ওয়াসি আহমেদের গল্প এক বহুস্বরিক ভুবন। সময়, সমাজ, প্রতিষ্ঠান যেমন তাঁর গল্পে বড় জায়গা জুড়ে থাকে, তেমনি ব্যক্তিমানুষের জগৎকেও আঁশে আঁশে ছেনে দেখার কারুকর্ম তাঁর গল্পে যোগ করে সেই ব্যাপ্তি ও গভীরতা যা মগ্ন পাঠকের জন্য হয়ে ওঠে স্মরণীয় পাঠঅভিজ্ঞতা।
ওয়াসি আহমেদের জন্ম ১৯৫৪ সালে, সিলেট শহরের নাইওরপুলে। স্কুলের পাঠ বৃহত্তর সিলেটের নানা জায়গায়। পরবর্তী শিক্ষাজীবন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু। ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘শবযাত্রী স্বজন’। কথাসাহিত্যে, বিশেষত গল্পে, মনোনিবেশ আশির দশকে। প্রথম গল্প সংকলন ‘ছায়াদণ্ডি ও অন্যান্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। পুস্তকাকারে প্রথম উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়’ প্রকাশ পায় ২০০০ সালে। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনসহ কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নানা অঙ্গনে। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ দেশের প্রায় সব প্রধান সাহিত্য পুরস্কার।
শিশিযাপন!!কেমন অদ্ভুত নাম না? শিশিতে বিষ থাকে। লোকজন নানান সমস্যায় জর্জরিত থাকলে কাঁদে,ঝগড়াঝাঁটি করে,রাগ দেখায় আর চকমধুরা গ্রামের মানুষ খায় শিশি!! খাওয়া,ঘুমের মতোই সহজ ব্যাপার বলে চকমধুরার সবাই এটা মেনে নিয়েছে। এ আবার হয় নাকি? শুনতে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে না? লেখক সরাসরি প্রায় কিছুই বলেন না, তিনি যা বলছেন না বা যে কথা বলছেন তার বিপরীত অর্থ ধরে নিয়ে আমরা খুঁজে নেই আমাদের বাস্তবতা।
গল্পে রাস্তাঘাট এতো বেশি মসৃণ যে গাড়ি পিছলে দুর্ঘটনা ঘটবে,"জ্বিন ভূত" মানুষকে তুলে নিয়ে যাবে; তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সাধারণ মানুষের পকেটে ইয়াবা ভরে দিয়ে দুই পুলিশ তুলে নিয়ে গেলেও কেউ নির্বিকার গলায় বলবে, "বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে পোশাক কিনছেন, এই টেকা উঠাইতে খাটনি তো করা লাগবই।", বাচ্চারা খেলবে গুম গুম খেলা।আর সবই ঘটে যাবে নির্বিবাদে।আমরা সবই মেনে নেবো বিনাপ্রশ্নে। আমাদের জীবনযাপন হয়ে উঠবে "শিশিযাপন।" বইতে ওয়াসি আহমেদের স্বভাবসুলভ ঠাণ্ডা, নিচু কিন্তু তীক্ষ্ণ ভঙ্গিমায় লেখা নতুন খেলা,জিন ও জিনগিরি সমাচার,অন্তরঙ্গ দূরত্ব,সহচর যেমন হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দ্যায়,তেমনি তার স্বভাববিরুদ্ধ কৌতুকী ক্রোধে লেখা শিশিযাপন, মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা,হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই গল্পগুলোও পাঠককে নিয়ে যায় এক বহুস্বরিক ভুবনে।
(দুইটা কথা না বললেই নয়। ১.সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদটা দারুণ সুন্দর। ২.অন্যান্য প্রকাশকরা যেখানে তিন/চার ফর্মার বইয়ের দাম অবলীলায় ২০০ টাকা রাখেন, সেখানে কথাপ্রকাশের কর্ণধার আট ফর্মার বইয়ের দাম রেখেছেন ২০০ টাকা!মোটামুটি অবিশ্বাস্যই বটে।)
❝শিশিযাপন❞ বইটি বর্তমান সময়ের নানা ঘটনার আলোকে লেখা চমৎকার একটি সমকালীন ঘরানার ছোটগল্প সংকলন। বইয়ের প্রায় সব গল্পই ভালো লেগেছে, তার ভেতরে ❝মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা❞, ❝কার্নিভাল❞ এবং টাইটেল স্টোরি ❝শিশিযাপন❞ সবথেকে ভালো লাগলো। সমকালীন ধারার ছোটগল্প যারা পড়ে থাকেন তাদের সবার কাছেই বইটা রিকমেন্ড করা থাকলো।
তেরোটি গল্পের সংকলন 'শিশিযাপন'। বইয়ের নামগল্প 'শিশিযাপন' অনবদ্য একটা ছোটগল্প হিসেবে বেঁচে থাকবে বাংলাসাহিত্যে। অন্যান্য গল্পগুলোও অনন্যসাধারণ।
"দারোগা-পুলিশ এ অবস্থায় কী করবে! খুনাখুনি না, বড় অসুখ-বিসুখ না, তারপরও লোক মরে, কোনো মাসে চার-পাঁচজন, বছরে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন।
লোকজন হা-হুতাশ করে না, কেউ কাউকে দোষ দেয় না। যা বলতে চায়— বড় কষ্টে ছিল, বড় দাগা পেয়েছিল, বাঁচার এমন কষ্ট সহ্য করা যায় না, নিজের পথ নিজে করে নিয়েছে।"
প্রথম গল্প অর্থাৎ নাম গল্পটা সবার পড়া উচিত। মাইন্ডব্লয়িং।
ওয়াসি আহমেদের গল্প এর আগে পড়িনি। পড়ে শেষ করলাম তাঁর 'শিশিযাপন'। এক ডজনের বেশি গল্প ছিল আট ফর্মার বইটিতে। তারমানে গল্পগুলো আকারে ছোট। সাবলীল ভাষা। পড়তে আরাম। গল্পগুলো পড়তে পড়তেই তাঁর অন্য গল্পগ্রন্থগুলোর তালিকা গুডরীডসে ঘেঁটে দেখা হয়ে যায়। এগুলোর দুয়েকটা 'পড়তে চাই' তালিকায় যুক্ত হয়।
গল্পগুলো কেমন? একটা গল্পগ্রন্থে যেমন হয়। কিছু গল্প বেশ, কিছু একেবারেই মাঝারি আর কিছু হল যথারীতি গেটিস।
সেলফ সেন্সরশিপের এই মহামারির আমলে 'নতুন খেলা' গল্পে বাচ্চাদের সাথে লুকোচুরি অমন খেলতে খেলতে হঠাৎ গুম হয়ে পড়া এবং তা থেকে মুক্তির পরেও নিজে থেকেই পুরো বিষয়টা গোপন রাখার সঙ্কল্প দেখে আমাদের যথারীতি মনে পড়ে যায় পৃথিবীর সেই দেশটির কথা যেদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় গুম বিষয়টিকে। সেই একই দেশের কথা মনে পড়ে 'জিন ও জিনগিরি সমাচার' গল্প পড়ে। কেননা জিন কর্তৃক অপহৃত হওয়ার পরে জিনের আয়নাঘর থেকে যারা ভাগ্যক্রমে ফিরে আসে তারা একইরকমভাবে জিনের দেওয়া কালো পাথর হাতে নিয়ে আনমনে ঘোরে ফেরে,ফাঁক পেলে নিরিবিলিতে মুঠি খুলে দেখে।
এভাবে অন্য গল্পগুলোর কোন কোনটাতেও দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ আর জীবনের রহস্যমাখা নানারকম প্রজেকশন এসে পড়ে। 'শিশিযাপন', 'মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা' এবং 'অন্তরঙ্গ দূরত্ব' গল্পগুলো ভালো লেগে যায়।
ওয়াসি আহমেদের লেখনী ক্রমাগত মুগ্ধ করে যাচ্ছে আমায়। তার গল্পে সবসময়ই বিদ্যমান থাকে সাম্প্রতিক জিনিস তবে সেগুলো বলেন কিছুটা ভিন্ন আঙিকে। খুব সহজেই বুঝে নেয়া যায় কী নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। এই গল্পগ্রন্থটা আরও পাঠকের নজরে আসা উচিত।
জ্যেষ্ঠ বাতাসের তোড়ে লেবুঝোপ থেকে আসা কচি লেবুর নরম সবুজ গন্ধে তখন মাতাল অবস্থা। গগনে গরজে মেঘ। সাদা জামরুল ও পল্লবঘন আমবাগানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রার্থনায় অবারিত নৃত্যগীত। উঠানের শেষ প্রান্তে, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের কিনারায়, জামগাছের শরীর ঘেঁষা মাচায় বসে আমি তখন শিশিযাপনের শেষ গল্পপাঠে নিমগ্ন। যখন শেষ করে মলাট বন্ধ করলাম তখন নৈঋত্য কোণে আকাশ - ভূমির বিভেদ রেখা অবধি গ্রাম্য কিশোরীর অবাধ্য ঘনকালো কেশের মেঘাড়ম্বর। প্রবল ঝড়ো বাতাসের ঝাপটায় হঠাৎ মনে পড়ে জীবনানন্দের বলা, 'এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন'৷ তাই এমন পরিবেশে শিশিযাপন পাঠের অনুভূতি ভাবতে গেলে একটা মোহগ্রস্ত সময়ের পাড়ে দাঁড়াতে হয়।
ওয়াসি আহমেদের গল্পজগত অভূতপূর্ব। আমাদের চারপাশে অনায়াসে দৃষ্টিগোচর হওয়া কতশত বিশেষত্বহীন ঘটনা কিংবা বাস্তবতার নানা সংকটকে কেন্দ্রে রেখে কুণ্ডলী পাঁকায় ওয়াসি আহমেদের "শিশিযাপন" গল্পগ্রন্থের বহুস্বরিক ভুবন। তেরোটি গল্প৷ তেরোটি ভিন্ন ধাঁচের জগত। প্রতিটা গল্প-জগতের স্বকীয়তার জানান দেয় গল্পের শৈলী, বিষয় নির্বাচন, কাঠামোর বৈশিষ্ট্য, ভাব-চেতনা ও বৈচিত্র্যগত পার্থক্য।
নাম-গল্প 'শিশিযাপন' এর ১ম প্যারা পড়লে চমকে উঠতে হয় গল্পের বয়ান ভঙ্গিমার মোহে; যা সমভাবে আবিষ্ট করে রাখে বইয়ের অন্যসব গল্প। লেখক চরিত্রদের জীবনযাপনের অসঙ্গতিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে গভীর পর্যবেক্ষণ করে তাদের মনোজগতিক বলয়ের ভেতর ঢুকে পড়েন। তারপর অবাধ বিচরণ করে অন্তর্মুখী সব ভাবনা শব্দ-দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে থাকেন। তাই হয়ত গল্পগুলো একটানা পড়তে গেলে হেঁচকা টান লাগে, থমকে যেতে হয়। ধীর-লয়ে সময় নিয়ে একটা গল্পের রেশ কাটিয়ে অন্য গল্পে পদার্পণ করতে হয়। গল্পের বয়ান ও বিষয় — দুটোতেই ছোটগল্পে নতুনত্বের স্বচ্ছ আভাস চোখে আরাম দেয়। সংলাপের আধিক্য কম৷ বরং, গদ্য-নির্ভর লেখনীর কায়দা আধুনিক সাহিত্যে এখন বেশ তরতাজা লাগে।
গল্পগুলো নিয়ে আলাদা আলোচনা করব না৷ তবে, সমকালীন ছোটগল্পের বই পড়তে চাইলে রেকমেন্ড করা যায়। বইয়ের প্রিয় কিছু গল্প হলো শিশিযাপন, মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা, নতুন খেলা, মিরাজ মণ্ডলের ইহকাল৷ অভিভূত হলাম!
জিন ও জিনগিরি সমাচার/ হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই —গল্প দুটোয় জাদুবাস্তবতার শীতল আবেশ মজ্জা স্পর্শ করে৷ বইয়ের সবচে প্রিয় দুটো গল্প, প্রশ্নাতীত।
বহু বছর আগে আমাদের কবিগুরু ছোটগল্প সম্পর্কে কয়েকটি লাইন বলে গিয়েছিলেন। সেই সামান্য কয়েকটি লাইন দিয়ে তিনি ছোট গল্পের খুব সুন্দর যে ব্যাখ্যা আমাদের দিয়েছেন, তা এখনো আমাদের মাঝে প্রতীয়মান।
"ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা- নিতান্তই সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি; তারি দু'চারিটি অশ্রুজল। নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘন ঘটা নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ, অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে- শেষ হইয়াও হইলো না শেষ..."
যদি বলি এই বইয়ের প্রতিটি গল্পও এই ব্যাখ্যার গুণে গুণান্বিত তাহলে হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে না। নানান গল্পের সংমিশ্রণে বইটি ভরে উঠেছে। মোট তেরোটি গল্পের সমাহারে শিশিযাপন। কিছু গল্প খুব চমৎকার, অনেকদিন মনে থাকার মতো। খোদ শিশিযাপন গল্পটির মোনসের প্রামাণিকের কথাই ধরা যাক। লেখক অর্থহীন এবং সংগ্রাম করে বাঁচতে না চাওয়া মানুষদের নিয়ে নিখাদ একটি গল্প ফেঁদেছেন। আবার অন্যদিকে মেহেরজানের পদ্মসুনা গল্পটিতে ফুঁটে উঠেছে মায়ের অনাদরে বেড়ে ওঠা পদ্মকে নিয়ে। পুলিশ আমাদের রক্ষক হলেও মাঝে মাঝে ভক্ষক হয়ে ওঠেন অনেকসময়। এই রক্ষকের ভক্ষক হওয়ার পিছনের একটি কারণ লেখক অনায়সে সালাম মিরধার নামক ব্যাক্তিকে দিয়ে বলিয়েছেন কার্নিভাল নামের গল্পে। মিরাজ মণ্ডলের ইহকাল গল্পটি খুব ভালো লেগেছে। অন্যরকম একটা গল্প। পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন। ঠিক সেইভাবে চমৎকার বাকি গল্পগুলোও। এর মধ্যে মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা, অন্তরঙ্গ দূরত্ব, সহচর এবং হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই নামক গল্পগুলোর কথা আলাদা ভাবে না বললেই নয়।
লেখক ওয়াসি আহমেদের সাথে পরিচয় বরফকল উপন্যাসটি। এই বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধ লাগা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন শিশিযাপন বইতে। কিছু চমৎকার গল্পের সমন্বয় গড়া বইটি বেশ ভালো লেগেছে।
" বাস্তবে আয়নায় দাঁড়িয়ে আমরা যা দেখি তা আয়না আমাদের যেটুকু দেখায়। একটা গল্প আয়নার অতিরিক্ত অনেক কিছু দেখায়। গল্পের কাছে সেই অতিরিক্তটুকু চাই " - ওয়াসি আহমেদ
ছোট গল্পের কাছে ওয়াসি আহমেদ এর চাওয়াটুকু পুরোপুরিভাবে সার্থক। আর সেই প্রতিফলন পাওয়া যায় তার শিশিযাপন গল্প গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে। হ্যাঁ, প্রতিটি স্বতন্ত্র গল্পই একেকটি আয়নার পেছনের গল্প বলে।
ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থেকে খেয়াল করেছি, যদি কোন গল্পগ্রন্থে ১০ টা গল্প থাকে তার ভেতর ৭/৮ টা গল্প পছন্দ হয়। ২/১ টা থাকে, যেটা আমার পছন্দ হয় না। কিন্তু শিশিযাপন সম্পূর্ন উল্টোরথ দেখিয়েছে। প্রতিটি গল্পই অসামান্য, প্রতিটি গল্প আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে। বিষয়বস্তু সিলেক্ট করতে, ওয়াসি আহমেদ আমাদের চারপাশে চোখ বুলিয়েছেন। প্রতিটি কাহিনি আমাদের পরিচিত, কিন্তু গল্পের মোড় এমন দিকে নিয়ে যায় যে সেই আয়নার অতিরিক্তটুকু আমাদের দেখিয়েছেন ওয়াসি আহমেদ।
" শিশিযাপন, কার্নিভ্যাল, মিরাজ মণ্ডলের ইহকাল, অন্তরঙ্গ দূরত্ব, হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই " এই গল্পগুলি সবচে ভাল লেগেছে।
'২২ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছে কথা প্রকাশ থেকে। কথা প্রকাশ এবার দারুন দারুন কিছু বই প্রকাশ করেছে, এদের ভেতর শিশিযাপন নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে আছে।
বইয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল "অদ্ভুত সব গল্পের সংকলন"। ওয়াসি আহমেদ সাহেব অদ্ভুত সব গল্পগুলোকেই এক মলাটে টেনে এনেছেন। এখানে একটা গ্রামের সকল মানুষ সুইসাইডাল যারা পান থেকে চুন খসতেই বিষ খায়, কিংবা এখানে বাচ্চারা মহাপরাক্রমশালীর মতন গুম গুম খেলা খেলে কিংবা একটা রাস্তায় যেখানে খালি এক্সিডেন্ট হয় তা মানুষ হিসাব করে কিন্তু রাস্তা মেরামতে কাউকে আগ্রহী দেখা যায় না। সবচেয়ে ভাল লেগেছে "মিরাজ মন্ডলের ইহকাল" গল্পে মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পর টাকার প্রতি লিপ্সা কিংবা স্ত্রীর প্রতি ক্রোধ কিংবা নিজের আহাম্মক ভাইয়ের জন্য হতাশা অনুভব করছে। মৃতরা মৃত্যুর পর জাগতিক সকল অনুভূতির উর্ধ্বে চলে যান তা আমরা বরাবরই জেনে এসেছি। এমন কি হতে পারে তারাও হয়ত খাটিয়ার পাশে মানুষ কাজকর্ম অনুভব করতে পারছে। সবগুলো গল্পই ইন্টারেস্টিং এবং মজার।
ওয়াসি আহমেদের সাথে আমার পরিচয় ঈদসংখ্যার মারফতে। গল্প লিখায় উনার জুড়ি নেই। উনার কোন উপন্যাস পড়া হয়নি, পরবর্তীতে উপন্যাস পড়ার পালা।
শুরু, শেষ, আর মাঝের দুটো গল্প ভালো লেগেছে। শিশিযাপন এক বসায় শেষ করার মতো বই না। অনেকবার বিরতি নিয়ে পড়তে হয়েছে। ব্যাক্তিগতভাবে বার বার বিরতি নিতে হয় এমন বই আমার খুবই অপছন্দ। তাই হয়তো এতটা ভালো লাগেনি। অনেক সময় নিয়ে পড়লে হয়তো কেউ কেউ আরো বেশি উপভোগ করতে পারবেন।
'ফাঁস দিয়ে বা গলায় কলসি বেঁধে পুকুরে ডুবে মরার কায়টাদা কঠিন বলে সে পথে তেমন কেউ যায় না। ফাঁস দেওয়া আসলেই কঠিন, জোগাড়যন্ত্র লাগে। পুরুষ হোক মেয়ে হোক, শাড়ি বা দড়ির দরকার পড়ে। সেই শাড়ি বা দড়ি জুতমতো ঘরের বাতায় বা গাছে বেঁধে ঝোলাঝুলিতে ম্যালা ঝামেলা। শিশি সেদিক দিয়ে সুবিধার।'
বলা হচ্ছে অদ্ভুত এক গ্রামের কথা। যেখানে শিশিবোতলে বিষ বিক্রি হয়। লোকেদের এদিকের পানি ওদিক গড়ালেই শিশি কিনে খায়। এমন সব গল্প দিয়ে মলাট পুরেছেন গল্পকার ওয়াসি আহমেদ। গল্পটির নাম শিশিযাপন। এবং এ গল্পের নামেই বইটি।
বইয়ে গল্প আছে তেরোটি। গল্পগুলির নাম সুন্দর। বেশি সুন্দর লেখকের লেখনশৈলী। সংলাপে সুন্দর শব্দের ব্যবহার ছিল। আমার লাগছিল শব্দগুলি সব মুখস্থ করে ফেলি। কিছু শব্দ খাতায়ও টুকেছি।
'শিশিযাপন' গল্পের মতন অন্যান্য গল্পগুলিও সাধারণ মানুষের গল্প বলছে। কৃষক, পতিতা, বাচ্চাশিশুর অনুভূতি বলে যাওয়া হয়েছে। আমাদের চারপাশে থাকা মানুষেরই জীবনগল্প। আমরা চোখ বুলালেই দেখতে পাই।
লেখককে প্রথম পড়লাম। এ বছর সমকালীন গল্পকারদের লেখা চেখে দেখেছি। এত সুন্দর এত সুন্দর যে, ওপারের লেখকদের লেখনী থেকে মন উঠে গেছে। এসব ক্লাসিক জনরার বই অন্যরকম স্বাদ দেয়। সাহিত্য অনুভব করতে জানলে এ লেখা টানবে।
চৈত্রের বিকেলে গমগম করা গরমের শেষে একধরনের যে ঠান্ডা হাওয়া বয় এই বই পড়তে গিয়ে একদম সেই সময়টা অনুভব করেছি। তবে আমার দুর্ভাগ্য এই যে, এটাই ছিলো ওয়াসি আহমেদের লেখা আমার প্রথম পড়া কোনো বই।
গল্পের কথায় আসি, ছোট গল্প পড়তে বরাবরই ভালোলাগে। এবার ও তার ব্যাতিক্রম নয়। লেখক ঠান্ডা মাথায় বেশ কৌশলে গল্প লেখেন। কিছু গল্প শেষে ধাঁধার মত উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। শিশিযাপন, মেহেরজানের পদ্মসুনা, জিন ও জিনগিরি সমাচার, অন্তরঙ্গ দূরত্ব, হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই। এই গল্পগুলো বেশি ভালো লেগেছে।
গ্যাপ রেখে রেখে পড়ার কারণে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছি না তেমন। তবে ছোট গল্প ভালোলাগলে অবশ্যই পড়বেন।
জীবনের গল্প গুলো বয়ে চলে ধীরে, বহতা নদীর মতো। আবার সময়ের সাথে থমকে যায় অনেক কিছু। হয়ত যা হবার নয় সেটাই হয়ে যায় আবার যেটা করার নয় সেটাও করা হয়। জীবনের চক্র মানুষের আবদ্ধতা সেই সৃষ্টির শুরু থেকে; এর বাইরে কেউ যেতে পারে না। সময় ও জীবন চক্র একে অন্যের পরিপূরক। . ছোট ছোট গল্পের কি দারূণ সমন্বয়। যেন জীবনের গল্পের নয় বাস্তবতার সাথে মিল স্বপ্নের এক সম্পর্ক ঘটিয়েছেন লেখক। যেখানে লেখক বেশ সুন্দর ভাবে তুলে এনেছেন মানুষের চিন্তাধারা কে। কিভাবে কখন ও কি হবে সেটা মানুষ যেন আগে থেকে চিন্তা করতে পারে না, আবার ভাবনারা বাক নেয় সময়ের সাথে সাথে। এটাই যেন শিশিযাপনের মুল কথা।
ওয়াসি আহমেদের লেখনশৈলী দারুণ। গল্প বলার স্টাইলে নিজস্ব ধারাটা চোখে পড়ে, ভালো লাগে পড়তে। তবে কিছু কিছু গল্পে মনে হয়েছে একটা চলন্ত ট্রেনকে তিনি মাঝপথে ফেলে রেখে চালকের আসন থেকে নেমে গিয়েছেন। মেটাফোরিক উপস্থাপন বেশ দারুণ। গল্পগুলো পড়ে ভাবতে হয়েছে, নিজস্ব চেনা-জানা জগতের সাথে রূপক অর্থগুলো মেলাতে হয়েছে। অনেকের হয়তো এটা ভালো লাগে না, তবে আমার কাছে ভালো লেগেছে।