What do you think?
Rate this book


304 pages, Hardcover
First published February 1, 1986
"এরা কে? তার মানে, অনেক কাল আগেকার মানুষও কি মিছিলে যোগ দিয়েছে? ঐ তো, মিছিলের মাঝখানে ইসলাম খাঁর আমলের খাটো-ধুতি-পরা ঢাকাবাসী! এমনকি তারো আগে চালের বস্তা বোঝাই নৌকা বেয়ে যারা সোনারগাঁও যাতায়াত করতো তারাও এসেছে। বাঙলা বাজার, তাঁতীবাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তো ইব্রাহিম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি-পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খাঁর টাকায়-আট-মন-চালের আমলে না-খেয়ে-মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই- কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে। মোগলের হাতে মার-খাওয়া, মগের হাতে মার-খাওয়া, কোম্পানীর বেনেদের হাতে মার-খাওয়া - সব মানুষ না এলে কি মিছিল এত বড়ো হয়? রেসকোর্সের কালীবাড়ির ইটের শুকনা পড়ত খুলে খাঁড়া হাতে নেমে এসেছে মারাঠা পুরোহিত, মজনু শাহের ফকিররা এসেছে, ঐ তো বুড়ো আঙুল-কাটা মুষ্ঠির ঘাই ছুঁড়তে ছুঁড়তে যাচ্ছে মসলিন তাঁতী, তাদের কালো কালো খালি গা রোদে ঝলসায়। ৪০০০ টাকা দামের জামদানী-বানানো তাঁতীদের না-খাওয়া হাডডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলেছে। সায়েবদের হাতে গুলিবিদ্ধ বাবুবাজার মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন মুসল্লিরা চলেছে, বিড়বিড় করে আয়াত পড়ার বদলে তারা আজ হুঙ্কার দিচ্ছে, 'বৃথা যেতে দেবো না!' লালমুখো সাহেবদের লেলিয়ে-দেওয়া নবাব আবদুল গনি-রূপলাল মোহিনীমোহনের শ্বাদন্তের কামড়ে-ক্ষতবিক্ষত লালবাগ কেল্লার সেপাইরা আসে, ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে গলায় দড়ি ছিঁড়ে নেমে আসে মীরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, স্বন্দীপ-সিরাজগঞ্জ-গোয়ালন্দের সেপাই। না হে, তাতেও কুলায় না। যুগান্তর অনুশীলনের বেনিয়ান ও ধুতি-পরা মাতৃভক্ত যুবকেরা আসে, তাদের মাঝখানে কলতাবাজারে নিহত ছেলে ২টিকে আলাদা করে চেনা যায়। নারিন্দার পুলের তলা থেকে ধোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। ঐ তো বরকত! মাথার খুলি উড়ে গেছে, দেখে একটু ভয় পেলেও ওসমান সামলে ওঠে। এত মানুষ! নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠেছে আজ, ঢাকা আজ সকাল-দুপুর-বিকাল-রাত্রি বিস্মৃত, তার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর দক্ষিন নাই, সপ্তদশ-অষ্টাদশ-উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত। সীমাহীন কাল সীমাহীন স্থান অধিকারে জন্য ঢাকা আজ একাগ্রচিত্ত। ওসমানের বুক কাঁপে; এই বিশাল প্রবাহের সঙ্গে সে কতোদূর যেতে পারবে? কতোদূর? গোলক পাল লেনের মুখে কলের নিচে কাঁপতে-থাকা কলসি যেমন পানিতে ভরে স্থির হয়, আমাদের ওসমান গনির বুকটাও দেখতে দেখতে পূর্ণ হলো, এই অবিচ্ছিল স্রোতধারার ক্ষুদ্রতম ১টি কণা হয়েও তো সেই এই হৃৎপিন্ডে তাপ বোধ করতে পারছে। তাই বা কম কিসে? ভরা-বুকে মুষ্টিবধ হাত তুলে সে হুঙ্কার দেয়, 'বৃথা যেতে দেবো না'।
না?
ঠিক জানেন তো! আমাদের ঢাকার ওসমান গনি, মানে রঞ্জু ও কিন্তু পাগল ছিল না। ব্যাচেলর ছেলে, চাকরী করে, রহমতউল্লার মওকানের চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানও কিন্তু বুঝতে পারেনি সে কখন পাগল হয়ে যেতে লাগল। তার বন্ধুরা শওকত, আলতাফ, ইফতিকার, আনোয়ার, কলিগ কামাল কেউই ঠিক টের পায় না ওসমান কখন পাগল হতে শুরু করেছিল। এমন কি, আশ্চর্য, রানুও টের পায় না যে অঙ্ক করাতে করাতে কখন ওসমান এর নিজের হিসেব একাকার হয়ে গেল! তাহলে?
তাহলে ওসমান কখন পাগল হল? পাগলামির বীজ কি আসলেই তার মধ্যে ছিল? না কি, সে স্বাধীনতা-মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে, আইয়ুব খানের পাকিস্থানের বিরুদ্ধে, শেখ মুজিবের পক্ষে বাঙালি জাতির ১৯৬৯-৭০ এর বিপ্লবে-বিদ্রোহে সামিল হতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল? সে কি বিপ্লবের স্রোতে ভেসে আসলে কোন অতল সমুদ্দুরের মোহনায় এসে পড়েছিল! মোহনার ঘুর্নিপাকে কি তার বোধশক্তি যায় গুলিয়ে আর হাজারও ঢেঊ এর দোলায় সে ভেসে যায় অন্য জগতে! কারন নিশ্চিত ভাবে যদিও বলা শক্ত কিন্তু এটা ঠিক যে ভেসে যেতে যেতেও ওস্মান এক নিদারুন সত্যকে প্রত্যক্ষ করে গিয়েছিল। সে সত্য, মানব-সভ্যতার আবহমান কালের ইতিহাস-জাত সত্য, মানুষের চিরন্তন লড়াই এর সত্য। মানুষের যে লড়াই, চিরকাল ধরে সেই প্রলুব্ধ ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে, তাদের হিংসাশ্রয়ী তাবেদার দের বিরুদ্ধে, সে লড়াই আজও অবিরাম চলছে; ব্যক্তিগত অধিকার ও তার ফলশ্রুতিতে তৈরী হওয়া ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আদিম গুহাবাসী মানুষের লড়াই হোক, ব্যক্তিগত পূঁজির লোভের ভেসে আসা সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে নেটিভ সেপাহী বা বিদ্রোহি ফকির-সন্নাসীর লড়াই হোক, ১৯৪৭ বা ১৯৭১ এ স্বাধীনতাকামী মানুষের লড়াই হোক, সে লড়াই কিন্তু থামে নি, লড়াই আজও একইভাবে চলছে! ওস্মান যদি আজ বেচে থাকত তবে দেখত আজও একই ভাবে বাংলাদেশের শাহবাগে, দিল্লীর যন্তর-মন্তরে, মিশরের তাহিরি স্কোয়ারে, ইরাক-আরবের এর মরুপ্রান্তরে মানুষ একই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে, পুঁজির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই চলছে ও চলবে; আর তাই আজও হয়ত কোন ওস্মান আকাশে চোখ তুললে দেখতে পাবে যে মৃত শহিদের আত্মারা পৃথবীর বুকে ভিড় করে এসেছে উত্তর পুরুষের এই লড়াই দেখতে!
ওস্মান এর এই নিদারুন উপলব্ধি যমন সত্য, তেমনি আনোয়ারের উপলব্ধি হয় আরেক সত্য, হয়ত কিছুটা বিপরীতার্থকই। আনোয়ার বোঝে যে এ লড়াই এ কোথাও ফাক থেকে যাচ্ছে, এ লড়াই একনিষ্ঠ নয়। লড়াই চলছে ঠিকই কিন্তু এই সর্বব্যাপী মহা-লড়াইয়ের মধ্যেও লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর রকম তার-তম্য। বৃহত্তর উদ্দেশ্য কে সামনে রেখে যে লড়াই, তাতেও কত দন্দ্ব-মূলক অবস্থান, ভিন্ন-ভিন্ন লড়াইকারী ভেদে, লড়াইএর কত ভিন্ন ভিন্ন রূপরেখা ও রূপায়ন পদ্ধতি! ফলে প্রশ্ন ওঠেই, এক জোট হয়ে লড়াই সত্ত্বেও মানুষ কি সত্যিই পরস্পরের প্রতি আস্থাবান? গ্রামের অশিক্ষিত কেরমালি, চেংটু, নওয়াজুদ্দীনরা শহুরে আনোয়ারকে পুরোপুরি নিজের লোক বলে ভাবতে পারে না কি এই আস্থার অভাবেই? একটা অবিশ্বাস যেন ভেসে বেড়ায় হাওয়ায়। শহুরে আনোয়ার বিশ্বাস করে, বিপ্লবের তত্ত্বে, পার্টির দলিলে লেখা নিয়মে কিন্তু গ্রামের আলিবক্স বিশ্বাস করে শুধু বিপ্লবের উদ্দেশ্য সাধনে, দলিল-নির্দেশিত রুপায়ন-পদ্ধতিতে নয়। বিপ্লব আর বিপ্লবীদের এই ভ��ন্ন মত-পথের অনায়াস সুযোগ নেয় খয়বার গাজী, আফসার গাজীর মত হীন লোকেরা। এমন কি এই পারস্পরিক অবিশ্বাসের সুযোগে মেজ-সেজো অসংখ্য নেতারা রাতারাতি ভোলও পালটে নেয় নিজেদের। এই বেনোজলে ধুয়ে যায় সংগ্রামের পথ আর এই ঘোলাজলে শেষপর্যন্ত ভেসে ওঠে যুবক চেঙটুর মৃত লাশ। শুধু সেদিন নয়, এদিনও যখন লাশ পড়ে অভিজিত-নিলয়ের-কালবুর্গির, নেতারা কিন্তু এই ঘোলা জলেই নৌকা ভাসায়! তাই বিভ্রম একটা থাকেই। দিনের শেষে কোথাও কোন বিপ্লব কি সম্পূর্নতায় পৌছায়, কিছু কি মৌলিক বদল হয় সমাজে? না কি কোথাও একটা আপোষ রয়েই যায় সিস্টেমের সাথে? আপোষহীন, একনিষ্ঠ বিপ্লব কি তবে একটি বিভ্রম, ইউটোপিয়া!
এই বিভ্রম যে শুধু বিপ্লবের পথে তা নয়, বিভ্রম ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও। রহমতউল্লা থেকে জুম্মনের মা, আলাউদ্দীন থেকে হাড্ডি খিজির, সিতারা থেকে রাণু, প্রায় সকল চরিত্রই জীবনে এই বিভ্রম দ্বারা জারিত। অথচ জীবনে শুধু বেচে থাকার তাগিদটা আমাদের এতটাই বেশী, এতটাই জান্তব যে এই বিভ্রম কাটিয়ে ওঠার, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, সেটা নির্নয় করবার মত ফুরসৎ প্রায় কাররই হয় না। ওস্মানের মতই আমরা প্রত্যেকে আসলে এক একটি চিলেকোঠার বাসিন্দে, আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্ব যেন একটি ক্ষীয়মান নড়বড়ে ভাঙাচোরা একঠেঙে সিড়ির উপর দাঁড়িয়ে। আমাদের জীবন দর্শনও তাই ওই চিলেকোঠার ‘ছাত’ থেকে দুনিয়াকে দেখার মত; আংশিক, ধোঁয়া ধোঁয়া। সমগ্রটা শেষপর্যন্ত, দিনান্তে উপলব্ধির বাইরেই থেকে যায়। আর এই বিভ্রমের সমুদ্রে ডুবে থেকেই আমাদের গরিষ্ঠ অংশের জীবন কাটে; কখনো-সখনো ধাঁধায় পড়লে শুধু প্রয়োজনমত অ্যান্টাসিড-নোভালজিনে জীবন একটু সহনীয় করে নেওয়া, এই আর কি! পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তর পুরুষেও এই জীবনের এই গতি ধারা মোটের উপর বদলায় না। এক্ষেত্রে কেরমালির সহজ স্বীকারোক্তি টাই কানে বাজে যে যেমন এই এই বিপ্লব, এই বিভ্রম সারাজীবন থাকবে, তেমনি মানুষের ‘হাওস’ ও থাকবে, কোন কিছুতেই জীবন প্রবাহ থেমে থাকবে না।
তো এমতাবস্থায় আমরা কি করব? আলাউদ্দিন, কেরমালি, নাদু প্রামানিক, বজলুর মত জীবন কাটিয়ে যাব? সব বিভ্রম, মায়া, বিপ্লব কে ঘরের চৌকাঠে দাড় করিয়ে, মন-মগজের দরজায় ভারি তালা লাগিয়ে যাপন করব এই চিলেকোঠার জীবন? না কি ওস্মানের মত ধাক্কা মেরে, দরজা-তালা ভেঙ্গে, এই বিভ্রম থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুজব? আমাদের কি সাহস আছে এই প্রচলিত আপোষকারী সমাজের মুখে, সকল গন্ডির মুখে ওস্মানের মত অবহেলে প্রস্রাব করে মুক্তির পথে পা বাড়ানোর? পা বাড়ালেও বা নিশ্চয়তা কি যে এক বিভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে আমরা আরেক বিভ্রমের দুনিয়ায় পৌছাব না!
উওর কেই বা জানে? লেখক জানেন বা জানেন না, জানি না; তিনি কিছু বলেও যান নি। তিনি ‘চয়েস’ ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের, পাঠকের হাতে। আর পাঠকেরা, আপনারা কি জানেন সেই পথের সন্ধান???
১০০ বছরেরও আগে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য নবাব আব্দুল গনিকে দিয়ে পোঁতানো পামগাছ বা সেইসব পামগাছের বাচ্চারা মানুষের স্লোগানে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি বলে আস্তে আস্তে হাই তোলে।