১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সংগঠিত হয়েছিল তিন তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান। তিনটি অভ্যুত্থানই যুগান্তকারী ঘটনা, শতাব্দীর অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে ঘটে ব্যাপক ইত্থান-পতন। এমন কি সরকার পরিবর্তনের মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে যায়। ১৫ আগষ্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানগুলোর উপর আমার লেখার সুবিধা হলো, ঐ সময় সৌভাগ্যক্রমে আমি ঢাকার স্টেশন কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত কাছ থেকে ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানগুলো প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। এছাড়া অভ্যুত্থানের প্রধান নায়কদের প্রায় সবার সাথে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও সরাসরি জানাশোনা। ২৫ মে ১৯৯৩ লে. কর্ণেল (অব.) এম.এ.হামিদ পিএসসি।
‘বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাঙালি। সবাই এবার বিজয়ের অংশীদার। ভারতীয় বাহিনী বলে বিজয় আমাদের। মুক্তিবাহিনী বলে আমাদের। মুজিববাহিনী ভাবে আমাদের। সেনাবাহিনী বলে আমাদের। দেশের আনাচে কানাচে ছিটিয়ে পড়া নাম-না-জানা গেরিলারা বলে আমাদের। সেতু পাড়ার গেদু মিয়া কদম আলীরা ভাবে আমাদের। …’
আহ বিজয়! এই চিত্র ৫২ বছর আগের হলেও বর্তমানের সাথে (ক্রেডিট কাড়াকাড়ি!?) কত মিল! 'ক্রাচের কর্নেল' পড়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি–একচেটিয়া শুধু কর্নেল তাহেরকে ভালো প্রমাণ করার জন্য অনেক বিষয় ঘোলাটে রেখে দিয়েছিলেন লেখক। এই বইয়ে জবাব পেয়ে গেলাম।
বইয়ের প্রধান আকর্ষণীয় বিষয় এটাই যে, কর্নেল হামিদ খুব সহজবোধ্য ভাষায় রাজনীতির ব্যাপারগুলো আলোচনা করেছেন। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরকার রাজনীতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে লেখা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। বইটা শেষ করার পর সামরিক বিষয়ে আমার জানার ক্ষুধা বেড়ে গেল...
যেকোন ফিকশনাল মিলিটারি কন্সপিরেসি থ্রিলার উপন্যাসের চেয়েও হাজারগুণ বেশি রোমহর্ষক নাটকীয়তাপূর্ণ দমবন্ধ করা উত্তেজনার টানটান গতিশীলতার রোমাঞ্চকর নিরেট বাস্তব ইতিহাস। আগস্ট-নভেম্বর ১৯৭৫ ও ৭৫-পরবর্তী সময় নিয়ে এতো বছর আমার কেবল একটা ভাসা ভাসা ঝাপসা ধারণাই ছিল। আর এখন যেন একেবারে হাই-ডেফিনিশন স্ক্রিনে ঝকঝকে সিনেমার মতো নিজ চোখেই প্রত্যক্ষ করলাম প্রতিটা ভয়াবহ ঘটনা, প্রতিটা সুররিয়ালিস্টিক পরিস্থিতি, প্রতিটা রাতারাতি দিনে-রাতে ঘটে যাওয়া ক্ষমতার হাতবদল-পাল্টা হাতবদল, প্রতিটা চোখের পলকের উত্থান-পতন, পতন-উত্থানের অবিশ্বাস্য অবাস্তব বাস্তবতা। এতটাই ঝরঝরে সাবলীল লেখনি ও পরিষ্কার স্বচ্ছ উপস্থাপন।
'তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' বইটি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনিতে কর্মরত একজন সেনা অফিসারের লিখিত বই। যিনি(এ সংক্রান্ত দলিলে, সংঘটিত অভ্যুত্থানে তিনি জড়িত হিসেবে তার নাম পাওয়া যায়নি) অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের সাথে হাস্যমুখে অন্তরঙ্গভাবে বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আড্ডায় বসেছিলেন বলে তার বক্তব্য থেকে জানা গেছে। এরপরও তিনি তার বয়ানকে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করেছেন বলে লেখকের দাবী। অত্যন্ত নিবিড় পাঠে যা পক্ষপাত দোষেদুষ্ট এবং বেশকিছু তথ্য আড়ালের প্রবণতা এখানে দেখা গেছে। তবে একটি বিষয়ে লেখককে ধন্যবাদ দিতে হবে, তিনি অভ্যুত্থানে জড়িত সবাইকে আকণ্ঠচিত্তে ক্ষমতালোভী হিসেবে বলতে দ্বিধা করেননি, যা অন্যান্য জড়িত বয়ানকারীদের মধ্যে 'আমি না, ও দোষী' এমন বলবার প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা গেছে। হয়ত তিনি এসবে জড়িত ছিলেন না বলে এমনটা বলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে বন্ধু, কোর্সমেট, 'তুখোড় প্রতিভার' অধিকারী জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি বন্ধুবাৎসল্য কিছুতেই গোপন করতে পারেননি অনেক ক্ষেএ্রেই। বিশেষ কিছু কারণে বইটির প্রতি আমি যথেষ্ট মাত্রায় বিরক্ত।
প্রথমতঃ বইটির ভূমিকাতে লেখক কর্ণেল এম এ হামিদ বয়ান শুরু করেন এভাবে "১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সংঘটিত হয়েছিল তিন তিনটি ভয়াবহ সেনা অভ্যুত্থান। তিনটি অভ্যুত্থানই যুগান্তকারী ঘটনা, শতাব্দীর অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে ঘটে ব্যাপক উত্থান-পতন। এমন কি সরকার পরিবর্তনের মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে যায়।" লেখকের এ বক্তব্যের মধ্যে কিছু শব্দের অভাববোধ করেছি, বাকিতে খুব একটা দ্বিমত নেই। কিন্তু হোঁচট খেতে হয় যখন লেখক বলেন, "সৌভাগ্যবশতঃ তিনটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানই অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।" স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় দেশটির প্রাণ পুরুষ পরিবারসহ তাঁর বিশ্বস্ত চার সঙ্গীর নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করা ঠিক কিভাবে 'সৌভাগ্যের' বিষয় হতে পারে!!! পরবর্তী অভ্যুত্থানগুলোর ক্ষেত্রেও গ্লান্তি, হতাশা আসবার কথা ছিল, সেনাবাহিনির মত একটি সুশৃঙ্খল বাহিনির শৃঙ্খলা ভেঙে গিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ের খোয়াখুয়ি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখাটা সৌভাগ্যের হতে পারে কী?
দ্বিতীয়তঃ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের হত্যা নিশ্চিতের পর একজন রাজনৈতিক নেতাকে খুনীগোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামনে রাখার প্ল্যান করেছিল। সে অনুযায়ী, মেজর রশিদের কাজ ছিল একজন রাজনৈতিক নেতার সন্ধান করা, যে হবে তাদের মতের অনুসারী, এবং সেটি সে করেও, আওয়ামীলীগে ঘাপটি দিয়ে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মোশতাককে খুঁজে আনার মধ্যে দিয়ে। লেখক এখানে বলেছেন, 'খন্দকার মোশতাক শেখ সাহেবের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ছিলেন না।' যেন এই অসন্তুষ্টির কারণেই পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টকে সপরিবারে খুন করা জায়েজ এবং সেই শূন্যতা পূরণ তার জন্য খুব সঠিক। তাও দলনেতা, দেশনেতাদের রক্ত মাড়িয়ে! এই শৃগাল বাংলাদেশ সৃষ্টি হোক সে বিষয়ে কতটা আত্ম নিয়োগ করেছিল? তার সচিব মাহবুব আলম চাষী ছিল সি. আই.এ'র মনোনীত এজেন্ট। এসব তথ্যের বিষয়ে লেখক উদাস। মোশতাক এবং চাষীর মত লোকেরা সি. আই. এ'র হয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভেদ তৈরিতে চেষ্টার ত্র্রুটি রাখেনি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ব্যাপার নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল না মোশতাক। তার স্বপ্নে অন্য পতাকা, অন্য হিসাব সুপ্ত ছিল, যা বিচক্ষণ কিছু মানুষের রাডারে ধরাও পড়েছিল। জনাব হামিদ সেসব জানেন না এটা অবিশ্বাস্য। এছাড়া লেখকের সবচে' গর্হিত কাজটি হলো তিনি এই পাপীষ্ঠার সাথে, বাংলাদেশের জন্য আত্মনিবেদিত নেতা তাজউদ্দীন আহমদের প্রিয় মুজিব ভাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্টিকে সমান্তরালে দাঁড় করিয়েছেন। এ ব্যাপারটি কিছুতেই হজম করা সম্ভব হয়নি।
তৃতীয়তঃ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানসহ বাকি অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কোনো বিদেশী হস্তক্ষেপের প্রমাণ বা উপস্হিতি লেখক মোটামুটি নাকচ করে দেন এবং এ বিষয়ে তার জ্ঞান সীমিত বলে পাশ কাটান। গৎবাঁধা বুলি, সেনাবাহিনির কতিপয় উচ্চাকাঙ্খী সদস্য ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে এবং দেশে চলমান চরম দুর্নীতি প্রতিহত করতে স্বৈরাচারী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে, এর বৃত্ত থেকে তিনিও বের হতে পারেনি বা সচেতনভাবেই সে বৃত্তে থেকেছেন। নইলে সেসময়ে তিনি সেনাবাহিনির যে পোস্টে কর্মরত ছিলেন এবং পরিকল্পনাকারীদের সাথে তার যেরকম ওঠা-বসা ছিল তাতে করে বিদেশি ষড়যন্ত্রের আঁচ বুঝলামই না, বলাটা শুধু হাস্যকর বলে পাশকাটানো যায় না, বরং একে উদ্দেশ্য মূলক ভাবলে ভুল হয় না। রক্ষীবাহিনি প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামান ১৫ আগস্টে দেশে ছিলেন না, এই তথ্যটি জনাব হামিদ দিয়েছেন। কিন্তু তাকে যে পরিকল্পনা করেই দেশ থেকে সরানো হয়েছিল সে তথ্যের বিষয়ে তিনি নিরব থেকেছেন। আর সেটি ছিল সি. আই. এ পরিকল্পনার অংশ।
সি.আই.এ'র ছক মত প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামানকে যুক্তরাস্ট্রে ডিফেন্স সম্পর্কিত ট্রেনিং কোর্সে আমন্ত্রণ করে সেখানে নেয়া হয়। কিন্তু রটনা করা হয় নূরুজ্জামান রক্ষীবাহিনির জন্য ট্যাংক সংগ্রহের জন্য সেখানে যাচ্ছেন। তিনি ১২ আগস্ট যুক্তরাস্ট্���ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। পথে লণ্ডনে খবর পান সপরিবারে শেখ মুজিব খুন হয়েছেন। নূরুজ্জামানের অনুপস্হিতিতে দায়িত্বে ছিল কর্ণেল আবুল হাসান, পাকিস্তান প্রত্যাগত, ভীত এবং আক্রমণের সময় পলাতক(তথ্য উৎস: ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস/লেখক: আবু সাইয়িদ)।
১৫ আগস্টে বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবরটি দেশের জনগণ সর্বপ্রথম জানতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের 'ভোয়া'র মাধ্যমে। ভোর সাড়ে পাঁচটার(উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় আনুমানিক ৫:৫০মিনিট) দিকে ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করা হয়। ঐ দিন ভোর ছটায় ঢাকায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্হার অফিসে রয়টারের একটি ছোট খবর আসে যে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উদৃতি দিয়ে প্রেরিত রয়টারের বার্তাটি টেলিপ্রিন্টার যোগে লণ্ডন হয়ে ঢাকায় পৌঁছায়। স্পষ্টতঃই ধারণা করা যায় ভোয়া ও রয়টারের খবরের মূল উৎস ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। সি.আই এ. মুজিব হত্যার ব্যাপারে এতবেশি উদিগ্ন ও জড়িত ছিল বলেই মুজিব হত্যার খবর অত তাড়াতাড়ি ওয়াশিংটনে পৌঁছে গিয়েছিল। জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর তার প্রশাসনে বসানো (অধিকাংশ) লোকগুলোর কর্ম বৃত্তান্ত ঘাটলেও পেন্টাগনীয় ছকের স্পষ্ট আলামত পাওয়া যায়। এছাড়াও কর্ণেল তাহের তার জবানবন্দীতে বলেছেন, 'দিন কয়েকের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মুজিব হত্যার পেছনে রয়েছে পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্র।' সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত দেশটাকে নতুনভাবে গড়ে তোলাটা যখন খুব জরুরী ছিল, তখন মওলানা ভাসানী 'আমি নতুন পতাকা ওড়াবো'র জিকির, এবং পরে ভুট্টোর আমন্ত্রণে পাকিস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে 'ইসলামী বাংলা' গঠনের ঘোষণাও পাকি ও তার বন্ধুমহলের ষড়যন্ত্রেরই অংশ। দৈনিক হলিডে, দৈনিক ইত্তেফাক ইত্যাদি পত্রিকাগুলো বিদেশি ষড়যন্ত্রীদের মুখোপাত্র হিসেবেই সেসময়ে দেশে সক্রিয় ছিল। মুজিবের পুরো শাসনকাল জুড়েই ছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জান্তিক ষড়যন্ত্রের মুষুল বর্ষণের কাল। অথচ লেখক অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সেনাবাহিনির ভেতরের অসন্তোষ, ব্যক্তিগত আক্রোশ ইত্যাদি বাজারে প্রচলিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছেন(বাস্তব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের জাল খুব কম সেক্টর ছিল, যেখানে তা বিছানো হয়নি) আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নিজের জ্ঞান সীমিত বলে দায় সেরেছেন।
এসব বিষয়ে( চাইলে আরো প্রচুর উদাহরণ টানা যেতো) লেখক এম এ হামিদের পাশ কাটানো ভাবের কারণেই বইটিকে আমার কোনোভাবেই নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠতার খাতিরে লেখা মনে হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫'ই আগষ্ট,৩রা নভেম্বর এবং ৭'ই নভেম্বরের তিন তিনটি অভ্যুত্থানে বদলে যায় বাংলাদেশের ইতিহাস। ইতিহাস সাক্ষী দেয়,অভ্যুত্থানগুলোর পেছনে ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নোংরা খেলা আর ব্যক্তিস্বার্থের এক অনন্য সমন্বয়ের। ইতিহাসের কলঙ্কজনক এই অধ্যায় যেন হার মানায় টানটান কোনো থ্রিলার সিনেমার চিত্রনাট্যকেও।
গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি অভ্যুত্থানের ব্যাপারেই এখানেওখানে কিছু না কিছু পড়া হয়েছে আমার। কিন্তু নিজে উপস্থিত ছিলেন এমন কারো বয়ানে এই প্রথমবার ঘুরে এলাম বীভৎস,ভয়াল সেই দিনগুলো থেকে।
বইটি যেহেতু নন ফিকশন এবং দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অভ্যুত্থানের ইতিহাস নিয়ে লেখা,সেখানে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, লেখক কতটুকু নিরপেক্ষ ছিলেন? এক্ষেত্রে বলা যায়,লেখক সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন নিরপক্ষ থাকার। কিন্তু জিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায়তেই কিনা সচেতন বা অসচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াকে তেমনভাবে সম্পৃক্ত করতে দেখা যায়নি। এছাড়া আরও অনেক সময়ই তিনি একটু বেশিই জিয়াঘেষা ছিলেন।
এইটুকু খামতি ছাড়া এম এ হামিদের এই বইটিকে ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হিসেবেই আখ্যা দেওয়া যায়। যারা ৭৫ এর তিনটি অভ্যুত্থান সম্পর্কে উপস্থিত কারোর চোখে দেখতে চান সেক্ষেত্রে "তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা" হতে পারে প্রথম পছন্দ।
বইটার নিরেট সত্যতা সম্পর্কে জানার সুযোগ না থাকলেও বইটি যে একটা দারুণ একটা বই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের উত্তাল সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বই লিখে থাকলেও এ বইটার স্থান তাদের মধ্যে অনন্য। ◽বইটি একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখেছেন এবং এটাই বইয়ের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট কারণ সে সময়ের ইতিহাস নিয়ে জল ঘোলা থাকলেও জলটা কোন খাত থেকে প্রবাহিত হয়েছে সেটা জানা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ◽বইয়ে প্রতিটি সেনা অভ্যুত্থানের হওয়ার কারণ এবং প্রভাব সম্পর্কে অনেক বিশ্লেষণ এবং যুক্তি দাড় করানো হয়েছে। এতে করে একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে না দেখে আমরা সে সময়ের পরিস্থিতিকে সামান্য আকারে হলেও ঘুরিয়ে দেখার সুযোগ পাই। ◽বইটির লেখক নিজে একজন আর্মি অফিসার থাকার কারণে তিনি অবশ্যই অন্যান্য সব বিষয়ে সাধারণ মানুষ থেকে বেশি জানবেন এবং বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্য এবং যুক্তি দিতে পারবেন বলে ধরে নেয়া যায়। সেজন্য উনি বিভিন্ন আর্মি অফিসার যারা কিনা ঘটনাগুলোর সংঘটনে প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত ছিলেন তাদের যে বর্ণনাগুলো তুলে ধরেছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে যায়।
মুজিব হত্যাকান্ডের সাথে জিয়ার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে লেখকের কোন বক্তব্য দেখলাম না।* এবং আরো কিছু এড়ানো ব্যাপার আছে মনে হল।
অবশ্য রশিদ শুধু মোশতাক নয়, অগাস্টের আগে থেকে আরও কজন আওয়ামী লীগ নেতার সাথে এ নিয়ে কৌশলে আলাপ করে। তাদের অনেকেই শেখ সাহেবের সর্বশেষ রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। জনাব তাজউদ্দীন তাদের অন্যতম।
প্যারা শেষ। আর কিছু নেই। কি কথা হয়েছিল? লেখক কি জানতে চেয়েছিলেন? তাজউদ্দীন আহমেদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
* বিতর্কিত সাংবাদিক Anthony Mascarenhas এর সাথে সাক্ষাৎকারে রশিদ বলেছিল, জিয়াকে তারা অবগত করেছিল এবং সে বলেছিল, তোমরা জুনিয়ররা কিছু করতে চাইলে কর। আমাকে এর সাথে জড়িও না। এখন ঠিক এটা নিয়েই বইয়ের মধ্যে কিছু পেলাম না। তারউপর মুজিবকে ঠিক কে খুন করেছিল সে প্রশ্নের জবাবে ফারুকের উত্তর ছিল, .... ও ব্যাটা একটা মিথ্যাবাদী। আন্ধা হাফিজ এটা ওটা যা-তা গল্প বানিয়েছে। তো লেখক কেন জিয়া সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন না?
নন-ফিকশন বই পড়ে থ্রিলারের অনুভূতি পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। খুব কাছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনা কে দেখেছেন লেখক। কোন মানুষ ই শতভাগ নিরপেক্ষ হতে পারেনা। লেখকেরও নিজ বন্ধু মানে জিয়াউর রহমানের প্রতি সহমর্মিতা লক্ষ করা যায় তবে বন্ধু সমালোচনা করবার মতো সততা লেখকের ছিলো। সব মিলিয়ে বইটির ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান।
ইতিহাস কি কখনো নিরপেক্ষ হয়? আমার মনে হয় না। যারাই ইতিহাস লেখেন তারা মানুষ। আর মানুষ হওয়ার ফল স্বরূপ তারা নির্দিষ্ট কাওকে অচেতনমনেই সমর্থন দিয়ে থাকেন। তারপরেও আমরা ইতিহাস জানতে চেষ্টা করি। বিভিন্ন মানুষের মতামত যাচাই করে আমরাও একটা মতে পৌছাই।
কিছুদিন ধরে পড়ছিলাম লেঃ কর্ণেল (অব.) এম.এ. হামিদের লেখা “তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা”। সত্য কথা বলতে এটা আমার জন্য খুবই লজ্জার ব্যাপার যে আমি এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। যদি অল্প কিছু জেনে থাকি তাহলে যা জেনেছি তার পিছনের খবর জানি না। না জানার প্রধান কারন হতে পারে জানার আগ্রহ না থাকা, এবং জানার আগ্রহ না থাকার কারন হতে পারে এই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা। যখন কিছুটা জানার চেষ্টা করলাম তখন দেখতে পাই যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে যে ইতিহাস জানতে পারি তার কোনোটাই সত্য না। তখন মূলত সঠিক ইতিহাস জানার একটা ইচ্ছা জাগে। তার ফলে কিছু বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি। সেই সুবাদেই আলোচ্য বইটি পড়া। বইটাতে লেখক স্বাধীন বাংলাদেশের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় বর্ণনা করেছেন।
সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়গুলো অনেকে কিছুটা হলেও জানেন। যদি বইয়ের নাম দিয়ে বিশ্লেষন করে বলি তাহলে বলতে হবে যে, নামের প্রথম অংশ অর্থাৎ তিনটি সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপার মোটামুটি অনেকে জানি। যেটা জানার জন্য বইটা পড়বেন সেটা হলো কিছু না বলা কথা।
১৯৭৫ সালে লেখক লেঃ কর্ণেল (অব.) এম.এ. হামিদ ছিলেন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। ফলে সেই বছর ঘটে যাওয়া তিনটি সেনা অভ্যুত্থান তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এবং এর সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তারা তার পরিচিত এবং কাছের মানুষ। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে তার “তুই-তুকারি” সম্পর্ক। তারা ছিলেন কোর্সমেট। এত কাছ থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষন করা এবং নিজে কোনো ঘটনার সাথে জড়িত না থাকার কারনে এই বইটি মোটামুটি নিরপেক্ষ বলা যায়। তবে যেহেতু জেনারেল জিয়া তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলো, তাই হতে পারে বন্ধুর ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় ছিলো। যদিও বইটি পড়ে সেটা মনে হয় না। বরং জেনারেল জিয়ার সাথে সম্পর্কের অবনতি ও তার অনিয়মের কারনেই লেখক সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তবে বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে দেখা যায় যে, শেখ সাহেবকে হত্যার পরিকল্পনাকারীরা দাবী করছে যে জেনারেল জিয়া এ ব্যাপারে সবই জানতেন। তবে লেখক এটার ইংগিত দিলেও কোথাও সরাসরি বলেন নাই।
যারা এর আগে কর্ণেল তাহেরকে নিয়ে লেখা উপন্যাস “ক্রাচের কর্ণেল” পড়েছেন তারা এই বইয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন। কারো কারো অভিযোগ যে, তাকে লেখক এক প্রকার অবজ্ঞা করেছেন। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা না। তবে এখানে ভেবে দেখতে হবে যে, লেখক সেই সময়ের ক্যান্টনমেন্টে যা যা ঘটেছে সেটা লিখেছেন। বাইরের ঘটনায় তেমন একটা দৃষ্টিপাত করেন নাই। তাই কর্ণেল তাহের উহ্য থাকাই স্বাভাবিক। তবে তিনি এ কথা ঠিকই বলেছেন যে। ৭ই নভেম্বরের মূল সংগঠক তাহের। এটা পড়ার পরে বরং আমার মনে হয়েছে যে, কর্ণেল তাহের সম্পর্কে ক্রাচের কর্ণেল উপন্যাসের তুলনায় এই লেখকের পর্যালোচনা অধিক গ্রহনযোগ্য।
লেখক একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বইটি লিখেছেন । কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে । আর পররাষ্ট্রনীতি, বিদেশী গোয়েন্দাদের তৎপরতা সম্পর্কে কিছুটা অজ্ঞ হিসেবে লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেকে । ফলে কে কার কোন দেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো তা বইটিতে পাওয়া যায় না । তবে লেখক এক জায়গায় তার এই দুর্বলতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন ।
রক্তাক্ত ইতিহাস কারো ভালো লাগে না। তাও যদি হয় নিজের দেশের, সেটা অনেক কষ্টের। বইয়ের চরিত্রগুলো কারো কল্পনা থেকে আসে নাই। সবচেয়ে বেশি কষ্টের ব্যাপার হলো, যারা এক সময় নিজের জীবন বিপন্ন করে নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য নায়কের মত ঝাপিয়ে পড়েছেন রণাঙ্গনে; তারাই আবার স্বাধীন দেশে ক্ষমতার লোভে ভিলেনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। বাংলাদেশি হিসেবে এই ইতিহাস বড়োই লজ্জার।
এটা নন-ফিকশন বই, কোনো থ্রিলার উপন্যাস না। বইটা পড়তে পড়তে নিজেকে কয়েকবার এই কথা স্মরণ করাতে হয়েছে। কত কম জানি আমি! বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে লেখা যেকোনো বই-ই পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ইতিহাস কি কখনো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়? তবে এই বইটিতে লেখকের নিরপেক্ষ থাকার প্রয়াস চোখে পড়েছে। আদৌ কতটুকু পেরেছেন তা বুঝতে হলে আমাকে আরও অনেক জানতে হবে, পড়তে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠালাভের পেছনে বড়সড় ভূমিকা ছিলো সেনাবাহিনীর। একাত্তরের যুদ্ধের প্রাক্কালে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নেতৃত্ব প্রদান থেকে শুরু করে স্বাধীন রাষ্ট্রে আইন শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা ও রাষ্ট্র পরিচালনা - সর্বত্রই সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও অবদান ছিলো অপরিসীম। তবে সবসময় যে তারা ত্রাণকর্তারূপেই আবির্ভূত হয়েছে তা নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের বেশ কিছু কালো অধ্যায়ের মূলেও সেনাবাহিনী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলো। তেমন তিনটি সেনা অভ্যুত্থান নিয়েই এই বই।
১৯৭৫ সাল, বাংলাদেশ। বাস্তবতা যখন হার মানিয়েছিলো যেকোনো থ্রিলারকে। খুব কম সময়ের ব্যবধানে একের পর এক ঘটে যায় ১৫ আগষ্টে সেনাবাহিনীর কয়েকজন মেজর কর্তৃক শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড এবং খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতায় আরোহণ; ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ-শাফায়েত জামিলের রক্তপাতহীন বিদ্রোহ, শেখ মুজিব হত্যাকারীদের বিদেশে পলায়ন, জাতীয় চার নেতার জেলহত্যা এবং জেনারেল জিয়ার বন্দী; ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবে খালেদ মোশাররফের পতন, জেনারেল জিয়ার মুক্তি ও ক্ষমতায় আরোহণ এবং কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি। পরবর্তীতে এসব ঘটনাপ্রবাহের ফলস্বরূপ সংঘটিত হয় বিচ্ছিন্ন বেশ কিছু সেনা বিদ্রোহ, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মন্জুরের হত্যাকান্ড এবং জেনারেল এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণ। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর এসেও এই ঘটনাগুলোর অনেক ব্যাখ্যা প্রচলিত, অনেক অলিগলি আমাদের অজানা।
বইয়ের লেখক কর্নেল হামিদ ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য। ১৯৭১ সালে তিনি সপরিবারে করাচীতে অন্তরীণ হন এবং ১৯৭২ সালে পলায়ন করে বাংলাদেশে এসে সেনাবাহিনীতে মিলিটারি সেক্রেটারী হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ এর অস্থির সময়ের পুরোটা জুড়ে তিনি ছিলেন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার এবং সেনানিবাসে অবস্থান করার কারনে প্রতিটি সেনা বিদ্রোহ কাছ থেকে দেখেছেন৷ অভ্যুত্থানগুলোর প্রধান নায়কদের অনেকের সাথেই তার ছিলো ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও সরাসরি জানাশোনা। বিদ্রোহের আগে ও পরে বিভিন্ন সময় তাদের সাথে কাজ করার সুবাদে অজানা অনেক তথ্যই তার সামনে এসেছিলো। তিনি এই ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাগুলো দিয়েই সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করেছেন এই বইতে।
১৫ আগষ্টে মেজররা কেন রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকান্ডের মত ঘৃণিত কাজে লিপ্ত হলেন, কখন কাদের সাথে সম্মিলিত হয়ে ও আলোচনা করে মেজর ফারুক-রশিদ প্ল্যান করলেন, কেনইবা শেখ মুজিবের কাছে কোন সতর্কতা বা সাহায্য প��ছালো না, সেনাবাহিনীর একজন সদস্যও কেন মুভ করলো না সেই রাতে, কেনইবা মুজিবের ঘনিষ্ট সেনা সদস্যরাও তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত ছিলেন না সেসবই আলোচনা করেছেন লেখক। তার আলোচনায় উঠে এসেছে খন্দকার মোশতাকের শাসনকালে বঙ্গভবনের চিত্র, রাষ্ট্র পরিচালনায় ১৫ আগষ্টের হত্যাকারী মেজরদের হস্তক্ষেপ ও সেনানিবাসে সকলের তা নিয়ে বিরূপ মনোভাব। শেখ মুজিবের সাথে একান্তে সাক্ষাৎকারের জের ধরে তিনি তার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করেছেন, আবার ১৯৭২-৭৫ সালে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি, বাকশালের গঠনের মতো বিতর্কিত ঘটনার ভিত্তিতে তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট হওয়ার কারনে অভ্যুত্থান চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে তার খুব কাছে থেকে ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেছেন লেখক। জেনারেল জিয়ার বন্দীদশা, তার মুক্তি, কর্নেল তাহেরের সাথে তার অলিখিত চুক্তি ও পরবর্তীতে রেশারেশি, আশেপাশের ক্ষমতাপিপাসুদের দমন করতে জিয়ার ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা করেছেন তার লেখায়।
বইটা যথেষ্ট নিউট্রাল দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। একাধিক সোর্স থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে অভ্যুত্থানগুলোর সময়কালের মিনিট বাই মিনিট পর্যালোচনা করে লেখক প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর লেখায়। ইতিহাস পড়ার বড় সমস্যা হলো এতো তথ্যের ভিড়ে কাটখোট্টা লেখা ও বর্ণনায় হারিয়ে যাওয়া। সেদিক থেকে 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' লেখনশৈলী দিয়ে যেকোনো সুচিন্তিত উপন্যাসকে টেক্কা দিতে সক্ষম।
সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশ। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে বাঙালির চিরায়ত 'খাই খাই' স্বভাব। যে যেভাবে পারছে দাবী দাওয়া নিয়ে উপস্থিত হয়ে এই নাই, সেই নাই নিয়ে অনুযোগ করছে জাতির জনকের কাছে।কেউ করছে কান ভারী, কেউ চাইছে ক্ষমতা আর নেতৃত্ব।টাইম ট্রাভেল করতে পারলে হয়তো সময়টাকে একটু টিউন করে দেখতে পাওয়া যেতো চিন্তামগ্ন জাতির জনকের গা এলিয়ে দিয়ে সোফার উপর আধশোয়া আর দীর্ঘশ্বাসের চিত্র। অন্যদিকে দুর্নীতির পরাকাষ্ঠা ও চেপে বসেছে দেশের প্রত্যেকটা অফিস আদালত, বর্ডার আর আনাচে কানাচে। কিছু ভুল পদক্ষেপ, কিছু অদূরদর্শিতা, কিছু কানকথা আর কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরবর্তী ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই ৭৫ এ পরপর তিনটি অভ্যুত্থান। সাথে কিছু কিংবদন্তি আর বীরদের রক্ত। কিন্তু নাটের গুরুরা ঠিকই কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে গেছে। এই হলো গে মূল কথা। খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বলতে গেলে বইটি হাইলি রিকমেন্ড করছি পড়ার এবং এটা মাস্ট রিড বলে মনে হচ্ছে। প্রত্যেকটা অভ্যুত্থানের পূর্বাপর পরিস্থিতি এবং ঘটনা বিশ্লেষণ করে লেখক একদম বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন সেই সাথে করেছেন কারণ বিশ্লেষণ। সুতরাং পড়ে দেখা উচিত। হ্যাপি রিডিং 💙
এত রোমাঞ্চ তো থ্রিলার পড়েও পাইনা। প্রায় সারাদিন ধরে বইটা পড়লাম। চিরকাল নেতা আর আমলাদের লোভের কথা জেনে আসছি, সেনাবাহিনীর অনেক হর্তাকর্তারাও যে এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিয়ে আসছে (তাও যাদের অনেকেই কিনা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা!) তা জানতাম না।
স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য সবে দূরের স্বচ্ছ আকাশে আভা ছড়াতে শুরু করেছে। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু কে জানত এমন স্বচ্ছ দুনির্বার আকাশেও নিমেষেই বয়ে আসতে পারে মেঘের ভয়াল কালো থাবা। চারদিকে হঠাৎ-ই ঘনিয়ে আসে অচেনা এক দুর্যোগ।
-তোরা কী চাস, তোরা কী করতে চাস?
-আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
-কী! তোদের এত সাহস! পাকিস্তান আর্মি আমাকে মারতে পারেনি। আমি জাতির পিতা। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।
অতঃপর আচমকাই ঝড়! বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। শুধু তাকে আক্রমণ করেই ক্ষান্তি হয়নি, সেদিন রচনা হয় লাশের স্তূপ।
বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ এভাবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট, ৩ নভেম্বর, ও ৭ নভেম্বর একের পর এক ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়ঙ্কর তিন-তিনটি অভ্যুত্থান; নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। পাল্টে যায় দেশের ইতিহাস, সামরিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঘটে ব্যাপক উত্থান-পতন। দুর্ভাগা জাতি হজম করে তিনটি রক্তাক্ত অধ্যায়। কিন্তু ‘বিহ্যাইন্ড দ্য স্ক্রিন’-এ কী ঘটেছে জাতি জানে না। সেসব নেপথ্যের অজানা কথাই উঠে এসেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একজন স্টেশন কমান্ডার লে: কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদ-এর কলমে। বলছি ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’র কথা।
‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান’— এটুকু সবার জানা। এই অংশটুকু নিয়ে অনায়াসে অনেকগুলো বই পড়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু যেটি অন্য কেউ লিখেননি, বা জানেন না সেটি হচ্ছে ‘কিছু না বলা কথা’। হ্যাঁ, ঠিক এই অংশটির জন্যই আপনাকে পড়তে হবে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি।
১৯৯৩ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তখনই বইটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যে বইটির নবম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় সংসদ বিতর্ক, এবং মুজিব হত্যা মামলায়ও বইটি রেফারেন্স হিসেবে আলোচনায় এসেছে।
যারা এই অভ্যুত্থানগুলো নিয়ে লিখেছেন তাদের বেশিরভাগই কারো কাছ থেকে শুনে কিংবা কোনো সেকেন্ডারি সোর্সের উপর ভিত্তি করে ঘটনা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ঠিক এই জায়গায় লে: কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদের ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি ব্যতিক্রম। অভ্যুত্থানগুলোর সময় লেখক ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার। যার সুবাদে তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন পরপর ঘটে যাওয়া তিন-তিনটি অভ্যুত্থান। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি ঘটনারই সাক্ষী হয়েছেন।
যারা অভ্যুত্থানে সরাসরি জড়িত ছিলেন কিংবা পেছন থেকে ইন্ধন যুগিয়েছেন সকলেই ছিল কোনো না কোনোভাবে লেখকের পূর্ব পরিচিত, বন্ধু, কোর্সমেট। যার ফলে ঘটনাগুলো খুব কাছে থেকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন লেখক। তিনি তার নিজস্ব জায়গা থেকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বইটি রচনার চেষ্টা করেছেন। বন্ধু বা পূর্ব পরিচিত হওয়ার খাতিরে কোথাও কোনো তথ্য উপস্থাপনে কৃপণতা বা ঘটনা আড়ালের চেষ্টা দেখা যায়নি বইটিতে। এজন্যই হয়তো পাঠকসমাজে বইটি পেয়েছে দারুণ জনপ্রিয়তা। এবার আসা যাক বইটিতে আসলে কী আছে। তখন আবার উল্টো প্রশ্নটি চলে আসে বইটিতে কী নেই? যেকোনো ফিকশনাল থ্রিলার ��পন্যাসে চেয়েও অনেক বেশি টানটান উত্তেজনাপূর্ণ রোমহর্ষক বর্ণনা এবং ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো এক নির্মম ইতিহাস। যে ইতিহাস পাল্টে দেয় দেশের ভবিষ্যৎ, পাল্টে দেয় দেশের রাজনীতি।
বইটির শুরু ১৯৭১-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো দিয়ে। অতিদ্রুত ঘটনা পৌঁছে যাবে ‘৭৪-এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ধূমায়িত অসন্তোষে, এবং মোড় নেবে সেই ‘৭৫-এর ভয়াল কালরাত্রি ও ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্তের দিকে। অতঃপর একেরপর এক ষড়যন্ত্রের কালো জাল আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
১৫ আগস্টের মূল হোতা ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের মেজর ফারুক ও টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ। তাদের মধ্যে ছিল পারিবারিক ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। এদিকে মেজর ফারুক এত জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও এমন দুঃসাহসিকতার প্রসঙ্গক্রমে লেখক লিখেছেন,
তবে অনেকের প্রশ্ন, ফারুকের মতো জুনিয়র অফিসারের শক্তির উৎস ছিল কোথায়? জবাব���া সবার জানা নেই। তার সকল শক্তির উৎস ছিল বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক সম্পর্কেও ফারুক ছিল খালেদের ভাগিনা।
এমনই নানান সম্পর্কের সমীকরণ আর রহস্যের জট খুলে এগিয়ে চলেছে ঘটনা। ১৫ আগস্ট রাতে কে ছিল নেপথ্যে, কারা ছিল মৌন সম্মতিতে আর কাদের তৎপরতায় হয়েছে এই অভ্যুত্থান; চিফ অব স্টাফ শফিউল্লাহ, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান, কর্নেল শাফায়েত জামিল, খন্দকার মোশাররফসহ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভূমিকা কেমন ছিল সরাসরি উঠে এসেছে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’-বইটিতে। জানা যাবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সরাসরি বক্তব্য থেকে।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরে তোলা ছবি। (বাঁ থেকে) শেখ কামাল, শেখ রেহানা, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কোলে শেখ রাসেল, বেগম মুজিব, শেখ জামাল ও শেখ হাসিনা; পরবর্তীতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নানান নাটকীয়তা, চিফ অব স্টাফ হাইজ্যাক ও পরে গদি দখল, ৪৬ বিগ্রেডের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা, মোশতাকের ট্যাংক মিছিল ও শপথ গ্রহণ, রাতের আঁধারে লাশ দাফনের চেষ্টা, বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপের আশঙ্কা এমনই বিভিন্ন উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা পাঠকের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক জন্মাতে যথেষ্ট বলেই মনে হয়।
বঙ্গবন্ধুকে কি আসলেই বাঁচানো যেত না? বঙ্গভবনে আক্রমণ জানার পরও কেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্য মুভ করেনি? কিছু ঐচ্ছিক সময় বিভ্রাটের কারণ কী? ফারুক-রশিদের সাফল্যের পেছনে কী ছিল? বইটিতে এমনই নানান অজানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক।
অতঃপর ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। ঘটে যায় অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, জিয়াউর রহমানের গৃহবন্দী, বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের উত্থান-পতন, জেলহত্যার ভয়াল রাত্রি, মেজরদের দেশত্যাগ, এবং দিনশেষে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সম্পর্কে লেখক বইয়ে মন্তব্য করেছেন এভাবে,
৩ নভেম্বরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, ওটার প্রস্তুতি হয়েছিল ঘটা করে প্রায় সবাইকে জানিয়েই। কিন্তু এসেছিল অতি নীরবে, নিঃশব্দে, মধ্যরাতে। একটি বুলেটও ফায়ার হয়নি, একটি হত্যাকাণ্ডও ঘটেনি। ভোরবেলা সবাই ঘুম থেকে উঠে জানতে পারে, আর্মির ক্ষমতা বদল হয়েছে। জিয়া আর চীফ অব স্টাফ নেই। তিনি বন্দি। খালেদ মোশাররফ নতুন অধিনায়ক।
৭ নভেম্বর, ১৯৭৫। দিন গড়িয়ে রাত্রি নামার সাথে সাথে বেজে উঠলো আরেকটি অভ্যুত্থানের দামামা। আবারো উৎপত্তিস্থল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। খালেদ মোশাররফ হত্যা, সেপাই-জনতার বিপ্লব, জিয়ার গৃহ-মুক্তি, জিয়া-তাহেরের ঠাণ্ডা লড়াই; অতঃপর সব মিলিয়ে এক নাটকীয় রক্তাক্ত রাত। বিপ্লবটা সাধারণ সেপাইদের হলেও কার্যত একচ্ছত্র ক্ষমতার আধিপত্য লাভ করেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
৭ নভেম্বর, জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন সাধারণ সৈনিকরা; বলা বাহুল্য, লেখক ও জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কোর্সমেট ছিলেন। তাদের সম্পর্কটাও অনেকটা তুই-তুকারির। এতদ্বসত্ত্বেও লেখকের সাবলীলভাবে ঘটনা বর্ণনা এবং বিশ্লেষণে কোনো ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়নি। নিরপেক্ষ এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেষ্টা করেছেন প্রতিটি ঘটনা। কখনো জিয়ার বুদ্ধিমত্তার তারিফ করেছেন, আবার কখনো বা ঘটনার নিরপেক্ষতার প্রয়োজনে হয়েছেন সমালোচকও। এমনকি পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের সাথে মনোমালিন্যতার সূত্র ধরেই লেখক সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন।
অতঃপর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের আগমন এবং আকস্মিক পদন্নোতি নিয়ে লেখক লিখেছেন,
এরশাদ ছিলেন তখন সাধারণ সৈনিকদের কাছে একেবারেই একটি ‘অজ্ঞাত’ নাম। অথচ জিয়ার বদৌলতে তিনি একলাফে সামনের কাতারে। জিয়ার এই ‘সাধাসিধে-নম্র বেচারা’ মানুষটিই দেখতে দেখতে একদিন পূর্ণ ব্যাঘ্রে পরিণত হয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের সাথে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ; এরশাদ কতটুকু পূর্ণ ব্যাঘ্রে পরিণত হতে পেরেছিল, তা বোধ হয় নব্বইয়ের দশকের রাজনীতিতে চোখ রাখলে পাঠকই ভালো অনুভব করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, ‘৮১-এর বিদ্রোহে জিয়ার নিহত হওয়ার পেছনের কলকাঠি নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন লেখক, এসেছে বিশ্লেষণও। এভাবেই তিন-তিনটি অভ্যুত্থান রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল, কে ছিল নেপথ্যে জানতে হলেও ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি অসাধারণ উৎস।
এদিকে বইটি পাঠক জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। লেখক এম. এ. হামিদ বইটি লিখেছেন একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আর বৈদেশিক গোয়েন্দাদের তৎপরতা কেমন ছিল, সেই দিকগুলো বেশ অস্পষ্টই রয়ে গেছে তার লেখায়। লেখক অবশ্য বইটিতে অকপটে স্বীকারও করেছেন তার সেই সীমাবদ্ধতার কথা।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে অন্তত এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, লেখক নিখুঁতভাবে নিরপেক্ষ যে বিবরণ দিয়েছেন, তা পড়তে পড়তে প্রতিটি ভয়াবহ ঘটনা, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, রাতারাতি ক্ষমতার হাতবদল, এবং প্রতিটি উত্থান-পতনের অধ্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে পাঠক। কী চমৎকার, স্বচ্ছ উপস্থাপন, ও সাবলীল লিখন! ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ও ৭ নভেম্বরের প্রতিটি ঘটনা ছিল অভাবনীয়, নাটকীয় ও রোমহর্ষক। সেসব রুদ্ধশ্বাস ঘটনা, নেপথ্যে কাহিনী আর ‘কিছু না বলা কথা’ জানতে আগ্রহী হলে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি আপনার জন্যই।
বই: তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা || লেখক: লে: কর্নেল (অব.) এম .এ. হামিদ, পিএসসি
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, ৩রা নভেম্বর ও ৭ই নভেম্বরে সংঘটিত হওয়া তিনটি সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমরা আমাদের দেশের ইতিহাস নিয়ে আসলে কতটুকু জানি! এই বই পড়ার আগে এই অভ্যুত্থান গুলো সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানতাম। বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া অভ্যুত্থান গুলো সম্পর্কে জানা সবার জন্যই জরুরি। খালেদ মোশাররফ,মেজর হায়দারের মতো মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়কদের এমন পরিণতি সত্যিই কষ্টদায়ক। ব্যক্তিস্বার্থ আর ক্ষমতার লোভের জন্য মানুষ কি না করতে পারে!
সেনা অফিসারদের বই লেখার ঘটনা নতুন না । কিন্তু তাঁদের বইয়ের একটা কমন বিষয় থাকে নিজেকে বড় বা বীর হিসেবে দেখানোর । আমার কাছে মনে হয়েছে, অন্তত বইয়ে এই জিনিস নেই । কোন কোন ক্ষেত্রে লেখকের নিজের দুর্বলতাও উঠে এসেছে । যেমন, মেজর ডালিমের বন্দুক তাক করা দেখে পিলারের আড়ালে নিজেকে লুকানো ।
তবে এম এ হামিদ যে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন , এটা বই পড়লেই বুঝা যায় । বি���েষ করে শেখ মুজিবের হত্যাকারি কে এটা তিনি যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন , সেটা অসাধারন । এই বইয়ের আরেকটা বৈশিষ্ট যে , ১৫ আগস্টের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অনেক বয়ান পাওয়া যাবে । তাঁদের সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এম এ হামিদ এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করেন । সেটাও আমাদের ইতিহাসের অংশ ।
শেষে বলব, যারা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে যায়, তাঁদের জন্য অবশ্যই পাঠ্য এই বই ।
একটি অসাধারণ বই, স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ অনুধাবনের জন্য অবশ্য পাঠ্য। যদিও লেখক সেনাবাহিনীতে তার কোর্সমেট জিয়াউর রহমানের প্রতি স্নেহ সম্পূর্ণ লুকোতে পারেন নি, তবে তার দোষ, গুন, হঠকারিতা বর্ণনা করেছেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবেই। তিনি পরিস্কারভাবেই বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনার তথ্য জিয়াউর রহমান সহ অনেক উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাই জানতো। এই সামান্য স্নেহ প্রদর্শন মানবিক দূর্বলতা ধরে নিলে বইটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
১৫ ই আগস্ট, ৩ রা নভেম্বর, ৭ ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের উপর লেখা " তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা" বইটা। লেখক এই তিন অভ্যুত্থানের অনেকটা প্রত্যক্ষদর্শী। খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন হত্যাকান্ড। ক্ষমতার টানা পোড়েন আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। যা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বইটিতে।
১৫ই আগস্ট সকাল ছটার রেডিও বাংলাদেশ অধিবেশন শুরু হতেই দেশবাসী শুনতে পেলেন মেজর ডালিমের কণ্ঠ। তবে ডালিম তখন মেজর ছিলেন না তাকে মেজরের পদ থেকে বহিস্কৃত করা হয়েছে বেশ আগেই।
ডালিমের কণ্ঠে দেশবাসী শুনলো স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।
ফারুকের পরিকল্পনায় রশিদ, মেজর হুদা ও মেজর নূর এর সহোযোগিতায় ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবের পরিবার।
অভ্যুত্থানের মূল নেতা মেজর ফারুক রহমান টার্গেট আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিয়েই খালাস। অন্যদিকে বুদ্ধিমান ধীরস্থির রশিদ দেশের স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে গায়ের ঘাম ঝরিয়ে ফেলছেন। আর ফারুক তখন তার পিছনে একডজন ট্যাংক নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ান।
এ অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর মাত্র দুটি ইউনিটের মাত্র ৯০০ সৈনিক এতে অংশগ্রহণ করেন তবে কোনকিছু না বুঝেই। অন্যকোন সিনিয়র অফিসারও এতে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তবে এটা ফারুক রশিদের একক অভিযান ছিলো না এটা। তাদের পেছনে বড় র ্যাংকের কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ জুগিয়েছেন।
১৫ ই আগস্টের অভ্যুত্থান ছিলো অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে।
শেখ মুজিবকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসানো হলো খন্দকার মোশতাকে এবং তিনি বেশ দক্ষতার সাথে দৃঢ় হস্তে দেশ শাসন করতে লাগলেন। তবে সে শাসন কাল টিকলো মাত্র ৮০ দিন।
৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালের মধ্যরাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সংঘটিত হলো এক রক্তপাতহীন নীরব অভ্যুত্থান। রক্তপাত হলোনা ঠিকই তবে আশঙ্কা এবং নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ কোথাও মাথা তুলে ভবিষ্যতে দাঁড়াক এটা চাননি। সে কারনে ৩রা নভেম্বরের মধ্যরাতে জেলের ভিতরেই খুন করা হয় চার নেতাকে। যা আমাদের জাতীর জন্য খুবই লজ্জাজনক।
গৃহবন্দি হলেন জিয়া এবং সব ক্ষমতা নিজের করে নিতে খালেদ মোশাররফ রক্তপাত ঘটালেন না তবে কিছু কৌশন অবলম্বন করলেন।
তবে তিনি চাননি চার নেতার হত্যা। চার নেতার হত্যার খবর পাওয়ার আগেই ফারুক রশিদের প্লেন আকাশে উড়ান দিয়েছে। এটা নিয়ে আর কোন কথা বলতে পারলেন না খালেদ মোশাররফ।
মাত্র ৫ দিন স্থায়ী হয়েছিলো ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের রক্তপাতহীন ৩ রা নভেম্বরের অভ্যুত্থান।
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালে রাত বারোটার সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হলো ঐতিহাসিক সিপাই- বিদ্রোহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।
চারদিক থেকে হাজার হাজার বুলেটের শব্দ।
৭ই নভেম্বর সকাল বেলা জিয়া বন্দী দশা থেকে মুক্তি পান। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়ার মুক্তির জন্য অভ্যুত্থানে জড়িত হন, তাহেরের সাথে জিয়ার একটা গোপন ১২ দফা ভিত্তিক পূর্ব সমঝোতার ভিত্তিতে। কিন্তু মুক্তি পাবার পর জিয়া এ দাবি পূরণে অস্বীকার করে। শুরু হয় সিপাহি দের দ্বারা অফিসারদের হত্যা ও লাঞ্ছিত হবার পালা। চারিদিকে হত্যা।
৭তারিখ সকালে জিয়া ছিলেন বিজয়ী বীর, জনপ্রিয় ব্যক্তি। ৮তারিখ সকালে তিনি সমস্যা জর্জরিত পরাজিত এক সম্রাট।
নিজের সাহস ও কূটবুদ্ধির দ্বারা জিয়া এ বিদ্রোহ দমন করেন। আর নিজেকে সৈনিকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। সৈনিকদের দাবি না রাখার কারনে তারপর আরও ১৮ টি ছোট- বড়ো সেনা বিদ্রোহ হয়।
তবে তিনি অকাতরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন সৈনিক দের। এমন কি তিনি তাহেরকেও ফাঁসিতে ঝুলাতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি।
ইতিহাস ক্ষমা করলো না প্রিয় জেনারেল কেও। অবশেষে সর্বশেষ বিদ্রোহে প্রাণ হারালেন জেনারেল জিয়া ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে।
"তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা" বইটিতে ১৫ ই আগস্ট, ৩ রা নভেম্বর ও ৭নভেম্বরের ঘটনাকে তুলে এনে তার বিশ্লেষণ করেছেন। কিছু ঘটনা লেখকের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া, কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জেনে, আবার ঘটনা সাথে যারা জড়িত তাদের থেকে জেনে লেখক তুলে ধরেছেন বইটিতে।
অনেক বির্তকিত প্রশ্নের সমাধান আছে আবার কিছু ঘটনার বিশ্লেষনে দেখা গেছে প্রকৃত সত্যটা অামাদের অজানাই রয়ে গেছে। অনেক সত্য তুলো এনেছেন লেখক যা জানটা খুবই জরুরী। তাছাড়া তিনটি অভ্যুত্থানের ঘটনা গুলোকে তিনি নানা দিক থেকে বিশ্লেষনও করেছেন সুন্দর ভাবে। কিছু মানুষের অবহেলা ও স্বার্থের কারনে আজ অনেক কিছু আমরা হারিয়েছি, এমনটা না ও হতে পারতো
লেখক যেখানে প্রত্যক্ষদর্শী সেখানে আগের কিছু বইয়ের ঘটনা বিভ্রান্তিকর লেগেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির খুব কাছ থেকে দেখা একজন উচ্চপদস্থ লোকের বয়ান। ১৯৭৫ সাল এদেশের শৈশবকালীন খুব দুর্যোগকালীন সময়। একের পর এক ক্ষমতার হাতবদল। ষড়যন্ত্র আর ধোঁকাবাজি। ক্ষমতার লোভ আর জিঘাংসা। হঠকারিতা আর বিবেকহীনতা। সব মিলিয়ে দেশের ক্রান্তিকালীন সময়। এমন সময়ে উঠে আসে সর্বনন্দিত নায়ক অথবা সর্বনিন্দিত খলনায়ক। সেই সময়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারক হয়ে পড়ে দেশের সেনাবাহিনী। সেখানকারই একজন আপাত অবহেলিত ও বন্ধুবৎসল এক লেফট্যানেন্ট কর্নেলের জবানিতে আমরা পাই সে ভয়াবহ বছরটির ৫ মাসের চাঞ্চল্যকর ঘটনা। আর সেই সাথে এর সাথে জড়িত নানা ব্যক্তির ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলাপন ও লেখকের কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, বেশ কিছ���খানি তৃতীয় পক্ষ থেকে দেখা কাহিনীর বর্ণনা। সেই সময় নিয়ে আগ্রহ থাকলে অবশ্য পাঠ্য এবং মেমোয়ার ধর্মী লেখা পছন্দ হলে অতিশয় উপভোগ্য।
'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে ঠিক কতটুকু জানি, বইটা পড়ার পর থেকে এই চিন্তায় বেশ বড়সড় ধাক্কা খেয়ে বসে আছি আসলে। বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান বেশ কয়েকবার কয়েক জায়গায় হয়। যেগুলো নিয়ে আমরা পাঠ্যবই কিংবা পত্রপত্রিকায় খুব একটা পড়িনি বা পাইনি। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাই এই দেশে একমাত্র বড় সেনা বিদ্রোহ নয়! ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট, ৩নভেম্বর, ৭নভেম্বর এর যে ডিটেইলস ঘটনা পড়লাম, তা সত্যিকার অর্থেই অভাবনীয় নারকীয়, লোমহর্ষক, ভয়ংকর। আমি রুদ্ধশ্বাসে প্রতিটা পাতা পড়েছি। এই ঘটনা গুলো আমার দেশের?! হার মানায় গল্প, কাহিনি কিংবা সিনেমা কেও। ক্ষমতার দ্বন্দে মানুষ কি না করতে পারে। লে. কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদ, পি.এস.সি তার দৃষ্টিতে সেসময়ের কাহিনী গুলো বেশ সুচারুভাবেই বর্ণণা করেছেন। বইটি সত্যিকার অর্থেই আমাকে কতটুকু জানি সেদিকে চোখে আঙুল তুলে প্রশ্ন করেছে।
এই বই আরো আগে পড়া উচিত ছিলো। কেন পড়লাম না! বইয়ের লেখা খুবই প্রাঞ্জল। মনে হচ্ছিল থ্রিলার বই পড়ছি, বইয়ের উপর একটা মুভি বানাতে পারলে চমৎকার মুভি হবে।
5 of 5 stars to তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা by এম এ হামিদ https://t.co/u3blVP06lX বইটার একটা রিভিউ লিখতে ইচ্ছে হল বইটির ডাউনলোড লিঙ্ক ---> https://drive.google.com/file/d/0B5TI... বইটি পড়ানোর জন্য প্রিয় বন্ধু Aniচানকে অনেক ধন্যবাদ লিঙ্ক দিয়ে সহায়তা করার জন্য । :)
বইটির লেখক কর্নেল (অব:) এম এ হামিদ, পিএসসি; জিয়ার কোর্সমেট, বন্ধু, তুই-তোকারি সম্পর্ক। প্রথম দেখাতেই বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার পরিচয় পান । আটকা ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের সময় ।
মুক্তিযুদ্ধ ও অব্যবহিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, অর্থনীতির সামগ্রিক মূল্যায়ন ও কারণ এখানে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে বেশ নিরপেক্ষভাবে । ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ সঠিকভাবে না জানলে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।
এই বইটির পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', হুমায়ূন আহমেদের 'দেয়াল', 'জোৎস্না ও জননীর গল্প', হুমায়ূন আজাদের 'পাক সাদ জমিন সাদ বাদ', শহীদ জননী জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি', সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের 'মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র' ও 'সেকাল একাল'--- বইগুলো পড়ার অনুরোধ করব সঠিক ইতিহাস জানার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে যার অনেকগুলোই বিভ্রান্তিকর, বায়াসড ও পক্ষপাতদুষ্ট ।
বইটি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে --- আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অবিসংবাদিত সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালেই বুঝতে পারেন, বাংলার মানুষের অধিকার লাভের জন্য দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র কখনোই সঠিক ঠিকানা নয় । স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই তিনি সকল আন্দোলন ও ৬ দফা দাবি পেশ করেন । পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র তিনিই মনের গভীর অন্তরালে বাঙালী জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই তিনি সাধারণ গণমানুষের এত প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন । যা ই হোক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষ, বাঙালী পল্টন, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালী অফিসার-সৈন্যরা বিভিন্নজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য-ধারণা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, বিশেষত সেনাবাহিনীর সদস্যরা । কারো ধারণা ছিল '৭০ এর নির্বাচনে জয়ী বাঙালী প্রতিনিধিদের মসনদে বসানোর জন্য তারা এ যুদ্ধ করছে । কেউ মনে করেছিল বঞ্চনার শিকার থেকে মুক্ত হতে এই যুদ্ধ । আবার কেউ স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা হবার খায়েশের স্বপ্নে বিভোর হয়েও যুদ্ধ করেন । কেউ ছিলেন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। মোটামুটি একেকজনের ধারণা একেক রকম ছিল । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলেন। সেনাবাহিনীতে তখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব । হালুয়া-রুটির ভাগবাটয়ারায় ব্যস্ত । ক্ষমতার লোভে অফিসাররা উন্মত্ত । দেশ স্বাধীনের পর চক্রান্তকারী পাকিস্তানী শক্তি, তাদের দোসর-দালাল, মুসলিম লিগের সদস্যরা, জামায়তে ইসলামীর সদস্যরা নিষ্ক্রিয় থাকেনি । কিছু বিচার চলতে থাকে । বলে রাখি, সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারটা অনেকে বিভ্রান্ত হন । আসলে সাধারণ ক্ষমা কিছু সাধারণ অপরাধে যুক্ত যুদ্ধাপরাধীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল । কারণ ১৬ ডিসেম্বরের পরে অনেকেই নিজের ভুল বুঝতে পারেন, অনেকে না বুঝে বিভ্রান্ত হয়ে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেন । সর্বোপরি সব বাঙ্গালীর আস্থা অর্জন ও ভালবাসার দরুণ শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন কিছু সাধারণ বাঙালীর জন্য । গুরুতর অপরাধীদের দালাল আইনে বিচার চলমান ছিল যা পরে জিয়াউর রহমান বাতিল করেন । দেশি-বিদেশী চক্রান্তে বাংলাদেশকে সত্যিকারের তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করার অপপ্রয়াস চলতে থাকে । চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্র থেকে রিলিফের মালবাহী মাদারভেসেল(বড় জাহাজ) যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের তৎপরতায় ফিরিয়ে নেয়া হয় । বন্ধ করে দেয়া হয় সব সাহায্য-সহযোগীতা । সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে চলতে থাকে ষড়যন্ত্র-অসহযোগীতা । চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একত্রে বিরুদ্ধে এসে দাঁড়ায় । পাশে ছিল কেবল তখনকার দুর্বল অর্থনীতির ভারত ও বৃহৎ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন যা ছিল অপ্রতুল । বলে রাখা ভাল, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিশ্বাস অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ভারতীয় সেনাদের সরিয়ে নিতে বলেন । ভারতের সেনারা যাবার সময় কিছু অন্যায়ও করে বসে । সেনানিবাসের কিছু সম্পদ তারা সাথে নিয়ে যায় যা বাঙালী সেনারা মেনে নিতে পারেনি । মূলত ভারতীয় বাহিনী এখানে অবস্থান করছিল একটি নতুন সুশৃঙ্খল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে দেয়ার লক্ষ্যে । যা পাকিস্তান আর্মির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালী অফিসারদের অপমানের কারণ ছিল । দীর্ঘদিনের ভারত-পাক বিদ্বেষ তাদের মনেও দানা বেঁধে ছিল । অতঃপর যাবার সময় ক্যান্টনমেন্টের সম্পদ নিয়ে যাওয়ায় তারা আরো ভারতবিদ্বেষী হয়ে ওঠে যা পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্যু ও ইসলামী তোষণের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায় । ভারতীর বাহিনী অপমান না কি কারণে এ অকাজটি করেছিল তা জানা নেই । তারপর, চলতে থাকে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা । বলে, অভাবে স্বভাব নষ্ট। সারাদেশে তৃণমূল নেতাদের দ্বারা চলে রিলিফের মাল লুটপাট । রিলিফ হিসেবে যা ও পাওয়া গিয়েছিল বন্ধুপ্রতিম অল্প কিছু দেশের কাছ থেকে, তাও যেতে লাগলো এসব চোরের পেটে । বঙ্গবন্ধু সংসদ��� আক্ষেপ করে তাই বলেছিলেন, " সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাইছি একটা চোরের খনি।" অর্থাৎ তিনিও এসব নিয়ে বিব্রত ছিলেন । উপায়ন্তর না দেখে সেনা-বিডিআর নিয়োগ দেন চোরাচালান-লুটপাট প্রতিরোধে । সেখানে সেনাবাহিনীর সাথে তৃণমূলের লাগে দ্বন্দ্ব । মোটামুটি স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকে অজনপ্রিয় করার সকল প্রচেষ্টা চলতে থাকে সবার অলক্ষ্যে, দেশি-বিদেশী চক্রান্তে । তারা সফলও হয় '৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে । মূলত এটা ছিল কৃত্তিমভাবে সৃষ্ট । ভাবগতি ভাল না দেখে নিরুপায় হয়ে অনেক ভাবতে লাগলেন শেখ মুজিব । মনে রাখতে হবে, তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি এখনকার মত ছিল না । ছিল ২ ভাগে বিভক্ত । পুঁজিবাদী মার্কিন, সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত । আর পুরো ভারতজুড়ে সক্রিয় ছিল চীনপন্থী মাওবাদী নকশালরা, এদেশে যাদের প্রতিনিধি ছিল সর্বহারা, পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি, এমএল জনযুদ্ধ (যারা নিজেদের Marxist বলে দাবি করতো যদিও) । এদের সবাইকে অস্ত্র সাপ্লাই দিত চীন । এদেরই মুখপাত্র হয়ে ওঠে জাসদ (রব-জলিল-তাহের) । ছিল ২ টি পক্ষ- ইসলামপন্থি পাকিস্থানপন্থীরা আর এই বামেরা যারা '৭৫ এর আগস্টের অভ্যুত্থানকে ত্বরাণ্বিত করে। এসব বুঝে বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকলেন । যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতন আর তুর্কি কামাল আতাতুর্কের ইতিহাসের অনুপ্রেরণায় 'বাকশাল' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি । একটা কথা বলা উচিত, বঙ্গবন্ধু কতটা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছিলেন তা যেমন প্রমাণ করে '৭২ এর সংবিধান, তেমনি তাঁর প্রচেষ্টায় কবি কাজী নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে এসে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো ইত্যাদি । 'বাকশাল' তিনি এমনি এমনি চাননি । বরং তাকে বাধ্য করা হয়েছি সমসাময়িক ষড়যন্ত্রময় ঘটনার দ্বারা । কেউ পাশে ছিল না শুধু ভারত-সোভিয়েতপন্থিরা ছাড়া । সবকিছু নিজের অধীনে নিয়ে এসে সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, ঠিকভাবে দেশের অর্থনীতি গড়তে চেয়েছিলেন । এলক্ষ্যেই মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার গঠন করেন । এর পরেও 'চোর'দের সামলাতে না পেরে 'বাকশাল' কে ই চূড়ান্ত হিসেবে নিয়ে এগুতো থাকেন । এটা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে অনেকের মনে । দূর করতে এটা পড়তে পারেন ---> https://www.facebook.com/atanudasbd/p... https://www.facebook.com/atanudasbd/p... https://www.youtube.com/watch?v=4BEgM... 'বাকশাল'ই ছিল একমাত্র সমাধান সব বিশৃঙ্খলা দূর করতে। কারণ প্রশাসনের সর্বত্র ছিল ছুপা স্বাধীনতা বিরোধীরা । মীরজাফররা ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে লুকিয়ে ছিল অদৃশ্য হয়ে । তাই বঙ্গবন্ধু সব ভেবেই বাকশালকে চূড়ান্ত করেন । আর 'বাকশাল' যে খারাপ ছিল তা Apply হবার আগেই কিভাবে বলে সবাই আমার জানা নেই। হলফ করে বলতে পারি, বাকশাল সরকার গঠনের ৩ বছরের মধ্যে সবাই একেই সমর্থন করতো । সব অসংগতি দূর হত । '৭১ এর মত জনপ্রিয়তা ফিরে পেত আওয়ামি লিগ । এসব বুঝে ভয় পেয়েই শেখ মুজিবকে হত্যা করে শয়তানরা । আর সেনাবাহিনীর এই খাওয়াখাওই, কামড়াকামড়ি, লোভ আর পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব-নিকাশে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এই সেনাবাহিনী দেশের জন্য শতভাগ ডেডিকেটেড নয় । তিনি প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী এজন্যই গড়ে তোলেন । গুজব ছিল, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীতে মার্জ করে যাবে, নেতৃত্ব দেবে, ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে যাবে, সব ভারি ভারি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে; অথচ তার কিছুই কিন্তু হয়নি । স্রেফ একটা সহকারী প্যারামিলিটারি বাহিনী হিসেবে ছিল যা বিভিন্ন দেশেও আছে । ছিলনা ভারী অস্ত্র, মাঝারী ও হালকা অস্ত্রের মজুদ ছিল তাদের । যা হোক, এক বিশাল বিভ্রান্তির ভিতরে ছিল সেসময়ের সেনাবাহিনী । আসলে বিভ্রান্তিতে রাখা হয়েছিল । এবারে আসি বইটিতে লেখা '৭৫ এর আগস্ট অভ্যুত্থান ও মুজিব হত্যা প্রসঙ্গে । পরিকল্পনা শুরু হয় মার্চে । যা গোপনে গোপনে জানতেন/অনুমান করতেন অনেকে । জেনেও চুপ ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ এসেব নেতা-অফিসারেরা । কারণ এরাই তো ছিলেন হয় পাকিস্তানপ্রিয় বা লোভী । বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন, জানা লোকদের মধ্যে ছিলেন খুনি মোশতাক, ডেপুটি সেনা চিফ অফ স্টাফ জিয়াউর রহমান(যিনি দীর্ঘদিন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরে কাজ করেছেন, ১৯৬৫ তে পাক-ভারত যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে হয়েছিলেন পাকিস্তানী জেনারেলদের আস্থাভাজন, প্রিয়ভাজন), ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন জাসদের অনেক নেতা । আর যারা হত্যাকান্ডে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তারা তো সব জেনে গোপনই রেখেছিলেন। মার্চ থেকে প্রতিমাসে একবার/দুইবার করে রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মহড়া দেওয়ানো হত সেনাদের দিয়ে । মহড়ার নোটিশ দেয়া হত না, করানো হত হঠাৎ নির্দেশে । আর কিছু অফিসার যেমন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ-কর্নেল শাফায়াত জামিল এদের মত কিছু গ্রুপ ছিল সেনাবাহিনীতে অখুশি । এদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব, লোভ এদেরকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড সম্পর্কে অন্ধকারে রাখতে এবং অজ্ঞাতে মৌন সমর্থন দিতে সহায়তা করে । তখনকার সবথেকে শক্তিশালী ইউনিট সেনা ৪৬-ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিল নির্বিকার ছিলেন, নির্লিপ্ত ছিলেন খালেদ মোশাররফও । সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহর নির্দেশ মানেননি । কারন হিসেবে একটা জিনিস প্রণিধানযোগ্য । ডেডিকেটেড অফিসার খালেদ মোশাররফ মনে করেছিলেন সফিউল্লাহর পরে বঙ্গবন্ধু তাকেই সেনাপ্রধান নিয়োগ করবেন । কিন্তু বদলে শেখ মুজিব ৩ বছর এক্সটেনশান করেন সফিউল্লার মেয়াদ । এতে নাখোশ ছিলেন খালেদ । বাংলাদেশ, ৩ বছর পর কি হয় না হয় । লোভও ছিল উচ্চাভিলাষের যা বইটিতে উল্লেখ আছে । ওদিকে সুবিধাবাদী জিয়াও যে মনে মনে সেনাপ্রধান হওয়ার খায়েশ ধারণ করেছিলেন তাও পরিষ্কারভাবে লেখা আছে বইটিতে । সেনাবাহিনীর জুনিয়র বিপথগামী কিছু অফিসারদের বিশ্বাসঘাতকতায় নিহত হন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সিরাজউদ্দৌলার পর প্রথম স্বাধীন বাংলার শাসক, ইতিহাসের একমাত্র বাঙালি যিনি সব বাঙালিকে ইতিহাসের ১বারই আনতে পেরেছিলেন এক পতাকাতলে, সেই সূর্যসম বিশালদেহী বিশাল মনের মানুষ, বাঙালীর অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । কারা তাদের বিপথগামী করেছিল তা নিতান্তই অতি সহজবোধ্য; সেই পাকিস্তানী দোসর, পাকি-সিআইএ এজেন্টস, এদেশীয় দালাল মোশতাক গং । ছিল মৌন সমর্থন লোভী অফিসারদের । ছিল অন্ধকারে থাকা সেনা অফিসারদের অজ্ঞ সহযোগীতা । সর্বোপরি সেই ধর্মান্ধ শক্তি সফল হয়েছিল এটাই বড় কথা । এরপর মোশতাক পাস করেন ইনডেমনিটি। বন্ধ হয়ে যায় বিচারের সব পথ। বুক ফুলিয়ে চলতে থাকে খুনিরা । জুনিয়র খুনি অফিসার ফারুক-রশীদ গং আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে মোশতাকের নতুন সরকারকে । ওসমানী, খলিলুর, তাহেরউদ্দিন ঠাকুরদের থেকেও বেড়ে যায় সেই জুনিয়রদের ক্ষমতা । বঙ্গভবনে মোশতাকের নতুন মন্ত্রিসভা-সরকারের পাশে থেকে গড়ে তোলে এক নতুন সেনা কমান্ড । ওদিকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ছিল এক সেনাবাহিনী, সফিউল্লাহকে সরিয়ে যার মসনদে বসেছিলেন নতুন আর্মি চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান । সব জানা ও মৌন সমর্থন দেয়া এই চরম সুযোগসন্ধানী জিয়া যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিসিয়ারি ছিলেন, এই হত্যা যার উপরে ওঠার সিঁড়ি তর তর করে খুলে দেয় তা এই বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন । কিন্তু, এদিকে খালেদ-শাফায়েত লোভে পড়ে বা কিছু না বুঝে বঙ্গবন্ধু হত্যায় মৌন সহযোগীতা করায় অনুশোচনা হোক, বা লোভে, পাওয়া-না পাওয়ার হিসেবে পরে হোক, জিয়ার এই উত্থান মেনে নিত�� পারেননি । মনে মনে এই খুনি মোশতাক সরকারকে উৎখাত এর চেষ্টা শুরু করেন । ৩রা নভেম্বরের নায়ক খালেদ-শাফায়াত কি উদ্দেশ্যে, কার/কাদের প্ররোচনায়, কিসের তাগিদে(নাকি খালি লোভে???) এ কাজ করার সাহস পান তা আজও অজানা । খালেদের ভাই রাশেদ মোশাররফ ছিলেন আওয়ামি লিগের নেতা । সে ও তার মা ৩ তারিখ আওয়ামি লিগের মিছিল বের করেন মোশতাক সরকারকে সরানোর দাবিতে । এতে খালেদের যে সমস্যা হয় তা তার সাথে তার মায়ের টেলিফোনে কথপোকথনের মধ্যেই উঠে আসে,''মা, আমাকে তোমরা আর বাচতে দিলে না, আমার কাজগুলো করতে দিলে না।'' তবে খালেদ মোশাররফের নিজের লোভ ও সেনাপ্রধান হওয়ার প্রবল ইচ্ছায় সময় নষ্ট করা ৩রা নভেম্বরের প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার অন্যতম কারণ । মোশতাক ও খুনি ফারুক-রশিদ গং আওয়ামি লিগের পুনরুত্থান ও সমূহ আন্দোলন ঠেকাতে ওই রাত্রেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে জেলখানার ইতিহাসে বিরল বর্বরোচিত জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটায় জাতীয় ৪ নেতার । আইজি প্রিজনকে সাবধান থাকতে বলে মোশ্তাক গং, যাতে কোন সেনা অফিসার নেতাদের মুক্ত করতে না আসতে পারেন । তাদের ভয় ছিল খালেদ-শাফায়াতের এই উত্থান এর সুযোগে আওয়ামি লিগ নেতারা জেল থেকে বের হয়ে জন আন্দোলন গড়ে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে । জনতায় যে বড় ভয় ছিল সেই পাকিপন্থি মোশতাক গং এর। '৭০ এর নির্বাচনের পরে বাঙালি যা করে দেখিয়েছে '৭১ এ তাতে ভয় পাওয়ারই কথা । যা হোক, পরে ফারুক-রশিদের অনুগামি বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশ নেয়া রিসালদার মোসলেহউদ্দিনকে পাঠিয়ে হত্যা করা হয় যখন মোশ্তাককে ফোন করা হলেও তাদের বিরত করতে জেলারকে নির্দেশ দেননি তিনি । অতঃপর ফারুক-রশীদকে থাইল্যান্ড প্রেরণ । তবে এর মধ্যে জিয়াকে বন্দী নাটক শুরু হয় । কারা করেন, খালেদ গ্রুপ করে, নাকি তিনি নিজেই নাটক করেন তা বোধগম্য নয় । বইটির শেষে কিছু কথপোকথন আছে যা পড়লে কিছুটা ধারণা করেন । মূল টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হলেও চালু থাকে বেডরুমের লাইন । বেগম জিয়া একজনকে(কাকে তা বইতে আছে, এখন মনে নেই) বলেন যে তারা ঠিক আছেন, বন্দী-টন্দি নন । আসলে জিয়া তার বন্ধু পঙ্গু কর্নেল(অবঃ) তাহেরের সাথে লিয়াজো রেখেই চলতেন । জাসদ গ্রুপের প্রতিনিধি তাহের আর জিয়া তক্কে তক্কে ছিলেন এরকন একটি সুযোগের, ৩রা নভেম্বরের ঘটনার । কারণ সর্বময় নেতা হবার এই তো সুযোগ, প্রতিযোগীদের দমনের এই এক বিরাৎ চান্স। এরপর জিয়া কিভাবে ৭ নভেম্বরের সিপাহীদের অভ্যুত্থানে 'মুক্ত?' হলেন , কিভাবে খালেদ-শাফায়েতের করুণ পরিণতি হল, কিভাবে সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হল, সৈনিকদের দ্বারা কিভাবে অফিসারদের বিতাড়ন ও হত্যা হল, তাহেরে সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও তার অবসান তাহেরের ফাঁসির মাধ্যমে, কিভাবে জিয়া সব নিজের নিয়ন্ত্রণে আনলেন তা সবই বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন । ৭ নভেম্বরের পর ১৮ টির মত প্রকাশ্য-গোপন, সত্য/মিথ্যা ক্যু বা ক্যু এর নামে সেনাবাহিনীর সৈন্য, অফিসার, ক্যু এর বিচারের নামে কোর্ট মার্শাল করে স্বাধীনতাপন্থি মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর অনুগত অফিসারদের হত্যা করা হয় কিভাবে তা বইটিতে চমৎকার ভাবে লেখা আছে । এসময় জিয়ার মূল উপদেষ্টা ছিলেন এরশাদ ও মঞ্জুর । জিয়া এদের কথা ছাড়া উঠতেন না, বসতেন না । পরে জিয়ার ভাগ্যে কিভাবে কার দ্বারা কি ঘটেছিল তা বইটিতে রহস্যেঘেরা আবর্তে বলা হয়েছে । মঞ্জুরকে কিভাবে সরানো হল কার নির্দেশে তার প্রমাণ না থাকলেও অনুমানযোগ্য । জিয়ার সাথে এরশাদেরও যাওয়ার কথা ছিল ১৯৮১ সালের ৩০ মে তে যেদিন জিয়া নিহত হন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে। কিন্তু অজানা এক কারণে তিনি ঢাকায় থেকে যান প্ল্যান বাতিল করে । তবে সেনাদের মধ্যে, সৈনিকদের মধ্যেও জিয়ার প্রতি ক্ষোভ ছিল বিচারের কারণে । মূলত তাহেরের ফাঁসি যারা মেনে নিতে পারেনি, সেই সমর্থকদের । জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের উত্থান ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা এক বিরাট ঘটনা । এতে যেমন ইতিহাস তার অপরাধের দায় মিটাল শেষমেশ, তেমনি নতুনকরে ধর্মীয় শক্তি রাজনীতিতে নতুন প্রাণ পেল যা নিষিদ্ধ ছিল '৭৫ এর আগস্ট পর্যন্ত । এদিকে জনসমর্থন আদায়ের জন্য মুজিব-আওয়ামি বিরোধী সকল শক্তি- মোশতাক, ফারুক-রশীদ, জিয়া, তাহের সবাই ইসলামকে ব্যবহার করেন । পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন যুদ্ধাপরাধীদের, পুরস্কৃত করেন রাজাকার-আলবদর, পাকিস্তানী দোসর, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের । ফিরে আসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা । ধীরে ধীরে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে । এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালে ফিরে আসে গোলাম আজম । এখানে বলে রাখা ভাল, আওয়ামি লিগকে ধরে রাখতে, আসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দেশে ফিরে ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা অবিরাম চেষ্টা করেন । নব্য বিএনপি তখন নতুন, সেনাবাহিনীর অফিসাররা তখনও তাদের শক্তি, কারন এই BNP, Jatiyo Party সবই সেনা ব্যারাক থেকে সৃষ্টি । জনতার দল ছিল আওয়ামি লিগ আর ওই স্বাধীনতাবিরোধীদের দল জামায়তে ইসলামী, যাদের অবস্থা ধীরে ধীরে ভাল হচ্ছিল(ভাল করা হচ্ছিল) । আওয়ামি লিগ ফিনিক্স পাখির মত দেয়ালে পিঠ ঠেকে বার বার ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল । ক্ষমতায় তখন আওয়ামি লিগকে একটু সহানুভুতি দেবে, সেনাবাহিনী থেকে সহায়তা করবে, এরকম কেউ নেই । তাই নিরুপায় হয়ে , দলকে টিকিয়ে রাখতেই হাসিনা এরশাদের নির্বাচনে যায়, গোলাম আযমের সাথে বিএনপির '৯১ আমলে সাক্ষাত করে । কারণ ঐ যুদ্ধাপরাধী আর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করতে অনিচ্ছা থাকলেও দলকে টিকিয়ে রাখতে, দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে শত্রুর সাথেও বসতে পিছপা হননি । ৪ নেতা নিহত । একা হাসিনা আর কত সাম্লাবেন । বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার তখনও ইনডেমনিটির অন্তরালে রুদ্ধ । অগত্যা এরশাদের নির্বাচনে ও গোলাম আযমের সাথে সাক্ষাৎ করা ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না । ধর্মীয় রাজনীতির বীজ তখন মানুষেরে মনে বপিত হচ্ছিল । এরশাদ ও জিয়া দুজনেই একই কাজ করেন । সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম স্থাপন, ধর্মীয় রাজনীতির অনুমতি, বিসমিল্লাহ সংযোজন এসব করেন তারা । একা হাল ধরেন হাসিনা। পালে হাওয়া নেই । তাই দিগ্বিদিক হয়ে যা পেরেছেন তাই করেছেন । যারা বলেন শেখ হাসিনাই এক সময় জামায়তের সাথে ছিলেন, তাদের তখনকার আওয়ামি লিগের অবস্থা্, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভেবে দেখতে বলব । আর জামায়তের সমর্থন করলে আজ ৬ জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি তিনি কোনদিনই হতে দিতেন না বিদেশী চাপকে উপেক্ষা করে । এসব ভাবার বিষয় বিভ্রান্তদের । আর যারা সব জেনেও অন্ধ তারা যে কোন পক্ষের তা বলি বলতে হবে না আর । জনগণকে বিভ্রান্ত করাই এদের কাজ । তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই ধর্মীয় শক্তিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন । এতে এই পাকিস্তানী জামায়তী শক্তিই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, আরো শক্তিশালী হয়েছে । প্রথমে মোশতাক, জিয়া, এরশাদরা তো use করতেন এই ধর্মীয় শক্তিকে । পরে ২০০১ সালে সব স্বাধীনতাবিরোধী এই শক্তিগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । ধর্মীয় শক্তির সাথে দূরত্ব রেখে চলা বিএনপি যে তাদের দ্বারাই পরিচালিত হত, বিএনপি একটি মুখোশ ছাড়া আর কিছু ছিল না সেটা বোঝা গেল ২০০১ এর পরে । মূলত সব অভিনয় ছেড়ে মুখোশের ভিতরের আসল শয়তানের চেহারা বেরিয়ে আসে যা বোঝা যায় যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সাকাচৌধুরির মন্তব্যে,''এতদিন জানতাম কুকুর লেজ নাড়ে, এখন দেখছি লেজই কুকুরকে নাড়ে'' । গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথা । :v শত ষড়যন্ত্রের পরেও, শত বাধা পেরিয়ে আজ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক শক্তি আজ ক্ষমতায় । প্রবল প্রতাপে দোর্দণ্ড ক্ষমতায়-সাহসে বিচার চলছে সেই সব খুনি-খুনির দোসরদের । দুঃখ লাগে একটা কথ�� ভেবে, মুক্তিযুদ্ধের পর সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, বিশেষত সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের জন্য আমি সর্বদাই একটা কথা বলি,"রাজাকার আজীবনই রাজাকার, কিন্তু সব মুক্তিযোদ্ধা সর্বদা মুক্তিযোদ্ধা নয়" । কষ্ট লাগে, মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসীকতায় নেতৃত্ব দেয়া সেই বীর অফিসাররা কিভাবে বিভ্রান্ত হয়ে(বিভ্রান্ত করে) করুণ পরিণতি লাভ করতে হয় ।বাঙালীর ইতিহাসে আর কেউ কখনো কোনদিন পারবে/পেরেছে কিনা জানি না, একমাত্র জাতির জনকই পেরেছিলেন লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে মানুষ বানাতে, ১৯৭১ সালে । কিন্তু তিনি যে বড় বিশ্বাস করেছিলেন সেই বাঙ্গালীদের যারা মীরজাফরের বংশধর । ভেবেছিলেন-বলেছিলেন কোন বাঙালি তাকে মারতে পারবে না, পারে না । আসলেও পারেনি । কারণ সেই বিপথগামীরা যে বাঙালী নয়, বাঙালী হতে পারে না ।
বইটি সকলের পড়া উচিত যাদের সত্য ইতিহাস নিরপেক্ষভাবে জানার ইচ্ছা। Cons: ১. লেখক এক জায়গায় নিজেকে একটু বেশি প্রচার করে ফেলেছেন, হিরো হিসেবে । আত্মপক্ষ সমর্থনও আছে । তার নিজের ভুমিকা কি ছিল স্টেশান কমান্ডার হিসেবে তা বলেননি । দায় এড়ানোর কিছু চেষ্টা আছে । অর্ডারের অপেক্ষায় কাটিয়েছেন নিজের দায়িত্ব । তবে সেলফ ডিফেন্স করতে গিয়ে মূল ঘটনা নিরপেক্ষভাবে লিখতে পিছপা হননি । ২. লেখক একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বইটি লিখেছেন । কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে । আর পররাষ্ট্রনীতি, বিদেশী গোয়েন্দাদের তৎপরতা সম্পর্কে কিছুটা অজ্ঞ হিসেবে লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেকে । ফলে কে কার কোন দেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো তা বইটিতে পাওয়া যায় না । তবে লেখক এক জায়গায় তার এই দুর্বলতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন । After all, বইটি চমৎকার । পাঠক হিসেবে পড়ার সুপারিশ করছি ।
ইতিহাস কখনো সম্পূর্ণভাবে সাদা বা কালো হয় না, ইতিহাস হয় ধূসর বর্ণের... '৭১ পরবর্তী আমাদের ইতিহাস সেই ধূসর বর্ণের ভেতর আরও ধূসরিত...
'৭১ পরবর্তী রাজনৈতিক আর সামরিক ইতিহাসের রয়েছে বিভিন্ন ভার্সন। এমনকি দু'জন প্রত্যক্ষদর্শীও দুই রকম ঘটনা বর্ণনা করবে। এর মাঝে আমরা যারা বিভিন্ন বই পত্র পড়ে ইতিহাস জানতে চাই, তাদের পরতে হয় বিপাকে। কোন সত্য, কোনটা মিথ্যা আমরা বুঝতে পারি না। তবে হ্যা, একাধিক ভার্সন জানার পর মোটামুটি একটা স্বচ্ছ ধারনা অনুমান করা যায়।
সেই অনুমান থেকে বলা চলে, 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট নিরপেক্ষ।
তবে লেখক হয়ত ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে জিয়ার প্রতি কিছুটা সদয় ছিলেন বলে মনে হলো। আর কর্ণেল তাহের ও জিয়ার সম্পর্কে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করা উচিত ছিল বলে মনে করি। আর, বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় জিয়ার অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত ছিল। যদিও, '৭৫ পর্যন্ত জিয়া'র রোল অন্যান্য চরিত্রের তুলনায় খু্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় তবুও পরবর্তী সময়ের বিবেচনায় স্পষ্টকরণ জরুরি ছিল।
এই বিষয় বাদ দিলে, লেখক সার্থক। ইতিহাসের বই সাধারণত খটমট ধরণের হয়, কিন্তু এই বইটি খুবই সুপাঠ্য। লেখকের বর্ণনা, ঘটনা প্রবাহ, নিজের অবস্থান স্পষ্টকরণ চমৎকার।
'৭১ পরবর্তী রাজনৈতিক আর সামরিক ইতিহাস জানতে বইটির বিকল্প আসলেই নেই।
রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে পড়ার এ এক মধুর সমস্যা। এ যেন অতল গহব্বর। এক বইজের লেজ ধরে উঠে আসে আরো ১০ বই।
এ বই নিয়ে বললে বলবো, যে ৩ সেনা অভ্যুত্থান এখানে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো নিয়ে প্রায় সব তথ্যই ইতোমধ্যে জানি। তবুও এ বইটা পড়লাম কারণ শুনেছি বইটা নিউট্রাল। কথাটা অলমোস্ট সত্যি। বইটা আসলেই নিউট্রাল শুধু শুরুর দিকে শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখকের একটা আফসোস দেখলাম, ওনাকে নাকি ওনার আশেপাশের লোকজন যা বলতো উনি সেটাই বিশ্বাস করতেন। ব্যাপারটা বেশ দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন লেখক।
কিন্তু শেখ মুজিবকে নিয়ে যতগুলো বই পড়েছি, তার চরিত্র যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে করে মনে হয়েছে, শেখ মুজিব তার আশেপাশের লোকজনের কথা ঠিকই বিশ্বাস করতেন তবে তার আশেপাশের লোকজন নিয়মিত পরিবর্তিত হতো শেখ মুজিব কী শুনতে চান সেটার ওপর নির্ভর করে। মানে শেখ মুজিব যা শুনতে চান সেগুলো নিয়মিত বলে গেলেই কেউ একজন তার কাছের লোক হতে পারতো।
১৯৭৫-১৯৮১ সময়কালের ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা, যেখানে লেখক অনেকটাই নির্মোহভাবে ইতিহাসকে অবিকৃতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এখানে আছে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভূত্থান, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা আরোহণ, প্রতিবিপ্লবী কর্ণেল তাহেরের ফাসি, জেনারেল এরশাদের উচ্চাশা ও জিয়া হত্যাকান্ড। উল্লিখিত সময়ের আলোকে বহুল আলোড়িত ' লিগ্যাসি অফ ব্লাড' বইটির তুলনায় এই বই এগিয়ে থাকবে। মাসক্যারেনহাস কিছু কিছু বিষয়ে ব্যাক্তিগত আক্রোশ নিয়ে ঘটনা বর্ণনা করেছেন বলে মনে হয়। সে তুলনায় এই বইটি যথেষ্ট নৈব্যক্তিক ও নির্মোহ বলে মনে হয়েছে।
কিছু টা বন্ধুর প্রতি বায়াজড থাকলেও অনেক টাই "অবজারভার" এর দৃষ্টিতে বর্ণনা করে গেছেন ঘটনাগুলো। বুঝতে হবে যে একজন সামরিক ব্যক্তির লিখা, তাই সাহিত্যের রস অনেক কম। তথাপি অত্যন্ত তথ্যবহুল হওয়ায় আকর্ষণীয়। অভ্যুত্থাণ এর সাথে জড়িত না থেকেও জড়িত সবার সাথে তার সামান্য হলেও উঠাবসা থাকায় অনেক ঘটনাই আমরা তার চোখে অবলোকন করি। সেই সাথে উনি পয়েন্ট আকারে যখন উনার যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন সেগুলো ও ঘটনা বুঝতে সহায়তা করে।