What do you think?
Rate this book


232 pages, Paperback
First published April 1, 2015
"১২০০ হইতে ১৪৫০ অব্দের মধ্যে বাঙ্গালা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন তো নাই-ই, বাঙ্গালা ভাষারও কোনো হদিশ পাওয়া যায় না।"—ডঃ সুকুমার সেন।
‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ বইটির কাহিনি আবর্তিত হয় চৌদ্দশ সালের হারিয়ে যাওয়া বেগবতী নদীর পার্শ্ববর্তী বল্লালগ্রামকে ঘিরে—যা আবার কালের পরিক্রমায় ‘পঞ্চমুণ্ড’ থেকে ‘পাঁচমুড়ো’ নাম নিয়েছে। পাঁচমুড়ো গ্রামের বহু পুরোনো চয়নবিলের তলা থেকে একদিন আবিষ্কৃত হলো পাথরে খোদাইকৃত ১৪০০ সালের কথ্য ভাষায় ও লিপিতে লেখা ‘পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য’।
কিছুদিন আগের ভূমিকম্পে চয়নবিলের নিচে থাকা চোরাগুহার মুখ ফেটে যাওয়ায় গুহা থেকে অনেক শিলালিপি এবং পাথরের খণ্ডাংশ বেরিয়ে আসতে দেখেন পাঁচমুড়োরই জমিদার সদানন্দ ভট্টাচার্য। ইংরেজ আমলে তার বাবার রমরমা পুঁথিব্যবস্যার দরুণ সদানন্দ নিজেও একজন দক্ষ পুঁথি বিশারদ। বাবার কাছেই তিনি এবং তার সৎভাই চিদানন্দ, পুঁথি যাচাইয়ের সকল দীক্ষা নেন। কিন্তু একসময় বুড়ো সদানন্দকে ধোঁকা দিয়ে চিদানন্দ বেশ কিছু প্রাচীন পুঁথি আর মূল্যবান নিদর্শন নিয়ে কলকাতা পারি দেয়। সদানন্দ যেতে পারেন না, তিনি থেকে যান এই পাঁচমুড়োর জমিদার বাড়িতে, পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে। আর তাই ব্যবস্যার এমন মন্দায় চয়নবিলের তলা থেকে অকস্মাৎ শিলালিপি ভেসে ওঠায় সদানন্দ যেন লক্ষ্মী হাতে পেলেন! লোকমুখে চলে আসা পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যের মিথ আর শিলালিপিতে থাকা বাংলা ভাষার নমুনা দেখে এর মূল্য বুঝে উঠতে বিচক্ষণ সদানন্দের একমুহূর্তও দেরি হলো না। বাংলাসাহিত্যের এই দুর্মূল্য নিদর্শন বিদেশের মাটিতে সর্বোত্তম উপায়ে সংরক্ষণের ইচ্ছা কিংবা নিজের পকেটের পোয়াবারো দেখার লোভ, যে কারণেই হোক না কেন, সদানন্দ খবর দিলেন ‘লন্ডনে নিজের মিউজিয়াম থাকা’ ডঃ ধাড়াকে। সদানন্দ ডঃ ধাড়ার সাথে এসব নিয়েই কথা বলছিলেন এমন মুহূর্তে সেখানে এসে হাজির কালাচাঁদ পণ্ডিত ওরফে কালাচাঁদ চোর। চোর বলতে ঠিক সিঁদ কেটে ঢোকা চোর নয়, কালাচাঁদের কাজ জালপুঁথি বিক্রি এবং আসল পুঁথির হাতবদল। একাজে যে সে খুব পারদর্শী, এমনটাও নয়। এই যেমন শেষবার যখন সে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে লালশালুতে জড়ানো ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের একটা পুঁথি বগলদাবা করে নিয়ে তিরের বেগে পালাতে গেল, অমনি সদ্য সাবান-পানিতে মোছা সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে শেষতক এক বেলা হাসপাতালে এবং তারপরের তিনমাস জেলে কাটাতে হলো। তবে এবেলায় তার চৌর্য-ইন্দ্রিয়ের জোরেই কালাচাঁদ বুঝে ফেললো সদানন্দ এবং ডঃ ধাড়া যা নিয়ে আলাপ করছেন তার বাজারমূল্য নেহায়েতই কম হবে না! আর তাই সুযোগ বুঝে সদ্য তুলে আনা শিলালিপিটা থেকে উদ্ধারকৃত বাংলা ভাষার সম্ভাব্য সেই পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যের চরণদুটো অন্তঃকরণে চটপট তুলে নিয়ে সোজা চলে এলো হরু ঠাকুর আর তার ভাগনে-বদনের বাড়িতে। সেযুগের ম্যানুয়াল পুঁথি-ফটোকপিয়ার এবং বর্তমানে সেসব নকলে সিদ্ধহস্ত হরু ঠাকুর তার এযাবতকালের অভিজ্ঞতা দিয়ে তৎক্ষণাৎ চরণদুটির ছন্দ উদ্ধার করে ফেললেন। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিলো যখন অঙ্কে পারদর্শী এবং সদ্যপাশকৃত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বদন সেই চরণদুটো থেকে আবিষ্কার করে ফেললো ছন্দের সাথে অঙ্কের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ! শব্দের অভাবনীয় কারুকার্যে লুকিয়ে আছে হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত অঙ্কের নানান সূত্র। ছন্দ আর অঙ্ক যেন তাতে পাখির ডানার দুটোদিক, ���কপাশে অঙ্ক তো আরেকপাশে ছন্দ নিয়ে সেই পাখি যেন সাহিত্যের অন্ধকার আকাশে আলোর সন্ধানে উড়ে চলেছে!
আমি শুরুতেই বলেছি এটি একটি থ্রিলার। কিন্তু এতদূর এসে পাঠক হয়তো ভাবছেন এখানে থ্রিল কোথায়? সদানন্দ-ডঃ ধাড়া-কালাচাঁদ-হরু ঠাকুর আর বদনের এই চক্রে থ্রিল নিয়ে আসে আরবের এক পাগলা শেখ, যে নিজেকে পরিচয় দেয় আল-খোয়ারিজমি নামে। প্রাচীন নিদর্শনের অবৈধ কেনাবেচাকারী ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া চক্রের বড়ো চাঁই এই শেখের প্রাচীন পুঁথি দিয়ে নিজ সংগ্রহশালা সুসজ্জিত করার কোনো সদিচ্ছা নেই, বরং সেসব হাতে পেলেই সে তা ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তাই অর্থলোভী ডঃ ধাড়া যখন শেখকে পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যের আবিষ্কারের কথা জানালো, তখন লেখকের ভাষ্যে,
“কুর্ম অবতারের পিঠে মেদিনী যেন দুলে উঠলো।”ডঃ ধাড়ার কথা শুনে কালাচাঁদ এবং হরু ঠাকুরও গিয়ে পৌঁছালো সেই শেখের ডেরায়। সেখানেই নিজের বেঈমান দালালের বুকবাহিত রক্তের স্রোতে দাঁড়িয়ে শেখ হুমকি দিল, "সাতদিনের মধ্যে আমার পঞ্চাননমঙ্গল চাই। না হলে—"। আর ঠিক এখান থেকেই আবিষ্কারের সাদাসিধে গল্পটার ভোল পাল্টে জীবনমরণের দোলাচলে থাকা টানটান উত্তেজনার থ্রিলার হিসেবে যাত্রা শুরু।
উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র কালাচাঁদ পণ্ডিত উপন্যাসটির অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ছিল আদ্যোপান্ত। চরিত্রটির গঠন বেশ নিরীক্ষণধর্মী, লেখকের যত্নের ছাপ এতে স্পষ্ট। লেখক এই চরিত্রকে ভালো-খারাপের বাঁধাধরা ছাঁচে ফেলতে চাননি, কিংবা বোকা-চতুরের কাঠগড়াতেও ফেলেননি। সময়ের প্রয়োজনে থরে থরে কালাচাঁদ নানা আঙ্গিকে পাঠকের সামনে আসতে থাকে। কখনো সে কার্যসিদ্ধির জন্য আচারের তেলকে মহামাঁষের তেল বলে সদানন্দকে পট্টি পড়ায়, তো কখনও বুড়ো সদানন্দের হরিণের মাংস আর দেরাদুন চালের ভাতের তৃপ্তিভোজে বিপত্তি বাঁধানোয় আক্ষেপ করে। কখনো সে বদনের অঙ্কের বই নিয়ে পালায় তো কখনো বদনের ব্যবস্যার জন্য নিজের ভাগের সব টাকা দিয়ে দেয়। কালাচাঁদ চরিত্রের এমন ধোঁয়াশা আবহই পুরো উপন্যাসকে আরও সুখপাঠ্য এবং বাস্তবিক করে তুলেছে।
এরপর চলে আসে সদানন্দ ভট্টাচার্যের কথা। পাঁচমুড়োর একসময়ের প্রতাপশালী জমিদারের সর্বশেষ বংশধর হিসেবে সদানন্দ বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। জমিদারি ঠাঁটবাট বর্তমানে না থাকলেও তার ব্যক্তিত্বকে এসবের কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, বাইরের শক্ত খোলসের ভেতরে থেকেও তার চরিত্রের নানান কোমল দিক উঠে এসেছে উপন্যাসের পরতে পরতে। তিনি কখনও কালাচাঁদকে শংকর মাছের চাবুকটা দিয়ে পেটানোর হুমকি দিয়েছেন, তো আবার ক্রোধের মাত্রা কমে এলে নিজেকে সামলাতে ঠিকই বলে উঠেছেন, "তোর হরিণের মাংসের দামটা দিতে ভুলে গেছিরে কালা।" টাকার লোভে ডঃ ধাড়ার কাছে পুঁথি বেচতে যাওয়া থেকে ভুল বুঝতে পেরে নিজের মূল্যবোধে অটল থেকেই কালাচাঁদকে সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে সদানন্দের চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ পরিস্ফুটন হয়েছে।
এছাড়া হরু ঠাকুর, বদন, ডঃ ধাড়াসহ অন্যান্য চরিত্রগুলো উপন্যাসের সাথে বেশ ভালোভাবে মিশে গেছে। কোনো চরিত্রকে উটকো বা গল্পে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়নি।
ভাষা-ইতিহাসের প্রতি দূর্বলতা থাকলে এমন একটা নিরীক্ষাধর্মী এবং তথ্যবহুল বই শেষপাতে মিষ্টির মতো মনে হয়। বইটির সবথেকে আকর্ষণীয় দিক হলো এর হালকা আমেজ এবং সকৌতুক পরিবেশনা। খুব সাধারণ কিছু ঘটনাও লেখকের বুদ্ধিমত্তা এবং ভাষার কারুকার্যে বেশ আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে। যেমন কালাচাঁদ, হরু ঠাকুর আর বদন—এই তিনটি চরিত্রের নাম নিয়ে বেশ মজার একটা অংশ আছে। তিনজনকে প্রথম দেখে সদানন্দ বলেন,
তা বেশ করেছে, নচেৎ বামে কালাচাঁদ, মধ্যে হারুচন্দ্র, ভাগ্নে বদন যদি চাঁদ জোড়ে তাহলে তো এই ক্যাটক্যাটে সকালে আমার বাড়িতে চাঁদের হাট বসে যাবে।
“কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভূতপূর্ব প্রধান অধ্যাপক প্রয়াত ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল থেকে একশোটি নতুন চর্যাপদ ১৯৬৩ সালে সংগ্রহ করে আনেন। এই চর্যাগুলির সন্ধান তিনি পান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর আর্নল্ড বাকেরের কাছ থেকে। ডক্টর বাকের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে ডঃ দাশগুপ্ত কুড়িটি চর্যাপদ টেপ রেকর্ডারে তুলে নিয়ে আসেন।”
নিরীক্ষাধর্মী এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যনির্ভর এই হিস্টোরিকাল ফিকশনটি বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম মাইলফলক। ছোটোবেলার রসকসহীন ইতিহাসের বুলি মুখস্ত করে প্রজন্মের পর প্রজ���্মে ইতিহাস নিয়ে যে বিতৃষ্ণা জন্মেছে, তার তিতকুটে স্বাদ কমাতে বইটি মধুর মতোই কাজে দেয়। বইটি পড়ার পর যে কারো বাঙালি এবং বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ তৈরী হবে। সেইসাথে বইয়ের শেষ কয়েক পাতায় সংযুক্ত রেফারেন্সসমূহ জ্ঞান-অন্বেষণের কাজটা আরেকটু সহজ করে দেয়। এছাড়া বইয়ের মলাট, কাগজ, বাঁধাই সবকিছুই অত্যন্ত মানসম্মত। বিশেষভাবে প্রচ্ছদের জন্য দেবাশীষ রায়েরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। বইয়ের প্লট এবং কাহিনিবিন্যাসের সাথে এর থেকে ভালো প্রচ্ছদ হয়তো করা সম্ভব হতো না।