"সূর্যতামসীতে যে রহস্যের সমাপ্তি ঘটিয়াছিল বলিয়া আপাতদৃষ্টিতে মনে হইয়াছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে উহা ঘটনার সূচনামাত্র। যে ভয়ানক ষড়যন্ত্রের জটাজাল ক্রমে এই দেশের পটভূমিতে ঘনাইয়া আসিতেছিল, কেহ তাহার বিন্দুমাত্র সন্ধান রাখে কি? প্রিয়নাথ দারোগা, তারিণীচরণ, গণপতি, সাইগারসন সকলই এক অদ্ভুত ক্রীড়ার ক্রীড়নক। অবাক বিষ্ময়ে তাঁহারা সকলে চাহিয়া দেখিবেন- অবশেষে ভূত জাগিয়াছে"...
একশো বছর পরে আবার সেই ভূতের ঘুম ভেঙেছে। একের পর এক মৃত্যু। হত্যা। দুর্ঘটনা। এঁরা কি পরস্পরের থেকে আলাদা? নাকি সবই এই ভূতের কারসাজি? না চাইতেই এই রহস্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পরে তুর্বসু রায়। তাঁর হাতে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু তথ্য আর তারিণীর রেখে যাওয়া অদ্ভুত এক সূত্র, যার সঙ্কেত উদ্ধার না করতে পারলে এ বিপদ থেকে মুক্তি নেই।
খেলা শুরু হয়ে গেছে। তবে এবার রহস্য আরও গভীর। আরও বিস্তৃত। আরও জঘন্য। জানা যাবে আগে ঘটে যাওয়া অনেক ছেড়ে আসা জিজ্ঞাসার উত্তর, দেবাশীষ গুহের মৃত্যুর পিছনের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র, জড়িয়ে পড়বেন একের পর এক মানুষরা। তারিণী, গণপতি, প্রিয়নাথ, তুর্বসু তো আছেনই, তাঁরই সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে পড়বেন সেকালের বঙ্কিমচন্দ্র, অমৃতলালের মত মানুষ থেকে আজকের চন্দননগরের দুই "সত্যিকারের" গবেষক। তাঁরাও সাহায্য করবেন এই ভয়ানক লোমহর্ষক রহস্য সন্ধানে।
পত্রিকার কাটিং, বিজ্ঞাপন, টিকিটের টুকরো, ফটোগ্রাফ সব মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে থাকবে ক্লু। আর থাকবে একটা বুক উইদিন বুক। তাতে কী থাকবে? থাকবে বটতলার হারিয়ে যাওয়া এক রহস্যময় নাটক।
জন্ম ১০ এপ্রিল, ১৯৮১, কলকাতা। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পি. এইচ. ডি. তে সেরা ছাত্রের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া Bacillus sp. KM5 এর আবিষ্কারক। বর্তমানে ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত এবং হাবড়া মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক। জার্মানী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর কমিকস ইতিবৃত্ত (২০১৫), হোমসনামা' (২০১৮),মগজাস্ত্র (২০১৮), জেমস বন্ড জমজমাট (২০১৯), তোপসের নোটবুক (২০১৯), কুড়িয়ে বাড়িয়ে (২০১৯),নোলা (২০২০), সূর্যতামসী (২০২০), আঁধার আখ্যান (২০২০) ও নীবারসপ্তক (২০২১) এই সব দিনরাত্রি (২০২২), ধন্য কলকেতা সহর (২০২২), আবার আঁধার (২০২২), অগ্নিনিরয় (২০২২), হারানো দিনের গল্প (২০২৪), সিংহদমন (২০২৪), ডিটেকটিভ তারিণীচরণ (২০২৪), আরও একটি প্রবন্ধ সংকলন (২০২৫) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সরাসরি জার্মান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ঝাঁকড়া চুলো পিটার (২০২১)। বাংলাদেশের আফসার ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ম্যাসন সিরিজের বাংলাদেশ সংস্করণ (২০২২, ২৩), মৃত্যুস্বপ্ন (২০২৪), ডিটেকটিভ তারিণীচরণ (২০২৪) । সম্পাদিত গ্রন্থ সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ (২০১৭, ২০১৮) ফুড কাহিনি (২০১৯), কলকাতার রাত্রি রহস্য (২০২০) সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষে একাই একশো (২০২২), কলিকাতার ইতিবৃত্ত(২০২৩), বিদেশিদের চোখে বাংলা (২০২৪) এবং কলিকাতার নুকোচুরি (২০২৫)
একটা পারফেক্ট ওয়ানডে ইনিংস কেমন হয়? শুরুতে ব্যাটসম্যান একটু দেখেশুনে বল খেলে, দু'চারটা মিসটাইমিং হয়, দু'একটা বাউন্ডারিও হয়। ২০-২২ রান করতে করতে ব্যাটসম্যান মোটামুটি সেটলড হয়ে যায়, এরপর বলে বলে সিঙ্গেলস, ডাবলস, আর বাজে বল পেলেই সীমানার বাইরে। আর শেষ ১০ ওভারে (এককালে একে স্লগ ওভার বলা হতো, এখন তো সারাক্ষণই পেটাপিটি চলে!) যদি ব্যাটসম্যান টিকে থাকে, তখন ভাল বলেও মারা শুরু হয়। ইনিংসের মাঝখানটা শেষদিকের শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে সেক্ষেত্রে। ফলাফল, একটা অনিন্দ্যসুন্দর সেঞ্চুরি, বা আরো বেশি রান। এ ব্যাপারে লারা-শচীন-সাঈদ আনোয়ারের ইনিংসগুলোকেই আমি আদর্শ মানবো, যেরকম ইনিংস গত বছর দশেকে বানানো পাটা পিচগুলোতে আর দেখিনি।
কৌশিক মজুমদারের 'সূর্যতামসী' সিরিজের প্রথম দু'টো বই পড়ে আমার সেরকম আদর্শ ওয়ানডে ইনিংসের কথাই মনে পড়ছে। প্রথম বইটাতে ইতিহাসের লেকচার একটু বেশি ছিল, কাহিনী কয়েক জায়গায় খাপছাড়া হয়ে গেছে, চরিত্রগুলো ১০০ ভাগ ফুটে ওঠেনি, অনেকটা প্রথমদিকের মিসটাইমিংয়ের মতই। আর ২য় বই 'নীবারসপ্তক' হয়েছে একেবারে বলে বলে সিঙ্গেলস-ডাবলস আর কয়েকটা বাউন্ডারি মেরে শক্ত ভিত্তির উপর ইনিংস দাঁড় করানোর মত। প্রথম পর্বের কয়েকটা খাপছাড়া বিষয়ের চমৎকার ব্যাখ্যা এসেছে, পরের অংশের ভিতটাও খুব মজবুত করে গড়া হয়েছে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে গল্প কখনোই একঘেয়ে হয়ে যায়নি বা গতি হারায়নি। টানটান ভাবটা ছিল পুরো বইটা জুড়েই। শেষটাও মিলেছে দারুণ, আর সেটা পড়ে পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা আর ফুরোতেই চাইবে না। দুঃখের বিষয় যে, দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে পরের পর্বটা বের হওয়ার পরেও সম্ভবত হাতে পাবো না, অপেক্ষা করতে হবে বছর দু'য়েক।
যদি শেষ পর্বটা কোন কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের স্লগ ওভারের মত লেখক গুলিয়ে না ফেলেন, তাহলে দারোগা প্রিয়নাথ-গোয়েন্দা তারিণীচরণ আর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সাইগারসন (এঁর পরিচয়টা দিলে স্পয়লার হয়ে যাবে)-কে নিয়ে লেখা এই ট্রিলজিটা বাংলা রহস্য কাহিনীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা সংযোজন হতে যাচ্ছে, সেটা লিখে দিলাম। লেখককে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি, দয়া করে এই অধম পাঠককে হতাশ করবেন না।
"সূর্যতামসী" তে কৌশিক মজুমদারের দায় ছিলো কাহিনির জন্য গড়ে তোলা জগৎকে বিশ্বাসযোগ্য করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার। এ কাজে তাকে প্রচুর বাক্য ব্যয় করতে হয়েছে বিধায় গল্পের গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে গিয়েছিলো। "নীবারসপ্তক" এ সেই পাট চুকেছে। একদিকে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে রহস্যের জটও খুলছে ধীরে ধীরে। একক কোনো চরিত্রের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে লেখক কাহিনির প্রতি জোর দিয়েছেন বেশি। কিছু সত্যিকার ঘটনার সাথে লেখক দক্ষতার সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। শেষ ফলাফল? দারুণ উপভোগ্য একটি থ্রিলার। পরবর্তী খণ্ড পড়ার জন্য তর সইছে না।
সূর্যতামসীর পরবর্তী খন্ড হচ্ছে নীবারসপ্তক। সূর্যতামসী পড়ার পরে ভেবেছিলাম যেই কৌতূহল জেগেছে সেটা মেটাবে এই খন্ডে। কিন্তু লেখক সেটা না করে কৌতূহল আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমার মনেহল নীবারসপ্তক-এই বইটা শেষ করে দিতে পারতেন। উল্টো ক্লিফহ্যাঙ্গার এ শেষ করাটা বেশ বিরক্তিকর। কারণ আমি খুব একটা ধৈর্যশীল নই। ভালো দিক হচ্ছে এখানে ইনফো ডাম্পিং টা কম হয়েছে সূর্যতামসী-র চেয়ে।
তারপরেও ভালো লাগার দিকে আমি সূর্যতামসী কেই এগিয়ে রাখবো। কারণ ওইটা যেরকম পেজটার্নার ছিল, নীবারসপ্তকে সেটা ছিলনা বা আমার সেটা মনে হয়নি।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: যাঁরা 'সূর্যতামসী' পড়েননি, তাঁরা খবরদার এই বই পড়বেন না! এবার আসি বইটির কথায়। কাহিনি~ 'সূর্যতামসী'-র শেষে মনে হয়েছিল, অতীতের অধ্যায়টি সমাপ্ত হয়ে এবার যা হওয়ার বর্তমানেই হবে। কিন্তু এই পর্বের শুরু থেকেই আমরা বুঝতে পারি, যা হয়েছিল তা প্রথম কয়েকটি অংক মাত্র। যবনিকাপাত এখনও অনেক দূরে। তাই আমরা ফিরে যাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের কলকাতায়— যেখানে কয়েকটি অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড এবং অন্য অপরাধ জুড়ে গিয়ে দেখা দেয় এক ভয়ংকর রহস্য। প্রিয়নাথ, তারিণী, গণপতি এবং আমাদের প্রিয় গোয়েন্দাটি সেই রহস্যের জটিল জালকে ছিন্ন করার বদলে আটকে পড়েন নানাভাবে। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে ওঠে এক হতভাগ্য নাট্যকারের লেখা একটি নাটক। তারপর? "পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!" বইটা পড়তে তো হবেই, সঙ্গে এর তৃতীয় পর্বের জন্যও বছরখানেক (অন্তত) কুম্ভক করে থাকতে হবে।
কী-কী ভালো লাগল? ১) অপরাধ যে স্থান ও কালের দুস্তর পারাবার পেরিয়ে যায়, ষড়রিপুর টানাপোড়েনে কীভাবে অতীত ও বর্তমান একইসূত্রে বদ্ধ হয়— তার এক দুর্ধর্ষ উদাহরণ এই লেখা। জীবনানন্দের লেখার অনুরাগী হলে আপনি জানেন, এই কালচেতনা 'রূপসী বাংলা'-র পাশাপাশি '১৯৪৬-৪৭'-এরও জন্ম দেয়। এই বইয়ে আমরা কল্লোলিনী কলকাতার সেই রক্তিম ও পঙ্কিল রূপটি দেখি— সেপিয়া-রঙা অতীত হয়ে মোবাইল-শাসিত বর্তমানে। ২) ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলা সহজ কাজ নয়। লেখক নিবিড় গবেষণা এবং সহজ ও স্বচ্ছন্দ লেখনীর মাধ্যমে খুব ভালোভাবে সেটি করতে পেরেছেন। অথচ এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি কাহিনির গতির সঙ্গে আপোষ করেননি। সুযোগ পাওয়ামাত্র "দেখুন, আমি কত জানি" ভঙ্গিতে বসিয়ে জ্ঞান দেওয়ার যে প্রবণতা প্রথম বইটি পড়ার অভিজ্ঞতাকে ক্লেশকর করে তুলেছিল, তা এখানে অনুপস্থিত। এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং প্রশংসনীয়। ৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা কলকাতার পটভূমিতে একাধিক উপন্যাস লেখা হলেও শ্বেতাঙ্গ বারবনিতাদের জীবন নিয়ে আলোচনা বিশেষ দেখিনি। এই উপন্যাস সেই রুক্ষ, যন্ত্রণার্ত বাস্তবকে খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছে— অথচ এই নিয়ে জ্ঞান দেয়নি। ৪) বাংলায় ফ্রি-ম্যাসনদের নিয়ে লেখালেখি বিশেষ দেখিনি। এই বইয়ে কাহিনির সূত্রেই সেই প্রসঙ্গগুলো এসেছে। তার সঙ্গে এসেছে স্টিফেন নাইটের গবেষণার কথা। নাইটের নাম বাংলায় একেবারেই অনালোচিত; অথচ তাঁর কাজগুলো যে কতটা কৌতূহলোদ্দীপক ছিল তা না পড়লে বোঝানো অসম্ভব। এই লেখার সূত্রে পাঠক নাইট-কে নিয়ে আগ্রহী হবেন— এমন আশা করাই যায়। ৫) বঙ্কিম থেকে অমিতাভ ঘোষ— সাহিত্যজগতের নানা আইকনের প্রতি নানাভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পিত হয়েছে এই লেখায়। থ্রিলারের কাঠামোয় এই কাজ যে কী ভীষণ কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। অথচ এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি পাতাই এমনভাবে সাজানো যে পড়তে-পড়তে ক্রমাগত ইচ্ছে হয় উল্লিখিত বা আভাস-দেওয়া জিনিসটাকে চট করে একবার পড়ে নেওয়ার। ৬) বইয়ের ছাপা, বাঁধাই এবং সামগ্রিক অঙ্গসজ্জা স্রেফ লা-জবাব। তার সঙ্গে রাহুল ঘোষের অলংকরণ সূর্যতামসী-র সেই শিশুসুলভ ছবিগুলোকে সর্বতোভাবে ছাপিয়ে গেছে।
কী-কী খারাপ লাগল? ১. অতীত ও বর্তমান— দুই স্তরেই প্রটাগনিস্টদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের প্রভেদ খুব বেশি থাকার ফলেই হয়তো তাদের মধ্যে কথোপকথনের জায়গাগুলো খুব আড়ষ্ট হয়ে এসেছে। অথচ কাহিনির স্বার্থে অধিকাংশ চমক (ইংরেজিতে যারে কয় রিভিলেশন) এই সংলাপের সূত্রে��� পরিবেশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একটু চাপের। তৃতীয় পর্বে সংলাপের বদলে ঘটমান বর্তমানের ন্যারেটিভ কাঠামোয় এই তথ্যগুলো সামনে এলে ভালো লাগবে। ২. বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের একটি মানুষ চরিত্র হিসেবে উপস্থিত থাকলেও এই কাহিনিতে সম্প্রদায়টি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু লেখক হয়তো পুরোনো অভ্যাস পুরোপুরি ছাড়তে না পেরে এখানেও ওই সম্প্রদায় সম্বন্ধে বিস্তর তথ্য দিয়েছেন। যাঁরা 'হলদে গোলাপ' পড়েননি, তাঁদের কাছে এগুলো নতুন তথ্য হিসেবেই স্বীকৃত হলেও কাহিনির প্রেক্ষাপটে এটি ইনফো-ডাম্পিঙের নিদর্শন ছাড়া কিছু নয়।
সামগ্রিকভাবে এটুকুই বলব যে 'নীবারসপ্তক' এই সময়ের অন্যতম সেরা ক্রাইম থ্রিলার হওয়ার পাশাপাশি সমকালীন ইতিহাসচর্চারও উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যদি অপরাধ ও ইতিহাসে আপনার আগ্রহ থাকে তাহলে এটি অবশ্যপাঠ্য। তবে ওই যে শুরুতেই বলেছি, আগে 'সূর্যতামসী' পড়ে নেবেন৷ নইলে সকলি গরলি ভেল হয়ে যাবে।
সূর্যতামসীর পরের পার্ট নীবারসপ্তক। এটাতে শুরু যেমন নেই তেমনি শেষও নেই। আছে শুধু পরের পর্ট জলদি পড়ে ফেলার জন্য প্রচন্ড রকমের তাগিদ। শুরু বা শেষ নেই বলে বইটিকে "অযৌক্তিক" ভাবার কোনো কারণ নেই। পরের বইয়ের জন্য অপেক্ষা ছাড়াও বইটিতে আছে সূর্যতামসীতে রেখে যাওয়া প্রশ্নের উত্তর, আছে নতুন কিছু সংযুক্তি আর আছে মেলবন্ধন। প্রত্যেক পরিচ্ছদে একের পর এক প্রশ্ন আর একের পর এক মেলবন্ধনের চাপে মাথার নিউরন চাপ সইতে ব্যার্থ হয়েছিলো প্রায় প্রতি ঘন্টাতে। কোনো প্রশ্নের উত্তর আগের পরিচ্ছদে আবার কোনোটা পরের বা দুই তিন পরিচ্ছদ পরে হওয়াতে একটু বেশিই চাপ সইতে হলো। যখন উত্তর এলো তখন মনে হলো আহ্ এই ছিলো ব্যাপার।
যেহেতু সিরিজের পরের পার্ট সেহেতু বলার অপেক্ষা রাখেনা আগের কাহিনী নিয়েই বা আগের রেখে যাওয়া অমীমাংশিত ঘটনা নিয়েই গল্প এগোবে। এগিয়েছেও তাই। সেই পুরোনো ১০০ বছর আগের ভুত আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। সেই প্যাটার্নে আবার খুন। খুন নাকি আত্মহত্যা! ১০০ বছর আগে শুরু হওয়া লড়াই আজকের দিনে আরও বীভৎস হয়েছে। হয়েছে আরও শক্তিশালী। অবহেলার ফলে সৃষ্টি হওয়া শক্তি রূপ নিয়েছে এক বিভীষিকার। যে বিভীষিকার আভাস ছিলো সূর্যতামসীতে সে বিভীষিকা এখানে পরিস্ফুটিত। অতঃপর তারা হাসিল করেছে তাদের মনষ্কামনা। অতঃপর জাগাতে পেরেছে সেই ভয়ানক শক্তিকে।
গল্পের চরিত্রগঠন থেকে শুরু করে তাদের পূর্বের জীবনের কথা আর বর্তমান জীবনের কথা এবং তার সাথে পারিপার্শ্বিক বিষয়ের যে সংযোগ লেখক করেছেন তা এক কথায় অসাধারণ। যে লখন, দেবাশিস, বিশ্বজিৎদের নিয়ে পূর্বের বইয়ে কথা ছিলো তাদেরও চুলছেড়া বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। মিলিয়েছেন ঘটনাপ্রবাহের সাথে। ফলে উঠে এসেছে শৈলচরণ বা রামানুজদের মতো নতুন নতুন চরিত্র। নতুন চরিত্রদের সাথে যোগ করেছেন পুরাতন কাহিনীগুলোকে। ফলে গল্প গুলো আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ফুটিয়ে তুলেছেন রামানুজদের মতো মানুষদের জীবনচক্র।
হিস্ট্রির সাথে ফিকশন যোগ করা যেন কেউ কৌশিক মজুমদারের কাছ থেকে শেখে! বরাবরের মতো এখানেও হিস্ট্রি আর ফিকশনের মেলবন্ধন করেছেন। করেছেন ফিকশন-ফিকশন মেলবন্ধও। প্রফেসর মরিয়ার্টি থেকে জ্যাক দ্য রিপার অবদি। আরও করেছেন সেই ১০০ বছর আগের ঘটনার সাথে ১০০ বছর পরের ঘটনার। সাইন্স ফিকশন না হয়েও টাইম ট্রাভেলের একটা স্বাদ যেন দিয়ে যাচ্ছেন এই সিরিজে। এই সিরিজ পড়ার সময় Woody Allen এর "Midnight in Paris" এর কথা মনে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
ভালো লাগার মধ্যে না গিয়ে একটু খারাপ লাগা দিক নিয়ে কথা বলি। সূর্যতামসী আমার কাছে বেশি হৃদয়ঙ্গম মনে হয়েছে। নীবারসপ্তক একটু প্যাঁচানো আর অধ্যায় গুলো বড় হওয়াতে আগের অধ্যায়ে কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো সেসব মনে রাখতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। কারন গল্প যেহেতু দুই টাইমলাইনে চলছিলো তাই কোন টাইমলাইনে কোনটা দিয়ে শেষ হয়েছিলো সেগুলা দেখে নিতে হয়েছিলো অনেকবার। হতে পারে আমার একারই সমস্যা এটা। তাছাড়া তেমন খারাপ লাগার কিছু নেই। গল্প আগের মতোই সুখপাঠ্য, আগের মতোই প্রাঞ্জল।
এখন শৈলচরণ, বিশ্বজিৎ, লখন, রামানুজ আর সাথে এভারগ্রিন সাইগারসন, প্রিয়নাথ, তারিণীচরণদের নিয়ে পরের যাত্রার জন্য পাড়ি দেবার পালা।
বইঃ নীবারসপ্তক জনরাঃ ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখকঃ কৌশিক মজুমদার পেইজঃ ২১০
দ্বিতীয়বার পড়া হল, 'অগ্নিনিরয়' শুরু করার আগে....
সম্প্রতি ‛Marvel’ এর একটি নতুন অ্যানিমেটেড সিরিজ চলছে, সিরিজটির নাম ‛What if...’ এই সিরিজের মূল বিষয়বস্তু হল - আমরা ‛Marvel Comics’ বা ‛Marvel Cinematic Universe’এ সুপারহিরোদের যে গল্পগুলির সাথে পরিচিত, সেই গল্পগুলি সত্যি না হয়ে যদি তাদের গল্পগুলি অন্যরকম হত... তাহলে কি হত ??? What if ???
🔸‛নীবারসপ্তক’ পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হয়েছে কৌশিক মজুমদারের লেখা ‛সূর্যতামসী - ট্রিলজি’ যেন “বিশ্বসাহিত্যের ডিটেকটিভ গল্পের ‛what if’ ভার্সন”। এইরকম কেন বলছি ??
▫️প্রফেসর মরিয়ার্টির সাথে ‛রাইকেনবার্গ ফলস্’ এ ডুয়েলের পর ‛শার্লক হোমস্’কে বেশ কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল মরিয়ার্টির অনুচরদের হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য । যদি আপনি জানতে পারেন এই সময়টিতে ‛শার্লক হোমস্’ ছিলেন আমাদের এই বাংলায়... সেইসময়ের লালবাজারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা ‛প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়’কে সঙ্গে নিয়ে তিনি চষে বেরিয়েছেন আমাদের এই চন্দননগর-চুঁচূড়া থেকে কলকাতা... কেমন লাগবে আপনার ?
🔻আমি ‛নীবারসপ্তক’ বইটির কোনো পাঠ-প্রতিক্রিয়া বা আলোচনা করবো না । বইটি পড়ে আমি রীতিমতো একটা ঘোরের মধ্যে আছি... তাই একটি দুর্দান্ত ডিটেকটিভ-ট্রিলজির দ্বিতীয় অংশ নিয়ে আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । যদি এই উপন্যাসদ্বয়কে ‛ফ্যান ফিকশন্’ বলে ধরে নিই, তাহলেও বলবো বাংলা সাহিত্যে এইরকম লেখা আগে কখনো হয়নি ।
▫️‛সূর্যতামসী’র চেয়েও ‛নীবারসপ্তক’ অনেক বেশি পরিণত লেখা, অনেক রোমাঞ্চকর, অনেক বেশি ডার্ক । দুটি আলাদা আলাদা পিরিয়ডের আলাদা আলাদা ঘটনাপ্রবাহের বর্ণণা, সাথে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের যথাযথ ব্যাকস্টোরি... রহস্য উপন্যাসের মধ্যেও যে এতরকম তথ্য সুন্দরভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করা যায় সেটা কৌশিক মজুমদারের লেখা না পড়লে অনুভব করা সম্ভব নয় ।
▫️উপন্যাসটি শেষ করা হয়েছে দুর্দান্ত ক্লিফহ্যাঙ্গার দিয়ে, পাঠক হিসেবে ভীষণ বিরক্তি অনুভব করেছি । লেখক বলেছেন পরবর্তী পর্বে সব রহস্যের সমাধান করা হবে, তাই পরবর্তী বইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই ।
আড়াল থেকে রমণপাষ্টির চাল চালছে কেউ, সেই থেকে শুরু হচ্ছে ভূতের নৃত্য। ফ্রিম্যাসন ভাতৃসঙ্ঘের আড���ালেই কে বা কারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শাসনের জন্য হন্যে হয়ে একের পর এক অপরাধ করতে পিছপা হচ্ছেনা। অপরাধীদের হাতের ছাপ ভোজবাজির মত পাল্টে যাচ্ছে। সঙ্গে সারা শহর জুড়েই যেন জাতিবিদ্বেষ বেড়ে যাচ্ছে - কী এক গোপন সূত্র একত্রে ভাগ্য বেঁধে দিচ্ছে রানি ভিক্টরিয়া থেকে গল্পের বর্তমান সময়ের প্রতিনিধি গোয়েন্দা তূর্বসুর... এককথায় 'নীবারসপ্তক' ঠিক সায়েন্স ফিকশন না হয়েও টাইম স্পেস উথাল পাথাল করা তার প্লট, তার মনোযোগ ও কিছুক্ষেত্রে উৎকন্ঠা ধরে রাখার ক্ষমতা এমনই যে একবার পড়তে বসলে শেষ না করে ওঠা যাবেনা। ব্যপ্তি ও পরিসরে যে সূর্যতামসীকে ছাপিয়ে গেছে সেকথা বলাই বাহুল্য। বরং যে রহস্যের জাল সুর্যতামসীতে প্রায় গুটিয়ে এসেছিল বলে মনে হয়েছিল সে যে যেমন তেমন জাল নয়, একটা স্থানকাল চিরে ফেলে বিস্তার করা নেটওয়ার্ক সেটির আভাস পাওয়া যায়। আরেকটা ব্যপার যেটা 'সূর্যতামসী' পড়েই উপলব্ধি হয়েছিল সেটা হল উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট গোয়েন্দাদের চরিত্রনির্মাণ। কম করে চারজন গোয়েন্দা এখন অবধি উপন্যাসে উপস্থিত, একজন রক্তমাংসের চরিত্র, দুজন লেখকের সৃষ্ট, আরেকজন হলেন সর্বকালের সবথেকে বিখ্যাত ফিকশনাল ডিটেকটিভ। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। শার্লক হোমস, যার ছায়ায় সবই ঢেকে যায় তাকে এই বই মহান দেখায়নি, অথচ তার সমস্ত জাগতিক, অজাগতিক বৈশিষ্ট্য, এবং বিশ্ববিখ্যাত ডিডাকশন ক্ষমতা অক্ষুন্ন রয়েছে। বরং প্রিয়নাথ ও তারিণী - হোমসের সমসাময়িক দুই নেটিভ গোয়েন্দা স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। এখন বাকি থাকল তূর্বসু, যে এখনো অবধি এটুকুই আবিষ্কার করতে পারে যে তাকে ঘিরে কোথাও একটা বীভৎস মস্করা চলছে, অজান্তেই সে ভূতের নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। বইয়ের ছাপা, বাঁধানো, প্রচ্ছদ নিয়ে বলার কিছুই নেই কিন্তু জায়গায় জায়গায় র্যাকের বানান ছাপাখানার ভূতের পাল্লায় পড়ে র্যাক হয়ে গেছে দেখে বিরক্ত লাগল, আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে প্রকাশক এটা ঠিক করে নেবেন। লেখার বাঁধুনি সূর্যতামসীর চাইতে বেশি 'টাইট', পৃষ্ঠাসংখ্যা কমলেও দ্বিতীয় খন্ড পড়তে একঘন্টা বেশি সময় লেগেছে। প্রসঙ্গত, জ্ঞান হবার পর থেকেই ফিকশন পড়ে আসার সুবাদে প্রচুর বই পড়া হয়ে যাবার পরেও মনে হয়েছে, এরকম জঁর মিক্সিং এদেশে বইয়ে তো বলাই বাহুল্য, বিদেশি বইয়েও বিশেষ একটা দেখিনি। একই সাথে ডিটেকটিভ, ক্রাইম থ্রিলার, খানিকটা পাল্প, একটু সাইফাই, ষড়যন্ত্র-গুপ্তসমিতি এদিকে আবার ফ্যানফিকশন ও প্যাস্টিশ - এদুটো উত্তরাধুনিক জঁরের অতি সার্থক সংমিশ্রণের পরিণাম এই গল্প। মাতৃভাষায় ভাল জঁর সাহিত্য খুঁজতে থাকা পাঠকদের কাছে 'নীবারসপ্তক' একটি ট্রীট। আমার মন বলছে পরের পর্বে প্লটের সাইফাই এসপেক্ট আরেকটু প্রবল হবে। সেটা যদিও পরের পর্বেই বিচার্য। ততদিন দেশে নাচতে থাকা ভূত ঘাড়ে না চাপলেই মঙ্গল। অলমিতি।
পুনশ্চ: কলকাতা থেকে দিল্লিতে এত কম সময়ে অর্ডার পৌঁছে গেছে দেখে একটু বিস্মিত এবং অনেকটা খুশিই হলাম। প্যাকিং এতই ভালো ছিল, যে সেটা দিয়ে মলাট করেই বই পড়েছি (আমার হার্ডকভারের বই মলাট ছাড়া পড়তে রীতিমত ভয় লাগে)। পুরোনো বাংলার চারটে ছবি আর রতিবিলাস তৈলের বিজ্ঞাপন দেওয়া বুকমার্ক উপরি পাওনা।
বেশ ভাল। তবে ক্লিফহ্যাঙ্গারে বই শেষ করে দেয়ায় আশাহত হলাম। সূর্যতামসীতে কাহিনি এক হিসেবে শেষ হয়েছিল, এ-কারণে পরের বই দেরিতে পেলেও খারাপ লাগেনি; কিন্তু এবার একেবারেই অসমাপ্ত অবস্থায় বই শেষ করে দেয়া হলো। এটা ভাল লাগল না।
রবিবাবু তাঁর 'যোগোযোগ' উপন্যাসে লিখেছিলেন, "কিন্তু আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে, সন্ধ্যেবেলায় দীপ জ্বালানোর আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো। " কৌশিক মজুমদারের 'সূর্যতামসী' ছিল সেই সকালবেলায় সলতে পাকানো। যেখানে অত্যন্ত রয়েসয়ে পটভূমি তৈরি করেছেন ঔপন্যাসিক। আর, তা দুর্দান্ত গতি পেয়েছে 'নীবারসপ্তক'-এ। জাবলুন ও হিলির ভূতের রহস্য এই পর্বে আরও ঘনিয়ে উঠেছে।
অতীতের ছায়া থেকে বর্তমানের চোরাবালি: সূচনার মধ্যেই এক অলৌকিক টান
‘সূর্যতামসী’ যেখানে এক রহস্যময় অথচ আপাত সমাপ্তির জায়গায় পৌঁছেছিল, ঠিক সেখান থেকেই নীবারসপ্তক শুরু করে এক জাগতিক ও অতিলৌকিকের মাঝখানে দাঁড়ানো নতুন খেলার সূচনা। পাঠকের মনে যা ছিল একটি উপসংহার, লেখকের কলমে তা হয়ে ওঠে একটি ছদ্ম সূচনা। যেন প্রথম খণ্ড ছিল কেবল সেতুবন্ধনের রিহার্সাল—কোনো সুদূরস্থ এক মহাকাব্যিক অর্কেস্ট্রার পূর্বতালে বাঁধা এক প্রস্তাবনা।
এই খণ্ডে এসে উপন্যাসটির ক্যানভাস একলাফে প্রসারিত হয়। গ্যাসবাতির কাঁপা আলোয় আলোড়িত ঊনবিংশ শতকের চিনেপাড়া, সেখানে ছড়িয়ে থাকা রক্ত-চিহ্নিত গলি, ই-চিং চিহ্নের ভাষায় লেখা মৃত্যুবার্তা, বটতলার শুঁড়িখানার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক অপবাদগ্রস্ত নাট্যকারের পাণ্ডুলিপি— সবকিছু মিলেমিশে উপন্যাসকে নিয়ে যায় এমন এক স্তরে, যেখানে সময় আর ইতিহাস কেবল প্রেক্ষাপট নয়, বরং চরিত্র।
এই কাহিনিতে অতীত আর বর্তমান আলাদা হয়ে থাকে না, তারা একে অপরের গলায় বাহু জড়িয়ে, কখনও বন্ধুর মতো, কখনও প্রতিপক্ষের মতো, পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এক চোরাগলি থেকে আরেক আলোকস্তম্ভে। এই যুগান্তরের দ্বৈরথে একদিকে দাঁড়িয়ে আছে ছিন্নচিহ্ন ইতিহাস, অন্যদিকে মোবাইল-শাসিত বর্তমান— আর মাঝখানে, সেই রহস্য, যে রহস্যের উত্তাপ একশো বছরেও নিভে যায়নি।
জাদু-আচ্ছন্ন কলকাতা এবং একটি অভিশপ্ত নাটকের অনুরণন
এই উপন্যাসে কলকাতা কেবল ভৌগোলিক পটভূমি নয়—সে যেন এক ঐন্দ্রজালিক চরিত্র, সময়ের রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা এক দেবী, যার চোখে জমে থাকা কুয়াশা প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে দেয় রহস্যের শ্বাস-প্রশ্বাস। এই শহরের প্রতিটি অলিগলি যেন খেলে ফিরে এক ইতিহাস-আক্রান্ত মায়ার জগতে, যেখানে চিনেপাড়ার জাতিগত টানাপোড়েন, শ্বেতাঙ্গ বারবনিতাদের অবহেলিত বিষণ্নতা, আর বটতলার বাতিল নাট্যমঞ্চ—সবই মিলে এক আশ্চর্য স্বরে ফিসফিস করে বলে ওঠে: "সবকিছুই এখনও শেষ হয়নি।"
উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে এক 'নাটক', যার প্রতিটি সংলাপ যেন বারুদে মোড়া চিঠি—কোনো প্রাচীন অভিশাপের ধ্বনি। কৌশিক মজুমদারের রচনায় এই নাটক শুধুই গল্পের উপাদান নয়, বরং সে-ও এক চলমান, নিঃশ্বাস ফেলা চরিত্র—একটি প্রেতাত্মার মতো, যা কেবল অতীত নয়, বর্তমানকেও গ্রাস করে। প্রতিটি সংলাপের মধ্যে নিহিত থাকে কোনও অজানা সংকেত, কোনও মঞ্চস্থ মৃত্যুর প্রতিশ্রুতি।
এমন আবহেই অনুরণিত হয় Agatha Christie-র সেই বিখ্যাত মন্তব্য:"The past is the father of the present." ( Hallowe'en Party) — আর নীবারসপ্তক যেন এই উক্তির কাব্যিক প্রমাণপত্র। এখানকার অতীত মাটি চাপা নয়—সে হাঁটে, সে কথা বলে, সে নাটক রচনা করে। এবং মাঝে মাঝে, সে খুনও করে।
প্রিয়নাথ-তারিণী-গণপতি-তুর্বসু: সময়ের চার কোণে দাঁড়ানো চারটি মুখ
‘নীবারসপ্ত���’-এর চরিত্ররচনার মধ্যে রয়েছে এক অভিনব ব্যালান্স—ঐতিহাসিক পুনর্গঠন আর সৃষ্টিশীল কল্পনার মাঝখানে হেঁটে চলা এক আশ্চর্য সংলাপ। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের নিষ্ঠুর পেশাদারি, গণপতি চক্রবর্তীর রহস্যময় শিল্পিত অস্তিত্ব, তারিণীচরণের নির্লিপ্ত চোরা-তীক্ষ্ণতা— এঁরা যেন উনিশ শতকের কলকাতা থেকে উঠে আসা ধুলো-মাখা চরিত্র, যাদের রক্তে লেগে আছে পুরনো অশরীরী আতঙ্ক।
আর তুর্বসু? তিনি যেন আমাদের আজকের ক্লান্ত, বিভ্রান্ত, অথচ গভীরে সাহস লুকিয়ে রাখা শহুরে মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। ইতিহাস যাঁর পায়ে শেকল বেঁধেছে, অথচ তিনিও সেই ইতিহাসেরই উত্তরসূরি। পাঠক হিসেবে তাঁর মাঝে নিজেদের প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়—আমরা যারা অতীতকে বইয়ের পাতায় রেখে দিতে চেয়েছিলাম, অথচ তা এসে বাসা বাঁধে আমাদের স্বপ্নে, জেগে ওঠা চিন্তায়।
এই চরিত্রগুলোর পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্য, সময়গত দূরত্ব, আর আদর্শগত দ্বন্দ্ব— সব একসঙ্গে মিলে গড়ে তোলে এক গাথা, যা শুধু রহস্য নয়, মনস্তত্ত্বও।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে T.S. Eliot-এর সেই বিখ্যাত উক্তি: "Time present and time past are both perhaps present in time future, and time future contained in time past.” (T.S. Eliot, “Burnt Norton,” Four Quartets)
এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র যেন এই চক্রাকার সময়-দর্শনেরই জীবন্ত অভ্যর্থনা। তাঁরা কেউই কেবল নিজেদের যুগে আবদ্ধ নন; তাঁদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি সন্দেহ, প্রতিটি সংঘাত অনুরণন তোলে ভবিষ্যতের ধমণীতে। ‘নীবারসপ্তক’ এই দিক থেকেই কেবল থ্রিলার নয়, বরং স্মৃতির রাজনীতিকে ছুঁয়ে ফেলা এক বুদ্ধিদীপ্ত সাহিত্যিক প্রস্তাব।
স্টিফেন নাইট থেকে বঙ্কিমচন্দ্র, মেসোনিক গিল্ড থেকে ই-চিং: গবেষণার স্বচ্ছ সুরধ্বনি
‘নীবারসপ্তক’-এর সবচেয়ে অপূর্ব দিকগুলোর একটি হল এর গবেষণাপ্রসূত আবহ—যা জ্ঞান বিতরণের ভারে নুয়ে পড়ে না, বরং উপন্যাসের অলিন্দে ফুলের গন্ধের মতো মিশে থাকে। লেখক যখন স্টিফেন নাইটের মত ব্রিটিশ লেখক ও ফ্রিম্যাসন-গবেষকের কাজকে বাঙালি পাঠকের সামনে আনেন, তা হয় না কোনও কৌতূহল-খোরানো নামডাকা কারিগরি মাত্র, বরং হয়ে ওঠে চরিত্র ও প্লটের নির্যাস।
একইভাবে, বৌদ্ধ ই-চিং প্রতীকের সাংকেতিক ব্যাখ্যা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের গোপন গিল্ড-ব্যবস্থা, বঙ্কিমচন্দ্র ও অমৃতলালের নাট্যভাবনার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা—সবই যেন এসেছে গল্পের শরীরে রক্ত হয়ে, তথ্যের ঢেঁকি-চাপা চাল না হয়ে। এই যে তথ্যের পরতে পরতে কবিতা, এই যে কল্পনার ভেতরেও তথ্যের উন্মেষ—এই সংমিশ্রণটাই তো এক বিস্ময়কর সাহিত্যিক আঙ্গিক।
এই প্রসঙ্গে একেবারে তলায় গিয়ে দাঁড় করাতে হয় রেবেকা সলনিটের সেই অনন্তদর্শী বোধকে: “Facts are subversive. Subversive of the lies, the deceptions, the clichés. Facts are not neutral. They have weight and meaning. They are the building blocks of stories.” ( Rebecca Solnit, "Hope in the Dark", 2004)
‘নীবারসপ্তক’-এ প্রত্যেক তথ্যই ঠিক সেইরকম সাবভার্সিভ। তারা শুধু প্রেক্ষাপট তৈরি করে না, তারা গল্পকে চালিত করে, পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, এমনকি অন্ধকারেও কিছু আলো খোঁজার প্ররোচনা দেয়।
কৌশিক মজুমদার তাঁর উপন্যাসে গবেষণাকে ব্যবহার করেন না, বরং তাঁকে আস্থা করেন। আর ঠিক সেখানেই তাঁর সাহিত্য সত্যিকার অর্থে ইতিহাসের সাথে মিশে যায়, এমনভাবে—যেন গল্পই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় দলিল।
বইয়ের সৌন্দর্যে এক নিঃশব্দ সম্মোহন
নীবারসপ্তক হাতে নেওয়ার মুহূর্তেই বোঝা যায়—এ শুধু একটি বই নয়, যেন একটি রহস্যমণ্ডিত শিল্পবস্তু, যাকে ছুঁলে শব্দহীন এক সম্মোহনের ঢেউ বয়ে যায় পাঠকের মনের ভিতর। রাহুল ঘোষের অলংকরণ যেন কেবল চিত্র নয়, বরং আখ্যানের ছায়াপথে ছড়ানো চিহ্ন, পাঠকের দৃষ্টিকে ধীরে ধীরে গল্পের ভিতরে টেনে নিয়ে যাওয়ার পথচিহ্ন। ছাপার পরিমিততা, বাঁধাইয়ের সংযত গাম্ভীর্য, পাতার গন্ধ—সবকিছু মিলে যেন বইটি হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ পারফিউম, যার গন্ধে মেশে ইতিহাস, মৃত্যু আর অলৌকিক ইঙ্গিত।
সূর্যতামসী ছিল একটি প্রোমিস, একটি আভাস। আর নীবারসপ্তক সেই প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা—একটি মার্জিত, পূর্ণাঙ্গ রহস্যপাণ্ডুলিপি। পাতা ওল্টানোর প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়, সাইগারসনের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার কোনো ভূত-ছোঁয়া খাতা খুলে ফেলেছি, যেটি আলোর নিচে নয়, বরং ছায়ার ভাষায় কথা বলে।
এই সৌন্দর্যের ভার এতটাই গভীর যে বারবার মনে পড়ে যায় ভার্জিনিয়া উল্ফের সেই কালজয়ী উক্তি: “Books are the mirrors of the soul.” — Virginia Woolf, "Orlando"(1928)
আর সত্যিই তো—নীবারসপ্তক শুধুমাত্র লেখকের আত্মার প্রতিচ্ছবি নয়, পাঠকের আত্মাকেও চমকে দিয়ে বলে—তুমি কি প্রস্তুত আরও গভীরে নামতে?
কিছু টানাপোড়েন: সংলাপের মেঘলা মুহূর্ত ও তথ্যের ভার
এই প্রায় নিখুঁত গঠনের মধ্যেও কিছু ক্ষীণ অসঙ্গতির রেখা রয়ে গেছে—যেন নিপুণ সেলাইয়ের মাঝে এক-আধটা সুতো আলগা। অতীত ও বর্তমানের চরিত্রদের মধ্যে কিছু সংলাপ খানিকটা আড়ষ্ট ঠেকেছে— যেন চরিত্রেরা নিজেরা কথা বলছে না, বরং পাঠকের উদ্দেশে ইতিহাসের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনাচ্ছে। কখনো মনে হয়, সংলাপ নয়, কোনও জাদুঘরের গাইডের ভয়েস-ওভার চলছে—“এখানে তাকান, এখানে খেয়াল করুন।”
একইসঙ্গে বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ—যদিও সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ—এই কাহিনির মূলস্রোতের সঙ্গে সবসময় একাত্ম হয়ে উঠতে পারেনি। লেখকের স্পষ্ট অভিপ্রায় ছিল তাঁদের ইতিহাস ও অবস্থানকে তুলে ধরা, তবে সেটা অনেকটা তথ্যপাতার মতো এসে পড়েছে মাঝেমধ্যে। ফলে কাহিনির গতি কিছু কিছু জায়গায় স্তিমিত হয়েছে।
তবু, এই ছোটখাটো গড়মিল রচনার মূল আবহকে বিঘ্নিত করে না। বরং এটুকু বলে পাঠকের শ্রদ্ধা বাড়ে—একজন লেখক যখন বিস্তৃত গবেষণার ভার সামলে গল্পের গরিমা অক্ষুণ্ণ রাখেন, তখন এমন কিছু ‘ধাক্কা’ বড় বেশি দোষের নয়।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটি মন্তব্য: “What matters in life is not what happens to you but what you remember and how you remember it.”
এই ছোটখাটো খুঁতগুলিও তাই থেকে যায় নীবারসপ্তক-এর স্মৃতিতে—কারণ সেগুলিও বইটির আন্তরিকতা ও উদ্যমের অংশ। আর সেই স্মৃতিই তো গল্পকে জীবন্ত রাখে, দীর্ঘস্থায়ী করে।
শেষের কথা: সময়কে পৃষ্ঠায় বাঁধতে চাওয়ার এক অনুপম সাহিত্য প্রচেষ্টা
‘নীবারসপ্তক’ নিছক একটি ক্রাইম থ্রিলার নয়—এটি এক অতল গল্প-গুহার দ্বার, যার গায়ে লেগে আছে ধুলোমাখা ইতিহাস, অন্ধকার বিশ্বাস, এবং উজ্জ্বল জিজ্ঞাসার দীর্ঘ ছায়া। কৌশিক মজুমদার এই উপন্যাসে শুধু সময়কে লেখেননি, তিনি তাকে জীবন্ত করে তুলেছেন—এক এক পৃষ্ঠায় যেন একটি করে ঘড়ির কাঁটা চলে, যার শব্দে বাজে ইতিহাস ও রক্তাক্ত রহস্যের যুগল সুর।
এই উপন্যাস পড়া মানে কেবল হত্যারহস্যের সমাধান নয়—বরং এক বিস্মৃত পাণ্ডুলিপির পাতায় হারিয়ে যাওয়া কালের শ্বাস টের পাওয়া। এখানে ইতিহাস কেবল অতীতের বিষয় নয়, সে বর্তমানের আত্মায় ঢুকে ভবিষ্যতের গল্প বলে। যেভাবে অপরাধ, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, নাটক ও লোকসংস্কৃতির অলিগলি এসে একত্রিত হয় একটি বিস্ময়কর নাট্যগৃহে—সেখানে শুরু হয় এক অনন্ত অভিনয়। পাঠক হয়ে ওঠে সেই মঞ্চের দর্শক নয়, বরং চরিত্র।
যাঁরা ‘সূর্যতামসী’ না পড়ে থাকেন, তাঁদের বলব—সেই প্রথম খণ্ড না পড়লে এই দ্বিতীয় খণ্ড আপনাকে এক চমৎকার কাঠামোর মাঝে ছুঁড়ে ফেলবে, কিন্তু ভিত্তি হারিয়ে। কারণ ‘নীবারসপ্তক’ নিঃসন্দেহে দাঁড়িয়ে আছে তার পূর্বসূরির কাঁধে ভর করে। এবং ‘অগ্নিনিরয়’ আসছে—সে হবে শেষ অঙ্ক, সেই মহাপ্রলয়ের মঞ্চ, যেখানে ভূত আর মানুষের লড়াই ফয়সালা চাইবে।
আর শেষটায় মনে রাখতে Dame Agatha Christie'র ভাষ্যে: “The past is the mother of the present. It is through understanding it that we find the keys to what lies ahead.” — The Moving Finger
ভূত এখনো জ���গে আছে। তার চোখ জ্বলছে। সে এবার চুপ করে থাকবে না। আপনি প্রস্তুত তো?
লেখক কৌশিক মজুমদার কর্তৃক রচিত এবং সদ্য প্রকাশিত 'নীবারসপ্তক' গ্রন্থটির সর্বজনীন পরিচয় হচ্ছে এটি অতীব রহস্যময় উপাদেয় ডিটেকটিভ উপন্যাস 'সূর্যতামসী'র পরবর্তী খণ্ড।আগেরবারের মতোই কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কতিপয় চরণ দিয়ে গ্রন্থটির সূচনা করেছেন লেখক ; পুনরায় গোটা গ্রন্থটিকে পূর্বখণ্ড-মধ্যখণ্ড এবং উত্তরখণ্ডে বিভক্ত করেছেন।তবে,এবার বইখানা সূর্যতামসী অপেক্ষা ক্ষীণকায়।কিন্তু,তাতে অবশ্য তত্ত্ব ও তথ্যের কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি। অনধিক দুশো পৃষ্ঠার বইটিতে লেখক অসামান্য ভাষাশৈলীর মাধ্যমে সুনিপুণ কৌশলে তুলে এনেছেন ভারতবর্ষের অন্ধকার এক ইতিহাস।বিশ্বকোষ না হোক ভারতকোষের অমূল্য এক অংশ হিসেবে একে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যায়।আমি অন্তত মেনে নিতে এক পায়ে খাড়া!শ্রী কৌশিক মজুমদার সেইসব গুটিকয়েক লেখকের একজন যাঁর প্রায় প্রতিটি লেখা আমাকে মুগ্ধ করেছে।অসামান্য ভাষাশৈলী ছাড়াও কৌশিক মজুমদারের লেখা ভালোবাসার একটি বড় কারণ হচ্ছে - তাঁর লেখা অনেক কিছু শেখায় ;অনেক অজানা তথ্য জানায়।একজন পাঠকের কাছে এইতো পরম প্রাপ্তি!
একশো বছর আগে কলকাতায় ঘটে যাওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তুর্বসু রায় এবং অন্যতম চরিত্র দেবাশিস গুহ'র হাত ধরে আলোচনায় এসেছিলো-যার বিবরণ আমরা সূর্যতামসীতে পেয়েছি।বোধ করেছিলাম, নীবারসপ্তকে বোধহয় সূর্যতামসীর অমীমাংসিত রহস্যাবলীর সমাধান মিলবে। কিন্তু,লেখক আমাকে ভুল প্রমাণ করে সেই রহস্যের জাল আরো বিস্তৃত করেছেন এবং এবার নিপুণ দক্ষতায় অধিকতর মজবুত রহস্যের জাল বুনেছেন।এক্ষেত্রে, বর্তমান সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে অতীতের রোমহষর্ক কিছু ঘটনার অবিকল পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কেন ঘটছে,কারা ঘটাচ্ছে,কেন-ইবা অতীতে এসব ঘটনা পরাক্রমশালী ইংরেজ শাসকবর্গের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিলো সেসবের উত্তর-ই অতীত এবং বর্তমান উথাল-পাথাল করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তুর্বসু-অমিতাভ মুখার্জি-তারিণীচরণ- দারোগা প্রিয়নাথ এবং সাইগারসন সাহেব । অতীত-বর্তমানের মধ্যে উত্তেজনাকর টাইমট্রাভেল ছাড়াও উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে তারিণীর খাতা, গণপতির ভূতের বাক্স,প্রিয়নাথের জার্নাল,বটতলার বই,কলকাতার আঁধার গলি, রমণপাষ্টি,নীবারসপ্তক নামের রহস্য,গুপ্তসংঘ,ফ্রিম্যাসনদের বর্ণনা।সেই সাথে প্রাচীন কতিপয় বিজ্ঞাপন,পেপার কাটিং,ফটোগ্রাফ,বুক এজেন্সী,সেকালের কলকাতার নাট্যজগৎ,অভিনব পদ্ধতিতে খুন,রক্তপাত এই উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।তারিণী-গণপতি-দারোগা প্রিয়নাথ-সাইগারসন সাহেব-লখন-তুর্বসু-ঊর্ণা-দেবাশিস গুহ ছাড়াও এই উপন্যাসে নতুন চরিত্র হিসেবে আগমন ঘটেছে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,সিনেমা জগতের মহারথী হীরালাল সেন,নাট্যকার শৈলচরণ শ্যান্যাল, 'দারোগার দপ্তর'-এর প্রকাশক অরুণবাবু, প্রসন্নকুমার দত্ত এবং দেশি-বিদেশি বেশ ক'জন সাহেব-সুবো মানুষসহ আরো অনেকের।বিশ্ববিখ্যাত মাইক্রফটের উপস্থিতি-ও পরিলক্ষিত হয়েছে এই উপন্যাসটিতে এবং বলাই বাহুল্য যে, তা উপন্যাসটিকে অন্য এক মাত্রা প্রদান করেছে।এতসব বৈচিত্র্যময় চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে কিংবা অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একের পর এক যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে লেখক একবারের জন্যেও হোঁচট খাননি ; একবারের জন্যেও বইটির কোনো অংশ থেকে অন্য অংশ কিছুমাত্র দূর্বল বলে মনে হয় নি। এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা প্রকাশ পায়!আর বইটির প্রচ্ছদ-অলংকরণ-বাঁধাই নিয়ে যে প্রশ্ন তুলবার কোনো অবকাশ-ই নেই তা তো আগেই জানিয়েছি।সেইসঙ্গে,উপরি পাওনা হিসেবে জুটেছে রতিবিলাস তৈলের বিজ্ঞাপন সংবলিত দারুণ একখানা বুকমার্ক।
পরিশেষে বলে রাখি,গত এক বছর ধরে সকলকে বলে বেড়াতাম আমার চোখে সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ রহস্যোপন্যাস - 'সূর্যতামসী'। কিন্তু,আজ বলছি সূর্যতামসী যদি ভিত্তি হয় তবে 'নীবারসপ্তক' প্রকাশিত হয়ে তাকে পূর্ণতা দিয়েছে।পড়তে গিয়ে বোধ করেছি যে,লেখক কৌশিক মজুমদার আরো বেশি প্রস্তুতি নিয়ে, অধিক যত্ন ও দক্ষতার সঙ্গে রচনা করেছেন 'নীবারসপ্তক'।আমার মতে, সার্বিক দিক বিবেচনায় নীবারসপ্তক সূর্যতামসীর চেয়েও অধিক শক্তিশালী-উন্নত এবং সুখপাঠ্য! রহস্য-রোমাঞ্চ কি নেই এই উপন্যাসে!পাতার পর পাতা উত্তেজনায় ঠাসা!একবার এই বইয়ে মুখ গুঁজলে শেষ না হওয়া অব্দি স্বস্তি নেই। এমনকি,'শেষ হইলেও ইহা হইবে না শেষ!' এর রেশ বহুদিন অব্দি ভাবাবে পাঠককে ;পরবর্তী খণ্ডের জন্যে অপেক্ষায় দিন গোনা ভোগাবেও বটে।আশা করছি,লেখক তাঁর প্রিয় পাঠকমহলকে বেশিদিন ভুগতে দেবেন না!
উর্ম্মিস্নাত মানবের অসীম উল্লাস, প্রথম - রহস্য - ব্যথা - বিস্ময়ের ত্রাস, প্রকাশ করিব মোর স্নায়ুর যৌবনে! আদিম সন্তান আমি - রোম শিহরণে গাব গান ; স্বর্ণশীর্ষ নীবারমঞ্জরী' - মধ্যাহ্নরৌদ্রের বুকে আপনারে ছিন্ন করি' করি'!
- শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত ।
ডিটেকটিভ পাঠকমাত্রই অবগত আছেন আপাতদৃষ্টিতে সূর্যতামসী বইতে যে রহস্যের ইতি হয়েছিল বলে মনে হয় সেটা আসলে কঠিনতর রহস্যের সূত্রপাত মাত্র । বাক্সের সেই ভূতের গল্প এখনো বাকি!
বলছিলাম শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রণীত সূর্যতামসী বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড 'নীবারসপ্তক' বইটির কথা । এই খণ্ডে রহস্য আরও গভীর ও বিস্তৃত । এখানে আগের পর্বের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে । জানা যাবে দেবাশিস গুহ হত্যার ঘটনার পেছনের ঘটনা । চর্মচক্ষুতে যা দেখা যায় তার বাইরেও যে গোপনে আরো কত রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে এই পৃথিবীতে তার একটা উদাহরণ এই বইটি । উনবিংশ শতকের পত্রিকার কাটিং, বিজ্ঞাপন, টিকিটের টুকরো, ফটোগ্রাফ সব মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে থাকবে বিভিন্ন ক্লু । আর তার সঙ্গে থাকবে একটা বুক উইদিন বুক - এক রহস্যময় নাটক । যার ওপর নির্ভর করছে অনেককিছু । এছাড়া পুরো বইজুড়ে রয়েছে এক গোপন LGBT সংগঠন, আরো আছে গুপ্ত সংঘ সহ চোখ কপালে তোলা তথ্যের সমাহার ।
আমি সরাসরি পাঠ প্রতিক্রিয়াতে যাচ্ছি । কাহিনী সংক্ষেপ আসলে সূর্যতামসী পড়া না থাকলে বললেও অতটা স্পষ্টভাবে বুঝবেন না । তাই স্পষ্ট ধারণা পেতে আমার লেখা সূর্যতামসী বইটির রিভিউ তে ঢুঁ মেরে আসার পরামর্শ রইলো এই সংযোগে : https://www.facebook.com/530426037/po...
যাহোক নীবারসপ্তকে ফিরি । প্রথমেই বইটির ভালো দিকগুলো তুলে ধরছি । আমি আগেও বলেছি, এবারও বলতে বাধ্য হচ্ছি কৌশিকদা'র লেখার অন্যতম আকর্ষণ হল সাবলীল ভাষাশৈলী । পাশাপাশি গল্পটা দুটো টাইমলাইনে হওয়াতে সাধু ও চলিত ভাষার সমন্বয় ছিল খুবই চমকপ্রদ । (সূর্যতামসীতেও একই ব্যপার লক্ষ্যণীয় ।) এছাড়া লেখকের বর্ণনাভঙ্গি বেশ ভালো লেগেছে । প্রতিটি দৃশ্যের বর্ণনা ছিল অত্যন্ত বাস্তবিক । বর্ণনাভঙ্গিতে সূর্যতামসীর থেকেও এগিয়ে থাকবে নীবারসপ্তক । প্রতিটি ঘটনা যেন চোখের সামনে দেখতে পেরেছি । এছাড়া চরিত্রায়নেও বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছেন লেখক । যখন যেভাবে চরিত্রগুলোকে দরকার সেভাবে ব্যবহার করেছেন । আর হ্যাঁ, বরাবরের মত চরিত্রগুলোর মাঝে এবারও চমক রয়েছে । স্পেশাল মেনশন, তুর্বসু রায় - আহা আমাদের তুর্বসু! সে এবারে আরো বেশি সাচ্চা গোয়েন্দা হয়ে উঠেছে যেন । তাকে নিয়ে লেখক ছোটগল্পও লিখেছেন । অচিরেই তুর্বসু সমগ্র হাতে পাবার অপেক্ষায় । এই যে দেখুন বারবার প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য আলাপ টেনে আনছি । নীবারসপ্তকেও কিন্তু কিছু জায়গায় মনে হবে কোনো কোনো ঘটনা অহেতুক এসেছে । তবে এক্ষেত্রে লেখকের ন্যায় ভারী কণ্ঠে একটা কথাই বলবো : 'ইগনোর করিবেন না ।' বাকিটা বুঝে নিবেন । সূর্যতামসী ট্রিলজি হবে খবরটা সম্ভবত সকলেই জানেন । অর্থাৎ নীবারসপ্তকেই গল্প কিন্তু শেষ নয় । নীবারসপ্তকেও এসেছে অনেক প্রশ্ন । যার উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে ট্রিলজির শেষ বইটার জন্য । এবারে একটু মন্দের পাল্লাটায় চোখ দেয়া যেতে পারে । নীবারসপ্তক পড়তে পড়তে আপনার মনে হতেই পারে গল্পটা যেন একটু ধীরগতির, সূর্যতামসীর মত সেই পারদের ন্যায় সাসপেন্স যেন এই বইতে কিঞ্চিত অনুপস্থিত । এখানে আসলে অভিযোগের তেমন জায়গাও নেই । একটা ট্রিলজির দ্বিতীয় বইটা সাধারণত পুরো গল্পটাকে বিল্ডাপ করার জন্যই বের হয় । এই বইটাও সেইম । নীবারসপ্তক এসেছেই সূর্যতামসীর উত্তর হিসেবে এবং প্রথম গল্পটাকে আরো জোরালো করতে । এজন্য লেখক সময় নিয়েছেন, ধীরে ধীরে গল্পটা বিল্ডাপ করেছেন । তাই গল্পের ধীরগতিকে বইয়ের নেগেটিভ দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না আসলে । তবু কোথাও যেন মনে হল সামান্য একটু গতির দরকার হয়তো ছিল । বিশেষত শুরুটা । এবার বুক ফার্মের প্রোডাকশনের কথা বলা যাক । বুক ফার্ম বরাবর ই আমার পছন্দের প্রকাশনী । বিশেষত তাদের প্রোডাকশন ও সম্পাদনা বেশ ভালো । পুরো বইটাতে চমৎকার কিছু আর্ট সংযুক্ত করা হয়েছে । বিজ্ঞাপনগুলোও নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ । পাশাপাশি বইয়ের বাঁধাই ও পৃষ্ঠা কোয়ালিটি বেশ ভালো । এছাড়া কামিল দাসের করা প্রচ্ছদটি বেশ চমৎকার । সবমিলিয়ে কৌশিকদা'র জাদুকরী লেখনশৈলী, বুক ফার্মের চমৎকার প্রোডাকশন মিলেমিশে দারুণ কিছু পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছে । বইটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো । পড়ুন, পড়ে মুগ্ধ হোন ।
এক নজরে, বই : নীবারসপ্তক লেখক : শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রকাশনী : বুক ফার্ম মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয়) : ২৭৫ টাকা বাংলাদেশী টাকায় : ৪১২ টাকা
বইয়ের নাম - নীবারসপ্তক লেখক - কৌশিক মজুমদার প্রকাশক - বুকফার্ম মূল্য -২৭৫ টাকা স্পয়লার_ফ্রী_রিভিউ বইয়ের রিভিউ এর আগে একবারই লিখেছি দায়ে পরে .....! আমি এমনি বইয়ের রিভিউ লেখি না .... তার কারণ প্রথমত আমি লিখতে পারি না আর দ্বিতীয়ত আমি খুব ল্যাদখোর ।। পাঠক হিসেবে আমি সর্বভুক। শরৎচন্দ্র থেকে অভীক দত্ত সবই চলে । তবে রোম্যান্টিক জিনিসপত্র বেশি নিতে পারি না কারণ আমি ও রসে বঞ্চিত।। আর থ্রিলার বা হরর পেলে আমি বিরিয়ানির আলু দিয়ে দিতে পারি ।। আপাতত গৌড়চন্দ্রিকা এখানেই শেষ করলাম .... ওপরের কথা গুলো বলা প্রয়োজন বোধ করলাম কারণ এতে করে সবাই অল্প হলেও আমার মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারবেন । কারণ কোনো একটি বই ভালো লাগা বা খারাপ লাগা সব সময় একান্ত ব্যক্তিগত হয় বলেই মনে করি। এবার আসি বইয়ের কথায় , বইটির নাম "নীবারসপ্তক" এর মানে সাতটি বুনো ধান । তবে এই রূপ নামকরনের কারণ জানতে হয়ে বইটা পড়তেই হবে। আর আমি বলছি নামকরন স্বার্থক। বইতে কী কী আছে আছে বললে বলবো শার্লক আছেন, গণপতি আছেন, প্রিয়নাথ আছেন, তারিনীচরণ আছেন, ক্যামিও রোলে মাইক্রফট ও আছেন। পুরনো কলকাতা আছে , চীনা পাড়া আছে, পুরনো চুঁচুড়া , পুরনো হাওড়া স্টেশন সবই আছে। বইতে নেই বলতে এক্সট্রা কিছু নেই ..... মানে ধরুন ফালতু কোনো কথা নেই । এক্সট্রা মেদ নেই , "আমি জানি" এই ভাব টা নেই ..... যেটা একটা থ্রিলার লেখার জন্য সব থেকে দরকারি। অথচ এই বিষয় নিয়ে লেখার সময় জ্ঞান জহির করার ফাঁদ প্রতিটা বাক্যেই ছিল। বইয়ের লেখা প্রাঞ্জল এবং সুস্বাদু। পুরনো দিনের কথা বলার সময়ও লেখার গতি মন্থর হয় না। এই জন্য লেখকের অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য। প্রচ্ছদ আর ভেতরের ছবি নিয়ে বললে শেষ হবে না ..... মানে এত সুন্দর একটা প্রচ্ছদ অনেক দিন পরে কোনো বাংলা বইয়ে দেখলাম। আর ছবিগুলি যথাযত এমনকি যে বিজ্ঞাপন গুলি পুণর্নির্বান করা হয়েছে সেগুলোও বেশ সঠিক । সূর্যতামসী এক রাতে শেষ করেছিলাম .... যদিও বইটি আমার কাছে নেই ঘুরতে গেছে। আর এই বইটিও এক রাতেই শেষ করলাম ।। কোনো বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ যখন বের হয় তখন একটু ভয় ভয় লাগে যদি সেই আমেজটা না আসে। তবে আমার সেই ভয় যে অমূলক ছিল তা জোর দিয়ে বলতেই পারি। তাহলে কী বইয়ে খারাপ কিছু নেই ? নাহ্ তেমন ব্যাপার নয়। অনেক কিছুই বেশ খারাপ আছে । যেমন ধরুন মুদ্রণ প্রমাদ যে এত রয়েছে তা আমি ভাবতেও পারি নি । বানান ভুল আমারও হয় তাই এসব নিয়ে এত মাথা ঘামাই না আমি , কিন্তু তাই বলে বইতে ঝিঁঝিঁ বানান "ঝিঁ২" লেখা থাকবে ? বা ধরুন বিজ্ঞাপনে ১০ আনা কে 1০ আনা লেখা হবে ? এসব তো মানা যায় না। আরো আছে এই উপন্যাসের নায়িকা মানে উর্নি(বানান ভুল হতে পারে) তার উপস্থিতি সাংঘাতিক ভাবে কম। সেই দিক দিয়ে দেখলে এটা অনেকটা তামিল সিনেমার নায়িকাদের কথা মনে পড়ে যায়, তবে আশার কথা যে অন্তিম ভাগে হয়তো তাঁর জোরালো উপস্থিতি দেখতে পাবো। আপাতত এই টুকুই ..... অনেক লিখে ফেললাম ..... বইটি গোয়েন্দা থ্রিলার হিসেবে স্বার্থক তো অবশ্যই কিন্তু তার সাথে পরের খন্ডের জন্য অনেক উচ্চাশা বেড়ে গেলো । তাড়াতাড়ি পরের খন্ডটা লিখে ফেলুন স্যার।
নীবারসপ্তক (সূর্যতামসীর পরবর্তী খণ্ড) লেখক - কৌশিক মজুমদার প্রকাশক - বুকফার্ম জেনার - ডিটেকটিভ মূল্য - 275/-
সূর্যতামসী পড়ার পর এই বই পড়তেই হতো, যারা এখনো সূর্যতামসী পড়েননি তারা প্রথমেই এই বইটি পড়বেন না। নীবারসপ্তক বইটির প্রচ্ছদ সূর্যতামসী এর মতোই দারুন, পুরোনো কলকাতার অলংকরণ নিয়ে বইটির প্রচ্ছদটি দারুন ইন্টারেস্টিং। ম্যাসন সিরিজ এর দ্বিতীয় পার্ট নীবারসপ্তক, তৃতীয় খণ্ডটির জন্য আবার বেশ কিছুদিন অপেক্ষা রইলো। বইয়ের ভিতরের চিত্রকর্ম, প্রাচীন বিজ্ঞাপনগুলো বইটিকে আরও সুন্দর করেছে। সূর্যতামসী বইটিতে একটা ঘটনার শুরু যেটা হয়েছিল, সেটা আরও আকর্ষিত ভাবে ঘটনা বহুল করে তুলেছে নিবারসপ্তক বইটিতে।
পটভূমি - সূর্যতামসীতে যে রহস্যের আপাত সমাপ্তি দেখা গিয়েছিল নীবারসপ্তকে এসে দেখা গেল সমাপ্তি এখনও অধরা এই রহস্যের। আর বর্তমান টাইমলাইনের রহস্য তো সূর্যতামসীতেও সমাপ্ত হয়নি। সূর্যতামসীর ন্যায় নীবারসপ্তক বইতেও প্রচুর ঐতিহাসিক রেফারেন্স এসেছে৷ অনেক প্রাচীন কলকাতার বিজ্ঞাপন, সাহিত্যের নমুনার বিবরণ এসেছে। একটি গুপ্ত সংঘের এবং এর সাথে জড়িত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির কথা উঠে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে যে সমাধান দেওয়া হয়েছিল সূর্যতামসীতে, সেটা যেন আরো ১৮০° ঘুরে যাচ্ছে। অন্যদিকে সূর্যতামসীতে দেবাশিস গুহ হত্যার কিংবা মৃত্যুর কোনো সমাধানে আসা হয়নি। এই বইয়েও নয়, তবে দেবাশিসের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখানো হয়েছে। উভয় টাইমলাইনের ঘটনাবলি অসমাপ্ত রাখা হয়েছে। সূর্যতামসীতে তবু একটি ঘটনার সম্ভাব্য সমাধান করা হয়েছিল, নীবারসপ্তকে তাও বাতিল হয়ে আসল রহস্যভেদ অধরাই রেখে দিয়েছেন। প্রিয়নাথ, তারিণী, গণপতি এবং তুর্বসু রহস্যের জটিল জাল ছিন্ন করার বদলে আটকে পরের রহস্যের জালে। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে ওঠে এক হতভাগ্য নাট্যকারের লেখা একটি নাটক। রহস্যের জাল ছারানোর জন্য অবশ্�� পরবর্তী খণ্ড পড়তেই হবে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া - সূর্যতামসী এর থেকে নীবারসপ্তক অনেক বেশি পরিণত লেখা, অনেক রোমাঞ্চকর, অনেক বেশি ডার্ক। দুটি আলাদা আলাদা পিরিয়ড এর দুটি আলাদা আলাদা ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা, সাথে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের যথাযথ ব্যাকস্টোরি। রহস্য উপন্যাস এর মধ্যেও লেখক প্রচুর তথ্য সমৃদ্ধ ভাবে লিখেছেন। নীবারসপ্তকটি শেষ হয়েছে একটি দারুন ক্লিফহাঙ্গের দিয়ে, পাঠক হিসেবে লাস্ট পার্ট এর জন্য অপেক্ষা করাটা বড়ো কষ্টকর। লেখক বলেছেন শেষ পার্ট টিতে সমস্ত রহস্যের সমাধান হবে, তাই পরবর্তী পার্ট এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
(ছবিটি সংগৃহীত)
For more reviews please visit Journal of a Bookworm
'সূর্যতামসী' পাঠ করার পরে মনে হয়েছিলো অতীতের কাহিনি শেষ, ভেবেছিলাম ১২৫ বছর আগের ঘটনাবলীর সমাপ্তি ঘটেছে। এই বইখানা পাঠ করে বুঝলাম অতীতের সকল কাহিনির মাত্র প্রথম অংশই আমরা জেনেছিলাম, মূল কাহিনি তো এই বই থেকে শুরু। 'সূর্যতামসী'-তে যেই ভূতের কথা বলা হয়েছিলো, সেই ভূতের রহস্য এই বইতে আরও বেশি জট পাকায়, যদিও বইখানা অতিপ্রাকৃত না। এই বই নিয়ে কোনো কিছু বললে প্রথম খন্ডের স্পয়লার হয়ে যাবে। তবে এই বইতে দুইটি চরিত্রের উল্লেখ্য রয়েছে, যদিও এদের কোনো কাহিনি নেই, শুধুই নাম উল্লেখ্য একটি বিশেষ কারনে, যেই নাম জানার পরে এই বইটির প্রতি আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে যায়, একজন 'মাইক্রফট' অন্যজন 'মরিয়ার্টি', একমাত্র ডিটেকটিভ প্রেমিরাই এই দুইজন চরিত্রকে চিনে থাকবেন। এদের উল্লেখ্য থাকার কারনেই এখন পর্যন্ত সাইগারসন চরিত্রটা আমার এই বইয়ের অন্যতম প্রিয় চরিত্র। কাহিনিতে গল্প অনেক বেশি প্যাঁচানো হয়েছে, খুব মনোযোগ দিয়া না পড়লে কাহিনির অনেক টুইস্ট বুঝা কষ্টসাধ্য, বিশেষ করে চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে যেইসকল টুইস্ট আছে। কয়েকটা ছোট ছোট টুইস্ট শুধু নাম প্রকাশ করার মাধ্যমেই প্রকাশ করা হয়েছে। হাজার বছরের পুরনো কোনো এক গুপ্তসংগঠন আসলে শত বছর আগে ভূতকে দিয়ে কি করেছিলো যার কারনে ব্রিটিশ রাজের ভীত কেঁপে উঠেছিলো, তার চূড়ান্ত উত্তর পাওয়া যাবে পরবর্তী খন্ডে।
সূর্যতামসী'র পড়ার পর এই বইটা নিয়ে এক্সপেকটেশন বেড়ে গেছিল অনেক। তার অধিকাংশ পূরণ করেছে নীবারসপ্তক। কিছু কিছু জায়গায় খাপছাড়া লেগেছে। বর্ণনা ভঙ্গিতেও কৃত্রিমত্তা চলে এসেছে বেশ কিছু অংশে। আশাকরি সিরিজের পরবর্তী বইটা সকল এক্সপেকটেশন ছাড়িয়ে যাবে। লেখকের জন্য শুভ কামনা রইল।
সময়কে জ্যান্ত করে তোলার যে কাজ সূর্যতামসী-তে ঘটেছে, তা আরো দক্ষতার সাথে করেছেন লেখক এই বইতে। ঘটনাপঞ্জির একেকটা স্থানের নাম যেগুলো নীবারসপ্তকে পেয়েছি, ঘুরেফিরে এসেছে কলকাতার মানুষদের আত্মজীবনীতেও- সে চিপেনডেলের চেয়ার বা স্টার থিয়েটার হোক, অথবা ভাসমান হাওড়া ব্রিজ (তাজ্জব লাগে, না? লোহার ব্রিজের জায়গায় পন্টুন ব্রিজ ছিল নাকি এককালে)।
পয়লা বইয়ের আপাত মৃয়মাণ কিছু চরিত্রকে নতুন করে চিনিয়েছেন লেখক, যুক্ত হয়েছে নতুন চরিত্রেরাও। আর এইবার চরিত্রদেরকে এতটা মানবিক করে তুলেছেন, অনেকের জীবনের গল্প পড়ে পাঠকের ভালো-মন্দ অনুভূতি তৈরী হতে বাধ্য তাদের জন্য।
ভারতবর্ষে ফ্রি-ম্যাসনের উপস্থিতি, এবং নামকরা সব ঐতিহাসিক চরিত্রদের সম্পৃক্ততাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে যে গবেষণাকাজ দেখিয়েছেন লেখক, সেটা চমকপ্রদ। পুরোন পেপার কাটিং এবং বিজ্ঞাপন (কিছু বাস্তব, কিছু লেখকের তৈরী) দিয়ে ঘটনাবলীর সত্যতা এবং তদন্তসূত্র প্রমাণ করেছেন। আঙুল তুলেছেন এমনকি বঙ্কিমের আনন্দমঠ আর প্রিয়নাথের দারোগার দপ্তরের মতো প্রতিষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের দিকেও। গুপ্তসংঘ বা গুপ্ত ইতিহাস নিয়ে থিওরি দেখাতে পছন্দ করেন জঁর লেখকরা, কিন্তু সেটা কৌশিক মজুমদারের মতো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মতো কাজ বাংলা সাহিত্যে কমই চোখে পড়েছে।
সিরিজের আরেক দারুণ ব্যাপার ছিল, শেখভের বন্দুক, বা Chekov's Gun - যে উপকরণগুলোর উল্লেখ হয়েছিল, নিতান্ত অদরকারি মনে হলেও সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে গল্পের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছেন লেখক। একটা ঘটনার উল্লেখকে সূর্যতামসীতে একদম অদরকারি মনে হয়েছিল, নীবারসপ্তকে এসে দেখা গেলো সে ঘটনা ছিল না-চেনা একটা চরিত্রের ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টের দরকারি একটা পয়েন্ট। পুরো সিরিজজুড়ে ফোরশ্যাডোর খেলা চমৎকার।
আগের বইয়ের তুলনায় তথ্য উপস্থাপন সূক্ষ্ম, এবং বরণনাভঙ্গি গতিময়। অবশ্য প্রথম বই নিয়েও কোনো আপত্তি ছিল না আমার। দুইশো পাতার বই শেষ করে তবেই উঠেছি।
আর, অলঙ্করণ! সূর্যতামসীতে এই নিয়ে সমস্যা ছিল। যে ঘটনা যে পৃষ্ঠায় ঘটছে, তাঁর আগেই ছবি এসে পড়েছিল। এই বইয়ে ছবি-রা অনেক প্রাসঙ্গিক, তাছাড়া গল্প বলায়ও তারা অংশ নিয়েছিল বেশ ভালোভাবে। মাঝে একটা নাটকের বিজ্ঞাপন ডিজাইন অরেছেন লেখক, যেটার ফরম্যাটটা বইয়ের ফ্ল্যাপের ভেতর দেখতে পাবেন। ওটার বুদ্ধিটা বেশ লেগেছে। আর নাটকটা-ও।
রমণোপাষ্টির খেলা কোথায় গড়ায়, তা দেখতে পাওইয়া যাবে তিসরা বই অগ্নিনিরয়-এ। কিন্তু খেলা যে দিনে দিনে বেশ জমে উঠেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নীবারসপ্তক এবং সর্বোপরি ম্যাসন ত্রয়ী'র ওপর স্পয়লারমুক্ত আলোচনা দেখতে পারেন এইখানে : https://youtu.be/RSz9hE4JZss
'সূর্যতামসী'র দুই সময়কালের হত্যারহস্য, যা কিনা হাজার বছরের এক পুরনো গুপ্তসংঘের করা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িয়ে আছে। সেই অসমাপ্ত রহস্যের বাকী অংশ দেখা যাবে কৌশিক মজুমদার রচিত 'নীবারসপ্তক' বইয়ে। যেখানে কিনা শতবছরের পুরনো এক ভয়ংকর ঘুমন্ত ভূত আবার জেগে উঠেছে। অতীতের প্রিয়নাথ মুখার্জি, তারিণীচরণ আর ডিটেকটিভ সাইগারসনের তদন্ত করা সেই অত্যাধিক গোপনীয় কেস যা ���িনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা উদ্ধার করে ডিটেকটিভ তুর্বসু কি পারবে ভয়ানক বিপদ থেকে নিজেকে আর নিজের আপনজনদের রক্ষা করতে?
কৌশিক মজুমদারের লেখা দুই বাংলায় জনপ্রিয় থ্রিলার ম্যাসন ট্রিলজির প্রথম বই 'সূর্যতামসী' পড়ে কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম বলা চলে। বেশ কিছু উচ্চাকাঙ্খী আইডিয়া নিয়ে সেই গল্প সাজানো হলেও গতানুগতিক গল্প আর তার খাপছাড়া প্রেজেন্টেশনটা ভালো লাগে নি। সবশেষের একটা দূর্বল রহস্যভেদ আর ক্লিফ হ্যাঙ্গারখানাও লাগে নি তেমন আহামরি কিছু। তাই সিরিজের পরবর্তী বই 'নীবারসপ্তক' একটু ভয়ে ভয়ে কম এক্সপেকটেশনে শুরু করেছিলাম।
কৌশিক মজুমদারের লেখনি ভালোই, আগের বইয়েও ছিল, এই বইয়ে তা আরও উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে সাধু ভাষার অংশগুলোতে প্রথম বইয়ে যেমন একটু জড়তা ছিল তা কেটেছে। তাছাড়া এই বইয়ে এসে পুরো ট্রিলজির গল্পটা মোটামুটি একটা ট্র্যাকে এসেছে, ফলে 'সূর্যতামসী'র গল্পের মতো খাপছাড়া ভাবটা নেই। একটা হিস্টোরিক্যাল-কন্সপিরেসি থ্রিলার গল্প হিসেবে লেখক বেশ ভালোভাবেই কাহিনীকে সাজিয়ে নিয়েছেন এই বইয়ে। তাকে আবার আগের বইয়ের কাহিনীর সাথে যেভাবে যুক্ত করা হয়েছে সেটাও ভালো। মূল কন্সপিরেসি থিওরিগুলো গতানুগতিক হলেও, লেখক বহু চরিত্র-ঘটনা, ফিকশনের সাথে ফ্যাক্ট মিশিয়ে তাকে জটিলভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে গল্পের প্রতি সবসময় আগ্রহ বজায় থাকে। আর এই বইয়ে তথ্য পরিবেশন ভালো হয়েছে, 'সূর্যতামসী'র মতো লেকচারবাজি মনে হয় নি।
চরিত্রায়ন এই বইয়েও আগের মতোই, বিশাল প্যাঁচানো গল্পের আড়ালে চাপা পরে গিয়েছে সব চরিত্র। তবে হয়তো আগের বই মিলিয়ে বেশী সময় ধরে একাগ্র হয়েছি বলে, প্রিয়নাথ, তারিণী আর তুর্বসুর চরিত্রটা খুব একটা খারাপ লাগছে না। কিন্তু সাইগারসনকে নিয়ে আমি এখনও হতাশ। তবে লেখক বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন ট্রিলজির বড় অ্যান্টাগনিস্ট লখনের চরিত্রায়নে। তার মাধ্যমে ব্রিটিশ আমলের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের দুরবস্থা লেখক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সেইসাথে রামানুজ চরিত্রটার দ্বারা বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের অন্ধকার জগতের চিত্রণও ছিল খুব ডার্ক আর ডিস্টার্বিং।
যদিও রুপান্তরকামীতাকে থার্ড জেন্ডার বা হিজড়া সম্প্রদায় দিয়ে ঢাকার অপচেষ্টাটা চোখে লেগেছে। তবুও মেনে নেওয়া যায়। যেহেতু তিনি কিছু প্রোমোট করছেন না জোর করে, শুধু অবস্থাটা দেখানোর চেষ্টা করছেন। এবার কি কি খারাপ লাগলো বলি। প্রথমত বইটাকে যদি এর প্রচ্ছদের উপর ঠাসা লেবেল, জনমত অনুসারে ডিটেকটিভ থ্রিলার ধরি, তাহলে বলতেই হয়, বইটা খুবই দূর্বল। অসংখ্য চরিত্র, বিল্ডআপ, ষড়যন্ত্রের আভাস, জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মাঝে একদম তাড়াহুড়োর সাথেই কোনোমতে গোয়েন্দাদের তদন্তকার্য সারা হয়েছে বলা চলে। তবে সেইটাকে আমি বুদ্ধিদীপ্ত বলতে নারাজ। তাছাড়া এখনও মূল গল্প, এর হালকা পাতলা টুইস্টগুলো খুবই টিপিক্যাল লাগছে।
আর যদি এই বইকে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ধারার কন্সপিরেসি থ্রিলার হিসেবে ধরি, সেক্ষেত্রেও হতাশ হয়েছি। কারণ এইক্ষেত্রে যে দ্রুতগতির এক্সিকিউশন আর উত্তেজনা আমি আশা করি, তা এই বইয়ে নেই। 'নীবারসপ্তক'ও সিরিজের প্রথম বইয়ের মতোই বেশ স্লো। যদিও লেখক কাহিনীকে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছেন ট্রিলজির প্রথম দুই বইয়ে। দেখা যাক সিরিজের শেষ আর সবচেয়ে বড় বই 'অগ্নিনিরয়'এ এই রমণপাষ্টির খেলা কিভাবে আর কেমন করে শেষ হয়।
লেখক পাঠককুলকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসে ফেলেছেন পরবর্তী শেষ পর্বের বইয়ের জন্য চরম উৎকন্ঠা সুনিশ্চিত। লেখকের গবেষণাকে জানাই কুর্নিশ। কৌশিকবাবুর দৌলতে ১০০ বছর আগের কলকাতার বহু চিত্র খুঁজে পেয়েছি । কলকাতাকে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছেন। দুটি পটভূমিকাকে কেন্দ্র করে রচিত এই বই। সমান ভাবে রহস্যের জট লেখক সুনিপুণ ভাবে রচনা করেছেন। একদিকে, তারিণী, প্রিয়নাথ আর শার্লক হোমসের যুগলবন্দী, অন্যদিকে, তুর্বসু আর ইন্সপেক্টর মুখার্জির যুগলবন্দী।
পুরাতন কলকাতার পটভূমিতে রচিত ভাগটি বেশ উপভোগ্য। লেখকের লেখনীকে জানাই কুর্নিশ। শেষের দিকে লেখক সব কিছু গল্পের জাল গুটিয়ে এনেও অসমাপ্ত রেখে গেলেন। আবার অপেক্ষা পরবর্তী পর্বের।
বুকফার্ম কে ধন্যবাদ এমন একটি উপহার দেবার জন্য। বইটির অলঙ্করণ আর প্রচ্ছদ এক কথায় অসাধারণ।বইটির প্রচ্ছদ বইটির সম্পর্কে অনেক কৌতূহলের জন্ম দেয়
সবাইকে একটাই অনুরোধ, সকলে সূর্যতামশি পড়ে তবেই নীবারসপ্তক পড়বেন।
লেখক যে ম্যাডনেস অফ মাল্টিভার্স তৈরি করেছেন এটি তার দ্বিতীয় ভাগ। এবং যথেষ্ট ওভার হাইপড্। বারবার মনে হয়েছে লেখাটিকে অযথা টানা হচ্ছে। কিছু তথ্য অপ্রয়জনীয়। লেখাটি ফ্যান ফিকশন হিসাবে ব্যবহারের কোন মানে হয়না৷ তবে এই লেখা বাংলায় প্রথম। লেখনী সাবলীল। পরবর্তী অংশ পড়ার জন্য মুখিয়ে আছি।
সূর্যতামসীর যেখানে শেষ, নীবারসপ্তকের সেখানেই শুরু। সূর্যতামসী যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই আমার মতোই অধীর আগ্রহে পরবর্তী খন্ডের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। সেই অপেক্ষার পালা শেষ হলো প্রায় বছর খানেক পরে। এই উপন্যাসেও সূর্যতামসীর মতোই ব্যবহার করা হয়েছে দুটো টাইমলাইন। প্রথমটি সূর্যতামসীর সময়ের প্রায় চার বছর পর অর্থাৎ ১৮৯২-৯৩ এর চারবছর পর ১৮৯৬ অপরটি সূর্যতামসীর মতোই ২০১৮। গত পর্বের প্রধান চরিত্রগুলো এ পর্বেও হাজির। দারোগার দপ্তরের লেখক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বা যাদুকর গণপতি চক্রবর্তীর মতো সত্যিকারের চরিত্রগুলো যেমন সেকালে হাজির সাথে আছেন বৃটিশ গোয়েন্দা সাইগারসন মোহেলস আর প্রথম বাঙালি গোয়েন্দা তারিণীচরণ রায়। তবে সাইগারসন যে স্বয়ং শার্লক হোমস এই খন্ডে তা আরও স্পষ্ট। বৃটিশ সরকারের গোপন নথির অংশ হিসেবে যা তুলে ধরা হয়েছে এই খন্ডে সেখানে উল্লেখ আছে শার্লক হোমস সিরিজে বহুল পঠিত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা লেস্ট্রেড এবং টোবিয়াস গ্রেগসনের, উল্লেখ আছে কনান ডয়েলের শার্লক হোমস এর প্রধান ভিলেন প্রফেসর মরিয়ার্টির সাথে তার অন্তিম লড়াই এর এমনকি শার্লক হোমসের ভাই মাইক্রফট হোমসেরও। এমনকি কাহিনীর উপসংহারে যেটা কিনা প্রিয়নাথের জার্নালের বকলমে এই খন্ডের শুরুতেই দেয়া আছে সেখানে বলা হচ্ছে সাইগারসন প্রিয়নাথকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছেন সাইগারসন গোয়েন্দাগিরি থেকে অবসর নিয়ে ডাউনস গ্রামে মৌমাছি পালন করছেন।
নতুন কিছু বাস্তব চরিত্রও এই উপন্যাসের সেকালের অংশে ঢুকে পড়েছেন তাদের সবার ভূমিকা হয়তো সমান নয় তবে কেউ কেউ এই পর্বের খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাদের মধ্যে আছেন স্টার থিয়েটারের অমৃতলাল বসু, হাটখোলার দত্ত বাড়ির বাবু প্রসন্নকুমার দত্ত, পরোক্ষভাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা ভারতীয় ��লচ্চিত্রের সূচনা যার হাত ধরে সেই হীরালাল সেন। এরা হয়তো এই উপন্যাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নন তবে প্রসন্নকুমার দত্ত ও বঙ্কিমচন্দ্রকে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে ফ্রিম্যাসনদের মূল এবং সুস্থধারার সংঘের সাথে। এরা দুজনেই নাকি ছিলেন ম্যাসনিক আর বঙ্কিমের সর্বশেষ উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার জন্য যে সামাজিক উপন্যাসের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল বঙ্গদর্শনে তার নাম নাকি ছিল রমণপাস্টি। এই রমণপাস্টিও নাকি একটা কোড ওয়ার্ড, ম্যাসনিক স্কোয়ারকে বঙ্কিম স্বয়ং নাকি এই নাম দিয়েছিলেন। এসব তথ্যের কতটুকু সত্য বা কতোটা কাহিনীর প্রয়োজনে কল্পনা মেশানো তা জানি না। তবে দারোগার দপ্তরের প্রথম খন্ডের দুটি দপ্তর যাদের নিয়ে লেখা হয়েছিল সেই ওয়ার্নার আর হিলি এই পর্বে সরাসরি খুব বেশি উপস্থিত না থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তবে দারোগার দপ্তরে এদের সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তার সাথে মেশানো হয়েছে বিস্তর তথ্য যার বেশিরভাগই হয়তোবা কাহিনীর প্রয়োজনে এবং কল্পনা। এই পর্বে অতীত অংশের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শ্রীযুক্ত শৈলচরণ শান্যাল। ন্যাশনাল থিয়েটারের সাবেক এই অভিনেতা (কিংবা অভিনেত্রী কারণ তিনি নারী চরিত্রেই অভিনয় করতেন) একটি অপ্রীতিকর ঘটনার পর ন্যাশনাল থিয়েটার ছাড়েন, আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেন নাট্যকার হিসেবে। তারিণীচরণের বন্ধু এই শৈলচরণের রচিত হিসেবে এই পর্বে লেখক সংযুক্ত করেছেন সেকালের বটতলা থেকে প্রকাশিত ( আদতে লেখকই লিখেছেন এ কালে বসে তবে ভাষা বা ধরণ সম্পূর্ণ সেকালের মতোই) সম্পূর্ণ একটি প্রহসন বিষম ভূত ও পুষ্পসুন্দরীর পালা। আপাত অশ্লীল এই প্রহসন কিংবা শৈলচরণ লিখিত মেয়েদের স্তনবৃদ্ধির বিজ্ঞাপন হয়তো ততোটা সাদামাটা নয়। শৈলচরণ চরিত্রটি নিশ্চয়ই কাল্পনিক, পুরুষের শরীরেও যার ছিল একটি নারীর মন, কোমল হৃদয়ের এই মানুষটিও জড়িয়ে গিয়েছিল গতপর্বে উল্লিখিত ফ্রিম্যাসন বা তাদের গোপন শাখা জাবুলনদের সাথে।
ফ্রিম্যাসনদের উৎপত্তি হয়েছিল প্রাক খৃষ্টিয় যুগে রোমানদের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ইউরোপে বা বৃটেনেও। সেকালের বৃটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরেও তারা একসময় তাদের দল গঠন করে। শান্ত ফ্রিম্যাসনদের নিয়ে সমস্যা ছিল না, সমস্যা দেখা দিল এই গুপ্ত সমিতির আরও গুপ্ত উপদল জাবুলানদের নিয়ে। সেই ১৮৯৬ সালে ভয়ঙ্কর এক পরিকল্পনা করেছিল জাবুলানরা। প্রায় ১০০ বছর পরে ২০১৮ সালে আবার ফিরে এসেছে তারা সেরকমই কোন ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে। আগের ষড়যন্ত্রে হিলি, ওয়ার্নার বা কল্পনার চরিত্র লখনা বা ল্যানসন যে কিনা গত পর্বেও ছিল এমন অনেকে যেমন জড়িয়ে ছিলেন এবারের মূল পরিকল্পনা তবে কার? গতবার সেই ষড়যন্ত্র কি রুখতে পেরেছিলেন তারিণী, প্রিয়নাথ, সাইগারসন আর গণপতিরা মিলে? সম্ভবত তাই। অথবা অল্পতেই থামিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের। এবারে সেই দায়িত্ব বর্তেছে তারিণীচরণের প্রপৌত্র একালের গোয়েন্দা তুর্বসু রায় বা পুলিশ অফিসার অমিতাভ মুখার্জির উপর (যার আরেকটি পরিচয় এই পর্বে নতুন করে পাওয়া যায়)। গতপর্বে খুন হওয়া স্টেট আর্কাইভের কর্মচারী দেবাশিস গুহ মৃত হয়েও যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন গোটা রহস্যে। আছে তুর্বসুর প্রেমিকা উর্ণা আর আছে নতুন চরিত্র রামানুজ। বৃহন্নলা রামানুজও এই উপন্যাসে জড়িয়ে আছে ভীষণরকম। তার কথা বলতে গিয়েই চলে এসেছে হিজড়া গোষ্ঠীর জীবনাচরন।হিজড়াদের গুরুমা, ঢোল পূজা, তাদের দেবী বহুচেরা, জেনানা, মোগা, নাগিন, ছিন্নি, চিসা এমন সব শব্দের অর্থ। আন্ডারওয়াল্ডের অপরাধমূলক কাজের সাথে হিজড়া গোষ্ঠীর যোগাযোগ কিংবা পকেটমারদের শ্রেণীবিভাগ যেমন হয়ে থাকে কারিগর, সেয়ানা আর টিংবাজে সেরকম দারুণ গবেষণাধর্মী নানা তথ্য।
এই পর্বেও লেখার মাধ্যমে লেখক প্রকাশ করেছেন অতীতের অনেক বিস্মৃত ইতিহাস। বটতলার বই বাজার গড়ে ওঠার কাহিনী, কিংবা ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে কলকাতায় কির্লবান এন্ড কোম্পানী যে কলকাতা শহরের গ্যাস বাতিগুলো বদলে বৈদ্যুতিক বাতি বসিয়েছিল সেই তথ্য অথবা সেরকম সময়েই ভিস্তিদের মাধ্যমে রাস্তায় জল দিয়ে পরিস্কারের বদলে পানির পাইপের ব্যবহার শুরু হয়েছিল এমন সব তথ্য। তাছাড়া ল্যান্ডো ফিটন বা ছ্যাকরা গাড়ির তফাত হাওড়ার সেসময়ের ভাসমান ব্রিজ বা রেল গাড়িতে ইউরোপিয়ান ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বা থার্ড ক্লাস কামরার তফাত এমন সব ঐতিহাসিক তথ্য।
এই খন্ডের নাম নীবারসপ্তক শব্দটিও কৌতুহলোদ্দীপক। প্রিয়নাথের হারিয়ে যাওয়া অপ্রকাশিত ২০৬ তম জার্নাল বা দপ্তরের নাম বলা হচ্ছে নীবারসপ্তক।এই নাম নাকি আবার দেয়া গণপতি চক্রবর্তীর। প্রাচীন ম্যাসনিক দেবতা জাবুলনেরই বাংলা নাম গণপতি দিয়েছিলেন নীবারসপ্তক। তবে এই নীবারসপ্তকেও শেষ হয় নি। হিলির ভূত নামের বস্তুটি আসলে কি ছিল? কি করেই বা আটকানো গিয়েছিলো ১০০ বছরেরও আগের জাবুলনদের ষড়যন্ত্র, এবারেই বা কি হবে সে রহস্যের সমাধান এই খন্ডেও নেই। সেজন্য অপেক্ষা করে থাকতেই হবে পরবর্তী খন্ডের জন্য। সাথে নতুন নতুন রহস্য আর তার সমাধানের জন্য।