ঊনবিংশ শতকের কলিকাতা কালচার বুঝতে এই বইয়ের চাইতে বড় রেফারেন্স আর যেথায় ই থাকুক বাঙলা সাহিত্যে নাই।শুধু কী ঊনবিংশ শতকের কালচার; অর্থনীতি, হিন্দু-মুসলমান সামাজিক অবস্থানে মর্যাদাবোধ, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থের গুণাগুণ ইত্যাদি
শুধু কলিকাতা নয় পুরো বঙ্গের 'এলিট' ক্লাসের মনস্তত্ত্বের পরিমাপক এই উপন্যাস।
হ্যা, প্রথাগত উপন্যাস কাঠামোর সার্থকতার মানদণ্ডে দাঁড় করালে " আলালের ঘরের দুলাল " হয়তো মোটামুটি উতরে যাবে। অনেকের কাছে এটি পুরোপুরি উপন্যাস মনে হবে না। মনে হতে পারে কিছু লোকের কার্যকলাপের ফিরিস্তিমাত্র। তবুও কিছু একটা আছে প্যাঁরীচাঁদ মিত্রের কলমে যা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় উপন্যাসের সামনের দিকে।
“… ছেলে না হবার এক জ্বালা – হবার শতেক জ্বালা – যদি ছেলের একটু রোগ হল, তো মার প্রাণ অমনি উড়ে গেল। ছেলে কিসে ভাল হবে এজন্য মা শরীর একেবারে ঢেলে দেয়– তখন খাওয়া বল– শোয়া বল, সব ঘুরে যায়। দিনকে দিন জ্ঞান হয় না, রাতকে রাত জ্ঞান হয় না। এত দুঃখের ছেলে বড় হয়ে যদি সুসন্তান হয় তবেই সব সার্থক – তা না হলে মার জীয়ন্তে মৃত্যু – সংসারে কিছুই ভাল লাগে না – পাড়াপড়সির কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না – বড় মুখটি ছোট হয়ে যায় আর মনে হয় যে পৃথিবী দোফাঁক হও আমি তোমার ভিতরে সেঁদুই। …”
▪️▪️▪️
উপন্যাসের নামেই বলে দেওয়া আছে, এক আদরের দুলালকে নিয়ে কাহিনি। ছোট থেকে প্রকৃত নীতিশিক্ষা ও ধর্মশিক্ষা না পেয়ে কেবল আদর পেলে সেই ছেলে কেমন বাঁদর হয়ে ওঠে– এটাই মতিলালের মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে। তবে এটাই শুধু উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু ছিল না। ইংরেজ শাসন, নীলকরদের অত্যাচার, একদল ঠকবাজ সবমিলিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় চিত্রই ফুটে উঠেছে।
মনে হয়েছিল, বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস খুবই খটোমটো হবে। কিন্তু নাহ; শব্দগুলো তো প্রায় পরিচিতই। সুখপাঠ্য না হলেও একেবারে খারাপ না।
বৈদ্যবাটীর বাবুরাম মশাই চারটি সন্তানের জনক। তিনি প্রচুর অর্থ উপায় করিয়াছিলেন। তবে লোক তাহার প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য তাহাকে মনে রাখিয়াছিলো এরকম কথা কেউ কহিতে পারিবে না। তেনাকে স্মরণ রাখিবার বিশেষ কারণ টি তাঁহার পুত্র মতিলাল। মতিলাল বাল্যকালেই পিতামাতার প্রশ্রয় পাইয়া বৃত্তাকারে ঘুরিতে আরম্ভ করে। এক পর্যায়ে তার ঘূর্ণনের গতি আশেপাশের মানুষের নিকট অসহনীয় হইয়া গেলে বাবুরাম তাহার এই কুলাঙ্গার পুত্রটিকে শিক্ষিত কুলাঙ্গার করিবার সিদ্ধান্ত লইলেন এবং দ্রুত ঘূর্ণনের স্থান টি পরিবর্তন করিলেন। শহরে আসিয়া মতিলালের আরো কয়েকটি সঙ্গি জুটিলো৷ এবারে ঘূর্ণন যাত্রায় উপযুক্ত সঙ্গী থাকিবার কারনে তা অধিক উপভোগ্য ও গতিময় হইলেও যাত্রাটি কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হইলো না। একদিন বাবুরাম সংবাদ পাইলেন তাহার পুত্রটি বৃত্তাকারে ঘুরিতে ঘুরিতে গতিপথ পাল্টাইয়া শ্রীঘরে গিয়া থামিয়াছে।
প্যারীচাঁদ মিত্র "টেকচাঁদ ঠাকুর" ছদ্মনামে "আলালের ঘরের দুলাল" উপন্যাস টি রচনা করেন।তৎকালীন সময়ের সাহিত্য ধারা থেকে এই উপন্যাস-টি স্বতন্ত্র গদ্যরীতিতে রচিত হয়।এটির ভাষা সেকালের কলকাতা অঞ্চলের জনসাধারণের দৈনন্দিন কথিত ভাষা।উপন্যাসে উনিশ শতকের ভাষা সম্বন্ধে যেমন একটা ধারণা পাওয়া তেমনি সেই যুগের আদালত এবং বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ ওয়াকিফ হওয়া যায়।
প্রেক্ষাপট: উনিশ শতকের কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজ এই কাহিনীর উপজীব্য।এই সময়ে হিন্দু মধ্যবিত্ত জাগরণের সাথে বিত্তবান এবং বিদ্যা যখন সমাজশাসনের অধিকার অর্জন করল তখন বিত্তের অধিকারের শুধুমাত্র উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত থাকল।ধনী ব্যবসায়ী বাবুরামবাবু তার পুত্রদ্বয় যথাক্রমে মতিলাল এবং রামলাল,ঠকচাচা,বরদাবাবু ইত্যাদি এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র।আবাল্য অতি আদুরে মতিলাল কখনও ধর্ম ও নীতির শিক্ষা না পেয়ে অবনতির শেষ ধাপে এসে নিজের চিত্তশুদ্ধি করে। "আলালের ঘরের দুলাল" বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসের স্বীকৃতি পেলেও একে সার্থক উপন্যাস বলা হয় না।বিক্ষিপ্ত প্লট,অবান্তর ঘটনায় আচ্ছন্ন মূল কাহিনী,নায়কের অপরিণত ভূমিকা ইত্যাদি ত্রুটি এতে লক্ষণীয়।তবুও বাংলা সাহিত্যের এটি অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।
আলালের ঘরে দুলাল। বাঙলায় এটি একটি প্রবাদ যার অর্থ বড়লোকের অতি আদুরে নষ্ট সন্তান। উপন্যাসের বিষয়বস্তুও তাই।
বাবুরাম বাবুর দুই ছেলে মতিলাল ও রামলাল। রামলাল যতটা ভদ্র, শিক্ষানুরাগী, আদব কায়দার মানুষ মতিলাল ঠিক তার বিপরীত৷ মতিলালই আলালের ঘরে দুলাল। যাকে অনেক চেষ্টা করেও পড়াশুনা করানো যায়নি৷ এলাকার মানুষ তার কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল তাকে অন্যত্র পাঠানো হয় শিক্ষার জন্য৷ কিন্তু সেখানে পড়াশুনা না করে উল্টো দল বানিয়ে এলাকার মানুষের উপর বৈরি আচরণ শুরু করে। ফলে পুলিশেও যেতে হয় তাকে। একসময় পিতা বাবুরাম মারা গেলে সে পরিবারের সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। ব্যবসা করে সব হারিয়ে তার জ্ঞান হয় যে আপন মানুষ ব্যতিত তার কেউ ভালো চায় না। তারপর একদিন এক জ্ঞানী বৃদ্ধের সাথে দেখা হলে তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভালো মানুষে পরিণত হয় মতিলাল। তার এক কৃত কর্মে সাহায্য করে ঠকচাচা হিসেবে পরিচিত এক চরিত্র৷ ঠকচাচা তার বাবার বন্ধু হিসেবে তাকে সব সময় কুমন্ত্রণাই দিয়ে যেতো। গল্পে বড়দা বাবু নামে আরো একটি চরিত্র পাওয়া যায় যে কিনা মানুষের ভালো চায়, ভালো বুদ্ধি দেয়, ভালো কাজ করে থাকে।
উনিশ শতকের কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজ আলালের ঘরে দুলালে'র কাহিনি পরিপ্রেক্ষিত। এই সমাজের একটি পরিবারের জীবনকথা উপন্যাসে শিল্পররূপ পেয়েছে৷ সেই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভাবেই চিত্রিত হয়েছে সেকালের কলকাতার জীবনযাত্রার বিচিত্র দিক; যেমন ব্যবসা বাণিজ্য, বিদ্যাশিক্ষা, বিচার-আচার ইত্যাদি। এমনকি নীল বিদ্রোহের বর্ণনাও পাওয়া যায়।
কিছু উক্তিঃ
এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে, বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক গৌরব হয় না।
সুপুরুষ আপন পত্নীকে অন্তঃকরণ সহিত ভালোবাসে কিন্তু স্ত্রীর সকল কথা শুনিতে গেলে পুরুষকে শাড়ি পরিয়া বাটীর ভিতর থাকা উচিত।
ছেলে না হবার এক জ্বালা- হবার শতেক জ্বালা। (মায়ের ছেলে হওয়া প্রসঙ্গে)
এক্ষণে টাকার যত মান তত মান বিদ্যারও নাই ধর্মেরও নাই।
স্ত্রীলোকদের স্নেহ ও সহিষ্ণুতা আশ্চর্য! বোধহয় পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোক এ বিষয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ।
ভোগবিলাসের আভিজাত্য আর হাস্যরসের ধারায় গড়া এক সমাজের ব্যঙ্গচিত্র প্রতিফলিত হয় প্রায় ঘরেই বা সমাজে, অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা তৈরি হয় মানুষের মাঝে যাকে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় বলে overindulgence syndrome.
নীতি, আদর্শ বর্জিত মানুষ সমাজে পরগাছার মতো যাকে সবাই উপরে ফেলতে চায়,তবে অনেক সময় উঁচু গাছের আশ্রয়ে থাকায় কেউ সেই আগাছাকে নির্মূল করতে পারে না।
সন্তান মানুষ করতে বাবা মা কে বদ্ধপরিকল্প হতে হয়। অতি আদরে যেমন সন্তান বখে যায় তেমনি অতি শাসনে পরিবারের সাথে সন্তানের সুতো ছিঁড়ে যায়। এমনি কিছু কাহিনি সংমিশ্রণে লিখা "আলালের ঘরের দুলাল" এটি কোনো কঠিন বা দুর্বোধ্য উপন্যাস নয়। এখানে ভালো ও মন্দ আদর্শের স্বরুপ তুলে ধরা হয়েছে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হলো মতিলাল, যার পিতা হলো বাবুরাম বাবু। তিনি সারাজীবন সবকিছুর আগে অর্থ ও খ্যাতিকে সামনে রেখে সেসবের পিছনে দৌড়েছেন।
একবার একজন শিক্ষক বলেছিলেন পুত্র অনেকটা পিতার ন্যায় গড়ে ওঠে, পিতা যদি মদ্যপ হয় তাহলে ছেলেকে মদ খাওয়া থেকে আটকানোর কঠোর প্রন্থা সে গ্রহন করতে পারে না,আর যদি পিতা নীতিবান হয় তবে সন্তানের মাঝে আপনা আপনি তার কিছুটা গুন দৃশ্যমান হয়।
এই উপন্যাসে ঠকচাচা চরিত্রের বেলায় মনে হচ্ছিল -"ঝুঠ বলে কাউয়া কাটে,কাউয়ে সে ডারিও" গানটা সত্যি হয়ে গেলেও পারতো,মিথ্যে গুলো তার বাহ্যিক আবরণেই প্রকাশ পেয়ে যেতো।
এই উপন্যাস কে অনেকে মানুষের চলমান জীবনের কাহিনি হিসেবেও মনে করে থাকেন।তবে প্যারীচাঁদ মিত্রের লিখায় কিছু তো একটা আছে যা পাঠকদের আটকে রাখে। piyus mishra র একটি কথা বলেছিলেন যে - "Sukoon milta hai do lafz kagaz par utar kar, Cheekh bhi lete hoon aur aawaz bhi nahi hoti"
মানুষ যা জনে জনে বলে বেড়াতে পারে না তা বলে কাগজের মাধ্যমে। বাবুরাম বাবু মতিলালের শিক্ষার দায়িত্ব অনেককে দেয় তবে সবাই ব্যর্থ হয়,কারণ মতিলাল ছিলো শিক্ষা বিমুখ ও অতি আদরে ননীর পুতুলে পরিণত এক আমড়া কাঠের ঢেঁকি। বাবুরামকে বেণীবাবু উপদেশ দেয় পুত্র কে শাসন করার, তবে বাবুরাম তখন সেসব আমলে নেয়নি। যার ফলে যতো খারাপ কাজ আছে সবি মতিলালের দ্বারা সম্পূর্ণ হয়েছে।
তাছাড়া লেখক এই উপন্যাসে সামাজিক সমস্যাকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। তৎকালীন কলকাতার সামাজিক অবস্থা,মানুষের জীবনযাত্রা এই উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টাকে এখানে বেশ বড়ো করেই দেখানো হয়েছে, টাকার বিনিময়ে সত্যকে মিথ্যা বানানোর যে প্রন্থা তাও লক্ষনীয়।তাছাড়া দেশে বিদেশি ভাষার চল অপ্রত্যক্ষভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলার প্রতি উদাসীনতাকে।
কোন বাঙালির লিখিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল। ১৮৫৭ সালে এটি বই আকারে বের হলেও মাসিক পত্রিকায় ১৮৫৪ সালেই প্রকাশিত হয়েছিলো। প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাঁদ ঠাকুরের লেখা এই বই। এর আগেই অবশ্য হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স ফুলমণি ও করুণার বিবরণ লিখেছেন (১৮৫২) তবে সেটি কোন বাঙালির লেখা নয়, তাছাড়া খৃষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে লিখিত এই উপন্যাস ছিলো একটি ইংরেজী গল্প/উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে, উপন্যাস হিসেবেও সেটিকে সফল বলা হয় না। প্যারীচাঁদ জীবনে একটিই উপন্যাস লিখেছিলেন, এটি দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে চির অমরত্ব লাভ করেছেন।প্রথম মানেই সর্বোৎকৃষ্ট হবে এমন নয়, সাহিত্য মানের বিচারে এই উপন্যাস হয়তো গড়পড়তা, কিন্তু ঐতিহাসিক মূল্য এর সুপ্রচুর।বইটা কিনে যখন বাসায় গেলাম বাবা বললেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে এর নাকি একটি প্রাচীন কপি ছিল, আমার বাবার দাদা মানে আমার প্রপিতামহের সংগ্রহ করা। একাত্তর সালে আরও অনেক কিছুর মতো সেই বইটিও নষ্ট হয়ে গেছে। সে যাই হোক, কালীপ্রসন্ন এর হুতুম পেঁচার নকশা পড়ে উনিশ শতকের কলকাতার জীবনযাত্রার একটা ধারণা পেয়েছিলাম, তাই আরেকটু বর্ধিত হলো এই বই পড়ে।বাঙালির নবজাগরনের শতক হলো উনিশ শতক। বিখ্যাত বাঙালিদের বেশিরভাগের জন্ম, বেড়ে ওঠাই ঐ শতকে। সেকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্য ছিলো বর্ধিষ্ণু, কলকাতা ছিলো তার কেন্দ্র, স্বাভাবিকভাবেই সেকালের বাঙালিরা অন্য অঞ্চলের মানুষের চেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছেন, সাফল্যও পেয়েছেন বেশি, তাই ঐ শতক নিয়ে আমার আগ্রহ চিরকালের, কিন্তু সেই সময়ের জীবনযাত্রা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বই কমই মেলে। পরবর্তী সময়ের লেখকেরা ঐ সময়কে উপজীব্য করে অনেক ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন, তবে সে হলো পরের মুখে ভাত খাওয়া, প্যারীচাঁদ খোদ সে সময়ের মানুষ, তার অভিজ্ঞতাটা প্রত্যক্ষ, তাই তার চরিত্রগুলো বেশি জীবন্ত, বিশ্বাসযোগ্য। সেকালের বাবু কালচারের একটা প্রতিচ্ছবি এই বই। সামান্য পরিশ্রমে বিপুল বৈভব এর মালিক হয়ে বাবুরা যে কি রকম বিলাস ব্যসনে লিপ্ত ছিলেন, মোসাহেব আর ঠক বাটপারদের কবলে পড়ে বাবুদের বাবুয়ানা যে বেশিদিন টিকতো না তাও তো বেশ বোঝা গেলো। অবশ্য সত্যের জয় আর মিথ্যার পরাজয় এই উপন্যাস এর মূল আদর্শ, গুটিকতক আদর্শবাদী বাংলা সিনেমার নায়ক টাইপের চরিত্রের আমদানিও করা হয়েছে, তবু সব হয়তো একেবারে কষ্ট কল্পনা নয়। কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজের দুরবস্থা, লোভী ধর্মব্যবসায়ী, বাটপার আইন ব্যবসায়ী, ঠক দালাল, আরামপ্রিয় অলস জমিদার, অবহেলিত নারী সমাজ, এমনকি অত্যাচারী নীলকর, মোটামুটি অনেক বিচিত্র চরিত্রই এসেছে এই উপন্যাসে। শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার কথাও এসেছে, এসেছে ধর্মে মতির সুউপদেশও।ভাষায় হয়তো সেকালের ছাপ আছে, আছে ফারসি ও আঞ্চলিক শব্দের বাহুল্যও। তবু বুঝতে তেমন সমস্যা হয় না, পড়তেও না। বাংলা সাহিত্যের এই মাইলফলকটা সব বাংলা সাহিত্যপ্রেমীরই বোধহয় পড়া উচিত, ইতিহাসের কানাগলিও কিঞ্চিৎ ঘোরা হয়ে যাবে সাথে।ভালো লেগেছে।
প্রথম জিনিসটার মধ্যে সবসময়ই একটা মাহাত্ম্য থাকে। উপরন্তু সেটি তাকেও মাহাত্ম্য দান করে যখন তা কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর আরোপিত হয়। যেমন - পরীক্ষায় প্রথম হওয়া। এটি যেমন সন্মানের, সেই সন্মানটি একইসাথে দেওয়া হয় যিনি প্রথম হন। এই উদাহরণে নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা যাবে প্যারীচাঁদ মিত্রের "আলালের ঘরে দুলাল" উপন্যাসটি। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। এবং এই কীর্তি স্থাপনের জন্য টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে লেখা প্যারীচাঁদ মিত্রও অমর হয়ে থাকবেন। সেই উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্য যখন সবে জন্মলাভ করল, তখন তা লেখা হত সংস্কৃতের আদলে। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (বাংলা গদ্যের জনক) তার লেখায় ব্যবহার করতেন প্রচুর সংস্কৃত শব্দ। তার ভাষাকে আদর্শ ধরে লেখা হত গদ্য। সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষার সাথে সম্পর্কহীন এই ভাষায় রচিত সাহিত্যের বিষয়াবলীও ছিল সীমিত। মূলত ইংরেজী, সংস্কৃত, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার সারসঙ্কলন বা অনুবাদই ছিল তখনকার গদ্য সাহিত্যের বিষয়বস্তু। কিন্তু আপামর জনসাধারণের ভাষা ও তাদের দৈনন্দিন জীবনকাহিনী নিয়েও যে গদ্য সাহিত্য রচনা করা সম্ভব সেই বিশ্বাসে সর্বপ্রথম আলো দেখান প্যারীচাঁদ মিত্র তার এই উপন্যাসের মাধ্যমে। তার এই ভাষা এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে এর নাম দেওয়া হল "আলালী ভাষ��"। উপন্যাসটির কাহিনী অতটা আহামরি না হলেও সেই গ্লানিতা ঘুচে গেছে বইটির এই অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে। হুমায়ুন আজাদের মতই বলা যায়, এটি আমাদের বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল দীপাবলি যার থেকে পরবর্তিতে আলোকবর্তিকা পেয়েছে এই সাহিত্যের আরও অসাধারণ সব কর্মী ও তাদের কর্ম।
This is one of the earliest novels in Bengali literature. It precedes Bankimchandra's 'Durgeshnandini'. The title literally means 'The Spoiled Brat' and the story follows the journey of such a character, among other aspects. The narrative is simple, a rich spoiled brat, looses everything and finally sees reason, makes amends. However the book also becomes a chronicle of Bengal (especially Kolkata) of the 19th century. This aspect interested me because I love texts which tell me how things were. It tells of the plight of women, married off at an early age to husbands with multiple marriages (in order to preserve the glory of their castes), often becoming widows, yet blaming their fate for it and not the system; the obnoxious 'babu' culture; the way life was carried on at that time etc. In addition, the author also has certain personal observations or aphorisms which are equally relevant to this day. The Bengali novel matured since 'Durgeshnandini', however this book has a different significance of it's own.
পুরনো কলকাতার সম্বন্ধে পড়তে বেশ ভাল লাগে। তখনকার জীবনযাত্রা কেমন ছিল, তখনকার সমাজ কেমন ছিল, এগুলো জানলে বোঝা যায় আমরা কতটা এগিয়েছি, বা এগোতে পারিনি (বা পিছিয়েছি?)। 'আলালের ঘরের দুলাল' - এ উনবিংশ শতাব্দীর দলিল পাওয়া যায়, যেখানে কলকাতা এবং অবিভক্ত বঙ্গের সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। তখনকার দিনের মেয়েদের দূর্দশা, অল্পবয়সে দোজবরের সঙ্গে বিয়ে(কূল রক্ষা করার জন্যে), অল্পবয়সে বৈধব্য ইত্যাদি, যার জন্য তারা সমাজকে দায়ী না করে নিজেদের ভাগ্যকেই দায়ী করে; কলকাতার ধ্বংসাত্বক 'বাবু' কালচার, তখনকার ধ্যানধারনা, সংস্কৃতি এসব অনেকিছুরই বর্ণনা আছে উপন্যাসে। এছাড়াও লেখকের কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধি আছে, যেগুলো এখনো বেশ প্রাসঙ্গিক। গল্পটা আদতে সোজাসাপটা, এক ধণী পরিবারের বখে যাওয়া ছেলে, সব হারিয়ে শেষ পর্যন্ত তার ভুল বুঝতে পেরে, নিজেকে সংশোধন করে। বাংলা উপন্যাস পরিপক্ক হয় বঙ্কিমচন্দ্রের 'দূর্গেশনন্দিনী'-র হাত ধরে(যা এর পরে লেখা হয়েছিল), তবে বাঙলা ভাষায় এই দ্বিতীয় উপন্যাসটির (সম্ভবত) একটা আলাদা গুরুত্ব থাকবেই।
কলকাতার সমকালীন সমাজ এর প্রধান বিষয়বস্তু। বৈদ্যবাটির উচ্চবিত্ত ঘরের আদুরে সন্তান মতিলালের উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচার এতে বর্ণিত হয়েছে। "সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ " - এই প্রবাদবাক্যের যথার্থ উদাহরণ মতিলাল। ‘ঠকচাচা’ এর অন্য একটি প্রধান চরিত্র। কথ্যভঙ্গির গদ্য ব্যবহার করে লেখক উপন্যাসকে বাস্তবধর্মী করে তুলেছেন।
"আলালের ঘরে দুলাল" বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হলেও এটি সার্থক উপন্যাস বলা হয় না। মূলত সেই কারণেই বইটা আগ্রহ নিয়ে পড়া প্রথম উপন্যাসই কেন সার্থক হইল না!? টেকচাঁদ ঠাকুর এর ছদ্ম নামে প্যারীচাঁদ মিত্রের রিচয়তা। সাধু, কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার গুরুচণ্ডালীতে হওয়ায় বিরক্ত লাগে। তবে চরিত্রের সমঝতা থাকলেও, প্লট ছিলো বিচ্ছিন্ন। তবুও বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে কথা মন্দ নয়।
কথায় আছে, ❛সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!❜ আমাদের আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তার ধরন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে আমরা কেমন লোকের সাথে মিশি তার উপর। পঁচা বস্তুর সংস্পর্শে ভালো বস্তুতেও পচন ধরে। আর একটা শিশুর শিক্ষা শুরু হয় তার জন্ম থেকে। আশেপাশের পরিবেশ যেমন সে বেড়েও ওঠে তেমন ভাবেই। শিশুরা নরম কাঁদামাটির ন্যায়। শৈশব থেকেই তাকে যে আদল দেওয়া হবে সেইরূপই ধারণ করবে সে। এতে পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমূল অবদান রাখে। বাবুরামবাবুর অঢেল সম্পত্তি। চার সন্তান এবং স্ত্রী নিয়ে পরিবার তার। গ্রামে তার নামডাক বেশ। অঢেল টাকা গড়েছেন তবে তার মধ্যে খেদও আছে। সৎপথে উপার্জন থেকে লাইনের বাইরের কর্মই বেশি। টাকার পিছে ছুটতে গিয়ে অন্দরের খবর হয়তো কমই রাখতেন। বড়োপুত্র মতিলাল বাপ মায়ের আদরে বাঁ দর হচ্ছিল। এহেন দুষ্কর্ম নেই যা মতিলাল তার দলবল নিয়ে করে না। বাবুরামের চেষ্টায় তাকে বিভিন্ন শিক্ষক দিয়ে অক্ষরজ্ঞান দিলেও মতির বেখায়ালিপনায় তার সিকিভাগও অর্জন হয়নি। পুত্রের এসকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত থাকার পরেও বাবুরাম যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে অপেক্ষা করে গেছেন ❛বয়স বাড়লে ব্যে থা করলে গতি আসবে❜ এই ভাবনায়। তবে যার ধাঁচ শুরু থেকেই নষ্ট সে কালে কালে আরো খেল দেখাবে এই আশা করাই উচিত। মতিলালও ক্রমেই উচ্ছন্নে যেতে থাকে। বাবুরামের ছোটো ছেলে রামলাল। আচার-ব্যবহারে অগ্রজের উলটো। গ্রামের পরিচিত এবং সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত বরদাবাবুর সংস্পর্শে সে ছোটো থেকেই আছে। ধর্মে-কর্মে, ন্যায়নীতিতে অনড় এবং পরমেশ্বরজ্ঞানে নিজেকে সেই শুরু থেকে চালিত করা বরদাবাবু রামলালকে নিজের সবটা দিয়ে চালনা করেছেন। তাইতো রামলাল হয়েছে আদর্শ ছেলে। তার নরম এবং জ্ঞানী স্বভাবে কু চক্রী অনেকেই রটিয়েছে ❛বাবুরামবাবুর ছোটো ছেলেটি পা গল❜। এমন রটনার পিছনে ঠকচাচার মতো লোকের হাত আছে। ঠকচাচা সেই ব্যক্তি যে আগেপিছে বাবুরামকে পরামর্শ (কু-পরামর্শ) দিয়ে থাকেন। নিজের স্বার্থসিদ্ধিও হয় তার। এহেন কুটিল-জটিল কাজ নেই সে করে না। মা মলা-মোকদ্দমায় সত্য-মিথ্যের বেড়াজাল তৈরি করে রায় পালটে দেয়ায় জুড়ি নেই তার। বাবুরামও তার কথাতেই চলেন। সামনে যখন এহেন লোকের আনাগোনা তখন বেচারামবাবু বা বেণীবাবুর মতো সৎ লোকের কথার ধার ধারার সময় নেই বাবুর। তবে অত্যাচার আর অন্যায়ের পথ তো সবসময় এক থাকে না। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মেই শিক্ষা দেয়। বাবুরামের ক্ষেত্রেও তার ব্যতয় ঘটে না। শেষ সময়ে এসে ভুল ভাঙলে সে ভুলের মাশুল হয় না। বাবুরাম শেষদিকে তার ভুল বুঝলেও আলালের ঘরের দুলাল, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো মতিলালের মতি তো হয় না। পিতার স্থানে বসে সে আরাম করতে থাকে। তবে কথায় আছে, বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরোয়। এভাবে কদ্দিন? আদর্শ পুত্র হিসেবে রামলাল থাকলেও কুটচালির মাঝে সে কীভাবে নিজেকে এবং তার পরিবারকে রক্ষা করবে? সুসময়ের মাছিরা বিপদে উড়ে যায়। মতিলালের সাথীরাও কি একই রূপ দেখাবে? বাবুরামবাবুর পরিবারের পরিণতি কেমন হবে? পাঠ প্রতিক্রিয়া: ❝আলালের ঘরের দুলাল❞ বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে উপন্যাসটি রচনা করেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করে। যার প্রশংসা করেছেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। বাংলা সাহিত্যে সাধুরীতির কঠিন ভাষা প্রয়োগের কালে লেখক এই উপন্যাসে কথ্যরীতির ব্যবহার করেছেন। যা তৎকালীন সময়ে উপন্যাস পাঠকে আরো সহজ করে। উপন্যাসের ভাষারীতিকে ❛আলালী ভাষা❜ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। ❝আলালের ঘরের দুলাল❞ উপন্যাসটি পড়লে ঊনিশ শতকের কলকাতা শহর এবং গ্রামের দারুণ একটা চিত্র উপলব্ধি করা যায়। লেখক সে সময়ের মানুষের জীবনযাপন গোটা অক্ষরে ফুটিয়েছেন। বাংলায় ❛আলালের ঘরের দুলাল❜ এর অর্থ হলো অতি আদরে নষ্ট সন্তান। উপন্যাসে বাবুরামের পুত্র মতিলালের চরিত্রের মাঝে লেখক এই প্রবাদের সর্বোত্তম প্রয়োগ দেখিয়েছেন। মতিলালের মতো চরিত্রের মানুষ সেই যুগের কলকাতায় যেমন ছিল, তেমন আছে বর্তমান যুগেও। সন্তানকে অধিক আদরে নষ্ট করার যে রীতি সেটা আজও চলমান। আর তার ফলাফল যে খুব একটা সুখকর নয় সেটাও এই উপন্যাস পড়লে টের পাওয়া যায়। উপন্যাসটি লেখক মোট ৩০টি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে সেখানে শিরোনাম বা বলা ভালো সে অধ্যায়ে কী কী ঘটবে তা অল্পের মাঝে বলেছেন। সাধারণ উপন্যাসে শিরোনাম এক দুই শব্দের দেখা যায়। তবে এ উপন্যাসের শিরোনাম আমার কাছে আগের পড়া বইগুলো থেকে ভিন্ন লেগেছে। যেমন: কলিকাতায় ইংরাজী শিক্ষার বিবরণ, শ��শুশিক্ষার প্রকরণ, মতিলালের কুসঙ্গ ও ধৃত হইয়া পুলিশে আনয়ন। উপন্যাসে লেখক ভালো সঙ্গের ফলাফল এবং খারাপ সঙ্গের নজির দুই-ই দেখিয়েছেন রামলাল এবং মতিলাল ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমে। এছাড়াও সে সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, স্কুলের পাঠ্যদান অবস্থা, বাঙালীর জীবনের হেয়ালীপনার চিত্রও তুলে ধরেছেন। লাভের আশায় লোকে ঠকচাচার মতো ধূর্ত লোকের সাথে দস্তি করে, কিন্তু সুপরামর্শদাতাদের দূর দূর করে। তবে এর ফলাফল যে ভালো নয় তা তো উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রমাণ পেয়েছে। উপন্যাসের কাহিনি, চরিত্র, পরিণাম এবং শেষ পরিণতি লেখক দিয়েছেন সুন্দরভাবে। চলিত গদ্যরীতি বা সংলাপনির্ভর উপন্যাস হিসেবে ❝আলালের ঘরের দুলাল❞ বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্য বা গদ্যসাহিত্য নতুন এক ধারায় প্রবেশ করে। তবে তাও একে সার্থক উপন্যাস বলা যায় না। সার্থক উপন্যাসের সকল গুনাবলী এতে উপস্থিত নেই। আমার কাছে বইটা পড়তে বেশ ভালো লেগেছে। তবে খারাপ লাগার পরিমাণ যে নেই বলা ভুল হবে। উপন্যাসে উপমা বা কিছু উদাহরণ বর্ণনার বিষয় ছিল। সেসব উদাহরণ পড়তে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়তি মনে হয়েছে। উপমা প্রয়োগের আধিক্য একটু কম হলে মন্দ হতো না। তৎকালীন কথ্যরীতি অনুযায়ী বইয়ের ভাষার ব্যবহার সহজপাঠ্য মনে হলেও শতবছর বাদে বর্তমানের কথ্যরীতি অনুযায়ী উপন্যাসটা পড়তে আমার একটু সময় লেগেছে। সাধু এবং সেকেলে ভাষা আমার কাছে কঠিন ঠেকেছে। মোটের উপর ❝আলালের ঘরের দুলাল❞ উপন্যাসটা উপভোগ্য এবং এ থেকে শিক্ষা নেয়ার ঢেড় বিষয় আছে। আপনার সন্তানকে আপনি যে আদলে যে ছাঁচে রাখবেন সে সেভাবেই বড়ো হবে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং যথাযোগ্য শাসন শিশুর ভবিষ্যতের জন্য জরুরী। গ্রাম্য প্রবাদে আছে, সন্তানকে মাটিতে রাখি না পিঁপড়ায় খাবে, মাথায় রাখিনি পাছে উঁকুনে খায়। অন্তরের মাঝে রেখে মানুষ করেছি। তবে সে সন্তান-ই যদি উচ্ছন্নে আয় তবে পিতা-মাতার দুর্ভোগের শেষ থাকে না। তাই সন্তান মতিলাল হবে না রামলাল হবে তার সিদ্ধান্ত গোড়াতেই নেয়া আবশ্যক।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস । তার হাত ধরেই চলিত ভাষার প্রথম উপন্যাস। বই পড়তে গিয়ে শুধু দাত না মাথার তার ও ছিড়ে গিয়েছে। নরমালি এই রকম উপন্যাস পড়তে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে সেখানে আমার দুদিন লাগল । উপন্যাসের গঠনরীতি অনুযায়ী নাজুক কিন্তু তিনি স্রষ্টা।
কথায় বলে, “সঙ্গদোষে লোহা ভাসে” বাবুরাম বাবু বড় বৈষয়িক মানুষ ছিলেন। তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে সকলে তাকে মান্য করত। কারণ, ❝এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক্ গৌরব হয় না।❞ যতই তার বৈষয়িকতার উন্নতি হলো ততই তার বাড়িতে লক্ষ্মীর বরযাত্রীর মতো মানুষের উপচে পড়া ঢল লেগেই থাকতো। যেমন, ❝মেঠাইওয়ালার দোকানে মিষ্ট থাকিলেই তাহা মক্ষিকায় পরিপূর্ণ হয় তেমন ধনের আমদানি হইলেই লোকের আমদানি হয়।❞ বাবুরাম বাবুর চার সন্তানের মধ্যে মতিলাল ছিল অতি আদুরে। পিতা তাকে বাড়িতে পড়াশোনা শেখানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনো সুবিধা হয় নাই। অতঃপর তাকে বালীর বেণীবাবুর নিকট শিক্ষাগ্রহণে পাঠানো হলো। বেণীবাবু সৃজনশীল শিক্ষাচর্চার মানুষ ছিলেন। যদিও ❝এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়ার শেষ হইল। কিন্তু এ বড় ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্য্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কূল পাওয়া যায় না, বিদ্যার চর্চ্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে।❞ এই মতে বেণীবাবু ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। কিন্তু মতিলালের স্বভাব দোষে সেখানে গিয়েও পড়াশুনা না করে উল্টো দল বানিয়ে এলাকার মানুষকে উত্যক্ত করা শুরু করে। ❝যে যে বালক বাল্যাবস্থা অবধি নির্দোষ খেলা অথবা সৎআমোদ করিতে না শিখে তাহারা ইতর আমোদেই রত হয়।❞ মতিলালও ঠিক তাই। তার দুষ্টু কৃতকর্মের জন্য তাকে জেলেও যেতে হয়। বাবার বন্ধুবর মোকাজান মিয়া ওরফ ঠকচাচার কুমন্ত্রণায় আরো লাটে উঠে মতিলাল। একসময় পিতা বাবুরাম মারা যায়। পিতার মৃত্যুর পর সে পরিবারের সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। ব্যবসা করে সব হারিয়ে তার জ্ঞান হয় যে আপন মানুষ ব্যতিত কেউ তার ভালো চায় না। অবশেষে ভুল অনুধাবনের পর সৎসঙ্গ লাভে মতিলালের চিত্ত পরিশোধিত হয়। অবশেষে― ❝আমার কথাটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল❞― #আলালের_ঘরের_দুলাল #প্যারীচাঁদ_মিত্র
“আলালের ঘরের দুলাল” বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস৷ টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে প্যারীচাঁদ মিত্র এর রচয়িতা। উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু সমকালীন কলকাতার সমাজ জীবন। উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান মতিলাল-ই উপন্যাসের আলালের ঘরের দুলাল৷ কথায় আছে—'সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ'। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই মতিলাল। অপরদিকে, মতিলালের ছোট ভাই রামলাল তার ঠিক বিপরীত। 'ঠকচাচা' এ উপন্যাসের অন্য একটি প্রধান চরিত্র৷
কেবলমাত্র মনের কৌতুহল থেকেই এই উপন্যাস পড়া৷ খুব জানার ইচ্ছা ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস কেমন ছিল, এর ভাষা কেমন ছিল, এর গঠন কেমন ছিল, এর চরিত্রচিত্রণ কেমন ছিল! যেমন আশা করেছিলাম তার চেয়ে ভালোই লেগেছে৷ মনে হয়েছিল ভাষা হবে দূর্বোধ্য, চরিত্র হবে অপরিণত/দুর্বল। ভাষা নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হয় নি। সাধু, কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার জগাখিচুরি কিছুটা উদ্ভট মনে হলেও, বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় নি। আর চরিত্রগুলো সাদা আর কালো। সেখানে ধূসরের কোন স্থান নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করিনা একজন ভালো মানুষ সর্বাঙ্গে ভালো, আর একজন খারাপ মানুষ হাড়েহাড়ে মন্দ। মানুষের চরিত্র হয় ধূসর। যেহেতু এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম উপন্যাস, তাই এই দোষ থেকে মুক্তি দিতে পারি। তবে উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে মনে হয়েছে উপন্যাসটি তার প্রধান চরিত্রকে যথেষ্ট 'স্পটলাইট' দিতে পারেনি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কে— মতিলাল নাকি বাবুরাম নাকি ঠকচাচা; তা নিয়ে মাঝে মধ্যেই যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে আমাকে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল। তৎকালীন প্রচলিত কথ্য বাংলায় লেখা বইটিতে লেখক প্রচুর বিদেশি শব্দের ব্যবহার করেছেন। ফলে হাল আমলের পাঠকের কাছে পুস্তকখানি কিঞ্চিৎ বিরক্তিকর মনে হইতে পারে। প্রচুর হাস্যরসে ভরপুর পুস্তকখানি। একটাই সমস্যা যে, বেশিরভাগ হিন্দু লেখকেরা একটু মুসলিম বিদ্বেষী হয়। এই লেখক যে অতিরিক্ত মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন তা এই কাহিনীতে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। বৈদ্যবাটির বাবুরাম বাবু খুবই বৈষয়িক মানুষ। তাহার অতিশয় আদরের পুত্র মতিলাল। পিতা মাতার অতি আদরের কারনে ছোট বেলায় বখে যায়। হিন্দু পন্ডিতকে ঘুস দিয়ে আর মুসলিম পন্ডিতের দারিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পড়াশুনোয় ফাঁকি দেয়ার এক ��ভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এরপর কলিকাতায় গিয়ে অসৎসঙ্গ পেয়ে বাকিটা পুরন করে ফেলে। মায়ের গায়ে হাত তোলা, ভাই বোন, স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হেন অপকর্ম নেই যা সে করেনি। মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, চুরি ছিনতাই সহ, জেল খাটা সব অপকর্মে সে হাত পাকিয়েছে। কিন্তু দিনশেষে কি পরিনতি হয়েছিলো মতিলালের? ঠকচাচা মোকাজান, পেশায় উকিল, ধর্মে মুসলিম। লেখক একে তার কাহিনির ভিলেন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অথচ আমার জানামতে এই বই যেসময় লেখা হয় মুসলিম সমাজে তখন এতটা দক্ষ মুসলিম উকিল ছিলোনা। লেখক মুসলিম বিদ্বেষ থেকেই মুলত মোকাজান চরিত্রকে কাহিনীতে তুলে এনেছেন হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। যা সেই সময়ের অধিকাংশ লেখকদের বেলায় দেখা যায়। এই বিষয়টা বাদ দিলে কাহিনীটা অসাধারণ ছিলো।
আলালের ঘরের দুলাল বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম উপন্যাস। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। অধ্যায় ৩০ টি। এর ইংরেজি অনুবাদ করেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র ' The Spoilt child' নামে। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস কিন্তু দুর্গেশনন্দিনী।
এ বাগধারার অর্থ অতি আদরে নষ্ট পুত্র। যদিও উপন্যাসের নামের সাথে মূলকাহিনীর মিল থাকে না প্রায় সময়। তবে এ উপন্যাসে মিল আছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে মতিলাল অতি আদর পেয়ে বকে গেছে। এমন কোনো কুকর্ম নাই যে সে করেনি। তার পিতা বাবুরামবাবু পুত্রের শিক্ষার ভার দেয় বেণীবাবু ও বেচারামবাবুর উপর কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছে। উপায় না পেয়ে মতিলালকে বিয়ে করানো হয়। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। বাবুরামের মৃত্যুর পর মা বোন ভাইকে বাড়ি ছাড়া করেছে।
একবার পূজায় মতিলাল গোল বাধালে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়৷ হাজত থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মোকাজান মিয়া উরফে ঠকচাচা এবং বাঞ্চারামের সাহায্যে ছুটিয়ে নিয়ে আসে৷ সুযোগসন্ধানী ঠকচাচা ও বাঞ্চারাম মামলা মোকদ্দমায় মিথ্যে সাক্ষী যোগাড়সহ বিভিন্ন কু কর্ম করে রোজগার করত।
পুরোটা ফুটিয়ে তুলা সম্ভব না, পড়তে পারেন..... ___
It was amusing and, at the same time, disturbing to see how the societal picture of Bengal is still pretty much the same after about 200 years. The whole time during the read I kept wondering when I will see a contrast to this distressful but never changing attribute of our land where "one receives higher veneration for more wealth and higher status, but not so much for knowledge and character".
বাংলা ভাষায় লিখিত প্রথম সফল উপন্যাস। যদিও পড়তে গিয়ে অনেকবার বিরক্ত হয়েছি। ভাষা সাধু ও চলিতের একটা জগাখিচুড়ি টাইপের মনে হয়েছে। কোন কোন স্থানে অতিরিক্ত কথা বলা হয়েছে। তবু সব মিলিয়ে প্রশংসনীয়। প্রথম উপন্যাস হিসেবে নিঃসন্দেহে অনেক উত্তম বলা যায়।
ঠিক উপন্যাস না। তবে উপন্যাসের মত। প্রথম উপন্যাসের স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি? প্রশ্নটা তোলা থাক। ফান ফ্যাক্ট বলি একটা। CrPC তে Justice of Peace এর আইডিয়া আছে। কিন্তু, এই পদের কাজ কী, তা একমাত্র বলা আছে এই উপন্যাসেই 😎
I found this book at Marrietta, Dhaka's distinguished bookstore, in 1985. It was one of the original editions published at least 30 years earlier (in the 1950s), so it was a special find for me.
A delightful little book that perfectly narrates the decadence of Calcutta during the colonial days. Authentic in terms of language, mood and topics. I still remember some famous lines "....কেউ কেউ পাকি হয়ে উড়তে চান...".