সেন, সত্যেন (১৯০৭-১৯৮১) সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক। ১৯০৭ সালের ২৮ মে মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ি উপজেলার সোনারঙ গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতৃব্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব আচার্য।
সত্যেন সেন সোনারঙ হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস (১৯২৪) করে কলকাতা যান এবং সেখানকার একটি কলেজ থেকে এফ.এ ও বি.এ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ (ইতিহাস) শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু যুগান্তর দলের সদস্য হিসেবে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তিনি ১৯৩১ সালে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন এবং জেলে থেকেই বাংলা সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের (১৯৩৮) পর বিক্রমপুরে ফিরে তিনি কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন এবং আমৃত্যু বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। সত্যেন সেন ১৯৪৯, ১৯৫৪, ১৯৫৮ ও ১৯৬৫ সালে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেন।
সত্যেন সেন ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদ-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। এ দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সত্যেন সেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সংগঠক এবং উদীচী (১৯৬৯) সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের সুকণ্ঠ গায়ক এবং গণসঙ্গীত রচয়িতা।
সত্যেন সেন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন পরিণত বয়সে এবং অতি অল্পসময়ের মধ্যে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় চল্লিশ। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ: উপন্যাস ভোরের বিহঙ্গী (১৯৫৯), অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭), পদচিহ্ন, (১৯৬৮), পাপের সন্তান (১৯৬৯), কুমারজীব, (১৯৬৯), বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯), পুরুষমেধ (১৯৬৯), আলবেরুনী (১৯৬৯), মা (১৯৬৯), অপরাজেয় (১৯৭০), রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ (১৯৭৩); ইতিহাস মহাবিদ্রোহের কাহিনী (১৯৫৮), বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম (১৯৭৬), মানবসভ্যতার ঊষালগ্নে (১৯৬৯), ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা (১৯৮৬); শিশুসাহিত্য পাতাবাহার (১৯৬৭), অভিযাত্রী (১৯৬৯); বিজ্ঞান আমাদের এই পৃথিবী (১৯৬৭), এটমের কথা (১৯৬৯); জীবনী মনোরমা মাসীমা (১৯৭০), সীমান্তসূর্য আবদুল গাফফার খান (১৯৭৬) ইত্যাদি।
চিরকুমার সত্যেন সেন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রগতিশীল ও গণমুখী চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যসাধনা করেন। তাঁর রচনায় ঐতিহ্য, ইতিহাস, দেশের মাটি ও মানুষের শ্রেণী-সংগ্রাম প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি উপন্যাসের জন্য ‘বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৭০) লাভ করেন।
১৯৮১ সালের ৫ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনএ তাঁর মৃত্যু হয়।
আমি ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে পড়াশোনা করছি। ইউনিভার্সিটিতে যেদিন প্রথম ক্লাস করতে আসি, সেদিন ক্লাসে শিক্ষকের প্রথম কথাটা ছিলো,Why some countries are poor while others are rich. প্রথম বর্ষতেই জানতে পারি এই উপনিবেশবাদের মূল কাহিনী। এই বইটার কথা আগে জানা থাকলে আরো আগে পড়তাম।
আমার সাবজেক্টের কল্যাণে মশলা পলিটিক্সের কথা কমবেশি আগেই জানতাম। তবে এভাবে গল্পের ছলে পরিপাটিভাবে এক মোড়কে আগে পড়া হয় নি। পড়তে পড়তে ক্রোধ, হতাশা, দুঃখবোধ সবকিছুর একটা মিশেল অনুভূতি হয়েছে। এরকম সহজ ছলে ইতিহাস বলে এমন বই আমাকে আরো সাজেস্ট করবেন যারা কমেন্টটা দেখবেন।
একটা ব্যাপার আমি না বলে পারছি না, আমার মনে আছে বাংলাদেশের ক্লাস ৬/৭ এ বোধহয় Rapid Reader নামে একটা পাতলা করে স্টোরিবুক ছিলো আমার সময়ে। সেখানে কলোম্বাসের খুব গুণ-কীর্তন লেখা ছিলো। এরপর সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ভাস্কো দা গামার অভিযানের প্রশংসা ছিলো। কিন্তু এই 'মহামান্য' ব্যক্তিদের প্রকৃত রূপটা যে কতোটা রেসিজম আর নিষ্ঠুরতায় ভরা তা কেনো তুলে ধরা হলো না আমার পরবর্তীতে তা ভেবে বেশ অবাক লাগতো। তারা Environmental Determinism নামের গালভরা থিওরিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কাজকে জাস্টিফাই করতে চেয়েছে যে, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা বা ভারতবর্ষ যেখানেই হোক না কেনো, নেটিভরা *অসভ্য*। নেটিভদের থেকে এই ইউরোপীয়ানরা মানুষ হিশেবে উঁচুস্তরের এবং যেহেতু তারা উঁচুস্তরের তাদের তো একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে এই *অসভ্যদের সভ্য* করে তোলার! স্কুলে বইয়ে যা পড়েছি, পরে গিয়ে দেখেছি সেখানে সবই পলিটিক্স করে লেখা। এই দেশের মানুষ হয়ে, ভারতবর্ষের সত্যকার ইতিহাস ইউরোপীয় শোষকদের আদলে গিলিয়ে খাওয়ানোর ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক।
এখন অবাক লাগে না। এখন বুঝি কলোনিয়ালিজম কিংবা মশলার যুদ্ধ কোনোটাই আমাদের ছেড়ে যায় নি। এখনো উত্তর পেয়ে গিয়েছি কিভাবে কিছু দেশ ধনী হয়েছে: রিসোর্সফুল দেশে গিয়ে দস্যুর মতো লুটপাট করে, তাদের নিজেদের মাটিতে রক্তের বন্যা বইয়ে,তাদের সম্পদ চুরি করে নিজের দেশে পাচার করে। এই রক্তের মূল্য কি তাদের শোধ করতে হবে না? কাগজের নোট রক্তের স্রোত শুষে নিতে পারে, আমি তা বিশ্বাস করি না।
মসলা না থাকলে কিন্তু পর্তুগিজরা এ দেশে আসতো না, আসতো না ডাচরা ও তাদের পিছু পিছু আংরেজরা! অবাক হচ্ছেন? ছোট্ট বইটা পড়ে ফেলুন, আরো অবাক হবেন । কলোনিয়াল ইতিহাস যাদের রীতিমত 'হিরো' বলে আখ্যায়িত তাদের আসল চেহারাও জানতে পারবেন । জানতে পারবেন এই মসলার ব্যবসা নিয়েই হয়েছে কত সংঘর্ষ, শোষণ আর মৃত্যু । বইয়ের দুটো প্যারা উল্লেখ করছি-
খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা মহামান্য পোপের আশীর্বাদপুস্ট পর্তুগীজ রাজা ডোম ম্যানুয়েলের ঘোষণা-অনুযায়ী ভাস্কো দ্য গামা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেই সামনে পড়া অন্য জাহাজগুলোর লোকজনকে আটক করে তাদের মালামাল লুটপাট করতে শুরু করে। ভারত মহাসাগরের বুকে ভাস্কো দ্য গামা এবং তার সহচরদের নৃশংস যথেচ্ছাচ্চার অব্যাহত গতিতে চলতে লাগল। সেই নিষ্ঠুর এবং করুন কাহিনিগুলো ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। সেই অগন্য কীর্তি থেকে একটির উল্লেখ করছি। ভাস্কো দ্যা গামার কীর্তির স্বরুপ এথেকেই কিছুটা বোঝা যাবে। মক্কা থেকে হজযাত্রীদের নিয়ে কয়েকটা নিরস্ত্র জাহাজ ফিরে আসছিল। দূর্ভাগ্যক্রমে তারা পর্তুগিজ জাহাজগুলোর সামনে পড়ে গেল। জাহাজগুলো আটক করে মালপত্র যা ছিল, সবকিছু তুলে এনে জাহাজগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হল। কিন্তু ভাস্কো ডা গামার কড়া আদেশ ছিল, জাহাজে যে সমস্ত আরবী লোক আছে, তাদের যেন তুলে না আনা হয়। হতভাগ্য আরবীরা সেই জাহাজের মধ্যেই পুড়ে কয়লা হল। ভাস্কো দ্যা গামা পরম আনন্দে সেই দৃশ্য উপভোগ করলেন।
আরেকটা ব্যাপার জানতে পারবেন, মীর জাফরেরা কেবল নবাব সিরাজদ্দৌলার আমলেই নয় এই উপমহাদেশে প্রতি শতাব্দীতেই জন্ম নিয়েছে :)
আমরা খাবারে স্বাদ বৃদ্ধি করতে যতটা প্রয়োজন মসলা ব্যবহার করি। আমরা অনেকে হয়তো জানি না এই মসলা নিয়ে কত মারামারি, কাটাকাটি, গুটিবাজি হয়েছে। এই মসলার জন্যে কত নিরিহ মানুষ যে রক্ত দিয়েছে এবং ক্রিতদাসের মত ব্যবহৃত হয়েছে।। মসলা বাণিজ্য নিজেদের হাতের মুটে নিতে, একচেটিয়া বাণিজ্য করতে কত বিদেশী বাবুরা কত কি যে করেছে তা জানতে এই ছোট বইটি পড়তে হবে
A small book, filled with information, rich in content yet thoroughly engaging. There's no redundancy, every line serves a purpose. It delivers a gripping and often sobering narrative of the history of the subcontinent. In the post-Crusade era, the Indian subcontinent, renowned for its spices, was considered the most promising region in the world for trade. As part of a long-planned effort to block the Muslims, who dominated this trade and were regarded as both religious and economic rivals by Christian Europe, the Portuguese Empire set its sights on India. Vasco da Gama eventually landed at the port of Calicut. 'Masalar Juddho' (The Spice War) recounts how this religiously charged mission, disguised as trade, marked the beginning of a brutal history of exploitation under colonial rule.
Author Satyen Sen masterfully condenses a vast historical event into a brief yet powerful narrative. Through simple yet powerful language and excellent narration, he has presented not just the events, but also the deeper truths behind them in a way that’s both clear and thought-provoking. Despite its rich information, it never feels dull, history unfolds like a gripping story. That’s what makes this book so enjoyable. This important yet tragic chapter of our past not only captivates but also enlightens. This important yet tragic history, as depicted in the book, offers many valuable lessons to learn from.
This book sheds light on the post-Crusade European states’ ruthless ambition to dominate global trade, their intense hatred toward Islam and Muslims, the Church-sanctioned legitimacy of piracy and raids, and the slow but calculated conquest of the spice-producing regions of the Indian subcontinent and Indonesia through years of patience and planning. It also highlights how the local populations—both Hindus and Muslims were repeatedly defeated and oppressed, largely due to internal divisions, lack of foresight, stagnation, and absence of enough strategic intelligence.
To be honest, despite the so-called fall of imperialism, the issues of oppression and exploitation around the world still persist. The author was a leftist, and his ideology subtly permeates the writing, yet it never feels forced or like propaganda. Because the author didn’t impose his ideology, but instead aimed to teach readers by showing the horrific history of colonialism in the subcontinent. Perhaps that’s why he could so naturally highlight the oppression of Muslims in history, as well as their significance in the battle of Calicut.
Because of the poison of colonialism that has so deeply spread religious extremism in the subcontinent that today, no one can remain neutral, people are forced to be either staunch supporters or opponents of a particular religion. Even being a so-called freethinker often means becoming an Islamophobe, which ultimately traces back to the very roots of this historical oppression. That is why people today are often seen to be heavily biased in their narration of history. From that perspective, Masalar Juddha stands out as a truly well-written and balanced book.
There isn’t much to criticize, but the section on the beginning of the Portuguese invasion of Indonesia felt a bit dull, as too much information was densely packed into a small space. Also, in some parts, the historical narrative, presented more as a story, may lack sufficient sourcing. While not misleading, this slightly weakens the book’s stance as a historical non-fiction. Overall, this is an exceptional book that everyone should read at least once. It deserves to be read slowly, attentively, and thoughtfully, and it’s certainly a book worth revisiting multiple times.
মসলা নিয়ে এতো যুদ্ধ, ভাবা যায়! এই ছোট্ট বইটা না পড়লে তো জানাই হতোনা, একসময় গোলমরিচের এতো দাম ছিল, লবঙ্গ চাষীদের উপর এতো অত্যাচার করা হয়েছিল, একদম নীল চাষীদের উপর করা অত্যাচারের মতোই।
এই নৃশংস যুদ্ধ করেছিল পর্তুগিজ আর ডাচরা, পরবর্তীতে মসলার গন্ধ শুঁকে শুঁকে ইংরেজরা। আর পর্তুগিজদের মুসলমানদের মারা টা তো ছিল রীতিমতো বিভৎস! সেই যুদ্ধ কি এখনো চলছেনা? কবে বন্ধ হবে এই হানাহানি?
মসলা নিয়ে এতো যুদ্ধের কথা জানতে চাইলে পড়তে পারেন এই ছোট্ট বইটি। সবার জন্য রেকমেন্ডেড।
এই বইকে কেন পাঠ্য বইয়ে যুক্ত করা হবেনা এ মর্মে হাই কোর্টে রিট করা উচিত।
এত গুরুত্বপূর্ন তথ্য আর ইতিহাস না জেনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে ফেললাম বলে অনুশোচনা হচ্ছে খুব।
বইয়ের লাস্ট অংশটুকু দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
এই মসলার যুদ্ধ রক্তাক্ত, হিংস্র, বীভৎস। আবার এই মসলার যুদ্ধ প্রাচ্যের পরিবর্তনহীন পশ্চান্মুখী সমাজের সামনে বৃহৎ বিশ্বের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বদ্ধ জীবনের উপরে দুরন্ত ঝটিকার আলোড়ন জাগিয়েছে, প্রচণ্ড অত্যাচারের শক্তি স্বপ্ন-দেখা ঘুমন্ত মানুষকে চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে তুলেছে।
খাবারকে সুস্বাদু করতে ব্যবহৃত হয় মসলা। খাবারকে সুস্বাদু করা সেই মসলার যে এত ঝাঁজ, এই বই না পড়লে জানতেই পারতাম না! মধ্যযুগে এই মসলা পাওয়া যেত শুধু প্রাচ্যে---নির্দিষ্ট করে বললে ভারতীয় ও পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে। পাশ্চাত্যে মসলার ব্যাপক চাহিদার কারণে শুধু মসলার ব্যবসা করেই সমৃদ্ধিতে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল এই অঞ্চল। মসলার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় পোরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল পাশ্চাত্যের অর্থলোলুপ শাসক-বেণিয়ারা। এই মসলার সূত্রেই ঔপনিবেশিকতার সূচনা হয় ভারতবর্ষে। প্রাণ হারায় হাজার-হাজার নিরীহ মানুষ। প্রথমে এল পর্তুগিজরা, তারপর ওলন্দাজরা। তাদের পথ ধরে এরপর এল ব্রিটিশরা। এদের আগমনের সাথে জড়িয়ে আছে প্রবঞ্চনা, অন্যায়, নির্যাতনের ইতিহাস। হারিয়ে যাওয়া সেই সময়ের কথা ইতিহাসের গলিঘুপচি খুঁজে তুলে এনেছেন সত্যেন সেন।
কলোনিয়াল ইতিহাস এতদিন ভাস্কো দা গামা'র মতো যেসব তস্করদের নায়ক(!!) হিসেবে দেখিয়ে এসেছে, তাদের সত্যিকারের বীভৎস, নোংরা চেহারাটা তুলে ধরেছে ছোট্ট, সুলিখিত, তথ্যে ভরপুর এই বইটি।
পায়েস আমার খুবই প্রিয়। মাঝেমাঝেই আম্মুকে পায়েস রাঁধতে বলি আর আয়েস করে খাই। আজও বইটা পড়া শেষে ভাতের বদলে পায়েস খাচ্ছিলাম... হঠাৎ এলাচে কামড় পড়তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাক্যবাণে এলাচের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে গিয়েও থমকালাম। … কারণ? কারণ এই বইটা।
স্কুলে থাকতে রাতে সমাজ পড়া মুখস্থ করতাম ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে। সমাজ বইয়ের আর সব মুখস্থ না হলেও ‘ভাস্কো দ্য গামা’ নামটা কেন জানি ভালোভাবেই মনে থাকত। এই বই পড়ার আগ পর্যন্ত মানুষটাকে খুব বড় কিছু মনে হতো। কিন্তু উপন্যাস পড়ে ঘেন্নায় আর রাগে টগবগ করছিল ভেতরটা। ধর্মান্ধতার কী বীভৎস রূপ! সাথে এ প্রশ্নও মনে জাগে, যুগে যুগে কেবল অসহায় চাষীগুলোই নিঃস্ব হয়ে গেল...?
কত বিশাল পরিধির এক ইতিহাস কত ছোট্ট একটা বইয়ে, তাও আবার পানির মতো সহজ ভাষায় লেখা যায়– অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। ইতিহাসের নাম শুনলেই আমার মতো যাদের হাই ওঠে, তাদের জন্য বইটা অবশ্যপাঠ্য।
ছোট্ট বই কিন্তু বেশ ইনসাইটফুল। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রপথটুকু বোঝার জন্য গুগল ম্যাপ দেখছিলাম। মসলাকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র, কালিকটের ঐক্য, পর্তুগিজ দের দস্যুপনা, ডাচদের অত্যাচার সব মিলিয়ে এক করুণ ইতিহাস।
এক পাউন্ড গোলমরিচের দাম ৩ শিলিং থেকে ৮ শিলিং এ বাড়িয়ে দিল হল্যান্ডের বণিকগোষ্ঠী, ১৫৯৯ সালে। ব্যস, মানুষের ইতিহাসের গতিপথ গেল পাল্টে! এক লাফে অতি প্রয়োজনীয় মসলা গোলমরিচের দাম বাড়ায় ক’জন ইংরেজ ভাবল তারা নিজেরাই কেন ভারত আর ইন্দোনেশিয়া থেকে মসলা সংগ্রহ করে এনে কম দামে ইংল্যান্ডে সরবরাহ করতে পারে কিনা, ব্যস মসলার ব্যবসা শুরু করল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ( ইংরেজদেরটা)!
মানুষের ইতিহাসে প্রস্তর যুগে, তাম্র যুগ, লৌহ যুগে, শিল্প যুগ, আধুনিক যুগ ইত্যাদির ফাঁকে কিন্তু মসলা যুগ যে আছে এটা আমরা অনেকেই খেয়াল করি না। অথচ এই মসলার খোঁজেই ইউরোপিয়ানদের বিস্বাদ খাবারকে সুস্বাদু করতে যেয়ে সারা বিশ্বের কোণে কোণে যেয়ে সেই যে খুঁটি গেড়ে বসল কলোনি করে, সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এখনো শেষ হয় নাই!
যা হোক, সেই মসলা আমল নিয়ে বিখ্যাত সত্যেন সেন লিখেছিলেন ‘ মসলার যুদ্ধ’ , ৫৫ পাতার এক ছোট্ট বই, আর মূলত সাল, স্থান ও নানা রসহীন তথ্য দ্বারা ভর্তি, কিন্তু এর আড়ালে আছে ইতিহাসের নানা তথ্য গেঁথে চমৎকার এক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চমকপ্রদ ব্যাপার। বইয়ের শুরু ১৪৮৮ সালের কালিকট বন্দর দিয়ে, যদিও প্রায়ই লেখক গল্পচ্ছলে ক্রুসেডের যুদ্ধের সময় থেকে ইউরোপিয়ান শক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইতিহাস ঠিকুজি কুলুজি টেনে ভাস্কো দা গামা হয়ে, সুরাটে ১৬১২ সালে ইংরেজদের বাণিজ্য ঘাটি স্থাপন পর্যন্ত যাবতীয় মূল্যবান তথ্য জানিয়েছেন আমাদের। বইয়ের শেষ পাতাটা হুবহু তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না,
‘ ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে মসলার ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। এখানকার মসলা পরপর তিনটি ইউরোপীয় শক্তিকে আকর্ষণ করে নিয়ে এসেছে। বাণিজ্য করতে এসে শেষ পর্যন্ত এরা সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসল।
এই মসলা-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কত শক্তির উত্থান পতন ঘটেছে, বণিকদের মুনাফার তৃষ্ণা মিটাতে গিয়ে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাদের রক্ত তিন সমুদ্রের জলে মিশে আছে।
এই মসলা-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কত দেশ তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে, কত মানুষের মর্যাদা ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছে। এই মসলার যুদ্ধ সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপর কঠিন আঘাত হেনেছে। যে-চাষীরা মসলা উৎপন্ন করত- তাদের জমি আর স্বাধীন জীবিকা থেকে উচ্ছিন্ন করে দিয়ে নিঃসম্বল কুলীতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের সম্পদ তাদের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে- আপনা মাংসে হরিনা বৈরী।
এই মসলার যুদ্ধ রক্তাক্ত, হিংস্র, বীভৎস। আবার এই মসলার যুদ্ধ প্রাচ্যের পরিবর্তনহীন পশ্চাৎমুখী সমাজের সামনে বৃহৎ বিশ্বের দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়েছে। বদ্ধ জীবনের উপরে দুরন্ত ঝটিকার আলোড়ন জাগিয়েছে, প্রচণ্ড অত্যাচারের শক্তি স্বপ্ন-দেখা ঘুমন্ত মানুষকে চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে তুলেছে।
'আর্কিটেকচার অব বেঙ্গল' নামে এক কোর্স আছে চতুর্থ বর্ষে। ক্লাসের প্রথমদিন শিক্ষকের মুখে প্রথম বইটা�� নাম শুনি। ওদিনই দোকানে গিয়ে কিনে আনি বই। পড়তে দু সপ্তাহ দেরী হলো ঠিকই, তবে দেরী করলেও শেষ করে মনে হলো বই পড়া সার্থক।
স্কুলে থাকতে প্রিয় বিষয় ছিল সমাজবিজ্ঞান। এখন তো ইতিহাসের অংশটা কত ছোট হয়ে এসেছে। তখনকার বইগুলোতে সেই পাল বংশ, সেন বংশ, অশোক পড়ে, ইউরোপীয়দের আগমন, যুদ্ধ, বিদ্রোহ পার হয়ে দেশভাগের কাহিনীতে আসতে হতো। গোগ্রাসে সেসব গিলতাম। অবিশ্বাস্য লাগত। তবে এমুহুর্তে তারচ���য়েও বেশি যা অবিশ্বাস্য লাগছে সেটা বোধহয় বইয়ের পাতায় ভাস্কো দা গামার গুনকীর্তণ যে পড়েছিলাম সেগুলো! মসলা নিয়ে রাজনীতি অনেকটা খাপছাড়া ভাবে জানতাম! যা জানতাম না, যা কল্পনার ও অতীত ছিল, এই বইটা পড়ে তাই জানতে পারা!
বইটা পড়ে অবাক হয়েছি, রাগ, ক্রোধ, কষ্টে মনটা ভরে উঠেছে, খানিকটা হাসিও পেয়েছে এই ভেবে পর্তুগীজদের এই নৃশংসতা ভুলে গেছি কত সহজে! আমরা যে বোকা ছিলাম, সে বোকাই রয়ে গেছি! জয়ীরা ইতিহাস লেখেনি, নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই ভুলে গেছি!
ইতিহাস, ফিকশন নয়, এসব ভেবে বইটা না হাতে নিলে ভীষণ বড় ভুল হবে। ছোট্ট ১০০ পাতার বইয়ে এত সুন্দর করে উঠে এসেছে আমাদের ওপর হওয়া শোষণের ঘটনা!
মোটামোটি লাগলো আসলে। উপনিবেশবাদ, পুঁজিতন্ত্রের ইতিহাস পড়ার সুবাদে মসলা সম্পর্কিত বেশিরভাগ ইতিহাসই জানা ছিল। তবুও বইটা পড়ার কারণে বলা চলে আরেকবার রিভিশন হল। বইয়ে মূলত মসলার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে পর্তুগিজদের ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে কালিকট, কোচিন, গুজরাটে আগমন ও মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের ইতিহাসকেই তুলে ধরা হয়েছে। শেষের দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে ডাচদের ইন্দোনেশিয়দের ওপর অত্যাচার ও উপনিবেশের ইতিহাসকে। হিস্ট্রি বা ননফিকশন হিসেবে মোটামোটি লাগল আরকি।
মসলাকে কেন্দ্র করে এতোকিছু! যুদ্ধ, রক্তপাত, শাসন-শোষণ কোনোকিছু বাদ যায় নি। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে উপনিবেশবাদী দেশগুলো যা যা করেছে, তাকে কোনো যুক্তিতে নায্যতা কিংবা সমর্থন দেওয়া সম্ভব না।
উপনিবেশিক দেশগুলোর মনোভাব আর শাসন - শোষণের প্রকৃতি বেশ ভালো ভাবে অল্পপৃষ্ঠায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। ভারতবর্ষ চিরকালই প্রকৃতির প্রাচুর্যের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও বঞ্চিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস বোধহয় কেবল বঞ্চনা আর শোষণেরই ইতিহাস :")
"মানবতাবিরোধী অতি জঘন্য কাজের সাথে যদি কোনো মতে ধর্মকে সংশ্লিষ্ট করে রাখা যায়, তবে তার সব দোষ কেটে যায়। শুধু দোষ কেটে যাওয়াই নয়, সময় সময় তা অতি মহৎ ও পবিত্র কাজ বলেও কীর্তিত হয়ে থাকে।"
❝ধর্মীয় প্রেরণা এবং নগ্ন ও নৃশংস স্বার্থ বুদ্ধির কি এক অপূর্ব সমাবেশ! কিন্তু এটা পোর্তুগীজদেরই একচেটিয়া নয়। এ দৃষ্টান্ত কোন দেশে নেই? মানবতাবিরোধী অতি জঘন্য কাজের সাথে যদি কোন মতে ধর্মকে সংশ্লিষ্ট করে রাখা যায়, তবে তার সব দোষ কেটে যায়। শুধু দোষ কেটে যাওয়াই নয়, সময় সময় তা অতি মহৎ ও পবিত্র কাজ বলেও কীর্তিত হয়ে থাকে।❞
এক লোকমা বিরিয়ানি মুখে দিলেন কিন্তু কোনো মসলা দেওয়া হয়নি বা এক চামুচ পায়েস মুখে নিলেন মসলা অনুপস্থিত, কেমন লাগবে? একসময় ছিল যখন মসলার দাম মণিমুক্তা থেকে কম ছিল না। চমকে উঠলেন? সাধারণ মসলার জন্য কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়া বইয়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই অসাধারণ হওয়ার দরুন দিতে হয়েছে প্রচুর রক্ত!
১৪৮৮ সালে কালিকট বন্দর বানিজ্যের জন্য পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি অর্জন করে। আরব বণিক, হিন্দু বণিক, গুজরাটের মুসলিম বণিকসহ চারিদিক থেকে প্রচুর জাহাজ এসে ব্যাবসা-বানিজ্য করতো। কিন্তু ব্যাবসার দিক দিয়ে কেউ আরবদের টেক্কা দিতে পারতো না। আরবের বণিকরা আরববিশ্ব ও ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে মসলার লেনদেনের মাধ্যম ছিল। এইসময় ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হওয়ার ফলে খ্রিস্টানরা কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে৷ নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বহু বহিরাগত শক্তি ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া ও সমুদ্র দখল নেওয়ার ফন্দি আঁটতে থাকে।
মসলা বানিজ্যের বিপুল লাভের কথা চিন্তা করে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজরা ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়াতে বেশ দীর্ঘ একটা সময় রাজত্ব করে। কিন্তু কালিকটে প্রথম এবং বারংবার আক্রমণ হলেও পর্তুগিজরা টিকতে পারেনি হিন্দু-মুসলিম জোটের কারণে। ভাস্কো দ্য গামা কলিকটে এসে যখন হজ্জ যাত্রীদের পুড়িয়ে মারে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কালিকট জয় করতে না পারলেও অন্যান্য রাজ্য দখল নিতে পারে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবের ফায়দা নিয়ে। বানিজ্যের নাম করে কৃষককে জমি কেড়ে নিয়ে তাঁদেরই কৃতদাস বানিয়ে ফেলে। বিদ্রোহী কৃষকদের রক্তে বারংবার ভিজেছে মাটি...
৮০ পৃষ্ঠার বইটা শেষ করার পর মনে হচ্ছে এখন খেতে বসলেই মনে পড়বে শত শত বছরের নির্যাতন, হত্যা, অন্যায়ের কথা। ছোট ছোট দানাদার মসলার মূল্য মানুষের জীবনের থেকেও বেশি!!! যতবারই দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে ততবারই তৃতীয়পক্ষ সুবিধা পেয়েছে। তবুও আজও কেন ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ হয় না? ভারতবর্ষের দাসত্বকাল নিয়ে জানলেও ইন্দোনেশিয়ারটা জানা ছিল না। এতো বর্বরতার পরও সাদা চামড়ার দালালরা নিজ জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কালে কালে মীরজাফরদের জন্ম হয়। বিদেশি শত্রু থেকে দেশীয় শত্রু অধিক বিপদজনক। নিমকহারাম নিজ দেশে থাকলে অপরের দাসত্ব তো করতেই হবে।
এবারের ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেনজার্নিতে পড়ার জন্য এ বইটিকে বেছে নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম উপভোগ্য হবে জার্নিটা। কিন্তু তা আর হলো কই! বরং মন খারাপ হলো। রক্তচোষা ইউরোপীয়ান দের লোলুপতার কাছে শান্তিপ্রিয়, নীরিহ ভারতীয় উপমহাদেশ আর জাভার নাগরিকদের শোষিত হবার গল্প পড়তে পড়তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আর মনে হলো "Peace was never an option"
যেকোনো অপকর্মের সাথে যদি একটু ধর্মের ছোঁয়া লাগিয়ে দেওয়া যায়, তবে দেখা যায় সেটা একটা বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে পবিত্র কাজ হয়ে যায়। এটা একটি চিরন্তন সত্য। অতীতে হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে। আশা করি ভবিষ্যতেও হতেই থাকবে। এই ধরুন আজকের জেহাদের নামে আত্মঘাতী বোমা হামলার কথাই বিবেচনা করি। অনেক মানুষ মনে করে ইহা পবিত্র কাজ। শুধুমাত্র ধর্মের ছোঁয়া লাগানোর কারনেই মানুষ মানবিকতার ধার ধরে না। যাই হোক বই এর কথায় আসি। সত্যেন সেন তার এই "মসলার যুদ্ধ" বইটি লিখেছেন এই উপমহাদেশে কিভাবে পশ্চিমারা সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেড়িয়েছিল সেসব কথা বলার জন্য। লেখক দারুণ ভাবে অনেক অজানা ইতিহাস সামনে নিয়ে এসেছে সেই সাথে মুখোশ খুলে দিয়েছে অনেক নায়কের।
ভাস্কো দ্যা গামা কে আমরা অনেকটা হিরোই মনে করতাম। অথচ কতোটা জঘন্য ছিল তার কাজ কারবার তা এই বই না পড়লে জানতাম না। ও হ্যা এই বই এর নাম কেন মসলার যুদ্ধ হল সেটাও তো জানা দরকার। আসলে সেই পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকের দিকে ফ্রিজ ছিল না, অথচ পশ্চিমা দেশগুলো একটা দীর্ঘ সময় শীতের কবলে থাকতো। তো সেসময়ে খাওয়ার জন্য মাংস সংরক্ষন করে রাখতে হতো। এই মাংস লবন আর গোল মরিচ দিয়ে সংরক্ষণ করা হতো। এই ক���রনে গোলমরিচের চাহিদা পশ্চিমে খুব বেশি ছিল। আর গোলমরিচ হতো ভারত, ইন্দোনেশিয়া এই সব এলাকায়। এই গোলমরিচ এর একচেটিয়া ব্যাবসা একসময় ছিল রোমানদের হাতে। কিন্তু অধিক লাভ করার লালসা বাকিদের বাধ্য করে গোল মরিচের উৎস সন্ধানে বের হতে। সেভাবেই পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্যা গামা পথ খুজতে খুজতে চলে আসে ভারতে। আর ভ্যাটিকান সিটি থেকে তৎকালীন পোপ পর্তুগাল কে এই এলাকায় ব্যাবসা করার একছত্র আধিপত্য দিয়ে দেয়। ফলে শুরু হয় পর্তুগিজ নোংরামি। আরবদের সাথে ছিল পর্তুগিজদের জাত শত্রুতা। তার নিদর্শন আপনি বইটা পরলেই বুঝতে পারবেন।
কিন্তু যখন থেকে প্রটেস্টান্ট মতবাদ মাথা চারা দিতে থাকলো তখন থেকে পোপের ক্ষমতা কমতে থাকলো। ফলে এবার ভারতে এলো প্রটেস্টান্ট মতবাদে বিশ্বাসী ডাচরা। এরপর এলো ইংরেজরা। শুরু হল দীর্ঘ মেয়াদী ঔপনিবেশিক শাসন। আর এ পথ আর ও সোজা করে দিলে কিছু বিশ্বাসঘাতক ভারতীয় রাজা।
বইটা পড়ে ফেলুন, অনেক অজানা ইতিহাস মনের জানালায় টোকা মেরে যাবে। লেখক দারুণ ভাবে সেসময়ের ইতিহাস তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল ভাবে সংক্ষিপ্ত পড়িসরে।
'...এই মসলার যুদ্ধ রক্তাক্ত, হিংস্র, বীভৎস। আবার এই মসলার যুদ্ধ প্রাচ্যের পরিবর্তনহীন পশ্চান্মুখী সমাজের সামনে বৃহৎ বিশ্বের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বদ্ধ জীবনের উপরে দুরন্ত ঝটিকার আলোড়ন জাগিয়েছে, প্রচন্ড অত্যাচারের শক্তি স্বপ্ন-দেখা ঘুমন্ত মানুষকে চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে তুলেছে। ওটাও সত্য। এটাও সত্য। কোনোটাই মিথ্যা নয়।'
ঠিক কতকাল আগে এরকম একটা দারুণ নন-ফিকশন পড়েছি বলতে পারবোনা। ঔপনিবেশিক ইতিহাস জুড়ে মসলা যে এতবড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, ব্যাপারটা জানতাম না। ছোট একটা বইয়ে এত দারুণভাবে ইতিহাস বর্ণণা করা যায় বইটা না পড়লে বুঝতাম না। মনে হচ্ছিলো কোনো থ্রিলার পড়ছি। পর্তুগিজ, ডাচ, ওলন্দাজরা ইংরেজদের আগে এই উপমহাদেশে এসেছিলো শুনেছিলাম। ব্যস অতটুকুই। কিভাবে এলো কেন এলো সেসব নিয়ে এই প্রথম পড়লাম। এই মসলা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে কত শক্তির উত্থান-পতন ঘটেছে। বণিকদের মুনাফার তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাদের রক্ত তিন সমুদ্রের জলে মিশে আছে। আর ডাচেরা ইন্দোনেশিয়ার উপর ঠিক ইংরেজদের নীলকর অত্যাচারের মতো অত্যাচার করে কতগুলো বছর যে লুটেপুটে খেয়েছে, এই তথ্যটাতেও অবাক হয়েছি। নিজের সম্পদে নিজেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে থেকেছে ইন্দোনেশিয়ার কৃষকেরা। লেখক যথার্থই বলেছেন, আপনা মাংসে হরিনা বৈরী।
বইটার অলংকরণ এত দারুণ! দ্যু প্রকাশনীর উপর আস্থা বেড়ে গেলো। এই বইটা যদি রঙিন ইলাস্ট্রেশন সহ আসে আমি লুফে নিবো!
ছোট মরিচে ঝাল বেশিই হয়। তেমনি এই বইটার কলেবর ক্ষুদ্র হলেও ভাষাটা ভীষণ রকমের শক্তিশালী। অল্প কথায় সত্যেন সেন বর্ণনা করেছেন উপমহাদেশের মসলার লোভে ইউরোপের লোভী পরাশক্তিদের আক্রমণ ও নির্বিচারে মানবহত্যার করুণ কাহিনী। শতবর্ষ ধরে চলে আসা পর্তুগীজ, ডাচ ও ইংরেজদের অত্যাচারের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই পুরনো কথাটাই- জোর যার, মুল্লুক তার। আফসোসের বিষয় এই ২০২১ সালে এসেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বইটা প্রথম পড়েছিলাম সম্ভবত ২০১৫ সালে। হার্ডকপি, এবার পড়লাম ইপাব। বেশকিছু বানান ভুল আছে যা যথেষ্টই বিরক্তিকর। তবে সেসব খুঁটিনাটি বাদ দিলে বইটা একবসায় পড়ে ফেলার মতো। তবে একটা কথা, চট করে পড়ে ফেলতে পারবেন- কিন্তু মাথায় ভাবনার খোরাক জোগাবে অনেকখানি সময়ের জন্য।
প্রথমে তেলের মধ্যে এলাচ, তেজপাতা, দারুচিনি দিয়ে একটু ভেজে নিন। একটা সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে। এরপর পেঁয়াজ কুচি (নায়িকাদের মতো moon moon শেপে না কাটলেও হবে!) করে কেটে নিয়ে তেলের মধ্যে ছেড়ে দিন। হালকা লালচে হয়ে আসলে সেখানে হলুদ, মরিচ, জিরা আর গরম মসলার গুঁড়া দিয়ে অল্প একটু পানি সহকারে নাড়তে থাকুন। মসলা ভাজা হয়ে গেলে আরেকটু পানি দিয়ে নিন। এরপর আদা, রসুন আর পেঁয়াজ বাটা দিয়ে আবার কষাতে থাকুন হালকা আঁচে...
মসলা কষতে থাকুক। এবারে একটু মসলার অতীতে যাই।
আমাদের খাওন মানেই মসলার বাহার। এই একটু ফোড়ন, এই গরম মসলা একদম ভেজে তেলে ভেসে উঠলে কী সুবাসটাই না আসে! বিদেশি মানুষ মসলা, ঝাল কম খায়। এদের অনেকে তো ক্যাপ্সিকাম খেয়ে বলে, ❛O my god! Toooo spicy!❜ জাপানে তো পাতলা ল্যারলেরে স্যুপ খায়, নেই মসলার কোনো উপস্থিতি। ভোজন রসিক জাতি হিসেবে মসলাদার খাবারের বদলে এসব দেখলে মুখ ব্যাকা হবেই!
তবে এই যে স্বাদ বৃদ্ধি করতে এত মসলার ব্যবহারের হিড়িক, এর অতীতটা র ক্তাক্ত। শ্রমিকের র ক্তে, ঘামে আর জুলুমে সিক্ত।
মসলা উৎপন্ন হয়ে তা বিকোতে আসার সবথেকে বিখ্যাত বন্দর কালিকট। তারা মসলার একচেটিয়া ব্যবসা করছে। আর ওদিকে কালিকট থেকে আরব বণিকেরা সেই মসলা ইউরোপে নিচ্ছে। তুমুল লাভ করছে। ভেনিসও চড়া দামে এগুলো বিক্রি করে পয়সা কামাচ্ছে। এভাবেই চলছিল। কিন্তু সমুদ্রের অনেক দূরের একটি দেশ ভাবলো না এভাবে হবে না। অন্যের মাধ্যমে আর নয়। আমরা নিজেরাই এই মসলার রাজত্ব করবো। যেই ভাবা সেই কাজ। তবে পরিকল্পনা করলো অনেকদিন ধরে। বলছিলাম পর্তুগিজদের কথা। তারা মসলার খোঁজ করতে লাগলো। কীভাবে ভারতবর্ষে আসা যায় সে পথ খুঁজলো। পথের মাঝে বাঁধা আছে মুসলিম রাজ্য। ক্রু সেড পরবর্তী থেকে খ্রিস্টান আর মুসলিমে দা কুড়ালের সম্পর্ক। তাই খুঁজলেন অন্য পথ। একদল ম্যাপ তৈরি করে জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আগে হাল হকিকত দেখে গেল। এরপর কামান দাগা নিয়ে আফ্রিকা পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকলেন ❛ভাস্কো দা গামা❜। তাকে এই উপমহাদেশের আবিষ্কারক বললেও ভেতরের ইতিহাস একটু ভিন্ন। তিনি এবং তার দল এলেন, দ স্যুবৃত্তি শুরু করলেন। নিজেদের সমুদ্রের অধিপতি বলে বয়ান নিয়ে নিলেন আর নির্বিচারে শুরু করলেন হ ত্যা। মুসলিমদের প্রতি অগাধ ঘৃণাও বর্ষণ করতে লাগলেন। হজ যাত্রীদের জাহাজ লুট, তাদের পুড়িয়ে দিয়ে আপন ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে লাগলেন। এরই মাঝে উদ্দেশ্য পূরণের কাজ করতে লাগলেন। কালিকট এসে ব্যবসার অনুমতি নিয়ে নিলেন। তবে সেখানে রাজা আর প্রজায় ভাব। কালিকট বন্দরের রাজার সাথে ভাব আছে আরব বণিকদের। তারা বলেন এই পর্তুগিজদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। রাজা শুনলেন। এবং প্রমাণ পেলেন।
এরপর পর্তুগিজদের সাথে বেধে গেলো তাদের সং ঘর্ষ। শুরুটা হয়েছিল ১৪৮৮ সাল থেকে। এরপর থেকে শুরু (১৪৯৭) হলো ❛মসলার যু দ্ধ❜। তবে তাদের ঐক্যের সাথে পেরে উঠলো না গিজরা। পিছু হটলো। আবার লোকবল নিয়ে অন্যদিকে দখলের চেষ্টা করলো। এবং সফল হলো��� এই সফলতা অনেকটাই ছিল কূটনৈতিক কৌশল আর ধর্মের দোহাই। যুগে যুগে সবাই এই ধর্ম ব্যবসা করেছে। জাগতিক আপন স্বার্থে, ক্ষমতার লোভে ঈশ্বরকে যু দ্ধে নামিয়েছে। ১৫০৩/০৪ থেকে প্রায় ১৫৯৯ পর্যন্ত বা আরেকটু বেশি সময় ইউরোপে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিল পর্তুগিজরা। মসলার ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। এরপর একই পথে পা দিলো ডাচেরা। তারাও একই আধিপত্য বিস্তারের জন্য পথ খুঁজে এলো। পর্তুগিজদের হটালো। সাথে দেশীয় কিছু লোকের সহায়তা তো ছিলই।
জা লিম পরিবর্তন হলো কিন্তু মজলুম অপরিবর্তিত। ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা আপন ভূমিতেই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হতে লাগলো। একসময় ডাচরা নিজেদের নানা নিয়ম চাপিয়ে দিতে লাগলো, করায়ত্ব করলো জমি, জোর করে লবঙ্গ চাষ নিষিদ্ধ করলো। উপনিবেশ তৈরি করলো। এভাবেই নির্যাতনের স্বীকার হতে লাগলো এই উপমহাদেশের মানুষ। এরপর এলো সাদা চামড়ার ব্রিটিশরা। এরাও মসলার ঘ্রাণেই এসেছিল। আধিপত্য ছড়িয়েছিল। রাজ করেছিল দুইশ বছরের মতো। ডাচরা যেমন চাষের জন্য নি র্যাতন করতো, তেমনই ইংলিশরা করলো নীল চাষের জন্য অকথ্য নি র্যাতন। সে এক অন্য ইতিহাস। মসলার জন্য, শুধু মাত্র স্বাদ বর্ধনের একটা উপকরণের আধিপত্য, সাম্রাজ্য বিস্তার আর ধর্মের দোহাই দিয়ে অগণিত মানুষের র ক্তে রঞ্জিত হলো ভূমি। যা চলমান আছে ভিন্ন কোনো রূপে, চলমান থাকবে। ধরন বদলাবে কিন্তু মূল একই থাকবে।
হায়রে মসলা!
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝মসলার যু দ্ধ❞ সত্যেন সেনের লেখা অসাধারণ এক বই। থ্রিলার উপন্যাসে যেমন থ্রিল পাওয়া যায় ১০০ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই প্রবন্ধে রোমাঞ্চের পরিমাণ কম নয়!
এই উপমহাদেশে রাজ করেছে অনেকে। সম্পদের ভান্ডার থেকে লুট, নি র্যাতন আর কাড়াকাড়ি হতে হতে বাকি নেই কিছুই। সত্যেন সেন সেই ইতিহাসেরই এক টুকরো এনে হাজির করেছেন বইতে। মসলার ইতিহাস করুণ। এতে লেগে আছে মানুষের র ক্ত। আধিপত্য বিস্তারের খেলায় পর্তুগিজ, ডাচ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ সবাই এসেছে। দেখে গেছে কী আছে এই উপমহাদেশে। থেকেছে, জুলুম করেছে, নিজের কোচ ভর্তি করে নিয়ে ভেগে গেছে। মসলার এই আধিপত্য বিস্তারের জন্য হানাহানির শুরুটা পঞ্চদশ দশকের একদম শেষের দিকে। একটু প্রস্তুতি শুরু হয় এরপর প্রায় দশ বছর পর তথা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় গিজদের অভিযান। সাফল্যের মুখ দেখতে একটু দেরি হলেও তা পুষিয়ে নিয়েছে। বণিকেরা শুধু বাণিজ্য করে। কিন্তু পর্তুগিজ এই দ স্যু গুলো বাণিজ্যের সাথে করতো লুণ্ঠন। মনে অসীম ঘৃণা রাখতো মুসলিমদের জন্য। সেই ঘৃণার প্রমাণ তারা দিয়েছে তাদের কাজে। স্কুলে থাকতে ইতিহাসে ভাস্কো দা গামাকে নিয়ে সুবাক্য পড়ে তার প্রতি যে ধারনা মনে থাকবে তার ভিত নড়ে যাবে ইতিহাসের ভেতরে পাঠ করলে। মসলার এই অভিযান, মৃ ত্যুর মিছিলের সামনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। নিজের বর্বতার প্রকাশ করেছিলেন, করেছিল তারপর আগত গিজরাও। লেখক কালো এই অধ্যায়ের বর্ণনা করেছেন নিপুণভাবে। প্রশ্ন রেখে গেছেন, করেছেন স্বগক্তি। ইতিহাসের করুণ এই অধ্যায় গুলো যেন সব কালের জন্যই এক। সবখানেই আছে ক্ষমতার লোভ, আধিপত্য বিস্তার, ধর্ম ব্যবসা, হানাহানি। এই দুনিয়ার কাঠামো যে কত লা শের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার কোনো সীমা নেই। পর্তুগিজ থেকে ডাচ এরপর ব্রিটিশ রাজে এসে ইতি টেনেছেন লেখক। মাঝে এনেছিলেন অল্প বিস্তর কফির ইতিহাস। সেখানেও আপন স্বার্থ, আপন আঁখের গোছানো আর জু লুমের কথা আছে। বইটা দারুণ। এত সুন্দর করে ইতিহাস যে লেখা যায় সেটা এই বইটা না পড়লে বোঝা যাবে না। আমরা বলি আগের যুগ, মানুষের অতীত ভালো ছিল। তারা সুখে ছিল। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যুগে যুগে সাধারণ মানুষ কত নি র্যাতনের মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। কত হাহাকার যে চাপা পড়ে গেছে আধুনিক সভ্যতার নিচে তার ইয়ত্তা নেই।
❛ক্ষমতার ল ড়াই ছিল, আছে থাকবে। দাপট দেখানোর জন্য বলি হবে সাধারণ মানুষ। এটাই ইতিহাস। ইতিহাস পড়তে পড়তে সেই নিয়ে দুঃখ করতে করতেই হয়তো আমি কিংবা আপনি এক প্লেট সুস্বাদু বিরিয়ানি কিংবা মসলার গুণে তৈরি কষা মাংস নিয়ে বসবো। খাবো আর বলব, ❛আহ! কী সুস্বাদু। আহারে ইতিহাসটা কত দুঃখের!❜❜
বেশ অনেকদিন ধরে বইটার রিভিউ গুডরিডস এবং সোসাল মিডিয়াতে দেখে পড়ার ইচ্ছা ছিল। অবশেষে পড়া হল। শুধুমাত্র মসলার জন্য শোষণের গল্প পড়লাম। তিন তিনটি ইউরোপীয় শক্তি মসলার জন্য এসে যেভাবে ভারতবর্ষ শোষণ করেছে তা আসলেই নির্মম। কিন্তু এই নির্মমতায় যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং যারা শোষণ করছে কোন না কোনভাবে যা নিজেদের লজিকে হালাল বানানোর প্রচেষ্টাও কম করছেনা। এবং দিনশেষে যারা শোষণের স্বীকার হচ্ছে তারাই ভুক্তভোগী। বইটা ভালো লাগলো, আলোচনা দেখে এক্সপেকটেশন যেমন ছিল সেটা পূরণ হয়েছে।
প্রথমেই জেনে নিন এটা কিন্তু ঐতিহাসিক কাহিনী।ব্যক্তিগত ভাবে আমার ইতিহাস সংক্রান্ত লেখা ভালো লাগেনা তাও বইটার খুব প্রশংসা শুনে পড়ার সির্ধান্ত নিই। ছোট্ট একটা বই অথচ কত তথ্যে পরিপূর্ণ।ভারতীয়দের ওপর ঔপনিবেশিকদের শোষণের অতি বিভৎস ও নগ্ন রূপ এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ইতিহাসপ্রেমী হলে অবশ্যই পড়ুন, ইতিহাসপ্রেমী না হলেও পড়ে দেখতেই পারেন মসলার সাথে জড়িত ইতিহাস।
মুখরোচক ও বৈচিত্র্যময় খাবার প্রস্তুতিতে যার কোনো বিকল্প নাই সেই মসলা, যা ছিল এককালে মনিমুক্তের মতো মূল্যবান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যের প্রথম ও প্রধান পণ্য ছিল এই মসলা।এই মসলার রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস।ভাবলেও অবাক লাগবে এই মসলার জন্য কত বড় বড় যুদ্ধও হয়েছে। সামান্য মসলার জন্য !! একটা বিস্ফোরক তথ্য, ভাস্কো দা গামার কীর্তির স্বরূপ এটাই প্রমাণ করে যে তিনি আসলে ধর্মবিদ্বেষী ও জলদস্যু ছাড়া আর কিছুই না।
ভারতবর্ষ এবং পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে উৎপাদিত হত বিভিন্ন ধরনের মসলা৷ আর ইউরোপীয়দের রান্নায় মসলার ব্যাপক চাহিদা ছিল৷ এসব মসলা ভারতবর্ষ, মালয় আর ইন্দোনেশিয়া ছাড়া কোথাও পাওয়া সম্ভব ছিল না৷ মসলার বাণিজ্য করে কালিকট রাজ্যর ব্যাপক সমৃদ্ধিতে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পর্তুগালের৷ পরবর্তীতে পঞ্চদশ শতকে এই মসলার জন্য কুৎসিত লোভে বর্বর অন্যায় দিয়ে শুরু হয় দখল-অধিকার, হানাহানি, উপনিবেশ স্থাপন ও সাম্রাজ্যেবিস্তারের অন্যরকম এক যুদ্ধ৷ এই মসলার যুদ্ধ রক্তাক্ত, হিংস্র ও বীভৎস৷ পর্তুগালের দেখানো পথ ধরে সেখানে এলো ওলন্দাজরা, গঠিত হয় ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তাদের পিছু নিয়েই আসলো ইংরেজরা- সপ্তদশ শতাব্দীতে৷ পরবর্তী দুইশ বছরের ইতিহাস সবার জা���া!
উপমহাদেশে পর্তুগালের ভিত্তিস্থাপন করতে অনেক নুন তেল কাঠ খরচ করতে হয়েছিল৷ ক্রুসেডসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে মুসলমান ও খ্রিস্টানরা তখন ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী৷ ইউরোপে আরব বাণিজ্যর একচেটিয়া ব্যবসার প্রধান পণ্য ছিল 'মসলা'৷ কিন্তু এই মসলার ব্যবসায় প্রভাব খাটাতে হলে পর্তুগালের মুসলিম দেশ অতিক্রম করে ভারতবর্ষ পৌঁছানো ছিল অসম্ভব ব্যাপার৷ তাই পৃথিবীতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে পোপের সাহায্য রাজা হেনরি দক্ষ নাবিক, গাণিতিক, মানচিত্রকারক ও জ্যোতির্বেত্তাদের নিয়ে ভারতবর্ষ যাবার বিকল্প পথের অনুসন্ধান চালালেন৷ অতপর দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর বিকল্প জলপথ আবিস্কার হলে রাজা ডোম ম্যানুয়েলের আদেশে ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে কালিকটে আক্রমণ চালায়৷ এই আক্রমণে রাজ্য রক্ষার্থে হিন্দু- মুসলমান- আরব বণিক সবাই ভেদাভেদ ভুলে কামানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠল৷ ফলাফল আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র নিয়েও পর্তুগিজের শোচনীয় পরাজয়৷ তাহলে কিভাবে পরবর্তীতে পর্তুগিজরা এই উপমহাদেশে আবাস গড়ে তুলল? কিভাবে ইন্দোনেশিয়া, মালাক্কা, কলম্বো, কোচিনসহ বিভিন্ন বড় বাণিজ্যকেন্দ্র দখল করে নিল? ডাচ (ওলন্দাজ) বাহিনী জমি দখল নিয়ে কিভাবে চাষীদের শোষণ করেছিল? এইসব প্রশ্নের উওর আর উপমহাদেশে অনেক ইতিহাস জানতে তথ্যপূর্ণ ছোট বই 'মসলার যুদ্ধ' পড়ে ফেলুন৷
কলোনিয়াল ইতিহাসে বীর 'ভাস্কো দা গামা'র নৃশংস মনোভাবের এক ঘটনা নিম্নরূপঃ 'মক্কা থেকে হজ-যাত্রীদের নিয়ে কয়েকটা নিরস্ত্র জাহাজ দুর্ভাগ্যক্রমে পর্তুগিজ জাহাজের সামনে পড়ে গেল৷ জাহাজগুলোকে আটক করে সব মালপত্র লুট করে তারা জাহাজগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল৷ কিন্তু ভাস্কো দা গামার কড়া আদেশ ছিল জাহাজে যে সমস্ত আরবীয়রা আছে তাদের যেন তুলে আনা না হয়৷ হয়ভাগ্য আরবীয়রা সেই জাহাজে জ্বলে পুড়ে মরল৷ আর ভাস্কো দা গামা সেই দৃশ্য পরম আনন্দে উপভোগ করলেন৷
স্কুলের পাঠ্যবই, ভর্তি পরীক্ষা কিংবা চাকুরির পরীক্ষার বদৌলতে সবাই কমবেশি "ভাস্কো দ্য গামার" গুণকীর্তন সমন্ধে হালকা-পাতলা জ্ঞান রাখি। হয়তো তিনিই প্রথম ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার সমুদ্র পথ আবিস্কার করেন বলে। কিন্তু ভাস্কো দ্য গামা মানুষটা আসলে কেমন ছিলেন? কেনই বা এসেছিলেন? এসেই বা কী করেছিলেন? আসলে ইউরোপিয়ানরা কেমন ছিলো? এসব প্রশ্নের উত্তর এই ছোট্ট বইটাতে পেয়ে যাবেন।
একসময়কার ধনকুবের রাষ্ট্র, সহজসরল মানুষদের সমন্বয়ে গঠিত ভারতবর্ষের পরাধীনতার বীজ বপন শুরু হয় এই "ভাস্কো দ্য গামার" কারণে। পর্তুগিজরা জলদস্যু ছিলো একথা হালকা পাতলা জানা থাকলেও বা পাঠ্য বইয়ে পড়ানো হলেও আসল অনেক কাহিনী বা তাদের বর্বরতা লুকায়িতই থেকে গেছে। হতে পারে ভয়ে বা ইউরোপিয় থাবা থেকে বাঁচতে। পশ্চিমাদের আজকের যে মনোভাব সেটি এই বর্তমান যুগের শুধু না। তারা অতীতেও এমোনি ছিলো। E.M. Forster তার বই A Passage to India তে যেমন বলে গেছেন কলোনিয়ালিস্টদের মনোভাব কেমন ছিলো সে সমন্ধেঃ
"You're superior to them, anyway. Don't forget that. You're superior to everyone in India except one or two of the Ranis, and they're on an equality."
ঠিক তেমোনি কথা এই বইতেও বলা। ভারতবর্ষের মানুষরা অত্যাচারীত নিপিড়ীত হবার যোগ্য। ইউরোপিয়রা যেন সকল ক্ষমতার উৎস। তারা যা বলবে সেসবই সঠিক। যেমন খ্রিস্টানদের সে সময়কার সর্বোচ্চ ধর্মনেতা বলেছিলেন পর্তুগিজদের ভারতবর্ষ আক্রমন, ভারতবর্ষে জলদস্যুতা সমন্ধে।
"কিন্তু মহামান্য পোপের বিধান-অনুযায়ী পর্তুগালরাজ জলরাজ্যের অধিপতি। কাজেই তিনি যাই করুন না কেন তাকে জলদস্যু কখনই বলা চলেনা।"
পর্তুগিজদের আসার পরই কী ভারতবর্ষে বানিজ্য শুরু হয়? না তার আগে থেকেই ভারতবর্ষ মসলার জন্য সমৃদ্ধ। আরব বণিকদের সাথে মসলার ব্যবসা অনেক পুরনো। এমনকি আরবরা কালিকটে তাদের নিজের বাসস্থানও তৈরী করে ফেলেছিলো। কিন্তু তারা কখনো পর্তুগিজ, ডাচ কিংবা ইংরেজদের মতো দস্যুতা করেনি। মুসলমান আর হিন্দুদের সমন্বয়ে গঠিত সুখ নগরীকে নরকে পরিনত করার জন্য প্রথমেই দায়ী পর্তুগিজরা। আর এসবের মূলে ছিলো মুসলমানদের হত্যা করার প্রয়াস। বিশেষত আরবদের। পর্তুগিজরা বর্বরতার এত নিচু পর্যায়ে গেছিলো যে তারা অস্ত্রছাড়া জাহাজগুলোকেও রেহাই দিতোনা। হজ্জের যাত্রীদের পুড়িয়ে মারতো।
এখানেও শেষ না। এর পরে আসে ডাচ আর ইংরেজরা। পর্তুগিজরা কে কাজ করে যেতে পারেনি সেটা এরা আসার পর শোধ করে নেয়। অন্তত তখনও ভারতবর্ষের কৃষকদের হাতে নিজের জমি ছিলো। নিজেরাই চাষাবাদ করত আর বিক্রিও করত। কিন্তু ডাচরা আসার পরে সেটুকুও তারা হারায়। জমিতে তারা আজও চাষাবাদ করে কিন্তু মালিক হিসাবে নয়, দিনমজুর হিসাবে।
বইটা ছোট্ট হলেও সমৃদ্ধ একটা বই। আমার তো মনে হয় সবারই এই বই পড়া উচিৎ। পড়ার সময় একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাবে "পশ্চিমারা হঠাৎ করে বেজন্মা হয়নি, তারা জন্মগতভাবে বেজন্মা, তাদের রক্ত দূষিত, এই রক্ত কখোনো ভালো কিছু বয়ে আনবেনা কারোর জন্যই, এরা যেখানেই যাবে সেখানেই ধ্বংসলীলা চালাবে।"
BCS নামক বোরিং সিলেবাসের অন্য সব বিষয় বিরক্তিকর হলেও। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে। অনেক রথী মহারথীদের নাম জানা হয়েছে এই সিলেবাস টুকুর সৌজন্যে। এজন্য আমি চির কৃতজ্ঞ। . অন্যান্য অনেক সাহিত্যিকের মত সত্যেন সেনের সাথে আমার পরিচয় BCS নামক সিলেবাসের বদৌলতেই। তার বিখ্যাত উপন্যাস "পাপের সন্তান, অভিশপ্ত নগরী " এর নাম জানা থাকলেও ইতিহাস আশ্রিত এই নন-ফিকশন বইটি রয়ে গিয়েছিল অজানাই। Saima Taher Shovon এর রিভিউ থেকে বইটি সম্পর্কে জানতে পারি। . বইয়ের বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় এটা যেন এক টুকরো ইতিহাস। প্রতিটি বর্ণনা যেন জীবন্ত। শুধু মসলার জন্যে উপমাহদেশে পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদের ভয়াল থাবা। প্রথম জানতে পারলাম ভাস্কো দা গামা আসলে নাবিক রুপি একজন জলদস্যু। শুধু মসলার জন্যে এই উপমহাদেশে একে একে পাড়ি দিয়েছে পর্তুগীজ, ডাচ্, ইংরেজরা। . ৬৭ পেজের এই নাতীদীর্ঘ বইটি আপনার মনে দাগ কাটবেই। Must read book. ☺ Happy Reading 🙂🙂
সমুদ্রের রক্তাক্ত ঢেউ ভারতবর্ষ এবং ইন্দোনেশিয়ার(বর্তমান) কিনারে যে মশলার গন্ধে আছড়ে পড়েছে তার এবং রক্তাক্ত স্রোতের মাধ্যমে ভেসে আসা ঔপনিবেশিক শক্তির বিচিত্র ইতিহাস এই ছোট্ট বইয়ে ফুটে উঠেছে ।জানা ইতিহাসের এক ভিন্ন অধ্যায় ,পড়ার মতো একটি বই।