দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দাবাড়ুর গল্প। দেশজুড়ে তখন রক্ত-অশ্রু-বারুদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। অধিকৃত দেশে চলছে শত্রু খোঁজার মরিয়া অভিযান। দুই দাবাড়ু একে অপরের বিরুদ্ধে দিতে থাকেন ঘুঁটির সূক্ষ্ম চাল। তাঁদের তিক্ত দ্বৈরথ দাবার বোর্ডের ৬৪ খোপের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।
জন্ম ১৯৭৩, ডােমার, নীলফামারী। বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি করলেও প্রধান ঝোঁক গল্প-উপন্যাসে। বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি ও রহস্যকাহিনি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত।
শিবব্রত বর্মনের ‘শোধ’ আগাগোড়া আনপুটডাউনেবল। উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছে ষাটোর্ধ্ব ইতিহাসের প্রফেসর আফসান চৌধুরী আর অঙ্কের তরুণ প্রফেসর ফিরোজ বেগের দাবার লড়াই। ৬৪ খোপে ‘লাইফ অ্যান্ড ডেথ’। আসলে তো বাঁচা চৌষট্টি খোপে সাদা কালোর খেলায়।ঘোড়া ছুটছে আড়াই চালে..হাতি বেড়াচ্ছে দাপিয়ে..নৌকা তরতরিয়ে এগোচ্ছে..মন্ত্রী চোখ রাঙাচ্ছে ইচ্ছেমতো।চক্রব্যূহে নাভিশ্বাস। এদের খেলা দেখতে আসেন কাজী মোতাহার হোসেন, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতো কিংবদন্তীরা। শুরুটা ওয়ালজের মন্থর তালে হয়েও কিন্তু দুইজনের এই দ্বৈরথ ৬৪ খোপে আটকে থাকে না। একে অন্যকে কাত করার দুর্বিনীত মানসিকতা অবিস্ফোরিত গ্রেনেডের মতো সর্বনাশের বীজ ছড়িয়ে দিতে থাকে। পরস্পরের একেকটা আঘাতে আহত অশ্বের মতো লাফায় ফিরোজ বেগ কিংবা আফসান চৌধুরী। এই কাহিনীতে দাবার প্রসঙ্গ ছাড়াও খোলামকুচির মতো ছড়ানো ওয়ার স্ট্র্যাটেজি,পাকিস্তানের তৎকালীন চলচ্চিত্র জগৎ,সিনেমা-রেডিওর সাথে জড়িত তারকারা,সিনেমাহলের হারানো ভূগোল,৭০ এর নির্বাচন পরিস্থিতি, ৭১ এ টর্চার শেলের অভিজ্ঞতা সব মিলেমিশে একাকার। ছোট একটা লেখা অথচ সেই সময়টার দর্পণ হিসেবে কাজ করছে যেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সেই বেরহমি বাতাসটাকে গ্রাফিকালভাবে উপস্থিত করেছেন লেখক। প্রকৃতপক্ষে তার দাবা গল্পটার এক্সটেনশন হলেও কমিউনিকেটিভ ধারার ন্যারেটিভ এক মুহূর্তের জন্যও বোর করে না। যতটা সময় গড়ায়,পরিস্থিতির আনসার্টেইনিটিগুলো পেয়ে বসে। আফসান চৌধুরী আর ফিরোজ বেগের মধ্যকার ঠাণ্ডা যুদ্ধ স্নায়ুছেঁড়া উত্তেজনাকে উসকে দিতে থাকে। উপন্যাসের সংলাপ লক্ষ্য করার মতো শক্তিশালী,ম্যাচিউর। হ্যালুসিনেশনের অংশগুলো সাটলি গ্রাফিক। বিশেষত সমাপ্তিতে লেখকের পরিমিতিবোধ মুগ্ধ করে। শিবব্রত বর্মন জানেন কোথায় থামতে হবে। শাণিত পরিমিতিবোধের কারণে লোভ সংবরণ করতে পারেন। ছোট্ট এই উপন্যাস বারবার মনে করিয়ে দেবে, ‘All wars are fought twice. The first time in the battlefield, the second time in memory.’বারবার ফিরে আসা যাবে শুধু একারণেই।
৪.৫ তারা। দুর্দান্ত! এত ছোট্ট পরিসরে, মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাসিকায় যেভাবে দাবার ইতিহাস, যুদ্ধের সময়কার বুদ্ধিজীবি সমাজের খণ্ডচিত্র আর চমৎকার চরিত্রায়ণ দেখিয়েছেন শিবব্রত বর্মন, তা লেখক হিসেবে তার শক্তিমত্তারই পরিচয় দেয়। বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে আপনার হয়তো নিজেকে মনে হবে আফসান চৌধুরী বা ফিরোজ বেগ। প্রতিটি চালের সাথে বাড়তে থাকবে বুকের ধুকপুকানি।
সাড়ে চার তারা। অনায়াসে পাঁচ তারা দেয়া যেত, কেন দিলাম না জানি না। শিবব্রত বর্মন আমার বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রিয় লেখক। উনার গল্প সাজানোর ধরন খুবই ভিন্ন। মস্তিষ্কের পরীক্ষা নিয়ে ছাড়ে অনেক সময়। শোধ নভেলাও ভিন্ন কনসেপ্টেই লেখা। এই গল্পের গ্লিম্পস ছিল সুরাইয়ার প্রথম গল্পে। ওটারই বিবর্ধিত ভার্সন এটা। কি বলব একে? রিভেঞ্জ থ্রিলার নাকি ড্রামা! দুইজন ফুলটাইম দাবাড়ু পার্ট টাইম প্রফেসরের দাবার দ্বৈরথ নিয়ে লেখা গল্পটা, তবে এই দ্বৈরথ দাবার বোর্ড ছেড়ে বাইরে চলে যায়। দাবার বোর্ডের মতোই চাল দিতে থাকে একে অপরের জীবনে? কে জেতে? পড়লেই বুঝতে পারবেন। বইটা পুরোপুরি উপভোগ করেছি। ভালো সময় কেটেছে। দুই দাবাড়ুর দ্বৈরথে নিশ্চিত জয়ী পাঠক।
"দাবা" কোনো স্পোর্ট না।দাবা একটা আর্ট।" "কাদের মধ্যে?" "দুটি ইতিহাসের মধ্যে।"
গতবছর প্রথম আলো'র ঈদসংখ্যায় পড়েছিলাম। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর আবার পড়লাম এবং মুগ্ধতার পরিমাণ দ্বিগুণ হলো। "শোধ" আদ্যোপান্ত ফর্মুলামাফিক লেখা। অনেকে "ফর্মুলা"র ঘোর বিরোধী। কিন্তু সঠিকভাবে লেখা হলে ফর্মুলা কতোটা কার্যকর হতে পারে এই উপন্যাসটি তার একটি উৎকৃষ্ট নমুনা। শুরুতেই বোঝা যায় ঘটনা কোনদিকে গড়াবে, কিন্তু শিবব্রত বর্মন পাঠককে চুম্বকের মতো টেনে রাখেন; তার সরল, সাবলীল, আত্মবিশ্বাসী গদ্য দিয়ে। চরিত্রদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ, একাত্তরের সময়কার বাস্তবানুগ বিবরণ আর ধারালো সংলাপও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরিণতি অবধারিত, অনুমেয় কিন্তু লেখার গুণে সেটাও দুর্নিবার আকর্ষণ নিয়ে পাঠ করি আমরা।
দুই প্রধান চরিত্রকে দ্বিতীয় পাঠে মনে হয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী। আফসান চৌধুরী বাঙালি, বন্ধুত্বপূর্ণ, নিরীহ; দাবা তার কাছে শুধুই শৈল্পিক খেলা। কিন্তু ফিরোজ বেগের কাছে দাবা প্রতিযোগিতা ও চূড়ান্ত অহং প্রদর্শনের ক্ষেত্র। সেই অহংয়ে আঘাত লাগলে সে হয়ে ওঠে প্রতিশোধপরায়ন এবং ডেকে আনে নিজের ধ্বংস। সে আফসান চৌধুরীকেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বাধ্য করে। দুই চরিত্রের সমান্তরালে থাকে দুই দেশ আর তাদের পরিণতি। মাঝখানে সূত্রধর হিসেবে থাকে দাবা। ভুলে গেলে চলবে না "দাবা ইজ কোল্ড ওয়ার। ইউ লাইক ইট অর নট।" আর "শোধ" পুরোটাই দাবার মতো তীব্র এক স্নায়ুযুদ্ধ।
দাবা, শুধু একটি খেলা নয়। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, যেখানে প্রতিটি চালই একেকটি কৌশল, একেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি। কিন্তু যদি কেউ এই খেলাকে যুদ্ধ হিসেবে না দেখে? যদি তার কাছে এটি হয় চিন্তার বিনিময়? শক্তির নয়, বরং বোঝাপড়ার এক মাধ্যম।
শিবব্রত বর্মনের শোধ বইয়ে দুই প্রতিভাবান দাবাড়ু আফসান চৌধুরী ও ফিরোজ আহসান বেগ, একই খেলায় দাঁড়িয়ে দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি। পাকিস্তানের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন ফিরোজ দাবাকে দেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ হিসেবে, যেখানে জয়ই একমাত্র সত্য। কিন্তু আফসানের কাছে দাবা কোনো যুদ্ধ নয়, বরং একধরনের আর্ট অব কনভার্সেশন।
তাই যখন ফিরোজ আফসানকে চ্যালেঞ্জ জানায়, একের পর এক গেমে পরাজিত হতে হয় তাকে। নড়বড়ে হয়ে যায় তার অহংকার, পরাজয় তাকে ক্রমশ অস্থির করে তোলে। কিন্তু আফসান ফিরোজকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না, বরং দয়া-ই দেখায়, পরাজয়ের পর তাকে সঙ্গ দেয়, শেখায় দাবার অন্যতম জটিল ব্লাইন্ডফোল্ড চেস। সম্পর্কটা যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে অন্যকিছুর দিকে মোড় নেয়, অদ্ভুত এক টানাপোড়েনের জন্ম দেয়।
কিন্তু দাবার এই লড়াই ধীরে ধীরে চৌষট্টি ঘরের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালের অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে গল্প, যেখানে কেবল দাবার ঘুঁটিগুলো নয়, বাস্তব জগতেও শুরু হয় এক রক্তাক্ত খেলা। যুদ্ধ যখন দাবার ছকের বাইরে গড়িয়ে যায়, তখন বোঝা যায় এই খেলার পরিণতি শুধু জয়-পরাজয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আরও গভীর, ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে।
শিবব্রত বর্মন আমার বেশ পছন্দের গল্পকার। 'বানিয়ালুলু' আর 'সুরাইয়া' গল্পগ্রন্থের ছোটগল্পগুলো পড়ার পর দারুণ সব কনসেপ্ট, সাবলীল লেখনী আর সেগুলার দূর্দান্ত সন্নিবেশ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। অনেকদিন তার লেখা পড়া হয় না। তাই প্রথমা প্রকাশন থেকে তার নতুন বই 'শোধ' প্রকাশিত হয়েছে দেখার পর, ��াম বেশি হওয়া সত্ত্বেও কিনতে দ্বিধা করি নি।
'শোধ' বইটা হলো তার লেখা 'দাবা' গল্পটার বিবর্ধিত নোভেলা রুপ। শিবব্রত বর্মনের প্রায় সব লেখা-ই কনসেপ্টবেসড। 'সুরাইয়া' বইয়ের 'দাবা' গল্পটাতে শোধের ছোট কিন্তু সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট অংশটা ছিল। সেটার ইন্টারেস্টিং পার্ট ছিল বোর্ড, গুটি ছাড়া নিজের মাথার মধ্যে একাধিক জনের সাথে কোনোভাবে চাল জানিয়ে দিয়ে দাবা খেলাটা, ব্লাইন্ডফোল্ড চেস যাকে বলে। আমার দাবার এইরূপ নিয়ে কোনো আইডিয়া ছিল না দেখেই কিনা, গল্পটা পড়ার সময় বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
'শোধ' বইয়ে লেখক অনেকগুলো ইন্টারেস্টিং কনসেপ্ট নিয়ে এসেছেন। তবে এর মূল কনসেপ্ট কিংবা থিম হলো দাবা এবং বাস্তব বিশ্বের মধ্যে একাধিক প্যারালাল সম্পর্ক তৈরি করা, বিশেষ করে ডেটা অ্যানালাইসিসের ভিত্তিতে। বাস্তব জগতে সাধারণ কোনো ঘটনা অনেক বড় বিপর্যয় বা অসংখ্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে, ঠিক যেমন দাবাতে একটি চাল বদলে দিতে পারে পুরো গেমের গতি। এই ধারণা প্রদর্শনের জন্য লেখক বিড়াল মিক জ্যাগারের ঘটনাকে "বাটারফ্লাই এফেক্ট" হিসেবে দেখিয়েছেন, যার চেইন অব ইভেন্টস হিসেবে 'শোধ'এর বাকি ঘটনাগুলো ঘটেছিল। এই বিষয়টা ছোট একটি ঘটনা কীভাবে বড় প্রভাব ফেলতে পারে, তা বোঝাতে সাহায্য করে।
আফসান চৌধুরী চরিত্রটি ইতিহাসের যুদ্ধের কৌশল নিয়ে দারুণ আগ্রহী। তিনি কার্ল ভন ক্লজেভিটসের অন ওয়্যার বই কিংবা ফিল্ড মার্শাল রোমেলের ওয়ার ট্যাকটিকসের বড় ভক্ত। তাই দাবার ক্ষেত্রে তার মূল মনোযোগ থাকে মনস্তাত্ত্বিক এবং কৌশলগত বিশ্লেষণে। আবার পাকিস্তান আর্মির কর্নেল নাদিম, একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার যে কিনা তথ্য বা ডেটার প্রতি অস্বাভাবিক রকমের অবসেসড। এই চরিত্রের মাধ্যমেই তথ্য বিশ্লেষণের শক্তি সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন লেখক। এছাড়া আরও নানাভাবে তথ্য বিশ্লেষণ আর কৌশলগত চিন্তার ভিত্তিতে দাবা এবং বাস্তব পৃথিবীর মধ্যকার সাদৃশ্যের একটা চিত্র শিবব্রত বর্মনের 'শোধ' প্রদান করে।
লেখক এবারে যেহেতু গল্পটা একটু বড় পরিসরে লিখেছেন, তাই চরিত্র, দৃশ্যপ্রবাহ, সমাপ্তি কেমন হবে তা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। যেহেতু লেখকের বড় বই কিংবা উপন্যাস আগে কখনো পড়া হয় নাই। কিন্তু তেমন কোনো সমস্যা এতে ছিল না, লেখক বেশ ভালোভাবেই বইয়ের সব ঘটনাপ্রবাহ গড়ে তুলেছেন তার মিলিমানিস্টিক স্টাইলের প্রাঞ্জল গদ্যের দ্বারা। একারণে পুরো বইটি সুখপাঠ্য, একবসায় পড়ে ফেলা যায়। প্রধান দুই চরিত্রের গঠন বেশ ভালো হয়েছে, আর তাদের মধ্যকার ডায়নামিকটা দূর্দান্ত। সেইসাথে তাদের চরিত্রায়ন পোক্ত করতে প্রভাবক হিসেবে পার্শ্বচরিত্রগুলোর ব্যবহারও দারুণ।
গল্পে মূল কনসেপ্টের বাইরেও আরো নানান ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেগুলো অনেক উপভোগ্য আর চিন্তার খোরাক জোগায়। সেইসাথে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতিটাকেও মোটামুটি ভালোভাবেই গল্পে আনা হয়েছে, আর বইয়ের মূল থিমের সাথে সেটার কানেকশানটাও ভালো।
সমাপ্তিখানা খারাপ না। বিশেষ করে লেখকের অন্যান্য গল্পের মতো এতেও ওপেন এন্ডিং রাখা হয়েছে, তবে সেটা এসেছে অনুমানযোগ্য হলেও একটা ভালো টুইস্ট আর সেটার বিশ্লেষণের পর। এইজন্য এই বইকে লেখকের ছোটগল্পগুলোর মতো শেষ হওয়ার আগেই হইয়া গেলো শেষ মনে হবে না। যদিও আরও বড় হলো না কেন সেই আক্ষেপ রয়েই যাবে। আমি চাই, 'শোধ' এর মতো লেখকের অন্যান্য গল্পও (বিশেষ করে 'বানিয়ালুলু'র অনেকগুলা) এভাবে নোভেলা বা উপন্যাস আকারে লেখা হোক। কারণ অনেকগুলো গল্পই স্রেফ কনসেপ্ট হয়ে আটকে আছে, চাইলেই যেগুলো বিস্তৃত করে লেখা যায় আস্ত উপন্যাস অথবা নোভেলা। আর এই বই থেকেও ঊনলৌকিক এর মতো ভালো ওটিটি কন্টেন্ট বানানো যাবে।
📚 বইয়ের নাম : শোধ
📚 লেখক : শিবব্রত বর্মন
📚 বইয়ের ধরণ : সাইকোলজিক্যাল ড্রামা, পেরিওডিক্যাল ফিকশন
পঁচিশের বইমেলা থেকে পড়া প্রথম বই। সুুরাইয়া'র দাবা গল্পের এক্সটেন্ডেড ভার্শন। দাবা খেলতে পারি না বলে সিংহভাগ মজা মিস করবো ভেবেছিলাম। শিবব্রত বর্মণ দয়াল লেখক, চমৎকার সাবলীল গদ্যে টেনে নিয়ে গেলেন আশি পৃষ্ঠা। দাবা নিয়ে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলেও এই নভেলা পড়া যায় বিনা টেনশনে বা লজ্জায়। খুবই ইন্টারেস্টিং প্লট, উইটের অভাব নাই। আর আছে লেখকের পরিমিতিবোধ। দাবা আর মুক্তিযুদ্ধ মিলিয়ে যে একটা কাহিনি তৈরি করা যায়, আগে ভাবতে পারি নাই।
শেষ দশ পাতা'য় মন খারাপ হইলো কিছুটা। সত্যিই আনপ্রেডিক্টেবল এন্ডিং। কিন্তু ইট কুড হ্যাভ বিন সামথিং বেটার।
চার তারার সাথে আরো কিছু ভগ্নাংশ টগ্নাংশ যুক্ত হবে।
বইটা কেনার আগে আমি শুনেছি, বইটা "মারাত্মক" এবং কেনা উচিত কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে আমি শুনেছি "বিলকুল"।
বইটা আসলেই খুব সুন্দর লাগলো। চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেছে প্রথম লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত।
বাঙালি অধ্যাপক আফসান চৌধুরী। ইতিহাস পড়ান। দাবা খেলতে পছন্দ করেন, তবে প্রতিযোগিতা হিসেবে নয়, তিনি এই খেলাকে ভাবেন একটা আর্ট, "আট অব কনভারসেশন"। কাদের মাঝের কথপোকথন? "দুটি ইতিহাসের মধ্যে"।
পাকিস্তানি অধ্যাপক ফিরোজ বেগ, জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন। দাবাকে ভীষণ সিরিয়াসলি নিয়ে বাচেঁন। নিয়তির বিধানে এনারা পরস্পরের মুখোমুখি হন। তারপর অপ্রত্যাশিত কিছু হতে থাকে।
এরই মাঝে দেশে নামে মুক্তিযুদ্ধ। দাবার বোর্ড থেকে খেলোয়াড় চলে গেলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। খেলা একসময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ইতিহাস কি খেলোয়াড়কে ক্ষমা করে???
শিবব্রত বর্মনের আকর্ষণীয় লেখনীর প্রতি ভালো লাগা "বানিয়ালুলু" থেকে। এখানেও খুব ঝরঝরে বর্ণনায় ঐতিহাসিক চরিত্রদের ভিড়ে গল্প ফেঁদেছেন। মাঝে সেরা কিছু কথা বলেছেন। যেমন:
"আসল মে জংগ দো ফিরকো কে দরমিয়ান নেহি হোতি। জংগ দো ইয়াদোঁ কে দরমিয়ান হুয়া করতা হ্যায় বাচ্চে, ইট ইজ ফট বিটুইন টু মেমোরিজ। অ্যান্ড হোয়েন দ্য ফাইট গোজ অন, ইয়াদেঁ বাদাল যাতি হ্যায়।"
যুদ্ধকৌশল নিয়ে লেখকের আগ্রহ/জ্ঞান এখানে আসায় ব্যক্তিগতভাবে ভালো লেগেছে।
উপন্যাসটি ছোটগল্পের এক্সটেনশন, ভিতরে উপন্যাসের ফিলিংসটা পেয়েছি টপনচ কিন্তু শেষমেশ ছোটগল্পই রয়ে গেছে এমন মনে হয়েছে। গল্পে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সীমিত কিন্তু মোট চরিত্রের সংখ্যা কম নয়, তবে প্রাণবন্ত সংলাপ আর আঁটসাঁট বর্ণনাতেই চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পটা। বিশেষত চরিত্রগুলোর সংলাপে যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা নামকরা চিত্রনাট্যকারদের দ্বারাও কঠিন। তবে এলিট ক্লাসের চরিত্রগুলোর ডেইলি রুটিনের ভিতর সত্তরের উত্তাল সময়টা টের পাওয়াটা কঠিন; আসলে লেখকও সেদিকে বাড়তি শব্দ ব্যয় করেননি। কাহিনী নিয়ে কিছু বললাম না যেহেতু আকারে খুব ছোট। তবে আমি আশা করেছিলাম গল্পটা হয়ত হিরো-ভিলেন টাইপ রিভেঞ্জ স্টোরি না হয়ে ভিন্ন কিছু হবে। সেটা না হলেও রোমাঞ্চকর মোমেন্টগুলো বেশ উপভোগ্য। তবে খানিকটা পড়ার আর একটু খ��ঁটিনাটি তথ্যের দিকে খেয়াল রেখে যা প্রেডিক্ট করেছিলাম তার সিংহভাগই মিলে যাওয়ায় আপসেট হয়েছি।
এইটুক একটা নভেলা সাইজ বই এভাবে আটকে রাখবে জাস্ট আনবিলিভেবল। এই জন্যেই কথায় আছে, খেলাকে খেলা হিসেবেই দেখা উচিত। দুর্দান্ত এক্সিকিউশন।
জাফর আহসান বেগ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক, দাবায় অদ্বিতীয়। তার জয়ের ঝান্ডা থেমে যায় ইতিহাসের এক প্রফেসর আহসান চৌধুরীর কাছে। যিনি দাবা খেলেন জাস্ট মনের আগ্রহ থেকে। কোন টুর্নামেন্টের জন্য নয়। সময়কাল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার অল্প কিছু আগের সময়টা। দ্বৈরথ জমে উঠে। খেলা চলে যায় আরেক লেভেলে।
গরম গরম মেলার বই হিসেবে পড়ে ফেললাম শিবব্রত বর্মনের নতুন বই 'শোধ'।
বইটাকে একেবারে ব্লাইণ্ড চয়েস বলা যাবে না, যেহেতু শিবব্রত বর্মন নতুন রাইটারদের মাঝে মোটামুটি হেভিওয়েট নাম। তার আগের দুটো গল্প সংকলনের বই 'বানিয়ালুলু' আর 'সুরাইয়া'র সব গল্প ভালো না লাগলেও বেশিরভাগই লেগেছে। তবে গল্প ভালো লাগা থেকেও যেটা বেশি ভালো লেগেছে সেটা হলো, ওনার এক্সক্লুসিভ গল্প ইটসেলফ। মানে প্লটগুলা একদমই অন্যরকম, ভাবনা চিন্তার উদ্রেক ঘটায় প্লাস বেশ খানিকটা ভাবায়ও। সেই হিসেব করে 'শোধ' নেয়া, অ্যাজ ইউজ্যুয়্যাল বই কেনা বা পড়া শুরু করার আগে বা পরে জানতাম না বইটা কী নিয়ে।
বইয়ের প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময়কার। তবে আপাতদৃষ্টিতে কিংবা গল্প শুরু করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটা খুবই প্রচ্ছন্নভাবে টের পাওয়া যায়, অতোটা জোরালো না। মানে এইটা মুক্তিযুদ্ধের টাইমের গল্প হইলেও মেইনস্ট্রিম মুক্তিযুদ্ধের গল্প না। এইখানে গল্পটা আবর্তিত হইছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি শিক্ষক ও তাদের পরিবারের মধ্যে। তবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির সেটাপ এই বইতে ১২ হাত কাঁকুড় হইলে দাবা হইতেছে ১৩ হাত বিচি। মানে দাবা, দাবা আর দাবা। দাবাকে কেন্দ্র করে না, দাবাকে পরিধি বানায়েই ৮৮ পৃষ্ঠার এই গল্পবৃত্তের এরিয়া।
গল্পের যুগপৎ কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের প্রৌঢ় প্রফেসর আফসান চৌধুরী আর গণিত বিভাগের ইয়ং প্রফেসর (নাকি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর খেয়াল নাই) ফিরোজ আহসান বেগ। ফিরোজ সাব তৎকালীন পাকিস্তান ন্যাশনাল দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয়বারের মতো কেবল চ্যাম্পিয়ন হইছেন। বাঙালি, ইয়ং পোলা বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্র্যাটেজিক্যাল একটা খেলায় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হইছে, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অহমিকা তার অলংকরণ হইয়্যা আছে।
আর ওদিকে আফসান সাব এইসব টুর্নামেন্টে খেলেন না, তবে তিনি যে দুর্দান্ত খেলেন এইটা সকলে জানেন। ঘটনাচক্রে ফিরোজ সাব চ্যালেঞ্জড হইলো আফসান সাবের সাথে খেলতে এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি তাকে হারাইতে। কিন্তু... কী ভাবতাছেন? নাটকে যা হয় তাই তো হবে, মানে ফিরোজ সাব আসলে তারে হারাইতে পারবে না, গো-হারা হাইরা বইসা থাকবে আফসান সাবের কাছে? শুধু যদি এইটুক ভাইবা থাকেন তাইলে ভুল করতেছেন। এইখানে এই বাইরেও আরো অনেক কিছু আছে। মনে রাইখেন, উপন্যাসিকার সেট আপ ১৯৭১ সাল আর 'দাবা একটা হিংস্র খেলা। যে বোঝে, সে জানে।' বাকিটা বই থাইকাই জাইনা নিয়েন।
শিবব্রত বর্মনরে এর আগে দেখছি সাই ফাই টাইপের গল্প লিখতে। এইখানে ডিরেক্ট সাই ফাই না বইলা সাই ফাই টাইপের বললাম কারণ উনি আসলে ঠিক সায়েন্সের গল্প বলতে চান না। মানে গল্পে সায়েন্সের উপাদান থাকলেও আমার কাছে কখনো ফিকশন হিসেবেই ধরা দিছে, কখনো ধরা দিছে দর্শনের একটা সুক্ষ্ম ইঙ্গিত নিয়া। আবার কখনো সুররিয়েলিজমের একটা সুর শোনায়ে গেছে।
এই বইটা অবশ্য বেসিক্যালি অমন কিছুই না, এইটা মূলত ফিকশনই মনে হইছে আমার। তবে এত ছোটো পরিসরেও চমৎকার চরিত্রায়ন, দাবার টুকটাক স্ট্র্যাটেজি, খানিকটা ইতিহাস ফিকশন বইটারে বিভিন্ন সাবজনরায় ফালাইছে। আর গল্পটা পড়তে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই আমি একটা উত্তেজনা ফিল করতেছিলাম। এক্সাক্ট পেজ টার্নার না হইলেও একটা সাসপেন্স যে ছিল সেইটা স্বীকার করতেই হবে। আর ক্ল্যাইমেক্সের শুরুটা দুর্দান্ত হইলেও শেষটা আরো একটু সময় নিয়ে করলে মনে হয় আরো বেশি ভালো লাগত। তবে এন্ডিংটা ভালো হইছে, অন্তত আমার ভালো লাগছে।
বইটার প্রকাশক প্রথমা, মুদ্রিত মূল্য ২৭৫ টাকা। বইয়ের সাইজ ছোটো হওয়ায় এক বসায় শেষ কইরা একটা তৃপ্তি পাওয়ার কথা পাঠকের।
ওহ ভালো কথা, এইটার প্রচ্ছদ সব্যসাচী মিস্ত্রির করা। উনি যে ওনার সিগনেচারের বাইরে ডিফারেন্ট টাইপের প্রচ্ছদও করেন সেইটা এই প্রচ্ছদ না দেখলে জানতাম না।
আমার কাছে বইটা বেশ ভালো লেগেছে। সত্যি বলতে, অনলাইনে হাইপ দেখেই বইটা নিয়েছিলাম, এবং পড়ার পর কোনোভাবেই ওভাররেটেড মনে হয়নি। প্রায় এক বসায় শেষ করার মতো বই। ৯০ পৃষ্ঠার কম এই বইয়ে লেখক দুর্দান্তভাবে এই উপমহাদেশের দাবার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, এবং সর্বোপরি রিভেঞ্জ থ্রিলারের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। লেখকের ছোটগল্প পড়া হয়েছে—সেই হিসেবে বলবো, উনার লেখা আমার বেশ পছন্দ। তবে শোধ উপন্যাসিকা হিসেবে চাইলে বইটা আরও বড় হতে পারতো—এটাই আফসোস। সব মিলিয়ে, দাবার চালে সাজানো এই থ্রিলারটি আমার বেশ ভালো লেগেছে।
দাবা খেলা নিয়ে বিস্তর স্মৃতি আছে আমার জীবনে। সেই স্মৃতির একটা খন্ডাংশ আমি ফিরে পেয়েছি এই বইটা পড়তে গিয়ে। দাবা খেলার হাতে খড়ি আমার ছোট মামার সাথে, তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। শেখার কিছুদিন পর দেখা গেল মামাকে আমি অনায়াসেই হারিয়ে ফেলছি। তারপর মেজো মামা, খালাতো ভাই এরাই ছিল আমার দাবার সঙ্গি। যতটুকু পারি ঠিক গর্ব করার মতো না। কিন্তু আমাদের স্কুলের এক দাবাড়ু চ্যাম্পিয়নের সাথে হঠাৎ করে মজার ছলে বসে পড়লাম খেলতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাটা কাত। তাও পরপর দুবার। মজার ব্যাপার, এরপর সে আর কখনো আমার সাথে খেলতে বসেনি। আমারও কখনো স্কুলের দাবা চ্যাম্পিয়নে নাম দেওয়া হয়নি। ভীষণ ভয় পেতাম তখন। বাস্তবতা হয়তো এরকমই।
লেখক শিবব্রত বর্মন যে গল্পটাকে এতো চমৎকার করে লিখবেন আমি সত্যিই আশা করিনি। রোলারকোস্টার রাইডে চড়েছিলাম মনে হচ্ছিল পুরোটা সময়। পাঠকের জন্য গল্পের নামটাই একটা স্পয়লার। নামটার জন্য আমি টুইস্টটা আগেভাগেই ধরে ফেলেছি। তবুও অসাধারণ লেগেছে। এই বইমেলার অন্যতম ভালো লাগার বইয়ে পরিণত হলো এইটা।
শিবব্রত বর্মনের 'শোধ' পড়ার পর যেন এখনো সেই ঘোরের ভেতর আছি। দাবা, যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা, নৃশংসতা— সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর উপন্যাস! এর আগে লেখকের 'বানিয়ালুলু' এবং 'সুরাইয়া' পড়ে তাঁর লেখনীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় ছিলাম উন্মুখ হয়ে। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিনি উপহার দিলেন এক অনবদ্য উপন্যাস 'শোধ'। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো, মনে দাগ কেটে যাওয়া এক অসাধারণ উ���ন্যাস!
দুই দাবাড়ু প্রতিদ্বন্দ্বী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রৌঢ় অধ্যাপক আফসান চৌধুরী এবং গণিতের তরুণ অধ্যাপক ফিরোজ বেগ। ফিরোজ বেগ অল পাকিস্তান ন্যাশনাল চেস চ্যাম্পিয়ন। তিনি দাবাকে শুধুই খেলা নয়, একে প্রতিযোগিতা মনে করেন। আর প্রতিটি ম্যাচ তাঁর কাছে এক যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিপক্ষকে তিনি শত্রু হিসেবে দেখেন, আর জেতাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। অন্যদিকে, আফসান চৌধুরী একজন বইপ্রেমী সাধারণ দাবাড়ু, যার কাছে দাবা মানে আনন্দ। তিনি প্রতিপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বন্ধু ভাবেন। তাঁর কাছে দাবা হলো দুইজন মানুষের মধ্যে আর্ট অব কনভারসেশন। একজন লড়াই করে জয়ের জন্য, আরেকজন খেলে আনন্দের জন্য—একই খেলা, কিন্তু দুই রকম দৃষ্টিভঙ্গি।
তবে শুধু দাবা খেলার মধ্যে এই উপন্যাসের চৌহদ্দি সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই উপন্যাসের সম্পৃক্ততা রয়েছে। দাবার প্রতিযোগিতা আর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ— দুটি যুদ্ধই এখানে যেন একই সুতোয় গাঁথা। একদিকে দাবার বোর্ডে চলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অন্যদিকে বাস্তবের রণাঙ্গনে গর্জে ওঠে মুক্তির লড়াই। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, দুই পক্ষের— একজন পশ্চিম পাকিস্তানের, অন্যজন পূর্ব পাকিস্তানের। দাবার চালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি কৌশল যেন প্রতিফলিত করে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তেজনা, প্রতিটি চাল একেকটি মরণপণ আক্রমণের প্রতিচ্ছবি। বোর্ডের গণ্ডি পেরিয়ে সেই লড়াই বাস্তবের মাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে— যেখানে জীবন আর স্বাধীনতার প্রশ্নে চলে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই।
এই উপন্যাস পড়ার জন্য আপনাকে দাবা খেলায় পারদর্শী হতে হবে না। 'শোধ' এক অসম্ভব টানটান উত্তেজনার গল্প, যা আপনাকে প্রথম পাতা থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবে। শিবব্রত বর্মনের অসাধারণ লেখনীতে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য।
বইটির সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলেছে সব্যসাচী মিস্ত্রির করা দারুণ প্রচ্ছদ। বাঁধাই থেকে শুরু করে পৃষ্ঠা, ফন্ট— সবমিলিয়ে প্রডাকশন কোয়ালিটি ভালো হয়েছে।
একজন গল্পকথক কতখানি ভাল সেটা বুঝা যায় তার গল্পের পরিবেশ সৃষ্টির সামর্থ্য দেখে। উঁচুমানের একজন গল্পকথক এমনভাবেই পরিবেশটা গড়ে তোলেন যে, পাঠককে আর কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় না, বরং নিজেই গল্পের অংশ হয়ে যায়। এই বইটাতে লেখক সেটা করতে পেরেছেন। পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হবে তিনি নিজেই যুযুধান দাবাড়ু, ভাবতে শুরু করবেন পরের চালটা কি হবে, চেয়ারের কিনারায় সরে আসবেন খেলার পরিণতি জানার জন্য। আর খেলাটা যখন দাবার বোর্ড ছেড়ে বাস্তবে চলে আসবে, ভাবতে চাইবেন কিভাবে জেতা যায় এই খেলায়। দাবার মত একটা নীরস খেলার বর্ণনাও যে এতটা টানটান হতে পারে তা ভাবা-ই যায় না। তার সাথে মিশে গেছে মনোজগৎ, সমাজ, রাজনীতি, যুদ্ধ, জাতিভেদ, আর মানুষের চিরকালীন ধ্বংসাত্মক অহংকার। শেষ পাতাটা বন্ধ করে পাঠক আবিষ্কার করবেন, এতক্ষণ স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাসও নিচ্ছিলেন না। থ্রিলার না হয়েও এই লেখা থ্রিলারের চেয়েও বেশি। তবে বইটা মাস্টারপিস হতে পারলো না শেষের তাড়াহুড়োর কারণে। দাবা খেলার বোর্ডের যুদ্ধটা যখন বাস্তবে নেমে আসে, সেখান থেকে আরো যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে গল্পটা শেষ করা যেত। যে অংশটা হতে পারতো সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক, সেটাই হুড়োহুড়ি করে শেষ করে দেয়া হলো ১ পৃষ্ঠার মাঝে। লেখক কি ছোটগল্পের মত সমাপ্তি চেয়েছিলেন? চাইলেও আমার কাছে সেটা খাপছাড়া লেগেছে। তারপরেও বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব আর দুর্দান্ত গল্প বলার কারণে বইটা অবশ্যপাঠ্য, এবং নতুন লেখকদের জন্য একটা স্টোরিটেলিং মাস্টারক্লাস।
ঢাবির ইতিহাস বিভাগের বুজুর্গ শিক্ষক আর গণিত বিভাগের তরুণ শিক্ষকের দাবা দ্বন্দ্ব। সময়ের অভাবে প্রথমে ১ পাতা পড়ে রেখে দিয়েছিলাম, তখন টাইমলাইন ছিল ১৯৭০ এ। টাইমলাইনে ট্রাঞ্জিশন আসলো, ৭১ উঁকি দিলো। সবশেষে শোধ নেয়া হলো, বাস্তবে ফিরলাম। ৭১ নয় মূলত "শোধ"ই ছিল এই নভেলার একক উদ্দেশ্য, ৭১ শুধু পথ তৈরি করেছে, উপসংহারে যাওয়ার পথ সুগম করেছে। কিন্তু লেখক যা উপস্থাপন করেছেন তাতে কোনো কিছুরই গুরুত্ব কমে যায়নি কখনও। স্বল্পদৈর্ঘ্যে এক চমৎকার গল্প (দাবার কৌশল, যুদ্ধের বিশ্লেষণ.. নাইস!) বলেছেন শিবব্রত বর্মন, আসলে চমৎকার কিছু হওয়ার জন্যে বাহুল্যের যে দরকার নেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
(তবে মজার বিষয় হচ্ছে কাহিনী শেষ হওয়ার পর ব্রেন অটো একটা কাজ করলো, দেখলাম শাহরুখ খান প্রীতির চারদিকে ঘুরান্টি দিতেছে আর সুরেলা কণ্ঠে বলতেছে "তুম ভুলা না সাকোগি ও আন্দাজ হু" হায়রে ব্রেনের রিফ্লেক্স!)
After finishing the book, I let out this laugh of pure satisfaction. I swear I haven’t felt this way after reading a Bangla book in, like, a million years! Thank youuu, sir! I freaking loved it!
I haven’t read Banialulu or Suraiya yet — I own them, but I just haven’t been in the right mood. And I have to be in a certain headspace to read certain books, you know? Otherwise, no matter how good the book is, I just can’t get into it.
And look — everyone’s already said everything there is to say about this book. So I’ll just say one thing. Recently, this one clownish advisor told us that ’71 is a lie. That nothing even happened in ’71. While I was reading that small scene in the book where the army’s brutality is described, just a tiny moment, my whole body crawled. Literal chills down my spine. And all I could think was, what if that bastard had been in that exact place? How would he react?
Even if it’s a fiction, make that mf read this book. Maybe he’ll learn something!
গল্পের বই ভেবে রাখা বই যখন উপন্যাসিকা হয়, তখন চমৎকার লাগে। আবার এতো কমের মধ্যেই এতো গল্প বলা চলে,সেটা অবাক করার মতোনই। একে তো দাবার উত্তেজনা আবার যুদ্ধকেন্দ্রীয় আবহ নিয়েও ছোটখাটো থ্রিলারের মতোন ফিল, স্পেশালি শেষের দিকে। একবসাতেই শেষ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই রিভিউটি তে ব্য��্তিগত স্মৃতিচারণের কথা লেখা আছে। সুতরাং পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলে ভালো হয়।আপনার জন্যেও, আমার জন্যেও। দাবা আমার পছন্দের খেলা না। লুডোও না। ক্যারাম ও না। তাস ও না। যেই খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী কোনরকম ভীতি আর সংশয় ছাড়া চোখের সামনে বসে থাকে সেরকম কোন খেলায় আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নাই। জীবনে দাবা খেলা একবার ই মনযোগ দিয়া দেখেছি । ছোটবেলায়। পিতৃদেব একবার দাবার বোর্ড আর ঘুঁটি জিতলেন তার অফিসের পিকনিকে অনুষ্ঠিত লটারিতে। মাতা যারপরনাই বিরক্ত হলেন। তিনি নিজে একটা বিশাল ফিরনি সেট জিতেছেন। ভেবেছিলেন স্বামী আর পুত্রটি যদি আরো কিছু কাজের জিনিস ঘরে আনতে পারে তাহলে বেশ হয়। কিন্তু ভাগ্যদেবতা অতটা কৃপা করেন নাই। স্বামী পেয়েছিলেন দাবা আর সন্তানের কপালে জুটলো একটা সাবানের কেস। তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বিড়বিড় করে বললেন ''পাগল ছাগলের ভাগ্য আর কত ভালো হয়!'' সন্তান অপমান হজম করতে পারলেও স্বামী পারলেন না। বাসায় এসেই ওপেন চ্যালেঞ্জ ''সারাজীবন তো খেলছো বোনদের সাথে লুডো, দাবা খেলার তুমি বুঝো কি! এই বস্তু খেলার জন্যে যেইগুলা লাগে সেইটা তোমার এবং তোমার বংশে কারোর মধ্যেই নাই আমি শিওর'' - তাই নাকি? সেগুলো কি? - বুদ্ধি ও ধৈর্য্য। - আচ্ছা তা তোমার থাকলেই হলো। - হ্যাঁ এখন তো এই কথা বলবাই। - তো কোন কথা বলবো? - সাহস থাকলে দাবা খেলো আমার সাথে। - না। - জানতাম। (আমি নিজেও প্রতিশোধের আগুনে জাজ্বল্যমান ছিলাম। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না ভেবে মাঝখান থেকে বললাম ''তাহলে তো শুধু বুদ্ধি আর ধৈর্য্য না। সাথে সাহস ও নাই। খুবই দুঃখজনক। একের ভেতর তিন। তুমি তো মা বৃত্তি গাইড'') সন্তানের সামনে পিতৃদেব যেমন অপমান হজম করতে পারেন নাই । মাতৃদেবীও পারলেন না। খেলা হলো। আমাদের যে আসলেই পাগল ছাগলের কপাল সেটা জননী একবার না দু দুবার প্রমাণ করলেন। পিতৃদেব বাজে ভাবে হারলেন। প্রথমবার হতভম্ব। দ্বিতীয়বার মানসিক ভাবে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো ''আর খেলে কাজ নাই । তার চেয়ে চলো একটা কোদাল নিয়ে দুইটা গর্ত করে পিতাপুত্র দুইজনেই ঢুকে যাই।'' শিক্ষাবোর্ডের লোকজন জানতে পারলে পাটিগনিতে পিতাপুত্রের বয়স নির্ণয় করা অংকের বিষয়বস্তুর এটলিস্ট একটু চেঞ্জ তো আসবে। দেশ আর দশের এই উপকার টা অন্তত আমরা করতেই পারি। জননী কিন্তু শুধু দাবায় জিতলেন না। দ্বিতীয়বার তিনি খেলতে রাজী হন এই শর্তে এইবার জিতলে একটা ওভেন কিনে দিতে হবে। আমার ওভারকনফিডেন্ট পিতা বিগিনারস লাক আর নিজের অনেকদিন চর্চা নাই ভেবে সেই শর্তে সেকেন্ড থট না দিয়েই রাজী হয়ে গেলেন এবং একটু পরেই নিজের কনফিডেন্স ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ধূলোয় তীব্র অবহেলায় গড়াগড়ি দিতে দেখলেন। পরের দিন দাবার বোর্ড আর ঘুঁটি দুই ই পাওয়া গেলো আবর্জনার ঝুড়ি তে। স্বাভাবিক। ঐদিন থেকে দাবার প্রতি আমার ভক্তি শ্রদ্ধা সব উঠে গেলো।আমি ইন্টারেস্ট ও হারিয়ে ফেলি। হাতি ঘোড়া নৌকা মন্ত্রী নিয়ে সাদা কালোর একে অপরের উপর হাস্যকর ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া! ধুর! যত্তসব রেসিস্ট মার্কা খেলা! আচ্ছা রিভিউ লিখতে গিয়ে কিসের প্যাচাল শুরু করলাম! তা শোধ উপন্যাস হিসেবে খারাপ নয়। যথেষ্ট উপভোগ্য। কেন? কারণ খেলাটা বোর্ড এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ওখান থেকে উঠে আসে বাস্তব জীবনে। পাকিস্তানের ন্যাশনাল দাবা চ্যাম্পিয়ন ফিরোজ বেগ, সামান্য এক ইতিহাসের মাস্টার আফসান চৌধুরীর কাছে দাবায় হারে। বারবার হারে । নিজের অহমিকার এমন মৃত্যু আর মৃত পিতার অহেতুক পুনর্জন্ম সে হজম করতে না পেরে অন্যদিক দিয়ে আফসান চৌধুরীকে হারানোর পরিকল্পনা করে। ঘরের ভেতরের খেলা আর ঘরের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে না। কিন্তু কিস্তি? খেলোয়ার হিসেবে দুইজন ই ভালো। শেষ পর্যন্ত কিস্তি কে দিবে?
যে কোন খেলার সাথে দাবা খেলার পার্থক্য কোথায় জানেন? ক্রিকেট বলুন, ফুটবল বলুন বা আর দশটা খেলায় প্রতিযোগিতার সঙ্গে চলে হৈ-হুল্লোড়, প্রতিযোগিদের রাগ, আনন্দ, হতাশা প্রকাশ, শব্দের চালাচালি। দাবা খেলায় এসব চলে না। দুজন প্রতিযোগী প্রায় নিঃশব্দে নেমে পড়েন ছোট্ট একটা বোর্ডের যুদ্ধের ময়দানে। যেখানে গোলাগুলি চলে না। দক্ষ সার্জন মস্তিষ্কের অপারেশন করার সময় শান্তভাবে নিষ্কম্প হাতে যেভাবে স্ক্যালপেল চালান ঠিক তেমন শান্ত, নিস্তব্ধ, বরফের মতো শীতল চিন্তাভাবনা করে নেয়া বুদ্ধির গোলা ছুড়ে দেয়া হয় বিপক্ষের ময়দানে। দু'পক্ষের প্রতিযোগীর মধ্যে ভাষার আদান প্রদান হোক না হোক, গিটারের টান টান তার হালকা ছুঁয়ে দিলেই যেমন টুং করে উঠে নীরবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তেমন একটা টানটান নীরবতা বিরাজ করে। যেন কেউ ছুঁয়ে দিলেই আর্তনাদ শোনা যাবে। গভীর এই মনোযোগের খেলায় যার মস্তিষ্ক যত নিখুঁতভাবে ফাংশন করবে সে-ই জিতবে। এই কারণে দাবা খেলায় হেরে গেলে মেনে নেয়া কঠিন। কারণ মানুষ খুব সহজে মেনে নিতে পারে না তার বুদ্ধি অন্য কারো চেয়ে কম। আপনার যদি সিংঘাম সিনেমার ভিলেন জয়কান্ত শিখরের মতো অল্পতেই ইগোতে হার্ট হওয়ার বাতিক থাকে, দাবা আপনার জন্যে না।
এত কথা অবতারণা করার কারণ শিবব্রত বর্মনের 'শোধ' লেখা হয়েছেই দাবা নিয়ে। এ এক এমন হিংস্র খেলা, যা মানুষের হিতাহিতজ্ঞান খুব সহজে হারিয়ে দিতে পারে। গল্পটা দুই শিক্ষকের। একজন প্রায় বৃদ্ধ প্রফেসর, যিনি দাবা খেলেজ ক্লাবে। অনেকটা শখের বসেই। দাবা তার পেশা না। দীর্ঘ জীবনে কখনোই প্রতিযোগিতামূলক টূর্ণামেন্টে অংশ নেননি। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ দেশ সেরা চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু। ঘটনাক্রমে দুই দাবাড়ুর মুখোমুখি দ্বৈরথে তরুণ দাবাড়ু পরাজিত হন। চৌষট্টি খোপের খেলা তারপর আর শুধু চৌষট্টি খোপেই আবদ্ধ থাকে না। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ে বাস্তব জীবনের সঙ্গে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে ভয়ংকর এক প্রতিশোধের গল্প। দাবার বোর্ড এবং বাস্তব জীবনের টানাপোড়েনে শেষে কে বিজয়ী হবে? কে শেষ হাসি হাসবে বলতে পারেন?
ছোট একটা বই। এক বসায় শেষ করা যায়। কিন্তু এই ছোট বইয়ের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বিশাল আনন্দের ভাণ্ডার। আপনি যদি দাবা আর যুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহী হন এই বই আপনাকে দ্বিগুণ আনন্দ দেবে। গল্পটা এক কথায় দারুণ। শেষ হওয়ার পর মনে হবে ওত দ্রুত শেষ না হলেও পারত। সেই সঙ্গে একটা জিনিস খুব ভালোভাবে অনুধাবন করবেন। সবখানে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর ইগো দেখানো মানুষের জীবনে সুফল বয়ে আনে না। এ দুটোই আপনার হারের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শোধ পড়তে গিয়ে আমার নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। আমরা বেশ কয়েকজন নিয়মিত দাবা খেলতাম। সবাই বড়ো ভাই, আমি তাদের চেয়ে বেশ ছোট। তাদের মধ্যে এক বড়ো ভাই ছিলেন দুর্দান্ত খেলোয়াড়। বুয়েট থেকে মাস্টার্স করা, স্যামসাংয়ে জব করতেন। উনার বন্ধুরাও দাবাতে তার কাছে পাত্তা পেতেন না। আমি তিনটে বা পাঁচটা খেললে একটায় জিততাম। উনি একবার আমাদের নিয়ে টূর্ণামেন্ট করলেন। সবাই জানতাম আমরা কেউ পাত্তাই পাব না। তিনিও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনিই জিতবেন আশ্চর্যজনকভাবে হলেও সত্যি, তিনি ফাইনালেও উঠতে পারেননি। এমন সিলি সব ভুল করে হেরেছেন, অবিশ্বাস্য। যার আসলে জেতার সম্ভাবনা ছিল প্রায় শূণ্য, সেই অধম আমিই জিতেছিলাম। ভাগ্যিস সেই বড়ো ভাইয়ের ইগো নিয়ে অত ভ্যাজাল নাই। নয়ত আমার জান প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত।
শোধের ছোট পরিসরে ইমানুয়েল লস্কর, ববি ফিশার, বরিস স্প্যাসকির নাম উঠে আসা স্বাভাবিক হলেও আনন্দদায়ক ছিল। সেই সঙ্গে প্রিয় কাজী মোতাহার হোসেনেও এক ঝলক দেখা দিয়েছেন। তবে চমকিত হয়েছি কার্ল ভন ক্লসেভিতজ আর ডেজার্ট ফক্স আরভিন রোমেলের কথা উঠে আসায়। যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে একসময় ভীষণ আগ্রহ থাকায় কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। রোমেল আর হিমলারের মস্তিষ্ক কীভাবে ফাংশন করত এটা জানার প্রচুর আগ্রহ ছিল। শোধ যেন তার ছোট পরিসরে আমাকে সেই সব স্মৃতি ভ্রমণ করিয়ে এনেছে।
শিবব্রত বর্মনের গল্প বলার ক্ষমতা অসাধারণ। পাঠককে খুব সহজে গল্পের মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে পারেন তিনি। মনে হয় যেন তিনি পড়াচ্ছেন না, দক্ষ শিল্পীর আলতো হাতের ছোঁয়ায় গল্পটা মানসচক্ষে ফুটিয়ে তুলছেন। গল্প একেবারেই ছোটো হওয়ায় স্পয়লার হয়ে যাওয়ার ভয়ে বেশি আলোচনা করা গেল না। বই নিয়ে অনুযোগ করার জায়গা ��েমন নাই। তবে গল্পটা আরেকটু বড়ো করা গেলে ভালো হত। শিবব্রত বর্মনের থেকে বৃহৎ পরিসরে একটা উপন্যাস পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে গেলাম।
শিবব্রত বর্মন-এর লেখা যখন আমি পড়তে বসি, বানিয়ালুলু অথবা সুরাইয়া-এর গল্পগুলো, তখন প্রথমেই যা আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়, তা হলো, লেখকের সৃজনশীলতা। কথাসাহিত্যিক মাত্রেরই সৃজনশীল হতে হয়, তবে, শিবব্রত সেটাকে নিয়ে গেছেন অন্য এক পর্যায়ে। সুরাইয়া গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প, দাবা, যা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল, লেখককে গল্পটিকে এঁটে দিতে হয়েছে অল্প জায়গার মাঝে। লেখাটি সুযোগ পায়নি নিজের সম্ভাবনাময় ডালপালা গজানোর। তাই পাঠের শেষে আক্ষেপ রয়ে যায়। অবশেষে, সেই আক্ষেপ মেটানো হলো। ৮৮ পাতার এই উপন্যাসিকা, যা যদিও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য নয় কোনোভাবেই, কিন্তু একে খুব দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন লেখক। এই বইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ দাবা। যারা খেলাটা পছন্দ করেন অথবা মোটামুটি বুঝেন তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপভোগ্য হবে। বাংলাদেশ, একইসাথে আমাদের উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে এখানে প্রধান চরিত্র আফসান চৌধুরীর কাছে দাবা শিখতে দেখা যায়, যে তখন বালক মাত্র। এ কি শুধু দুই দাবাড়ুর গল্প, যাদের একজন অন্যজনকে হারাতে না পেরে ডেসপারেট হয়ে যায়? না। এই বইটি তারও বাইরে গিয়ে বিশেষ কিছু হয়ে প্রকাশিত হয় আমাদের কাছে।
"কত প্রশ্নের বনে হারিয়ে জড়িয়ে বোঝেনা তবু এ মন শান্ত নিবিড় পথে হেঁটে কাটে সারাদিন সারাক্ষণ শূন্যের পরে খুঁজেছি তোমায়,অসীমের পথে তুমি......"
ফিরোজ বেগ অহংবোধে উপ্তপ্ত,হিতাহিত শূন্য জ্ঞানে অন্ধ হয়ে "শোধের" পথে আফসান চৌধুরীকে একটু ছুঁতে চেয়েছিলেন।কিন্তু হায়!উনি তো ইতিহাসের বিস্তৃত বিশালতার ন্যায় অসীম দিগন্তের পানে নিমিখ চেয়ে শান্ত পদক্ষেপে হেঁটে এগিয়ে গেছেন-বহু...বহু......বহুদূর!
ঠিক যেমন নীল সমুদ্রের বাঁধভাঙ্গা উন্মত্ততায় অসহায় হয়ে ভেসে যায় সংকীর্ণতার বস্তুজগৎ,হৃদয়ের উদারতার গভীর উত্তাল ঢেউয়ে খেই হারায় মস্তিষ্কে বোনা যুক্তিতর্কের ভেগ টার্ম,সময়ের প্রবাহমান খরস্রোতে বিলুপ্ত হয়ে যায় অতীতের অন্ধকারময় ভুলভ্রান্তির মামুলি অজুহাত।
দাবার হিংস্র ব্যাটলফিল্ডে জয় হয় সাবলীল বোঝাপড়ার মাস্টারপিস আর্টওয়ার্কের,কোন অন্ধ প্রতিদ্বন্দ্বিতার অহংবোধে "শোধের" নয়।
হয়ত এখন বইখানা পড়ে আছে বুকশেলফের সাজানো-গোছানো প্রিজনে, বহু আগেই লেখকের কলমের আঁচড় সমাপ্তি টেনেছে কাহিনীর,তবুও সিক্সথ সেন্সে অনুভূত হয়-এখনও চলছে আফসান চৌধুরী আর ফিরোজ বেগের অপার দ্বৈরথ...দাবার সাদা-কালো বোর্ডের সীমানা ছাড়িয়ে...মনস্বত্বের ঐন্দ্রজালিক জটিলতায় আচ্ছাদনে ব্যক্তিত্বের বৈপরীত্যের ঠাণ্ডা মাথার হিসাবনিকাশে......
অসাধারণ! ফেলুদার ভাষায় আনপুটডাউনেবল। যেমন আইডিয়া, তেমনই তার এগজিকিউশন। প্লট, লেখা, প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন... সবই টপ নচ। ছোটখাট দু-একটা মুদ্রণপ্রমাদ আছে যদিও। তবে পাঁচ তারা না দিয়ে পারা গেল না।
গল্পের শেষটা না থাকলে আসলে তেমন আহামরি মনে হচ্ছিল না। শেষটাও অনেকটা সিনেম্যাটিক। অতঃপর হিরোর বিজয় হইল টাইপ। সাধারণ দাবার বোর্ড থেকে যে গল্প সিরিয়াস সিরিয়াস রাষ্ট্রীয় সামাজিক দর্শনে আঘাত হানতে পারে। সময়ের ছবি আঁকতে পারে এসবই তো আসলে অসাধারণ ব্যাপারই। ভালো লাগল আর কি।
"...আসল মে জংগ দো ফিরকো কে দরমিয়ান নেহি হোতি। জংগ দো ইয়াদোঁ কে দরমিয়ান হুয়া করতা হ্যায় বাচ্চে, ইট ইজ ফট বিটুইন টু মেমোরিজ। অ্যান্ড হোয়েন দ্য ফাইট গোজ অন, ইয়াদেঁ বদল যাতি হ্যায়।"
বাইরে থেকে বোঝার উপায় না থাকলেও দাবা অত্যন্ত হিংস্র খেলা। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মগজে চলতে থাকে দুটো লোকের ধুন্ধুমার যুদ্ধ। দর্শন ও দাবা মধ্যেও একটা চমৎকার মিল রয়েছে। একজন প্রখ্যাত দাবাড়ু বলেছেন তিনি কাম্যুর দর্শন নিজের গেমে ব্যবহার করেন। তিব্বতের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দাবাকে ধ্যানের টুলস হিসেবে ব্যবহার করতেন। তারা একে বলতেন চান্দারাকি। ব্যক্তিগতভাবে দাবা আমার খুব পছন্দের খেলা।
'শোধ' গল্পটি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দাবাড়ুর। ইতিহাসের এক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী ও একসময়ের ম্যাথমেটিক্সের ছাত্র ফিরোজ আহসান বেগের। তাদের কিংবদন্তিতূল্য লড়াই একসময় দাবার বোর্ডের বাইরে অনেক দূর গড়ায়। ঘটায় রক্তপাতের সূচনা। ঘটনার প্রেক্ষাপট যে সময়ের, তখন দেশে একটা রক্তাক্ত যুদ্ধ চলছিল।
তিনবারের পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন ফিরোজ আহসান বেগ লোকটা মিখাইল তাল, ক্যাপাব্লাঙ্কা, অ্যান্ডারসন, ইমানুয়েল লাসকার ভেজে খাওয়া লোক। ভয়ানক অবসেশন তার দাবার প্রতি। একে তিনি শুধু একটা গেম মনে করেন না, যুদ্ধ মনে করেন মনেপ্রাণে। নিজের উপর তার বেজায় কনফিডেন্স আর অহম। চ্যাম্পিনশিপের ম্যাচ তুড়ি মেরে উড়িয়ে তিনি মন্তব্য করতে পারেন - 'চেস ইজ বিকামিং আ বোরিং গেম ফর মি!'
আফসান চৌধুরী একজন অ্যামেচার, দাবার দুনিয়ায় নেই কোনো অস্তিত্ব। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে কথিত আছে তিনি কখনো দাবায় হারেননি। তার বুকশেলফ ঘাঁটলে মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি, কমব্যাট স্ট্র্যাটেজি নিয়ে বিস্তর বই পাওয়া যাবে। নোটবই, মার্জিন ঘাঁটলে পাওয়া যাবে রোমেল, প্যানজার ডিভিশন, গোস্ট ডিভিশন, ডেজার্ট ফক্সের মতো নানান মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির নোট। আফসান চৌধুরীর মতে, দাবা কোনো স্পোর্ট না। দাবা একটা আর্ট। আর্ট অব কনভারসেশন। দুটি ইতিহাসের মধ্যে কথোপকথন। দুটো ব্যক্তিত্বের মাঝে কথোপকথন।
এই দুই মেরুর মানুষের দেখা হয় সত্তর সালের অক্টোবর মাসের এক বিকেলে, তখন শীতও আসেনি। এই গল্পের মূল সূচনা হয় সুরাইয়া বইয়ের 'দাবা' শিরোনামের গল্পটি থেকে। 'দাবা' গল্পটি শেষ হয় বোর্ড গেমের বাইরে বাস্তব জীবনের দন্দে রূপ নেয়া এক অসমাপ্ত গল্প হিসেবে। সেই গল্পটিরই অতঃপর এবং যবনিকা টানলেন আমার খুব প্রিয় লেখক শিবব্রত বর্মণ 'শোধ' নামের এই নভেলাটির মাধ্যমে। আমি লেখক কে পছন্দ কেন করবোনা? সাড়ে সাতাশি পৃষ্ঠার এই ছোট বইটার প্রথম বাক্য থেকে শেষ বাক্য পর্যন্ত লেখক শব্দ আর বাক্যের যে সুবিন্যস্ত বুনট সৃষ্টি করেন, তা নতুন লেখকদের মাঝে খুব কমই দেখা যায়। এমন নয় যে প্লট এতো আনঅর্থডক্স, এত মাথা খারাপ করে দেয়া, যা আগে পড়িনি বা একদম আন্দাজ করতে পারিনি কেমন হচ্ছে গল্পটা। আমার ধারণা, ব্যাপারটা হলো ওনার অর্গানাইজিং স্ট্র্যাটেজিটা খুবই ভালো। কোনো এক অপরাহ্নে মিক জ���যাগার এর গল্পে প্রবেশ করাটা কোনো কোইন্সিডেন্স নয়, সম্পূর্ণ ক্যালকুলেটেড। দাবার চালের মত। তাছাড়া এইটুকু একটা গল্প লিখতে যত ঐতিহাসিক রেফারেন্স আর গভীর আলোচনা আছে, যত শব্দ আর বাক্যের সৌন্দর্য আছে, এসব লেখকের পড়াশোনার রেঞ্জকে জানান দেয়।
বইটিকে আমি পাঁচ তারাই দিতাম। শেষটায় হালকা মেলোড্রামা এসে গেছে। আর কি যেন ছিল মনে পড়ছেনা। মজার ব্যাপার স্যাটিসফায়িং এন্ডিং থাকায় এই প্রথমবার বোধহয় আমি খুশি হইনি। আমি বোধহয় ট্র্যাজিক কিছু বা ক্লিফহ্যাংগারই চেয়েছিলাম। যাহোক, ওসব ব্যক্তিগত বিবেচনা। খুব আনন্দ পেয়েছি বইটা পড়তে গিয়ে। তাই রেকোমেন্ডেড।
দাবা নিয়ে আরেকটা গল্পের কথা মনে পড়ছে। সেটার কথা দিয়েই শেষ করি। গল্পটা হুমায়ুন আহমেদের। নাম 'খেলা'। নলিনী বাবু নামের একজন চেস প্রডিজিকে নিয়ে গল্প। গল্পের শুরুটা এমন- ‘খায়রুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের থার্ড স্যার, বাবু নলিনী রঞ্জন একদিন দুপুরবেলা দাবা খেলা শিখে ফেললেন। এই খেলাটি তিনি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। দু’জন লোক ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা বোর্ডের দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে- মানে হয় কোনো? তবুও তাঁকে খেলাটা শিখতে হলো।’
সদ্যই দেশসেরা দাবাড়ুর খেতাব জেতা ফিরোজ বেগ যখন শুনল তারই ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের এক অধ্যাপককে এর আগে কেউই দাবায় হারাতে পারেনি, তখন সেটা তার অহমে গিয়ে আঘাত করল। আফসান চৌধুরীকে দাবায় হারানোর চ্যালেঞ্জ করল ফিরোজ। এই চ্যালেঞ্জ দুজনের জীবনে নিয়ে এলো আমূল পরিবর্তন। ৭১ সালের সেই পট পরিবর্তনের সময়টায় যা রূপ নিল ভয়াবহ এক দ্বৈরথে।
এক কথায় বলতে গেলে চমৎকার বই। এর আগে লেখকের বানিয়ালুলু পড়েছিলাম। সেটার মতো এই বইটাতেও শিবব্রত বর্মনের নিজস্ব ঢং এ গল্প বলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। এক ধরণের স্বকীয়তা আছে উনার গদ্যশৈলীতে।
দাবা নিছক কোনো খেলা নয়, একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ
গল্পের প্লটটা অন্যরকম, কিছুটা অদ্ভুত! দাবা খেলা নিয়ে এমন একটা প্লট সাজানো সম্ভব তা এর আগে ভাবিনি। মাত্র ৮৮ পাতার বইতে লেখক স্রেফ একটা গল্প বলে গিয়েছেন। যে গল্পের মূখ্য চরিত্র দুইজন দাবাড়ু। পুরো বইটা দাবা খেলা নিয়ে এগুলেও, পাঠককে দাবা খেলা শেখাতে চাননি লেখক। যে কারনে বইটাতে ইনফো ডাম্পিং টাইপ ব্যাপার স্যাপার নেই। আর তাই যে পাঠক জীবনেও দাবা খেলেনি, সেও বইটা পড়তে গিয়ে কোনো অস্বস্তিতে ভুগবে না।
বইয়ের পটভূমি যদিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন। তবে এখানে আসলে যুদ্ধের অমন কিছু নেই। স্রেফ জয় পরাজয়ের গল্পটাই এখানে বড় হয়ে এসেছে।
চরিত্রায়ন
লেখকের চরিত্রায়ন হয়েছে দূর্দান্ত। আফসান চৌধুরীর ধীর, স্থির, শান্ত বুদ্ধিমত্তা তার একটা অবয়ব দাঁড় করিয়ে দেবে পাঠকের কল্পনায়। একই রকমভাবে ক্ষ্যাপাটে, জেদী ফিরোজ বেগকেও সহজেই অনুধাবন করা যাবে। গল্পের প্রয়োজনে বইয়ে আরো বেশ কিছু চরিত্র এলেও তাদের তেমন কোনো মূখ্য ভূমিকা নেই। রওশন আরা, মীরা কিংবা সালমা বেগমরা এই দুজনের চরিত্রকেই বরং আরো হাইলাইট করেছে। আফসান চৌধুরী ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধকৌশল নিয়ে কৌতুহলী। আর তার সে পড়াশুনা আর জ্ঞান তিনি কাজে লাগান দাবা খেলায়। লোকটাকে বেশ ভালো লেগেছে। ফিরোজকে আগলে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তিনি।
চমৎকার গদ্যশৈলী, দারুণ এক্সিকিউশান
গল্পটা আসলে হিংসার। একজন মানুষের মাঝে থাকা অপরিসীম হিংসা কীভাবে তাকে সর্বোচ্চ খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তা বুঝা যাবে এই গল্প পড়লে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পের গতি একই রকম থাকে। যে কারনে কখনো বোরিং লাগেনি আমার কাছে। গল্পটা নিয়ে বেশিকিছু বলা।সম্ভব হচ্ছে না। কারন ছোট এই বইয়ের যাইই বলব তাই স্পয়লার হয়ে যাবে। শুধু বলি, কীভাবে ফিরোজ বেগ আফসান চৌধুরীর খোঁজ পায়, কেন তাকে চ্যালেঞ্জ করে, কীভাবে তাদের সম্পর্কটা একই সাথে বন্ধুত্ব আর চিরশত্রুতায় রূপান্তরিত হয় তা জানবেন পাঠক শোধ পড়ে। আর এই যাত্রার পুরোটাই ভালো লাগার মতো। দাবার কিছু কৌশলের পাশাপাশি কিছু সমরনীতির জ্ঞানও রয়েছে, যেটা আমার মতে বাড়তি ভালো লাগার উপাদান হয়ে এসেছে। ব্লাইন্ডফোল্ড চেসের ব্যাপারটা এত্ত চমৎকার!!
বইটা নিয়ে আফসোস যদি কিছু থাকে, তা হলো ফিরোজের মানসিক সমস্যার ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে দেখানো দরকার ছিল। তার ব্যাকস্টোরিটা আরো একটু বিশদ হলে ভালো হতো। ভালো হতো এন্ডিংটাও আরো সময় নিয়ে লিখলে। বইটা আরো বেটার এন্ডিং ডিজার্ভ করে। বলছি না যেমনটা আছে তা খারাপ, জাস্ট আরেকটু বিস্তৃত হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করি। বইয়ে প্রচুর ইংরেজি এবং উর্দুর ব্যবহার ছিল। উর্দুর অংশগুলো পড়তে আমার বেশ বিরক্ত লেগেছে। এছাড়া কিছু সাবপ্লট এসেও হারিয়ে গিয়েছে।
ব্যক্তিগত রেটিং: ০৭/১০ (বইটা নিয়ে তেমন কিছুই বলতে পারিনি। শুধু বলব আমার রিভিউর উপর যাদের ভরসা আছে, তারা বইটা পড়তে পারেন)