফিল করতে শুরু করেছে।
পরদিন যখন আমি "নায়না' নামে আর একটা হরর মুভি নিয়ে হাজির হলাম দেখলাম নিষাদের চেহারা অনুভূতিহীন হলেও চোখদুটো চক চক করে উঠেছে। বুঝলাম কাজ হয়েছে! এভাবে ভূত, ১৯২০, ডরনা মানা হ্যায় সহ বেশ কিছু হরর হিন্দি মুভি দেখা হয়ে গেল। এবার শুরু করলাম ইংলিশ মুভি দেখা। একসময় ঝুকে পড়লাম ফ্রেঞ্চ মুভির প্রতি। ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা দুজনের জন্যই নেশায় পরিনত হল।
কোনদিন একটা হরর মুভি দেখা না হলে দুজনেরই আর ঘুম আসে না। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি এই হরর মুভি দেখার অভ্যাসটা আমার জন্য মানসিক বিপর্যয়ের বীজ হয়ে দাঁড়াবে।
***
৩ বছর পর একদিন...
গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছিল অফিসে, ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিজে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছি আজ। ড্রাইভারটা ছুটি নিয়েছে কিছুদিনের জন্য। ভাবছি ব্যাটাকে ছাঁটাই করে দেব। দুদিন পর পর এই সমস্যা- সেই সমস্যার কথা বলে ছুটি নেয়। বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়ার কোন অর্থ হয় না।
আজ আমি আর নিষাদ "হাই টেনশন' নামের একটা ফ্রেঞ্চ মুভি দেখব। এটাও যথারীতি কলিগ সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাজেশন। মুভিতে কিছু যায়গায় অতিরিক্ত ভায়োলেন্স আছে। নিষাদের ভাল না লাগলে টেনে দিতে বলেছেন উনি। আমি মনে মনে হাসলাম। নিষাদের ভায়োলেন্স দেখার ক্ষমতা সম্পর্কে সানাউল্লাহ ভাইয়ের কোন ধারনাই নেই। জম্বি মুভিগুলোতে হাড় মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমি যখন ভয়ে শিউরে উঠি, তখন দেখি নিষাদ আশ্চর্য এক কৌতূহল নিয়ে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
স্ক্র্যাচ ভিডিও সেন্টার এর সামনে গাড়ি থামিয়ে হাই টেনশনের একটা ডিভিডি কিনে নিলাম। ভিডিও সেন্টারের ঠিক পাশ দিয়েই একটা সরু রাস্তা আছে। ডিভিডি হাতে এসে গাড়িতে উঠতে যাব তখন রাস্তার দিকে নজর গেল। একটা মেয়েকে দেখছি সরু রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজ। কে ওটা? মমতা না?
মমতা আমার বাড়ির সামনের বাড়িতে থাকে। সম্ভবত অনার্স পড়ছে মেয়েটা, নিলুফারের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। নিলুফারের ছাঁদ থেকে পরে যাওয়ার দৃশ্যটা সে দেখে ফেলেছিল। সেই থেকে একটা মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে। অ্যাবনরমাল আচার আচরন করছে।
কিন্তু মেয়েটি ওদিকে কোথায় যাচ্ছে? এদিকটাতে মানুষজন যায় কম। পরিত্যক্ত নিচু এলাকা, বর্ষা এলেই পানি ওঠে, তেমন কোন বসতিও নেই। একটা বড় জলাশয় আর পুরনো একটা কবরস্থান আছে। আজেবাজে নেশাখোর ছেলেপিলে সব আড্ডা দেয়। মমতাকে পেলে ওরা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে খাবে। আমি পা বাড়ালাম। মেয়েটিকে থামান দরকার!
মমতা হাটার গতি বাড়িয়ে দিল। আমি দু তিন বার নাম ধরে ডাকলাম। সে ফিরে তাকাচ্ছে না। সামনেই একটা ডোবা, মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পরে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে না তো? আমি আরও দ্রুত পা চালালাম। মমতা হঠাৎ দৌড় লাগাল। আমি বুঝতে পারছিনা কী করা উচিত। রাত হয়ে যাচ্ছে, এদিকে মানুষের চলাচল একেবারেই কম। মনে হচ্ছে আজ নেশাখোর ছেলেগুলোও আড্ডা দিচ্ছেনা। মেয়েটিকে এভাবে এখানে ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? মমতার আকর্ষণীয় ফিগার ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। চকিতে একটা সম্ভাবনা খেলে গেল মাথায়। বিরান এলাকা, কাছে ধারে কেউ নেই। মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন, কিছু একটা ঘটে গেলে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবেনা। আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আবিস্কার করলাম, পশুর শক্তি। প্রতিটি পুরুষের মাঝে একটা পশুর বাস, আমার ভেতরের পশুটা জেগে উঠেছে। আমিও দৌড় লাগালাম মমতার পেছন পেছন।
মেঘের আড়ালে চাঁদ হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জোনাকীরা সব এক সাথে জ্বলে উঠে পৃথিবীকে আলোকিত করার বৃথা প্রয়াস চালাচ্ছে । দূর থেকে ভেসে আসা নৈঃশব্দ্য রজনীর নিঃসঙ্গতার করুণ বিলাপ মনে ভয় ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। তবুও মমতার পেছনে পেছনে আমি এমন ভাবে দৌড়াচ্ছি, যেন আবেগহীন, অনুভূতিহীন পাথরের এক মূর্তি। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি? কেন মমতা একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না? ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই আমার মনে জাগছে না! দৌড়ে চলেছি দ্বিধাহীন চিত্তে অজানার উদ্দেশ্যে। আমাকে এক নেশায় পেয়ে বসেছে, অন্যরকম নেশা।
মমতা হঠাৎ দাঁড়াল। তার ঠিক দুই কদম পেছনে আমিও থমকে দাড়ালাম। ভাসমান কালো মেঘের ফাঁক গলে একটু আধটু জ্যোৎস্না গলে পড়ছিল। সেই আলোয় দেখলাম আমরা পুরনো কবর স্থানে এসে পরেছি। কবরস্থানের পাশেই একটা ছোট বাঁশঝাড়। বাঁশগাছগুলোর ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে উঠছে। অনেকদিন পর দৌড়েছি, হাঁপাচ্ছি কুকুরের মত।
মেঘ ফুঁড়ে হঠাৎ চাঁদটা বেরিয়ে এল। পাতলা কামিজ পড়েছে মমতা, বুকের ওড়নাটা দৌড়ানোর সময় গায়েব হয়েছে। চাঁদের আলোয় মেয়েটির অপরুপ দেহসৌষ্ঠব সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। আমার শরীর শিহরিত হল । মনে হচ্ছে অপার্থিব কোন এক অনুভূতি শক্তি জমা হচ্ছে আমার মাঝে! ভেতরে ভেতরে ক্ষীণ কম্পন শুরু হয়েছে। হঠাৎ মমতা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ঠোঁট টিপে হাসছে। ওকি আহবানের হাসি? আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। ঝাঁপিয়ে পরলাম ওর উপর। মমতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে।
পিঠের নিচে আলগা মাটির মত লাগছে। সেদিকে তখন খেয়াল করার মত ধৈর্য আমার নেই। দুহাত চলে গেছে প্রয়োজনের খোঁজে, নাকে মুখে গোগ্রাসে গ্রহন করছি নারীমাংসের স্বাদ। মাতালের খেলায় মত্ত আমি। মমতা বাধা দিচ্ছেনা মোটেও। বিকারগ্রস্ত একটা মেয়ে জানেনা এই খেলার পরিনাম। হঠাৎ পিঠের কাছে নরম কিছু একটার স্পর্শ পেয়ে থমকে গেলাম আমি। মনে হচ্ছে মানুষের হাত, কি ভীষণ ঠাণ্ডা! পিঠের নিচে কি কবর ফুঁড়ে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে নাকি! ভয়ের একটা অনুভূতি নামল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমি মমতাকে ছেড়ে উঠে বসলাম।
কোথায় হাত? আমার মনের ভুল হবে হয়ত। অবশ্য কাছাকাছি একটা নতুন ঝকঝকে একটি কবর দেখতে পারছি! একেবারেই নতুন কবর! মনে হচ্ছে কয়েক দিন আগেই কাউকে দাফন করা হয়েছে আমি যতদূর জানি এদিকটাতে এখন আর কাউকে কবর দেওয়া হয়না। তাহলে এটা কার কবর? আরও সামনে তাকাতেই দেখলাম ছোট একটা গর্ত। কবরে কেউ গর্ত করে রেখেছে! গর্তের কাছে গিয়ে উকি দিতেই দেখলাম দুটো কুকুর কিছু একটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে । মানুষের পা-এর মতো লাগছে! সেই পা থেকে মাংস ছিড়ে মজা করে চিবোচ্ছে লাশ খেকো কুকুরদুটো।
এমন সময় প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল–সেই আলোয় দেখলাম কবরের অন্ধকারে এক সুন্দরী নারী শায়িত, তার গালদুটি সুডৌল, ঠোঁটদুটি লাল! নিলুফার! তাকিয়ে আছে আমার দিকেই! তার চোখ দুটোতে কষ্ট! আচমকা মৃত নিলুফার যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল!
আমি আতংকে শিউড়ে উঠে দু পা পিছিয়ে এলাম! হঠাৎ বাতাস ছাড়াই কবরের পাশের বাশের ঝোপটি এলোমেলোভাবে দুলতে শুরু করল! ভয়ে আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে । ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্বস্তি! মমতার দিকে ফিরে তাকালাম। কী আশ্চার্য! মমতা কোথাও নেই! সে যেখানে দাড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে একটি কুৎসিত দর্শন কুকুর দাড়িয়ে আছে । আদমখোর সেই কুকুর বড় বড় চোখে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! কুকুরটাকে আগে কখনো না দেখলেও তার ভয়ংকর চোখ দুটো আমার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে । ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে । আমি ঝেড়ে দৌড় দিলাম । কুকুরটিও আমার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে ! আমি সর্ব শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি অথচ কেন যেন মনে হচ্ছে একচুলও এগুতে পারছি না।
হঠাৎ আমার কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল! চমকে দেখি আমার পাশে নিষাদ দৌড়াচ্ছে! নিষাদ এখানে এল কেমন করে?
“আমাকে বাঁচাও নিষাদ” আমি অনুনয় করলাম ছেলের কাছে।
নিষাদ কিছু বলছে না। ভালভাবে খেয়াল করতেই দেখলাম আসলে এটা নিষাদ নয়! নিষাদের শরীর কিন্তু মুখটা দেখতে কুকুরের মত। নিষাদরুপী একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে! কুকুরটা আমার কাধ ধরে ঝাঁকাল, “কি হয়েছে ড্যাড!”
আমি প্রানপনে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। নিষাদ আবার জিজ্ঞেস করল, “ড্যাড, কি হয়েছে? এমন করছ কেন?”
আমার ঘোর কেটে গেল। নিজেকে আবিস্কার করলাম ড্রয়িংরুমে, টিভি স্ক্রিনের সামনে। সিনেমা চলছে "হাই টেনশন', একটা খুব ভায়লেন্সের দৃশ্য দেখাচ্ছে!
একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “কি হয়েছিল আমার?”
“তুমি সিনেমা দেখতে দেখতে হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরন শুরু করেছিলে! উল্টা পাল্টা বকছিলে!” নিষাদ বলল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে আসলাম। শরীরটা ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। ডাক্তার দেখানো দরকার। আর হরর মুভি দেখাও বন্ধ করতে হবে। মনের উপর খুব বেশি চাপ ফেলছে!
বেডে শুয়ে খেয়াল করলাম নিষাদ এসে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ভঙ্গীটা আমার খুব পরিচিত। এটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সে। এর মানে হচ্ছে নিষাদ কিছু একটা বলতে চায়, অনুমতি দরকার!
অনুমতি দিলাম, “কি বলবে বল, নিষাদ!”
“আমি একটা কবিতা লিখেছি ড্যাড। ইংলিশ পোয়েম”।
আমি হাসলাম। আমিও স্টুডেন্ট লাইফে ভাল ইংরেজি কবিতা লিখতাম। এই প্রতিভা নিষাদ জেনেটিকেলি পেয়েছে। বললাম, “তুমি পড়ে শোনাবে নাকি আমি পড়ব?”
“আমিই পড়ে শুনাই?”
“শুনাও!”
নিষাদ শুরু করল...
My Mother seems so far away from me,
On that beautiful white shore across the sea.
Yet I remember love’s soft glow upon her face,
And the feel of her touch and tender embrace.
When I am weary from the burdens I’ve borne,
And the path is unclear and I feel so forlorn,
I remember her loving support was always near,
And her advice made the path ahead seem clear.
When I feel there is no one who seems to care,
Or when the heartache seems too hard to bear,
I remember how she always stood by my side,
And would tenderly wipe away the tears I cried.
When there are moments of great joy and pride,
And I wish my Mother was standing at my side,
I remember she saw more than I thought I could be,
And know I owe my triumphs to her belief in me.
When I reminisce about the things she used to say,
And I miss her and think she is so far away,
I remember what she gave lives on through me,
And one day I’ll see her on the shore across the sea.
কবিতা শেষ করে নিষাদ আর দাঁড়াল না। ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এই কবিতা কেন লিখেছ তুমি?”
নিষাদ জবাব দিলনা। রুমের দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল।
জেনির সাথে একবার কথা বলা দরকার। নিষাদকে নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। জেনি আর আমার বিয়েটা আটকে আছে ওর কারনেই। নিষাদ ব্যাপারটা কীভাবে নেবে সেটা না বুঝে আমি ফাইনাল কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা।
জেনিকে ফোন দিলাম। সে রিসিভ করতেই বললাম, “জেনি একটা সমস্যা হয়েছে”।
জেনি বলল, “কি সমস্যা?”
“মনে হচ্ছে নিষাদ তার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানে!”
“মানে? অসম্ভব!” জেনির কণ্ঠে অবিশ্বাস টের পেলাম।
“হ্যা... সে আজ একটা কবিতা লিখেছে তার মাকে নিয়ে। কবিতার ভাষা সন্দেহজনক!”
দুজনে এ বিষয়ে মিনিট পাঁচেক কথা বলে ফোন রাখতে যাচ্ছি তখন দরজায় নকের শব্দ হল।
আমি বললাম, “ভেতরে এস নিষাদ”।
নিষাদ ভেতরে এলনা, দরজা একটু ফাঁক করে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে “কবিতাটা আমি লিখিনি ড্যাড, বেলিন্ডা স্টলার নামে একজন মহিলা লিখেছেন” বলেই চলে যেতে উদ্যত হল।
আমি ডাকলাম, “নিষাদ! দাড়াও”।
নিষাদ দাঁড়াল।
ভেবেছিলাম কেন মিথ্যে বলেছে তা জিজ্ঞেস করব। কিন্তু জানি জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পাওয়া যাবেনা! এইধরনের আচরন নিষাদ হরর মুভি দেখে দেখে শিখেছে। আমি বললাম, “কাল বিকালে তোমার কোন কাজ আছে?”
নিষাদ ঘুরে তাকাল, “না কাজ নেই। কেন?”
“কাল আমি আগে আগে অফিস থেকে ফিরব”।
“নতুন মুভি দেখার জন্য?”
“নাহ! কালকে লং ড্রাইভে যাব। অনেক দূরের পথে!”
নিষাদকে খুব একটা আগ্রহী মনে হচ্ছে না। সে বিনা বাক্যব্যয়ে আমার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ছেলেটাকে আর হরর মুভি দেখানো যাবেনা! অন্য কিছুতে আগ্রহী করে তুলতে হবে!
***
আমি সাধারণত কাউকে কথা দিলে সেটা রাখার আপ্রান চেষ্টা করি। অফিস থেকে তাই আজ আগেই ফিরেছি। নিষাদকে নিয়ে লাঞ্চ সেরেই বেরিয়ে গেছি লং ড্রাইভে। আমরা যাচ্ছি ময়মনসিংহের হোতাপাড়ার দিকে। উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছাকাছি কিছুটা সময় কাঁটিয়ে আসা। এতে করে মাথাটা একটু হালকা হবে। নিষাদকে ঘুরাঘুরি করা, বাইরের জিনিস দেখা- এসবের প্রতি আগ্রহী করে তোলা গেলে হয়ত হরর মুভি দেখার নেশাটা একটু কাটানো যাবে।
বিকেলের নরম রোদ পড়েছে রাস্তায়। দুধারে ঘন জঙ্গল। এদিকটাতে জনবসতি খুব একটা নেই। জঙ্গলের একপাশে দেখলাম একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। মনে হচ্ছে এই রাস্তায় লোক-চলাচল বিশেষ হয় না। খুব ভাল লাগল আমার। ড্রাইভারকে বললাম রাস্তার ধারে সাইড করে গাড়িটা থামাতে।
“এখানে থামাচ্ছ কেন ড্যাড?” নিষাদের প্রশ্ন।
“দেখছ না কি সুন্দর জায়গা। চল একটু নেমে ঘুরে দেখি”।
ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে দুজনে নেমে এলাম। মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে এলাম বেশ খানিকটা পথ। এখান থেকে জঙ্গলটা ক্রমশ ঘন হয়েছে। রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে রাখা গাড়িটা আর চোখে পড়ছে না।
“তোমার ভাল লাগছে না যায়গাটা, নিষাদ?”
“না” নিষাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কেন নিষাদ?”
“আমার ভয় করছে”।
দিনরাত হরর মুভি দেখা নিষাদের মুখে ভয় পাওয়ার কথা শুনে আমার হাসি পেল। আরও কিছুদূর হেঁটে এলাম দুজনে। হঠাৎ কুকুরের কান্নার মতো একটা ডাক শুনতে পেলাম। দূর থেকে আসছিল আওয়াজটা। নিষাদ সতর্ক হয়ে দাড়িয়ে গেল।
“কি হল?” এস আর কিছুক্ষন হাটি!
“আমার মনে হচ্ছে ওটা নেকড়ের ডাক”।
আমার হাসি পেল। হাসি আটকে রেখে বললাম, “কি আবল তাবল বলছ নিষাদ? হরর মুভি দেখে মাথা গেছে তোমার! ঢাকা শহরে নেকড়ে আসবে কোত্থেকে?”
“আমি ফিরব বাবা?”
আমার তখন একটা পুরনো একটা রাস্তা চোখে পড়েছে। “যাব তো অবশ্যই, তার আগে চল ঐ রাস্তাটা কোথায় গেছে সেটা একটু দেখে আসি। মনে হচ্ছে কাছে ধারে একটা গ্রাম আছে”।
“আমি আর যাবনা” গোঁ ধরল নিষাদ।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “ঠিক আছে আমি তোমাকে জোর করছি না। তুমি গাড়িতে গিয়ে বস। আমি খানিক বাদেই আসছি”।
নিষাদ যেন হতাশ হয়েছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে গাড়ির দিকে ফিরে চলল। আমি কিছুক্ষন তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার রাস্তাটা ধরলাম নিশ্চিন্ত মনে। নিষাদের আপত্তির কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছি না। রাস্তার শেষটা কোথায় সেটা দেখার জন্য আমার মনে একটা জেদ চেপেছে।
কতক্ষন যাবত হাঁটছি বলতে পারব না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই রাস্তা আর কখনো শেষ হবেনা। বাড়িঘর বা লোকজন কিছুই চোখে পড়ল না। নির্জন পরিত্যক্ত গোছের জায়গা। এই ব্যাপারটা আগে খেয়াল হয়নি। রাস্তার বাঁকে এসে যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করছিল, তা এই জায়গাটার পরিত্যক্ত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অবচেতন মন বারবার তাগাদা দিচ্ছে ফিরে যাওয়ার জন্য। একদিনের জন্য ঘুরাঘুরি যথেষ্ট হয়েছে। আমি ফিরতি পথ ধরলাম। এতক্ষন দূর থেকে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা দুরপাল্লার যানবাহনের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এখন তাও শুনছি না। আরও একটা বিষয় হচ্ছে, ফেরার পথে জঙ্গলটা একটু বেশি ঘন মনে হচ্ছে।
আরও কিছুদূর হাটার পর বুঝলাম পথ হারিয়েছি। গাজীপুর অঞ্চলের এই জঙ্গল সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি আমি। এখানে রাত বিরাতে ডাকাতি হয়, আর মানুষ মেরে ফেলে যাওয়াটা নতুন কোন বিষয় না। এতক্ষনে ভয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছি আমি। দাঁড়িয়ে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করছি কোন দিক দিয়ে এসেছিলাম। এখানে সেখানে ঝোপঝাড় আর গর্ত দেখছি। একটা রাস্তা দেখলাম এঁকেবেঁকে একটা ঘন ঝোপের দিকে এগিয়ে গেছে, তারপর তার পিছনে গিয়ে হারিয়ে গেছে। একটা গা-ছমছমে অনুভূতি হল। হাত পা অবশ হয়ে এল। এই প্রথম বারের মত মনে হল, নিষাদের সাথে ফিরে গেলেই ভাল করতাম।
ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাথার উপর মেঘও ঘনীভূত হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে গম্ভীর মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে। সেই গর্জনকে ভেদ করে আবার মধ্যে মধ্যে রহস্যজনক এক চিৎকার শোনা যাচ্ছে– যেটাকে নিষাদ ভেবেছিল নেকড়ের চিৎকার। সেদিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় কনকনে ঠান্ডা বাতাস লাগল গায়ে।
হাঁটছি আমি। মনে হচ্ছে যেন পেরিয়ে এসেছি অন্তবিহীন পথ। মাঝে মধ্যেই আকাশ বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে এক ঘন জঙ্গল যার শুরু বা শেষ খুজে পাওয়া সম্ভব হবেনা। জায়গাটা তুলনামূলকভাবে নিস্তব্ধ। মাথার অনেক উপরে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ঝড়ের অন্ধকার যেন মিশে গেছে রাতের অন্ধকারে। এই অবস্থায় সেই নেকড়ের অদ্ভুত শব্দটা আমার চারপাশের নানা শব্দের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
আমার মাঝে একটা ঘোরলাগা অনুভূতি সৃষ্টি হল। এই অর্ধ চৈতন্যাবস্থা স্থায়ী ছিল অনেকক্ষণ। হঠাৎ একটা গা-ঘিনঘিনে বমি বমি ভাব হল। প্রকাণ্ড স্থবিরতা গ্রাস করল আমাকে। মনে হল, সারা পৃথিবীটা হয় ঘুমাচ্ছে, নয় মরে গেছে– শুধু আমার কাছে বসে থাকা কতগুলো জানোয়ারের নিঃশ্বাসের আওয়াজ সেই নৈঃশব্দের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। গলার কাছে একটু উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম। তারপর ব্যাপারটা টের পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিণ্ডটা ঠান্ডা হয়ে এল ভয়ে। একটা বিরাট জন্তু আমার উপর শুয়ে আমার গলাটা চাটছে। ভয়ে নড়তে পারলাম না। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আমার উপর এক দৈত্যাকার নেকড়ের দুটো বড়ো বড়ো চোখ জ্বল জ্বল করছে। ফাঁক হয়ে থাকা বিরাট মুখের মধ্যে চকচক করছে ধারালো সাদা দাঁত। তার গরম জান্তব ক্ষুরধার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার উপর।
হঠাৎ আমার চোখ দুটো নেকড়েটাকে ছেড়ে গেল। দূরে কিছু একটার নড়াচড়া টের পাচ্ছি আমি। মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কে ওটা? অবয়বটা খুব বেশি পরিচিত। আরও কাছে এগিয়ে এল সেই ছায়ামূর্তি। এবার আর চিনতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। নিষাদ! আমার ছেলে। নিষাদের চোখদুটো নেকড়ের মতই জ্বলজ্বল করছে, মুখের ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে ভয়ংকরদর্শন দাঁত। আমি একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
হুঁশ ফেরার পর দেখলাম কোথায় জঙ্গল, কোথায় নেকড়ে, আমি বাড়িতেই বসে আছি। প্রথমে খানিকক্ষণ কিছু মনে ছিল না। তারপর মনে পড়তেই গোঙানির মত একটা আওয়াজ করে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। দেখলাম নিষাদ বসে আছে কাছেই। ডিভিডি প্লেয়ারে মুভি চলছে।
“কি হল ড্যাড?”
“কি ব্যাপার নিষাদ? আমরা এখানে এলাম কখন? আমরা কি লং ড্রাইভে যাইনি?”
“নাহ ড্যাড”।
“কেন?”
“তুমিই তো অফিস থেকে ফিরে বললে আজ শরীরটা ভাল লাগছেনা। আজ লং ড্রাইভে যাবেনা!”
“তাহলে মুভি দেখছি কেন?”
“নতুন কোন মুভি বাসায় নেই বলে তুমিই তো বললে ড্রাকুলাস গেস্ট মুভিটা ছাড়ার জন্য। আমি তাই করলাম!”
আমি মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। এতক্ষনে সবটা মনে পড়েছে। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোন সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারে ভুগছি আমি। নইলে কোনটা স্বপ্ন, কোনটা বাস্তব- তা প্রায়ই গুলিয়ে যাচ্ছে কেন?
বিছানায় শুয়ে পরলাম আমি। সিলিঙের ফ্যানটা কি আস্তে ঘুরছে নাকি? বাতাস এত কম লাগছে কেন? নিষাদের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, “বাবা, ডিনার করবেনা?”
নিষাদ আমার বেডরুমের দরজায় দাঁড়ানো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “না, তুমি খেয়ে নাও”।
নিষাদ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকল।
“কি ব্যাপার কিছু বলবে?”
“আমি একটা কবিতা লিখেছি ড্যাড। ইংলিশ পয়েম”।
“আবার একটা কবিতা নকল করেছ?”
“না ড্যাড, আমি নিজে লিখেছি এবার” নিষাদ তার শার্টের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলতে লাগল।
আমি বললাম, “রেখে যাও। পরে পড়ব”।
“তুমি ভুলে যাবে ড্যাড, আমি তোমাকে পড়ে শুনাই?” নিষাদ আমার মাথার কাছে চলে এসেছে।
আমি কিছু বললাম না।
নিষাদ শুরু করল...
A face that is always on my mind,
A smile I have seen a million times,
Two eyes that would light up the sky at night,
One last battle you could not fight,
The day was long, then night then morn.
I knew that soon you would be gone,
I clasped your hand so warm in mine,
Soon we would be out of time,
To stay with us you fought so hard,
A million pieces went my heart,
Now a photo I look at to see your smile,
I keep your number on my speed dial,
A video I watch to hear your voice,
This I do.... I have no choice.,
But great memories I will always keep with me,
Your love in my heart for eternity,
I never got to say goodbye,
To understand why, I can but try,
Waiting in heaven from this moment on,
'Till god asks you to bring me home....
কবিতা শেষ হতেই বললাম, “অনেক ভাল লিখেছ নিষাদ। কিন্তু এই একই থিম নিয়ে খুব বেশি লেখার দরকার আছে কি? অন্য কিছু নিয়ে লেখার চেষ্টা কর”।
নিষাদ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। আমি শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। হঠাৎ আবার মাথার কাছে নিষাদের কণ্ঠস্বর শুনলাম। “ড্যাড, একটা কথা বলব”।
আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললাম, “আবার কি বলবে?”
“ড্যাড, এই কবিতাটা!”
“হুম”
“এটাও আমি লিখি নাই। লিখেছে লরনা ফারগুসন নামে বাইরের এক মহিলা কবি”।
আমি নিষাদের কথা শুনছিনা। আমার ঘুম দরকার! ঘুমিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি অতলে..
***
আজ জেনির সাথে ডেট ছিল। অফিস শেষে সরাসরি জেনির সাথে গিয়ে মিট করলাম। তারপর গেলাম বেইলি রোডে। থার্টি থ্রি তে বসে দুজনে খেলাম। জেনির পছন্দের একটা শাড়ি কিনে দিলাম। ঘুরাঘুরি করতে করতে ৮টা বেজে গেল। জেনিকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার পথে নির্জন রাস্তা দেখে দুজনে একটা লং কিস করলাম । মেজাজটা তাই খুব ফুরফুরে লাগছে।
বাড়ির কাছের ডিভিডির দোকানটা ছাড়িয়ে এলাম। আজ থেকে আর কোন হরর মুভি দেখব না। যদিও নিষাদ দুই তিন বার অনুরোধ করেছে আনডিভাইডেড মুভিটার ডিভিডি আনার জন্য। তার কোন এক ক্লাসমেট মুভিটা দেখে ভাল বলেছে। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হরর মুভি। কিন্তু আমি আর হরর মুভি দেখব না বলে ঠিক করেছি। এই হরর মুভি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে এক একটা দুঃস্বপ্নে পরিনত করেছে। আমি আর নিষাদের এই খেলার গুঁটি হবনা।
নিষাদ চুপচাপ ড্রয়িং রুমের এক কোনায় বসে ছিল। আমাকে দেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। সম্ভবত বুঝতে পেরেছে আমি মুভিটা আনিনি। আমি চেহারায় কাঠিন্য ধরে রেখে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলাম। কাপড় পালটাচ্ছি, দেখলাম নিষাদ নিঃশব্দে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
"কিছু বলবে?'
নিষাদ নিচু কণ্ঠে বলল, "একটা জিনিস দেখাব তোমাকে'।
মুভি এনেছি কিনা জিজ্ঞেস না করায় আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিষাদের সামনে মিথ্যে বলা কঠিন। আমি বললাম, "কি দেখাবে?'
"আগে ডিনার সেরে নাও। তারপর দেখাচ্ছি'।
আমি রাতের খাবার খেতে খেতেই আর একবার জিজ্ঞেস করলাম, "কি দেখাতে চাও নিষাদ?'
নিষাদ বলল, "বললাম তো খাওয়ার পর দেখাব'।
"খাওয়ার পরই দেখব। আপাতত কি দেখাতে চাও, সেটা তো বলতে পার!'
"তুমি গতকাল রাতে একটা কবিতা লিখেছ' নিষাদ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল।
আমি মুখের ভেতরে ভাত চিবান বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলাম।
নিষাদ আবার বলল, "ইংরেজি কবিতা'।
"আমি কবিতা লিখেছি! অসম্ভব! কখন লিখলাম?' মুখের ভেতরে ভাত থাকায় কথাগুলো অস্পষ্ট শোনাল।
নিষাদ বলল, "খেয়ে নাও ড্যাড, তারপর দেখাচ্ছি'।
আমি আর খেতে পারলাম না। মুখের ভেতরে খাবার স্বাদহীন মনে হচ্ছে। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। আমি কবিতা লিখলাম কখন? ঘুমের ঘোরে? কিন্তু কেন লিখব? কি নিয়ে লিখব?
এঁটো ভাত ফেলে রেখে উঠে পড়লাম। বেসিনে হাত ধুয়ে আমি নিষাদের পেছন পেছন তার রুমে ঢুকলাম। নিষাদ তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা হাতে লেখা কাগজ বের করে দিল। ইংরেজিতে লেখা কবিতা। ঠিক যেমনটি নিষাদ এর আগে দুবার দেখিয়েছে আমাকে।
Alone with the raging in my soul,
I know not where to turn.
I have opened up to some,
But this raging makes me burn.
My heart and soul are screaming,
But I try to hold it in,
For, they make me feel I'm wrong,
That my hurt is like a sin.
I am fighting for a way,
To be not weak and small.
But my pain is not subsiding,
Please someone hear my call!
I've done what they have asked,
Tried going down their path.
But they know not why I'm hurting,
They haven't felt the wrath.
I look to them sincerely,
I TRY to help them SEE,
But, they just don't understand it,
So they choose to leave me be.
I long to just be normal,
Then maybe they'll accept,
The reasons why I need them,
The reason why I've wept.
The demons they hold strong,
As, they've broken my life down.
Are they afraid of these monsters?
Is that why they seem to frown?
I'm afraid to admit,
The help that I need.
I don't want them to know,
That in my pai I BLEED.
Because he was unkind,
So many years before,
I think her death, they want me,
To move on and IGNORE.
Nilufar, can you hear me?
Can you please let them know,
That special part of you
That I just can't let go?
Is anybody listening?
Does anybody SEE?
Help me to set myself in rest
Please help to set me free!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কাগজের দিকে। এই কবিতা আমি লিখেছি! নিষাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, "তুমি মিথ্যে বলছ নিষাদ! এটা আমি লিখিনি'।
নিষাদ বলল, হাতের লেখাটা দেখ ড্যাড। কি মনে হয়? ওটা কার লেখা।
মনে হওয়ার কিছু নেই। নিজের হাতের লেখা চিনতে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। আমি এক দৃষ্টিতে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ করে মাথাটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে।
"ড্যাড, মুভি এনেছ?'
"না'
"আমি জানতাম তুমি মুভিটা আনবেনা'।
আমি কিছু বললাম না। আমার হাটুর নিচ থেকে শরীরটা কেমন অবশ লাগছে।
"ড্যাড, এখন থেকে তোমাকে আর মুভি আনতে হবেনা'।
"আচ্ছা' আমি বুঝতে পারছি আমার এখনি শুয়ে পরা দরকার। শরীর খারাপ করবে বুঝা যাচ্ছে। আমি পা বাড়ালাম নিজের রুমে দিকে।
"কেন আনতে হবেনা সেটা জিজ্ঞেস করলেনা?'
আমি নিষাদের রুম থেকে বেরতে বেরতে বললাম, "তুমি আর মুভি দেখবেনা'।
"না ড্যাড। এখন আরও বেশি করে দেখতে পারব'।
আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, "কীভাবে?'
"আমার কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়েছি, ড্যাড। এখন থেকে ভাল ভাল মুভি ডাউনলোড করে নেব যাবে খুব সহজেই'।
আমি তিক্ত ভঙ্গিতে একটু হাসলাম।
রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। মাথা ঝিম ঝিম করছে, হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু কোন শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। মানসিক সমস্যাটাই বেশি ভোগাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে নিজের অজান্তে কবিতা লিখা শুরু করেছি। আমার জীবনে গোপন করার মত অনেক কিছুই আছে। এভাবে ঘোরের মধ্যে থাকা অবস্থায়, কখন কোন বেফাঁস বিষয় বেরিয়ে আসে তার ঠিক নেই। সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হওয়া কম্পালসরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশের রুম থেকে স্পিকারের আওয়াজ আসছে। নিষাদ সিনেমা ছেড়েছে। এত জোরে আওয়াজ দিয়েছ কেন? সিনেমায় বোধহয় ভায়োলেন্স অনেক বেশি। খুব বেশি চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে। আমি বার কয়েক এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলাম। নিষাদকে ভলিউম কমাতে বলে আসা দরকার।
নিষাদের রুমের সামনে গিয়ে দাড়াতেই চমকে উঠলাম। "ভেতরে এস বাবা। মুভি মাত্র শুরু হয়েছে'।
আমি মুভি দেখতে আসিনি। এসেছি ভলিউম কমাতে বলার জন্য। কিন্তু কিছু একটা আমাকে তা বলা থেকে বিরত রাখল। মুভিটা আমাকে চুম্বকের মত টানছে, নিষাদের পাশে গিয়ে বসে পরলাম।
মুভির প্রধান চরিত্র একটি অল্প বয়সী মেয়ে- অ্যানা। অগ্নিকান্ডে মায়ের মৃত্যু দেখার পর থেকে ক্রমাগত আত্মহত্যার চেষ্টা করার কারনে তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। প্রায় ১০ মাসে পর সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। অ্যানার বাবা ডেভিড একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ডেভিড তাকে সমুদ্রতীরের একটা নির্জন কটেজে নিয়ে আসল। বাড়িতে ফিরেই আনা দেখল তার মায়ের সেবাদান কারী নার্স এলিজাবেথ এখন তার সৎ মা। মুভি কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল অ্যানা মাঝে মাঝে তার মৃত মায়ের আত্মাকে দেখতে পাচ্ছে! ছোটবোন এলেক্স আর সে মিলে আলোচনা করে নিশ্চিত হল র্যাচেলই তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী। র্যাচেল আর ডেভিড মিলে তাদের মাকে মেরে ফেলেছে নিজেদের পথের কাটা দূর করার জন্য। অ্যানা উঠে পরে লাগল তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। প্রয়োজনে সে তার বাবাকে
Published on September 06, 2013 22:19
August 15, 2013
সময়ক্রম (আমার ৫০তম গল্প)
৪ঠা নভেম্বর, ১৯৮৮
স্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
“সুপ্রিয় দর্শকবৃন্দ, এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে অবস্থান করছেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট পদার্থবিদ প্রফেসর ইউসুফ শিকদার। আপনারা জানেন যে প্রফেসর ইউসুফ সম্প্রতি বিশ্ব বিজ্ঞান পরিষদ আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলন’ এ ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। আমরা এখন তার সাথে এ বিষয়ে কিছু কথা বলব........”
টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই মিসেস ইউসুফ সখিনাকে ডাকলেন। “সখিনা.... এক কাপ চা দিয়ে যা তো”!
উপস্থাপিকা বলছে, “স্যার, কেমন আছেন?”
প্রফেসর ইউসুফ শিকদার ভরাট কণ্ঠে জবাব দিলেন, “ভাল আছি”।
“স্যার, দুদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনি ছিলেন আমাদের অঞ্চলের একমাত্র প্রতিনিধি। কেমন কাটল দিনগুলো?”
মুহূর্তে প্রফেসরের হাসি খুশি চেহারা ম্লান হয়ে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “বিশ্ব বিজ্ঞান পরিষদ হচ্ছে একটা বোকার স্বর্গ। আর তাদের সম্মেলনে যতসব থার্ড ক্লাস মাথা মোটা উজবুকগুলো এসে মিলেছে । দিনগুলো মোটেও ভাল কাটেনি”।
কিন্তু উপস্থাপিকার কণ্ঠে উৎসাহের অভাব নেই, “স্যার, বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনার উত্থাপন করা থিওরির তীব্র বিরোধিতা করেছে বিজ্ঞান পরিষদের সদস্যরা। বিশিষ্ট জনেরা বলছেন বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনার বক্তব্য এই উপমহাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?”
“আমার আসলে বলার কিছু নেই। শুধু বলব, আমার থিওরি ছিল খুব সাধারণ। কিন্তু এই সাধারন যুক্তি বোঝার মত মানসিকতা তাদের মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করতে করতে তারা এক একটা রোবটে পরিনত হয়েছে। চিন্তা শক্তি, বিবেক বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে”।
“স্যার, আপনি কি আপনার সেই থিওরিটুকু আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?”
“হ্যা, সাধারন মানুষের সামনে এই থিওরিটুকু উপস্থাপনের জন্যই আমি এই সাক্ষাৎকারে রাজি হয়েছি”।
“বলুন স্যার”।
প্রফেসর ইউসুফ শিকদার বড় করে একটা দম নিয়ে শুরু করলেন, “প্রতিটি মানুষের মাঝে জিনগতভাবে কিছু ক্ষমতা বিদ্যমান। কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে সেটা অর্জন করে নিতে হয়। একটা উদাহরন দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে।
মানব শিশুর হাঁটতে শেখার কথা ভাবুন। একটি সুস্থ স্বাভাবিক মানব শিশুর মাঝে হাঁটার ক্ষমতা আছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে নিজ থেকে হাঁটার চেষ্টা করে, প্রথম দিকে পারেনা, হোঁচট খায়, ব্যাথা পায়, ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয় কিন্তু একটা সময় কিন্তু সে হাঁটতে শিখে ফেলে। আর একটা উদাহারন হতে পারে সাঁতার কাটা। প্রত্যেকটি স্বাভাবিক মানুষের মাঝে সাঁতার কাটার সহজাত ক্ষমতা বিদ্যমান। কিন্তু যে কখনো পানিতে নামেনি সে যদি হঠাৎ কোন নৌ দুর্ঘটনায় পরে যায়, তাহলে কি সে সাঁতার কেটে জীবন বাঁচাতে পারবে? অবশ্যই নয়। তাকে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে সাঁতার কাটার ক্ষমতা আয়ত্তে আনতে হবে। সাইকেল চালানোর কথাই ধরুন। প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষের মাঝে সাইকেল চালানোর সহজাত প্রবৃত্তি আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অনুশীলন ছাড়া সাইকেল চালানোর ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়। একই ভাবে আমরা আরও অসংখ্য উদাহারন টানতে পারি। যেমনঃ ঘোড়ায় চড়া, জিমনাস্টিক, যেকোনো ক্রীড়ায় দক্ষতা অর্জন, পিস্তল চালনা ইত্যাদি। পর্যাপ্ত অনুশীলনের মাধ্যমে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অসংখ্য ক্ষমতা অর্জন করে নিতে পারে।
আমার গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এমন কিছু ক্ষমতা খুঁজে বের করা যা মানুষের মাঝে জিনগত ভাবে আছে কিন্তু অনুশীলনের অভাবে অর্জন করে নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা! দীর্ঘদিন এই বিষয়ের উপর কাজ করতে করতে একটা সময় আমি খুব অদ্ভুত একটা তত্ত্ব আবিস্কার করতে সমর্থ হই। মানুষের ডিএনএর মাঝে টাইমলাইন ও স্পেস ভেদ করে যাওয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে! অর্থাৎ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে অতীত অথবা ভবিষ্যৎ ভ্রমন করা সম্ভব, কিন্তু অনুশীলনের অভাবে সেই ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছেনা। এটাই হচ্ছে আমার থিওরি”।
উপস্থাপিকার পরবর্তী প্রশ্ন প্রস্তুত ছিল। “স্যার, আপনার থিওরি নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন। ল্যাটিন আমেরিকান বিজ্ঞানী ফিল কলিংস ব্যাঙ্গ করে বলেছেন, মানুষের পক্ষে হেঁটে হেঁটে চাঁদে যাওয়া সম্ভব কিন্তু অনুশীলনের অভাবে তা পারছে না”।
প্রফেসর ইউসুফ শিকদারকে কিছুটা বিচলিত মনে হল। “আমি জানি আমার কথা শুনে তার মত অনেকেই হয়ত হাসছেন, ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করছেন। তাদের কাছে আমি বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যা করেছি কিন্তু তারা যুক্তি মানতে নারাজ”।
সখিনা এসে চা দিয়ে গেল। মিসেস ইউসুফ চায়ে চুমুক দিলেন।
উপস্থাপিকা বলছে “স্যার, আমাদের উদ্দেশ্যে কি আপনি যুক্তিগুলো একটু ব্যাখ্যা করবেন?”
“অবশ্যই। এবং সে জন্যই আজ আমি মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি মানুষের পক্ষে যে ক্ষমতা অর্জন সম্ভব, সৃষ্টিকর্তা তা অনুশীলন করার সুযোগ রেখেই তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। এখন প্রশ্ন করতে পারেন মানুষের পক্ষে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ ভ্রমনের অনুশীলন করা সম্ভব কিনা। আমি বলব অবশ্যই সম্ভব। অন্যান্য ক্ষমতা অর্জনের অনুশীলনের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে- একটা নির্দিষ্ট যায়গায় অবস্থান করেই অন্যান্য ক্ষমতাগুলো অর্জনের জন্য অনুশীলন করা সম্ভব হয়। যেমন সাইকেল চালনা, সাঁতার শেখা এগুলোর জন্য নির্দিষ্ট যায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে হয়না। কিন্তু সময়ের সাথে স্পেস খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অর্থাৎ একটি ছাড়া অপরটির ব্যবহার সম্ভব নয়। সময় ভেদ করে যেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই স্পেস পরিবর্তন করতে হবে। ঘাবড়াবেন না। একটা উদাহারনের মাধ্যমে আমি বিষয়টা বুঝিয়ে দিচ্ছি।
এখন আমাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। এটি জিএমটি+৬ টাইম জোনের মাঝে পরেছে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী বাজে সন্ধ্যা ৭টা। ল্যাটিন অ্যামেরিকান বেশ কিছু দেশ জিএমটি-১০ বা জিএমটি-৯ টাইম জোনের আন্ডারে পরেছে। অর্থাৎ আমাদের থেকে প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা পেছনে তাদের অবস্থান। স্থানীয় সময় অনুযায়ী কোথাও বাজে রাত ২টা কোথাও বাজে রাত ১টা। এখন আপনি যদি প্লেনে চেপে ১৫ ঘণ্টার আগেই সেখানে পৌছাতে পারেন, তাহলে সেখানকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী আপনি আরও একবার সন্ধ্যা ৭টার সময়টা ফিরে পাচ্ছেন। অর্থাৎ দুটি যায়গায় একই সময়ে আপনি অবস্থান করার সুযোগ পেলেন। কিন্তু একই যায়গায় অবস্থানের মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়।
এই অনুশীলন যথেষ্ট নয়। দীর্ঘসময় ব্যাপী একটা নির্দিষ্ট সময়ে ভিন্ন ভিন্ন যায়গায় অবস্থানের দ্বারা মানুষ অতীত ও ভবিষ্যৎ ভ্রমনের ক্ষমতা অর্জন করে নিতে সক্ষম হবে”।
“স্যার, এই থিওরি কি প্রমান করে দেখানো সম্ভব?”
“সম্ভব। আমি দীর্ঘদিনের রিসার্চ থেকে বের করেছি দিনের অর্ধভাগ অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা ধরে একটা নির্দিষ্ট রুটে ভ্রমন করলে টাইম লাইন ক্রস করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেজন্য প্রচুর আর্থিক সাহায্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। যার কোনটাই আমি পাবনা”।
“আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?”
প্রফেসর ইউসুফ হাসলেন, “আমি বাকিটা জীবন চেষ্টা করে যাব এই থিওরি প্রমান করার। কখনো সফল হতে পারব না কিনা জানিনা। কিন্তু বেঁচে থাকতে হাল ছারব না”।
শঙ্কিত চোখে টিভি পর্দায় স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন মিসেস ইউসুফ শিকদার। স্বামীর গলার এই সুর তার অনেক দিনের চেনা। সমাধানে পৌঁছানোর আগে তাকে থামানো সম্ভব নয়।
****
৩রা নভেম্বর, ২০১৩
স্থানঃ চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
জামিল সাহেব দিনের মধ্যে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে করেন তা হচ্ছে পেপার পড়া। রিটায়ার করার পর থেকেই সকাল বেলা চায়ের কাপে চুমুকের ফাকে ঘণ্টা খানেক লাগিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকার প্রত্যেকটা লাইন পড়া তার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ পত্রিকা খুলেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। প্রথম পাতাতেই বড় করে একটা নিউজ ছেপেছে। পড়তে পড়তে জামিল হায়দার চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার কথা ভুলে গেলেন।
“বিখ্যাত মানুষের অদ্ভুত খেয়াল”
আগামীকাল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচিত্র অভিনেতা সাজিদ খান এর ৩০ তম জন্মদিন। সাজিদ খান নামটি এই উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। তার জন্ম ঢাকায়। ছোটবেলায় পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। অসাধারন অভিনয় প্রতিভার জোরে নিজেকে হলিউডের চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অস্কার, গোল্ডেন গ্লোবের মত বড় বড় পুরস্কার সব আদায় করে নিয়েছেন খুব কম বয়সেই।
এবছর জন্মদিন পালন উপলক্ষে তার মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চেপেছে। তিনি একই দিনে ১২ টি ভিন্ন যায়গায় ১২বার ১২টি কেক কেটে নিজের জন্মদিন পালন করতে চান। আর সেই ১২ বার জন্মদিন পালনের ব্যাপারটিও অদ্ভুত। স্থানীয় সময় অনুযায়ী প্রতিবার ঠিক রাত ১২ টার সময় কেক কেটে তিনি নিজের জন্মদিন পালন করবেন। তিনি যদি সফল হন তবে এটা হতে পারে একটা বিশ্বরেকর্ড। গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ইতিমধ্যে তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে। এছাড়াও অনেক কোম্পানি তাকে স্পন্সর করতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে এক্সন মোবিল সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্যাটেলাইট টিভি প্রোভাইডার ডিরেক্ট টিভির কিনে নিয়েছে সমস্ত প্রোগ্রাম লাইভ দেখানোর সত্ত্ব। গ্রিনিচ মান মন্দিরের টাইমজোন অনুযায়ী সাজিদ খান একটি রুট বেছে নিয়েছেন। এই রুট ধরে চলার পথে ১২ বার তিনি থামবেন এবং জন্মদিন পালন করবেন।
চার্টার্ড প্লেন ভাড়া করা হয়েছে। এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় এয়ারক্র্যাফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিএকশন ইঞ্জিন’স এর তৈরি আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন এয়ারক্র্যাফট স্কাইলন স্পেস প্লেন। এই প্লেনের গতির সাথে রকেটের গতির তুলনা চলে। প্লেনটি ৩০০ যাত্রী নিয়ে মাত্র ৪ ঘণ্টায় ইউরোপ থেকে অস্ট্রলিয়া পাড়ি জমাতে পারে। প্লেনটির চিফ ডিজাইনার অ্যালান বন্ড-এর ভাষ্যমতে প্লেনটি একটি স্ট্যান্ডার্ড রানওয়ে থেকে টেক অফ করলে ঘণ্টায় প্রায় ১৯০০০ মাইল স্পীড তুলতে সক্ষম। চলার রুটে প্রয়োজনে প্লেন বদল করতে হতে পারে তাই বিকল্প প্লেনের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। তবে বিকল্প প্লেনের ব্যবস্থা থাকলেও বিকল্প পাইলটের ব্যাবস্থা নেই। প্রধান পাইলট হিসেবে আছেন জন ল্যাম্পারড। তিনি এমিরেটস এয়ারলাইন কোম্পানির একজন দক্ষ ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ পাইলট। তার সহযোগী হিসেবে আছেন নায়ক সাজিদ খান নিজেই। উল্লেখ্য যে নায়ক সাজিদ খান চলচিত্রে অভিনয়ের আগে একজন বেসরকারি পাইলট ছিলেন। সাজিদ খান, তার স্ত্রী সুচিত্রা, পাইলট জোন এবং দুজন এয়ার হোস্টেস সহ মোট ৫ জন আরোহী নিয়ে প্লেনটি আকাশে উঠবে। একদিনের জন্য এই প্লেন ভাড়া করতে কি পরিমান অর্থ খরচ করতে হচ্ছে সাজিদ খানকে, এই প্রসঙ্গে সঠিক তথ্য জানা যায়নি, তবে সেটা কোটির ওপরে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। গোপন সুত্রে প্রকাশ, অ্যামাউন্টটি নয় অংকের! সম্ভাব্য অবস্থানের জন্য দেশগুলোর সরকার এবং তাদের বিমানবন্দর কতৃপক্ষের সাথে ইতিমধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আগামীকাল ঢাকার হযরত শাহজালাল রহঃ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে সাজিদ খান শুরু করবেন এই পথ চলা। সে যাত্রা শেষ হবে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে। সম্ভাব্য যে টাইমজোন ও দেশগুলোতে তারা থামবেন জন্মদিন পালনের জন্য তা নিচে উল্লেখ করা হলঃ
১. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ১২টা।
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৬.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ বাংলাদেশ
বিকল্প অবস্থানঃ নেই
২. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ১টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৫.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ মালদ্বীপ
বিকল্প অবস্থানঃ উজবেকিস্তান, পাকিস্তান
৩. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ২টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৪.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ ওমান
বিকল্প অবস্থানঃ আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, আরব আমিরাত
৪. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ৩টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৩.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ জর্ডান
বিকল্প অবস্থানঃ বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, সৌদি আরব
৫. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ৪টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০২.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ মিশর
বিকল্প অবস্থানঃ দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, জিম্বাবুয়ে
৬. বাংলাদেশ সময়ঃ ভোর ৫টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০১.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ আলজেরিয়া
বিকল্প অবস্থানঃ নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, তিউনিশিয়া
৭. বাংলাদেশ সময়ঃ ভোর ৬টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০০.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ আইভরি কোস্ট
বিকল্প অবস্থানঃ ঘানা, আইসল্যান্ড
৮. বাংলাদেশ সময়ঃ সকাল ৭টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০১.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ কেপভার্দ
বিকল্প অবস্থানঃ নেই
৯. বাংলাদেশ সময়ঃ সকাল ১০টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০৪.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ বলিভিয়া
বিকল্প অবস্থানঃ চিলি, ত্রিনিদাদ এন্ড টোব্যাকো
১০. বাংলাদেশ সময়ঃ সকাল ১১টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০৫.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ পেরু
বিকল্প অবস্থানঃ কিউবা, জ্যামাইকা
১১. বাংলাদেশ সময়ঃ দুপুর ১২টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০৬.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ কোস্টারিকা
বিকল্প অবস্থানঃ এল সালভাদর, মেক্সিকো
১২. বাংলাদেশ সময়ঃ বিকেল ৪টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -১০.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ
বিকল্প অবস্থানঃ নেই
লক্ষ করলে দেখবেন বিভিন্ন টাইমজোন পাড়ি দেয়ার ফাকে সাজিদ খান সুকৌশলে ইউরোপিয়ান দেশ গুলোকে এড়িয়ে গেছেন। অনেকে বলছেন ইউরোপে সাজিদ খানের জনপ্রিয়তা না থাকা এর প্রধান কারন। আবার অনেকেই বলছেন ইউরোপ হয়ে যাওয়াটা খুব বেশি ব্যায়বহুল হতে পারে তাই খরচ কমাতে এই ব্যাবস্থা। তবে সাজিদ খান বলেছেন, “যেভাবে সুবিধা হয়, কম ভ্রমনে লক্ষে পৌঁছানো যায় সেভাবেই প্লান করা হয়েছে। ইউরোপ- আফ্রিকা কোন সমস্যা নয়”। এদিকে এমন ইচ্ছা হওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে সাজিদ খান বলেন, “তেমন কোন কারন নেই। আমার স্বভাবটাই এমন একটু পাগলাটে। বিয়ের পর এই প্রথম জন্মদিন আমার। চেয়েছিলাম এবার এমন কিছু করতে যেন পৃথিবীবাসী অনেক দিন তা মনে রাখতে পারে”। “কিন্তু ১২ বারই কেন? কম বেশি নয় কেন?” এমন প্রশ্নের জবাবে সাজিদ খান বলেন, “আমি জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বর্তমান আবাস স্থল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে এই ভ্রমন শেষ করতে চাই। হিসেব করে দেখেছি এর মধ্যে ১২বার জন্মদিন পালন সম্ভব, তাই ১২ বার ঠিক করেছি। এছাড়া বিশেষ কোন কারন নেই”।
এদিকে সমালোচকরা বলছেন অদ্ভুত খেয়ালের বসে এত টাকা খরচ না করে সাজিদ খান এই টাকা দিয়ে খুব সহজেই ভাগ্যবঞ্চিত অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। সেটাও পৃথিবীবাসী অনেকদিন মনে রাখার মত একটা কাজ হত।
***
তারিখঃ ৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩
স্থানঃ কলকাতা, ভারত
মোবাইল থেকে ফেসবুকে চ্যাট করছিল দীপা। হঠাৎ মৌরির ফোন আসায় বিরক্ত হল। কল রিসিভ করে বলল, “কি ব্যাপার?”
“কি করছিস?”
“সুজয়ের সাথে চ্যাট করছিলাম। তুই কল দিয়ে তো দিলি ভেজাল করে”। বিরক্তি প্রকাশ পেল দীপার কণ্ঠে।
“আরে রাখ তোর সুজয়”। ওপাশ থেকে মৌরির গলায় উত্তেজনা টের পাওয়া গেল। “ভুলে গেছিস আজ যে সাজিদ খানের জন্মদিন”।
“ওহ মাই গড!!” চেঁচিয়ে উঠল দীপা।
“আমি জানতাম তুই ভুলে যাবি। এক্ষুনি টিভি অন কর। কেক কাটা হয়ে গেছে!”
দীপা দৌড়ে গেল ড্রয়িং রুমে। দেখল ছোটভাই অমিত আগে থেকেই টিভি ছেড়ে বসে আছে। সে রাগে ভ্রু কুচকাল, “কিরে তুই একা একাই দেখছিস আমাকে ডাকিস নি কেন?”
অমিত কিছু বলল না। সে টিভি দেখায় ব্যস্ত।
দীপা ধপ করে সোফায় বসে পরল। কেক কাটা পর্ব শেষ। এখন নায়ক সাজিদ খান তার স্ত্রী সুচিত্রাকে কেক খাওয়াচ্ছে। উপস্থাপক বলছে, “আমরা দেখতে পাচ্ছি এবার সাজিদ খান তার স্ত্রী সুচিত্রাকে কেক খাওয়াচ্ছে। আসেপাশের মানুষের বিপুল করতালি আপনার শুনতে পাচ্ছেন”।
দীপা মনে মনে বলল, “অমন সুদর্শন একটা মানুষ কীভাবে এমন বোয়াল মাছের মত মুখওয়ালা মেয়েকে বিয়ে করল?”
উপস্থাপক বললেন, “এবার আমরা সাজিদ খানের সাথে দুই একটা কথা বলল, স্যার, প্রথম জন্মদিন তো পালিত হয়ে গেল। আপনার অনুভুতি কি?”
উপস্থাপক মাইকটা সাজিদ খানের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। সাজিদ খানের ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে দীপা শিউড়ে উঠল, “অনুভুতির কথা তো অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবেনা। কিন্তু আপনারা জানেন আমাদের হাতে সময় খুব কম। মাত্র ১ ঘন্টার মধ্যে মালদ্বীপ পৌঁছুতে হবে। সংক্ষেপে শুধু এত টুকুই বলব, আমি খুব এক্সাইটেড। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। ইনশাল্লাহ, আপনাদের শুভকামনা পাশে থাকলে আমি এই কাজে সফল হতে পারব। ধন্যবাদ”।
উপস্থাপক এবার মাইক ধরলেন সুচিত্রার দিকে, “আপনার অনুভুতি কি সুচিত্রা?”
“আমি খুব খুব খুব এক্সাইটেড। নেক্সট জার্নি মালদ্বীপ। আমি আগে কখনো মালদ্বীপ যাইনি। আই হোপ উই উইল বি এবল টু মেইক ইট ইন ওয়ান আওয়ার”।
দীপা আনমনে গুজুর গুজুর করছে, “উহ! ইংরেজি মারছে! বেটি তোর কণ্ঠ হচ্ছে ফ্যাসফেসে, তোর তো কথা বলাই উচিত না!”
টিভিতে উপস্থাপক বলছেন, “এখানেই শেষ হল সাজিদ খানের প্রথম জন্মদিন পালন। এখন স্কাইলন প্লেনে চেপে মালদ্বীপ যাবেন সাজিদ খান এবং তার স্ত্রী। হাতে সময় আছে এক ঘন্টা অর্থাৎ আর ঠিক এক ঘন্টা বাদে মালদ্বীপের স্থানীয় সময় অনুযায়ী ১২টা বাজবে। এর আগেই সেখানে পৌঁছুতে হবে সাজিদ খানকে, এজন্য পাড়ি দিতে হবে ১৪৭৭.০১ মাইল পথ। কোথাও যাবেন না। আমাদের সাথেই থাকুন। ঠিক একঘন্টা পরে আপনাদের সাথে দেখা হবে মালদ্বীপের রাজধানী মালের হুলহুলে উপদ্বীপে অবস্থিত ইব্রাহিম নাসির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে.........”
দীপা ব্যাস্ত হয়ে পড়ল ফেসবুকে সাজিদ খানকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে।
***
৪ঠা নভেম্বর ২০১৩
স্থানঃ মানামা, বাহরাইন।
ঠাস করে টিভি সেটটা বন্ধ হয়ে গেল। লোড শেডিং হয়েছে সেটা বুঝতে দু সেকেন্ড সময় লাগল হাবীবের। এই মধ্যরাতে লোড শেডিং! মেজাজ সপ্তমে চড়ল তার। এখন উপায় কি? জলদি মোবাইলে এয়ারফোন কানেক্ট করে এফএম রেডিও অন করল সে। যাক বাঁচা গেল! রেডিওতেও সাজিদ খানের জন্মদিন পালনের বর্ণনা দিচ্ছে।
“...লিসেনারস, আমরা এখন আছি মিশরের নীলনদের তীরে। এখানেই ৫ম বারের মত কেক কেটে জন্মদিন পালন করতে চলেছেন সাজিদ খান। আপনার নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন এই ভেবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ওমান, জর্ডানের মত কেন মিশরেও এয়ারপোর্টে জন্মদিন পালন করছেন না সাজিদ খান। কারনটি হচ্ছে জর্ডানের রাজধানী আম্মানের রানী আলিয়া বিমানবন্দর থেকে কায়রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দূরত্ব মাত্র ৩০৮ মাইল। মাত্র ১৮ মিনিটে পৌঁছে গেছে স্কাইলন প্লেন। হাতে যথেষ্ট সময় থাকায় কায়রো থেকে একটি হেলিকপ্টারে চেপে স্ত্রী সুচিত্রাকে নিয়ে নীলনদের তীরে এসেছেন সাজিদ খান।
এইমাত্র স্থানীয় সময় অনুযায়ী রাত ১২টা বেজেছে, সাজিদ খান কেক কাটছেন। তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছেন অগনিত ভক্তরা। সমস্ত নদীর তীর আলোয় উদ্ভাসিত। মিশরের নীল নদ যেন আজ অন্যরকম এক মাত্রা পেল! সেই সাথে বোনা হল আরও একটা ইতিহাসের বীজ। আমরা দেখতে পাচ্ছি সাজিদ খান তার স্ত্রী সুচিত্রাকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন... চারিদিকে তুমুল করতালি... এবার সুচিত্রা সাজিদ খানকে কেক খাওয়াচ্ছেন... এবং এরই সাথে শেষ হল আরও একটি জন্মদিন পালন। এখন হেলিকপ্টারের করে সাজিদ খান ফিরে যাবেন কায়রো বিমানবন্দরে।
লিসেনারস, আপনারা জানেন জর্ডানে ল্যান্ড করার সময় স্কাইলন প্লেনটি রানওয়ে থেকে কিছুটা ছিটকে গিয়েছিল। ল্যান্ডিং পারফেক্ট না হওয়ায় বিমানে সামান্য ত্রুটি ধরা পরেছে। ইতিমধ্যে বিকল্প প্লেনের কথা চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। সম্ভবত কেপভার্দ যাওয়ার পর প্লেনটি পরিবর্তন করা হবে। আপাতত পরবর্তী গন্তব্য নাইজেরিয়া। লিবিয়ার আকাশপথ ব্যবহার করতে লিবিয়ান সরকার আপত্তি করায় আলজেরিয়ার পরিবর্তে শেষ মুহূর্তে নাইজেরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন সাজিদ খান। মিশর থেকে নাইজেরিয়া প্রায় ১৮৯৭.৫৩ মাইল দূর। প্রচণ্ড গতিতে এগোতে না পারলে একঘণ্টায় সেখানে পৌঁছুনে সম্ভব হবেনা। তাই বলা যায় সাজিদ খান এই প্রথম একটি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছেন”।
কান থেকে এয়ার ফোন খুলল হাবীব। “শিট!! টিভিতে দেখতে পারলে ভাল লাগত! লোডশেডিংয়ের জ্বালায় লাইফটাই হেল হয়ে গেল। সাজিদ খানকে না হোক, অন্তত তার রূপসী স্ত্রী সুচিত্রার মুখটা এক নজর দেখতে পারলেও শান্তি পেতাম”!
***
৪ঠা নভেম্বর ২০১৩
স্থানঃ নাইরোবি,কেনিয়া।
ভোরবেলা স্বামীকে বিছানায় না দেখে অবাক হলনা সাচিনি। ড্রয়িং রুম থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। সে উঠে এল।“কি ব্যাপার স্টিভ? এই ভোর বেলা আবার টিভির সামনে এসে বসে আছো! এমনিতে সারারাত ঘুমাওনি! আজ আর অফিসে যাওয়া লাগবে না!”
ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল স্টিভ, মুখে হাসি। “এমন দিন তো বার বার আসবে না। আজ না হয় না গেলাম অফিসে”।
“অফিস থেকে ফোন করলে কি বলবে?”
“বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেব। এখন এস আমরা সাজিদ খানের জন্মদিন পালন দেখি”।
সাচিনি স্বামীর পাশে বসতে বসতে বলল, “কি অবস্থা? এখন কোথায় আছে সাজিদ খান?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না। যাওয়ার কথা ছিল আলজেরিয়া, পরে বলা হল যাবে নাইজেরিয়া, এখন আবার দেখি আলজেরিয়ায় ল্যান্ড করেছে! এই মাত্র কেক কেটে আবার টেক অফ করেছে”।
দুজনের দুজোড়া চোখ টিভির মনিটরে নিবদ্ধ হল।
“.... এই মাত্র সঠিক খবর আমাদের হাতে এসেছে। প্লেনটি মিশর থেকে টেক অফ করার পর প্লেনের ইতিমধ্যে ধরা পরা ত্রুটিটি বড় আকার ধারন করে। পাইলট জন সাজিদ খানকে জানান নাইজেরিয়া গিয়ে প্লেন পরিবর্তন করতে হবে। ত্রুটি পূর্ণ এই প্লেন নিয়ে আর টেক অফ করা সম্ভব হবেনা। নাইজেরিয়ায় কোন স্কাইলন প্লেন নেই। নিকটবর্তি ইউরোপিয়ান দেশ স্পেনেই শুধু ব্যাকআপ প্লেন রেডি ছিল। সেখান থেকে নাইজেরিয়া প্রায় ২৩০১ মাইল দূরবর্তী। এক ঘণ্টায় স্পেন থেকে নাইজেরিয়া পৌঁছুনো সম্ভব নাও হতে পারে তাই পূর্বের গন্তব্য আলজেরিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সাজিদ খান। এদিকে প্রধান স্পন্সর কোম্পানি এক্সন মোবিলের বিশেষ অনুরোধে লিবিয়ান সরকার সাজিদ খানকে লিবিয়ার আকাশ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ১২টা বাজতে কেবল ২মিনিট বাকি থাকতে সাজিদ খান প্লেন নিয়ে আলজেরিয়ার আন্নাবা সিটির রাবাহ বিতাত এয়ারপোর্টে পৌঁছান। হাতে সময় কম থাকায় কেক কেটেই আবার পরবর্তী গন্তব্য আইভরি কোস্টের আবিদজান শহরের পোর্ট বুয়েত এয়ারপোর্ট এর দিকে রওনা হয়েছেন, আলজেরিয়া থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১৫৭৩.৮৭ মাইল। যাত্রা পথে এই প্রথম সাজিদ খানকে একটা বড় ধরনের বিপত্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে আরও একটি বিপত্তি ঘটতে পারে আবিদজান থেকে কেপভার্দ যাওয়ার সময়। কারন এই স্থানের কোন বিকল্প ঠিক করে রাখেন নি সাজিদ খান..........”
***
৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩
স্থানঃ কিয়েভকা, কাজাকাস্তান
আহমেদ মাসউদ মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরেই দেখেন দরজার সামনে পত্রিকা পরে আছে। আজ দেখি সকাল সকাল হকার পত্রিকা দিয়ে গেল। কোন কোন দিন তো ৮টা -৯টা বেজে যায় জমিদার মশাইয়ের।
পত্রিকা হাতে নিতেই মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। প্রথম পাতা জুড়ে সাজিদ খানের জন্মদিন পালনের কাহিনি ছাড়া কিছু নেই। ইচ্ছে হচ্ছে পত্রিকাটা নর্দমায় ফেলে দিতে। কয়েকদিন যাবত এই ফালতু কর্মকাণ্ডের বর্ণনা ছাড়া পত্রিকাতে আর কিছু ছাপছেই না। যেখানে যাও শুধু সাজিদ খান সাজিদ খান!
আহমেদ মসউদের ছোটমেয়ে শবনম কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে সে বলল, “আব্বা, আপনি কি আজ পেপারটা একটু পরে পড়বেন? খুব ইম্পরট্যান্ট খবর ছেপেছে তো, তাই!”
আহমেদ মাসউদ মনে মনে বললেন, “কি তোমার ইম্পরট্যান্ট খবর তা তো আমি জানিই! এই সাজিদ খানকে নিয়ে উঠতি বয়সি মেয়ে গুলো কি পেয়েছে কে জানে! বিবাহিত একটা পুরুষের প্রতি তাদের এত আকর্ষণ কেন?” কিন্তু মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, “ঠিক আছে, শবনম। আজ তুমি আগে পড়!”
পত্রিকা হাতে নিয়ে শবনম প্রায় দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পত্রিকা মেলল। পাতায় পাতায় শুধু কেক কাটা আর জন্মদিন পালনের ছবি। কেপভার্দ পর্যন্ত সব রাত জেগে দেখা হয়ে গেছে তার। লেটেস্ট খবর জানা নেই। কেপভার্দ থেকে বলিভিয়া যাওয়ার পথে কিছু সমস্যা হয়েছে জানা গেছে। তাই ৯ম জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান লাইভ দেখানো হয়নি। একটু খুঁজতেই খরবরটা খুজে পেল শবনম।
“বলিভিয়ার বদলে চিলিতে পালিত হল ৯ম জন্মদিন”
কেপভার্দ থেকে বলিভিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বেই সাজিদ খান জানতে পারেন বলিভিয়ান প্রেসিডেন্ট জোয়ান ইভো মোরালেস আইমা ঘোষণা দিয়েছেন তাকে বলিভিয়াতে ল্যান্ড করতে দেওয়া হবেনা। কেপভার্দ থেকে বলিভিয়া ৩৪৮৯.২৮ মাইল দূরে অবস্থিত। হাতে তিন ঘন্টা নিয়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব ছিল। সম্ভাব্য বিকল্প অবস্থান হতে পারত ত্রিনিদাদ এন্ড টোব্যাকো। কিন্তু সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য পেরুর পথে যাত্রার সু ব্যাবস্থা নেই। তাই সবচেয়ে দীর্ঘযাত্রা পথ চিলিকে বেছে নেওয়া হয় পরবর্তী জন্মদিন পালনের জন্য। উল্লেখ্য যে কেপভার্দ থেকে চিলি প্রায় ৪৭০৯.৪৮ মাইল দূরে অবস্থিত। এদিকে কেপভার্দ এর আশেপাশের সামুদ্রিক অঞ্চলে নিন্ম চাপের কারনে প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। তাই এয়ারপোর্ট অথোরিটি স্কাইলনকে টেক অফ করতে নিষেধ করে। প্রতিকুল আবহাওয়ায় এতটা পথ তিন ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। কিন্তু পাইলট জন ল্যাম্পারড তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সময় মত চিলিতে পৌঁছায়। পথে অবশ্য ব্রাজিলে থামতে হয়েছে রিফুয়েলিং এর জন্য। পরবর্তী গন্তব্য পেরু প্রায় ১৮৪৫.০৪ মাইল দূরে। এক ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছুনো আরও একটা চ্যালেঞ্জ তাই বেশি দেরি না করে দ্রুত টেক অফ করেন পাইলট জন।
আর একটা খবরে শবনবের দৃষ্টি আটকে গেল।
“বলিভিয়ায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ”
বলিভিয়ান সরকার প্রাথমিক অবস্থায় সাজিদ খানের বলিভিয়াতে জন্মদিন পালনকে স্বাগত জানায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেশটির কংগ্রেস পার্টি প্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোয়ান ইভো মোরালেস আইমার আপত্তির কারনে সাজিদ খানকে দেওয়া বলিভিয়াতে ল্যান্ড করার অনুমতি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট বলেছেন বলিভিয়া ইতিহাসের কোন কৌতুকপূর্ণ অধ্যায়ের অংশ হয়ে থাকতে চায়না। কিন্তু দেশটির যুব সম্প্রদায়ের জনসাধারণ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সিয়াল রেসিডেন্টের সামনে নানা রকমের ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ করে। এসময় পুলিশের জল কামান নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জে বেশ কিছু বিক্ষোভকারি আহত হয়। ধারনা করা হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির গ্রহন যোগ্যতা কমিয়ে দেবে বহুলাংশে।
***
৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩
বেকারস ফিল্ড, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য, ইউএসএ।
“ওহ কেভিন, তোমার জন্যই দেরি হয়ে গেল”। দরজা খুলতে খুলতে বলল সিমি।
“শুধু আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই সিমি। তুমিই তো বললে আঙ্কেল ফিলিপ অনেক অসুস্থ, একবার দেখে না আসলে খারাপ দেখায় খুব। তাই তো যাওয়া হল”।
সিমি ততক্ষনে ভেতরে ঢুকে লাইট জ্বালাল, “কিন্তু আমি তো বলেছিলাম তোমার বাইকটা নেয়ার জন্য। তুমি বললে বাসে যাবে। রোজডেলের দিকে বাস সার্ভিসের বাজে অবস্থা সেটা তো জানতেই”।
“কিন্তু তুমি তো জানতে সাজিদ খান কোস্টারিকার বদলে সরাসরি ক্যালিফোর্নিয়ার আসছে ১১তম জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে। আমরা তো বাড়িতে না ফিরে সরাসরি এয়ারপোর্টের দিকে চলে যেতে পারতাম”।
সিমি রিমোট টিপে টিভি অন করতে করতে বলল, “ছাই পারতাম! এখন সেখানে যে ভিড় হয়েছে তোমার ধারনা আছে কোন? আগে আগে যেতে পারলে হত। এখন আর একনজর দেখতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। তারচেয়ে টিভিতেই দেখি”।
টিভি অন হতেই রিপোর্টারের কথা শোনা গেল। “...... ক্যালিফোর্নিয়া বাসী ভাবতেও পারেনি সাজিদ খানের ১১তম জন্মদিনের সাক্ষী হয়ে থাকবে তারা। সাজিদ খানের যাওয়ার রুটে ক্যালিফোর্নিয়া আসার কোন প্লান ছিলনা। পেরু থেকে কোস্টারিকার উদ্দেশ্যে উড্ডয়নের পর জানা যায় কোস্টারিকায় যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কোস্টারিকা ভ্রমন ও কোস্টারিকা সম্বন্ধীয় কিছু বৈদেশিক চুক্তির স্বাক্ষরের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীদের দাবী মেনে রাজধানী স্যান জোসের দুটি এয়ারপোর্ট থেকেই যুক্তরাষ্ট্র গামী এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত সকল ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় কোস্টারিকায় ল্যান্ড করাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এদিকে পেরু থেকে টেক অফ করার আগেই খবর পাওয়া যায় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি সমুদ্রে নিন্ম চাপ থেকে প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে, হাওয়াইয়ের দিকে ধেয়ে আসছে সাইক্লোন। তাই সময়ের আগে থাকার জন্য সমগ্র মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে সাজিদ খান ল্যান্ড করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ৪২৮৯.৪৯ মাইল পথ পাড়ি দিতে সাজিদ খানের প্লেন মেক্সিকো সিটিতে একবার অল্প সময়ের জন্য নেমেছিল রিফুয়েলিং করতে। ক্যালিফোর্নিয়া কোস্টারিকার তুলনায় টাইম জোন অনুযায়ী দুই ঘণ্টা পিছিয়ে আছে, তাই এখান থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার জন্য হাতে এখনও দু ঘণ্টা সময় রয়েছে। দূরত্ব ২৪৭১.৩৭ মাইল। আমরা এখন চলে যাব বেকারস ফিল্ড এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। সেখানে আমাদের প্রতিনিধি হ্যারিস আছেন সাজিদ খানের সাথে”।
লাউঞ্জে রিপোর্টার হ্যারিস শুরু করলেন, “ভিউয়ারস, আমরা এখন আছি বেকারস ফিল্ড এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। আর কিছুক্ষন পর ক্যালিফোর্নিয়ার সময় অনুযায়ী বাজবে রাত ১২টা। সাথে সাথে কেক কেটে ১১তম বারের মত জন্মদিন পালন করবেন সাজিদ খান।
কিন্তু দর্শক, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন লাউঞ্জ জুড়ে সবার মাঝেই একটা মনমরা ভাব। সাজিদ খান নিজেও এখন আর হাসছেন না। দীর্ঘ সময়ের জার্নির কারনে তিনি এবং পাইলট জন ল্যাম্পারড দুজনেই ক্লান্ত। তবে মন খারাপের কারন ক্লান্তি নয়। মন খারাপের কারন হচ্ছে দুটো। প্রথম কারনটি আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন। সাজিদ খানের স্ত্রী সুচিত্রা পেরুতে পৌঁছানোর পর খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পরেন। তাই তার পক্ষে আর ক্যালিফোর্নিয়া আসা সম্ভব হয়নি। তিনি পেরুর লিমা অঞ্চলের ন্যাশনাল হসপিটাল দেল সুরে ভর্তি আছেন। একটু সুস্থ হলে পরবর্তীতে অন্য প্লেনে চেপে তিনি হাওয়াইতে ফেরত আসবেন সাজিদ খানের সাথে যোগ দিতে। এবার আসি ২য় কারনটির প্রসঙ্গে। আপনারা জানেন ইতিমধ্যে হাওয়াই দ্বীপ পুঞ্জে সর্বোচ্চ বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। সামুদ্রিক ঝড় উঠেছে নর্থ প্যাসিফিক সমুদ্রে। সাইক্লোন ধেয়ে আসছে ক্রমশ। ঝড় না থামা পর্যন্ত হাওয়াইকে নো ফ্লাই জোন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং সকল ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। তবে কি শেষে এসে সমস্ত পরিকল
স্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
“সুপ্রিয় দর্শকবৃন্দ, এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে অবস্থান করছেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট পদার্থবিদ প্রফেসর ইউসুফ শিকদার। আপনারা জানেন যে প্রফেসর ইউসুফ সম্প্রতি বিশ্ব বিজ্ঞান পরিষদ আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলন’ এ ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। আমরা এখন তার সাথে এ বিষয়ে কিছু কথা বলব........”
টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই মিসেস ইউসুফ সখিনাকে ডাকলেন। “সখিনা.... এক কাপ চা দিয়ে যা তো”!
উপস্থাপিকা বলছে, “স্যার, কেমন আছেন?”
প্রফেসর ইউসুফ শিকদার ভরাট কণ্ঠে জবাব দিলেন, “ভাল আছি”।
“স্যার, দুদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনি ছিলেন আমাদের অঞ্চলের একমাত্র প্রতিনিধি। কেমন কাটল দিনগুলো?”
মুহূর্তে প্রফেসরের হাসি খুশি চেহারা ম্লান হয়ে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “বিশ্ব বিজ্ঞান পরিষদ হচ্ছে একটা বোকার স্বর্গ। আর তাদের সম্মেলনে যতসব থার্ড ক্লাস মাথা মোটা উজবুকগুলো এসে মিলেছে । দিনগুলো মোটেও ভাল কাটেনি”।
কিন্তু উপস্থাপিকার কণ্ঠে উৎসাহের অভাব নেই, “স্যার, বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনার উত্থাপন করা থিওরির তীব্র বিরোধিতা করেছে বিজ্ঞান পরিষদের সদস্যরা। বিশিষ্ট জনেরা বলছেন বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনার বক্তব্য এই উপমহাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?”
“আমার আসলে বলার কিছু নেই। শুধু বলব, আমার থিওরি ছিল খুব সাধারণ। কিন্তু এই সাধারন যুক্তি বোঝার মত মানসিকতা তাদের মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করতে করতে তারা এক একটা রোবটে পরিনত হয়েছে। চিন্তা শক্তি, বিবেক বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে”।
“স্যার, আপনি কি আপনার সেই থিওরিটুকু আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?”
“হ্যা, সাধারন মানুষের সামনে এই থিওরিটুকু উপস্থাপনের জন্যই আমি এই সাক্ষাৎকারে রাজি হয়েছি”।
“বলুন স্যার”।
প্রফেসর ইউসুফ শিকদার বড় করে একটা দম নিয়ে শুরু করলেন, “প্রতিটি মানুষের মাঝে জিনগতভাবে কিছু ক্ষমতা বিদ্যমান। কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে সেটা অর্জন করে নিতে হয়। একটা উদাহরন দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে।
মানব শিশুর হাঁটতে শেখার কথা ভাবুন। একটি সুস্থ স্বাভাবিক মানব শিশুর মাঝে হাঁটার ক্ষমতা আছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে নিজ থেকে হাঁটার চেষ্টা করে, প্রথম দিকে পারেনা, হোঁচট খায়, ব্যাথা পায়, ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয় কিন্তু একটা সময় কিন্তু সে হাঁটতে শিখে ফেলে। আর একটা উদাহারন হতে পারে সাঁতার কাটা। প্রত্যেকটি স্বাভাবিক মানুষের মাঝে সাঁতার কাটার সহজাত ক্ষমতা বিদ্যমান। কিন্তু যে কখনো পানিতে নামেনি সে যদি হঠাৎ কোন নৌ দুর্ঘটনায় পরে যায়, তাহলে কি সে সাঁতার কেটে জীবন বাঁচাতে পারবে? অবশ্যই নয়। তাকে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে সাঁতার কাটার ক্ষমতা আয়ত্তে আনতে হবে। সাইকেল চালানোর কথাই ধরুন। প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষের মাঝে সাইকেল চালানোর সহজাত প্রবৃত্তি আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অনুশীলন ছাড়া সাইকেল চালানোর ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়। একই ভাবে আমরা আরও অসংখ্য উদাহারন টানতে পারি। যেমনঃ ঘোড়ায় চড়া, জিমনাস্টিক, যেকোনো ক্রীড়ায় দক্ষতা অর্জন, পিস্তল চালনা ইত্যাদি। পর্যাপ্ত অনুশীলনের মাধ্যমে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অসংখ্য ক্ষমতা অর্জন করে নিতে পারে।
আমার গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এমন কিছু ক্ষমতা খুঁজে বের করা যা মানুষের মাঝে জিনগত ভাবে আছে কিন্তু অনুশীলনের অভাবে অর্জন করে নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা! দীর্ঘদিন এই বিষয়ের উপর কাজ করতে করতে একটা সময় আমি খুব অদ্ভুত একটা তত্ত্ব আবিস্কার করতে সমর্থ হই। মানুষের ডিএনএর মাঝে টাইমলাইন ও স্পেস ভেদ করে যাওয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে! অর্থাৎ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে অতীত অথবা ভবিষ্যৎ ভ্রমন করা সম্ভব, কিন্তু অনুশীলনের অভাবে সেই ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছেনা। এটাই হচ্ছে আমার থিওরি”।
উপস্থাপিকার পরবর্তী প্রশ্ন প্রস্তুত ছিল। “স্যার, আপনার থিওরি নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন। ল্যাটিন আমেরিকান বিজ্ঞানী ফিল কলিংস ব্যাঙ্গ করে বলেছেন, মানুষের পক্ষে হেঁটে হেঁটে চাঁদে যাওয়া সম্ভব কিন্তু অনুশীলনের অভাবে তা পারছে না”।
প্রফেসর ইউসুফ শিকদারকে কিছুটা বিচলিত মনে হল। “আমি জানি আমার কথা শুনে তার মত অনেকেই হয়ত হাসছেন, ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করছেন। তাদের কাছে আমি বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যা করেছি কিন্তু তারা যুক্তি মানতে নারাজ”।
সখিনা এসে চা দিয়ে গেল। মিসেস ইউসুফ চায়ে চুমুক দিলেন।
উপস্থাপিকা বলছে “স্যার, আমাদের উদ্দেশ্যে কি আপনি যুক্তিগুলো একটু ব্যাখ্যা করবেন?”
“অবশ্যই। এবং সে জন্যই আজ আমি মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি মানুষের পক্ষে যে ক্ষমতা অর্জন সম্ভব, সৃষ্টিকর্তা তা অনুশীলন করার সুযোগ রেখেই তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। এখন প্রশ্ন করতে পারেন মানুষের পক্ষে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ ভ্রমনের অনুশীলন করা সম্ভব কিনা। আমি বলব অবশ্যই সম্ভব। অন্যান্য ক্ষমতা অর্জনের অনুশীলনের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে- একটা নির্দিষ্ট যায়গায় অবস্থান করেই অন্যান্য ক্ষমতাগুলো অর্জনের জন্য অনুশীলন করা সম্ভব হয়। যেমন সাইকেল চালনা, সাঁতার শেখা এগুলোর জন্য নির্দিষ্ট যায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে হয়না। কিন্তু সময়ের সাথে স্পেস খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অর্থাৎ একটি ছাড়া অপরটির ব্যবহার সম্ভব নয়। সময় ভেদ করে যেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই স্পেস পরিবর্তন করতে হবে। ঘাবড়াবেন না। একটা উদাহারনের মাধ্যমে আমি বিষয়টা বুঝিয়ে দিচ্ছি।
এখন আমাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। এটি জিএমটি+৬ টাইম জোনের মাঝে পরেছে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী বাজে সন্ধ্যা ৭টা। ল্যাটিন অ্যামেরিকান বেশ কিছু দেশ জিএমটি-১০ বা জিএমটি-৯ টাইম জোনের আন্ডারে পরেছে। অর্থাৎ আমাদের থেকে প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা পেছনে তাদের অবস্থান। স্থানীয় সময় অনুযায়ী কোথাও বাজে রাত ২টা কোথাও বাজে রাত ১টা। এখন আপনি যদি প্লেনে চেপে ১৫ ঘণ্টার আগেই সেখানে পৌছাতে পারেন, তাহলে সেখানকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী আপনি আরও একবার সন্ধ্যা ৭টার সময়টা ফিরে পাচ্ছেন। অর্থাৎ দুটি যায়গায় একই সময়ে আপনি অবস্থান করার সুযোগ পেলেন। কিন্তু একই যায়গায় অবস্থানের মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়।
এই অনুশীলন যথেষ্ট নয়। দীর্ঘসময় ব্যাপী একটা নির্দিষ্ট সময়ে ভিন্ন ভিন্ন যায়গায় অবস্থানের দ্বারা মানুষ অতীত ও ভবিষ্যৎ ভ্রমনের ক্ষমতা অর্জন করে নিতে সক্ষম হবে”।
“স্যার, এই থিওরি কি প্রমান করে দেখানো সম্ভব?”
“সম্ভব। আমি দীর্ঘদিনের রিসার্চ থেকে বের করেছি দিনের অর্ধভাগ অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা ধরে একটা নির্দিষ্ট রুটে ভ্রমন করলে টাইম লাইন ক্রস করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেজন্য প্রচুর আর্থিক সাহায্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। যার কোনটাই আমি পাবনা”।
“আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?”
প্রফেসর ইউসুফ হাসলেন, “আমি বাকিটা জীবন চেষ্টা করে যাব এই থিওরি প্রমান করার। কখনো সফল হতে পারব না কিনা জানিনা। কিন্তু বেঁচে থাকতে হাল ছারব না”।
শঙ্কিত চোখে টিভি পর্দায় স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন মিসেস ইউসুফ শিকদার। স্বামীর গলার এই সুর তার অনেক দিনের চেনা। সমাধানে পৌঁছানোর আগে তাকে থামানো সম্ভব নয়।
****
৩রা নভেম্বর, ২০১৩
স্থানঃ চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
জামিল সাহেব দিনের মধ্যে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে করেন তা হচ্ছে পেপার পড়া। রিটায়ার করার পর থেকেই সকাল বেলা চায়ের কাপে চুমুকের ফাকে ঘণ্টা খানেক লাগিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকার প্রত্যেকটা লাইন পড়া তার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ পত্রিকা খুলেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। প্রথম পাতাতেই বড় করে একটা নিউজ ছেপেছে। পড়তে পড়তে জামিল হায়দার চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার কথা ভুলে গেলেন।
“বিখ্যাত মানুষের অদ্ভুত খেয়াল”
আগামীকাল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচিত্র অভিনেতা সাজিদ খান এর ৩০ তম জন্মদিন। সাজিদ খান নামটি এই উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। তার জন্ম ঢাকায়। ছোটবেলায় পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। অসাধারন অভিনয় প্রতিভার জোরে নিজেকে হলিউডের চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অস্কার, গোল্ডেন গ্লোবের মত বড় বড় পুরস্কার সব আদায় করে নিয়েছেন খুব কম বয়সেই।
এবছর জন্মদিন পালন উপলক্ষে তার মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চেপেছে। তিনি একই দিনে ১২ টি ভিন্ন যায়গায় ১২বার ১২টি কেক কেটে নিজের জন্মদিন পালন করতে চান। আর সেই ১২ বার জন্মদিন পালনের ব্যাপারটিও অদ্ভুত। স্থানীয় সময় অনুযায়ী প্রতিবার ঠিক রাত ১২ টার সময় কেক কেটে তিনি নিজের জন্মদিন পালন করবেন। তিনি যদি সফল হন তবে এটা হতে পারে একটা বিশ্বরেকর্ড। গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ইতিমধ্যে তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে। এছাড়াও অনেক কোম্পানি তাকে স্পন্সর করতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে এক্সন মোবিল সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্যাটেলাইট টিভি প্রোভাইডার ডিরেক্ট টিভির কিনে নিয়েছে সমস্ত প্রোগ্রাম লাইভ দেখানোর সত্ত্ব। গ্রিনিচ মান মন্দিরের টাইমজোন অনুযায়ী সাজিদ খান একটি রুট বেছে নিয়েছেন। এই রুট ধরে চলার পথে ১২ বার তিনি থামবেন এবং জন্মদিন পালন করবেন।
চার্টার্ড প্লেন ভাড়া করা হয়েছে। এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় এয়ারক্র্যাফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিএকশন ইঞ্জিন’স এর তৈরি আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন এয়ারক্র্যাফট স্কাইলন স্পেস প্লেন। এই প্লেনের গতির সাথে রকেটের গতির তুলনা চলে। প্লেনটি ৩০০ যাত্রী নিয়ে মাত্র ৪ ঘণ্টায় ইউরোপ থেকে অস্ট্রলিয়া পাড়ি জমাতে পারে। প্লেনটির চিফ ডিজাইনার অ্যালান বন্ড-এর ভাষ্যমতে প্লেনটি একটি স্ট্যান্ডার্ড রানওয়ে থেকে টেক অফ করলে ঘণ্টায় প্রায় ১৯০০০ মাইল স্পীড তুলতে সক্ষম। চলার রুটে প্রয়োজনে প্লেন বদল করতে হতে পারে তাই বিকল্প প্লেনের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। তবে বিকল্প প্লেনের ব্যবস্থা থাকলেও বিকল্প পাইলটের ব্যাবস্থা নেই। প্রধান পাইলট হিসেবে আছেন জন ল্যাম্পারড। তিনি এমিরেটস এয়ারলাইন কোম্পানির একজন দক্ষ ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ পাইলট। তার সহযোগী হিসেবে আছেন নায়ক সাজিদ খান নিজেই। উল্লেখ্য যে নায়ক সাজিদ খান চলচিত্রে অভিনয়ের আগে একজন বেসরকারি পাইলট ছিলেন। সাজিদ খান, তার স্ত্রী সুচিত্রা, পাইলট জোন এবং দুজন এয়ার হোস্টেস সহ মোট ৫ জন আরোহী নিয়ে প্লেনটি আকাশে উঠবে। একদিনের জন্য এই প্লেন ভাড়া করতে কি পরিমান অর্থ খরচ করতে হচ্ছে সাজিদ খানকে, এই প্রসঙ্গে সঠিক তথ্য জানা যায়নি, তবে সেটা কোটির ওপরে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। গোপন সুত্রে প্রকাশ, অ্যামাউন্টটি নয় অংকের! সম্ভাব্য অবস্থানের জন্য দেশগুলোর সরকার এবং তাদের বিমানবন্দর কতৃপক্ষের সাথে ইতিমধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আগামীকাল ঢাকার হযরত শাহজালাল রহঃ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে সাজিদ খান শুরু করবেন এই পথ চলা। সে যাত্রা শেষ হবে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে। সম্ভাব্য যে টাইমজোন ও দেশগুলোতে তারা থামবেন জন্মদিন পালনের জন্য তা নিচে উল্লেখ করা হলঃ
১. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ১২টা।
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৬.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ বাংলাদেশ
বিকল্প অবস্থানঃ নেই
২. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ১টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৫.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ মালদ্বীপ
বিকল্প অবস্থানঃ উজবেকিস্তান, পাকিস্তান
৩. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ২টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৪.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ ওমান
বিকল্প অবস্থানঃ আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, আরব আমিরাত
৪. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ৩টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০৩.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ জর্ডান
বিকল্প অবস্থানঃ বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, সৌদি আরব
৫. বাংলাদেশ সময়ঃ রাত ৪টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০২.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ মিশর
বিকল্প অবস্থানঃ দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, জিম্বাবুয়ে
৬. বাংলাদেশ সময়ঃ ভোর ৫টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০১.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ আলজেরিয়া
বিকল্প অবস্থানঃ নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, তিউনিশিয়া
৭. বাংলাদেশ সময়ঃ ভোর ৬টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ +০০.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ আইভরি কোস্ট
বিকল্প অবস্থানঃ ঘানা, আইসল্যান্ড
৮. বাংলাদেশ সময়ঃ সকাল ৭টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০১.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ কেপভার্দ
বিকল্প অবস্থানঃ নেই
৯. বাংলাদেশ সময়ঃ সকাল ১০টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০৪.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ বলিভিয়া
বিকল্প অবস্থানঃ চিলি, ত্রিনিদাদ এন্ড টোব্যাকো
১০. বাংলাদেশ সময়ঃ সকাল ১১টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০৫.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ পেরু
বিকল্প অবস্থানঃ কিউবা, জ্যামাইকা
১১. বাংলাদেশ সময়ঃ দুপুর ১২টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -০৬.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ কোস্টারিকা
বিকল্প অবস্থানঃ এল সালভাদর, মেক্সিকো
১২. বাংলাদেশ সময়ঃ বিকেল ৪টা
স্থানীয় সময়ঃ রাত ১২টা
আন্তর্জাতিক সময়ঃ -১০.০০
সম্ভাব্য অবস্থানঃ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ
বিকল্প অবস্থানঃ নেই
লক্ষ করলে দেখবেন বিভিন্ন টাইমজোন পাড়ি দেয়ার ফাকে সাজিদ খান সুকৌশলে ইউরোপিয়ান দেশ গুলোকে এড়িয়ে গেছেন। অনেকে বলছেন ইউরোপে সাজিদ খানের জনপ্রিয়তা না থাকা এর প্রধান কারন। আবার অনেকেই বলছেন ইউরোপ হয়ে যাওয়াটা খুব বেশি ব্যায়বহুল হতে পারে তাই খরচ কমাতে এই ব্যাবস্থা। তবে সাজিদ খান বলেছেন, “যেভাবে সুবিধা হয়, কম ভ্রমনে লক্ষে পৌঁছানো যায় সেভাবেই প্লান করা হয়েছে। ইউরোপ- আফ্রিকা কোন সমস্যা নয়”। এদিকে এমন ইচ্ছা হওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে সাজিদ খান বলেন, “তেমন কোন কারন নেই। আমার স্বভাবটাই এমন একটু পাগলাটে। বিয়ের পর এই প্রথম জন্মদিন আমার। চেয়েছিলাম এবার এমন কিছু করতে যেন পৃথিবীবাসী অনেক দিন তা মনে রাখতে পারে”। “কিন্তু ১২ বারই কেন? কম বেশি নয় কেন?” এমন প্রশ্নের জবাবে সাজিদ খান বলেন, “আমি জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বর্তমান আবাস স্থল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে এই ভ্রমন শেষ করতে চাই। হিসেব করে দেখেছি এর মধ্যে ১২বার জন্মদিন পালন সম্ভব, তাই ১২ বার ঠিক করেছি। এছাড়া বিশেষ কোন কারন নেই”।
এদিকে সমালোচকরা বলছেন অদ্ভুত খেয়ালের বসে এত টাকা খরচ না করে সাজিদ খান এই টাকা দিয়ে খুব সহজেই ভাগ্যবঞ্চিত অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। সেটাও পৃথিবীবাসী অনেকদিন মনে রাখার মত একটা কাজ হত।
***
তারিখঃ ৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩
স্থানঃ কলকাতা, ভারত
মোবাইল থেকে ফেসবুকে চ্যাট করছিল দীপা। হঠাৎ মৌরির ফোন আসায় বিরক্ত হল। কল রিসিভ করে বলল, “কি ব্যাপার?”
“কি করছিস?”
“সুজয়ের সাথে চ্যাট করছিলাম। তুই কল দিয়ে তো দিলি ভেজাল করে”। বিরক্তি প্রকাশ পেল দীপার কণ্ঠে।
“আরে রাখ তোর সুজয়”। ওপাশ থেকে মৌরির গলায় উত্তেজনা টের পাওয়া গেল। “ভুলে গেছিস আজ যে সাজিদ খানের জন্মদিন”।
“ওহ মাই গড!!” চেঁচিয়ে উঠল দীপা।
“আমি জানতাম তুই ভুলে যাবি। এক্ষুনি টিভি অন কর। কেক কাটা হয়ে গেছে!”
দীপা দৌড়ে গেল ড্রয়িং রুমে। দেখল ছোটভাই অমিত আগে থেকেই টিভি ছেড়ে বসে আছে। সে রাগে ভ্রু কুচকাল, “কিরে তুই একা একাই দেখছিস আমাকে ডাকিস নি কেন?”
অমিত কিছু বলল না। সে টিভি দেখায় ব্যস্ত।
দীপা ধপ করে সোফায় বসে পরল। কেক কাটা পর্ব শেষ। এখন নায়ক সাজিদ খান তার স্ত্রী সুচিত্রাকে কেক খাওয়াচ্ছে। উপস্থাপক বলছে, “আমরা দেখতে পাচ্ছি এবার সাজিদ খান তার স্ত্রী সুচিত্রাকে কেক খাওয়াচ্ছে। আসেপাশের মানুষের বিপুল করতালি আপনার শুনতে পাচ্ছেন”।
দীপা মনে মনে বলল, “অমন সুদর্শন একটা মানুষ কীভাবে এমন বোয়াল মাছের মত মুখওয়ালা মেয়েকে বিয়ে করল?”
উপস্থাপক বললেন, “এবার আমরা সাজিদ খানের সাথে দুই একটা কথা বলল, স্যার, প্রথম জন্মদিন তো পালিত হয়ে গেল। আপনার অনুভুতি কি?”
উপস্থাপক মাইকটা সাজিদ খানের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। সাজিদ খানের ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে দীপা শিউড়ে উঠল, “অনুভুতির কথা তো অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবেনা। কিন্তু আপনারা জানেন আমাদের হাতে সময় খুব কম। মাত্র ১ ঘন্টার মধ্যে মালদ্বীপ পৌঁছুতে হবে। সংক্ষেপে শুধু এত টুকুই বলব, আমি খুব এক্সাইটেড। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। ইনশাল্লাহ, আপনাদের শুভকামনা পাশে থাকলে আমি এই কাজে সফল হতে পারব। ধন্যবাদ”।
উপস্থাপক এবার মাইক ধরলেন সুচিত্রার দিকে, “আপনার অনুভুতি কি সুচিত্রা?”
“আমি খুব খুব খুব এক্সাইটেড। নেক্সট জার্নি মালদ্বীপ। আমি আগে কখনো মালদ্বীপ যাইনি। আই হোপ উই উইল বি এবল টু মেইক ইট ইন ওয়ান আওয়ার”।
দীপা আনমনে গুজুর গুজুর করছে, “উহ! ইংরেজি মারছে! বেটি তোর কণ্ঠ হচ্ছে ফ্যাসফেসে, তোর তো কথা বলাই উচিত না!”
টিভিতে উপস্থাপক বলছেন, “এখানেই শেষ হল সাজিদ খানের প্রথম জন্মদিন পালন। এখন স্কাইলন প্লেনে চেপে মালদ্বীপ যাবেন সাজিদ খান এবং তার স্ত্রী। হাতে সময় আছে এক ঘন্টা অর্থাৎ আর ঠিক এক ঘন্টা বাদে মালদ্বীপের স্থানীয় সময় অনুযায়ী ১২টা বাজবে। এর আগেই সেখানে পৌঁছুতে হবে সাজিদ খানকে, এজন্য পাড়ি দিতে হবে ১৪৭৭.০১ মাইল পথ। কোথাও যাবেন না। আমাদের সাথেই থাকুন। ঠিক একঘন্টা পরে আপনাদের সাথে দেখা হবে মালদ্বীপের রাজধানী মালের হুলহুলে উপদ্বীপে অবস্থিত ইব্রাহিম নাসির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে.........”
দীপা ব্যাস্ত হয়ে পড়ল ফেসবুকে সাজিদ খানকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে।
***
৪ঠা নভেম্বর ২০১৩
স্থানঃ মানামা, বাহরাইন।
ঠাস করে টিভি সেটটা বন্ধ হয়ে গেল। লোড শেডিং হয়েছে সেটা বুঝতে দু সেকেন্ড সময় লাগল হাবীবের। এই মধ্যরাতে লোড শেডিং! মেজাজ সপ্তমে চড়ল তার। এখন উপায় কি? জলদি মোবাইলে এয়ারফোন কানেক্ট করে এফএম রেডিও অন করল সে। যাক বাঁচা গেল! রেডিওতেও সাজিদ খানের জন্মদিন পালনের বর্ণনা দিচ্ছে।
“...লিসেনারস, আমরা এখন আছি মিশরের নীলনদের তীরে। এখানেই ৫ম বারের মত কেক কেটে জন্মদিন পালন করতে চলেছেন সাজিদ খান। আপনার নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন এই ভেবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ওমান, জর্ডানের মত কেন মিশরেও এয়ারপোর্টে জন্মদিন পালন করছেন না সাজিদ খান। কারনটি হচ্ছে জর্ডানের রাজধানী আম্মানের রানী আলিয়া বিমানবন্দর থেকে কায়রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দূরত্ব মাত্র ৩০৮ মাইল। মাত্র ১৮ মিনিটে পৌঁছে গেছে স্কাইলন প্লেন। হাতে যথেষ্ট সময় থাকায় কায়রো থেকে একটি হেলিকপ্টারে চেপে স্ত্রী সুচিত্রাকে নিয়ে নীলনদের তীরে এসেছেন সাজিদ খান।
এইমাত্র স্থানীয় সময় অনুযায়ী রাত ১২টা বেজেছে, সাজিদ খান কেক কাটছেন। তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছেন অগনিত ভক্তরা। সমস্ত নদীর তীর আলোয় উদ্ভাসিত। মিশরের নীল নদ যেন আজ অন্যরকম এক মাত্রা পেল! সেই সাথে বোনা হল আরও একটা ইতিহাসের বীজ। আমরা দেখতে পাচ্ছি সাজিদ খান তার স্ত্রী সুচিত্রাকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন... চারিদিকে তুমুল করতালি... এবার সুচিত্রা সাজিদ খানকে কেক খাওয়াচ্ছেন... এবং এরই সাথে শেষ হল আরও একটি জন্মদিন পালন। এখন হেলিকপ্টারের করে সাজিদ খান ফিরে যাবেন কায়রো বিমানবন্দরে।
লিসেনারস, আপনারা জানেন জর্ডানে ল্যান্ড করার সময় স্কাইলন প্লেনটি রানওয়ে থেকে কিছুটা ছিটকে গিয়েছিল। ল্যান্ডিং পারফেক্ট না হওয়ায় বিমানে সামান্য ত্রুটি ধরা পরেছে। ইতিমধ্যে বিকল্প প্লেনের কথা চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। সম্ভবত কেপভার্দ যাওয়ার পর প্লেনটি পরিবর্তন করা হবে। আপাতত পরবর্তী গন্তব্য নাইজেরিয়া। লিবিয়ার আকাশপথ ব্যবহার করতে লিবিয়ান সরকার আপত্তি করায় আলজেরিয়ার পরিবর্তে শেষ মুহূর্তে নাইজেরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন সাজিদ খান। মিশর থেকে নাইজেরিয়া প্রায় ১৮৯৭.৫৩ মাইল দূর। প্রচণ্ড গতিতে এগোতে না পারলে একঘণ্টায় সেখানে পৌঁছুনে সম্ভব হবেনা। তাই বলা যায় সাজিদ খান এই প্রথম একটি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছেন”।
কান থেকে এয়ার ফোন খুলল হাবীব। “শিট!! টিভিতে দেখতে পারলে ভাল লাগত! লোডশেডিংয়ের জ্বালায় লাইফটাই হেল হয়ে গেল। সাজিদ খানকে না হোক, অন্তত তার রূপসী স্ত্রী সুচিত্রার মুখটা এক নজর দেখতে পারলেও শান্তি পেতাম”!
***
৪ঠা নভেম্বর ২০১৩
স্থানঃ নাইরোবি,কেনিয়া।
ভোরবেলা স্বামীকে বিছানায় না দেখে অবাক হলনা সাচিনি। ড্রয়িং রুম থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। সে উঠে এল।“কি ব্যাপার স্টিভ? এই ভোর বেলা আবার টিভির সামনে এসে বসে আছো! এমনিতে সারারাত ঘুমাওনি! আজ আর অফিসে যাওয়া লাগবে না!”
ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল স্টিভ, মুখে হাসি। “এমন দিন তো বার বার আসবে না। আজ না হয় না গেলাম অফিসে”।
“অফিস থেকে ফোন করলে কি বলবে?”
“বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেব। এখন এস আমরা সাজিদ খানের জন্মদিন পালন দেখি”।
সাচিনি স্বামীর পাশে বসতে বসতে বলল, “কি অবস্থা? এখন কোথায় আছে সাজিদ খান?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না। যাওয়ার কথা ছিল আলজেরিয়া, পরে বলা হল যাবে নাইজেরিয়া, এখন আবার দেখি আলজেরিয়ায় ল্যান্ড করেছে! এই মাত্র কেক কেটে আবার টেক অফ করেছে”।
দুজনের দুজোড়া চোখ টিভির মনিটরে নিবদ্ধ হল।
“.... এই মাত্র সঠিক খবর আমাদের হাতে এসেছে। প্লেনটি মিশর থেকে টেক অফ করার পর প্লেনের ইতিমধ্যে ধরা পরা ত্রুটিটি বড় আকার ধারন করে। পাইলট জন সাজিদ খানকে জানান নাইজেরিয়া গিয়ে প্লেন পরিবর্তন করতে হবে। ত্রুটি পূর্ণ এই প্লেন নিয়ে আর টেক অফ করা সম্ভব হবেনা। নাইজেরিয়ায় কোন স্কাইলন প্লেন নেই। নিকটবর্তি ইউরোপিয়ান দেশ স্পেনেই শুধু ব্যাকআপ প্লেন রেডি ছিল। সেখান থেকে নাইজেরিয়া প্রায় ২৩০১ মাইল দূরবর্তী। এক ঘণ্টায় স্পেন থেকে নাইজেরিয়া পৌঁছুনো সম্ভব নাও হতে পারে তাই পূর্বের গন্তব্য আলজেরিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সাজিদ খান। এদিকে প্রধান স্পন্সর কোম্পানি এক্সন মোবিলের বিশেষ অনুরোধে লিবিয়ান সরকার সাজিদ খানকে লিবিয়ার আকাশ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ১২টা বাজতে কেবল ২মিনিট বাকি থাকতে সাজিদ খান প্লেন নিয়ে আলজেরিয়ার আন্নাবা সিটির রাবাহ বিতাত এয়ারপোর্টে পৌঁছান। হাতে সময় কম থাকায় কেক কেটেই আবার পরবর্তী গন্তব্য আইভরি কোস্টের আবিদজান শহরের পোর্ট বুয়েত এয়ারপোর্ট এর দিকে রওনা হয়েছেন, আলজেরিয়া থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১৫৭৩.৮৭ মাইল। যাত্রা পথে এই প্রথম সাজিদ খানকে একটা বড় ধরনের বিপত্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে আরও একটি বিপত্তি ঘটতে পারে আবিদজান থেকে কেপভার্দ যাওয়ার সময়। কারন এই স্থানের কোন বিকল্প ঠিক করে রাখেন নি সাজিদ খান..........”
***
৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩
স্থানঃ কিয়েভকা, কাজাকাস্তান
আহমেদ মাসউদ মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরেই দেখেন দরজার সামনে পত্রিকা পরে আছে। আজ দেখি সকাল সকাল হকার পত্রিকা দিয়ে গেল। কোন কোন দিন তো ৮টা -৯টা বেজে যায় জমিদার মশাইয়ের।
পত্রিকা হাতে নিতেই মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। প্রথম পাতা জুড়ে সাজিদ খানের জন্মদিন পালনের কাহিনি ছাড়া কিছু নেই। ইচ্ছে হচ্ছে পত্রিকাটা নর্দমায় ফেলে দিতে। কয়েকদিন যাবত এই ফালতু কর্মকাণ্ডের বর্ণনা ছাড়া পত্রিকাতে আর কিছু ছাপছেই না। যেখানে যাও শুধু সাজিদ খান সাজিদ খান!
আহমেদ মসউদের ছোটমেয়ে শবনম কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে সে বলল, “আব্বা, আপনি কি আজ পেপারটা একটু পরে পড়বেন? খুব ইম্পরট্যান্ট খবর ছেপেছে তো, তাই!”
আহমেদ মাসউদ মনে মনে বললেন, “কি তোমার ইম্পরট্যান্ট খবর তা তো আমি জানিই! এই সাজিদ খানকে নিয়ে উঠতি বয়সি মেয়ে গুলো কি পেয়েছে কে জানে! বিবাহিত একটা পুরুষের প্রতি তাদের এত আকর্ষণ কেন?” কিন্তু মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, “ঠিক আছে, শবনম। আজ তুমি আগে পড়!”
পত্রিকা হাতে নিয়ে শবনম প্রায় দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পত্রিকা মেলল। পাতায় পাতায় শুধু কেক কাটা আর জন্মদিন পালনের ছবি। কেপভার্দ পর্যন্ত সব রাত জেগে দেখা হয়ে গেছে তার। লেটেস্ট খবর জানা নেই। কেপভার্দ থেকে বলিভিয়া যাওয়ার পথে কিছু সমস্যা হয়েছে জানা গেছে। তাই ৯ম জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান লাইভ দেখানো হয়নি। একটু খুঁজতেই খরবরটা খুজে পেল শবনম।
“বলিভিয়ার বদলে চিলিতে পালিত হল ৯ম জন্মদিন”
কেপভার্দ থেকে বলিভিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বেই সাজিদ খান জানতে পারেন বলিভিয়ান প্রেসিডেন্ট জোয়ান ইভো মোরালেস আইমা ঘোষণা দিয়েছেন তাকে বলিভিয়াতে ল্যান্ড করতে দেওয়া হবেনা। কেপভার্দ থেকে বলিভিয়া ৩৪৮৯.২৮ মাইল দূরে অবস্থিত। হাতে তিন ঘন্টা নিয়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব ছিল। সম্ভাব্য বিকল্প অবস্থান হতে পারত ত্রিনিদাদ এন্ড টোব্যাকো। কিন্তু সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য পেরুর পথে যাত্রার সু ব্যাবস্থা নেই। তাই সবচেয়ে দীর্ঘযাত্রা পথ চিলিকে বেছে নেওয়া হয় পরবর্তী জন্মদিন পালনের জন্য। উল্লেখ্য যে কেপভার্দ থেকে চিলি প্রায় ৪৭০৯.৪৮ মাইল দূরে অবস্থিত। এদিকে কেপভার্দ এর আশেপাশের সামুদ্রিক অঞ্চলে নিন্ম চাপের কারনে প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। তাই এয়ারপোর্ট অথোরিটি স্কাইলনকে টেক অফ করতে নিষেধ করে। প্রতিকুল আবহাওয়ায় এতটা পথ তিন ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। কিন্তু পাইলট জন ল্যাম্পারড তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সময় মত চিলিতে পৌঁছায়। পথে অবশ্য ব্রাজিলে থামতে হয়েছে রিফুয়েলিং এর জন্য। পরবর্তী গন্তব্য পেরু প্রায় ১৮৪৫.০৪ মাইল দূরে। এক ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছুনো আরও একটা চ্যালেঞ্জ তাই বেশি দেরি না করে দ্রুত টেক অফ করেন পাইলট জন।
আর একটা খবরে শবনবের দৃষ্টি আটকে গেল।
“বলিভিয়ায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ”
বলিভিয়ান সরকার প্রাথমিক অবস্থায় সাজিদ খানের বলিভিয়াতে জন্মদিন পালনকে স্বাগত জানায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেশটির কংগ্রেস পার্টি প্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোয়ান ইভো মোরালেস আইমার আপত্তির কারনে সাজিদ খানকে দেওয়া বলিভিয়াতে ল্যান্ড করার অনুমতি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট বলেছেন বলিভিয়া ইতিহাসের কোন কৌতুকপূর্ণ অধ্যায়ের অংশ হয়ে থাকতে চায়না। কিন্তু দেশটির যুব সম্প্রদায়ের জনসাধারণ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সিয়াল রেসিডেন্টের সামনে নানা রকমের ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ করে। এসময় পুলিশের জল কামান নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জে বেশ কিছু বিক্ষোভকারি আহত হয়। ধারনা করা হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির গ্রহন যোগ্যতা কমিয়ে দেবে বহুলাংশে।
***
৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩
বেকারস ফিল্ড, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য, ইউএসএ।
“ওহ কেভিন, তোমার জন্যই দেরি হয়ে গেল”। দরজা খুলতে খুলতে বলল সিমি।
“শুধু আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই সিমি। তুমিই তো বললে আঙ্কেল ফিলিপ অনেক অসুস্থ, একবার দেখে না আসলে খারাপ দেখায় খুব। তাই তো যাওয়া হল”।
সিমি ততক্ষনে ভেতরে ঢুকে লাইট জ্বালাল, “কিন্তু আমি তো বলেছিলাম তোমার বাইকটা নেয়ার জন্য। তুমি বললে বাসে যাবে। রোজডেলের দিকে বাস সার্ভিসের বাজে অবস্থা সেটা তো জানতেই”।
“কিন্তু তুমি তো জানতে সাজিদ খান কোস্টারিকার বদলে সরাসরি ক্যালিফোর্নিয়ার আসছে ১১তম জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে। আমরা তো বাড়িতে না ফিরে সরাসরি এয়ারপোর্টের দিকে চলে যেতে পারতাম”।
সিমি রিমোট টিপে টিভি অন করতে করতে বলল, “ছাই পারতাম! এখন সেখানে যে ভিড় হয়েছে তোমার ধারনা আছে কোন? আগে আগে যেতে পারলে হত। এখন আর একনজর দেখতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। তারচেয়ে টিভিতেই দেখি”।
টিভি অন হতেই রিপোর্টারের কথা শোনা গেল। “...... ক্যালিফোর্নিয়া বাসী ভাবতেও পারেনি সাজিদ খানের ১১তম জন্মদিনের সাক্ষী হয়ে থাকবে তারা। সাজিদ খানের যাওয়ার রুটে ক্যালিফোর্নিয়া আসার কোন প্লান ছিলনা। পেরু থেকে কোস্টারিকার উদ্দেশ্যে উড্ডয়নের পর জানা যায় কোস্টারিকায় যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কোস্টারিকা ভ্রমন ও কোস্টারিকা সম্বন্ধীয় কিছু বৈদেশিক চুক্তির স্বাক্ষরের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীদের দাবী মেনে রাজধানী স্যান জোসের দুটি এয়ারপোর্ট থেকেই যুক্তরাষ্ট্র গামী এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত সকল ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় কোস্টারিকায় ল্যান্ড করাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এদিকে পেরু থেকে টেক অফ করার আগেই খবর পাওয়া যায় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি সমুদ্রে নিন্ম চাপ থেকে প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে, হাওয়াইয়ের দিকে ধেয়ে আসছে সাইক্লোন। তাই সময়ের আগে থাকার জন্য সমগ্র মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে সাজিদ খান ল্যান্ড করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ৪২৮৯.৪৯ মাইল পথ পাড়ি দিতে সাজিদ খানের প্লেন মেক্সিকো সিটিতে একবার অল্প সময়ের জন্য নেমেছিল রিফুয়েলিং করতে। ক্যালিফোর্নিয়া কোস্টারিকার তুলনায় টাইম জোন অনুযায়ী দুই ঘণ্টা পিছিয়ে আছে, তাই এখান থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার জন্য হাতে এখনও দু ঘণ্টা সময় রয়েছে। দূরত্ব ২৪৭১.৩৭ মাইল। আমরা এখন চলে যাব বেকারস ফিল্ড এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। সেখানে আমাদের প্রতিনিধি হ্যারিস আছেন সাজিদ খানের সাথে”।
লাউঞ্জে রিপোর্টার হ্যারিস শুরু করলেন, “ভিউয়ারস, আমরা এখন আছি বেকারস ফিল্ড এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। আর কিছুক্ষন পর ক্যালিফোর্নিয়ার সময় অনুযায়ী বাজবে রাত ১২টা। সাথে সাথে কেক কেটে ১১তম বারের মত জন্মদিন পালন করবেন সাজিদ খান।
কিন্তু দর্শক, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন লাউঞ্জ জুড়ে সবার মাঝেই একটা মনমরা ভাব। সাজিদ খান নিজেও এখন আর হাসছেন না। দীর্ঘ সময়ের জার্নির কারনে তিনি এবং পাইলট জন ল্যাম্পারড দুজনেই ক্লান্ত। তবে মন খারাপের কারন ক্লান্তি নয়। মন খারাপের কারন হচ্ছে দুটো। প্রথম কারনটি আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন। সাজিদ খানের স্ত্রী সুচিত্রা পেরুতে পৌঁছানোর পর খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পরেন। তাই তার পক্ষে আর ক্যালিফোর্নিয়া আসা সম্ভব হয়নি। তিনি পেরুর লিমা অঞ্চলের ন্যাশনাল হসপিটাল দেল সুরে ভর্তি আছেন। একটু সুস্থ হলে পরবর্তীতে অন্য প্লেনে চেপে তিনি হাওয়াইতে ফেরত আসবেন সাজিদ খানের সাথে যোগ দিতে। এবার আসি ২য় কারনটির প্রসঙ্গে। আপনারা জানেন ইতিমধ্যে হাওয়াই দ্বীপ পুঞ্জে সর্বোচ্চ বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। সামুদ্রিক ঝড় উঠেছে নর্থ প্যাসিফিক সমুদ্রে। সাইক্লোন ধেয়ে আসছে ক্রমশ। ঝড় না থামা পর্যন্ত হাওয়াইকে নো ফ্লাই জোন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং সকল ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। তবে কি শেষে এসে সমস্ত পরিকল
Published on August 15, 2013 18:45
গুডরিডস ব্লগ
এই ব্লগে নাজিম উদ দৌলার লেখা ছোট গল্পগুলো পড়তে পাওয়া যাবে।
- Nazim Ud Daula's profile
- 151 followers
