ভেবে দেখুন, বাংলাদেশের প্রথম নভোচারি আপনি, উৎসাহে টগবগ করছেন আর ক'দিন পরেই রকেটে চড়ে বসার জন্য। কিন্তু ঠিক এই সময়েই আবিষ্কার করলেন একটা খুনের দায়ে ফাঁসানো হচ্ছে আপনাকে, স্পেস স্টেশনের বদলে হয়তো যেতে হবে জেলে। লাশ গুম করবেন কিভাবে?
আর স্পেস স্টেশনে যেতে পারলেও শান্তি নেই - আপনি জানেন না আমেরিকান আর রাশিয়ান নভোচারিরা কি গোপন মিশন নিয়ে এসেছে, তারা মহাকাশেই একে অন্যকে মারার জন্য উঠেপড়ে লাগবে কি না। অভিনব কোনো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে কি তারা? আপনার এক সহকর্মী উদ্ভট আচরণ শুরু করলো কেন, মহাকাশ থেকে আসা কোনো রহস্যময় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কি? বিভং কাকে বলে?
এদিকে, যে মহাশক্তিধর অশুভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের হাত থেকে কয়েকদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে মানুষ, সে আবার ফেরার চেষ্টা করছে না তো? পৃথিবীব্যাপী তার সমর্থকরা কিসের আশায় বিশৃঙ্খলা চালাচ্ছে?
আর সবচেয়ে বড় কথা, সবকিছু বিগড়ে গেলে কিভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফিরবেন আপনি?
“Imagination will often carry us to worlds that never were, but without it we go nowhere.” - Carl Sagan - বিভং নামক এই গল্পের শুরু অদুর ভবিষ্যৎ এ যেখানে মানব সভ্যতা এক ভয়াবহ আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এর করাল গ্রাস থেকে মাত্রই নিস্তার পেয়েছে। রুপু ,যে কি না একজন হবু বাঙালী নভোচারী, তার প্রথম মহাকাশ যাত্রার আগে এক দারুন ঝামেলায় পড়ে যায়। এর ফলে অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় তার মহাকাশ যাত্রা। - এদিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এর হাত থেকে রেহাই পেলেও পৃথিবীতে শুরু হয় এক অদ্ভুত স্নায়ুযুদ্ধ, যার মুলে রয়েছে আমেরিকা এবং রাশিয়া। রুপুর সহকর্মিদের ভিতরে বেশিরভাগ এ দুটি দেশের হওয়ায় না চাইলেও এ স্নায়ুযুদ্ধের ভিতরে জড়িয়ে পরে সে। এখন এতসব ঝামেলা ফেলে সে কি মহাকাশে যেতে পারবে, আর গেলেও সেখানে তার জন্য কি ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে সে সব কিছু জানতে হলে পড়তে হবে লেখক নাবিল মুহতাসিম এর সাই ফাই থ্রিলার " বিভং " .
"বিভং" লেখক নাবিল মুহতাসিমের লেখা প্রথম সাই ফাই থ্রিলার। এ বইতে সবচেয়ে যে জিনিষটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হলো নভোচারীদের ট্রেনিং এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের বিশদ বিবরণ। দেশে বিদেশে এ ধরণের সাই ফাই বেশ লেখা হলেও কেন জানি এ ব্যাপারটিকে প্রায় সবাই এড়িয়ে যায়। এ জাতীয় তথ্য- উপাত্ত জোগাড় করতে লেখককে বেশ খাটুনি করতে হয়েছে তা লেখার বিবরণেই স্পষ্ট। পড়ার সময় মনে হয়েছে স্পেসের যাওয়ার জন্য ট্রেনিং, ট্রেনিং করানোর জায়গা এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে একদম চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
"বিভং" এর নামকরণ সহ লেখা যতই এগিয়েছে, কাহিনীর প্রয়োজনেই অনেক জায়গায় নানা ধরণের শিল্প এবং সাহিত্যের প্রচুর রেফারেন্স এসেছে,যার কারণে একে বাংলা পপ কালচারের প্রতি এক প্রকার ট্রিবিউট বলা চলে। কাহিনী বেশিরভাগ সময় ফার্স্ট পার্সন ভিউতে বলা, যা গল্পের প্রধান চরিত্র রুপুর মতো একজনের জন্য ঠিকই আছে। তবে গল্পের বেশিরভাগ জুড়ে রুপুর কাহিনী থাকায় বাকি চরিত্রগুলো সেভাবে ফুটে উঠতে পারেনি।
কাহিনী বেশ ফার্স্ট ,তাতে নানা ধরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাপারের সাথে হিউমারের মিক্স বেশ ভালো লেগেছে।গল্পে টুইস্ট এর পরিমান ও বেশ ভালো (যদিও মেইন টুইস্ট আগেই ধারণা করতে পেরেছিলাম ) .গল্পে নানা ধরনের টেকনিক্যাল দিকগুলো অনেক ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে,তাই বুঝতে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি। এছাড়া গল্পে কিছু জায়গায় কিছু শব্দ মিসিং ছিল,তাতে কাহিনীতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি। "বিভং" এর প্রচ্ছদ গল্পের সাথে বেশ মানানসই।বাধাই ও কাগজের মান ও ভালোই বলা যায়।
বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সাই ফাই এর এই ঘরানায় বেশ কিছু বই পড়লেও বলা যায় "বিভং" এ বেশ কিছু নতুনত্ব ছিল যা বাকি বইগুলোতে আমি বলতে গেলে পাইনি। বেশ ভালো লাগছে এটি দেখে যে এদেশে গতানুগতিক কল্পবিজ্ঞানের ধারার চেয়ে নতুন নতুন ধারায় গল্প বলা হচ্ছে। সামনে নাবিল মুহতাসিম সহ বাকি লেখকেরা বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাক, এ প্রত্যাশায় রইলাম।
সত্যি বলতে বিভং যেন হলিউডের বিশাল বাজেটের এক সাই-ফাই - কনস্পারেসি থ্রিলারের স্ক্রিপ্ট। প্রতিটা চ্যাপ্টার পড়ার থেকে ভিজ্যুয়ালাইজ করার ফিল টাই যেন বেশি পাবেন।
তবে যেটা না বললেই না, সেন্স অফ হিউমারের জন্যই নাবিল ভাই এর কোনো তুলনা হবে না৷ বই এর স্টোরি যায় হোক না কেন, তার স্টোরি টেলিং অন্য লেভেলের!
'বিভং' নামটা প্রথম শুনেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। যারা জানার তারা তো জানেনই রেফারেন্সটা কিসের। পুরো বইয়ে ইস্টার এগের অভাব নেই। উপভোগ্য বর্ণনার সাথে এই রেফারেন্সগুলো পড়ার মজা বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে।
"মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না। এই একটা জিনিস, যেটা মানুষকে মানুষ বানিয়েছে।" – নাবিল মুহতাসিম
নাবিল মুহতাসিমের লেখনশৈলীতে অদ্ভুত একটা ঘোরলাগা ভাব আছে। পাঠকের এমনটা মনে হতে বাধ্য যে – লেখক একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি বসে একটা গল্প শুনাচ্ছেন। যেন লেখক লেখাটা এখনো প্রকাশ করেনি; অথচ বন্ধুত্বের খাতিরে পাঠককে আগেভাগেই শুনিয়ে দিচ্ছেন গল্পটা। গল্পটা কেবলই একটা সাদামাটা আর গন্ডিবদ্ধ সায়েন্স ফিকশনে আবদ্ধ না রেখে বরং পুরোদস্তুর একটা তথ্যবহুল বইয়ে রূপান্তর করেছেন লেখক।
নট অনলি নন-লিনিয়ার বাট অলসো ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভ। হ্যাঁ, গল্পটার প্লট সাজানো হয়েছে খানিকটা নন-লিনিয়ার ধারায়। তবে পুরো বর্ণনাভঙ্গি উত্তম পুরুষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে লেখক উত্তম পুরুষের চেতনা প্রবাহকে গল্পে রূপদান করতে গিয়ে পাঠকের মনে খানিকটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছেন। সেইজন্যেই স্ট্রিম অফ কনশাসনেস আর নন-লিনিয়ার ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভে খানিকটা দ্বন্দ্ব মনে হলেও হতে পারে পাঠকের। তবে এতে গল্পের প্রবাহে তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি। এগুলোর সঙ্গে আবার ডার্ক কমেডি একদম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির অমিলই বেশি। বইটি সম্পর্কে অনেক পজেটিভ রিভিউ দেখেছি। কিন্তু যে আশা নিয়ে শুরু করেছিলাম, পড়তে গিয়ে ততোটাই হতাশ হয়েছি। গল্পটা ভালো। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনার বাহুল্যে প্রচুর বিরক্ত হয়েছি। শুধু শুধু তথ্য ঠেসে পৃষ্ঠা সংখ্যা না বাড়ালেই হতো। গল্প বলার ভঙ্গিও পছন্দ হয়নি। অবশ্য সবার সবকিছু ভালো লাগবে এমনটা ভাবাও ঠিক না। পড়া শেষে একটা কথাই মনে হয়েছে, এই বই আমার জন্য না।
অনেক কিছুই লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেছে। দেখি কী কী লেখা যায়! বইয়ের প্লট খুব বিশাল নয়, ছোটই। তারপরেও ২৫৬ পৃষ্ঠার হয়ে গেছে বইটা কীভাবে যেন। হ্যাঁ, বর্ণনার আধিক্য আছে বইতে, কিন্তু তা বিরক্ত করার পরিবর্তে মুগ্ধতায় আবিষ্ট করেছে। সেটা কেন? পড়লেই বুঝতে পারবেন। কাহিনী, চরিত্র গঠনের জন্য এই বর্ণনার দরকার পড়েছে এবং বইয়ের মূল যে অংশ স্পেস স্টেশন, নভোচারী ট্রেনিং, স্পেস সম্পর্কে যে ধারণা লেখক দিয়েছেন, তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। লেখক নাবিল মুহতাসিমের লেখার ধার আশা করি "বাজিকর" সিরিজেই পেয়ে গেছেন, এখানেও সেই ধারা অব্যাহত। স্বতন্ত্র এক লেখনশৈলী, মুগ্ধ হবার মতোই। আর যে দিকগুলো গল্পকে আরো আকর্ষণীয় করেছে তা হলো বইতে প্রচুর "ইস্টার এগ" বা শিল্প, সাহিত্য ও বাংলা পপ কালচারের রেফারেন্স ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো আবিষ্কার করেও আনন্দ পেয়েছি। লেখক এগুলো এত সূক্ষ্ণভাবে ��র্ণনার সাথে ব্লেন্ড করেছেন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। আর যেটা ভালো লেগেছে তা হলো হিউমার, কখনো মুচকি হাসবেন, আবার কখনো জোরেসোরেও হেসে ফেলতে পারেন। আমার কাছে এটা অতি চমৎকার একটা বই। দেশে এমন একটি সায়েন্স ফিকশন লেখা হবে চিন্তা করিনি আগে। আশা করি, আরো চমৎকার মৌলিক সায়েন্স ফিকশন পাব আমরা আগামীতে।
লেখা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। একবার পড়া শুরু করলে আপনা থেকেই তরতর এগিয়ে যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট কবিতা, গান আর উক্তির রেফারেন্স পেয়ে বেশ ভাল লেগেছে। বিবরণগুলোও উপভোগ্য ছিল। তবে টুইস্টটা মোটামুটি শুরুর দিকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, আর ফিনিশিংটা একটু আলাদা হতে পারত। বাকি সবে নাবিল মুহতাসিম বরাবরের মতোই বাউন্ডারি হাকিয়েছেন!
ফ্ল্যাপে লেখা গল্প পরিচিতি পড়লেই বইটা হাতে নিতে ইচ্ছে করবে! ঝরঝরে প্লট, লেখার হাতও সাবলীল। সাইফাই জগতের সাথে আবেগের সংযোগ চমৎকার ছিল। সাথে এসেছে প্রিয় কবি সাহিত্যিক আর মিউজিশিয়ানদের ক্যামিও এপেয়ারেন্স। এক কথায় চমৎকার!
তবে কিনা জায়গায় জায়গায় বর্ণনার বাহুল্য ছিল। আর প্রচুর ভুল বানানের সমাহার পড়তে গিয়ে যথেষ্ট বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। এজন্য সাড়ে তিন তারা।
কাজী রূপু। প্রথম বাঙালি যে কিনা মহাকাশচারি হিসেবে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে। কিন্তু জ্ঞান ফিরতেই এমন এক উটকো এবং অবিশ্বাস্য ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে এই সম্ভাব্য এস্ট্রোনাট যা তাঁর সারাজীবনের অমানুষিক সাধনাকে ভেস্তে দিতে পারে। সয়ুজ করে টেক অফের পরিবর্তে রূপুর স্থান হতে পারে কারাগারে। মহাকাশযানের পরিবর্তে তাঁকে নিয়ে বসানো হতে পারে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে।
নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে পরিচালিত স্পেসস্টেশনের মধ্যে ওজনশূণ্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালিত হবে। তবে ওখানে পৌছেই রূপু বুঝে উঠতে পারলো যে এক মারাত্মক রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক দ্বন্দ্বের মাঝে চলে এসেছে ইতিহাসের প্রথম বাঙালি এস্ট্রোনাট। ভূরাজনীতির তাপ এমনকি স্পেসস্টেশনে পর্যন্ত গড়িয়েছে। কি এমন গোপন এক্সপেরিমেন্ট করছে রাশিয়ানরা এবং কি ধরণের দুরভিসন্ধি নিয়ে সেই মহাকাশের ঘরে পা রেখেছেন রূপুর মার্কিন কমান্ডার?
পৃথিবীজুড়ে রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, নারীবিদ্বেষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং প্রগতিশীলদের পর্যন্ত নিজ নিজ চিন্তায় গোঁড়ায় পরিণত হয়ে যাওয়ার প্রভাব তো মহাকাশেও চলে যাওয়ার কথা। শত হলেও মহাকাশ অভিযান শুরুই হয়েছিল বিশ্বজুড়ে সামরিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য, স্নায়ুযু্দ্ধের সময়ে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধিত হলেও মানুষ এখনো যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে উঠেছে আরো ভয়ানক।
বছর খানেক আগের সর্ববিদ্যায় পারদর্শি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা 'রবি' কে আদালতের রায়ের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। প্রফেসর জয়ন্তর আবিষ্কার প্রায় মানুষের মত এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিন্তু তার আগে মানবতার ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সমস্যা বিশ্লেষণ এবং সমাধানে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। এখন পরিণত হয়েছে ট্যাবুতে। মহাকাশে রাশিয়ানদের সাথে সাথে নিজ দলের সদস্যদের অদ্ভুত আচরণে রূপু ভড়কে না গিয়ে পারে না। তার উপর এক অচেনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে গেছে ঐ স্পেসস্টেশনেই। আমাদের মূল চরিত্রকে বারবার চলে যেতে হচ্ছে মনোস্কোপে। শেষ রক্ষা কি হবে?
নাবিল মুহতাসিমের লেখা আমার বরাবরের মতই দারুন লাগে। তবে এই বইটি তাঁর মহাকাশ সংক্রান্ত তীব্র প্যাশনের সাথে সাথে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি যথারীতি লেখকের দুরন্ত ভালোবাসার এক নিদর্শন দিয়ে গেছে। বিভং এ পাঠক নন-ফিকশনের একটু যান্ত্রিক ভাষার পরিবর্তে উত্তম পুরুষে রূপুর কাছ থেকেই মহাকাশ যাত্রার প্রস্তুতি, মহাকাশযান, স্পেসস্টেশন, ঐতিহাসিক কিছু তথ্য, সেসবের সাথে জড়িত ভূরাজনীতির দুর্দান্ত বর্ণনা পেতে পারেন। নাবিল মুহতাসিমের লেখালেখিতে উত্তম পুরুষে গিয়ে কখনো কখনো ফোর্থ ওয়াল ভেঙে শিল্প-সাহিত্যের এবং ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান এবং ভূগোলের বিভিন্ন তথ্য একধরণের 'ডার্ক কমেডি' এর মাধ্যমে প্রকাশটা আমার বরাবরের মতই খুব পছন্দের বিষয়। লেখনীর মাধ্যমে সার্কাজম এবং ডার্ক এন্ড গ্রিটির কম্বিনেশন মনে হয় নাবিলের চেয়ে বর্তমানে ভালো কেউ দিতে পারেন না।
আরেকটা কথা বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম। এই গ্রন্থে বাংলা এবং ভিন্নভাষার বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি কবি-সাহিত্যিক-ব্যান্ডতারকার উপস্থিতি লেখক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এইরকম সায়েন্স ফিকশন আমি মনে হয় আগে পড়িনি।
পৃথিবী হোক বা মহাকাশ, সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন পরিচয়বাদী আচরণের কারণে সুন্দর এবং সহজ জীবনেও যেকোন মূহুর্তে নেমে আসতে পারে বিভং।
❝মনোস্কোপ না মনস্তাপ? এই মনস্তাপ কী করবে, আমাকে মরণ থেকে বাঁচাবে? হা হা হা। বাতাস দে হারামজাদা, নইলে স্পেস সুট চিবিয়ে খাবো।❞
নিজের সাথে নিজে বলা কথাকে কখনও গল্প বানিয়ে অন্যকে শুনিয়েছেন? অবাস্তব কিছু না। বাস্তবে ঘটেছে এমন কিছু। হতে পারে কোনো ঘটনা; যা ঘটেছে অনেক দিন আগে। পালটে দিয়েছে আপনার মনের গতিপ্রকৃতি, পরিবর্তন এনেছে আপনার মনস্তত্ত্বে? মনে পড়ে সে-রকম কোনো ঘটনার কথা?
আচ্ছা বিপদে পড়লে কী করেন? কোনো নির্দিষ্ট শব্দ জপে নিজেকে শান্ত করেন না-কি হুটহাট জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন? বিপদের ভয় তো আবার দু’রকম। হিউম্যান সাইকোলজি বিচারে সেটা হতে পারে সত্য অথবা মিথ্যা। একটু খুলে আলোচনা করি। যদিও শুদ্ধ সাই-ফাই প্লটে লেখা উপন্যাসে কেন আমি সাইকোলজি নিয়ে কথা বলছি সেটা অনেক পাঠকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ঠেকতে পারে। রিভিউ বলে কথা, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক একটু-আধটু থাকলে অসুবিধে নেই।
কথার প্রসঙ্গে অনেক কথায় আসে। তাই ভূমিকাতে এই নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি আমি। একটি উপন্যাসের গূঢ় অর্থ যদি আমি না ধরতে পারি অথবা সেটা নিয়ে দুয়েক কথা না বলতে পারি—তাহলে সময়গুলো বৃথা মনে হয়। আসল কথায় আসি। বকবক শুনতে কেউ পছন্দ করে না; অথচ ❛বিভং❜ উপন্যাসের শুরু থেকে ৭০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এবং তারপরেও অনেক বকবক আপনাকে শ���নতে হবে! যেহেতু উত্তম পুরুষে বেশির ভাগ পর্ব লেখা তাই ‘শুনতে’ হবে শব্দ উল্লেখ করেছি।
কোথায় যেন ছিলাম? ওহ হ্যাঁ, বিপদ! বিপদ নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য কী? আছে, ওই যে বললাম সত্য-মিথ্যা। অজানা বিপদে ভয় থাকে, যেখানে লুকিয়ে থাকে সত্য আর জানা বিপদে কী থাকে তা আশা করি বলে দিতে হবে না। ❛বিভং❜ উপন্যাসে অজানা বিপদের সত্যকে লেখক খুবই ধূর্ততার সাথে সায়েন্স ফিকশনের মোড়কে সাইকোলজি গেম হিসেবে উপস্থাপনা করেছে। সেই গেমের প্রতিটি লেভেলে লুকানো আছে প্রচুর পপ কালচার রেফারেন্স এবং মহাকাশে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি এবং পরবর্তী কার্যপদ্ধতি নিয়ে বিশদ খুঁটিনাটি।
এ-ছাড়া স্পেস স্টেশন, নভোচারীদের প্রশিক্ষণ, রকেটের বিশ্লেষণ, মহাকাশের বর্ণনা-সহ অনেক বিষয় পুরোপুরি ডকুমেন্টারি টাইপ (অবশ্যই গল্পচ্ছলে) করে লেখা। কোন যন্ত্র কীভাবে কাজ করে, কীভাবে সেটাকে নভোচারী’রা পরিচালনা করে, তাঁদে�� সুবিধা-অসুবিধা ছাড়াও স্পেস স্টেশনে রাজনীতি, দু’দেশের মধ্যবর্তী গোপন এক মিশন নিয়ে কন্সপিরেসি এবং মহাশক্তিধর অশুভ এক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ‘রবি’! তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ভরপুর এই উপন্যাসে প্রতি পাতায় পাতায় থ্রিল অনুভব না করলেও, শুরুতে ধৈর্য হারা মনোভাব সাথে কিছুটা অনীহা; ‘হচ্ছে কি!’ টাইপ বাক্যও মুখ দিয়ে বেরুতে পারে।
তাই অনুরোধ করব, মন স্থির ও মাথা ঠান্ডা করে তবেই বইটি নিয়ে বসুন। ধৈর্য ধরুন ‘কী হচ্ছে’ জানার জন্য। শুধু বলব গল্পের চেয়েও ডকুমেন্টারি এবং পপ কালচার নিয়ে উক্তি প্রয়োজনের চেয়েও অধিক মনে হয়েছে। গল্পের ফ্লো নষ্ট করার জন্য যা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। অনেকের কাছে ভালো লাগলেও, আমার লাগেনি।
➲ আখ্যানপত্র—
গুডরিডস অথবা কমেন্ট বক্সের প্রথম কমেন্ট চেক করুন।
➤ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা—
❛বিভং❜ নিয়ে প্রতিক্রিয়া আমার মিশ্র। শতকরা হিসেবে যদি বলি তাহলে পুরো বইয়ের চল্লিশ ভাগ আলোচনা, বিশ ভাগ পপ কালচার দিয়ে ঠাসা আর বাকিটা গল্প। ২৫৬ পৃষ্ঠার বইটি লেখক যে শুধু স্পেস স্টেশনে নভোচারী পাঠানোর উদ্দেশে লিখেছেন তা-ও না; খুবই সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে একটি গল্পকে হাতিয়ার বানিয়ে সেখানে মালমসলা হিসেবে মহাকাশ-রকেট-নভোচারী ট্রেনিংয়ের তথ্য-উপাত্ত ঢুকিয়ে সাথে পপ কালচার ও মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়ার উপস্থিতি মিশিয়ে এক সুস্বাদু উপন্যাস কাম ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন।
এক টানে এই উপন্যাস পড়া আর এই নিয়ে কিছু লেখা আক্ষরিক অর্থে অনেক ভাবনার বিষয়। প্রতিক্রিয়া ঠিকমতো জানানোও এক প্রকার চ্যালেঞ্জ; যেখানে প্রায় পাঠকের ভালো লেগেছে উপন্যাসটি। আমার করা আলোচনার বিষয়গুলো নিয়ে—নেতিবাচক মনোভাব না রাখার অনুরোধ রইল। আমি উপন্যাস পড়তে এসেছি এবং সেই উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিয়ে বেশ ভালোই জেনেছি।
আপনার যদি নভোচারী হওয়ার শখ জাগে অথবা মহাকাশ ও ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন নিয়ে জানার আগ্রহ থাকে এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কী কী পরিবির্তন ঘটাতে পারে তা জানার ঔৎসুকতা থাকলে—বইটি সুখপাঠ্য মনে হবে। কারণ লেখক সেই জায়গাগুলোতে ভালোই ফোকাস করেছেন। যদি কাহিনির পাতায় পাতায় রোমাঞ্চিত হওয়ার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে বইটি এড়িয়ে যাওয়া উত্তম। যদিও সাই-ফাই; সেখানে রোমাঞ্চ হওয়ার পরিবর্তে ‘অবাক হওয়া’ বেশি মানানসই।
বইটি কেন পড়বেন আর কেন পড়বেন না; দুটোই বলে দেওয়া হয়েছে। বাকি সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।
● সূত্রপাত—
পরিত্যক্ত এক এয়ারপ্লেন হ্যাঙ্গারের ভেতর থ্যাঁতলানো এক লাশের পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা কাজী ওরফে রূপু। প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে রূপু’র। কিন্তু একি! কেন সে এই পরিত্যক্ত এয়ারপ্লেন হ্যাঙ্গারের ভেতর একটা লাশের পাশে এ-ভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে? কী ঘটেছিল রূপু এবং এই লাশের সাথে?
পুরো ৭০ পৃষ্ঠা ধরে লেখক সেটা আপনাকে জানাবে। তারপরে মূল গল্পে ঢুকবে। আবার দীর্ঘক্ষণ আলোচনা। ২ ১৬ পৃষ্ঠায় গিয়ে গল্প কাঙ্ক্ষিত মোড়টি নিবে। বাকিটা গল্পের ছেড়ে দেওয়া সুতোর গুটিয়ে নেওয়ার অংশ। শুরুতে কয়েক পৃষ্ঠা আগ্রহ তুঙ্গে থাকলেও, হুট করে সেটা নিচের দিকে ধাবিত হবে। আমার ক্ষেত্রে সেটা হলেও, আপনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে।
● গল্প বুনট • লিখনপদ্ধতি • বর্ণনা শৈলী—
বইয়ের অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও মূল বিষয়বস্তু নিয়ে এখন আলোচনা করব। লেখকের লেখা পূর্বে পড়ার অভিজ্ঞতা থাকায় বলতে পারি, নিজস্ব ঢঙে পুরো উপন্যাসটি তিনি লিখেছেন। প্রেক্ষাপট সাজানো থেকে শুরু করে, সবকিছু দক্ষ হাতে মেইনটেইন করেছেন। লেখনশৈলী বেশ ভালো। বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেক কথোপকথন এবং স্পেস স্টেশন, নভোচারী ট্রেনিং ইত্যাদি নিয়ে বিশ্লেষণ অনেক প্রাঞ্জলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ-সব বিষয়ের পর্ব যখন আসবে তখন ধীরে সুস্থে পড়ার চেষ্টা করা ভালো।
উক্ত উপন্যাসের ‘সংলাপ’ আমার সবচেয়ে স্ট্রং পয়েন্ট মনে হয়েছে। বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (রবি) এবং প্রতিষ্ঠাতা ড. জয়ন্ত ব্যানার্জীর সাথে যখন আদালতে প্রশ্নের মুখোমুখি পর্বগুলো রয়েছে। আগেও বলেছি সাই-ফাই হলেও সাইকোলজি এবং দর্শনের মাত্রা এই উপন্যাসে কাঁধাকাঁধি ছিল। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর রূপ ও রং বদলে দেওয়ার চিন্তা বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
● চরিত্রায়ন—
চরিত্রের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। রূপু চরিত্রটিকে ঘিরে পুরো উপন্যাস আবর্তিত হলেও পরবর্তীতে কয়েকটি চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
● অবসান—
শুরু থেকে শেষটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। তবে এই পূর্ণতা পাওয়ার জন্য শুরু থেকে ধৈর্য সহকারে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। গল্পের আধিক্য শেষের দিকে প্রকটভাবে ধরা দিয়েছে।
● খুচরা আলাপ—
যম্মিন দেশে যদাচার! অর্থাৎ যে দেশে যেমন আচার। শুধু দেশের দিক থেকে না; যে-কোনো কাজ করার আগ মুহূর্তে অনেক আচার-আচরণ পালন করতে হয়। লেখক তাই ব্যঙ্গার্থে এইভাবে বাক্যটি বলেছেন। ইন্টারেস্টিং। এ-রকম বাক্য আরও রয়েছে পুরো উপন্যাসে।
সব কিছু বলা হলো, অথচ ❛বিভং❜ নিয়ে কিছুই বললাম না! বইয়ে এত ‘এস্টার এগ’ রয়েছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। তাই আমিও সেটা—সেইভাবে রেখে দিলাম। উক্ত উপন্যাসে বিশেষ কিছু মানুষের কাল্পনিক উপস্থিতি কিছুটা প্রশান্তি এনে দিয়েছে এবং সেই সাথে বিশ্ব রাজনীতি, মানবাধিকার ও বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে দারুণ সব কথাবার্তা রয়েছে। ভালো যেমন অনেক কিছু লাগেনি, তেমন ভালো লাগারও অনেক কিছু এই উপন্যাসে আছে। মিশ্র এই দোলাচলচিত্ত উপন্যাসের অনুভূতি নিয়ে আজকের আলোচনায় এখানেই ইতি টানলাম।
➣ লেখক নিয়ে কিছু কথা—
নাবিল মুহতাসিমের চিন্তাভাবনা বেশ ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের। দারুণ প্রতিভাবান একজন লেখক। ❛বিভং❜ বইটিকে সাই-ফাই বা থ্রিলার জনরায় বেঁধে না রেখে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে যে ট্রিবিউট তিনি দিয়েছেন; যা প্রশংসার যোগ্য। এটাও ঠিক, গল্পের প্রয়োজনে এই বিষয়গুলো বেশি মনে হবে। তবে যে সুতা তিনি নির্দ্বিধায় ছেড়েছেন—তা নির্দিষ্ট বিন্দুতে এনে আবার জুড়ে দিয়েছেন। ‘সসেমিরা’র পরে ওনার এই উপন্যাস পড়ে আমার উপকার হয়েছে, কারণ এরপরে ‘বাজি’ ট্রিলজিতে পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারব।
● সম্পাদনা ও বানান—
লেখক এত পরিশ্রম করেছেন যে, সম্পাদনা ত্রুটি থাকলে সেটা অনেক ব্যথিত করত। তবে সুস্থির বিষয় যে, সম্পাদনা জনিত তেমন বৃহৎ কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি। বানান ভুলও প্রকাশনার দিক চিন্তা করলে অনেক কমই ছিল।
● প্রচ্ছদ—
বইয়ের কনটেন্টের সাথে প্রচ্ছদ ভালোই মানিয়েছে। সিম্পল কিন্তু সুন্দর।
● মলাট • বাঁধাই • পৃষ্ঠা—
সেকেন্ড হ্যান্ড পড়েছি বইটি। এখনও বেশ ভালো অবস্থায় আছে। বাঁধাই কিছুটা হালকা হওয়ার কারণে একেবারে খুলে আরাম করে পড়া যায়। ফন্ট সাইজ ও লাইন স্পেসও ঠিকঠাক।
⛃ বই : বিভং • নাবিল মুহতাসিম ⛁ জনরা : সায়েন্স ফিকশন ⛃ প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ⛁ প্রচ্ছদ : ডিলান ⛃ প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী ⛁ মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা মাত্র ⛃ পৃষ্ঠা : ২৫৬
কল্পনা করুন, আপনি "রুপু" - বাংলাদেশের প্রথম নভোচারী ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে আবিষ্কার করলেন পরিত্যক্��� এক জায়গায়। পাশে একজনের লাশ। কার লাশ আপনার জানা নেই। কেবল জানা আছে, লাশটির লাশ হওয়ার জন্য দায়ী আপনি নিজেই। সহজ করে বলি। লাশটির খুনি আপনি নিজেই। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আপনার মহাকাশ যাত্রা। রকেটে চড়ার আগে হয়ত আপনাকে চড়তে হবে পুলিশের লড়িতে।
এমন পরিস্থিতি থেকেই গল্পের যাত্রা শুরু। শুরুটা কিছুটা ধীরগতির। তবে বিরক্তিকর নয়৷ কারণ - লেখকের সাবলীল লেখনী। "বাজিকর" সিরিজ যারা পড়েছেন, তারা লেখকের ভিন্নধর্মীর এই লেখনীর সাথে পরিচিত। তবে "বিভং" গল্পে নিজের আগের লেখাগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছেন বহুগুনে। লেখকের বর্ণনাবহুল লেখা পড়ে যেতে এজন্য একবারের জন্যে হলেও বিরক্তি ভর করে নি।
গল্পে চরিত্রের ঘনঘটা নেই। প্রায় পুরো গল্পই "রুপু" এর ফার্স্ট পার্সন ভিউয়ে লেখা৷ বইয়ের ভূমিকায় লেখক উল্লেখ করেছেন, ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণে "ডার্ক কমেডি" এর ব্যবহার এই বইয়ে রয়েছে। যদিও তার পরিমাণ খুবই কম। তবে উপভোগ্য ছিল।
সায়েন্স ফিকশন গল্পে সাধারণত "হলেও হতে পারে" - এমন গল্পের আশ্রয় নেওয়া হয়৷ সায়েন্সের বর্ণনা সেসবে নেহায়াতই কম থাকে। বলা যায়, সেসব লেখকরা সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যান। তবে এই গল্পে লেখক তা এড়িয়ে যান নি৷ "বিভং" গল্প পড়ে যে কারো মনে হবে - লেখক হয়ত নিজেই নভোচারী ছিলেন এবং স্পেস স্টেশনে ৬ মাস / ১ বছর কাটিয়ে এসেছেন। মহাকাশ, নভোচারীদের ট্রেনিং, ইন্টারন্যাশনাল স্পেশ স্টেশন সম্পর্কে গল্পে যে বিস্তর বর্ণনা - অনেকের কাছে তা অতিরিক্ত মনে হতে পারে৷ আবার অনেকের কাছে তথ্যের কচকচানি মনে হতে পারে। তবে আমার কাছে তা মধুর ঠেকেছে। এর কারণ আগেই উল্লেখ করেছি লেখকের বর্ণনাভঙ্গি। ফার্স্ট পার্সন ভিউয়ে লেখাগুলি পড়ে যেতে কোনো সমস্যাই মনে হয় নি। বরং মুগ্ধতা বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে লেখক গল্পে প্রচুর সাহিত্যিক রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন। যা গল্পের মাত্রাকে আরেকটু উঁচু করেছে।
গল্পে রহস্য এবং টুইস্ট থাকলেও, প্রধান টুইস্ট অনুমেয়। বিশেষ করে কেউ যদি ব্যাককাভারের অংশটুকু আগে পড়ে ফেলেন। তাই ব্যাককাভার না পড়ারই সাজেশন থাকবে৷ পুরো গল্প যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল, ফিনিশিংটা আরো ভালো কিছু এক্সপেক্ট করেছিলাম। ফিনিশিংটা আরেকটু ভালো হতে পারতো। সাই ফাই থ্রিলার না বলে আমি "বিভং" কে শুধু সাই-ফাই হিসেবেই পরিচয় দিব। কারণ থ্রিলের রসদ ছিল কম৷ গল্প কিছুটা ধীরগতির। বিশেষ করে প্রথমার্ধে। তাই "বিভং" থ্রিলার হিসেবে প্রথম সারির না হলেও, সায়েন্স ফিকশন হিসেবে দারুণ।
বিশেষ করে, আমাদের দেশে গতানুগতিক ধারায় যেভাবে সায়েন্স ফিকশন লেখা হয়ে থাকে - "বিভং" সেই গন্ডির বাইরে। সায়েন্স ফিকশনে যাদের আগ্রহ - তাদের জন্য অবশ্যই Recommended থাকবে।
লেখকের প্রথম বই সুপারন্যাচারাল থ্রিলার "শ্বাপদ সনে" তাঁকে পাঠক মহলে পরিচিত করে তোলে। এরপর স্পাইথ্রিলার "বাজিকর" এবং "বাজি" দিয়ে তিনি বাজিমাত করেন। "বিভং" - নাবিল মুহতাসিমের ৪র্থ মৌলিক গ্রন্থ৷ লেখকের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত আশা করছি৷
"বিভং" - ২০১৯ বইমেলায় বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়৷ প্রচ্ছদ যদিও সরাসরি কপি, তবুও বইয়ের সাথে মানানসই। ২৫৫ পেজের বইটির মুদ্রিত মূল্য ৩০০টাকা। বাতিঘরের অধিকাংশ বইয়ে অতিরিক্ত বানানভুল এবং খারাপ মানের বাইন্ডিং এর অভিযোগ দেখা যায়। তবে এই বইয়ে বানানভুল তেমন চোখে পড়ে নি। বাইন্ডিং ও ছিল বেশ ভালো। So, Thumbs up for বাতিঘর 👍
নাবিল ভাইয়ের লেখনি সম্পর্কে সেরা উক্তিটি সম্ভব অনুবাদক/লেখক সালমান হকের। "নাবিল মুহতাসিমের লেখনির ধরনটাই এমন, যেন আপনার চোখের সামনে বসে গল্প বলছেন।"
কথাটার প্রমাণ পাবেন বাজিকর ট্রিলজিতে। বিভং বইটাও কম যায় না। স্রেফ লেখনি গিলিয়ে লেখক আপনাকে পুরো বইটা পড়তে বাধ্য করবেন।
বাংলাদেশের প্রথম নভোচারী রুপু। নাসার হয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাচ্ছে সে। রকেটে ওঠার আগেই একটা খুনের সাথে জড়িয়ে যায় সে। প্রথম মিশনের আগেই তাকে পাকড়াও করা হবে?
এরপরও কোনোভাবে মিশনে যেতে পারে রুপু। সেখানে নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পন্ন করে তাকে পৃথিবীতে ফিরতে হবে। কিন্তু এর মাঝেই সে মার্কিন-রুশ রাজনৈতিক দ্বন্দে পড়ে যায়।
এদিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রবিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ট্রায়াল বসে আদালতে। সেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার চেষ্টা করে রবি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। আদালতের রায়ে চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয় রবিকে। রবি যে ফিরে আসছে না, তার কী গ্যারান্টি আছে আপনার কাছে?
কাঠামোগত ভাবে বইটা সায়েন্স ফিকশন। সাথে থ্রিলও আছে। ক্রাইম আছে।
স্পেস ট্রাভেল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সম্পর্কে লেখক মোটামুটি সলিড বর্ণনাই দিয়েছেন। যেকারণে বইটি কাঠামোগত ভাবে হার্ড সাইফাই।
সায়েন্স ফিকশন হলেও বইটিতে উদ্ভট কোনোকিছু নেই। লেখক প্রতিটা বিষয়ের যৌক্তিক বর্ননা দিয়েছেন।
বইটিতে অল্প কিছু চরিত্র রয়েছে এবং প্রতিটি চরিত্রই ওয়েল ডেভেলপড। কেন্দ্রীয় চরিত্র রুপুকে আপনার ভালো লাগতে বাধ্য। সাথে অন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে রব ফিংকেলস্টাইনও বেশ ইন্টারেস্টিং একটি চরিত্র।
বইটির সবথেকে ইন্টারেস্টিং পার্ট হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রবির ফিরে আসা। শেষের টুইস্টটাও যথাযথ ছিল। সবমিলিয়ে পারফেক্ট একটা কম্বো।
নাবিল ভাইয়ের লেখনি আপনাকে বাধ্য করবে বইটি শেষ পর্যন্ত পড়তে। হাইলি রেকমেন্ডেড একটা বই।
কাহিনি সংক্ষেপঃ রূপম কাজী ওরফে রূপু নামের এক যুবক প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মহাকাশ অভিযানের সুযোগ পেয়েছে। একজন অ্যাস্ট্রোনট হওয়া ওর আজীবন লালিত স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রূপুর জ্ঞান ফিরলো অজানা এই স্থানে। যেখানে ওর পাশেই মুখমণ্ডল থ্যাঁতলানো একটা লাশ পড়ে আছে রক্তে মাখামাখি হয়ে। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে সে নিজেও। তবে কি খুনটা রূপুই করেছে? এবার বোধহয় মহাকাশে যাওয়ার বদলে খুনের দায়ে জেল যাত্রার আয়োজন করতে হবে তাকে। এমন এক খুন, যেটার ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও মনে করতে পারছেনা রূপু। ওর অবস্থাটা বুঝুন একবার!
নির্দিষ্ট দিনে সমস্ত ঝামেলা থেকে গা বাঁচিয়ে কাজাখস্তানের বাইকোনুর উৎক্ষেপনকেন্দ্র বা কসমোড্রোম থেকে রাশিয়ান সয়ুজ স্পেসশিপে চড়ে বসলো রূপু। ওদের তিন জনের এই ছোট অ্যাস্ট্রোনটের দলে আরো আছে পাওলো নামের একজন ইতালিয়ান আর রব ফিংকেলস্টাইন নামের একজন আমেরিকান। ফিংকেলস্টাইনই ওদের কমান্ডার। স্পেশশিপ সয়ুযের গন্তব্য মহাকাশের ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএস। সেখানে রূপুদের টিমের অপেক্ষায় আছে তিন জন রাশিয়ান অ্যাস্ট্রোনট পাভলোভিচ, নাতাশা ও বশিরভ। উল্লেখ্য, সয়ুজের আইএসএস-এর দিকে এই যাত্রাটাই শেষ যাত্রা। এই মহাকাশ মিশনের পরেই পরিত্যক্ত হবে পুরোনো আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশনটা।
মহাকাশের প্রথম সফরটা যতোটা স্বাপ্নিক হবে বলে রূপু ভেবেছিলো, ততোটা কিন্তু হয়েও হলোনা। আইএসএসে পৌঁছেই রাশিয়ানদের বৈরী মনোভাব প্রত্যক্ষ করতে হলো ওকে। ওদিকে কমান্ডার ফিংকেলস্টাইন বাকি সবার থেকে লুকিয়ে অজ্ঞাত এক প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা রাশিয়ান অংশেও। ঢাকঢাক গুড়গুড় যেন সবখানেই। পৃথিবীর দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান কোল্ড ওয়ারের সাথে কি আইএসএসে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো কোনভাবে সম্পর্কিত? তার ওপর রূপুর সহযাত্রী পাওলো হঠাৎ করেই অদ্ভুত ও আগ্রাসী আচরণ করতে শুরু করেছে। এটা কি সেই কিংবদন্তির স্পেস সিকনেস, নাকি অন্যকিছু? সমস্ত বিপদ-আপদের মাঝেও রূপুর মনোস্কোপ খুলে যায়। মনোস্কোপ, অর্থাৎ মনের ভেতরের সেই পর্দায় এসে হাজির হন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলস সহ অনেকেই। গান-ক���িতা দিয়ে তাঁরা পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন বাঙালী মহাকাশচারী রূপুকে।
বেশ কিছু বছর আগে মহাশক্তিধর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রবি-কে ডিজেবল করে দেয়া হয়েছিলো বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগে। একসময় পৃথিবীর মানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে পরিচিত এই রবি আজ সবার কাছেই ভয়াবহ 'অশুভ'। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রবি-র স্রষ্টা ড. জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কোন খোঁজ নেই। বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা সহ অন্যান্য অনেক ব্যাপারে মোড়ল সেজে যাওয়া রবি কি আবারো ফেরার চেষ্টা করছে? নাকি একেবারেই শেষ হয়ে গেছে সবকিছু? আমেরিকা ও রাশিয়া হয়তো এবার সত্যিই সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়বে, যার মূলে থাকবে ভয়ঙ্কর কিছু মারণাস্ত্র।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এসবের সাথে বাংলাদেশী তরুণ অ্যাস্ট্রোনট রূপম কাজী ওরফে রূপুর লেনাদেনা কি? আর সেটার উত্তর দেবে একটামাত্র শব্দ। বিভং।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আপনার মুখোমুখি যদি কেউ বসে আপনাকে ধীরে ধীরে কোন ইন্টারেস্টিং গল্প শোনায়, আপনার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগবে? রীতিমতো উপভোগ করবেন আপনি। 'বিভং'-এ লেখক নাবিল মুহতাসিমও ঠিক এমনভাবেই গল্প বলে গেছেন। একদম ধীর-স্থিরতার সাথে, অথচ সাসপেন্সফুল একটা প্রেজেন্টেশন মনে হয়েছে ব্যাপারটাকে আমার কাছে।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রূপম কাজী ওরফে রূপুর প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মহাকাশযাত্রার গল্পটা নানারকম চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। বাইকোনুর কসমোড্রম থেকে স্পেসশিপ সয়ুজের উৎক্ষেপিত হওয়া থেকে শুরু করে আইএসএস পর্যন্ত পৌঁছানো পর্যন্ত ও তারপর সেখানে ঘটে যাওয়া একের পর এক রহস্যময় ও অদ্ভুত ঘটনা দারুন এক থ্রিলের সৃষ্টি করেছিলো বইটা পড়ার সময়। আর উপরি পাওনা হিসেবে 'বিভং'-এ পেয়েছি অ্যাস্ট্রোনমি ও তার সাথে সম্পর্কিত নানা অজানা বিষয়ের দেখা। অনেক নতুন জিনিস জেনেছি বইটা পড়তে গিয়ে। আর এই ব্যাপারটা 'বিভং'-কে সাদামাটা কোন সায়েন্স ফিকশন থ্রিলারের গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে পরিণত করেছে তথ্যবহুল এক বইয়েও।
শুরু থেকে তেমন কিছু আন্দাজ করতে না পারলেও ধীরে ধীরে গল্পের কিছু অংশ আন্দাজ করতে পারছিলাম। আর শেষে গিয়ে সেগুলোর কিছুটা মিলেও গেছে। মহা ক্ষমতাধর ও বুদ্ধিমান আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রবি-র উৎপত্তি ও কর্মকাণ্ডের অংশগুলো পড়তে গিয়ে বেশ উপভোগে করেছি। আর পছন্দ হয়েছে 'বিভং'-এর ক্লাইম্যাক্সটাও। বইটা দ্রুত শেষ করার মতো হলেও নানা ঝামেলায় শেষ করতে প্রায় সাত দিন লেগে গেছে আমার৷
আমি এর আগে নাবিল মুহতাসিমের একটা মাত্র বই-ই পড়েছি। আর তা হলো 'শ্বাপদ সনে'। এরপর তিনি 'বাজি' ও 'বাজিকর' নামে দুটো এসপিওনাজ থ্রিলারও লিখেছেন, যার শেষ কিস্তি 'বাজিমাত' সম্ভবত সামনে আসবে। এগুলো পড়া হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে পড়তে হবে। সামান্য পরিমাণ টাইপিং মিসটেক ছিলো 'বিভং'-এ। ডিলান সাহেবের করা 'বিভং'-এর প্রচ্ছদটা ভৌতিক রকমের নান্দনিক হয়েছে। আগ্রহীরা চাইলে চেখে দেখতে পারেন 'বিভং'।
এক বসাতে পড়ে ফেললাম। অনেকদিন পরে একটা ভালো বাংলা সাইন্স ফিকশন পড়লাম। শেষের টুইস্টটা চমকদার ছিলো। সবচেয়ে ভালো লেগেছে রবি চরিত্রটি। পাচ ★ দিতাম, কিন্তু জায়গায় জায়গায় কবিতার লাইন বইয়ের ফ্লো নষ্ট করেছে। দুই একটা ঠিক ছিলো, কিন্তু এক সময়ে বিরক্ত লেগেছে৷ আর জায়গায় জায়গায় অতিরিক্ত ইনফোডাম্পিং এটাও বিরক্ত লেগেছে। তবে প্রধান চরিত্রের হিউমার পুরোদমে উপভোগ করেছি। সাথে উপভোগ করেছি বিভং নামের ব্যাখা। মৌলিক সাই-ফাইয়ের এই আকালের যুগে উপভোগ্য একটা বই উপহার দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
বিভং এর উপর কৌতুহল লেখকের সাইফাই বই দেখে। বিভং শব্দটা মাথায় বাড়ি দিয়েছে ক'বার, বিশেষ পাত্তা দেইনি, মস্তিষ্কের কোনো কোণায় হয়তো লুকিয়ে ছিল। পড়তে পড়তে যতক্ষণে খেয়াল হলো- ততক্ষণে নামের কারণটা পরিষ্কার।
গল্পটা রুপুর, প্রথম বাংলাদেশী নভোচারীর। আপাতদৃষ্টে যাকে দেখতে জিনিয়াস লাগে কিন্তু তার কী মাথায় চলছে অনুমান করা কষ্ট।
গল্পটা রবির, এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, যার উপর মানবসভ্যতা খানিকক্ষণ নির্ভরশীল থাকার পর জায়গা হয় নির্বাসনে।
কাহিনী শুরু হয়েছে এমন জায়গায়, যেইটা মর্ম আপনি হুট করে বুঝবেন না। আবার একশন, কবিতা আর রাজনীতির প্যাচালে পড়তে পড়তে সামনে কী হচ্ছে সেটা বুঝতেও টালমাটাল অবস্থায় পড়ে যাচ্ছেন।
কেমন লেগেছে? এককথায় বলবো জগাখিচুড়ি।
শুরুটা যতটা ধুন্ধুমার ছিল, শেষটা ততটা লাগেনি। মূল চরিত্র বাদ দিয়ে কারো ডেভেলপমেন্ট অতটা চোখে পড়ে না।
একেবারেই খারাপ বলে উড়িয়ে দেয়ার মত না। আবার, এক্সপেরিমেন্ট পুরোপুরি সফল হয়েছে তাও না।
নাবিল মুহতাসিম আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। যেকোনো বিষয়— সে প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন হোক বা এস্পিওনাজ থ্রিলার— তাঁর হাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু... এটা কী ছিল? 'লেখকের কথা' অংশে নাবিল বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো করে জানিয়েছেন, এতে 'ডার্ক কমেডি'-র ব্যবহার আছে। সঙ্গে আছে প্রচুর সাহিত্যের রেফারেন্স আর 'ট্রিবিউট'। ভালো কথা। কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের নামে, বা মোড়কে এটা আসলে ঠিক কী ধরনের কাহিনি? এতে খুন, ষড়যন্ত্র, রাজনীতি, ফ্যান্টাসি— সব মিশে এমন একটি অসম্ভাব্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে যা পড়তে গেলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভ আর স্ট্রিম-অফ-কনশাসনেস মাখামাখি হয়ে যায়। আর সবকিছুর মধ্যে ওই 'ডার্ক কমেডি'! বিধুশেখর টাফা থেকে ফেরেনি। এই বইটাকেও শেলফের তেমন একটা কোণে গুঁজে দেব— ব্যস।
বই: বিভং লেখক: নাবিল মুহতাসিম প্রকাশনী: বাতিঘর প্রকাশনী পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৫৪, মুদ্রিত মূল্য: ৩০০টাকা। ছোটবেলা থেকেই রুপকের নেশা মহাকাশযাত্রার। আর সেই নেশার তাড়নায় সে যে কোনো মূল্য দিতে রাজি। কিন্তু নভোচারী হওয়ার জন্য নাছোড়বান্দা রুপক যেদিন যাত্রা করবে মহাকাশে, সেদিন সকালে সে জেগে উঠলো এক লাশের পাশে! এভাবেই অদ্ভুত এক ঘটনার মাধ্যমে শুরু নাবিল মুহতাসিমের প্রথম সায়েন্স ফিকশন “বিভং” । কাহিনীর শুরুটা বেশ চমকপ্রদ । রূপক নামক অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের চরিত্রটির বিভিন্ন স্বভাবের বর্ণনা মনে অনেক বেশী কৌতুহল সৃষ্টি করে। এই বর্ণনায় লেখক শুরুর দিকে কাহিনীটিকে অত্যন্ত ধীরগতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু কিছুদূর পড়ার পরই ফিরে পাওয়া যায় সেই “বাজিকর” এবং “বাজি”র পুরনো নাবিল মুহতাসিমকে। বইটিতে শুরু থেকেই একের পর এক গোলকধাঁধা তৈরি হতে থাকে। রুপক বাংলাদেশের প্রথম নভোচারী। অথচ সে যাত্রা করতে যাচ্ছে রাশিয়ার এক রকেটে! লেখক যে রাশিয়ার বিভিন্ন স্থান, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রীতিনীতি- সবকিছু সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখেন, তার প্রমাণ আরও একবার পাওয়া যায় এই বইটিতে। রূপকের যাত্রা রাশিয়ান রকেটে হলেও, তার সঙ্গী হিসেবে আছেন নাসার দুইজন বিজ্ঞানী; যার মধ্যে একজন ঘোরতর ��মেরিকান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। আমেরিকা আর রাশিয়া- ইউক্রেনের শীতল রাজনীতির ছায়া পড়ে এই মহাকাশযাত্রায়ও। রুপক নিজেও জানে না, তার এই যাত্রার আসল উদ্দেশ্য কি। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে কে। টেক অফের দিন সকালে তার পাশে পড়ে থাকা লাশটি কার। কিচ্ছু জানে না সে। জানতেও চায় না। তার একমাত্র লক্ষ্য, ছোটবেলা থেকেই যে স্বপ্ন লালন করে আসছে, আকাশ ছোঁয়ার। তার সেই স্বপ্ন কি সত্যি হবে? ঘটনা যখন অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করে, তখন পাঠক অবশ্যই চমৎকৃত হবেন।অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হয়ে রূপকের পাশাপাশি পাঠক নিজেও অবাক হবেন। ২৫৪পৃষ্ঠার এই বইটিতে ঘটনাপ্রবাহ বলতে গেলে তুলনামূলক কম। কিন্তু বইটিতে লেখক যে পরিমাণে সাহিত্যিক reference ব্যাবহার করেছেন, তা পড়ার পর কেউই নাবিল মুহতাসিমের প্রশংসা না করে পারবেন না।এটিই বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। আর মহাকাশ সম্পর্কে বিস্তর বর্ণনা পড়ে যে কেউ ভেবে বসতে পারেন, লেখক নিশ্চয়ই কোনো এক সময় নভোচারী ছিলেন! নাবিল মুহতাসিমের বর্ণনাভঙ্গি বরাবরই আর দশজন লেখক থেকে আলাদা। কিন্তু এই বইটির বর্ণনাভঙ্গি একটু অন্যরকম। ইংরেজী সাহিত্যের আদলে তার ডার্ক কমেডির ব্যবহার আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে ভালো লেগেছে, বিশেষ কয়েকটি জায়গা বাদে। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে পাঠক এটিকে কিভাবে নিবেন, সেটিই দেখবার বিষয়। পরিশেষে, “বিভং” একটি ভালো মানের সাইন্স ফিকশন। প্রচলিত গণ্ডির বাইরের একটি সাইন্স ফিকশন। Personal Rating: 4/5 Happy Reading. ^_^
মহাকাশে একটা আবাস, যা কোনো জ্বালানি ছাড়া ভাসতে থাকবে আর সেটাতে মানুষ বাস করবে এই আইডিয়া থেকেই স্পেস স্টেশনের জন্ম। এবং এই আইডিয়া অনেক পুরনো। প্রথম এর হদিস পাওয়া যায় এডওয়ার্ড হেল নামের এক আমেরিকান লেখকের লেখা 'দ্য ব্রিক মুন' নামের একটা সায়েন্স ফিকশন নভেলাতে। প্রথম বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনা করেছিলেন সিলকোভস্কি নামের এক বিজ্ঞানী, বিশ শতকের শুরুতে। এরপর অনেকেই স্পেস স্টেশনের মডেল বানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দূরদর্শী বৈজ্ঞানিক ওয়ার্নার ভন ব্রাউনও আছেন (এঁর হাত ধরেই নাসার জন্ম, রকেট বিষয়ক শত শত নতুন আইডিয়া দিয়েছেন)। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় স্পেস স্টেশন বানানো।
ছোটোবেলায় গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রূপম কাজি ওরফে রূপু তারায় ভরা আকাশ দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে সে প্রচুর অ্যাস্ট্রোনমির বই পড়া শুরু করে। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মহাকাশে যাওয়ার। সেই রূপুই আজ বাংলাদেশের প্রথম অ্যাস্ট্রোনট, যে আর কদিন পর রকেটে চড়ে স্পেস স্টেশনে যাবে। কিন্তু এরইমধ্যে সে হঠাৎ নিজেকে খুব সংকটজনক অবস্থায় পায়। জ্ঞান ফিরে আসার পর দেখে তার হাতে, মুখে, চুলে, জামায় রক্ত লেগে রয়েছে, তার মাথায় পরানো রয়েছে একটা হেলমেট এবং সে যে ঘরে আটক হয়েছে, সেই ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি লাশ। লাশটি কার? কী ঘটেছিল রূপুর এবং লাশটির মধ্যে?
ছোটো থেকেই দেখে আসা স্বপ্ন অর্থাৎ মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ তো হলো রূপুর। স্পেস স্টেশনে এসে পৌঁছেছে তাদের আমেরিকান টিমটি। কিন্তু স্পেস স্টেশনে এসেও শান্তি পায় না সে। আগে থেকে স্পেস স্টেশনের দায়িত্বে থাকা রাশিয়ানরা তাদের সেখানে পৌঁছানোর পরই আক্রমণ করে তাদের ওপর। রূপু বুঝতে পারলো যে আমেরিকা-রাশিয়ার সাংঘাতিক দ্বন্দ্বের মাঝে চলে এসেছে তারা। যার প্রভাব পৃথিবীর ভূভাগ ছাড়িয়ে এই স্পেস স্টেশনেও এসে পৌঁছেছে। কিন্তু কী এমন গোপন কারণ হতে পারে যার জন্য রাশিয়ানরা এই আন্তর্জাতিক মিশনকেও পন্ড করতেও পিছপা হচ্ছে না? এদিকে আবার স্পেস স্টেশনে রূপুদের এক সাথি এক অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অদ্ভুত আচরণ শুরু করে সে। সে চায় রাশিয়ান কমান্ডারকে হত্যা করতে। এই সকল পরিস্থিতির মধ্যে রূপু কী করবে? কী করে উদ্ধার হবে সে? আর বিভং টাই বা কী?
অন্যদিকে আবার ডক্টর জয়ন্ত ব্যানার্জি নামে এক বাঙালি সফটওয়্যার ডেভলপার রবি নামক একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ.আই তৈরি করে। এই রবি কিন্তু সিরি, অ্যালেক্সার মতো কোনো সাধারণ এ.আই নয়, রবির চিন্তাভাবনা একদম মানুষের মতো। একবার ফোনে ইনস্টল করলেই হলো, সে মানুষের মুড ধরতে পারত, চাহিদা বুঝত, মানুষকে পরামর্শ দিতে পারত। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতা মন্ত্রীরা পর্যন্ত রবির ওপর নির্ভর করত। তবে সকলের প্রশংসার এ.আই হওয়া এই রবিই একদিন সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে মিসাইল ইনসিডেন্ট ঘটাল। ফলস্বরূপ মহাপতন হলো রবির। মুক্তি পেল মানুষ। কিন্তু এই মহাশক্তিধর অশুভ এ.আই আবার ফিরে আবার চেষ্টা করছে না তো? আমেরিকা-রাশিয়ার মহাকাশ অভিযানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি?
গত দুদিন ধরে ধীরে ধীরে পড়ে শেষ করলাম নাবিল মুহতাসিমের লেখা এই বিভং বইটি। লেখকের লেখা 'শ্বাপদ সনে' পড়ে এতোটা ভালো লেগেছিল যে এই বইটা তারপর কিছু না ভেবেই কিনে ফেলি। যাক কিনে যে খুব একটা ভুল করিনি তা বুঝতেই পারছি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রূপুর মতো আমিও রাতের তারা ভরা আকাশ দেখে কতবার ভেবেছি যে ইশশ্ যদি মহাকাশে যেতে পারতাম, সেখানে গিয়ে দেখতে পারতাম সেখান থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখায়, এছাড়া আরও অনেক ইচ্ছেই করতো। কিন্তু বাস্তবের দুনিয়ায় সেগুলো সম্ভব হয়নি। নিজের চোখ দিয়ে দেখতে পারিনি সেসব। তবে লেখক রূপুর চোখ দিয়ে সমস্তটা দেখিয়েছেন আমাদের। রকেটে ওঠার আগে কি কি প্রোটোকল মানতে হয়, রকেটে তাদের জীবন কীভাবে কাটে, তারা কীভাবে থাকে, কীভাবে খাওয়া দাওয়া করে, কীভাবে ঘুমায়, দরকারী সমস্ত জিনিস কীভাবে কীকরে রাখে, একদম রকেট লঞ্চ থেকে শুরু করে স্পেস স্টেশনের সমস্ত কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন খুব সুন্দরভাবে।
বইটাকে আমি কোনোভাবেই একদম সহজ সরল বলবো না। অবশ্যই বইটা কিছু ক্ষেত্রে একটু জটিল ঠেকেছে, আর তারজন্যই সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম দিকে পড়তে গিয়ে মনোযোগের অভাব ঘটছিল যথেষ্ট, কিন্তু বইয়ের কাহিনী যতো এগিয়েছে বিষয়গুলো ততো সহজ হওয়ার ফলে ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করে। আরেকটা বিষয়, বইয়ের কিছু পাতার পরপরই কবিতার লাইনগুলো রয়েছে, প্রথমদিকে ভালোই লাগছিল, কিন্তু পরের দিকে পড়ার ফ্লো নষ্ট করছিল কেবল। আমার মতে অতো কবিতা হয়তো না থাকলেও চলতো। তবে হ্যাঁ এসবের পরেও বলবো লেখকের লেখনশৈলী যথেষ্ট ভালো। কাহিনীর বিষয়বস্তু সাজানো থেকে শুরু করে সেটাকে শেষ অবধি বজায় রেখে শেষের চমৎকার টুইস্টটার সাথে কাহিনী শেষ করা, এখানেই লেখকের অসাধারণ লেখনশৈলীর পরিচয়।
শেষে এটাই বলবো কাহিনী যে বিষয়ের ওপর ছিল তার সাথে পুরোপুরি ন্যায় বিচার করেছে। তবে যাত্রা দীর্ঘ হওয়ায় ধৈর্য্য ধরে পড়তে হয়েছে যা। যারা সায়েন্স ফিকশন ভালোবাসেন তাদের এই বই অবশ্যই ভালো লাগবে। তাই পাঠকদের বলবো একবার পড়ে দেখতে। আশাহত হবেন না আশা করি। পাঠে থাকুন।
সবশেষে যে কবিতার অংশটা সবথেকে বেশ�� ভালো লেগেছে সেটা হলো; "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।" ~জীবনানন্দ দাস
📝 গল্প-সংক্ষেপ : ভেবে দেখুন... বাংলাদেশের প্রথম অ্যাস্ট্রোনট আপনি, একজন অ্যাস্ট্রোনট হওয়া আপনার সারাজীবনের স্বপ্ন । সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে আপনার জ্ঞান ফিরলো অজানা এক স্থানে, যেখানে আপনার পাশেই রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে মুখমণ্ডল থ্যাঁতলানো একটা লাশ । রক্তে মাখামাখি হয়ে আছেন আপনি নিজেও । তবে কি খুনটা আপনিই করেছেন ? নাকি একটা খুনের দায়ে ফাঁসানো হচ্ছে আপনাকে ? স্পেস স্টেশনে যাওয়ার বদলে হয়তো যেতে হবে জেলে । জ্ঞান হারানোর আগের কথা কিছুই মনে নেই আপনার । এখন কি করবেন আপনি ?
▪️নির্দিষ্ট দিনে সমস্ত ঝামেলা এড়িয়ে বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে রাশিয়ান ‘সয়ুজ’ স্পেসশিপে চড়ে বসলো রুপু (ওরফে রূপম কাজি)। ওদের তিনজনের এই ছোট অ্যাস্ট্রোনটের দলে আছে পাওলো নামের একজন ইতালিয়ান আর রব ফিংকেলস্টাইন নামের একজন আমেরিকান । এই ফিংকেলস্টাইনই ওদের কমান্ডার । কিন্তু স্পেস স্টেশনে পৌঁছে সে জানতে পারল - এখানেও শান্তি নেই । ওই আমেরিকান আর রাশিয়ান নভোচারিরা কি গোপন মিশন নিয়ে স্পেশে এসেছে সেটা বুঝে উঠতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে । পৃথিবীর দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান কোল্ড ওয়ারের সাথে কি স্পেস স্টেশনে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো কোনভাবে সম্পর্কিত ? তারা মহাকাশেই একে অন্যকে মারার জন্য উঠেপড়ে লাগবে কি ? নাকি অভিনব কোনো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে কি তারা ? তার ইতালিয়ান সহকর্মী পাওলো হঠাৎ উদ্ভট আচরণ শুরু করলো কেন ? মহাকাশ থেকে আসা কোনো রহস্যময় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কি ?
▪️এদিকে, বেশ কিছুদিন আগে মহাশক্তিধর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ‘রবি’কে ডিস্যাবল করে দেওয়া হয়েছিল বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগে । একসময় পৃথিবীর মানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে পরিচিত এই ‘রবি’ আজ সবার কাছেই ভয়াবহ । সে আবার ফেরার চেষ্টা করছে না তো ? পৃথিবীব্যাপী তার সমর্থকরা কিসের আশায় বিশৃঙ্খলা চালাচ্ছে ? আমেরিকা ও রাশিয়া হয়তো এবার সত্যিই সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়বে, যার মূলে থাকবে ভয়ঙ্কর কিছু মারণাস্ত্র । কিন্তু এসবের সাথে বাংলাদেশী তরুণ অ্যাস্ট্রোনট রূপুর সম্পর্ক কি ?
📝 পাঠ-প্রতিক্রিয়া : ‘নাবিল মুহতাসিম’ আমার ভীষণ পছন্দের একজন লেখক, তার লেখা উপন্যাস ‘শ্বাপদ সনে’ এবং গল্প সংকলন ‘জিয়নবিদ্যা’ আমার ভীষণ প্রিয় দুটি বই । কারণ, এই লেখকের লেখার ভীষণ স্বতন্ত্র একটা স্টাইল আছে । পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে – লেখক যেন আপনার মুখোমুখি বসে আপনাকে ধীরে ধীরে কোনো ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাচ্ছেন । আর ঠিক এই বিষয়টিই রীতিমতো উপভোগ করবেন আপনি ।
▪️বইয়ের শুরুতেই লেখক স্বীকার করেছেন যে - জ্যোতির্বিদ্যা তার কতটা পছন্দের একটা বিষয় । আর সেই পছন্দের বিষয় নিয়ে লেখা উপন্যাসটি কেবলমাত্র একটি সাদামাটা সায়েন্স ফিকশন থ্রিলারে আবদ্ধ না রেখে, ভীষণ তথ্যবহুল একটি বইয়ে রূপান্তরিত করেছেন তিনি । শুধু সায়েন্স ফিকশন নয়... এতে আছে খুন, ষড়যন্ত্র, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কন্সপিরেশি থিওরি থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য ।
▪️মহাকাশে যাওয়ার আগে একজন অ্যাস্ট্রোনটকে মহাকাশের প্রতিকূল পরিবেশ টিকে থাকার জন্য যে প্রশিক্ষণ নিতে হয় তা থেকে শুরু করে, ‘বাইকোনুর কসমোড্রোম’ থেকে ‘সয়ুজ’ কীভাবে উৎক্ষেপিত হয়, সেই বর্ণনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছানো অবধি সয়ুজের অবস্থান – সমস্তটাই লেখক বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন । পড়তে পড়তে ‘আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন’ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাবে পাঠক । এই উপরিউক্ত বর্ণনাগুলি পড়ার সময় পাঠকের মনে হতেই পারে যে, লেখক অ্যাস্ট্রোনট হিসেবে বছরখানেক মহাকাশে কাটিয়ে এসেছেন ।
▪️গল্পের চরিত্রের সংখ্যা ভীষণ সীমিত, তাই ঘটনাপ্রবাহও তুলনামূলক কম । তবে গোটা উপন্যাস জুড়ে প্রচুর পরিমাণে সাহিত্য এবং গানের ‘পপ কালচার’ রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে । কিন্তু এমন নয় যে লেখক এইসব রেফারেন্স অপ্রাসঙ্গিকভাবে দিয়ে বিনোদনের চেষ্টা করেছেন, বরং গল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে এইসব রেফারেন্স । পাঠক ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন - উপন্যাসেরর শিরোনামটিও একটি রেফারেন্স, যা গল্পের সাথে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক । তবে, এই এত রেফারেন্স নিয়েও একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হতেই পারে অনেক পাঠকের মনে । কারণ... লেখকের বর্ণনা লেখনীর মতোই স্মুথ হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিশদ বর্ণনা গল্পের গতি ভীষণভাবে কমিয়ে দেয় ।
📜 পড়তে পড়তেই গল্পের কিছু অংশ আন্দাজ করতে পারছিলাম, আর শেষে গিয়ে সেগুলো মিলেও গেছে । এই উপন্যাসে থ্রিল খুব বেশী নেই, তবে ‘সায়েন্স ফিকশন’ উপন্যাস হিসেবে বইটি যথাযথ ।
নাবিল মুহতাসিমের ভক্ত হই তাঁর লেখা শ্বাপদসনে পড়ে । এখন পর্যন্ত আমার কাছে সেটিই উনার লেখা সবচেয়ে চমৎকার বই। এরপর বাজি এবং বাজিকরও চমৎকার। সেই আশা করেই বিভং কেনা ২০১৯ বইমেলায় বের হবার সাথে সাথেই। প্রায় দেড় বছর ফেলে রাখবার পর তা পড়া এবং হতাশ হওয়া।
নাবিল সাহেবের লেখার হাত ঝরঝরে, পড়তে গিয়ে কোথাও আটকায় না। এই বইও ব্যতিক্রম নয়, আড়াইশ পৃষ্ঠা এক বসাতেই শেষ করা সম্ভব, আমার লেগেছে দুদিন। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হিসেবে প্লটও চমৎকার, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী প্রথম মানুষ হিসেবে রুপুর মহাকাশ যাত্রা নিয়ে কাহিনী।
তবে প্রথম খটকাটা লাগে পুরুষে, বইটি উত্তম পুরুষে লেখা, পুরোটাই "আমি"র সমাহার। আমার কাছে কেন যেন লেখকের এই উত্তম পুরুষ লেখার স্টাইলটা পছন্দ হয় নি। বই কম, ব্যক্তিগত ডায়েরী বেশি লেগেছে। আর সবার ব্যক্তিগত ডায়েরী পড়তে ভালো লাগার কথা না। এরপর আসে চরিত্রের নামকরণ। নামগুলো পড়ে কেমন খটকা লেগেছে আমার কাছে। মনে হয়েছে এর চেয়ে ভাল নামকরণ করা যেত। লেখক অন্যান্য দিকে জোর দিতে গিয়ে নাম নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়েছেন যেন! উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মহাকাশযাত্রার দলনেতার (কমান্ডার) কথা নামখানা। গোড়া আমেরিকান, নাসার কোন মিশনের কমান্ডার কারো নাম ফিংকেলস্টাইন মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। এছাড়া গল্পের সুর মাঝেমাঝেই কেটে গিয়েছে মনে হয়েছে, তা হোক ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা কিংবা মাত্রাতিরিক্ত রেফারেন্সের কারণেই। বইয়ে প্রচুর পরিমাণ রেফারেন্স আছে। বিটলসের গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রুমি কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা, লেখক বাদ দেন নি কাউকেই। লেখক হতে গেলে অনেক পড়তে হয় জানা ছিল, তবে কাউকে কোন গল্পের মাঝে সেই পঠিত পুস্তকের ছাপ এই স্কেলে রেখে যেতে দেখিনি আজ অব্দি। আর গুডরিডসের অনেকের রিভিউতেই দেখেছি গল্পের মেইন টুইস্টটা বেশ আগেই আঁচ করে ফেলতে। আমিও তাঁর ব্যতিক্রম নই, মোটামুটি অর্ধেকের কিছুটা পরেই টুইস্টটা আন্দাজ করা যায়। তবে আমার ধারণা, এটা শুধুমাত্র একটা বিশেষ চ্যাপ্টারের কারণে। এই মুহূর্তে বইটা হাতের কাছে না থাকায় পেজ বা চ্যাপ্টার নাম্বারটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। অন্য কোন মুদ্রণে সেই চ্যাপ্টারটা মুছে দিলে কিংবা অন্যভাবে লিখলেই বিষয়টা বদলে যাবে।
নেগেটিভ কথা বেশি বলে ফেললাম, বইটা এতটাও খারাপ না আসলে। সম্ভবত আগের তিনটে বই থেকে তৈরি হওয়া এক্সপেক্টেশন পূরণ না হওয়াতেই...... অথচ ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন, মহাকাশযাত্রার বিভিন্ন দিক বা নাসা নিয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই আছে এতে যা জানতে এবং বাংলা ভাষায় লিখতে লেখকের অনেক খাটাখাটনি করতে হয়েছে এবং সেজন্য অবশ্যই এপ্রিসিয়েশন প্রাপ্য তাঁর। স্পিডি লেখার কথা আগেই বলেছি। যদিও সম্পূর্ণ কাহিনী ভালো লাগেনি কিন্তু পড়তে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও আটকাতে হয় নি, মনে হয় নি - অর্ধেক পড়েই ফেলেছি, শেষ না করে উঠি কীভাবে? আর একদম শেষে এসে মনে হয়েছে বইটার সমাপ্তি টেনেছেন তিনি সুন্দরভাবে, আর সিক্যুয়েল বের করার ইচ্ছে নেই হয়ত! যা বর্তমান বাতিঘর প্রকাশনীর সাথে যায় না। বাতিঘর প্রকাশনী ক্রমেই চুইংগাম প্রকাশনীতে রূপ নিচ্ছে, বিনা কারণে জিনিসপত্র টেনে লম্বা করেন তারা!
সব মিলিয়ে লেখকের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখার প্রচেষ্টায় আমার ওভারঅল রেটিং ২.৫/৫। নাবিল মুহতাসিমের লেখার প্রতি অতীত মুগ্ধতার কারণেই ফ্লোরিং না করে সিলিং করা।
বেশ এক্সপেকটেশন নিয়েই পড়া শুরু করেছিলাম। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির অমিল ছিল, তবে সেটাকে গোণায় না ধরে দুয়েকটা কথা বলা যাক।
১। গল্পে রেফারেন্স আর রেফারেন্স.. রেফারেন্স আর রেফারেন্স। গান-কবিতা-সিনেমা সবকিছুই টেনে এনেছেন লেখক। এই ব্যাপারটা ভালই লাগে এমনিতে। তবে বইটায় একটু বেশিই ছিল। ২। পুরো বইটাই লাইট টোনে লেখা। তবে চরম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও রসিক আলাপচারিতার ঢং-টা ঠিক গ্রহণযোগ্য লাগছিল না। ৩। স্পেস-রিলেটেড প্রচুর ইনসাইডার ইনফো আছে, লেখকের পরিশ্রম ও জ্ঞানের মাত্রা প্রশংসনীয়। ৪। বইয়ের আনুমানিক ৬৫% এ এসে অনুমান করতে পারছিলাম কী হতে যাচ্ছে। তবে সেটা পড়ায় ব্যাঘাত ঘটায়নি। ৫। প্রথম পুরুষে লেখা বইটায় রূপুর চরিত্র ছাড়া অন্য কেউ তেমন ফোকাস পায়নি। ৬। সাই-ফাই জনরা এমনিতে তেমন পছন্দ না আমার। তবে দেশী রাইটার বলেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম। সময়টা খারাপ গেছে- বলার সুযোগ নেই মোটেও। ভবিষ্যতে আরও লেখা পাবার প্রত্যাশা করছি।
আমার পড়া প্রথম outer space নিয়ে সাইন্স ফিক্শন। বইটিকে ভালো লাগার কয়েকটি কারণ
১. Anxiety নিয়ে যে symptoms গুলো লেখক দেখিয়েছেন সেগুলো একেবারে বাস্তব। আমার নিজেরও anxiety, panic attack হয়। তাই আমি relate করতে পেরেছি।
২. Launch থেকে শুরু করে স্পেস স্টেশনের খুটিনাটি বিবরণ বেশ ভালো লেগেছে।
৩. স্পেস স্টেশনের জীবন যাপন এর বর্ণনাও খুবই সহজসরল ভাবে লেখা।
৪. সাইন্স ফিক্শন আমার সেরকমই ভালো লাগে না। তবে এই বইটা পড়ে সত্যি আনন্দ পেয়েছি।
৫. আমি সবসময় বিশ্বাস করি থ্রিলার আরো বেশি সার্থক হয় যখন লেখক আসল ব্যাপারটা জানা সত্ত্বেও শুধুমাত্র লেখনী আর থ্রিল উপভোগ করার জন্য লেখাটি পড়ে। এখানে লেখক সেটা খুবই দক্ষভাবে সেটা করে দেখিয়েছে।
পরিশেষে এতো সাবলীলভাবে লেখার জন্য ধন্যবাদ। এর আগে আমি বাংলাদেশী লেখকের লেখা খুবই বেশি পড়িনি, শুধুমাত্র হুমায়ুন আহমেদ আর এক দুজন ছাড়া। তবে এবার থেকে পড়বো।
২.বিভং লেখকের সব বইয়ের মধ্যে এটি আমার সবচেয়ে সবচেয়ে সবচেয়ে পছন্দের।সাই-ফাই-থ্রিলার জনরার।কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বিধুশেখর নামক এক রোবট ও মহাকাশচারী রুপুকে ঘিরে,কাহিনীর পটভূমি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন।বইটা পড়া শেষ করার পর আমি প্রথম যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম তা হলো,এটা আমি আবার পড়বো,এবং মাঝে মাঝে খুলে খুলে পড়বো।if i had to describe it in one line it would be--this book is ahead of its time and someday it will get the appreciation it deserves (not my words,its his).বইয়ের ছোট্ট একটা গলদ আছে,যদিও সেটা শুধুই আমার চোখে ধরা পড়েছে,অন্যদের চোখে না পড়লে আমি আর না জানাই।
বইটা নিয়ে যদি আমি এক কথায় বলি তাহলে বলতে হবে মাস্টারপিস । অনেক জটিল বিষয় গুলো সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন লেখক । কোনো মনগড়া কথা স্থান পায়নি বইটিতে । সাইন্স ফিকশন আমি মোটামুটি এড়িয়ে চলি কারণ সেগুলি আমার মাথার উপর দিয়ে যায় ☹️ । আমার পছন্দের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হলো বই । আশা করি সময়টা দারুন যাবে বইটির সাথে ।
গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু উপহার দিয়েছেন লেখক। ধীরে সুস্থে পড়ুন, তাড়াহুড়োয় যাবেন না, তাহলে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতে পারবেন। প্রতিটা বাক্য,কবিতার লাইন..আর চমক সব কিছুই চমৎকৃত করবে সবাইকে নিঃসন্দেহে। 😊
বিভং বইটি একটি চমৎকার উপন্যাস, যেখানে মহাকাশ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগত অত্যন্ত জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। অসাধারণ লেখনশৈলীর কারণে যাদের এই বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ কম, তাদের কাছেও গল্পটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। বিশেষ করে উপন্যাসের শেষ দৃশ্যের চিত্রায়ন ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।