চাঁদের অমাবস্যার ‘চুম্বক-চরিত্র’ যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর আত্ম-প্রবঞ্চনা এবং অস্তিত্ব-অন্বেষার বিষয়াদি। আর খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় প্রবেশ করবে আখ্যানটির প্রতিবেশ এবং ধর্ম কিংবা বিচার-বিবেচনা বিষয়ে লেখকের নানানকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়- কথাটি মিথ্যা নয় কিছুতেই। তারপরও বাঁচবার আকুলতা বুকে নিয়ে আর অমরতা লাভের অষুধের দোকান খুঁজতে খুঁজতে সাড়ে তিন হাত নিরাপদ ও আপন প্লটের দিকে আমাদের নিবিড়-নিশ্চিত অভিযাত্রা। মানুষের বাঁচবার এই অশেষ আকুলতার কারণেই গোরস্থানের সামনের ফ্ল্যাটের চেয়ে লেকের পাশের ফ্ল্যাটটির দাম দাঁড়ায় অনেকটা বেশি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস-গল্প ও নাটকে ‘ভয়’, ‘চাঁদের আলো’, ‘অন্ধকার’ প্রভৃতি অনুষঙ্গ পরিবেশিত হয়েছে।
Syed Waliullah was born on 15 August 1922 at Sholashahar in Chittagong. After completing his Bachelor’s from Ananda Mohan College in Mymensingh, he enrolled at Calcutta University but did not complete his Master’s. Proficient in both Bangla and English, he worked for the Statesman during 1945-1947. After the Partition, he moved to Dhaka and joined Radio Pakistan as assistant news editor. In 1950 he was posted to Radio Pakistan, Karachi. From 1951 to 1960 he served as press attache at Pakistan missions in New Delhi, Sydney, Jakarta and London. It was in Sydney that Waliullah met Anne-Marie Thibaud, whom he later married and who translated Lal Shalu into French. In 1960 Waliullah moved to Paris where he served as first secretary at the Pakistan Embassy till 1967 when he joined UNESCO. Syed Waliullah did not live to see the liberation of his motherland, passing away in Paris on 10 October 1971.
Syed Waliullah (Bengali: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ) is often considered the pioneer of existential analysis of the characters psyche and root cause analysis of social-psychic conflicts in the literature of Bangladesh. The last two of his three novels, specially Kando Nadi Kando, show his mastery in revealing the inner depths of his characters. Contemporary writer Shahidul Jahir was influenced by him.
Novels: লালসালু(Tree without roots), ১৯৪৮ চাঁদের অমাবস্যা (Dark moon), ১৯৬৪ কাঁদো নদী কাঁদো (Cry, o river), ১৯৬৮ The Ugly Asian, 1959
Play: বহিপীর (১৯৬০) তরঙ্গভঙ্গ (The Breakers), ১৯৬৫ সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) উজানে মৃত্যু
Short story collection: নয়নচারা (১৯৫১) দুই তীর ও অনান্য গল্প (Akte Tulse Gaser Khine), ১৯৬৫
ফ্রান্স আর ইতালির সীমানার খুব কাছে, আল্পস পর্বতের কোল ঘেঁষে ইউরিয়াজ নামের ছিমছাম একটি গ্রাম। পাইন, ফার ,এলমের ছায়াঘেরা এই প্রত্যন্ত জনপদে মধ্যরাতের সুনসান নীরবতা। ভালমত কান পাতলে পাণ্ডববর্জিত সেই প্রত্যন্ত জনপদের এক নিভৃত গৃহকোণে কলমের খসখস শব্দই শোনা যাবে কেবল। গৌরবর্ণের সেই মানুষটা লিখে চলেছে অবিরত, খানিক পর চশমাটা আলগোছে পাশে রেখে কী যেন ভেবে চলেছেন চুপচাপ। আবার তিনি মৌনীর মত সেই পিনপতন নীরবতার মাঝে কলম তুলে নেন, লিখে ফেলেন লাইনের পর লাইন। ফ্রান্স থেকে যোজন যোজন দূরের এক দেশে কী ভাবছেন এই তাপস ?
ফ্রান্স থেকে সটান চলে যাব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে। তখনো সেখানে শীতের কুয়াশা জেঁকে বসেনি, পাতলা সরের মত তার একটা পরত পড়েছে মাত্র। জ্যোৎস্নাশোভিত সেই রাতে একজন যুবক শিক্ষক দেখতে পায় একজন অর্ধ উলঙ্গ যুবতি নারীর নিস্পন্দ দেহ। সেই দেহ থেকে প্রাণপাখি অনেক আগেই উড়ে গেছে, একথা ঠাহর করতেও কষ্ট হয়না যুবকের। সেই আশ্চর্যউজ্জ্বল রাতে এই উটকো আবিষ্কার যুবকের ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়, সে জড়িয়ে পড়ে এক অযাচিত দৈব দুর্বিপাকে।
এদিকে ফ্রান্সের সেই গাঁয়ে লেখকের কলম তখন তুফান গতিতে ছুটছে। তার মাথার ভেতরে তখন এক অতীন্দ্রিয় জগত, যেখানে একজন যুবক শিক্ষক অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে খাবি খাচ্ছে, পড়ে গিয়েছে ভয়-দ্বিধা-সংশয়ের এক অতল গহবরে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নামের ওই ভিনদেশী লেখক বুঁদ হয়ে আছেন এক জাদুবাস্তবতার জগতে, লিখে চলেছেন তার এক কালজয়ী কীর্তি- চাঁদের অমাবস্যা ।
চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট আদপে একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য, দুলাইনেই এর সারগর্ভকে এক খোঁচায় লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এই আপাত নিস্তরঙ্গ, নিথর উপন্যাস হাতে না নিলে বোঝা দায়, কি এক অদ্ভুত প্রহেলিকা প্রোথিত আছে এই উপন্যাসের ভেতর। উপন্যাসের শুরুটা আগেই জানান দেওয়া হয়েছে। যুবক গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের আশ্রিত শিক্ষক, এক শীতের রাতে কোন এক বিচিত্র খেয়ালে সেই পরিবারের একজন সদস্য কাদেরের পিছু নেয়। কাদের একজন স্বল্পবাক ব্যক্তি, নিজেকে রহস্যের মোড়কে আবৃত করে রাখতেই পছন্দ করেন। অন্তুর্মুখী কাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন, এমন কথা অনেকে বলতে কসুর করেননা। কিন্তু তার অলৌকিক ক্ষমতা থাক আর নাই থাক, নিজেকে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন করে রাখার কারণে আকে নিয়ে অনেকের মাঝেই শ্রদ্ধামিশ্রিত সমীহভাব কাজ করে। এই অতিসাধারণ অর্বাচীন যুবক শিক্ষক আরেফ আলীও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই এই সমীহজাগানিয়া কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরেই সেই রাতে কাদেরের পিছু নেয় শিক্ষক। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে বাঁশঝাড়ে আবিষ্কার করে বসে এক গ্রাম্য রমণীর মৃতদেহ। এবং এই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার শেষে সে কাদেরের সাথে মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ঐ নির্জন স্থানে একটি শবদেহের আবিষ্কার, এবং এরপর হঠাৎ রহস্যময় কাদেরের আকস্মিক উদয় যুবককে ফেলে দেয় এক দুর্বোধ্য জটাজালে।
অবাক হতে পারেন, উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ বলতে গেলে এটুকুই। কিন্তু এই অঘটনের পর যুবক শিক্ষকের টানাপোড়েন আর দ্বন্দ্বই মূলত উপন্যাসের উপজীব্য। দরবেশসুলভ ভাবমূর্তির জন্য কাদেরকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে না পারা যুবক শিক্ষকের মানসিক অসহায়ত্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার মুদ্রার উলটো পিঠে কাদেরের সাথে সেই নারীর কোন সংযোগ স্থাপনে অক্ষমতা তাকে নিদারুণ পীড়া দিতে থাকে। লৌকিক, প্রচলিত ধারণার বাইরে কোন অসংস্কৃত, অগ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে পৌঁছানোর দীনতা তাকে কুরে কুরে খায়। বরং নিজের দুর্বলতার জন্য তার মাঝে এমন ভাব্নাও আসে, কাদের কি তাকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিল? এ ধরনের পরস্পরবিরোধী এক ইন্দ্রজালে ধীরে ধীরে লেখক পাঠককে জড়িয়ে ফেলেন, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের চিরন্তন সংজ্ঞার ব্যবচ্ছেদে প্রলুব্ধ করেন।
বলতে দ্বিধা নেই, এক লহমায় গোগ্রাসে গেলার মত বই এটি নয়। যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি লেখক পাঠককে করতে চেয়েছেন, সেসব সওয়ালের জবাব দিতে হলেও ভাবনার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যেতে হবে নিশ্চিত। অস্তিত্বের এই নানামুখী সংঘাতে যুবক শিক্ষক নাচার হয়ে পড়েন, কিন্তু শেষমেশ প্রকৃত ঘটনার নগ্ন রুপ উন্মোচিত হয়, এবং সেই দুরুহ সত্য তাকে তিলে তিলে গ্রাস করে। এবং অবধারিতভাবে এই সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে না পারার মাশুল তাকে দিতে হয়, পাকেচক্রে তার ঘাড়ে বর্তায় হত্যাকাণ্ডের দায়ভার। এসবই মোটামুটি অনুমেয় পরিণতি, কিন্তু যেটা অননুমেয়,তা হল এই সত্য আবিষ্কারের পথের নানান ঘাত প্রতিঘাত। কীভাবে একজন আপাতভীরু শিক্ষক অবস্থার ফেরে দুর্দান্ত সাহসী হয়ে ওঠে, সেটারই এক উত্থানপতনবহুল দ্বন্দ্বমুখর বয়ান এই বইটি।
ওয়ালীউল্লাহর এই উপন্যাস বিভিন্ন দিক দিয়েই অভিনব, উল্লেখ করার মত হাতেগোনা কটি চরিত্র, কিন্তু সেগুলোকেই তিনি ছাঁচে ঢেলেছেন নিপুণ হাতে। পাঠকের মর্মমূলে গিয়ে তিনি আঘাত করেছেন বারংবার, তাকে দাঁড় করিয়েছেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়। অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের সংজ্ঞা না জেনেও তাই সচেতন পাঠকের কাছে চরিত্রগুলোর অস্তিত্বের সংকট ধামাচাপা থাকেনা, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত ধীরে ধীরে বিমূর্ত হয়ে উঠতে থাকে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর ভাষা এতো অসম্ভব সুন্দর! এই উপন্যাস ' stream of conscious ' আর ' existentialism 'ধারার অসাধারণ সমন্বয়। এমন উপন্যাস এতো আগে বাংলায় লেখা হয়েছে তা ভাবতে পারিনি। এই উপন্যাসের অনেক রিভিউ বিদ্যমান, আমার তা না দিলে ও হবে। তবে মুগ্ধতাবোধ তো প্রকাশ করা উচিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আমাদের সাহিত্য জগতের সুপারস্টার তাতে কোন সন্দেহ নেই।' চাঁদের অমাবস্যা '- মানব মনের চিরায়ত কল্পনা-বাস্তবের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সামাজিক নৈতিকতার হিপোক্রেসি, আমাদের সমাজ বাস্তবতার রূঢ়তা, অন্যায়ের প্রতীকী প্রতিবাদ ইত্যাদির অসামান্য সাহিত্যিক সমন্বয়। আমাদের আরো বেশি বেশি ওয়ালী-চর্চা করা উচিত।
এটা ঠিক উপন্যাস না, একটা জাল। ঘোর লাগানো মায়ার জাল। যেখানে পাঠক আটকে পড়তে বাধ্য। শহিদুল জহিরের উপন্যাস বা ছোট গল্প পড়ে যেমন হতবাক হয়ে বসে থাকতে হয় ঠিক তেমন অবস্থা হল সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্র দ্বিতীয় উপন্যাস "চাঁদের আমাবস্যা" পড়ে। হয়তো জহির সাহের তার জাদুবাস্তব ওইসব লেখার অনুপ্রেরনা ওয়ালিউল্লাহ্ সাহেবের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।
উপন্যাসটিতে খুব বেশি চরিত্র নেই, এমনকি খুব বেশি কথোপকথন ও নেই। আছে এক যুবক শিক্ষক এর নিজের সাথে যুদ্ধের অন্য রকম বর্ণনা। এক রাতে বাশ বনে যুবক শিক্ষক এক অর্ধ উলঙ্গ নারীর লাশ দেখতে পায়, দেখতে পায় তার হত্যাকারীকেও। সেখান থেকে শুরু হয় যুবক শিক্ষকের যুদ্ধ। অত্যন্ত দুর্বল ও ভীতু মনের অধিকারী যুবক শিক্ষক তার বিবেকের সাথে, তার মানসিক দুর্বলতার সাথে যুদ্ধ করতে থাকে অনবরত। পুরো উপন্যাস চলেছে যুবক শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিক এই টানপোড়েন নিয়ে।
অসাধারন লেখনী দিয়ে লেখক আপনাকে আটকে রাখবে, ঘুরপাক খাওয়াবে নিজের ইচ্ছেমত। না পড়া থাকলে পড়ে ফেলুন। চমকে উঠবেন।
ধরুন একটা ঘটনা আপনি শুনলেন। কিন্তু জানেননা আসল কাহিনী কী। আপনার আগ্রহ আছে ঘটনাটার উপর। আপনি চিন্তা করেন সেটা নিয়ে। একেকবার একেক চিন্তা। একবার এইটা দিয়ে মিলানোর চেষ্টা করেন তো আরেকবার ওইটা দিয়ে। কল্পনার রাজ্যে মানুষ কল্পনা করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই কল্পনা ঠিক কত রকমে করা যায় সেই সুত্র কী আছে?
মাতাল করা চাঁদনি-রাত... কেউ একজন সেই অপরূপ মধ্যরাতে বিভোর হয়ে জোছনা-আচ্ছাদিত রূপসুধা পান করছিল। হঠাৎ পরিচিত একজনকে হনহন করে হেঁটে যেতে দেখল, এই মাঝরাতে? কোথায়, কেন যাচ্ছে? চাঁদশোভায় মত্ত–কাজেই ঝোঁকের বশে অনুসরণ করতে শুরু করে সেই কেউ একজনটি। কিন্তু অচিরেই হারিয়ে বসে লক্ষ্যবস্তুকে। যাক, চান্নি-রাতের বিভ্রম ভেবে ফিরতে মনস্থির করে। কিন্তু একটা কণ্ঠ শুনল বোধহয়! নারীকণ্ঠ কি? নিশ্চিত হতে চাইল সে, তাই বাঁশঝাড়ের পাশে এগোতে লাগল... সেকেন্ডেই যেন আরো কিছু শব্দ .. পাতার মচমচ .. আবার নৈঃশব্দ বজায় থাকল পূর্বের মতোই।
সে কী কিছু দেখেছিল? কিছু শুনেছিল? কিংবা যা হয়ে গেল, এসব কি মস্তিষ্কের উর্বর কল্পনা ছিল? সে হয়তো নিশ্চিত, হয়তো না। পাজলের সব টুকরো মেলানোর জন্য সে সত্য-স্বপ্ন গুলিয়ে ফেলছে না তো? মাঝখানে আবার সরু খালের মতো ক্ষীণ একটি ধারা বয়ে যাচ্ছে– চোখ আর মনের দ্বিধা, বিশ্বাস ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। আচ্ছা, সে কেন এতসব ভাবছে? তার কি দুর্বলতা আছে সত্য প্রকাশে? সে কী পারবে তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মনুষ্যত্বকে জয়ী করতে?
▪️▪️▪️
বাংলা ভাষার অন্যতম সাইকোলজিক্যাল উপন্যাস বলা চলে। মানবমনের সূক্ষ্ম টানাপোড়েনের চিত্র কত সহজভাবে গ্ৰামীণ প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন– অসাধারণ।
অন্য আর দশজন বাঙ্গালির মতো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ’লালসালু’ দিয়ে। কবে, কোন মুহুর্তে সেই পরিচয় হয়েছিলো আজ ঠিক মনে নেই, তবে এতটুকু মনে আছে যে বয়সে ‘লালসালু’ পড়েছি সেই বয়সটি ’লালসালু’ কে ধারণ করার মতো সক্ষমতা আমার হয়নি। খুব সম্ভব এসএসসিতে কিংবা এইচএচসিতে পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে ’লালসালু ‘ ছিলো আমাদের। ফলে সিলেবাসের পড়ার জন্য যতটুকু পড়তে হয়, যতটুকু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিতে হয় ততটুকু পড়েছি হয়তো। স্কুল কলেজ পাশ দিয়েছি অনেকদিন হলো, বছর বছর চশমার গ্লাসও ভারি করছি অনেকদিন হলো কিন্তু সেই ওয়ালীউল্লাহর কাছে আর ফেরা হলো না। অবশেষে ’চাঁদের অমাবস্যা’ দিয়ে আবার প্রথম যৌবনের অধরা ওয়ালীউল্লাহর কাছে ফিরলাম।
সেই ফেরা বিফলে যায়নি। ‘চাঁদের অমাবস্যা’ আমার কাছে ধরা দিয়েছে অসাধারণ এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই হিসেবে। নিজের বোধের সাথে, নিজের বিবেকের সাথে, নিজের ভেতর লালন করা ন্যায়বোধের সাথে নিজের যে লড়াই হয়, সে লড়াইয়ে সামাজিক প্রতিপ্রত্তি কতোটা প্রভাব বিস্তার করে তার অসাধারণ এক আখ্যান এটি। মানুষের বিশ্বাস আর মূল্যবোধের যে চরিত্র সেটিই রচিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এর সাথে আছে গভীর জীবনবোধ অর্থাৎ জীবন সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, যা গল্পের মূল চরিত্র যুবক শিক্ষক তথা আরেফ আলীর আত্নকথনের মাঝদিয়ে ফুটে উঠেছে। আপতত দৃষ্টিতে একটি খুন এবং সেই খুন দেখে ফেলা ’যুবক শিক্ষকের’ ভেতর যে মায়াভ্রম তৈরি হয়, সেই ভ্রম কাটিয়ে উঠার লড়াই হলো উপন্যাসের গল্প। এই কাটিয়ে উঠার সাথে নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, প্রশ্ন, যুক্তি, জ্ঞান আর ন্যায়বোধ গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। এই এক লাইনের গল্পের মাঝেও লেখক পাঠককে কতোটা বিভ্রান্ত করতে পারে, কতো যুক্তি আর প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিতে পারে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই উপন্যাস।
গ্রামের নি:স্তব্ধ অন্ধকারে চাঁদের আলোয় যে বিভ্রম সৃষ্টি করে, যে মন্ত্রমুগ্ধতার জগতে নিয়ে মানুষকে বিহ্বল করে দিতে পারে এবং সেই বিহ্ববলতা পূর্ণ ভয়ের সাথে অপরাধবোধ সৃষ্টি যে একটি ধোঁয়াশাময় জগত সৃষ্টি করে ঠিক সেটিই করেছিলো যুবক আরেফ আলীর মনোজগতে। সেই ধোঁয়াশাময় সময়ে সে দেখতে পায় বাঁশবাগানে একজন নারী খুন হয়েছে এবং সেই বাঁশবাগানের সামনে আশ্রিতবাড়ীর ছোটছেলে কাদের কে দেখতে পায়। কিন্তু খুনটি কে করেছে সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারে না। নিজের ভেতর অসংখ্য বিশ্বাস, মমত্ববোধ দিয়ে সেই খুনের নানা কারণ, নানান ব্যাখ্যা সে দাঁড় করাতে চেষ্টা করে। অসংখ্য প্রশ্ন, অসংখ্য যুক্তির মধ্যে ডুবে থেকে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী একটা ঘোরলাগা সময়ে চলে যায়। আর সেখানেই নিজের সাথে নিজের নানাবিধ লড়াই চলে এবং এক সময়ে সমস্ত বিশ্বাস কে যুক্তির আঘাতে ভেঙ্গে দিয়ে সে সত্যিটি আবিষ্কার করে।
উপন্যাসটি তে খুব বেশি চরিত্রায়ন নেই, নেই তেমন দীর্ঘ কোন কথপোকথন। তবে উপন্যাসের সময়ের সাথে গল্পের অগ্রগামিতায় প্রধান দুটি চরিত্র আরেফ আলী আর কাদের চরিত্র দুটো নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিকাশিত হতে থাকে আর এই বিকাশ পাঠকের মনে অসংখ্য রহস্যের জাল বুনতে থাকে। ফলে পাঠক নিজেেই হয়ে ওঠে এই উপন্যাসের একটি চরিত্র। গল্পের ভেতর পাঠককে বসিয়ে দেওয়া, ঘটনাগুলোর সাক্ষী করা, নিজের মতো চিন্তা করতে দেওয়ার ক্ষমতাই বোধহয় বড় লেখকের ক্যারিশমা। সেই ক্ষমতায়নের সফল সংযোজন ঘটিয়ছে ওয়ালীউল্লাহ ’চাঁদের অমাবস্যাতে।’ বাংলা সাহিত্যে খুব সম্ভব ’ওয়ালীউল্লাহ’ই প্রথম এই উপন্যাসে যাদুবাস্তবতার পরশ দিয়েছেন। ওয়ালীউল্লাহর পরে ’আখতারুজ্জামেনর চিলেকোঠার সেপাই’ তে কিছুটা এবং ’শহীদুল জহিরের’ প্রায় সব লেখাতেই এই যাদুবাস্তবতা আমরা দেখতে পাই। পাঠককে বিভ্রান্ত করার মতো ঘোরলাগা একটা আবহ সৃষ্টি করার বাহিরেও ওয়ালীউল্লাহ তার প্রথম উপন্যাসের মতো এখানেও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে দেখিয়েছেন, সামাজিক প্রতিপত্তির রক্তচক্ষু কে স্পষ্ট করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ লেখকের যাপিত সময় কে বুকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসের মাঝে অন্যতম উজ্জ্বল উপন্যাস হিসেবে টিকে থাকবে।
দুর্দান্ত! সুখপাঠ্য। মানুষ আসলে কেমন? দুর্বল? মানুষের মন দুর্বল, নাকি শক্তিশালী? গ্রামের মাইনর স্কুল শিক্ষক আরেফ মিঞা দুর্জ্ঞেয়, লেখক সম্বন্ধে এমন কিছুই বলেছিলেন তার স্ত্রী। কিন্তু আরেফ মিয়া উন্মূল ন���, মানুষকে ভালোবাসে, তাই গল্পের শুরুতে যে নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায় তার প্রতি খুনি কাদেরের মায়া-মোহাব্বত ছিল কিনা তা নিয়ে চিন্তিত। "স্পয়লার" বলে একটা কথা আছে প্রায়ই দেখি। উপন্যাসের আবার স্পয়লার কী? গল্পটা জেনে নিলেন আর সেটি পড়ার প্রয়োজন রইল না? গোয়েন্দা গল্পও লেখকের গুণে বার বার পড়া যায়। ওয়ালীউল্লাহর গোয়েন্দাগিরি মানব মনের অলিগলিতে, ঘাত-প্রতিঘাতে, ওখানে স্পয়লার আছে, সেটুকু উপন্যাস পাঠ ব্যাতিত সম্ভব না। তাই "চাঁদের অমবস্যা" পাঠ সার্থক ।
অদ্ভুত জ্যোৎস্নার রাত, এক সংবেদনশীল যুবক শিক্ষক, একটি হত্যাকাণ্ড, অস্থির সমাজ, আর গভীর মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন সব মিলিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'চাঁদের অমাবস্যা' দীর্ঘ সময় পেরিয়েও অস্বস্তিকরভাবে প্রাসঙ্গিক।
মানসিক টানাপোড়েনের সঙ্গে পরিবেশগত বিচ্ছিন্নতার মিশেলে গড়া এক ধরনের দমবন্ধ করা চাপা উত্তেজনা এই উপন্যাসজুড়ে। ভাষা, বর্ণনা আর মনস্তত্ত্বের ঘোর পাঠের সময় এমন অভিজ্ঞতা এনে দেয়, যেখান থেকে একবার ঢুকলে বেরোনো কঠিন।
কলেবরে ছোট হলেও এর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, অস্তিত্ব সংকট, আর চরিত্রগুলোর আত্মসংঘাতের যে তীব্রতা, তা অবিশ্বাস্যরকম আধুনিক! বিশ্বাস করা কঠিন, এমন এক গভীর সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাস লেখা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে!
অনবদ্য! ছোট একটি ঘটনার উপর লেখকের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি যে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে এবং চিন্তার উদ্রেক ধরাতে পারে এত জোরেশোরে, তা 'চাঁদের অমাবস্যা' পড়ার আগ পর্যন্ত বোধগম্যই হয়নি। বলাই বাহুল্য, একটানা পড়ে শেষ করে ফেলার মতো বই এটি নয়। ১১২ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে যেসব গভীর ও সুকঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার উত্তর খুঁজে পেতে বারবার আটকে পড়তে হয়েছে লেখকের সুনিপুণ হাতের লেখনীর মধ্যে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কত বড় মাপের লেখক, তা এর আগে উচ্চমাধ্যমিকে তাঁর 'লালসালু' উপন্যাসটি পড়েই আন্দাজ করেছিলাম; আর 'চাঁদের অমাবস্যা' পড়ে সেই ধারণাটি বদ্ধমূল হলো।
উনার লেখার প্রতি অদ্ভুত এক টান অনুভব করি মূলত তার অসম্ভব সুন্দর বাক্যগুলোর জন্য। নিজেকে মনে হয় ছোট্ট এক বাচ্চা, অধীর আগ্রহে ঘরের দাওয়ায় বসে আছে উপহার হাতে সেই বয়স্ক লোকটির প্রত্যাবর্তনের জন্যে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, খানিক পরপরেই তিনি আবারো হাজির হন স্বরূপে। নানান ভঙিমায় ছুড়ে দেন উপহাররূপী শব্দগুলো। বাক্য যদি গাছ হয়, তবে এই গাছ এতই লম্বা আর পিচ্ছিল যে তরতর করে বেয়ে ওঠা সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন একাগ্রতা, মনোযোগ আর ধৈর্য। এই তিনটি যার আছে সে এই গাছ বেয়ে উঠতে পারবে, তারপর যখন চূড়ায় পৌঁছাবে, যে বিশ্বজয়ের অনুভূতি হবে তা দ্যুলোকের আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। আমার এই ধরনের গাছই ভালো লাগে। অনায়াসলভ্য গাছ হালকা ঝড়েই উড়ে যায়। আর কষ্টলভ্য গাছের শেকড় মাটির এত গভীরে যে তাকে উড়িয়ে দিতে গিয়ে ঝড়ের নিজেরই প্রাণশঙ্কা দেখা দেয়, শ্বাস ফুরিয়ে গিয়ে হাঁফাতে থাকে বায়ু নিজেই।
প্লট আর পরিণতি অনুমেয় হলেও পড়ে মজা পাওয়া যায় এই বাক্যগুলো আর যুবক শিক্ষকের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের কারণেই। পুরো একটি গল্প লেখা হয়েছে শুধু ইন্টার্নাল কনফ্লিক্টকে কেন্দ্র করে, ভাবা যায়! পুরো কাহিনী আবর্তিত হয়েছে এই একটা প্রশ্নকে ঘিরে: যুবক শিক্ষক কি পারবে খুনির পরিচয় দাদা সাহেবের কাছে বলতে? আর এই পুরোটা সময় ধরেই সে যেসব আজগুবি যুক্তি দিয়ে নিজেকে বুঝ দিয়েছে, তা আসলে খুনিকে নীরিহ প্রমাণ করার জন্য না, তাকে বাঁচানোর জন্যেও না, বরং অন্তিম পরিণতি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে। বিবেক বনাম বুদ্ধি। শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে, বিবেক না বুদ্ধি?
আর এই ইন্টার্নাল কনফ্লিক্ট এর মাধ্যমে চমৎকাভাবে ফুটে উঠেছে গল্পের মূল থিম: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কি সবসময় বিবেককেই প্রাধান্য দেয়া উচিত নাকি মাঝেমাঝে বিবেকেরই উচিত যুক্তি আর কমন সেন্সের কাছে হেরে যাওয়া?
এই ধরনের আরেকটা ক্লাসিকের কথা মনে পড়ছে এখন, যেটা অন্তর্গত দ্বন্দ্বের উদাহরণ দেয়ার সময় লিটারারি থিয়োরিস্টরা প্রায়ই ব্যবহার করে। এলিস সী বোল্ডের দ্য লাভলি বোনস। আমি নিজেও ইন্টার্নাল কনফ্লিক্ট এর উদাহরণ দিতে গিয়ে এর উদাহরণ দিতাম এতদিন। এখন সেই তালিকায় যুক্ত হলো যুবক শিক্ষকের অদ্ভুত, ঘোরলাগা এই গল্পটিও।
Every sentence is a piece of art. This is the most beautifully written piece of literature I've read this year. An eerie atmospheric descriptions of moonlight,inner conflict, self doubt and PTSD.
গ্রামের ধারে নির্জন বাঁশ ঝাড়ে পড়ে আছে সদ্যমৃতা এক যুবতীর অর্ধনগ্ন দেহ। দুর্ঘটনার সাক্ষী হওয়া তরুণ স্কুল শিক্ষক আরেফ মিয়ার মনে পরবর্তী কয়েকদিন যাবত যেসব ঘটনাবলী ঘটে তারই সূক্ষ্ম বিবরণ মূলত এই উপন্যাস।
এই বই নিয়ে আমার অনুভূতি নিজেই বুঝতে পারছি না আসলে। পাঠ্যভুক্ত লালসালু পড়েই মনে হয়েছিলো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র লেখার ধরন হয়তো আমার পছন্দের হতে পারে। চাঁদের অমাবস্যা পড়ে সেটা একপ্রকার নিশ্চিতই হওয়া গেল। বাংলায় এমন ন্যারাটিভ স্টাইল কমই দেখেছি। হয়তো বেশিরভাগ পাঠকের পছন্দ হবে না - কারণ লেখনী চরিত্রগুলোর সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার তেমন সুযোগ দেয় না। তারা কেমন নিস্পৃহই থেকে যায়। অবশ্য কেন্দ্রীয় চরিত্রটি বাদে অন্য কোন চরিত্রের প্রতি তেমন নজর দেয়াও হয়নি। আরেফ মিয়ার বিভ্রম আমাকেও বিভ্রান্ত করে ছাড়লো। অথচ মূল যা ঘটনা ঘটেছে তা এত সাধারণ এবং একমাত্রিক যে এমনটা হওয়ার কোন কথা ছিলো না। যেভাবে শেষ হলো সেটাও তেমন মনে ধরেনি।
যাক, অনুভূতি যাই থাকুক, লেখক আমাকে বেশ ভাবালেন৷ সময় নিয়ে অল্প অল্প করে পড়ার মত একটা লেখা, যদি লেখার ধরন ভালো লেগে থাকে আরকি। আলবার্ট কামুসের দ্য আউটসাইডারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো কিছু কিছু জায়গায়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় মোট ৩টা উপন্যাস লিখেছেন। ১. লালসালু ২. চাঁদের অমাবস্যা ৩. কাঁদো নদী কাঁদো। এর মধ্যে তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস লালসালুর জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। যার ফরাসি অনুবাদ করা হয় "L’arbre sans racines" নামে ১৯৬৩ সালে আর ইংরেজি অনুবাদ করা হয় ১৯৬৭ সালে "Tree without roots" নামে।
"লালসালু" উপন্যাসে মজিদের মধ্য দিয়ে যে অস্তিত্ববাদের প্রকাশ ঘটেনি তার সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটে "চাঁদের অমাবস্যা" উপন্যাসের আরেফ আলীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রটি ঔপন্যাসিকের এক সার্থক সৃষ্টি।
উপন্যাসে ফুটে উঠেছে সমাজের নির্মম বাস্তবতা। সমাজের উচ্চবিত্তের লোকদের আধিপত্যের চাপে পিষ্ট হয় ন্যায়বিচার। মনুষ্যত্বের প্রভাবে তাদের দোষের কথা প্রকাশ করতেই বিপদে পড়ে সাধারণ আর নিম্নশ্রেণির মানুষ।
একজন মানুষ, যখন আকস্মিক কোন অপরাধের সম্মুখীন কিংবা সাক্ষী হন, তখন উক্ত ব্যাক্তির মনস্তাত্ত্বিক এবং চিন্তাধারার মধ্যে যে প্রভাব পরে তা, যুবক শিক্ষক আরাফ আলীর মধ্যে দিয়েই ফুটিয়ে তুলেন। উপন্যাসটি যদিও শুরুর দিকে প্রচুর থ্রিলিং একটা অনুভূতি জাগিয়েছিল, কিন্তু একই কন্চেপ্ট(বিষয়)কে ঘিরেই ছিল বলে, একটা একঘেয়ে ভাব নিয়ে শেষ করতে হল!
লেখকের প্রথম উপন্যাস লালসালু বেরিয়েছিল ১৯৪৮-এ। আর দ্বিতীয় এটির প্রকাশ '৬৪। পরপর উপন্যাস দুটি পড়লে লেখার উপর বয়সের একটা প্রভাব খেয়াল করা যায়। তার পররাষ্ট্র দপ্তরে ডাঙ্গর নোকরির শুরু পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক থেকে। এই সময়টাতেই লালসালুর প্রকাশ হয়। সে সময়('৪৮ আর আশেপাশে)বিদেশে অবস্থান করলেও তার মাঝে যেকোন ঘটনা দৃশ্যসহকারে বর্ণনা করার যে সাবলীলতা তা '৬৪ তে এসে ঠোকর খেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু মনঃস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে ব্যপৃত হয়েছে।এই বই লেখার সময় লেখক দেশ থেকে বহুদুরে ফ্রেঞ্চ আল্পসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এবং দীর্ঘদিন প্রবাসবাসের ফলে দেশের চিত্রপট নিখুত চিত্রনের চেয়ে তার মনোযোগ হয়ত মানব/সমাজমনের দিকদিশা খুজ বের করতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি এতে আমাদের সাহিত্যের লাভই হয়েছে ষোল আনা।লালসালুতে মনঃস্তত্ত্ব আর প্রকৃতিবর্ণন সমান পরিধির ছিল। লালসালুর লেখক সত্ত্বা ভেঙ্গে "চাঁদের অমবস্যায়" আসতে লেখককে নিশ্চয়ই প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু মাঝের এই বইটিকে ট্রান্সফর্মেশান ধরলে আমরা লেখকের এর পরের মাস্টারপিস 'কাঁদো নদী কাঁদো' হাতে পেয়েছি।সেই হিসেবে এই বইটি লেখকের একটি সফল নিরিক্ষাধর্মী বই... মাঝে মাঝে বইটা পড়তে একঘেয়ে লাগে কিন্তু যুবক শিক্ষকের শেষ্পর্যন্ত কি হয় তা জানার জন্যে ওঁত পেতে বসে থাকি। মাঝের কোন একটা জায়গার বর্ণনা পড়ে মনে হল শহীদুল জহির নিশ্চিতভাবেই আমাদের আলোচ্য লেখকের দ্বারা প্রভাবিত।সেই একি ধরণের ফগি,স্মোগি,অস্পষ্টকরে চারিদিককে উপস্থাপনের একটা চেষ্টা। বইটা বেশ ভাল লেগেছে...।
রাতের যে মোহন বর্ণনা, ঈশ্বর! 'গল্পটা' এমন, যেন একটা কাচের দমবন্ধ ঘরে আটকা পড়েছে কিছু খরগোশ, কিছু সাপ। জোছনা দেখতে দেখতে তাদের মৃত্যু হচ্ছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসগুলোর ভেতর আমার সবচেয়ে প্রিয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর লেখা আগে পড়েছি স্কুলের, কলেজের বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য হিসেবে। পরীক্ষার সৃজনশীলের দশটি মার্কের লোভে পড়াতে আনন্দ যে বেশি ছিল না বলা যাবে না।
আগে লালসালু আর বহিপীর পড়েছিলাম। সেগুলোর চেয়ে এই উপন্যাস আলাদা কারণ এখানে সমাজের কোনো সমস্যা প্রধান উপজীব্য নয়।
লালসালু প্রকাশের প্রায় দেড় দশক পর এটি প্রকাশিত। গদ্যে ব্যাপক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। ভরাট, সুন্দর শব্দ, বর্ণনা ঘোর লাগা।
এই বই পড়ে শেষ করার পর বইটা নিয়ে কিছু না লিখলে মনে হয় অন্যায় হয়ে যায়! যদি কেউ এই বইয়ের কাহিণীসংক্ষেপ আমাকে লিখতে বলে তাহলে হয়তো এক পৃষ্ঠাতেই তা লিখে দিতে পারি! কিন্তু এটা আসল কথা না! আসল কথা হচ্ছে এইটা এমন এক উপন্যাস যেখানে গল্পের থেকে যাকে ঘিরে এই গল্প তার মনের গল্পটায় যেন বেশি ফুটে উঠেছে! শুধু সহজ সাবলীল ভাষাতেই যে একজন মানুষের মনের জটিল সব চিন্তা-ভাবনা, ধাপে ধাপে তার পরিবর্তন, বিবেকের দংশন আর নিজের মনকে নিজের মত করে বুঝিয়ে নেওয়ার মত কঠিন বিষয়গুলো একসাথে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব তা এই বই না পড়লে আমার অজানাই থেকে যেত! আর বারবার একই শব্দ আর একই গল্প শুনিয়ে যাওয়ার পরও পাঠককে বিরক্ত না করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাওয়াও যে সম্ভব সেটাও হয়তো থাকতো অজানা! সবশেষে যাদের গল্প ছাড়াও গল্প পড়ার মত ধৈর্য্য আছে তাদের আমি এই বইটি একবার হলেও পড়ার জন্য রিকমেন্ড করবো!
আমার অন্যতম একজন প্রিয় লেখক 'শহীদুল জহির', জাদুবাস্তবতার ব্যাপারটাতে শহীদুল জহিরের পূর্বসূরি বলা হয় সৈয়ত ওয়ালীউল্লাহকে। কিন্তু কেনো বলা হয়, তার অনেকটাই বুঝতে পারলাম চাঁদের অমাবস্যা পাঠ করে। 'চাঁদের অমাবস্যা"-র কাহিনি একদম ছোট। এক মিনিটেই কাহিনি বলে দিয়ে শেষ করা যায়। এক যুবক শিক্ষক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে বড়বাড়ির কাদেরকে দেখতে পায়, সে কাদেরের পিছু নেয় এবং তাকে হারিয়ে ফেলে, এরপর হাটতে হাটতে সে একটি বাঁশঝাড়ের কাছে এসে শব্দ শুনে ভিতরে গেলে একটি অর্ধ-উলঙ্গ মৃত নারী দেহ দেখতে পায়। এরপর যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড় থেকে বের হয়ে আসে, সম্মুখেই কাদেরকে দেখতে পায়, তারপর যুবক শিক্ষক দৌড়াতে শুরু করে। মোটামুটি উল্লেখযোগ্য কাহিনির মাঝে এটুকুই রয়েছে, তবে বাকি উপন্যাস জুড়ে কি আছে? কেনো তবে এতো বইটি এতো বেশি কালজয়ী হলো। পুরো বইটি জুড়ে মূলত আমরা যুবক শিক্ষকের অন্তর্দন্দ দেখতে পাই, যুবক শিক্ষকের মনে কি চলছে, যুবক শিক্ষক কি চিন্তা করছে, সময়ে সময়ে তার চিন্তারা কিভাবে দুর্বল হচ্ছে এবং শক্তিশালী হচ্ছে সেটাও আমরা দেখতে পাই। পুরো উপন্যাসটি একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, যার প্রধান উপদান যুবক শিক্ষকের মন। এখানে সংলাপ এবং চরিত্র একদম কম। এখানে বারবার ডুব দেয়া হয়েছে যুবক শিক্ষকের মনে, তার মনের সেই দুর্বল চিন্তাগুলো বারবার আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, চিন্তাগুলো আমাদের খুব পরিচিত মনে হয়, যেনো এমন দুর্বল চিন্তার সাথে আমরাও বেশ পরিচিত। এই উপন্যাসের সবথেকে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর বর্ণনাশৈলী, উপন্যাসের প্রতিটি বাক্য যেনো একেকটা শিল্প, যেই শিল্প বারবার পড়তে মন চায়। এই শিল্পটা এতোই সুন্দর যে, আপনাকে যদি আমি বাকি বইয়ের কাহিনি স্পয়লারও করে দেই, তারপরও আপনি সেই শিল্পে ডুব দিতে পারবেন।
ভাবনার জগতে যত চিন্তাভাবনার এফোঁড় ওফোঁড় বিচরণ, যুক্তিতর্ক, যুক্তিখণ্ডন, অন্তর্দ্বন্দ্ব, আত্নগ্লানি এধরনের অত্যন্ত অভ্যন্তরীণ অনুভূতি নিয়ে গড়া বই। এই ক্লান্তিকর অনুভূতি মাথায় করে দিবারাত্রি তো চলতে হয়ই, এবার যখন বইয়ের পাতায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম নিজের সাথে মিলিয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজেছি, মাথার চারিধার থেকে চাপ অনুভব করেছি ঠিকই, তবে সামনে আগাতে দ্বিধা হয় নি। কারণ দিনশেষে, এই বইটাই যেন আমার, আমাদের অনেকেরই মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দাহের শক্তিশালী উপস্থাপন। তরুণ শিক্ষকের নিজের চিন্তাজগতের মধ্যে এত সজ্ঞান বিচরণ ভাবনার জগতকে নাড়া দিতে বাধ্য। নিঃসন্দেহে বইটা বেশ যত্নের ও সময়ের দাবিদার। সময় নিয়ে অনুধাবন করে ধীরলয়ে এগোলে লেখকের চমৎকার ভাষাশৈলী বুঝতে পারা যায়।
এক যুবক যিনি গৃহশিক্ষক থাকেন, তিনি একটা খুনের ঘটনার সাথে অনাকাঙ্খিতভাবে জড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে তার মনের অবস্থা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যুবক শিক্ষকের নেওয়া সিদ্ধান্তসমূহ চিত্রিত হয়েছে চাঁদের অমাবস্যা তে। মনস্তাত্বিক ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি নিজে নিজে প্রায়ই চিন্তাভাবনা করলেও লিখিত আকারে পড়ার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এই বইটা পড়ার আগে আমি একবার ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অনুবাদের মান ভালো না হওয়ার কারনে শেষ না করেই রেখে দিয়েছিলাম। এই বইটা পড়ার ক্ষেত্রেও আমার অনেক সময় লেগে গেছে। কারণ অন্যান্য বইয়ের মতো এই বইটা আমাকে অতটা টানেনি। তবুও পুরোটা পড়ার পরে আমার কাছে ভালো লেগেছে..
ওয়ালীউল্লাহ'র লিখা বরাবরই ব্যতিক্রমী। খুব চাঞ্চল্যকর একটা কাহিনী দিয়ে উপন্যাসের শুরু। পুরো উপন্যাস শেষে সেই কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে। কাহিনীটা শুরুতে যেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, বয়ে চলার সময় পারিপার্শ্বিক কাহিনীর জন্য কোনো আকর্ষণ পাই নি। এখানেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। বুঝাই যাচ্ছিল ঘটনাটা কিসে গড়াবে। একটা সাসপেন্স যখন তৈরি হয়, পাঠককে শেষ পর্যন্ত আকৃষ্ট করে পারিপার্শ্বিক চমক - যেটা অনুপস্থিত মনে হয়েছে।
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলা চলে একে। একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা চরিত্রের মনে চলা দ্বিধা-দ্বন্দ - এটাই উপন্যাসের উপজীব্য ছিল। কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে লিখাটি। তবে আমার কাছে সুখপাঠ্য ছিল না।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আমরা অনেকেই 'লালসালু' উপন্যাসের মাধ্যমে চিনি। তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলেই উঠে আসবে অস্তিত্ববাদ, চেতনাপ্রবাহ, ধর্মীয় সংস্কারকে আঘাত করা, লেখনীর নতুন বিন্যাস ইত্যাদি সম্পর্কে। বাংলাসাহিত্যে তাঁর দেখানো পথ ধরে পরবর্তীতে হেঁটেছেন আরো অনেকে।
তাঁর সাহিত্যবোধ, দর্শন ও জীবনকে দেখার ধরন সমন্ধে এখনো নানা পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে। তাঁর বর্ণনায় জাদুময়তা আছে, একধরনের অস্তিত্বের প্রকাশ আছে। আর সবচেয়ে বেশি আছে একটি জনপদকে সাংস্কৃতিকভাবে চিহ্নিত করার তীব্র বাসনা। উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন হয়েও সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কথাকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য করেছেন।
অনেক দিন বুক শেলফে পড়ে থাকার পর গতকাল সন্ধ্যায় হাতে নিয়েছিলাম এই কালজয়ী কথাসাহিত্যিক এর লেখা 'চাঁদের অমাবস্যা' বইটি। শেষ করেছি আজ। পড়া শেষের অনুভূতি যদি এক বাক্যে বলতে বলা হয়, তাহলে বলবো- এটি সুখপাঠ্য ও ধীরগতির এক দুর্দান্ত সাসপেন্স থ্রিলার। অন্যকথায়, দারুণ এক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।
পাঠ প্রবেশের পূর্বেই লেখক জানাচ্ছেন ‘এই উপন্যাসটির বেশির ভাগ ফ্রান্সের আলপ্স্ পর্বত অঞ্চলে পাইন-ফার-এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে লেখা হয়।'
জ্যোৎস্না রাতে এক নগ্ন নারীর লাশ আবিস্কার করে গ্রামের তরুণ স্কুলমাস্টার। লেখক যাকে বারবার 'যুবক শিক্ষক' নামে অভিহিত করেছেন। নাম 'আরেফ আলী', কিন্তু আখ্যানে নামের চেয়ে বারবার এই যুবক শিক্ষক হিসেবেই এসেছে পাঠকের সামনে। এই ‘যুবক শিক্ষক’ শব্দযুগলের ভেতর দিয়ে লেখক সামর্থ্য-সাহস-স্পৃহা-সম্ভাবনা প্রভৃতি সামাজিক পজিটিভ সমাচার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সম্ভবত। অথবা একজন শিক্ষক কখনো সত্য-ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হতে পারেন না, কিংবা অন্যায়ের সাথে আপোষ করে থাকতে পারেন না, সে সত্যটিই হয়তো প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিংবা লেখক যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক একটি কাঠামো দাঁড় করাবেন, সেহেতু একজন শিক্ষককেই বেঁছে নিলেন চরিত্র নির্মাণের সুবিধার্থে। কিন্তু আমাদের দেশের অন্যান্য অনেক শিক্ষকদের মত আরেফ আলীকেও আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে মানসিক যন্ত্রণা ও ব্যর্থতার তাপে পুড়তে হয়েছে বারবার। বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করে লেখকে দেখাতে হয়েছে আরেফ আলীর বিপন্নতা। সত্য প্রকাশে তার সাহসহীনতা। নিজের আশ্রয় (বসবাস করবার জন্য) এবং চাকরি টিকিয়ে রাখতে সে অপরাধকে গোপনে প্রশ্রয় দিয়ে চলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস করে না।
তবে শুধু শিক্ষক সমাজ কিংবা আরেফ আলীই কি দোষী? আমাদের সমাজে কি এমন চরিত্র আমরা সবসময়ই দেখি না, আমি আপনিও কি অারেক আরেফ আলী নই? বস্তুত এই চরিত্রটি আমাদের চারপাশে পরিচিত ভুবনে বিরাজমান হাজার-কোটি মানুষের প্রতিনিধি মাত্র। নিজের অবস্থানে থেকে নিজেকে আড়াল করার যে শামুকস্বভাব আমরা লালন করে চলেছি প্রতিদিন-প্রতিরাত, তারই সামান্য ও সফল রূপায়ন যুবক শিক্ষক আরেফ আলী।
খুনি এই যুবক শিক্ষকের আশ্রয়দাতা পরিবারেরই একজন হওয়ার কারণে সাময়িকভাবে বিষয়টা চেপে যায় সে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে- একদিকে সত্য প্রকাশ করতে না পারার বেদনা, অন্যদিকে তার আশ্রয় এবং শিক্ষকতার পেশাটা হারানোর ভয়। এই শিক্ষক শুধু যে একটা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অবগত তা নয়, হত্যাকারীর আহ্বানে লাশ গুম করার ব্যাপারে একজন সহকারীও। যদিও তা বাধ্য হয়ে। এবং তখনো সে নিশ্চত নয় পুরো ঘটনা সম্পর্কে।
উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদ এ একটু নজর যদি দেই, তাহলে দেখবো-
'শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাত, তখনো কুয়াশা নাবে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটি দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট্ করে বোঝা সহজ নয়। পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো।'
'চন্দ্রালোকের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক হয়তো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ নির্জন রাতে চলনশীল কিছু দেখতে পেলে প্রথমে সে চমকে ওঠে। তারপর সে তাকে দেখতে পায়। বড়বাড়ির কাদেরকে চিনতে পারলে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। চন্দ্রালোক-উদ্ভাসিত এ-মায়াময় রাতে কাদেরের আকস্মিক আবির্ভাব তার কাছে হয়তো অজাগতিক এবং রহস্যময়ও মনে হয়। এত রাতে এমন দ্রুতগতিতে কোথায় যাচ্ছে সে?'
কুয়াশাহীন শীতরাত্রি, হালকা অন্ধকার, যুবক শিক্ষকের এক যুবতীর ডেডবডি দর্শন, জোছনার প্রসন্নতা, মায়াময় রাত- সবকিছু মিলিয়ে সাদার অন্তরালে কালো, স্পষ্টতার আড়ালে অস্পষ্টতা আর সত্যকে ঢেকে দিয়ে মিথ্যার প্রভাববিস্তারের এক ধরনের ছায়া-সন্দেহ তৈরি হয় গল্পের ক্যানভাসে। এরপর নানান রহস্য আর সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখক অগ্রসর হতে থাকেন।
এই নৃশংস খুনের ঘটনাই খুনের সাক্ষী আরেফ আলীর চিন্তাস্রোতকে আমূল বদলে দে���়; ফলত যা হয়, একজন ভীত গৃহশিক্ষক সমূহ ভীরুতা ঝেড়ে ফেলে এতটা সাহসী হয়ে ওঠে যে, যা আবার প্রকারান্তরে তার বিপদ ডেকে আনার জন্য যথেষ্টই; আরেফ আলীর এই পরিবর্তিত বিপদসঙ্কুল চিন্তাস্রোতই শেষমেশ ‘চাঁদের অমাবস্যা’র কেন্দ্রীয় থিম হয়ে উঠেছে।
শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব ও মনোজগতের সাথে সংগ্রাম করে আরেফ আলী কি পারবে সত্য প্রকাশ করতে, মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে একটি খুনের প্রকৃত ঘটনা আইন ও সমাজের নিকট উন্মোচন করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে? সেখানেও আশংকা থেকে যায়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কি অসহায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করবে, নাকি সম্ভ্রান্ত বিত্তশালীদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে? প্রতিবাদের কণ্ঠ যে অনৈতিকতা ও দাপটের কাছে হেরে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই প্রশ্নগুলোও বড় আকারে সামনে এসে যায়।
সমাজ, সমাজের মানুষ, শ্রেণি, ধর্ম ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ঠুনকো বিচার ও প্রশাসন ব্যবস্থার এক কুশলী আখ্যানের স্বাদ নিতে পড়তে পারেন 'চাঁদের অমাবস্যা'।
হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যে এমন একটি উক্তি ছিল- "Even the wisest cannot resist love's temptation"
এই কথা আমি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি, তবে আমি যা সমর্থন করি না তা হলো- "Even most of the strong and wise people cannot resist fleeting desire."
যুগ যুগ ধরে আমরা শত শত এমন কাহিনী শুনে ও দেখে আসছি, যেমন: ট্রোজান যুদ্ধের পিছনের প্রচলিত কাহিনী, জন কিডস এর le bella dame sans merci তে উল্লেখ্য নাইট এর ঘটনা, বিখ্যাত গলফ খেলোয়াড় টাইগার উডস এর বিবাহিত জীবন ধ্বংস ও ক্যারিয়ারে তার কর্মের প্রভাব।
প্রবাদ আছে, "চতুর সে-ই যে প্রতারণা করতে চায়,কিন্তু দেবতাদের ন্যায়ের হাত থেকে রেহাই নেই।" পরকীয়া সম্পর্ক মানুষ কে মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিতে পারে, ডেকে দিতে পারে চাঁদের আলোও,বের করতে পারে কেঁচোর গর্ত থেকে সাপ।
claude debussy এর clair de lune (যার অর্থ চাঁদের আলো) বিখ্যাত পিয়ানোর impressionist তার সুর ও আর্কেস্টেশন এর মধুর দৃশ্যকে অনুসরণ করে যুবক শিক্ষক যেতে থাকে এক ছায়া মানবের প্রতিচ্ছবিকে অনুসরণ করে।
সেই রাত ছিল একদম স্বচ্ছ, চাঁদের আলো রাতকে আরো সম্মোহনী করে তুলেছিল। কিছু কিছু রাত এমন থাকে যখন নীরবতাও কথা বলে আর কিছু কিছু কথা এমন থাকে যা নীরবতার চেয়েও ভারী হয়ে উঠে। সেই রাতটা ছিল এমনি এক রাত।
যুবক শিক্ষক ছিলেন পুরো Absurd, তিনি জীবনকে অর্থহীন দৃষ্টিকোন থেকে দেখতেন। তার ভীতু প্রকৃতির চরিত্রকে পাশে রেখে সে তার কৌতুহল কে প্রাধান্য দিয়ে চলতে থাকে সামনের দিকে। কখনো সে কলাপাতাকে কাদের ভেবে কথা বলে লজ্জা পেয়ে যায়,আবার কখনো বাঁশ ঝাড় থেকে কারো কথার আওয়াজ ভেসে আছে তার কানে। তার অন্ধকারে পদচারণ মূলত কাদের কে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে তবে সে দিক হারিয়ে ফেলে এবং বাঁশঝাড়ের দিকে এগোতেই আবিষ্কার করে এক নারীর অর্ধনগ্ন মৃতদেহ। এটি দেখে সে কয়েক মূহুর্তের জন্য জিরো থ্রট অবস্থায় চলে যায়। এর পরমুহূর্তে তার শরীরে যেন Dave brubeck এর take five রিদম এর মতো অদ্ভুত ও অস্থির রিদমের আবির্ভাব হয়, সে দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে সে নিজের অস্তিত্ব, পরিবেশ,পরিস্থিতি, নিজের ভয় সবকিছুর সাথে লড়াই করতে থাকে। অবশেষে চাঁদের আলোকে বাস্তবিত করে পিছে ফেলে ফিরে আসে নিজ কক্ষে, এবং দেখা হয় কাদেরের সাথে। কাদের বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকে তার এই অবস্থার কারণ কি কিন্তু যুবক শিক্ষকের মুখ চিরে একটা আওয়াজ ও বের হয় না।
কার্ল মার্ক্স একটা কথা বলেছেন যে- "Religion is the opium of the masses" আমাদের সমাজ ব্যবস্থার রূপ বৈচিত্র্য অনেকটা কার্ল মার্ক্স এর বলা কথার মতোই। মানুষের বাস্তব দুঃখ কষ্ট থেকে পালানোর মাধ্যম হিসাবে ধর্ম কাজ করে, ঠিক যেমন আফিম ব্যাথা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের কাদের নিম্নবিত্ত শ্রেণির অবচেতন মানসিক দাসত্বের প্রতিক। সে কুসংস্কার এর শিকল দিয়ে সেই সময়কার মানুষদের সামনে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছিলো। এবং কি কাদের এর বড় ভাই যে কিনা আল্লাহ ভীরু মানুষ ছিলো সে পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিলো কাদের একজন দরবেশ। এবং সে রাত্রি বিচরণ করতো সেইটাতেও কারো কোনো সমস্যা ছিলো না, কারণ সবাই মেনেই নিয়েছিলো কাদের একজন দরবেশ।
উচ্চবিত্ত হওয়ায় কাদেরদের পরিবারের ছিলো বিশেষ খ্যাতি। এর সুযোগ নিয়ে অনেক কিছুর সুবিধাই ভোগ করতো কাদের।
কক্ষে ফিরার পর শুরু হয় যুবক শিক্ষক এর আত্মযুদ্ধ। তার মনোজগতে চলতে থাকে টানাপোড়েন, যার মধ্যে id,ego,superego সবকিছুর আবির্ভাব ঘটে। তার সবকিছুই ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্বের সাদৃশ হয়ে গিয়েছিলো।
যুবক শিক্ষকের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস, তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও যুক্তির প্রতি সংশয়। তাছাড়া সমাজ ধর্ম ও নৈতিকতা তাকে যা বিশ্বাস করতে বাধ্য করে সেগুলোর প্রতি প্রশ্ন তোলা। কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। এইসবের মধ্যে দিয়ে কয়েকদিন কাটে যুবক শিক্ষকের। সে অবশেষে আবিষ্কার করে খুনি ও নিজেও জরিয়ে যায় খুনের সাথে। তাহলে কি ভয় যুবক শিক্ষকের চিন্তা শক্তি, বোধ শক্তিকে অকেজো করে দিয়েছিলো?
নাকি সে অসহায়ত্বের দুর্বিপাকে পড়ে গিয়েছিলো। লুদভিগ ভ্যান তার পিয়ানোর সুরে বিষন্নতা ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কিন্তু যুবক শিক্ষকের এই অন্তরালের ঘূর্ণিঝড় কোনোভাবেই তিনি রোধ করতে পারেননি।
রেনে ম্যাগ্রিট বলেছেন- যা কিছু আমরা দেখি, তা অন্য একটি জিনিস আড়াল করে রাখে। আমরা সবসময় দেখতে চাই আমরা যা দেখছি তার আড়ালে কি থাকে।
এই উপন্যাসটাকে আমি the son of man পেইন্টিং এর সাথে তুলনা দিতে চাই এটিও মূলত ১৯৬৪ সালে করা হয়েছিল আর চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাস ও ১৯৬৪ সালে প্রকাশ পায়। the son of man একটি সুপারিয়ালিস্টিক চিত্রকর্ম যা জীবন ও অস্তিত্বের রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করে,যেখানে মানুষ প্রকৃত পরিচয় ও কৃতকর্ম অনেকসময় আড়াল করে। এবং মানুষকে অনেক সময় বাহ্যিক পরিচয়, বিত্ত,প্রাচুর্য দিয়ে বিচার করা হয়। ঠিক এই উপন্যাসের শানে নুযূল এর মতো।
আচ্ছা যাক, তাহলে শেষ পর্যন্ত কি হলো এই উপন্যাসের অন্তে, আসল খুনি কে ছিলো, কি কারনেই বা মহিলাটা কে খুন করা হয়েছিলো? তবে স্পইলার না দিয়ে এতটুকু বলতে পারি শেষে চোখ ধাঁধানো টুইস্ট আছে, যা আমাকে বিস্মিত করেছে হয়তো আরো যারা সামনে পড়বে তাদেরকেও করবে।
ওয়ালিউল্লাহর তিনটি উপন্যাসের মধ্যে এটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। যেকোন সচেতন পাঠকই তিনটি উপন্যাসের যোগসূত্র ধরে ফেলতে পারেন। আপাতদৃষ্টিতে সিকুয়েল না হলেও আসলে কাহিনীর সম্প্রাসারণই ঘটেছে। তাই জমিলা, যুবক শিক্ষক আরেফ, আর মুহম্মদ মোস্তফার চরিত্রায়নের মাঝে যে সম্প্রসারণ সেটাও কাকতাল নয়। তবে চাঁদের অমবস্যা আমার কাছে প্রিয় মূলত এর এক ধরণের ঘোর লাগা বর্ণনার কারণে। কমেন্টে একজন পাঠক যেমনটি বলেছেন, শহীদুল জহিরের রচনার অনেক জায়গাতেও ঘোর লাগানো জাদুবাস্তবতার যে আঁচ পাওয়া যায় তা হয়তো এই উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত। উপন্যাসে কিছু বিশেষ দিকও চোখে পড়বে। আরেফ আলীর কথার উল্লেখে লেখক প্রতিবারই 'যুবক শিক্ষক' টার্মটা ব্যবহার করেছেন। এই ব্যবহারও অনুমিতভাবেই কাকতাল নয় এমনটি বুঝা যায়। সময়কে ডিসরিগার্ড করে কাদের আর যুবক শিক��ষকের দেখা হয়ে যাওয়া সেই রাতে থেকেই সম্প্রসারিত হয়েছে ঘটনা। অনেকটাই মাকড়সার জালের মত করে ভাবনা বিস্তার লাভ করেছে। তবে এই বিস্তার বিস্তৃত হয়েছে মূলত যুবক শিক্ষকের ভাবনার বলয়কে ঘিরেই। চমক লাগা শুরুর সাথে পাঠকদেরকে নিয়ে লেখকেরও যুবক শিক্ষকের ভাবনার রাস্তায় হেঁটে চলা চমৎকার এক অনুভূতি। তাই উপন্যাস জুড়েই যুবক শিক্ষকের সাথে সাথে লেখক এবং তার সাথে পাঠক দ্বিধাগ্রস্থ হয়েছেন, সত্য কে অস্বীকার করে তার উপরে মিথ্যার প্রলেপ এটেছেন, কখনও বা রুটি রুজি নিয়ে আশঙ্কায় ভুগেছেন, আবার কখনও বা সমস্যার একটি নির্ভেজাল সমাধান চেয়েছেন ছা পোষা মানুষের মত। শেষতকও যুবক শিক্ষক বিভ্রান্তই থাকে তার পরিণতি নিয়ে-- পুরো উপন্যাসে তার পদচারণার মতই।
এই উপন্যাসটি লেখকের অপর দুটি উপন্যাসের সংযোগস্থলও বটে। সেই জন্যেই লেখকের ভাবনার জগতে ঢুকবার জন্যও উপন্যাসটি আলাদাভাবে জায়গা করে রাখবে। সেই সাথে লেখক ওয়ালিউল্লাহর লেখার ব্যাপ্তির রূপান্তরিক ধাপ হিসাবেও হয়তো একে বিবেচনা করা যায়।
মনস্তাত্ত্বিক লড়াই ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে অনেকে রিভিউ লিখেছেন। তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা। দুঃখজনকভাবে এটা আমার টাইপের বই নয়। নিজের মন নিয়ে লড়াই করে এমনিতেই প্রতিদিনকার জীবন চলে, তারউপর যখন এক শিক্ষকের মনের মধ্যে চলমান ঘটনাপ্রবাহ পড়তে থাকি তখন প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগে। বাস্তবিকই এই বইটা আমাকে অনেক ক্লান্ত করেছে প্রতিবার শুরু করতেই, তাই এই ছোট বইটা শেষ করতে খুব কষ্ট হয়েছে।
নয়নচারা ছিল আমার পড়া এই জনাবের প্রথম বই । এটা পড়ার পর মনে হল সবার আসলে এই বই দিয়ে শুরু করা উচিত , কিন্তু দুঃখজনকভাবে শুরু হয় বহিপির / লালসালু দিয়ে । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল দস্তয়ভস্কি মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল কাফকা পড়ছি । হয়ত অনেকদিন পর কিছু পড়ার কারণে ভালো লাগল who knows অনেক দিন পর ফিল্ম ও দেখলাম - উৎসব । এখন আবার এক বস্তা বই কিনে tsundoku করতে ইচ্ছা করছে :3