....স্পষ্ট দেখতে পাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের এক কোণে সস্তা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়ে দাবা খেলে চলেছেন আবদুর রাজ্জাক। প্রতিপক্ষের একটি একটি করে গুটি তিনি কাটেন, তারপর সেটিকে পাশে না রেখে জমা করেন নিজের বাঁ হাতের মুঠোয়। মুঠিটি পূর্ণ হয়ে গেলে সৈন্য-সামন্ত-মন্ত্রীরা সব ছিটকে যায় চারপাশে। আমার ঢাকা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। যতই আঁকড়ে ধরতে চাই, আমি জানি, তার হাতের মুঠি পূর্ণ হয়ে উঠবে একদিন। প্রতাপশালী রাজা, মান্যবর মন্ত্রী আর তুচ্ছ সৈন্য— এ শহর সবাইকে ছেড়ে দেবে তখন।
Shuhan Rizwan is from Bangladesh. His debut novel, a historical fiction named 'সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ (Knight in the Oblivion)' was published in 2015; since then, he published 3 more full-fledged novels. His novels often centered around the geo-political nuances and predicaments of life in contemporary Dhaka.
Apart that, Shuhan is a screenwriter too, and the recipient of Chorki Best Screenplay Award-2022.
Being a Mechanical Engineering Graduate, Shuhan choose to be a fulltime writer since 2020. Now when he is not writing in his muddled studio, he spends most of his time reading, traveling with his wife and watching sports events.
বইটির কিছু অংশ অতীব চমৎকার। বৃষ্টিস্নাত ঢাকা শহর, শামসুর রাহমানের সাথে মানস ভ্রমণ, লেখালেখির জন্য চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত, আত্মজিজ্ঞাসা, বিভিন্ন কথাসাহিত্যিককে নিয়ে লেখকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ পড়তে দারুণ লাগে।
সুহান রিজওয়ানের উপন্যাসের ভাষা এতো সহজ আর সাবলীল কিন্তু দিনলিপির কিছু কিছু বাক্য অতিদীর্ঘ, অলংকারবহুল ও অনাবশ্যক রকমের জটিল। এছাড়া দিনলিপি হিসেবে বইটি অত্যাধিক পরিমার্জিত ও পরিশীলিত। একান্ত ব্যক্তিগত খাতায় যে গহীন গোপনের লেখককে পাওয়ার কথা পাঠকের, তার দেখা কমই মেলে। নিজের দিনলিপিতে সরাসরি কারো নাম ধরে দোষারোপ না করে "শার্লকের শহরে বসে দরদাম করে তিরিশ লক্ষকে তিনে নামাতে চাওয়ার ফেরিওয়ালা" জাতীয় ধোঁয়াশাপূর্ণ বাক্য দেখতে খটকা লাগে। সবমিলিয়ে বইটি পড়ে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।
বইটি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে বইটির নাম নিয়ে সংশয়। নাম এমন কেন? চতুর পাঠকরা অবশ্যই নাম দেখে ধারণা করে নেবেন যে লেখক কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানাকে তার বইয়ের নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বইয়ের নামটি কথায় বলতে গেলে, "তেইশ ডিগ্রি চুয়াল্লিশ মিনিট আটচল্লিশ সেকেন্ড থেকে নব্বই ডিগ্রি বাইশ মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড" এইরকম শোনাবে। এরপর এই লোকেশনটা যদি আপনি আপনার স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারের ম্যাপে খোঁজ করেন তাহলে সুনির্দিষ্ট ভাবে যে ঠিকানার উল্লেখ পাবেন সেটা হলো ঢাকা শহরের মিরপুর রোডের পাশের একটা ঠিকানা। এর কারণ হলো লেখকের বেড়ে ওঠা ঢাকা হওয়া সম্ভবত। তবে তিনি ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, অফিসের কাজে চীন ভ্রমণ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইউরোপ ভ্রমণের কথাও যোগ করেছেন তার বইয়ে।
এরপর আসি বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে, বইটা লেখকের জার্নাল। ২০১৫ থেকে ২০২০। দীর্ঘ ৬ বছরের লেখকের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়, চিন্তাভাবনা, নিজের কথা উঠে এসেছে বইটিতে। তৎকালীন সময়ে ঘঠে যাওয়া নানান আলোচিত ঘটনাগুলি সম্পর্কে নিজের মন্তব্য যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে বিভিন্ন মুভি কিংবা সিরিজ নিয়ে কথা, বই নিয়ে আলোচনা, বিভিন্ন লেখক কিংবা লেখিকার লেখা অথবা উনাদের বক্তৃতা শোনার অভিজ্ঞতা সাথে সাক্ষাৎ লাভের ঘঠনা-ও উল্লেখ্য।
একজন লেখকের জার্নাল পড়ার মানে হলো তার নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা। তাতে তাঁর লেখার উপকরণ নিয়ে কথা যেমন রয়েছে তেমনই লেখা নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাসহ সাহিত্য বিষয়ক চিন্তাভাবনাও উপস্থিত। তার মানে আমরা লেখকের ব্যক্তিগত চিন্তার জগতের আরো কাছে যেতে পারছি। তাঁর চিন্তাভাবনাগুলোর পাশে যাওয়ার জন্য জার্নাল চমৎকার এক উপায় বলে মনে হলো। বইয়ের এক পর্যায়ে দেখেছি লেখক পুরোদস্তুর লেখক হওয়ার জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। আমি যদি ভুল না হই তাহলে কিছুদিন আগে লেখক সেই দুঃসাহসী কাজটাই করে ফেলেছেন। তারমানে আমরা হয়তো ভবিষ্যতে এমন একজন লেখকে পাবো যিনি পুরোদস্তুর লেখক। জার্নাল পড়ে আরেকটা অনুভূতি হলো যেটার কথা না বললেই নয়। আপনি হয়তো একটা ঘটনা বা প্রেক্ষাপটকে একটা দৃষ্টিতে দেখছেন এখন আপনি জানেন যে ব্যক্তিভেদে যেকোনো প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। জার্নাল সেই সুযোগটিই করে দিয়েছে খুব সহজে, লেখকের মনোজগতে প্রবেশের(অবশ্যই লেখক যতটুকু প্রবেশ করতে দিয়েছেন তার মনোজগতে) একটা সুযোগ। লেখক বিভিন্ন ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন তাঁর দেখার সাথে আমার কিংবা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির মিল কিংবা অমিলটা ধরতে পারবেন।
সুহান রিজওয়ানের কোন লেখা(উপন্যাস) আমার পুরোপুরি পড়া হয়নি। তবে পড়ার তীব্র ইচ্ছে রাখি। আমার পরিচিত পাঠকের সুবাদে তাকে চিনেছি,ফেসবুকের কল্যাণে ভদ্রলোককে আরেকটু ভালো ভাবে জেনেছি। টুকটাক তার লেখা পড়ি ফেসবুক ওয়ালে,ভালো লাগে,আরো পড়ার সুপ্ত বাসনা জাগে।
পরীক্ষার বোঝা কাঁধে নিয়ে যখন, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত তখন জানতে পারলাম সুহান সাহেবের জার্নাল প্রকাশ হবে, সহজ ভাষায় "দিনলিপি"। আবার উপরি পাওনা হিসেবে জানতে পেলাম,লেখক চট্টগ্রামে আসবেন এবং পাঠকের মুখোমুখি হবেন। এই খবরে খুব অবাক হয়েছিলাম কারণ লেখকরা খুব একটা চট্টগ্রাম মুখী হন না,তারা তাদের বৈকুণ্ঠধাম " ঢাকাতেই" থেকে যান। যাই হোক,সুহান সাহেব এসেছিলেন,মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনেছি। ভদ্রলোকের প্রতি আমার ভালো লাগা আরো বৃদ্ধি পেল।
আমার একটা বাজে স্বভাব আছে,যাকে ভালো লাগে,তার খুঁটিনাটি জানতে ইচ্ছে করে। সেই জন্য সুহান সাহেবের দিনলিপি পড়তে দেরি করি নি...
পড়া শেষ, শুধু একটুকু বলব যে "আমার ভালো লাগা কয়েকগুন না,কয়েক হাজার গুন বেড়ে গেল"। অনেক দিন পর নিজের আরেকজন প্রিয় মানুষ কে আবিষ্কার করলাম,এই সুখ, কি যে সুখ,তা কখনো বলে বোঝানো যাবে না। " সুহান সাহেব,আপনি লিখুন,আপনি পড়ুন,আপনি এই পঁচে যাওয়া পৃথিবীতে একজন শুদ্ধ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকুন। আপনাকে ভালোবাসি। "
সুহান ভাইকে ১মবার চিনি সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রান বইয়ের লেখক হিসেবে। এরপর ব্যাক্তি সুহান ভাইকে চিনি ২০১৬ সালের বই মেলায়। এখন ২০২৩ সালে উনার জার্নালের মাধ্যমে ৩য় দফায় চিনলাম।
উনার উপন্যাসে চারপাশের সব কিছু নিয়ে একরকমের হতাশা, আশাভঙ্গতা টের পাওয়া যায়। তাতে হয়তো থাকে কিছু আশার আলোর উঁকিঝুঁকি। জার্নাল ব্যক্তিগত লেখা সেখানে উনার চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা, বিষণ্নতা, রাগ উঠে এসেছে। লেখায় যখন দেখি গালি দিচ্ছেন, কাউকে তাচ্ছিল্যভাব নিয়ে কিছু বলছেন তখন আতকে উঠি এ কোন সুহান রিজওয়ান!
কয়েকদিন আগে Home নামে একটা মালায়ালাম সিনেমা দেখেছিলাম। বাবা-মা, দুই ভাই আর দাদুকে নিয়ে সংসার। বাবার শখ হয় স্মার্ট ফোন ব্যবহারের। একদিন তিনি ভুলেভালে ফেসবুকে লাইভে চলে যান আর ঠিক সে সময়েই স্ক্রীপ্ট রাইটার ছেলে তার ডিরেক্টরের সম্পর্কে কিছু বেফাস কথা বলে বসে। এরপর ত চারদিকে ছিছিকার পরে যায়। এই নিয়ে মেলা জল ঘোলা হওয়ার পর সিনেমার শেষে গিয়ে ছেলেটা একটা চিঠি লেখে.... বাইরে হিংসা, ঈর্ষা, রাগ হলেও দেখানো যায় না পারফেক্ট হওয়ার চেষ্টায় এসব চেপেচুপে রাখতে হয়। কিন্তু বাড়িতে পারফেক্ট হওয়ার ভরং করার দরকার হয় না। বাড়িতে আমাদের ইমপারপেক্ট আচরণই বের হয়ে আসে। সো রাগের মাথায় বাড়িতে বসে বলা কিছু কথা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে তাকে যেন দূরে সরিয়ে না দেয় ডিরেক্টর। চিঠির মূল বিষয়টা এরকমই।
এই জার্নাল পড়তে গিয়ে বারবারই চিঠির কথাটা মনে হয়েছে। জার্নালে যা মনে আসে তাই ই ত লিখবে মানুষ। নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগা, রাগ, ঈর্ষা, হতাশা বিশেষ করে অন্যকে না বলা কথাগুলো। ওখানে পারফেক্ট হওয়ার চেষ্টা করার দরকার নাই। ওটা একান্তই নিজস্ব লেখালেখির জায়গা। কোন কোন লেখক সাহস করে নিজের এই ইমপারফেক্ট জায়গাটুকু পাঠকের হাতে তুলে দেন (যদিও এডিট করা থাকে)।
সুহান রিজওয়ানের এই বইটা ব্যক্তিগত জার্নাল। বইটার নামকরণ ইন্টারেস্টিং। গুগল ম্যাপে সার্চ দিলে ঢাকার ধানমন্ডি চলে আসে।
লেখকের ঢাকা আবিষ্কার, সাহিত্যচর্চা, চিন্তাভাবনা দুর্বোধ্যভাবে শেয়ার করেছে এই জার্নালে। ব্যক্তিগত জার্নালে তাই হওয়া উচিত বুঝি। একজন মানুষের ভেতরের সুরূপ-কুরূপ, তার ভালো-মন্দ চিন্তা সচরাচর ডায়েরিতে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এই বইটা প্রকাশের আগে বোধহয় কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছে।
আমার বিশ্বাস ডায়েরি লিখলে দুঃখ কমে, নিজেকে আবিষ্কার করা যায় গভীরভাবে, নিজের চিন্তাভাবনাকে সুসংহত করা যায়। তাছাড়া নিজের পঞ্চইন্দ্রিয়ের ভাবনাগুলো অর্থাৎ কী পড়ছি/দেখছি/শুনছি/ভাবছি/করছি তার একটা দলিল থাকে। পরবর্তী জীবনে জার্নালে চোখ বুলালে নিজের অতীত জীবন চোখের সামনে চিত্ররূপময় হয়ে ধরা দেয়। আমরা বুঝতে পারি যে দিনেদিনে আমরা নিজেদের শুধু গড়ছি আর ভাঙ্গছি। নিজেকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলতে থাকে আমরণ।
ইন্টারনেটের যুগে আমরা অনেকে হয়তো নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-ব্যর্থতা, রাগ-ক্ষোভ, দুর্বলতা সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করি। কিন্তু আসলে বর্তমানে সবাই নিজেকে পন্ডিত মনে করে এবং অন্যের সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করে। এজন্য নিজের ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাভাবনা গুলো যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ না করে ডায়েরিতে লেখা যায় তাহলে মনে শান্তি চলে আসে। আমাদের দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-ব্যর্থতা, রাগ-ক্ষোভ, দুর্বলতাগুলো নিজের মধ্যেই থাকে। যার ফলে আমরা ভালো থাকতে পারি। তাই জার্নাল লেখার একটা ভীষণ উপকারিতা আছে।
সুহান রিজওয়ানের লেখা অন্য বইগুলো পড়ার ইচ্ছে আছে।
লেখক সুহান রিজওয়ানের ব্যাক্তিগত জার্নাল। নাম খুব খটোমটো আর দাঁতভাঙ্গা, বইয়ের দোকানে গিয়ে বইয়ের নাম বলে কিনতে পারার জো নেই। তবে গুগল ম্যাপে এই অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ বসিয়ে দিলে যে লোকেশন স্ক্রীনে আসে তা হলো মিরপুর রোড ঘেঁষে থাকা ধানমন্ডির কোন একটা জায়গা। জার্নালের শুরুতে লেখকের ভূমিকা পড়ে বুঝেছি এই জার্নাল লেখালেখির সময় সুহান ধানমন্ডির ঐ এলাকার কোন বাড়িতেই থাকতেন। জার্নাল, বায়োগ্রাফি বা মেমোয়ার টাইপের লেখা পড়তে আমি ভীষণ পছন্দ করি, এতে করে লেখককে খুব কাছ থেকে জানা যায়, মনে হয় যেন লেখকের মস্তিষ্কের ভেতরে মোড়া পেতে বসে তাঁর চোখেই সবকিছু দেখছি। ২০১৫-২০২০, এই সময়কালে সুহানের চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আশা, নিরাশা ও চিন্তার দারুণ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই জার্নালে। নিত্যদিনের অতি-সাধারন ঘটনা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে দেশ, রাজনীতি, সাহিত্য, খেলাধূলা, বৈশ্বিক পরিস্থিতির নানা দিকও। বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের কঠিন সময়, প্রকাশক দীপন ও টুটুলের উপর উগ্রবাদীদের আক্রমণ, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ফুটবল আর ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন, কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ হামলা, কোভিড মহামারী সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে এই জার্নালে। খুব ছোট পরিসরে হলেও এই জার্নাল আজ থেকে ১০/১৫ বছর পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার এক গুরুত্বপূর্ন অনুস্বারক হয়ে থাকবে। সুহান নিজে লেখক, পড়তে ভালোবাসেন খুব। জার্নালের বিভিন্ন পাতায় বিশ্ববিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বেশকিছু বইয়ের নাম উঠে এসেছে, যা ঐ সময়ে সুহান পড়ছিলেন। এসেছে বইগুলো নিয়ে তাঁর মতামত। ঢাকার লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল ও ছোট ছোট বেশকিছু সাহিত্য সম্মলনের টুকরো টুকরো স্মৃতি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, বিদ্যুৎ বিভাগের চাকুরীর নানা ঘটনা এবং চীন ও ইউরোপ ভ্রমণের বর্ণনা পড়ে আরাম পেয়েছি। আমি নিজেও ইউরোপের বেশ ক’টা দেশ ঘুরেছি বলে সুহানের সাথে নিজের পুরনো স্মৃতিগুলোও একটু ঝালিয়ে নিয়েছি। সুহান তাঁর দ্বিতীয় বই ‘পদতলে চমকায় মাটি’ লিখতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায় ও তাঁদের জীবনযাত্রা নিয়ে প্রচুর পড়েছেন, সবকিছু জার্নালে আসেনি। লেখকের প্রতি অনুরোধ রইলো পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত অভিজ্ঞতা লেখার জন্য। লেখক হিসেবে বা লেখেলেখি নিয়ে সুহান বেশ খ্যাপাটে! এই পুঁজিবাদের যুগে শুধুমাত্র লেখালেখির জন্য কেউ সরকারি চাকুরী ছেড়ে দিবে, এমন পাগলামী সুহানের মতো সাহিত্যপ্রেমী, পড়ুয়া কারো পক্ষেই সম্ভব। চাকুরি ছাড়ার সময়ে বুয়েটের আশিক স্যারের সাথে কথোপকথনের অংশটুকু ভালো লেগেছে খুব। আশিক স্যার বলেছিলেন, “ সামাজিক অনিরাপত্তা নয়, বাঙালিরা যে আসলে স্বপ্ন তাড়া করে না, সেটার মূল কারণ তাদের ভীরুতা”। সুহান সেই ভীরুতা কাটিয়ে নিজের স্বপ্ন কে তাড়া করার সাহস দেখাতে পেরেছেন, এইটুকু কয়জনে পারে? সুহানের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
বেশ ভালো ভালো রিভিউ থাকলেও হতাশ করলো বইটা। সবচেয়ে ভালো দিক বিগত আধ দশকের ঢাকার বৃষ্টির চমৎকার বর্ণনা। এর বাইরে উপন্যাস লেখা নিয়ে লেখকের গভীর চিন্তাভাবনা, ইউরোপ ট্যুর আর সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারগুলো ভালো লেগেছে। বাকিটা শুধু প্রলাপের মত অনর্থক জটিলতায় বিভিন্ন বাস্তব আর অবাস্তব চরিত্র আর ভাবনা চিন্তার জগাখিচুড়ি। ভবিষ্যতে ভাব নেওয়া টাইপ মানুষজনের কোটেশন দেয়ার আরেকটা উৎস বাড়লো।
"দিনলিপি লিখতে বসে এসব আলাপ করতে ইচ্ছে করে না। ডায়েরি তো লিখা উচিত প্রফেসর শঙ্কুর মতো, পাতার পর পাতা যেখানে ভরে থাকবে রোমাঞ্চকর অভিযানে। 'মরুরহস্য' গল্পে উধাও হয়ে যাওয়া ডিমেট্রিয়াস ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিল: 'আমার চাই উন্মুক্ত প্রান্তর। আমার চাই সাহারা।' কী চাই, অমন স্পষ্ট করে ডায়েরিতে তা লেখা কি আমার পক্ষে সম্ভব হবে কখনো?"
সুহান রিজওয়ান। ১৭ নভেম্বর ২০১৫ সনে লিখেছিলেন এসব কথা, তার দিনলিপিতে। তাঁর জার্নালের এ কথাগুলো তো আসলে খুবই সত্য। মানব মনের বহু চিন্তা টেক্সট আকারে কখনো রূপান্তরিত হয়ই না। তার উপর সেই ইউটোপিয়ান সম্পূর্ণ বাকস্বাধীনতা পাওয়ার পরও কি কোন লেখক সব লিখতে পারবেন? এমনকি তাঁর দিনলিপিতে?
২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়কালের নানামুখী চিন্তা-ভাবনা পাওয়া যায় অদ্ভুত নামের এই বইয়ে। ব্লগ যুগের শেষের দিকের সময় থেকে শুরু করে করোনাকালের একাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত এসব লেখালেখি। লেখক সেই সময়কার প্রাসঙ্গিক, অস্বস্তিকর এবং বিভিন্ন পরিবর্তনের কথা বলে গেছেন বেশ সুন্দর ভাষায়।
সুহানের ঔপন্যাসিক হওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার সাথে দেখা মিলতে পারে পাঠকের। পুরো জার্নাল জুড়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের সাথেও সাক্ষাত হয়ে যাবে রিডারের অনেকটা জাদুবাস্তবতার মতই। উপন্যাস, গল্প তথা রাইটিং নিয়ে যেমন লেখক আলোচনা করেছেন প্রচুর, ঠিক তেমনি বিভিন্ন বইয়ের খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু মোক্ষম অংশে দৃষ্টিপাত করেছেন সুহান।
লেখকের এঞ্জিনিয়ারিং জীবন, ইউরো ট্রিপ, চীনের অভিজ্ঞতা, ইতিহাসবোধ, সমসাময���িক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থলন একদম স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে এসেছে তাঁর অনন্য গদ্যের হাত ধরে। সুহান রিজওয়ানের লেখার মধ্য বা আশপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পাঠক হয়তো বা হয়ে যেতে পারেন মুগ্ধতার কারণে অন্যমনস্ক। আবার তাঁর মধ্যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে শুধুমাত্র নভেলিস্ট হওয়ার প্রচন্ড ডিজায়ার এবং সেরূপ জীবনযাপন হয়তো ঈর্ষান্বিত করতে পারে অনেককেই।
সুহান রিজওয়ান সম্ভবত কবিতা লিখেন বা লিখতেন। কারণ বারবার বিভিন্ন উপমা, ভঙ্গিমা, ইশারা চলে আসে তার গদ্যে। তবে এইসকল ইনডাইরেক্ট কথাবার্তা পাঠকের সহ্যের সীমা ছাড়াবে না, মনে হয়। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে আমি শুধুমাত্র 'পদতলে চমকায় মাটি' পড়েছি। স্লো বার্ণ এই উপন্যাস আমাকে চমৎকৃত করেছিলো। বিশ্বজুড়ে অত্যাচার-বৈষম্যের শিকার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির প্রতি লেখকের অনন্য পক্ষপাত আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একইসাথে ঢাকার এবং সেই অদ্ভুত শহরের ভৌগলিক এবং যাপনের চিত্রায়ণও আছে উক্ত বইয়ের ছত্রে ছত্রে।
সুহান রিজওয়ানের দিনলিপি সুন্দর এবং শক্তিশালি গদ্যে রচিত। লেখক যে প্রথমে একজন পাঠক তা তাঁর লেখায় ঘুরেফিরে আসে। প্রচুর বই পড়েন তিনি যা দিনলিপিটি পাঠ করলে বুঝা যায়। ব্যক্তিগত কোন পরিচয় না থাকলেও লেখক আমার গুডরিডসেও আছেন। তাই সুহানের বহু বই পড়ার আপডেট আমার গুডরিডস নিউজফিডে চলে আসে।
সুহানের মতে, একজন ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য যে বিপন্ন বিস্ময় দিয়ে যেতে হয়, যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সাথে থাকতে হয় ঠিক সে কারণেই ঔপন্যাসিকের পদতলে চমকায় মাটি।
ধানমন্ডির যে ল্যাটিচিউড এবং লঙ্গিচিউড ( অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ) দিয়ে নিজের পছন্দের অবস্থানের উপর বইয়ের নামকরণ, এবং এক বসায় পড়ার মত গ্রন্থটি পড়ে আমার মতে, একজন ঔপন্যাসিকের শুধুমাত্র পদতলে মাটি চমকায় না। সেই নভেলিস্টের আশেপাশে, এমনকি মহাকাশ পর্যন্ত অসীম উপরিতল চমকাতে থাকে।
বই রিভিউ
২৩° ৪৪' ৪৮" ৯০° ২২' ৫০"
( সুহান রিজওয়ানের জার্নাল )
লেখক : সুহান রিজওয়ান প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০২৩ প্রকাশনা : চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন প্রচ্ছদ : আজকা ঈশিতা জঁরা : নির্দিষ্ট সময়কালের আত্মজীবনীমূলক, জার্নাল, দিনলিপি। রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
ব্যক্তিগত দিনলিপির সাথে আমার আত্মিক সম্পর্কটা বহু পুরানো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার শেষে যে বিকেলে ছোট খালা হাতে তুলে দেন 'অ্যানা ফ্র্যাংকের ডায়েরি' ঠিক সেদিন থেকেই সম্পর্কের শুরু। বলা বাহুল্য, সে কারণেই চতুর্থ শ্রেণী থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত এমন কোন বছর যায়নি, যে বছর নতুন ডায়েরিতে নিজের অপুষ্ট মানসিক জগতের ছাইপাঁশ লিখিনি। ফলে, কিছু উপলব্ধি আসার কারণে ও ডায়েরির গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে; একদিন সব বড় বড় সাহিত্যিকদের দিনলিপিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেই আনাড়ি লেখার যাত্রা থামিয়ে দেই। সুহান রিজওয়ানের জার্নাল পড়া শুরু করতে গিয়ে তাই সংগত কারণেই কিছুটা স্মৃতিকাতর হতে হয়। একইসাথে টুটুল ভাই, তারেক ভাই, রণদীপম দা ও দীপন ভাইয়ের কোপ খাবার সেই ৩১ অক্টোবরের ট্রমাও নতুন করে মস্তিকে ঝাঁকি মেরে বসে। অনুভব করতে পারি, শাহরুখ খানের প্রেমময় ডায়লগের পিছু ফিরে তাকানোর তাগাদা নয় বরং সমসাময়িক সময়ে অন্য কারও চশমায় দৃষ্টি ফেলে, জুতোয় পা গলিয়ে অতীতে ফিরে দেখাটা কখনও ট্রমার, কখনও সংকটের আবার কখনও নিখাদ ভালোলাগার।
একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, আমরা মানুষরা বৃক্ষের মতো। কোন শহরে দীর্ঘদিন থাকলে, কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়মিত আড্ডা দিলে, একই সিগন্যালে প্রতিনিয়ত থামলে সেখানে আমাদের অভ্যন্তরীণ এক অদৃশ্য শিকড় গড়ে ওঠে। তারপর স্মৃতি-বিস্মৃতি ডালপালা ছড়ায়। সে কারণেই ঢাকা হোক কিংবা কান্ট্রি সাইডে থাকা প্রবাসের ছিমছাম শহর, দুটোই আমাকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করেছে সব সময়। তাই সুহান যখন ঢাকার কথা লেখে, ইতিহাসের কথা লেখে, যখন দু:সহ জ্যামের ভেতর আটকা পড়ে প্রতিটি পথচারীর মুখের পানে তাকায়, তখন সেই লেখার সাথে, শব্দের সাথে, কোন এক বাউলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয় অবিরত।
আর এই মায়াবী অথচ ডিস্টোপিয়ান ঢাকাকে বর্তমান সময়ে সুহান রিজওয়ানের মতো করে আর কেই বা তুলে নিতে পেরেছে নিজ করতলে? জার্নালের বোধ্য, দুর্বোধ্য ও অর্ধ-স্ফূট ভাষা সে জন্যই দীর্ঘদিন ধরে ভালোবেসে যাওয়া নাগরিক মনের গলিপথে আঁচড় কেটে যাবে গভীরভাবে। কোহেনের বিখ্যাত ব্লু রেইনকোট নাই বা থাকলো; তবে ফেব্রুয়ারির শেষ শনিবার ভোরে, জার্নাল শেষ করে উপলব্ধি করতে পারি, যতই ব্যক্তিগত জানাশোনা থাকুক, দিনশেষে লেখার টেবিলে মগ্ন হয়ে লিখতে বসা মানুষটিই আসলে সমস্ত সত্ত্বা পেরিয়ে আমাদের পরিচিত হয়ে উঠেছে।
যতটা না দিনলিপি, তার চেয়েও বেশি মনে হয়েছে লেখকের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোর একত্র প্রকাশ। কারণ সাধারণ ডায়েরির একঘেয়েমী থেকে এ লেখা একেবারেই মুক্ত। এখানে নানান সময় নানান রূপ ধরে সাহিত্য, মিউজিক আর মুভিরই আনাগোনা বেশি। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে যায় সুহান আর তার দৈনন্দিন জীবনের কিছু কিছু কথা। যেখানে পদতলে চমকায় মাটি উপন্যাস লেখার কালটা রয়েছে, রয়েছে উপন্যাসের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে গিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার কথা। ব্লগারদের খুন দিয়ে শুরু হওয়া বইটা শেষ হয় বাউল গান দিয়ে। বিষয়বস্তু আর ভাবনার বিচিত্রিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে সুহান রিজওয়ান আমার অন্যতম প্রিয় একজন। তাঁর প্রতিটা বইই আমার সংগ্রহে রয়েছে এবং পড়া। তাঁর লেখার একটা আপাতকাঠিন্য আছে, কিন্তু আমি সেটা পছন্দ করি। আমি বিশ্বাস করি সকল বই সবার জন্য না। বইয়ের আলাদা আলাদা পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। এছাড়াও লেখকের সাথে অনেক ভাবনা মিলে যায়। তাঁর দেখা-পড়া মিলে যায়। তাই লেখককে বেশ কাছের মানুষ বলে মনে হয়। একজন কমলালেবু পড়ে আমার অনুভূতিটা যা হয়েছিল তা হুবহু সুহান রিজওয়ান এর সাথে মিলে যেতে দেখে মজা লাগল। ভালো লাগল জাফর ইকবালকে নিয়ে তাঁর ভাবনাও। আসলে আজকের যুগে পাঠক-লেখকদের সংখ্যা তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম! সেখানে বিশ্বসাহিত্যের অলিগলিতে নিরন্তর ঘুরে বেড়ানো সুহান এক ব্যতিক্রমই বটে৷ অত সুন্দর সুন্দর কথাগুলোর মাঝে গালিগালাজগুলো না থাকলেও বোধহয় হত, আমার অতি নীতিবান অবচেতন মনের ভাবনা এটা। সচেতনভাবে গালাগালিকেও শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলে বাহবা দেয়ার লোকই আমি! বইটা টানা পড়া একটু কঠিনই, মাঝে মাঝে অল্প একঘেয়েমি পেয়ে বসে, কারণ লেখাটা ওই যে বললাম একেবারে সরল-সোজা নয়। হৃদয় এবং মস্তিষ্ক, ব্রেনের দুই ধরনের কাজই সমভাবে চালাতে হয় তো। মুভিগুলো প্রায়ই দেখা, বাকেট লিস্ট বোধহয় বেশ আন্ডাররেটেড একটা মুভি। যদিও দেখেছিলাম ছাত্রজীবনে। অবশ্য আমার ছাত্রজীবন তো আবার ফুরোবার নয়। তাই ছাত্রজীবন বলে নস্টালজিয়া করার তেমন একটা ফুরসত নেই! সুহান রিজওয়ান আবার আমার এক বন্ধুর পরিচিত ছিলেন। সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ বের হওয়ার পরপরই সেই বন্ধুর মুখে নাম শুনি তার, কেবল শুনি সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ পড়ছি৷ উন্নাসিক আমার তখন সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে তেমন কোন ধারণাই ছিল না! কিন্তু বন্ধুটির রুচিবোধের উপর ছিল ষোলো আনা ভরসা। পরে যখন আরণ্যক আর আনা কারেনিনার মাধ্যমে সত্যিকারের পাঠকে রূপান্তরিত হলাম, ভাবলাম এইবার দেখি তো কী আছে এতে! ব্যস! সাক্ষী থেকে পদতল হয়ে গ্রাফিতি আর আজকের এই জার্নাল। সবকটাই আমার মনে হয়েছে বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছে নয়া মাত্রা। তবে আমার ব্যক্তিগত প্রিয় গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে। দুর্দান্ত! একী! সুহান রিজওয়ান এর জার্নাল পরে নিজেই লিখতে শুরু করে দিলা��� যেন ব্যক্তিগত কথামালা। এখানেই থামা দরকার।
কিছু কিছু বই আছে যেসব পড়ার জন্য লেখকের কাছাকাছি পর্যায়ের পড়াশোনা থাকা প্রয়োজন। এমন কথা যে লেখকের সম্পর্কে মনে হয় তার সমান পাঠ অভিজ্ঞতা থাকাটা কঠিন। তবু আজকের দিনে ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া থাকার কারণে লেখক সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়। আবার তার এযাবৎ প্রকাশিত বই পড়া থাকলে লেখকের জার্নাল পড়ে লেখাগুলো রিলেট করা যায়। নইলে সুহান রিজওয়ানের এ বই পড়ে অনেকেই অনেক কিছু বুঝবে না।
তবে বোঝা সহজ হয় কয়েকটা কারণে। সুহান ঢাকার নাগরিক। মাহমুদের ভাষায় ঢাকাজীবী। তাই সুহান ঢাকার যেসব কথা বলে তা কোনো না কোনো সময় মাহমুদ বলেছে এবং না বলে থাকলেও ভেবেছে। মাহমুদ কেবল রঙ মিলান্তি, রুসওয়া, বেলাভূমির লেখক না, সে হতে পারে যে কোনো বাসযাত্রী বা সড়ক আন্দোলনে পথে থাকা কোনো ছাত্র। তাই প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টি দেখে সুহানের দেয়া গালি বা বিরক্তির প্রকাশ সবার জন্য রিলেটেবল। সুহানের স্বপ্নের, পড়ার বা দেখার ইচ্ছাগুলার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা।
ঝরঝরে গদ্য। আর ভাষাটা সুহান রিজওয়ানের নিজস্ব। সেখান থেকে পাঠ অভিজ্ঞতা সুখের। তবে আর দশজন পাঠক তার লেয়ার্ড, উপমা দেয়া কয়েকটা লাইন থেকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বুঝে নিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। বলে রাখা ভালো, যারা বুঝবেন না তাদের জন্য লেখাও হয়নি। কখনো হয় না৷ বুুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব লেখকের না। পাঠককে বোঝার চেষ্টা করতে হয়। জার্নালে দেখা যায় সুহান কিছু একটা খুঁজছেন, অনেক কিছু খুঁজছেন। সেখানে পাঠককেও খুঁজতে হবে। দেখতে হবে সুহান যা দেখছেন। তাহলেই বোঝা যাবে।
কিছু বইয়ের নাম পাবেন, লেখকের নাম পাবেন। সিনেমাও আছে। টুকে টুকে দেখতে পারেন। আমি অবশ্য আরো বেশি আশা করেছিলাম। ততটা পণ্ডিতি সম্ভবত সচেতনভাবেই ফলাননি লেখক। তিনি ফিরেছেন ইলিয়াসে, মাহমুদুল হক, সৈয়দ হকে। প্রুস্ত কাফকা আউড়ে উচ্চমার্গীয় হননি। আর যাদের কথা বলেছেন তাদের নিয়ে নমঃ নমঃ ভাব নেই। তবে কিছু মত, দর্শনে পার্থক্য, দ্বিমত তো থাকেই৷ সেসব আছে। তবে আমি রিশাদ কিংবা রেজা না বলেই এসব নিয়ে সুহান রিজওয়ানের সঙ্গে কথা হবে না। তবে একটা সচেতন বিস্ময় থাকল যে কিছু পর্যবেক্ষণ, কিছু বক্তব্য আমার লেখার সঙ্গে এতোটা মিলে গেল! বিস্ময়টা সচেতন কেননা গ্রাফিতিতেই সেটা টের পাই। এর কারণ হয়ত, আমরা তীব্রভাবে ঢাকাবাসী।
সৌরভের ভাষায়, 'ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে পড়ে ফেলার মতো বই'টা পড়তে আমন্ত্রণ রইল।
Unfinished. ৬৫ পৃষ্ঠা পড়ে আর পরের দিকের কিছু পাতা ঘেটে শেষমেষ ছেড়ে দিলাম। আর আগাবোনা তাই শেষ ও করব না। এই ব্যক্তিগত ডায়েরি বই আকারে ছাপানোর কি দরকার ছিল জানিনা। লেখকের চিন্তাভাবনা যা প্রকাশ পেয়েছে, তার মনের সাথে সরাসরি সংযোগ না থাকলে কিংবা বলা যেতে পারে তার বেস্ট ফ্রেন্ড কিংবা নিদেনপক্ষে তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা আছে এমন কেউ না হলে তার এলোমেলো থট প্রসেসের সাথে কানেক্ট করে তার চিন্তার উপসংহারের মর্মোদ্ধার করা সম্ভব না, অথবা উপসংহারে আসার জন্য এই বই পড়ে যাবার যে ধৈর্য্য ও আগ্রহ প্রয়োজন তার যোগান দেয়াও সম্ভব না। তার ব্যক্তিগত চিন্তার অনেককিছু এবং বইপত্র, ভ্রমণ, ছেলেবেলা, সিনেমা ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট রেলেভেন্স পাবার পরও আমি আগ্রহ ধরে রাখতে পারি নি। কখনো ভাবিনি আমার প্রিয় লেখকের বই নিয়ে এমন রিভিউ লিখতে হবে। হতাশ। এসব বই ছাপিয়ে পাঠকের সাথে মজা না নেয়াই ভাল হয়তোবা।
❝২৩°৪৪'৪৮" ৯০°২২'৫০"❞ সুহান রিজওয়ানের জার্নাল, না স্ক্র্যাপবুক?
এখনকার সময়ের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে যাদের লেখা অন্তর্জালে বা সোস্যাল মিডিয়াতে আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করি, বইমেলায় প্রতিবছর যাদের বইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকি, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুহান রিজওয়ান! সাধারণত সুহান ভাই এর বই তিন-চার বছর পরপর বের হয়। এই বছর কোনো আশাই ছিল না নতুন বই নিয়ে। হঠাৎ বইমেলার আগ দিয়ে লেখকের ঘোষণা আসে বইটি প্রকাশ পাওয়ার। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, প্রকাশ পাওয়ার এক মাসের আগেই প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়, দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ পায়। অবাক করার মতো বলছি অন্য কারনে, লেখক যে জনরার বই লেখেন তা সচারাচর বাংলাভাষী পাঠকসমাজ তেমন পড়েন না - একটু অ্যাডভান্সড পাঠকরা পছন্দ করেন সুহান রিজওয়ানের লেখালিখি, তার উপর লেখকের নিজের ডায়েরি বা জার্নাল নিয়ে কতজনেরই বা আগ্রহ থাকে!
শুরু করি বইয়ের নাম দিয়ে। বইটির নাম দেয়া হয়েছে খুবই অদ্ভুত, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ দিয়ে ❝২৩°৪৪'৪৮" ৯০°২২'৫০"❞ - এই লোকেশনটি হলো ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার একটি কফিশপের। এরকম নাম দেয়ার কারন অবশ্য লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন বইয়ের মুখবন্ধে, তার লেখকজীবনের পদচারণার সাথে এই জায়গাগুলো জড়িয়ে আছে অনেকখানি। তবে হ্যাঁ! সুহান রিজওয়ানের এই উদ্ভটদর্শন খটমটে নাম মনে রাখতে হবে না আলাপ আলোচনার জন্য- লেখক আদর করে বইটির নাম দিয়েছেন সুহানের জার্নাল!
ডায়েরি বা জার্নাল আসলে কি? কেনই বা একজন পাঠক অন্য একজনের ডায়েরি পড়বে? আমার বা আপনার মতো শুধু যারা ছোটখাটো পাঠক, তাদের ডায়েরী কাছের মানুষগুলো ছাড়া কেউ পড়বে না। কিন্তু সে ডায়েরীর লেখক যদি হন কোনো প্রতিযশা লেখক- তাহলে তো আগ্রহ জাগবেই। পাঠকরা তাদের প্রিয় লেখককে খুজে নিতে চান, তার ভাবনাগুলো জানতে চান লেখকের ডায়েরির পাতায়। কিভাবে তৈরি হলো উপন্যাসের চরিত্রগুলো, কেন লেখক গল্প ফেদে বসলেন- আসলে গল্পের প্লট তো লেখকের সাব-কনশাস মাইন্ডের খেলা, আর পুরো গল্প তৈরি হয় শব্দ নিয়ে টুকিটাকি করতে যেয়েই। সুহান রিজওয়ানকে খুজতে গিয়ে তাই দ্বারস্থ হতে হয় লেখকের জার্নালের।
লেখকের নিজের ভাবনাগুলোকে কি-বোর্ডের কালো-সাদা ফন্টে- ওয়ার্ড ফাইলের সিন্দুকে তুলে রাখার শুরু হয়েছিল ২০১৫ তে, অন্তর্জালের সাদা কালো দুনিয়া যখন রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল ঘাতকদের মূহর্মুহ আঘাতে। এই সময় শব্দগুলোকে সবাই তুলে রেখেছিল যত্ন করে আলমারির এক কোনে, শব্দগুলো যেন হয়ে উঠেছিল একমাত্র আশ্রয়, সবকিছু থেকে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন! এ সময় থেকে লেখকের টুকরো ভাবনাগুলো ফিরে এসেছে লেখকের জার্নালে।
ভাবনাগুলো আমাদের সময় কে নিয়ে, আমাদের ঢাকা নিয়ে। প্রতিদিন ঢাকার বিষন্ন যান্ত্রিক জীবনকে আমরা যেভাবে দেখি, লেখক কি ঠিক সেভাবে দেখেন? অনেক গভীর থেকে যেন লেখক দেখেছেন ঢাকার জীবনকে। হয়তঃ 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' এর মূল অনুপ্রেরণা ছিল ঢাকার জীবন! লেখকের চোখে যেন বৃষ্টি ধরা দিয়েছে অনেকটা ডিস্টোপিয়ান ধাঁচে- চারশ বছরের পুরোনো এই ঢাকা ধুয়ে দিতে চায় যেন আমাদের আত্মাকে। নিজের সাথে নিজের বসচা, নিজেকে খুজে দেখা, ব্যক্তিজীবনের টানপোড়ন, দেশি ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য নিয়ে লেখকের ভাবনা- এসব বিষয় এসেছে সুহানের জার্নালে।
❝উপন্যাস যে লিখতে চায়, সে সম্ভবত প্রশ্নটাই জানে, উত্তর তাকে খুঁজতে হয় অক্ষরের সাথে যাত্রায়। ❞- এই উত্তরগুলোই কি সুহান রিজওয়ান খুজতে চেয়েছেন তার নিজের সাথে নিজের কথোপকথনে - তার জার্নালে? ভাবনাগুলো যেন এলোমেলো জট পাকিয়ে যায়- নিজেকে খুজে ফেরার চেষ্টা, কখনো হতাশা, আবার কখনো নতুন স্বপ্ন দেখা- সাথে লেখকের সাহিত্য নিয়ে জানার পরিধি - সবকিছুর এক অদ্ভুত মিশেল বইটি।
❝নিজস্ব একটি ভাষা কীভাবে গায়ে জড়িয়ে হাঁটা যায় মহাকালের শীতল রাস্তায়, পড়তে পড়তে সে চিন্তায় আমি হাঁপিয়ে যাই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ক্লান্তিতে জলাবদ্ধ এই মাদারচোত শহরে আমাদের এলো আবেগের মূল্য এক ফোঁটাও নয়, কিন্তু তবু নিজের কাছে এমনই অভিনয় করি, যেন আমি হেমিংওয়ে বা সতীনাথ ভাদুড়ী.....❞- জার্নালটির সবচেয়ে কৌতুহলউদ্দীপক দিক হলো নিজেকে রিফর্ম করার চেষ্টা- লেখক ধীরে ধীরে নিজের লেখার শৈলীতে নান্দনিকতার ছোয়া দিয়েছেন, নাকি অন্যভাবে চিন্তা করলে এই দিনলিপিগুলো হলো সুহানের স্ক্র্যাপবুক? লেখকের "গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে" -তে ঠিক এই স্টাইলের লেখা দেখতে পাই, যেন লেখক লেখা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন নিজের জার্নালে -নিজের লেখকসত্তার কাছে নিজে জবাব দিয়েছেন, খুজে ফিরেছেন নিজের লেখনশৈলীকে- কখনো তীর্যক মন্তব্য করেছেন দেশের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে। কখনো বা নিজের মতো করে বলে গিয়েছেন নিজের কথা। কখনো বা পরিস্থিতির চাপে হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকেই- ❝আমি মানুষটা কি আজকাল আমিই? না র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে আব্দুল আজিজ ব্যাপারীর ভাড়াটে সুবোধচন্দ্রই প্রেসক্লাব আর ফার্মগেটের মাঝে এখনো ঢাকায় চক্কর খায় নয়টা-পাঁচটা চাকরি নিয়ে? নিজেকে খুঁজে না পেয়ে আমার অথবা সুবোধচন্দ্রের সবকিছু ভেঙেচুরে যায়।❞
এই নিয়েই সুহানের জার্নাল! সাবলীল একটা বই- ইচ্ছা করে যেন অল্প অল্প করে, রেখে রেখে পড়ি। বিশেষ করে ২০১৫-২০১৮ সালের লেখাগুলো খুব সুন্দর লেগেছে পড়তে। তবে কিছু জায়গায় লেখক অনেক লম্বা বাক্য ব্যবহার করেছেন - যা লেখার সাবলীলতা কমিয়ে দিয়েছে খুব অল্প হলেও। এই বিষয় বাদে অসাধারণ লেগেছে এই জার্নাল।
বইটা পড়ার আগে, মাঝে এবং পড়ার পরে তিনটা প্রশ্ন বারবার মাথায় এলো– প্রশ্ন ১. পৃথিবীর সব রাইটার-ই কি মলাটবদ্ধ বইয়ের গ্রন্থকার হওয়ার আগে ডায়েরি বা দিনলিপি লিখেছেন? প্রশ্ন ২. বর্তমানে বাংলাদেশের বেবাক 'লেখক আর্টিস্ট বুদ্ধিজীবী' সমাজ ঢাকায় বসবাস করেন কেন? ঢাকার মতো একটা যান্ত্রিক শহরের প্রতি এই মোহের কারণ কী? প্রশ্ন ৩. আমি কি একমাত্র গাধামানব যে সুহান রিজওয়ানের মোটাতাজা প্রশংসিত উপন্যাসগুলো পড়ার আগে জার্নাল পড়তে এলাম?
সুহান রিজওয়ানের গদ্য আমার ভালো লেগেছে। অনেক রকম বিশেষণে দাঁড়ায়; সাবলীল-কঠিন-স্বতস্ফূর্ত-জটিল। পাঁচ বছরের দিনক্ষণ যাপনের কথাবার্তা লিখেছেন; যেসবের বিষয়বস্তু ছিল কখনো অন্তর্গত বিষণ্ণতা, কখনো ফুটবল প্রেম বা রাজনীতি বা পুরনো স্মৃতি। সাহিত্য বইপত্র, সিনেমা, লিটফেস্ট সম্বন্ধে বিচিত্র সব অনুভূতি লিখলেন সুহান। আমি সেইসব রেফারেন্স টুকে নিলাম আমার ভবিষ্যতে পড়বার অন্তহীন তালিকায়। কিছু তারিখের ওপর কোয়েশ্চেন মার্ক দিয়ে রেখেছি। কোনো একদিন লেখকের কাছে জানতে চাইবো সেসব দিনের বিশদ বিবরণ; এমন আশায় দোষ কী? তার আগে আরেকটু সজাগ হতে চাই। পড়তে চাই।
আনা ফ্রাঙ্ক নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন– Paper has more patience than people. বোধ করি মানুষের ডায়েরি হওয়া উচিত এমন যা অন্যরা পড়ছে না ভেবেই লেখা হবে। শুধুই কাগজের কাছে বলে হালকা হওয়ার মতোন ব্যাপার।
এই বইটাকে মাত্র তিন তারা দেওয়ার কারণ; আমার মনে হলো- লেখকের সত্যিকার দিনলিপির ওপর অনেক ধকল গেছে। অনেক রকম কাঁটাছেড়া, সম্পাদনায় এই জার্নাল এখন ইটসেলফ ক্লান্ত।
আগেও বলেছি, আবার বলছি "সুহান রিজওয়ান আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক"। এই বইয়ে ২০১৫ থেকে ২০২০ এর মধ্যে টুকরো টুকরো জীবনের ছবি, রাজনীতি, বই, সিনেমা, বিভিন্ন আলোচিত ঘটনা উঠে এসেছে । আমি এই ধরনের লেখা পড়তে খুবই পছন্দ করি। নাক লম্বা না করেই অন্যের জীবনে নাক গলাতে পারছি এটার জন্যই বোধহয়।আবার চিরকুটের তুবড়ি ছুটিয়ে নিজের মতের ছুরি চালাচ্ছি, এ বেশ লাগে। কিংবা শুধু ভালো লেগেছে বা লেখকের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারছি,অনুভব করছি, এটার নেশার জন্যই।
বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, "ডায়েরি তো লেখা উচিত প্রফেসর শঙ্কুর মতো, পাতার পর পাতা ভরে থাকবে রোমাঞ্চকর অভিযান "। অথচ আমার আফসোস হচ্ছে লেখক এর মত লিখতে না পারায়।প্রতিটি ঘটনা টুকরো টুকরো গল্পের মত। কিছু সমাপ্ত, কিছু "এই যা!এর পরের দিন কী হলো বললেন না কেনো!” এই আফসোসে ভরা। যখন লেখককের বইয়ের কথা হচ্ছিল, বিশেষ করে "পদতলে চমকায় মাটি" (এটা চারটার ভেতরে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে) আমি আরো বেশি বেশি আশা করেছিলাম। যেহেতু উনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবনের উপর পড়াশোনা করেছেন বলেছেন,এ নিয়ে কিছু থাকবে এই-ই ভেবেছিলাম। এটা হতাশ করেছে বলা বাহুল্য।
"পৃথিবীর কত আশ্চর্য উপন্যাস পাঠ করা হয়নি আমার, কতকিছু নিজেরই এখনো লেখা বাকী রয়ে গেছে। শুধু টাকার জন্য এই অফিসে বসে উপন্যাসের প্রতি সেই প্রেমটাকে আমি কেন ক্ষয় করে যাচ্ছি?"উনি যে লিখতে চান এ বুঝেছিলাম উনার গ্রাফিতি পড়ে। উনি পড়ুয়া, সাহিত্যের কদর করেন, এ উনার ফেজবুক পেজে অল্পস্বল্প বুঝা যায়। কিন্তু বাস্তব রূপ যে এক গ্লাস পানিতে এক চিমটে লবণের মতো, সেটা তার জার্নাল পড়েই বুঝলাম। লেখার জন্যে, পড়ার জন্য এ মানুষ সোনার হরিণ ছেড়েছেন। বলতে শুনি, চাকরি সোনার হরিণ। তবে সরকারি চাকুরি আরেকটু বেশি কিছু হবে না?সোনার চেয়ে দামি কী?
বইয়ের ২০২০ কবে শেষ হয়ে গেল সেটা খেয়ালই করিনি। শেষ পাতায় মনে হলো-শেষ কেন! আরো থাকার দরকার ছিল! জার্নাল ছোট গল্পের মত ধুম করে শেষ হবে কেন?তৃপ্তি- অতৃপ্তির মাঝে রেখে দেয়ার কোনো মানে হয় না।
সুহান রিজওয়ানের প্রথম উপন্যাস ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’—এই একটি মাত্র উপন্যাসের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছিল যে সুহান একজন ঔপন্যাসিক। কারণ গাদা গাদা উপন্যাস লিখলেই যেমন ঔপন্যাসিক হওয়া যায় না, ঠিক তেমনি ঔপন্যাসিক হতে হলে গাদা গাদা উপন্যাস লিখতেই হবে এমনও নয়। শওকত আলীর জন্য যেমন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’–ই তাঁকে ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে যথেষ্ট, সুহানের জন্য ঠিক তেমনি ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’।
সুহানের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পদতলে চমকায় মাটি’—এই উপন্যাসের মূল বিষয় একজন খ্যাপাটে ফুটবলার কোচ এবং আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। পাহাড়ি–বাঙালি সংঘাত, তাদের উপর অত্যাচার ও শোষণ; স্বাধীন বাংলাদেশের আশির দশকের গণহত্যা এবং হাজার হাজার গরিব বাঙালিকে সেটলার হিসেবে পাহাড়ে এনে আদিবাসীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত—সবই এই উপন্যাসে উঠে এসেছে। এই উপন্যাসে আমরা সুহানকে পাই ফুটবলপাগল হিসেবে এবং ইতিহাস হাতড়ে বেড়ানো এক তরুণ লেখক হিসেবে। ব্যক্তিগতভাবে ফুটবল পছন্দ না হলেও আদিবাসীদের ব���ষয়ে তুমুল আগ্রহ থাকার কারণে উপন্যাসটি বেশ ভালোই লেগেছিল।
এরপর ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’—একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যজগতে প্রায় নতুনই এক জনরা। যেহেতু এটি এক্সপেরিমেন্টাল কাজ, তাই গতানুগতিক লেখার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করা ঠিক হবে না। তবে আমি বলব, এই উপন্যাস সর্বজনীন পাঠকের জন্য নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু পাঠকের জন্যই লেখা।
এর পরের উপন্যাস ছিল ‘মুখোশের দিন বৃষ্টির রাত’—a great mess! খুবই বিরক্তিকর, অগোছালো ও খাপছাড়া একটি উপন্যাস।
এই উপন্যাসের আগে সুহানের আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল—‘২৩°৪৪’৫৮” ৯০°২২’৫০”’। জনরা হিসেবে উল্লেখ ছিল ব্যক্তিগত ডায়েরি বা জার্নাল জাতীয় কিছু। এই বই প্রকাশের আগে পাঠকদের মনে একটা সাধারণ প্রশ্ন ছিল: সুহানের ব্যক্তিগত ডায়েরি প্রকাশের সময় কি সত্যিই এসেছে? কারণ সাধারণত কোনো লেখকের ব্যক্তিগত ডায়েরি বা চিঠিপত্র প্রকাশ পায় তাঁর সাহিত্যজীবনের অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর। সুহান এখনো সে জায়গায় পৌঁছায়নি।
তবুও আগ্রহ হয়েছিল, এবং পড়তে নিলে প্রচণ্ড বিরক্তিও হয়। ফেসবুক পোস্ট আর ডায়েরি বা জার্নালের পার্থক্য কি লেখক ও প্রকাশক ভুলে গিয়েছিলেন? হয়তো তাই হয়েছিল ‘২৩°’-এর ক্ষেত্রে।
একটি জার্নাল বা ব্যক্তিগত ডায়েরিতে আমরা কী আশা করি—বিশেষ করে একজন লেখকের ক্ষেত্রে? সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, ���বং তার সাহিত্যজীবনের পথচলা—এগুলোই তো মূল বিষয়। কিন্তু ‘২৩°’-এ এসবের কিছু নেই; আছে কেবল কয়েক লাইনের ফেসবুক পোস্ট।
আমার আশা ছিল লেখকের প্রথম উপন্যাসের পেছনের গল্প থাকবে এই বইতে—কেন লেখক ‘তাজউদ্দিন আহমেদ’ কে বেছে নিলেন, কেন তার বিষয়ে আগ্রহী হলেন… কিন্তু না, এসবের কিছুই নেই। আছে কেবল ঢাকার ট্রাফিক জ্যামকে গালি দেওয়া। কিন্তু কেন এই জ্যাম হয়—অন্তত লেখকের কী মনে হয়, সেটুকুও নেই।
ছোটখাটো কয়েকটি অধ্যায় বাদ দিলে—আসলে চ্যাপ্টার নয়, তারিখ দিয়ে লেখা দিনলিপি বাদ দিলে—এই বইয়ে কিছুই নেই, একদম কিচ্ছু না। পাঠক হিসেবে আমি প্রকাশকের কাছে প্রশ্ন রাখতেই পারি—তাহলে কেন প্রকাশিত হলো? বিষয়টি কি শুধুই বাণিজ্যিক? উত্তর হচ্ছে—হ্যাঁ। বাণিজ্যিক এই বইমেলায় বাণিজ্যিক বই অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সুহান রিজওয়ানের কাছ থেকে এমন বাণিজ্যিক বই অপ্রত্যাশিত। জার্নাল বা ব্যক্তিগত ডায়েরি শামসুর রাহমানের কবিতা নয় যে যেমন ইচ্ছে লেখাই থাকবে লেখকের খাতায়।
দিনলিপির তুলনায় একটু বেশি ই পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত। তবে সুহান রিজওয়ানের লেখা অত্যন্ত সুখপাঠ্য। কিছু কিছু অংশ তো অতি চমৎকার, মুগ্ধকর। বার বার পড়বার মতো। সুহান রিজওয়ানের লেখক-সত্ত্বার আরো গহীন বিবরণ পাঠের অপেক্ষা ও আশায় রইলাম।
এরকম অভিজ্ঞতা সবারই কমবেশী আছে যে প্রথম দেখায় যা খুব এলেবেলে বা সাধারণ মনে হয়েছে পরবর্তীতে সেটা দেখেই আবার রীতিমত চমকে উঠতে হয়েছে। তাই দেখার ক্ষেত্রে ঠিক কোন পয়েন্ট অফ ভিউ বিবেচনা করা হচ্ছে সেটার গুরুত্ব বিনা বাক্যবায়ে মেনে নিতে হবে।
একজন লেখকের জার্নাল দেখার ক্ষেত্রে সেই সুবিধাটা তৈরি করে দিতে পারে যাতে করে লেখকের মস্তিষ্কের কারখানায় দিন-রাত তৈরি হওয়া বিচিত্র সব ভাবনাগুলোর একটা সাধারণ রুপরেখাটা অনুমান করে নেওয়া যায়।
সত্যিকারের লেখক মূলত একজন যাদুকর। যাদুকর মুগ্ধতা ছড়ান। তিনি তার মাথার হ্যাট খুলতেই সেখান থেকে গোলাপ বৃষ্টি নামে কৌতূহলী দর্শক সারিতে কিংবা জলমলে জামার আস্তিনের ভেতর থেকে পাখা ঝাপটে উড়ে আসে ধবল পায়রা। উপবিষ্ট দর্শকের দৃষ্টির উপর তিনি একের পর এক দৃশ্য নির্মাণ করে চলেন। একজন লেখকের মঞ্চ তেমন কাগজের জিওমেট্রি আর প্রকাশ অক্ষরের সমাহারে। তিনি মুগ্ধতা ছড়ান তার ভাবনার সৌন্দর্য্যে-বৈচিত্রে।
লেখকের ব্যক্তিগত ভ্রমন সম্পর্কে জানাশোনার সাথে শিল্পের মর্যাদার কোথায় যেন একটা সুক্ষ যোগসূত্র আছে। লেখকের প্রত্যক্ষ যাপন ও সাধনার ইতিবৃত্ত্ব জানা থাকলে বোধহয় তাকে গ্রহণ না করলেও অতো সহজে অস্বীকারও করা যায় না।
মন চাইলো আর মহৎ কিছু লিখে ফেললাম বা তৈরি করে ফেললাম, ব্যপারটা মোটেও এমন মামার বাড়ির আবদার নয়। মহৎ কিছু তৈরির পেছনের গল্পটা অমন মধুরেণ সমপয়েৎ না। মস্তিষ্কের সমস্ত ইন্দ্রিয় খোলা রাখার কারণে একজন লেখক সবসময়ই ভালনারেবল থাকেন কারণ ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক ছোট-বড় সবধরণের ইট-পাটকেলের আঘাতই তাকে সহ্য করতে হয়।
দিনের পর দিন নিজেকে ক্ষয় করে লেখক শেষমেশ যা মলাটবন্দি করে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেন, পাঠক কিন্তু তা পছন্দ না হলে মুহূর্তেই তা বাতিল বলে ট্রাশক্যানে ছুঁড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। এমন ভয়ানক ঝুঁকি ও অবমাননার সম্ভাবনা মাথায় রেখে একজন লেখক তবুও লিখে যান। So you must show a little respect to the writer dude
প্রকৃত লেখক স্বভাবে সদা সঞ্চারমান, তিনি নিজের ভেতর থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়েন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। অন্যের জুতোয় স্বেচ্ছায় পা গলিয়ে যেমন নিয়ত জর্জরিত হন, আবার কখনো কখনো ব্যক্তির গন্ডি পার হয়ে হয়ে পড়েন সামষ্টিক কণ্ঠস্বর। এই ভ্রমণটা একই সাথে সুন্দর ও ভয়ংকর রকমের পীড়াদায়ক
Great artist think alike উপন্যাসিক সুহান রিজওয়ানের জার্নালে খুঁজে পাওয়া যায় একজন প্রকৃত লেখক ও জাতিস্মরের কণ্ঠস্বর। তার জহুরি চোখ এড়ায় না ছোটবড় কোনকিছুই। তার উল্লেখিত সময়ের গন্ডিতে ধরা পড়ে ব্যক্তি, শহর, ভুখন্ড তথা সময় নির্মাণ-বিনির্মাণের সমূহ ডিটেইল। একজন দক্ষ যাদুকরের মতো সুহান রিজওয়ান মুগ্ধতা ছড়ান পাঠকের ভেতর। তার একান্ত ব্যক্তিগত ভ্রমণ, ভাবনা ও দর্শণের নির্যাস অসামান্য শক্তিতে হয়ে ওঠে সার্বজনীন।
এই প্রথম কারো ব্যাক্তিগত জার্নাল পড়লাম।বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি, লেখাটাকে মূল পেশা হিসেবে নেয়ার জন্য আবার সেই চাকরি ছেড়ে দেয়া বলা যায় এই সময়ে বিরল। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনার ব্যক্তিগত মতামত পাওয়া যায় তার এই জার্নালে।ব্লগার হত্যা, কোটা আন্দোলন, ফুটবল বিশ্বকাপ এবং মহামারী করোনা। যেহেতু দিনিলিপি তাই একেকদিন একেক ঘটনায় আলোকপাত করেছেন এবং সম্ভবত যেসব প্রকাশ করলে সেন্সর এবং পার্সোনাল তথ্য লহোয়া যেতো না কেবল সেসব ই প্রকাশ করেছেন সেহেতু একটু বিক্ষিপ্ত লেগেছে। ��বার কিছু লেখা তিনি ফেসবুক, ব্লগ কিংবা গুডরিডসে বই রিভিউতে আগেই প্রকাশ করেছেন, সেসব ই তুলে দিয়েছেন বইয়ে।তবে এতকিছুর পরেও ঘুরে ফিরে কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে বেশ ভালো ভাবেই যেমন, লেখকের লেখক হয়ে উঠতে চাওয়ার প্রবল আকাঙ্খা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাব এবং অন্তত একটা ভালো উপন্যাস লেখা। আশা করি লেখক একদিন 'লেখক' হয়ে উঠবে এবং অন্তত একটি ভালো উপন্যাস উপহার দিবেন। হ্যাপি রিডিং💙
কোনো বই পড়তে গিয়ে যখন আরো অনেক গুলো বই এর উল্লেখ পেয়ে যাই তখন সেই বই টি কেন জানি আমার পছন্দের বই হয়ে যায়।সেখানে এটি তো প্রিয় লেখকের দিনলিপি তাই পছন্দ না হয়ে উপায় কই? তবে হ্যাঁ পক্ষপাত করে বলছি না অনেক দিন পর সত্যিই সুন্দর কিছু পড়লাম,পড়ে তৃপ্তি পেলাম।লেখকের দিনলিপি না বলে বই টি কে বলা যায় লেখকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন সব ভাবনার সমষ্টি।পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হয় অনেকগুলো ছোট গল্পের সংকলন যা পাঠক কে কোনো ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে টুপ করে শেষ হয়ে গেলো। ঢাকা শহর যে লেখকের কত ভালোবাসার তা বইটির পাতায় পাতায় ফুটে উঠে,সেই সাথে চলে আসে সাহিত্য প্রেম।রাজনীতি,খেলা,দেশ বিদেশ ভ্রমণ, বই,উপন্যাস, মুভি,থিয়েটার,গান সব কিছুর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যায় লেখকের নিত্য নৈমিত্তিক দিন কে। পাওয়া যায় লেখকের উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা কে।পড়তে পড়তে কিছু কিছু জায়গায় একঘেয়েমি চলে আসে তবে পরক্ষণেই লেখক তার অদ্ভুত সুন্দর লেখনী দিয়ে সেই একঘেয়েমি টাকে দূর করে দেন।২০১৫ সাল হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত উল্লেখ আছে বই টি তে, তাই পরবর্তী বছর গুলোর জন্য আর একটি দিনলিপির আশা পাঠক হিসেবে করতেই পারি?
ডায়রিতে লেখকের ব্যক্তিগত বিষয় আশয় তেমনভাবে আসেনি। মনে হয়েছে পাঠকের জন্যই লেখা। এর একটি কারণ হয়ত মাঝে মাঝে ডায়রির অনেকগুলো দিনেই লেখা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করার জন্য। এতে আমরা দেখি লেখক ঢাকাকে ঢাকার মানুষকে দেখছেন। নিজের একটা স্টাইল তৈরির চেষ্টা করতে করতে তাদের কথা বলছেন। সেই স্টাইল তৈরির কসরতে আমরা দেখতে পাই চেনা অচেনা অনেক বিষয়ের রেফারেন্স। এই কসরত মাঝে মাঝে ক্লান্তিকর লেগেছে। কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ দারুণ কিছু কথা, দারুণ কিছু বাক্য এসে চাঙ্গা করে দিয়ে গেছে।
পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে ইউরোপভ্রমণ কিংবা দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার গল্প আরো বিস্তারিত পড়তে পারলে মন্দ হ'ত না। লেখালেখির জন্য যখন লেখক চাকরি ছেড়ে দিলেন, তখন মনে হলো ডায়রিটা হঠাৎ একটা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসিকা হয়ে উঠেছে যেন। তাঁর প্রিয় ঔপন্যাসিক পামুক কিংবা কাদারের চেয়েও সার্থক সাহসী সব উপন্যাস তিনি লিখে ফেলুন এই শুভকামনা রইল।
জীবন চলে যায় একটা একটা করে দিনের সীমানা পাড়ি দিয়ে, যার মাঝে কতরকম বিচিত্র অনুভূতি নিজের অজান্তে কোথা থেকে যেন এসে কীসব বোধ নাড়া দিয়ে যায়। প্রায়ই আকাঙ্খা জাগে ধরে রাখি কোথাও অনুভূতিগুলো, কিন্তু তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করার ভাষাগত দক্ষতা সবার থাকে না। যাদের থাকে, তাদের আমি ঈর্ষা করি ভীষণ।
যদিও তাঁর লেখালেখি অনেকদিন ধরেই অনুসরণ করা হয় জানা ছিলো না একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের এলুমনাই ছিলেন তিনি। যানজট ও দূষণের কলুষিত এই শহর ঘিরেই আমার জীবন। লেখকের সুন্দর লেখনীতে নিত্যদিনকার চিরপরিচিত এলাকাগুলোকে তাদের স্বরূপে হাজির হতে দেখে ভালোই লাগলো। একটা সুন্দর সময় কাটলো বইটাকে ঘিরে, যার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। যদিও নিজ সীমাবদ্ধতার দরুণ সব লেখা পুরোপুরি ধরতে পেরেছি এমনটাও নয়।
বইটা পড়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল, তার প্রকাশিত সব বই শেষ। মাস খানেক ধরে তার সবগুলো বই আস্তে আস্তে শেষ করলাম। গত বাধা কিছু না, আসলেই এগুলো মন দিয়ে পড়ার মত লেখা। প্রতিটি লাইনে, প্রতিটি শব্দে আছে চেষ্টা সাহিত্য সৃষ্টির। যতবার পড়ি, আমি বলি যে আমরা ভাগ্যবান যে আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন সুহান রিজওয়ান লিখছেন। ভালো লাগল জেনে যে উনি চাকরি ছেরে দিয়ে সম্পুর্ন ভাবে সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দিয়েছেন। শুভ কামনা এবং অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী বইয়ের।
না-জানি কতদিন পর এমন মনের-মতো-নিরেট-একটা-রচনার সাক্ষী হলাম! আমার মনে হয়, যদি জয়েসের ইউলিসিস থেকে ডাবলিনকে পুনরায় নির্মাণ করা যায় তবে এ-গ্রন্থ থেকে গড়া যাবে ঢাকা শহরকে। শহরের পেটের ভেতরকার রাজনীতি কোলাহল যানজট আর আবছা হয়ে আসা দেয়াললিখন সমেত হাজির হচ্ছেন সুহান রিজওয়ান। বছরের পর বছর ধরে পড়তে গিয়ে শহরে যাপিত নিজের জীবনটাই যেন ঝলসে উঠলো চোখের সামনে। আমাদের সময়টা নিরেট গদ্যে ধরা রইলো- এই যা!
একটা লেখা কোন জনরাকে ছুঁতে পারলো তারও চাইতে আমার বেশি আগ্রহ জাগায় সে বইটার বক্তব্য। আর সেই সাথে লেখকের লেখার ধরণ। ভাষা নিয়ে সুহান রিজওয়ানের এই খেলাটা আমি খুব উপভোগ করি। সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ এর পর তাঁর লেখা আরেকটি বই যুক্ত হলো পছন্দের তালিকায়।
লেখককে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি বলে এ লেখাগুলোর অনেকগুলো অভিজ্ঞতা, চরিত্র আমার পরিচিত। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় আমি নিজেও আছি জার্নালের এন্ট্রি হিসেবে। তবে আমার মনে হয় এ জিনিসটা ঠিক জার্নাল হয়ে ওঠে নি। তার মূল কারণ হল, জার্নাল ঘরানার লেখায় পাঠকের চাহিদা থাকে লেখক পাঠকের সাথে আন্তরিক হবেন, নিজের ভেতরকার চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা আরো উন্মোচন করবেন। তার সংশয়, বয়, রাগ, অভিমানের ব্যাপারেও আরো খোলামেলা হবেন। পাঠকেরা যদি ঐ আশা করে পড়তে আসেন, তাহলে একটু হতাশই হবেন। তবে সুহানের ক্যাজুয়াল লেখা আমার ভাল লাগে কারণ সেটা গদ্য হলেও পদ্যের মত ছন্দময়। ব্যক্তিগতভাবে এজন্যই আমি সুহানের লেখার ভক্ত। সে জায়গাটায় সুহান হতাশ করে নি।
বইয়ের নামকরণটা ইউনিক তো বটেই, কিছুটা অদ্ভুতও, যা সহজেই দৃষ্টিকে টেনে নেয় বইয়ের দিকে। প্রথম দেখায় কয়েকটি এলোমেলো সংখ্যা মনে হলেও একটু মনযোগী হতেই এগুলো যে অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ, তা ঠাহর করা যায়। আরেকটু আগ্রহী যদি হয় কেউ, গুগল ম্যাপে অনুসন্ধান চালায় এই অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ দিয়ে, তাহলে উঠে আসে ধানমণ্ডির একটি নির্দিষ্ট এলাকা… অর্থাৎ বইয়ের নামটা দাঁড়ায় তাহলে, "ধানমন্ডি থেকে"। চমৎকার, তাই না?
বইটা কী? এ প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর হতে পারে, সুহান রিজওয়ানের জার্নাল, দিনলিপি। যদিও এটা পড়তে গিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেয়া গেছে খুব কমই। অর্থাৎ কেউ যদি ভাবেন, এই জার্নাল থেকে লেখক সুহানকে চিনবেন, তাহলে কিছুটা হতাশই হতে হবে। তবে একটু মনযোগী পাঠক হলে লেখককে জানার সুযোগ রয়েছে, লেখালেখি, জীবন, সাম্প্রতিক ঢাকা শহর, কিংবা সমসাময়িক বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে লেখকের চিন্তা, ভাবনা- যদিও খুব সংক্ষেপে, প্রায় না বলার মত করেই- জানার সুযোগ রয়েছে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে এই জার্নাল লিখতে লিখতেই এক সময় লেখক তাঁর তৃতীয় উপন্যাস লেখার আইডিয়া পেয়েছেন। করোনা কালীন দমবন্ধ সে সময়টা লেখকের জার্নালে একেবারেই আসে নি, এর কারনটাও অনুমেয়। করোনা, সমসাময়িক ঢাকা, নিজের জীবন, সব কিছু নিয়েই তাঁর "গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে"। এমনকি, গ্রাফিতিতে যদি এই জার্নালের এন্ট্রি গুলো ফাঁকে ফাঁকে বসিয়ে দেয়া যেতো, আলাদা করার সুযোগ থাকতো না। জার্নালের সুহান, বা গ্রাফিতির সুহান, দুজনের থেকে দুজনকে আলাদা করা যায় না তাই।
এই জার্নাল কেউ কেন পড়বে? না পড়লেও আসলে ক্ষতি নেই তেমন। কিন্তু লেখক সুহান রিজওয়ানের পাঠক যদি হয়ে থাকে কেউ, সুনির্দিষ্ট করে বললে ভক্ত পাঠক, তাহলে তার কাছে এ জার্নালটা উপভোগ্য হতে পারে খুব। অবশ্য সেজন্য তার পড়াশোনার ক্ষেত্রটাও লেখকের পড়াশোনার জগতের সমান বা কাছাকাছি হওয়া আবশ্যক। নয়তো, প্রতি লাইনে লাইনে, শব্দের ব্যাবহারে, এমনকি উপমা রূপক বা দৃশ্যকল্প তৈরিতেও লেখক কীভাবে বারবার জহির, ইলিয়াস, শওকত আলি, সৈয়দ হক, জীবনানন্দ, ওরহান পামুক, কাফকা কি দস্তয়েভস্কি', এমনকি বব ডিলান বা কোহেনের গানের লাইনের কাছে পর্যন্ত ফিরে ফিরে গেছেন, তা বুঝতে কষ্ট তো হবেই, এমনকি কিছু কিছু বাক্য অর্থহীনও লাগতে পারে। আমার কাছে অবশ্য সবচেয়ে ভালো লেগেছে লেখকের পূর্ব ইউরোপ ভ্রমণের অংশটুকু, একেবারে ভ্রমণের বীজটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। পূর্ব ইউরোপ ঘুরতে যাওয়ার বাসনাটা তীব্র হয়ে জেঁকে বসেছে।
যদিও আমার মতে লেখক ইতোমধ্যে সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রান বা গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে বেশ পোক্ত আসন নিয়ে নিয়েছেন, তবুও, জার্নালের সুহান, বা গ্রাফিতির সুহানের আকাঙ্খার মতই আমাদেরও চাওয়া, সুহান একদিন "ভালো" একটা উপন্যাস লিখে উঠুন।
There'll be parties for hosting, Marshmallows for toasting And caroling out in the snow There'll be scary ghost stories And tales of the glories of Christmases long, long ago! ...It’s the most wonderful time of the year! ওয়ান্ডারফুল টাইম! সত্যি যতক্ষণ বইয়ের মধ্যে ছিলাম এভাবেই কাটলো সময়। দীর্ঘদিন লিখতে পারছিলাম না৷ লেখার জন্য যে মোটিভেশন দরকার সেটা হারিয়ে গিয়েছিলো। ডায়েরিটা পড়ে নোটস ওপেন করলাম; যা মাথায় আসলো লিখলাম; হয়তো আরো লিখবো। আমার কাছে এই ডায়েরির সার্থকতা এখানেই। কেন ডায়েরি বলছি? হ্যাঁ, সুহান রিজওয়ান ভাইয়ের ২০১৫-২০২০ সালের ডায়েরি লেখা নিয়েই এই বই। কিন্তু বিষয়বস্তু? অনেক নামি-দামি বেস্টাসেলারের চেয়েও সহস্রগুণ সুন্দর কন্টেন্ট। পড়তে পড়তে যেন বিগত সময়টা রিভাইজ দিলাম। চোখের পলকে কেটে যাওয়া জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা৷ ২০১৫ সালে আমি পড়তাম ক্লাস-৮ এ। এখন অনার্স থার্ড ইয়ার। কত দ্রুত চলে যায় সময়। এর মধ্যে কত শত মেমোরি লস। ডায়েরি পড়ে একটা বড় আফসোস হলো, যদি সময়টা কোথাও লিপিবদ্ধ থাকতো! রাষ্ট্রীয় জীবন না হোক! অন্তত ব্যক্তিগত জীবন! পরক্ষণে এটাও মনে হয়, কোন সময়কে লিপিবদ্ধ করতাম! সুন্দর স্মৃতি বলতে তো কেবল স্মৃতিহীনতা। যাকগে... এই বইটিকে কোনো গুণে বিচার করলে হয়তো ভুল হবে। ভুলে হবে বলছি কারণ একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখক, তার পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে। এরচেয়ে দুঃসাহসিক কাজ কি হতে পারে একজন লেখকের পক্ষে? ডায়েরি হচ্ছে সেই স্থানে যেখানে নিজেকে সবদিক দিয়ে মেলে ধরা যায়। আমি যা, আমার বিশ্বাস, আমার চেতনা, আমার আদর্শ এসব নিয়েই তো আমার ডায়েরি। ঢাকায় গিয়ে এই বইয়ে ব্যবহৃত সবগুলো জায়গা, ব্যক্তি আর গানগুলো এক্সপ্লোর করবো। একটা আক্ষেপ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই ডায়েরি শেষ হওয়ার মতোই। অথচ কত জানা বাকি! কত দেখা বাকি! কত পড়া বাকি! এক জীবনের কতটা নষ্ট করলার তার হিসেব মেলানো বাকি! এই সব বাকির মধ্যেও আশা রাখি এই বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব হয়তো লেখক কখনো আবার প্রকাশ করবেন। শেষে এটাই বলতে চাই, সুহান ভাইয়ের পর্যবেক্ষণ শক্তি ভীষণ চমৎকার। এতো সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়, ঘটনা মেটাফরিক ওয়েতে তুলে এনেছেন তার মূল্যবান ডায়েরিতে! একেকটি বিষয়বস্তুকে তিনি রূপক, কম্পারিজন আর মুগ্ধতা দিয়ে সাজিয়েছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ সাধারণ ও সুন্দর। নামকরণের বিষয়টি মুখবন্ধতে রয়েছে। তাই সেটি সংযুক্ত করছিনা। -২৯/০৬/২০২৩