পুরোনো একটা ড্রয়িং খাতা আর একখানা হলুদ হয়ে যাওয়া বিবর্ণ চিঠির সূত্র ধরে গণিতের অধ্যাপক শৌনক মিত্র, তার মেয়ে পেখম ও ভাগ্নে দালি জড়িয়ে পড়ে সুদূর ১৯৩০-এর সশস্ত্র বিপ্লব-আন্দোলনের এক নিগূঢ় অধ্যায়ের সঙ্গে। এই সমস্যারই অন্য প্রান্তে রয়েছে উপন্যাসের রহস্যময় প্রতিনায়ক বিরূঢ়ক, ধর্মভীরু সাহিল আল ফারাজি, নিরুদ্দিষ্ট শিল্পী শ্রীনিবাসন ও তাঁর স্ত্রী দেবলীনা। এবং অকস্মাৎ এই বিপদের বৃত্তে ঢুকে পড়ে নিজের অজান্তেই আরেকজন— ট্যাক্সি-ড্রাইভার প্রতুল। প্রাণিবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, গণিত, ইতিহাস, চিত্রকলা, কল্পবাস্তবতা, ক্রিপ্টোগ্রাফি ও ট্রেজার-হান্টের উপাদানে নির্মিত এই উপন্যাস ‘দীনেশ গুপ্তের রিভলভার’ একই সঙ্গে আত্মদানের আদর্শে স্পন্দিত ও অস্তিত্বের নীল বিষে জর্জরিত।
ফেসবুকে সন্মাত্রানন্দ-এর লেখা পড়ে বিপুল আনন্দ পাই। এখানে যে সেটা পেলাম না, মনে হলো তার মূল কারণ দুটি। প্রথমতঃ লেখকের জঁরা পরিবর্তন। সন্মাত্রানন্দ ধ্রুপদী ধারার লিখিয়ে (ফেসবুকে তার লেখা পড়ে মনে হয়েছে), রোমাঞ্চ উপন্যাস ঘরানার লেখা তার হাতে নাও ফুটতে পারে।
দ্বিতীয় কারণটি আরও সার্বজনীন। থ্রিলার সাহিত্যের ভাষা পশ্চিমবঙ্গে তৈরিই হয়নি৷ বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে কাজী আনোয়ার হোসেনের ছায়ায় যে পাঠকগোষ্ঠী বেড়ে উঠেছে, পশ্চিমবাংলার থ্রিলার পড়তে গেলেই তারা সেটার খাপছাড়া ভাব টের পায়। আমাদের তরুণ থ্রিলার লেখকরাও তাই বেশ তৈরি একটা ভাষায় লেখেন, গল্পের গরু যেখানেই যাক।
খুব চমতকার একটা প্লট ছিলো এই বইতে। কিন্তু সমাপতন, কার্ডবোর্ড খলনায়ক আর শেষের বাস্তব-অধিবাস্তব মিলে বেশ জটায়ূ মার্কা হয়ে গেলো।
অধীর আগ্রহে শ্রদ্ধেয় সন্মাত্রানন্দ-এর 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা' পড়তে বসবো এবার। ভদ্রলোকের ভাষাজ্ঞান আর ইতিহাসপ্রেমের পরিচয় যা পেয়েছি, মনে হয় হতাশ হতে হবে না।।
এ এক আশ্চর্য লেখা! আজ্ঞে হ্যাঁ, এটি কী ধরনের বা গোত্রীয় উপন্যাস, তা আমার ভালো লাগল না মন্দ— এ-সবেরও আগে এই সরল কথাটি স্বীকার করতেই হচ্ছে। তার কারণ... বরং গল্পটা কী নিয়ে, অন্তত সেটুকু লিখি।
মেদিনীপুরে ছুটি কাটাতে এসে ভারি অদ্ভুত এক ধাঁধায় জড়িয়ে পড়ল উদ্দালক ওরফে দালি। এক স্কেচ-বুক দিয়ে শুরু হওয়া সেই ধাঁধার সূত্র ধরে শৌনক, পেখম, আর তাদের সঙ্গে আমরাও পৌঁছে গেলাম বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল, রক্তলাল অধ্যায়ে— যাকে মুছে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা হয়েছে এত-এত বছর ধরে। তারই সঙ্গে এল বিরূঢ়ক। মৃত্যু-নামক উত্তেজনার সন্ধানেই বাঁচা এই প্রখর বুদ্ধিমান মানুষটি অন্ধকারের আড়ালে খুঁজে পেয়েছিল কোনো এক গুপ্তধনের কথা। সেও এসে পৌঁছোল ক্লাইম্যাক্সে। এল দুর্ধর্ষ দুশমন। এল পথভোলা কোনো পথিক। এল প্রেমের শুকনো পাতা মাড়িয়ে নতুন কিছুর সম্ভাবনা। মিশে গেল অতীত আর বর্তমান। একাকার হল গণিতের জ্ঞান আর ইতিহাসের অভিজ্ঞান। আর সবাইকে, সবকিছুকে জড়িয়ে ধরল কাল তার রহস্যময় জাল দিয়ে। তারপর কী হল?
এই বইটি কংক্রিট কোনো রহস্যভেদ, বা ট্রেজার-হান্ট, বা থ্রিলার নয়। এটি ইতিহাসাশ্রয়ী রোমাঞ্চকর আখ্যান ঠিকই; কিন্তু সময়ের গতিকে নিতান্তই এলোমেলো করে দিয়ে এই লেখা স্বেচ্ছায় তেমন উপন্যাসের সংজ্ঞাও উল্লঙ্ঘন করেছে। আদতে এই বই অভিমান আর অবরুদ্ধ ক্রোধের এক গতিময়, স্বচ্ছন্দ প্রকাশ। নিঃশেষে প্রাণ দান করে যাওয়া যে মানুষগুলোর স্মৃতি প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের আপোষ আর আলস্যে, তাঁদের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য এই বই। তারই সঙ্গে এটি হয়তো শনশন হাওয়ার মুখে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টাও— যাতে মানুষ লড়তে পারে দেশের জন্য, সম্মানের জন্য, প্রেমের জন্য... জীবনের জন্য। সেইসব মুষ্টিবদ্ধ হাতে থাকুক গোলাপ, থাকুক প্রদীপ; আর থাকুক দীনেশ গুপ্তের রিভলভার!
সন্মাত্রানন্দের লেখা পড়াই এক অভিজ্ঞতা৷ এমন লেখা যেন সহজ অথচ কালজয়ী, দুর্জ্ঞেয় অথচ আকর্ষণীয় কিছুর দিকে আমাদের ছুটে যেতে বাধ্য করে প্রাত্যহিকতার মালিন্যের মধ্যেও। এই বই সেই বিশেষ ঘরানার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারই সঙ্গে এই বই আমাদের ঘুম ভাঙানোরও। যদি সেই ভুলিয়ে দেওয়া রক্তঝরা দিনগুলোর কথা জানতে চান, তাহলে এই বই পড়তে ভুলবেন না। ওই ঐতিহ্য আর ইতিহাসই আমাদের আসল ট্রেজার— আসল রিভলভার!
১৯২৭ থেকে ১৯৩৩ - এই সময়কালে সংঘটিত বিপ্লব আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বইটা লেখা হয়েছে। যদিও বইটাকে লেখক ইতিহাসআশ্রিতো বই বলে দাবি করেননি। আমিও বলবো বইটা মোর লাইক রহস্যউপন্যাস বা থ্রিলার জনরায় পড়ে।
আমার বইটা খুবই ভালো লেগেছে। পেজটার্নার ছিল। হেঁয়ালি, ট্রেজার হান্টিং এসব ছিল। কিন্তু উপন্যাসের প্রতিনায়কের এন্ডিংটা ভালো লাগলোনা। গোটা উপন্যাসের এন্ডিংটাই মনে হয়েছে বড্ড তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দিয়েছেন লেখক।
সাল ১৯৩০। ক্ষুদিরাম বসু অনেক আগেই বাংলার যুবকদের মনে জ্বালিয়ে দিয়েছেন বিপ্লবের আগুন। বাদল গুপ্ত, বিনয় বসু সহ অনেকে যোগ দিয়েছেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার'সে। একের পর এক অভিযান করে যাচ্ছেন অত্যাচারী বৃটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। প্রতিটি অভিযানের সময় তাদের একহাতে আছে পটাশিয়াম সায়ানাইডের অ্যাম্পুল, আর অন্য হাতে দীনেশ গুপ্তের লাকি রিভলবার। সবসময় মনে হতো, ইতিহাসের এই অধ্যায়ের উপর যদি কেও একটা থ্রিলার লিখত! অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো লেখক সম্মিত্রানন্দের হাত ধরে। ❝দীনেশ গুপ্তের রিভলবার❞ থ্রিলারটি লেখা হয়েছে ইতিহাসের এই চমকপ্রদ অধ্যায়ের উপর ভিত্তি করে। ইতিহাসের শিক্ষক শৌনক মিত্র, তার মেয়ে পেখম ও ভাগ্নে দালি- ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পরে ইতিহাসের এক অজ্ঞাত অধ্যায়ের সাথে। এক সিক্রেট সোসাইটি - যারা যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলছে অতি মূল্যবান কিছু। তাদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দারুণ এক সংকটের মুখে পড়ে যায় শৌনক মিত্রের পুরো পরিবার, যার সাথে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র।
ইতিহাসআশ্রিত এই থ্রিলারটির শেষটুক খুবই অদ্ভুত। বইটা পড়ে যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। দীনেশ গুপ্তের প্রিয় রিভলবারের মধ্য দিয়ে অতীত- বর্তমান নিয়ে অদ্ভুত এক গল্প বলে গেলেন লেখক 'সম্মাত্রানন্দ'। ইতিহাসআশ্রিত থ্রিলারটি যেকোনো পাঠকের মনেই চিন্তার খোরাক যোগাবে- একনিশ্বাসে গিলে ফেলার মতো এই বইটি। সব মিলিয়ে ভালোই লেগেছে।
ইতিহাস আমার কোনোদিনই প্রিয় ছিলোনা, এই সাল, সময় মনে রাখতে গিয়ে কাহিল হয়ে যেত আমার মাথা। কিন্তু অনেকদিন পর হয়তো নিজের ইচ্ছেতে কোনো ইতিহাস(মাইথলোজি নয়) কেন্দ্রিক বই পড়লাম, এবং সেটা শুধুমাত্র নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা পড়ে, উনার লেখা এতটাই ভালো লাগে যে আর একটা বই পড়তেই হলো। এবং সত্যি ভালো লাগলো বইটা পড়েছি বলে।
সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস, বাংলার ভুলে যাওয়া বিপ্লবীরা আর ইংরেজদের নৃশংসতা, সব কিছুই মনে করিয়ে দিয়েছেন উনি। বইয়ের পাতা থেকে কখন যে দীনেশ-বাদল-বিমল বাবুরা উঠে এসেছেন, মনে করিয়ে দিয়েছেন ঠিক কতটা দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে মানুষ হয়ে উঠতে পারেন বিপ্লবী। বইয়েতে যেমন আছে ধাঁধা সমাধানের উত্তেজনা, তেমনই আছে খুন-কিডন্যাপের মতো থ্রিলার প্লট। বইটি এতো সুন্দর করে ইতিহাসের সাথে কল্পনাকে মিশিয়েছে যে কখন যে আপনি সময়ের গন্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যাবেন সেই 1930-35 এর সময়ে যে মনে হবে আপনি হয়তো সত্যি হয়ে গিয়েছেন পাঠক থেকে প্রত্যক্ষদর্শী।
সন্মাত্রানন্দ বাবুর লেখা পড়ে সত্যি দুবারই ঘোরে চলে গিয়েছিলাম।
বাংলা সাহিত্যে এমন থ্রিলার আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে না যেখানে ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব, জ্যামিতি, সংখ্যাতত্ত্ব, প্রাণীবিজ্ঞান, ক্রিপ্টোগ্রাফি সবটাই প্রসঙ্গক্রমে মিলেমিশে এমন রহস্যজাল বুনেছে যে শেষ পাতা পর্যন্ত চোখ আটকে রাখতে বাধ্য। বিশেষত লেখক আত্মদানের আদর্শগত দ্বন্দ্বের জায়গাগুলো কাহিনী নির্মাণের ক্ষেত্রে এত সুন্দর ব্যবহার করেছেন যা পড়লে অবাক হতে হয়। বিনয়-বাদল;'দীনেশ গুপ্তের রিভলভার' ❤️❤️❤️
সন্মাত্রানন্দ এইসব থ্রিলারঘেঁষা উপন্যাস লেখার চেষ্টা যত কম করবেন ততই বেশি মঙ্গল হবে। মানে অন্তত আমার জন্যে তো সেটাই সত্যি, নইলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে আমার। নিচের লেখা পড়ার আগে, সাবধান করে দিচ্ছি।
সাবধান! সাবধান! রাগের মাথায় গল্পের অনেক "রহস্য" (থুড়ি সুপারন্যাচারাল কপচানি) আমি উদঘাটন করে ফেলেছি। বইটি সম্পর্কে আগ্রহ থাকলে, এই অর্ধোন্মাদ বইপ্রেমীর সমালোচনা পড়া বন্ধ করুন। অনেকেরই ভাল লেগেছে, পাঁচ তারকা দিয়েছেন। সেগুলো পড়ে, বইটা কিনে ফেলুন। কারণ ভাল লাগার জন্যে এই বইয়ে প্রচুর জিনিস রয়েছে।
এইবার আসি আসল কথায়।
এত সুন্দর একটা গল্প শেষে ভয়ানকভাবে চুপসে গেল! চোপসাবি তো চোপসা একসময় মনে হল তথাকথিত থ্রিলার জঁরের প্যারোডি পড়ছি নাকি। ক্রুর ভিলেইন এতদিন সাইকোপ্যাথ ছিল, হঠাৎ তাকে ট্র্যাজিক আন্টিহিরো দেখানোর জন্য লেখক উঠে পড়ে লাগলেন (জয় মা ডেইনেরিস টারগারিয়েন)। মনে আছে, এই উপন্যাসের প্রথমেই দেখানো হয়েছিল, ভিলেইন এন্তার খুন করে বেড়াচ্ছে? সেইসব ভুলে যান। ওই ভিলেইন এখন গল্পের নায়কের সাথে ব্যাপক আড্ডা দেবে। মাল খেয়ে কবিতা আওড়াবে। ট্র্যাজিক বাবাজিকে (সার্টিফায়েড জিনিয়াস) ওর গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গেসল শুনে নায়কের চোখ ছলছলিয়ে উঠবে। আহা, কি করুণ দৃশ্য! কী? নায়ক আর নায়কের মেয়েকে একটু আগেই এই বদ লোকটা কিডন্যাপ করে এনেছে? কী বললেন? এর আগে নায়কের পূর্বপরিচিত এক লোককে অমানুষিক টর্চার করেছে? তাতে কী? দেখছেন না আমাদের ভিলেইনের গার্লফ্রেন্ড ওকে ছেড়ে চলে গেসল। বড়ই দর্দনাক ঘটনা।
আচ্ছা সেইসব বাদ দিন। গুপ্তধনের ব্যাপারটা আছে তো। চলুন, সবাই মিলে এইবার পাতালঘর সিনেমার সেই বিখ্যাত সিনটা আরেকবার রিএন্যাক্ট করে ফেলি। শুধু কিতকিত না খেলে আমরা ফিবোনাচ্চির সেই বিখ্যাত সিরিজ নিয়ে অঙ্ক ফঙ্ক কষবো (দুই পাতা), তারপরেই... চিচিং ফাক!!!
এরপরেও অনেক কিছুই হয়েছে। ভূতেদের সাথে ঝগড়া। দারুণ একটা খাঁজা প্লট টুইস্ট ("আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন উমুক ব্যক্তি।" "মাই গহড!"), সস্তা ইন্ডিয়ানা জোনস, আরও কত কী। এটা যদি জনৈক কিছু লেখক লিখত, আমি এত কথা বলতামই না। কিন্তু ইনি যে সন্মাত্রানন্দ, তাঁর লেখনীতে দেখেছিলাম জাদু...
উপন্যাসের প্রথমে যে কিছু কিছু সমস্যা ছিল না, সেটা বললে ভুল বলা হয়ে যাবে। অনেকক্ষেত্রেই গল্পের দৈর্ঘ্য অলৌকিক আর মেটাথিয়েট্রিকাল এলিমেন্ট ঢুকিয়ে বাড়ানো হয়েছে। এই ব্যাপারটা আমি লেখকের আধ্যাত্মিক উপন্যাসে দেখতে পেয়েছি, তবে সেখানে অলৌকিকের একটা সুন্দর অবস্থান রয়েছে। মেটাথিয়েট্রিকালিটির জন্যে ঘটনার ঘনঘটা আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু এই উপন্যাসে সেই ব্যাপারটা বিরিয়ানিতে পাওয়া এলাইচি মত।
একটা অসাধারণ উপন্যাস হয়ে যেত পারত "দীনেশ গুপ্তের রিভলভার"। অনেক অনেক অধ্যায়ে আমাদের দেশের বিপ্লবীদের সংগ্রামের জ্বালাময়ী বিবরণ রয়েছে। সেটার সাথে সমান্তরাল ভাবে একটা গুপ্তধন খোঁজার গল্প এগিয়ে চলেছে। বাধ সাধল এই দুটো সমান্তরাল স্রোতকে মেলানোর সময় (মেলানোটা খুব দরকার ছিল কি?)
সন্মাত্রানন্দ ঠিক করলেন, ভূত, হ্যাঁ, ভূত দিয়েই এই দুই সময়ের স্রোতকে মিশিয়ে দেবেন। ভূত এসে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সামনে হিলির নাচ করবে। একটা ছেলে ভুতুড়ে বই পড়ে কোমায় চলে যাবে। ভূতেরা রাউন্ড টেবিলে বসে উইকিপিডিয়ার চাকরি করবে। ভূত, চারিদিকে, ভূত। এইসব ভূত প্রেতের সাথে মুল গুপ্তধন প্লটের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাতে কী হইসে? দেখছেন না, কেমন জটিল হয়ে গেছে ব্যাপারটা। আর কে না জানে, জটিল মানেই গভীর কিছু একটা। জয় সৃজিতদার, জয়।
যাই হোউক। এই লেখাটা লিখে মাথা অনেকটা ঠান্ডা হয়েছে। কেউ এত অবদি পড়ে থাকলে, আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
যদি সত্যিই আমার মতামত জানতে চান, তবে বলব, এই বই বাদ দিয়ে "ছায়াচরাচর" পড়ুন মশাই। মাল্টিভার্সের আমেজে বুঁদ হয়ে থাকুন। শুভরাত্রি।
This entire review has been hidden because of spoilers.
লেখকের নামটা পড়ার পর যেমন একটা কঠিন বা দুর্বোধ্য মনে হয় ঠিক সেরকম ভাষায় লেখক এই উপন্যাসই লেখার চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসটি মূলত দুইটা সময়কালে বিস্তৃত। এক. বর্তমান সময়ে যেখানে ট্রেজার হান্ট ঘটছে আর দুই. ১৯৩০ এর দশকের উত্তাল বিপ্লবের সময়ে যেখান থেকে ট্রেজারের উৎপত্তি।
অতীতের সময়কালের বর্ণনা বেশ চমকপ্রদ এবং আগ্রহোদ্দীপক। কিন্তু বর্তমানের সাথে তার যোগাযোগের সুতোটা বেশ হালকা। সেজন্য শেষ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই 'কি হবে' বা 'কি হতে যাচ্ছে' এর আগ্রহ মরে যায়। শেষাংশেও পরাবাস্তব বিষয়য়ের অবতারণা মোটেই স্মার্ট কিছু লাগেনি।
এটা যদি আমি থ্রিলার হিসেবে না পড়তাম তাহলে হয়তো ৪ তারা দিতাম। কিন্তু থ্রিলার হিসেবে পড়েছি তাই ৩ তারা দিলাম। কেননা সব কিছু কেমন যেন জোর করে সমাধান করে দেয়া হচ্ছে মনে হয়েছে। রহস্যের জট খোলার মজাটা ছিল না। তবে ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস হিসেবে বেশ ভালো। লেখকের প্রথম পড়া উপন্যাস এবং আমি এনার আরো বই পড়তে চাই, কারণ তার লেখার গাঁথুনি অনেক স্ট্রং।
"দীনেশ গুপ্তের রিভলবার"- বইয়ের নাম এবং প্রচ্ছদ দেখে প্রথমে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। সন্মাত্রানন্দের "নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা" আর "ছায়াচরাচর" পড়ে একটা ধারণা মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো যে আবার ওনার লেখার মধ্যে দিয়ে ফিরে যাব সেই সূদুর অতীতে, শত -সহস্র বছর আগের এক মায়াময় জগতে, এটাই যেন প্রত্যাশিত ছিলো।
কিন্তু তা হয় নি, বইয়ের নামে যতটা চমক, বইটি পড়ার পরেও তার রেশ থেকে যায়। একটি সম্পুর্ণ অন্যধারার লেখা, যার বিষয়বস্তু পুরোপুরি আলাদা তাঁর ইতিহাস সৃষ্টি করা বেস্টসেলার বইগুলির থেকে। "দীনেশ গুপ্তের রিভলবার" মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার এব�� একটি ট্রেজার হান্টের গল্প, যা ইতিহাস নির্ভর বটে, কিন্তু কখনোই তা ইতিহাস সবর্স্ব নয়, বরং অসাধারণ সাহিত্যগুণে ভরপুর একটি রোমাঞ্চকর ফিকশন উপন্যাস।
মেদিনীপুর শহরের একটি পুরনো বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে এক পুরনো বাক্সের মধ্যে পাওয়া একটি পুরনো ড্রয়িং খাতা আর হলুদ এবং বিবর্ণ হয়ে যাওয়া হলুদ চিঠির সুত্র ধরে মেদিনীপুর কলেজের গণিতের অধ্যাপক শৌনক মিত্র, তাঁর মেয়ে পেখম এবং ভাগ্নে দালি (ভালো নাম উদ্দালক) জড়িয়ে পড়ে ১৯৩০-এর সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের এক অধ্যায়ের সাথে এবং সেইসাথে এক ট্রেজার হান্টের রহস্যময়তায়। অন্যদিকে রয়েছে, ���ই উপন্যাসের একটি রহস্যময় এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র বিরূঢ়ক। বড় অদ্ভুত মানুষ সে, বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত এবং একইসাথে নির্দয় আর নিষ্ঠুর। তার বাড়িতে পোষা নানা ধরনের সাপ এবং সে তাদের মধ্যেই যেন বেশ স্বচ্ছন্দ। সভ্যতার সংজ্ঞা তার কাছে বেশ ব্যাতিক্রমী। সাধারণ মানুযের তুলনায় অত্যন্ত জটিল তার মনস্তত্ত্ব। তার অন্তর বিষাদে পরিপূর্ণ, বিষাদজাতক বললেও অত্যুক্তি হয় না। Professor Moriarty কে আশাকরি সবারই মনে আছে, (তুলনা করছি বা মিল খুঁজে পাচ্ছি ভাবলে ভুল ভাবছেন)। এমন একটি চরিত্র যাকে আপনি যতই ঘৃণা করুন তার মেধা আর বুদ্ধিমত্তাকে অগ্রাহ্য করতে পারা যায় না, অবচেতন মনে সম্ভ্রম জাগাতে বাধ্য। বিরূঢ়ককেও তেমনই অপছন্দ হলেও তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না, সে আপনার চিন্তায় বিচরণ করবেই। তাকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। শৌনক, পেখম এবং দালির সাথে বিরূঢ়কও এই রহস্যের জালে জড়িয়ে যায়, কিন্তু কেমন করে - তার উত্তর এই টানটান, উত্তেজনায় ভরপুর এই উপন্যাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। এছাড়াও আছেন , ধর্মভীরু মানুষ সাহিল আল ফরাজি, শিল্পী শ্রীনিবাসন এবং তাঁর স্ত্রী দেবলীনা এবং পাকেচক্রে নিজের অজান্তেই এই রহস্যের বৃত্তে ঢুকে পড়া ট্যাক্সি- ড্রাইভার প্রতুল। এনারা সবাই নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে একসূত্রে জড়িয়ে পরেন। শেষপর্যন্ত তাঁরা কি গুপ্তধনের সন্ধান পেলেন? এবং কিই বা সেই গুপ্তধন? তা জানতে গেলে এই বইটি পড়তে হবে।
আচ্ছা, যদি প্রশ্ন করি ডগলাস পেডি বার্জ এরা কারা - কিছু মনে পড়ে কি আপনাদের ? হয়তো কারোর মনে পড়ছে আবছা, কিন্তু অনেকেরই হয়তো পড়ছে না, ইনফ্যাক্ট আমার নিজেরও মনে পড়েনি। এবার যদি জিজ্ঞেস করি শ্রী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, শ্রী বিমল দাশগুপ্ত, শ্রী যতীশ গুহ, শ্রী যতিজীবন ঘোষ, শ্রী প্রভাংশু পাল, অনাথবন্ধু পাঁজা, মৃগেন দত্ত - এনাদের কি মনে পড়ে? হয়তো হ্যাঁ, বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো না। পেডি, ডগলাস, বার্জ এনারা ছিলেন ইংরেজ শাসক, অত্যাচারী এবং প্রত্যেকেই মেদিনীপুর শহরে পোস্টেড ছিলেন। আর শ্রী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, শ্রী বিমল দাশগুপ্ত, শ্রী যতীশ গুহ, শ্রী যতিজীবন ঘোষ, শ্রী প্রভাংশু পাল, অনাথবন্ধু পাঁজা, মৃগেন দত্ত - এনারা প্রত্যেকেই ছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামক বাংলার স্বেচ্ছাসেবক দল এবং ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠী এবং উপরে উল্লিখিত তিন ইংরেজ শাসকদের এনারাই নিকেষ করেছিলেন। এনাদের ব্যাপারে মনে না পড়া বা না জানার কারণ একটাই, আমরা যে ইতিহাস পড়েছি তা হলো "অফিসিয়াল হিস্ট্রি", এবং সেখানে এনারা ব্রাত্য বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না। ঐতিহাসিক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ভারতীয় ইতিহাস কমিটির প্রধান করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি "অফিসিয়াল হিস্ট্রি" নয় বরং সত্যিকারের ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন, এবং সেই নিয়ে মতবিরোধের জেরে তিনি ইতিহাস কমিটির প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং সরকার মনোনীত শ্রী তারাচাঁদ মহোদয়, সরকারের মনপসন্দ " অফিসিয়াল হিস্ট্রি " রচনা করেন, যেখানে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের বা বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনের সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল গঠন করেন। এই গ্রুপটি বাঙ্গালীর স্বেচ্ছাসেবকদের নামকরণ করেছিল এবং মেজর সত্য গুপ্তের নেতৃত্বে ছিল। তাই পরবর্তীতে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামে পরিচিত হয়।
উপরের প্যারাগ্রাফে লেখা কথাগুলি অনেকেরই হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, এই বইয়ের প্রেক্ষিতে। কিন্তু না, এই বইটির সাথে তা ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। বইটির নাম "দীনেশ গুপ্তের রিভলবার ", এই দীনেশ গুপ্ত ছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর একজন প্রথম সারির নেতা এবং বিনয় বাদল দীনেশের (বিবাদী) শেষজন। এই দীনেশ গুপ্ত এবং বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। আগেই বলেছি এই বইটি কিন্তু মোটেই অতীতের ইতিহাস বিষয়ক নয়, বরং বর্তমান সময়ের একটি ফিকশন , এক অদ্ভুত রহস্যময় ট্রেজার-হান্ট, যার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। তবে,এই বইটি পড়ার পর, আমার নিজের বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের বিষয়ে বিশদে জানার আগ্রহ জন্মেছে, ব্যাস এইটুকুই এবং তা একান্তই ব্যাক্তিগত।
আগে লিখেছি বইটির নাম আর প্রচ্ছদ দেখে অবাক হয়েছিলাম। এর কারণ, একের পর এক বেস্টসেলার বইয়ের পরে সাধারণত যা হয়, যে কোনো লেখকেরই একটা লেখার প্যাটার্ন তৈরী হয়ে যায়, একটা বাধাঁছকের মতো এবং পাঠকের প্রত্যাশাও সেরকমই থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি, এবং নিজেকে ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে এরকম একটি অসাধারণ এবং পুর্বের লেখাগুলির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার একটি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেবার জন্য লেখকের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। এই বাঁধাছকের বাইরে বেরনোর যে প্রবল ইচ্ছা তাকে যথাযোগ্য সন্মান জানাই।
এই অসাধারণ, রোমাঞ্চকর, ইতিহাসের পটভুমিকায় লেখা মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারটি পড়ার অনুরোধ জানাই সবাইকে।
কাজের সুত্রে বহুবার মেদিনীপুর গেছি আমি... না, মূল শহরে গিয়ে ওঠা হয়নি তবে স্বয়ং বিদ্যাসাগরের সেই বীরসিংহ গ্ৰামে গেছিলাম একবার... মা বলে মেদিনীপুর জেলা নাকি তাঁ আশীর্বাদধন্য আজও... তাই ঐ জেলার প্রতিটি সন্তান খুব মেধাবী হয়... কে জানে... অবশ্য আরেকটা যোগাযোগ থেকে গেছে আমার সাথে মেদিনীপুরের.... আমার আদি নিবাস মেদিনীপুর... যদিও আমি কষ্মিনকালেও সে জায়গা চোখে দেখিনি... তবুও শুনেছি তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ভারতের বহু বিপ্লবী নায়কের সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার পরিবারের... ঐ পাড়ার ছেলেপিলে... যা হয় আর কি... এটুকুর অংশীদার ভেবেই এতকাল গর্বে বুকপেট ভরে যেতো আমার... একটা অযথা খামোখা দেশপ্রেম মার্কা মনোভাব তৈরি হতো ভেতর ভেতর... হ্যাঁ খামোখা বলছি কারণ এই প্রেমের সিকিভাগ গুরুত্ব বোঝার ক্ষমতাও ভগবান আমায় দেওয়ার সুযোগ পাননি... স্বাধীন দেশে বসে পরাধীনতার গ্লানি বোঝা অত সহজ নয়...
একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আছি আসলে... চোখের সামনে শুধু কয়েকটা জায়গার নাম, মানুষের নাম, গুলির কানফাটানো আওয়াজ ছাড়া কিছু শুনতে বা দেখতে পাচ্ছি না... ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৩০ সালের ঐ একটা বিমর্ষ দিনকে কেন্দ্র করে একটা সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবীর ছবি এঁকেছেন লেখক... একটা জেলা নাম মেদিনীপুর... বাংলার বাঘা বাঘা বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে সেখানে ব্রিটিশদের ইমারতের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেওয়া একটা সংঘ... নাম, "বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স"... যার নায়ক বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ওরফে অরুণেশ গুপ্ত... এতদিন জানতাম পেটের জ্বালা বড়ো জ্বালা... মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে এগোতে দুবার ভাবে না... কিন্তু স্বাধীনতার জ্বালা.. ??? সে যেন পেটের জ্বালাকেও হার মানায়... স্বাধীনতার সূর্য দেখার জন্য মানুষ যে কতদূর যেতে পারে তা যেন আজ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলাম... ইতিহাস বইতে পড়া মুখস্থ করার সময় এতটাই নম্বর তোলার হিড়িক ছিল যে কোনোদিন সহমর্মিতাটুকুও জন্মায়নি পড়ার সময়... তখন ওগুলো শুধু কতগুলো সাল মনে রাখার ট্রিক ছিল মাত্র.. আজ ঐ অপমানগুলো চামড়ার পরতে পরতে জ্বলছে কাটা দগদগে ঘায়ের মতো... কারণ আজ স্বয়ং ঐ লম্বা কালো বার��ন্দাটায় দাঁড়িয়ে মানুষখেকো জানোয়ার জেনারেল সিম্পসন কে মরতে দেখে যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটা বিপ্লব অনুভব করতে পারছি... চোখের সামনে তিনটে তরতাজা বাচ্চা ছেলেকে মরতে দেখে ঐ আজ আবার ঐ দেশটার প্রতি ঘেন্না জন্মাচ্ছে আর জন্মাচ্ছে নিজেদের প্রতি... ভুল বললাম... ওরা বাচ্চা ছেলে নয়, ওরা ঐ বয়সেই আস্ত একজন গুরুজনের মতো কাজ করেছিল যা গুরুজনদের করার কথা মাথাতেও আসেনি...
এত বিপ্লবের পরিণতি শুধু ইতিহাস বইতে একলাইনে কয়েকটি নাম এবং ইত্যাদি সহযোগে শেষ হয়ে যায়... কেউ মনে রাখেনা এদের, কেউ মনে রাখেনি... শুধু তাদের নামে কতগুলো মেট্রো স্টেশন আর রাস্তা বানিয়ে দিলেই সম্মান আদায় করা যায় না... বরং অপমান হয় চারগুণ... কিন্তু এই পোড়া দেশে মাটির তলায় শুয়ে তারাও হয়তো ভাবছে এই বেশ ভালো আছি... ক্ষুদিরাম বসু আটকে রইলো "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি" গানের মধ্যে. . . কিন্তু আরেক নায়ক... প্রফুল্ল চাকী??? কতজন জানে তাকে??? চেনে কজন তাকে?? ঐটুকু ছেলেটাকে পুলিশ খুন করে তার ধর থেকে মুন্ডুটা কেটে যখন তার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, বল্ এ ছেলে তোদের কিনা... ঐ হৃদয় নিংড়ানো চিৎকার টা কেউ মনে রাখেনি... রাখেনা... পুজো হয়ে গেলে সবাই প্রসাদ খাওয়ার ধান্দাতেই ব্যস্ত থাকে... পুজোর মন্ত্র কেউ কি শোনে মন দিয়ে?? ফলই তো আসল...
ধরুন যদি দীনেশ গুপ্তের সেই বিখ্যাত "থ্রি এইট্টি বোর ওয়েবলি রিভলবার" টার সন্ধান পান এই ২০২২ এ বসে?? হঠাৎ জানতে পারলেন মেদিনীপুরের কোনো এক পোরো বাড়িতে রয়েছে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের খাজানা..আর সেই গুপ্তধনের খোঁজে কিছু অসাধু লোক চক্রান্ত চালাচ্ছে তা হড়পে নেওয়ার..?? এর বিনিময়ে মানুষ খুন করতেও তাদের হাত কাঁপে না...
ঠিক এমনই একটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েন মেদিনীপুর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক শৌনক এবং তার মেয়ে পেখম... আর তাও সম্পূর্ণ না জেনেই নেহাত খেলার ছলে.. রূপেন, শৌনক, প্রতুল, প্রতিমা ছোটবেলার বন্ধু... একসাথে বড়ো হওয়া, খেলা.. তারপর চাকরিসূত্রে বাইরে চলে যাওয়া রূপেনের... প্রতুল গাড়ির ব্যবসা করে, শৌনক একটি কলেজে পড়ায় এবং প্রতিমার বিয়ে হয়ে গেছে অনেক বছর... গরমের ছুটিতে দিদার বাড়ি বেড়াতে আসে প্রতিমার ছেলে দালি... দুপুরবেলা দিদা ঘুমিয়ে পড়ার পর লুকিয়ে চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে সে আবিষ্কার করে দিদার একটা হলুদ হয়ে যাওয়া পুরোনো আঁকার খাতা...যা একসময় দিদার বড়ো দিদির ছিল... বিয়ের পর এবাড়িতে মৃত দিদির একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ দিদা তা নিয়ে আসে... তাও এখন ধুলোবন্দী... দালি দেখলো সেই খাতায় শুধু পাতার পর পাতা কাকাতুয়া আঁকা তাও বিভিন্ন অবস্থায়... আর শেষ পাতায় কাকাতুয়া নেই, দাঁড় খালি... শুধু আবছা একটা মানুষের অবয়ব... শুধুমাত্র কৈশোরের কৌতূহল থেকেই সে সেই খাতা নিয়ে যায় শৌনক মামার বাড়িতে... মামা আর পেখম দিদিকে দেখাতে... আর সেই খাতার মর্মোদ্ধার করতে গিয়েই তিনজনের হাতে চলে আসে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের গুপ্ত চিঠি... যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তারা ফুরিয়ে গেলেও আজও তাদের সম্পদ রক্ষা করে চলেছে এই গুপ্ত সমিতির কিছু গুপ্ত রক্ষক.... সেই রক্ষকই যখন রক্তচোষা ভক্ষক হয়ে ওঠে... গুপ্ত সমিতির প্রোটোকল ভেঙে যখন তার লোলুপ জিহ্বা গ্ৰাস করতে চায় একের পর এক নিরপরাধ মানুষকে... ঠিক তখনই গর্জে ওঠে দীনেশ গুপ্তের রিভলবার.... কীভাবে??? পড়তে হবে তাহলে...এই বই সকলেই পড়ুন আর মুগ্ধ হন।।
আমায় যাঁরা এই বইটি ২০২১ সালে recommend করেছিলেন, তাঁরা দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। উপন্যাসটি সম্পর্কে পাঠকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম তখন। কিছু পাঠক গল্পের প্লট ও রহস্য উপাদানকে প্রশংসা করেছিলেন, আবার কেউ কেউ সমাপতন, কার্ডবোর্ড খলনায়ক এবং শেষের বাস্তব-অধিবাস্তব মেলবন্ধনকে করেছিলেন কঠোর সমালোচনা করেছেন।
আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত? মহারাজের অনুপম ভাষাশৈলী ও ন্যারেটিভ গঠন এবং সর্বোপরি ইতিহাসপ্রেম, এই উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
এই উপন্যাসটি ইতিহাস, রহস্য এবং রোমাঞ্চের মেলবন্ধন। গণিতের অধ্যাপক শৌনক মিত্র, তার মেয়ে পেখম এবং ভাগ্নে দালি মেদিনীপুরের একটি পুরনো বাড়ির চিলেকোঠায় একটি পুরনো ড্রয়িং খাতা এবং বিবর্ণ চিঠি আবিষ্কার করেন। এই সূত্র ধরে তারা ১৯৩০-এর দশকের সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের এক নিগূঢ় অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
এদিকে, রহস্যময় প্রতিনায়ক বিরূঢ়ক, ধর্মভীরু সাহিল আল ফারাজি, নিরুদ্দিষ্ট শিল্পী শ্রীনিবাসন ও তার স্ত্রী দেবলীনা এবং ট্যাক্সি-ড্রাইভার প্রতুলও এই রহস্যের জালে আটকে যান। প্রাণিবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, গণিত, ইতিহাস, চিত্রকলা, কল্পবাস্তবতা, ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং ট্রেজার-হান্টের উপাদানে নির্মিত এই উপন্যাসটি আত্মদানের আদর্শ এবং অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
এই উপন্যাসে একে একে উঠে এসেছে নানাবিধ theme :
১) ইতিহাস ও সমকালীনতা: উপন্যাসটি বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের ইতিহাসকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছে। শৌনক ও তার পরিবারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে অতীতের বীরত্বগাথা বর্তমানের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।
২) রহস্য ও ট্রেজার-হান্ট: পুরনো ড্রয়িং খাতা ও চিঠির সূত্র ধরে গুপ্তধনের অনুসন্ধান উপন্যাসে রহস্য ও উত্তেজনা যোগ করেছে। ক্রিপ্টোগ্রাফি ও ধাঁধার মাধ্যমে পাঠকদের মগ্ন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
৩) মনস্তত্ত্ব ও চরিত্র বিশ্লেষণ: প্রতিনায়ক বিরূঢ়কের জটিল মনস্তত্ত্ব, তার সাপের প্রতি আকর্ষণ এবং সভ্যতার প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসে গভীরতা এনেছে। তার চরিত্রটি পাঠকদের মুগ্ধ ও বিভ্রান্ত করে।
৪) কল্পবাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা: উপন্যাসে কল্পবাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার উপাদান সংযোজন করে গল্পের রহস্যময়তা বাড়ানো হয়েছে। তবে, কিছু পাঠকের মতে, এই উপাদানগুলি গল্পের মূল স্রোত থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
মহারাজ প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য ভাষায় উপন্যাসটি রচনা করেছেন, যা পাঠকদের জন্য সহজপাঠ্য। তবে, কিছু পাঠকের মতে, উপন্যাসের শেষাংশে পরাবাস্তব উপাদানের সংযোজন গল্পের স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।
উপসংহারে এটুকুই বলবো, এই কাহিনী ইতিহাস, রহস্য এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সমন্বয়ে গঠিত একটি অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি। বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই কাহিনী পাঠকদের অতীতের সাথে বর্তমানের সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। যারা ইতিহাস-আশ্রিত রহস্য উপন্যাস পছন্দ করেন, তাদের জন্য এই বইটি একটি ভালো পছন্দ হতে পারে।
দীনেশ গুপ্তের রিভলবার"- বইয়ের নাম এবং প্রচ্ছদ দেখে প্রথমে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। সন্মাত্রানন্দের "নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা" আর "ছায়াচরাচর" পড়ে একটা ধারণা মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো যে আবার ওনার লেখার মধ্যে দিয়ে ফিরে যাব সেই সূদুর অতীতে, শত -সহস্র বছর আগের এক মায়াময় জগতে, এটাই যেন প্রত্যাশিত ছিলো।
কিন্তু তা হয় নি, বইয়ের নামে যতটা চমক, বইটি পড়ার পরেও তার রেশ থেকে যায়। একটি সম্পুর্ণ অন্যধারার লেখা, যার বিষয়বস্তু পুরোপুরি আলাদা তাঁর ইতিহাস সৃষ্টি করা বেস্টসেলার বইগুলির থেকে। "দীনেশ গুপ্তের রিভলবার" মূলত একটি রহস্য কাহিনী বা আরো স্পষ্ট ভাবে বললে একটি ট্রেজার হান্টের গল্প, যা ইতিহাস নির্ভর বটে, কিন্তু কখনোই তা ইতিহাস সবর্স্ব নয়, বরং অসাধারণ সাহিত্যগুণে ভরপুর একটি রোমাঞ্চকর ফিকশন উপন্যাস।
মেদিনীপুর শহরের একটি পুরনো বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে এক পুরনো বাক্সের মধ্যে পাওয়া একটি পুরনো ড্রয়িং খাতা আর হলুদ এবং বিবর্ণ হয়ে যাওয়া চিঠির সুত্র ধরে মেদিনীপুর কলেজের গণিতের অধ্যাপক শৌনক মিত্র, তাঁর মেয়ে পেখম এবং ভাগ্নে দালি (ভালো নাম উদ্দালক) জড়িয়ে পড়ে ১৯৩০-এর সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের এক অধ্যায়ের সাথে এবং সেইসাথে এক ট্রেজার হান্টের রহস্যময়তায়। অন্যদিকে রয়েছে, এই উপন্যাসের একটি রহস্যময় এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র বিরূঢ়ক। বড় অদ্ভুত মানুষ সে, বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত এবং একইসাথে নির্দয় আর নিষ্ঠুর। তার বাড়িতে পোষা নানা ধরনের সাপ এবং ��ে তাদের মধ্যেই যেন বেশ স্বচ্ছন্দ। সভ্যতার সংজ্ঞা তার কাছে বেশ ব্যাতিক্রমী। সাধারণ মানুযের তুলনায় অত্যন্ত জটিল তার মনস্তত্ত্ব। তার অন্তর বিষাদে পরিপূর্ণ, বিষাদজাতক বললেও অত্যুক্তি হয় না। Professor Moriarty কে আশাকরি সবারই মনে আছে, (তুলনা করছি বা মিল খুঁজে পাচ্ছি ভাবলে ভুল ভাবছেন)। এমন একটি চরিত্র যাকে আপনি যতই ঘৃণা করুন তার মেধা আর বুদ্ধিমত্তাকে অগ্রাহ্য করতে পারা যায় না, অবচেতন মনে সম্ভ্রম জাগাতে বাধ্য। বিরূঢ়ককেও তেমনই অপছন্দ হলেও তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না, সে আপনার চিন্তায় বিচরণ করবেই। তাকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। শৌনক, পেখম এবং দালির সাথে বিরূঢ়কও এই রহস্যের জালে জড়িয়ে যায়, কিন্তু কেমন করে - তার উত্তর এই টানটান, উত্তেজনায় ভরপুর এই উপন্যাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। এছাড়াও আছেন , ধর্মভীরু মানুষ সাহিল আল ফরাজি, শিল্পী শ্রীনিবাসন এবং তাঁর স্ত্রী দেবলীনা এবং পাকেচক্রে নিজের অজান্তেই এই রহস্যের বৃত্তে ঢুকে পড়া ট্যাক্সি- ড্রাইভার প্রতুল। এনারা সবাই নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে একসূত্রে জড়িয়ে পরেন। শেষপর্যন্ত তাঁরা কি গুপ্তধনের সন্ধান পেলেন? এবং কিই বা সেই গুপ্তধন? তা জানতে গেলে এই বইটি পড়তে হবে।
আচ্ছা, যদি প্রশ্ন করি ডগলাস, পেডি, বার্জ এরা কারা - কিছু মনে পড়ে কি আপনাদের ? হয়তো কারোর মনে পড়ছে আবছা, কিন্তু অনেকেরই হয়তো পড়ছে না, ইনফ্যাক্ট আমার নিজেরও মনে পড়েনি। এবার যদি জিজ্ঞেস করি শ্রী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, শ্রী বিমল দাশগুপ্ত, শ্রী যতীশ গুহ, শ্রী যতিজীবন ঘোষ, শ্রী প্রভাংশু পাল, অনাথবন্ধু পাঁজা, মৃগেন দত্ত - এনাদের কি মনে পড়ে? হয়তো হ্যাঁ, বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো না। পেডি, ডগলাস, বার্জ এনারা ছিলেন ইংরেজ শাসক, অত্যাচারী এবং প্রত্যেকেই মেদিনীপুর শহরে পোস্টেড ছিলেন। আর শ্রী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, শ্রী বিমল দাশগুপ্ত, শ্রী যতীশ গুহ, শ্রী যতিজীবন ঘোষ, শ্রী প্রভাংশু পাল, অনাথবন্ধু পাঁজা, মৃগেন দত্ত - এনারা প্রত্যেকেই ছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামক বাংলার স্বেচ্ছাসেবক দল এবং ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠী। উপরে উল্লিখিত তিন ইংরেজ শাসকদের এনারাই নিকেষ করেছিলেন। এনাদের ব্যাপারে মনে না পড়া বা না জানার কারণ একটাই, আমরা যে ইতিহাস পড়েছি তা হলো "অফিসিয়াল হিস্ট্রি", এবং সেখানে এনারা ব্রাত্য বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না। ঐতিহাসিক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ভারতীয় ইতিহাস কমিটির প্রধান করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি "অফিসিয়াল হিস্ট্রি" নয় বরং সত্যিকারের ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন, এবং সেই নিয়ে মতবিরোধের জেরে তিনি ইতিহাস কমিটির প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং সরকার মনোনীত শ্রী তারাচাঁদ মহোদয়, সরকারের মনপসন্দ " অফিসিয়াল হিস্ট্রি " রচনা করেন, যেখানে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের বা বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনের সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল গঠন করেন। এই গ্রুপটি বাঙ্গালীর স্বেচ্ছাসেবকদের নামকরণ করেছিল এবং মেজর সত্য গুপ্তের নেতৃত্বে ছিল। তাই পরবর্তীতে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামে পরিচিত হয়।
উপরের প্যারাগ্রাফে লেখা কথাগুলি অনেকেরই হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, এই বইয়ের প্রেক্ষিতে। কিন্তু না, এই বইটির সাথে তা ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। বইটির নাম "দীনেশ গুপ্তের রিভলবার ", দীনেশ গুপ্ত ছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর একজন প্রথম সারির নেতা এবং বিনয় বাদল দীনেশের (বিবাদী) শেষজন। দীনেশ গুপ্ত এবং বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। আগেই বলেছি এই বইটি কিন্তু মোটেই অতীতের ইতিহাস বিষয়ক নয়, বরং বর্তমান সময়ের একটি ফিকশন , এক অদ্ভুত রহস্যময় ট্রেজার-হান্ট, যার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। তবে,এই বইটি পড়ার পর, আমার নিজের বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের বিষয়ে বিশদে জানার আগ্রহ জন্মেছে, ব্যাস এইটুকুই এবং তা একান্তই ব্যাক্তিগত।
আগে লিখেছি বইটির নাম আর প্রচ্ছদ দেখে অবাক হয়েছিলাম। এর কারণ, একের পর এক বেস্টসেলার বইয়ের পরে সাধারণত যা হয়, যে কোনো লেখকেরই একটা লেখার প্যাটার্ন তৈরী হয়ে যায়, একটা বাধাঁছকের মতো এবং পাঠকের প্রত্যাশাও সেরকমই থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি, এবং নিজেকে ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে এরকম একটি অসাধারণ এবং পুর্বের লেখাগুলির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার একটি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেবার জন্য লেখকের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। এই বাঁধাছকের বাইরে বেরনোর যে প্রবল ইচ্ছা তাকে যথাযোগ্য সন্মান জানাই।
এই অসাধারণ, রোমাঞ্চকর, ইতিহাসের পটভুমিকায় লেখা ট্রেজার হান্ট বিষয়ক বইটি পড়ার অনুরোধ জানাই সবাইকে।
"আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।" - বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলার সংলাপের মতোই বলতে ইচ্ছা করছে, "আহা! কি পড়িলাম! জন্মজন্মন্তরেও ভুলিব না।" একটি বই ভালো না খারাপ তার থেকেও বোধহয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বইটি পাঠককে ধরে রাখতে পারছে কিনা। প্রায় ৩৬০ পৃষ্ঠার বইটি মাথা যন্ত্রণা নিয়েও একদিনে, বলা ভালো সন্ধের থেকে রাতের মধ্যে শেষ করে ফেলেছি মানে সেটি যে আমায় মাঝে একবারও উঠতে দেয়নি তা বলাই বাহুল্য। পড়তে পড়তে একদিকে যেমন দালির মতো আমিও চোখের সামনে দেখছি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের, তেমনি অন্যদিকে যেনো বিরূঢ়কের আদল ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বড়োই অদ্ভুত যেনো এই চরিত্রটি। বাকিদের আপনি আপাতভাবে ভালো বা খারাপ একটা ক্যাটাগরিতে রাখতে পারবেন হয়তো, কিন্তু এই বিরূঢ়ক যেনো একটা ধরেও ধরা দেয়না, যাকে ধরে judge করতে গেলেই সে পিছলে বেরিয়ে যাবে আপনার হাত থেকে। গোটা উপন্যাস শেষের পরও আমি একটা জিনিসই ঠিক করতে পারছিনা যে ঠিক কি ভাববো তার সম্পর্কে। একদিনে অঙ্কের জিনিয়াস, অন্যদিকে সাপকে আকর্ষণের জন্য বানাচ্ছে পারফিউম; একদিকে VPN হ্যাক করছে, অন্যদিকে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করছে গড়গড় করে, একাধিক ভাষায় পাণ্ডিত্য তার। এমন একটি চরিত্রকে খারাপ জানলেও মন সেটা সহজে স্বীকার করতে চায়না, হয়তোবা তার এইসব গুণের জন্যই। আর হয়তো আমার মনের এই দ্বন্দ্ব দূর করার জন্যই একদম শেষে সে নিজের প্রাণ বাজি রেখে বাঁচায় বাকিদের, বদলে নিজে হারিয়ে যায় কংসাবতীর চোরাস্রোতের অতল গহ্বরে। হয়তো একদিন সে ফিরবে, একইভাবে অথবা অন্য কোনো ভাবে, অন্য কোনো রূপে। কারণ বিরূঢ়করা যে মরেনা, মানুষের অন্তরেই যে তাদের বাস.....
This entire review has been hidden because of spoilers.
বইটি পড়ার পর একটি মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়েছে। লেখক স্পষ্টতই গল্পের মাধ্যমে অনেক কিছু প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই অতিরিক্ত রিপ্রেজেন্টেশন গল্পের মূল কাঠামোকে কিছুটা জটিল এবং বিভ্রান্তিকর করে তুলেছে। যারা একটি সোজাসাপ্টা, টানটান উত্তেজনাপূর্ণ থ্রিলারের প্রত্যাশা নিয়ে বইটি হাতে নিয়েছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই হতাশ হবেন।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল **সুররিয়ালিজম এবং থ্রিলারের ফিউশন**। যদিও এটি একটি সাহসী প্রচেষ্টা, কিন্তু এই দুটি ধারার মিশ্রণটি গল্পের সাথে সঠিকভা���ে মেলেনি। সুররিয়ালিজমের বিমূর্ত ও গভীর উপস্থাপনা এবং থ্রিলারের সরলতা ও উত্তেজনার মধ্যে ভারসাম্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে সেই ভারসাম্যের অভাব প্রকটভাবে ধরা পড়েছে।
গল্পের ধারণা এবং লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট অভিনব হলেও, এটি একটি থ্রিলার গল্পের জন্য জটিল এবং অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হতে পারে। থ্রিলারের পাঠকেরা সাধারণত একটি সরল, টানটান এবং মনোযোগ ধরে রাখার মতো গল্প আশা করেন। কিন্তু সুররিয়ালিজমের সঙ্গে গল্পের সংযোগ অনেকক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং কৃত্রিম মনে হয়েছে।
যদি আপনি বিমূর্ত ধারণা বা গভীর প্রতীকী ভাবনার প্রতি আগ্রহী হন এবং ক্লাসিক থ্রিলারের ধারা থেকে কিছুটা আলাদা কিছু খুঁজে থাকেন, তবে এটি আপনার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হতে পারে। তবে যারা একটি সহজবোধ্য থ্রিলার পড়তে চান, তাদের এই বইটি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
**শেষ কথা:** লেখকের কল্পনাশক্তি এবং ফিউশন তৈরির প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়, তবে গল্পের সামগ্রিক নির্মাণ এবং পাঠকের প্রত্যাশার সাথে এটি সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি।
ইতিহাস, ফ্যান্টাসি আর ট্রেজার হান্ট মিলাইয়া লেখক এক খিচুড়ি রান্না করিয়াছেন যা খাইয়া আমার বদহজমের উদ্রেক হইতেছে।
গণিতের অধ্যাপক শৌনকের হস্তে যেরূপ কাকতালীয় ভাবে রহস্য সমাধানের হাতিয়ারেরা ছুটিয়া আসিতেছিল তাহাতে কাহিনির গতিবেগ বারংবার রুদ্ধ হইয়াছে বলিয়া আমার মনে হয়। গীতার শ্লোক সহযোগে ধাঁধা নির্মাণ কিংবা কেরানীতলা অর্থ যে রাইটার্স বিল্ডিং এই দুর্ভেদ্য সমাপতন যিনি করিতে পারিলেন তিনি ই কিনা "ফিবু নাচে' অর্থ ফিবোনাচ্চি সিরিজ হইতে পারে তা কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া মধ্যরাত্রে ভাঙাচোরা নেটওয়ার্ক পার হইয়া পার্থসারথি মানে কোন এক পার্থদাকে ফোন করিয়া উদঘাটন করিলেন! অথচ তিনি নিজেই গণিতের অধ্যাপক!
যাহারা আপাদমস্তক ফ্যান্টাসি রচনা করিয়া থাকেন পাঠকের কাছে বোধ করি জবাবদিহিতার কিছু থাকেনা তাহাদের। কারণ নিজেদের নির্মিত জগতেই তাহারা বিচরণ করেন। কিন্তু সন্মত্রানন্দ উপন্যাসের শেষে যে কাল্পনিক "ইম্প্রেশন সুড়ঙ্গ" এর অবতারণা করিলেন কিংবা দালি বা প্রতুলের যেরূপ টাইম ট্রাভেল এর বর্ণনা করিলেন তাহার কোন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করিলেন না ইহা আমার দুর্বল পাঠক হৃদয় মানিয়া লইতে পারিল না। অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা এবং অপ্রয়োজনীয় চরিত্র যেমন দালি আর প্রতুল চরিত্র দুটি লেখক চাহিলেই বর্জন করিতে পারিতেন।
বাংলাদেশে থাকিবার কারণে মুসলিম বন্ধু ও পরিচিতের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু লেখক সাহিল চরিত্রের মাধ্যমে আরবী ফারসি শব্দ সহযোগে যেরূপ মুসলমান সমাজের চিত্র আকিবার প্রচেষ্টা করিয়াছেন তাহাতে যথেষ্টই ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ "হোম ওয়ার্ক" করা লেখকের জন্য উচিত ছিল।
থ্রিলার রচনায় কারণে অকারণে ইতিহাস আর জটিল তথ্যের আহ্বান আজকাল অনেক লেখকের মাঝেই দৃশ্যমান। তাহাতে জিলাপি হয় কিন্তু থ্রিলার নয়। সাহিত্যের কঠিনতম ঘরানার একটি থ্রিলার - ইহা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত মাত্র। কাজেই আটঘাট আর কোমর বাঁধিয়াই তাহাতে নিবৃত্ত হওয়া প্রয়োজন।
চলতি সময়ের আরেকটা আলোচিত বই। সম্মাত্রানন্দ বেশ পঠিত। তার বই প্রশংসিতও। নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা পড়ে আমি মোটামুটি ইম্প্রেসড ছিলাম তবে একটা পর্যায়ে 'একটু ঝুলে যাওয়া' সমস্যা ছিল। এরপর আর কিছু পড়া হয় নাই তবে মনে হইছিল ভদ্রলোকের ভাষা ঠিকঠাক। বর্তমান বইটারে 'রহস্য কাহিনী' বলা যাইতে পারে তবে রহস্য এখানে খুব একটা জমে না। সম্মাত্রানন্দ টাইমলাইনের কারিকুরি করে একটা কনফিউজিং অবস্থা তৈরি করতে ভালো পারেন তবে রহস্য জমানোর বিষয়টা তার এখনো আসে নাই, এই বই অন্তত তা-ই বলে। কেননা স্টোরির বহু জায়গায় ধরে ফেলা গেছে রহস্য। এমনকি এরপর কী হবে তাও নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। সেদিক থেকে দীনেশ গুপ্তের রিভলভার ভালো রহস্য কাহিনী না। তবে অন্যান্য (সদ্য পঠিত) রহস্য কাহিনীর চেয়ে এটার ভাষা ভালো। লেখক দৃশ্যকল্প তৈরি করতে চান বর্ণনার মাধ্যমে এবং সেটা তিনি করতে পেরেছেন। বর্ণনার এই জায়গায় এখনকার রহস্য কাহিনীগুলো পিছিয়ে। তবে ব্যক্তি মনের জটিলতা সম্মাত্রানন্দ এই বইয়ে আনতে চাইলেও সেটার উপস্থাপন দুর্বল। আর দালি (একটা পিচ্চির নাম) চরিত্রর মধ্য দিয়ে আবারো টাইমলাইনে অতীত আনার পুরনো চেষ্টাটা না করলেও হইত। রহস্য কাহিনীর মধ্যে বিপ্লবীদের পরিচয় করানো যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, সেটা মোটামুটি সাধিত হলো। তবে এই রকম বর্ণনা (ইতিহাসের) সম্ভবত কিশোররাই পছন্দ করবে।
"তথাগতর পট খুলে যায়, ফিবু নাঁচে শর্টে হদিস পাবেই, যদি তোমার বুদ্ধি থাকে ঘটে"
সন্মাত্রানন্দের "নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা" পড়ে যাদের দন্ত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিলো তারা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে এই বইটি পড়তে পারেন। নাস্তিক পণ্ডিতের দুরূহ ভাষার ব্যবহার এখানে নেই, বরঞ্চ আছে চমৎকার প্রাঞ্জল ঝরঝরে লেখনি। দু'টি বইয়ের লেখক যে একই এটা ভাবতেই অবাক লাগে। একটুও বোরিং লাগার কোনো সুযোগ নেই, রীতিমতো পেইজ টার্নার! ১৯৩০ এর ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটিতে কি নেই ?? গণিত, ইতিহাস, চিত্রকলা, দর্শন, ক্রিপ্টোগ্রাফি, জাদু-বাস্তবতা, ট্রেজার হান্ট সবমিলিয়ে এক বিচিত্র সমারোহ। যারা এখনো বইটি পড়েননি, ট্রাই দিয়ে দেখতে পারেন, আশা করি হতাশ হবেন না।
ভীষণ ভীষণ ভালো লাগল। সংগ্রহে রাখার মতো বই।আমাদের বাংলার সশস্ত্র সংগ্রামের কথা প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে,তার উল্লেখও আমরা তেমনভাবে পাইনা। এই বই সেই ঘটনাগুলো আবার করে মনে করিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল যেন চোখের সামনে সব ঘটে চলেছে।
সন্মাত্রানন্দ স্যারের লেখা পড়লে অদ্ভূত ঘোরের সৃষ্টি হয়। এই লেখাগুলো বাংলা সাহিত্যে অনন্তকাল জীবিত থাকবে। ভাবতে ভালোলাগে আমরা সেই সৃষ্টির সাক্ষী থাকছি।
👨🏻💻📌২০২৪ এর প্রথম #পাঠপ্রতিক্রিয়া 📖: দীনেশ গুপ্তের রিভলভার ✒️: সন্মাত্রানন্দ 🖨: ধানসিড়ি 🔖: ₹525 (এপ্রিল '22 সংস্করণ)
🌻গত জানুয়ারিতেই বইটি পড়া শেষ করেছি। এখন পড়ছি ওঁর লেখা বিখ্যাত বই 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা'। 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা' পড়তে গিয়ে আমাকে প্রায়ই বাংলা অভিধানের সাহায্য নিতে হচ্ছে, অনেক নতুন নতুন শব্দ শিখছি, উপন্যাসটি অনুভব করে সময় নিয়ে পড়ছি। তুলনায় দীনেশ গুপ্তের রিভলভার অনেক সহজ ভাষায় লেখা এবং বেশ টানটান একটি উপন্যাস। ইতিহাস, বর্তমান এবং কল্পনার একটি ভালো মিশ্রণ রয়েছে এতে। আমার পড়ে বেশ ভালোই লেগেছে।
🌻আপনাদের সন্মাত্রানন্দের লেখা কেমন লাগে এবং ওঁর লেখা কোন বইটি আপনার সবচেয়ে প্রিয় আমাকে কমেন্টে জানান। আগাম ধন্যবাদ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত, বিপ্লবী দিনেশ গুপ্তের বিখ্যাত রিভলবারকে কেন্দ্র করে গল্প গড়ে উঠলেও, শেষভাগে অতিরঞ্জিত কল্পনা ও অবাস্তবিক অশরীরী উপস্থিতি কোথাও যেন আলগা করে দেয় গল্পের বাধন। ক্রমাগত ঘটনাবলীর মুহুর্মুহু সমাপতন বেশ কিছুটা খেলো ও শীর্ণকায় করে তোলে কাহিনির মজবুত প্রেক্ষাপটকে। শুরু থেকে সমগ্র ইতিহাস ও বর্তমানের সহাবস্থানে কিঞ্চিত অতিরিক্ত লবণাক্ত করে অত্যধিক শব্দচয়ন। লেখকের ভাষা প্রয়োগ উপর্যুপরী যথার্থ হলেও জায়গা ভিত্তিতে অপ্রয়োজনীয় বলে ঠাওর হয়। এ বাদে, স্বাধীনতার ইতিহাসে বাংলার আনত অবদান সম্পর্কে শিহরণ জগতে, এই উপন্যাসের জুড়ি মেল ভার।