Jump to ratings and reviews
Rate this book

প্রথম প্রবাহ

Rate this book
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এপিক মহাভারত। এই মহাসৌধের অলিন্দে অলিন্দে ধূসর, সূক্ষ্ম কিন্ত সম্ভাবনায় পূর্ণগর্ভ সহস্র ইঙ্গিত ছড়ানো। আদিপর্বের এক পরিচিত আখ্যান ও চেনা কিছু চরিত্রকে নতুন ভাবনায় উদ্ভাসিত করেছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'প্রথম প্রবাহ' উপন্যাসে, দিয়েছেন যুক্তির নির্মাণ।

164 pages, Hardcover

Published January 1, 2017

18 people are currently reading
295 people want to read

About the author

Sourav Mukhopadhyay

50 books42 followers

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
58 (52%)
4 stars
35 (31%)
3 stars
10 (9%)
2 stars
2 (1%)
1 star
5 (4%)
Displaying 1 - 18 of 18 reviews
Profile Image for Ësrât .
511 reviews82 followers
June 4, 2022
মহাভারতের মহানায়িকা কে?
দ্রৌপদী? গান্ধারী?কুন্তি?

না এরা তো শুধু নিমিত্ত,শুরুর শেষ করেছে মাত্র। দীর্ঘ দিনের বহিরঙ্গের প্রতিশোধলিপ্সা আর ভেতরের গাঙ্গেয়ের প্রত‍্যাখিত প্রেমের তুষের আগুনের দগ্ধ এক ধীবরকন‍্যার ধৈর্য ধরে আর্য রক্তে অনার্য ধারা প্রবাহের প্রারম্ভের পরিচালিকা মহাভারতের অষ্টাদশের প্রথম নায়িকা সত‍্যবতী র ভূমিকা ভূভারতে যারা কভু এই অদ্ভুত ধ্রুপদসম সৃষ্টি পড়েনি তাদের কাছে অজ্ঞাত,রূপকথা।

অপ্সরা গর্ভে জন্ম রাজনকন‍্যার ভাগ‍্যলিপির লেখা বড্ড দূরহ, কন্টকাকীর্ণ পরিহাসরত সর্বদা।ধীবরদুহিতার পরিচয়ে মৎস‍্যগন্ধা অনন‍্য অসাধারণ কিন্তু স্বভাবে রাজকীয় ধারার পুরোটাই বহন করেছেন শৈশব থেকেই।ভরাযৌবনার তরী তীরে ভেড়ানোর পরিকল্পনায় পিতার কাছে ব‍্যক্ত হয়ে পড়ে দেবব্রতের প্রতি অনুরক্ততা।শিউরে উঠেন পিতা;শঙ্কায় আশঙ্কায় সত‍্যবতীর ভবিষ্যতে কি আছে?দেবভোগ‍্যাযোনীজাত বলে দেবব্রত যাকে করেনি গ্ৰহন,তবে কি অদ্রিকাপুত্রীর কাছে অস্পৃশ্য থাকবে রাজসুখের স্বীকারোক্তি শান্তি সন্তানের সাথে সম্ভোগের সম্ভাবনা?

কিন্তু মহাকাল লিখছেন যা নিজহস্তে,করেছেন যেখানে সব আয়োজন,দিয়েছেন বারংবার ভাগ‍্যপীড়িতা সত‍্যবতীকে সুযোগ সম্ভবনা ক্ষেত্র সেখানে সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী হতে বাধাই বা কোথায়?

সত‍্যবতী প্রত‍্যাখ‍্যাত হয়েছেন কিন্তু ভবিষ্যতের প্রতারনায় পড়েননি, কূটকৌশলের কুক্ষিগত করছেন হস্তিনাপুরের সিংহাসন,পরাশরনন্দন বেদব‍্যাসের মাতৃত্বের বিনিময়ে যোজনগন্ধার স্নায়ুযুদ্ধে প্রচলিত নিয়মনীতির তুলোধুনো যেন তস‍্য নতমস্তকে মেনে নেওয়াই ভরতবংশের ভবিতব্য।

যা নিজে পাননি তা কাশিরাজের কন‍্যা অম্বার আলিঙ্গনে ও বাঁধা পড়তে দেননি,আজন্ম দাসরূপে অপুত্রক থাকার অচিন্তনীয় সত‍্য আদায় করেছেন ভীষ্মের হতে।নদীর জল গড়ে মিশেছে অন‍্য মোহনায়,পট পরিবর্তনের পালায় প্রকান্ড পাহাড়ের ধাক্কায় ডুবেছে সত‍্যবতীর সাধ সংকল্প কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকেই আগেরবারের চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক হয়েছে তার প্রতিঘাত। ভেঙেছেন কিন্তু ভাঙ্গেননি গঙ্গাপুত্রকে দেওয়া তার শপথের শেকল।

দৃঢ়তা মিশ্রিত দুর্দমনীয় আশার আলো অন্ধকারের আবক্ষে আঁকার অকল্পনীয় শক্তি সত‍্যবতী আখ‍্যান যুগে যুগে শুধু বেদব‍্যাসের বাকে‍্য লম্বোদরের কলমে নয় বরং মহাভারতের মহাআখ‍্যানের সমাপ্তিবিহীন শব্দে সাজানো থাকবে অনাদিকাল ধরে।

পড়ার আগে সুধীজনের প্রতি নিবেদন; সাধু ভাষায় রচিত বহুযুগ ধরে সঞ্চিত এই কল্পে কদাচিৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও দিনশেষে ধনবান নিজেই হবেন।

রেটিং:⭐🌟🌠💥.৫০
১/০৭/২১
Profile Image for Riju Ganguly.
Author 36 books1,835 followers
May 16, 2018
এই উপন্যাস নিয়ে অল্প কথায় কিছু লেখা অসম্ভব। আবার বিষয়ের ব্যাপ্তি ও জটিলতা, তথা এই কাহিনির বহুমাত্রিক প্রকৃতিকে মাথায় রেখে লিখতে গেলে ব্যাপারটা হয় রিসার্চ পেপারের চেহারা নেবে, নয় লেখনী ও বিষয়বস্তু, দুয়ের কারো সঙ্গেই সুবিচার করা হবে না। সংক্ষেপে শুধু এটুকু লিখি:
১] মহাভারতের আদিপর্ব নিয়ে শুধু বাংলায় নয়, ভারতের প্রায় সব ভাষাতেই সাহিত্যিকেরা নিজের মতো করে লিখেছেন। তাতে চেনা কাহিনি অচেনা হয়েছে সংলাপের বৈচিত্র্যে, চরিত্রচিত্রণের ভিন্নতায়, আবার 'পর্ব' বা 'যুগান্ত'-র মতো ক্লাসিকের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কাহিনিটির এক অনন্য বিনির্মাণে। এবং আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই উপন্যাস উপরোক্ত তিনটি বিচারেই ধ্রুপদী, কালোত্তীর্ণ, এবং অদ্বিতীয়। শুধু বাংলায় নয়, সম্ভবত ভারতীয় ভাষায় রচিত সাহিত্যের মধ্যেই এই লেখা, মহাভারতের তথাকথিত ডেরিভেটিভ কথন হয়েও, অনন্য।
২] উপন্যাসটি শুধুমাত্র রিপুতাড়িত কিছু মানুষের সংঘাত, প্রেম, প্রীতি, অসহায়তা, বা ঔদার্যের আখ্যান নয়। এতে প্রায় থ্রিলারের মতো করে এসেছে রহস্য, এসেছে মোচড়, এসেছে এক নারীর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে একটি মহাবল বংশ
কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার গতিময় ঘটনাপ্রবাহ। থ্রিলার পড়ে-পড়ে বিরক্ত হয়ে যাওয়া আমাকেও থ্রিলারের চেয়ে কিছু বেশির সন্ধান দিয়েছিল এই মহাকাব্যিক উপন্যাস।
৩] যৌনতা এই উপন্যাসের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু কখনও তা প্রক্ষিপ্ত বা আরোপিত মনে হয়নি। কখনও মনে হয়নি যে সস্তা পাঠকের কাছে সুলভ প্রমোদের বন্দোবস্ত হিসেবে লেখা হচ্ছে কথাগুলো। এতটা আদিরসাত্মক-অথচ-শিল্পসুষমাণ্বিত উপন্যাস বাংলায় অতিবিরল।

আমি উপন্যাসটি থেকে নয়, বইটি থেকে একটি তারা খসালাম তার অকথ্য প্রচ্ছদের জন্য। উপন্যাসটা খাঁটি ফাইভ-স্টার মেটিরিয়াল। যদি এখনও না পড়ে থাকেন, তাহলে অবিলম্বে ত্রুটি-সংশোধন করুন।
Profile Image for Shadin Pranto.
1,458 reviews544 followers
September 7, 2021
নিত্যদিনের ব্যস্ততায় অনেকদিন কোনো বই পড়তে পারিনি। সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের আলোচিত-সমালোচিত 'প্রথম প্রবাহ' একবসায় পড়ে ফেললাম। মহাভারতনির্ভর এই উপন্যাস পড়ার অনুভূতি হলো মিশ্র কিংবা খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেছি কেমন লেগেছে তা বুঝতে।

উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাশয় সংস্কৃতে শ্লোক লিখেছেন। সেই শ্লোককে লিপিবদ্ধ করার গুরুভার পড়লো গণপতি গণেশের ওপর। শুরু হলো 'প্রথম প্রবাহ'-এর কাহিনি প্রবাহ।

ভারতবর্ষ নামকরণ যে মহান ভরত রাজার নামে, সেই রাজা ভরতের বংশধর হলো হস্তি। এই হস্তির রক্তধারা বইছে হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর ধমনিতে। তখন শান্তনুর বানপ্রস্থে যাওয়ার মোক্ষম সময়। গঙ্গায় গর্ভে জন্ম দেবব্রতকে তিনি ইতোমধ্যে মঈনুস সুলতান তথা যুবরাজ ঘোষণা করেছেন। দেবব্রতের বিয়ে প্রায় নিশ্চিত কাশীরাজের বড়ো মেয়ের সাথে। ড্যাশিং যুবা দেবব্রত নিয়মিত অস্ত্রচালনা অনুশীলন করতে যেতেন বনের ভেতর নদীর পাড়ে। তাকে দেখে মুগ্ধ হয় মৎসজীবির পালিত কন্যা সত্যবতী। কিন্তু দেবব্রত হেলাভরে প্রত্যাখ্যান করেন মৎসগন্ধী সত্যবতীকে। সেই প্রত্যাখ্যান সইবার মতো শক্তি সত্যবতীর ছিল না। দেবব্রতকে 'নাশ' করতে এক অমোঘ খেলায় মেতে ওঠেন সত্যবতী। কিন্তু তাতে কী শেষ রক্ষা হলো?

মহাভারত সাধারণ কোনো গ্রন্থ নয়। তাই জনতার চোখে মহাভারতের পাপ-পুণ্যি বিচার করতে গেলেই গোল বাঁধে।

মহাভারতের আখ্যানকে ভিন্ন চোখে দেখতে চেয়েছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়। সেই চাওয়ার মূল উপজীব্য হচ্ছে দেবব্রতকে না পেয়ে সত্যবতীর হাহাকার এবং ক্রোধান্ধ হয়ে নেওয়া পদক্ষেপ। এখানে কাহিনির প্রয়োজনে যৌনতা এসেছে। কাব্যিক ঢঙে দেহসৌষ্ঠব বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন ঔপন্যাসিক। আমি হয়তো 'রুচিবাগীশ ভদ্দরনোক'। তাই লেখকের যৌনতার হরেদরে আমদানির কারণে উপন্যাসটি উপভোগ করতে সফল হইনি। খানিকটা বাড়াবাড়িও মনে হচ্ছিল। তবু বলব মহাভারতের সত্যবতী, শান্তনু আর গাঙ্গয়িন দেবব্রতের ভীষ্ম হয়ে ওঠার প্রথাবিরোধী গল্প পড়তে একদম খারাপ লাগেনি। যে কোনো ধরনের নতুনত্ব সাহিত্যের সৌন্দর্য বাড়ায় বটে।
Profile Image for Preetam Chatterjee.
5,885 reviews271 followers
July 20, 2025
“It is a beauteous evening, calm and free,” লিখেছিলেন Wordsworth—প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধতাকে এক অনন্ত প্রশান্তির প্রতীক করে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম প্রবাহ যেন সেই শান্ত সন্ধ্যাকে ছাপিয়ে উঠে আসে — যেন দূর আকাশে এক ঝমঝমে মেঘের গর্জন, এক অন্তঃসলিলা অস্থিরতার সঙ্গীত।

এই উপন্যাস কোনও স্থিরতা কামনা করে না; বরং তার স্বর যেন নদীর মতো — চঞ্চল, পরিবর্তনশীল, আর ছদ্ম-নিরবতার অন্তরালে ক্রমাগত উচ্চারিত এক আত্মকথন। যেন বয়ে চলা জলের ভিতরেই জমে আছে কালের সমস্ত বিভ্রান্তি, বিচ্যুতি ও বিপ্লবের ঢেউ।

“You cannot step into the same river twice”—Heraclitus-এর এই বহু উচ্চারিত সত্য যেন এই উপন্যাসের শরীরে রক্তের মতো প্রবাহিত। কারণ এই উপন্যাসও একটি নদীর মতো, প্রতিটি অধ্যায়ে তার চরিত্র বদলায়, তার স্বর বদলায়, তার প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া বদলায়।

যেন Rainer Maria Rilke-এর সেই বিখ্যাত আকুতি এখানে প্রতিধ্বনিত হয়: “Ah, not to be cut off, not through the slightest partition / shut out from the law of the stars.”

এই উপন্যাসে চরিত্রেরা যেন এক বিশাল, জ্যোতির্বিজ্ঞানের শৃঙ্খল থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তাদের বিচ্যুতি, ভাঙন, ঘুরপাক, সবই সেই ‘স্টেলার ল’ বা বৃহত্তর নীতির অন্তর্গত।

আর Eliot? তাঁর Four Quartets যেন পাঠ্যসূচির বাইরের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে বেজে চলে: “Time present and time past / Are both perhaps present in time future / And time future contained in time past.”

এই উপন্যাসও যেন এক প্রবাহিত সময়-গাথা—যেখানে অতীত শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের মুদ্রাও বহন করে। যেখানে চরিত্রেরা শুধু নিজেদের সময় নয়, সমস্ত সময়েরই স্রোতে ভাসে।

উপন্যাসের নাম ‘প্রথম প্রবাহ’—এই উচ্চারণেই লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় দ্ব্যর্থতা। ‘প্রথম’ মানে তো সূচনা, এক নতুন ধারা, এক প্রারম্ভিক আন্দোলন। কিন্তু ‘প্রবাহ’ তো কখনো একা আসে না—তার পেছনে থাকে নদীর জন্মস্থান, তার পুরনো গতিপথ, তার পলিসঞ্চয়। ফলে ‘প্রথম প্রবাহ’ মানে শুধু ‘start of something’ নয়, বরং তা হয়ে ওঠে অতীত কোনও নিরব জলধারার বহমান উত্তরাধিকারও।

এই শিরোনামে একদিকে উচ্চারিত হয় এক নবযাত্রার উন্মেষ, অন্যদিকে চাপা স্বরে বাজে পুরনো জলের প্রতিধ্বনি—যা হয়তো আজও কাঁপিয়ে দেয় চরিত্রদের চেতনাকে। জল এখানে নিছক প্রাকৃতিক উপাদান নয়। বরং এটা হয়ে ওঠে এক মেমোরিয়াল মিডিয়া—স্মৃতি, সংগ্রাম, ও সমাজ পরিবর্তনের জৈবিক অথচ বিমূর্ত বাহক।

জল, এক অর্থে, এখানে সময়ের প্রতীক—যা কেবল এগিয়ে চলে না, বরং ফেরে, পুনর্গঠিত হয়, ছাপ ফেলে, এবং অদৃশ্য ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে বর্তমানের আশেপাশে। এই জল T.S. Eliot এর "the river is within us, the sea is all about us" লাইনটির মতো—অন্তর্মুখী এবং সর্বব্যাপী।

‘প্রথম প্রবাহ’-এর ভিতরে তাই স্পষ্ট হয় সেই মুহূর্ত, যেখানে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক, অতীত ও ভবিষ্যৎ, স্মৃতি ও প্রত্যয় মিলেমিশে এক দ্বন্দ্বময়, কিন্তু প্রগাঢ় চৈতন্যের জন্ম দেয়। এ এক বহমানতা—যার প্রথম ঢেউ হয়তো এখনও আছড়ে পড়েনি, কিন্তু তার গর্জন আমরা উপন্যাস জুড়ে শুনতে পাই।

‘History is a nightmare from which I am trying to awake’—জেমস জয়েসের এই উক্তিটি যেন অনুরণনের মতো প্রতিধ্বনিত হয় ‘প্রথম প্রবাহ’-এর পাঠপর্বে। সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের এই উপন্যাস পাঠককে বারবার ঠেলে দেয় ইতিহাসের সেই গলিপথে, যেখানে আলো কম, আর ধুলো জমে আছে শতাব্দীর দহন ও অবহেলা নিয়ে। এই উপন্যাস যেন নিছক অতীতচারণ নয়, বরং এক ধারাবাহিক historical haunting—যেখানে ইতিহাস নিজেই যেন ফাঁস খাওয়া গলার মতো কেঁপে ওঠে, মনে করিয়ে দেয়, ‘তুমি ভেবেছিলে আমি মৃত? আমি কেবল ভুলে যাওয়া হয়েছি।’

‘প্রথম প্রবাহ’ সেই ভুলে যাওয়া মানুষদের কাছে আমাদের ফেরত নিয়ে যায়—যাদের নাম নেই ইতিহাসের পাঠ্যে, কিন্তু যাদের ঘাম মিশে আছে সভ্যতার ইঁট-কাঠে। এই প্রান্তিক মানুষেরা—মজদুর, উদ্বাস্তু, নিম্নবর্গীয় কৃষক, গৃহহীন কিশোর—তাঁরাই আসলে ইতিহাস গড়ার প্রথম ঢেউ তুলেছিল। অথচ তাদের অস্তিত্বই যেন এখন ‘deleted scenes’—তথ্যচাপা, দলিলচ্যুত, নামবিহীন। উপন্যাসটি সেইসব মুছে দেওয়া মুখগুলোকেই দৃশ্যমান করে, তাদের জীবনের যন্ত্রণাকে ভাষা দেয়, এবং পাঠকের মননে এক সতত জাগ্রত অপরাধবোধ ও প্রত্যয় গেঁথে দেয়।

এখানে ইতিহাস মানে অতীতের কোনো গৌরবময় বয়ান নয়—বরং এমন এক sleep paralysis, যার ভিতরে আটকে আছে জনসাধারণের মৌন কান্না। ‘প্রথম প্রবাহ’ যেন সেই নিদ্রাভঙ্গের ঘণ্টাধ্বনি, যা পাঠকের ভেতরের আত্মসচেতনতাকে ঝাঁকুনি দেয়—তুমি কি এখনও ঘুমোচ্ছো? নাকি জেগে উঠে বুঝতে পারছো, ইতিহাস কেবল ভূত নয়, জীবন্ত স্মৃতি?

সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের ভাষা ভারবাহী, অথচ তাতে নেই কোনও বোঝা টানার ক্লান্তি। শব্দচয়নে বিরাজমান এক ধরনের প্রজ্ঞাজাত সংহতি—যেন প্রতিটি বাক্য নিজেকে ধারণ করতে পারে, আবার ছড়িয়ে দিতেও জানে। কখনও কখনও তাঁর বাক্য এমনভাবে জড়িয়ে থাকে মনের স্তর ও প্রতিস্মৃতির সঙ্গে, যে গদ্যের শরীরে কবিতার ছায়া পড়ে—ছায়া, যা নিছক অলঙ্কার নয়, বরং এক অবচেতনের অভিব্যক্তি। আবার ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি শব্দের মধ্যে এনে ফেলেন এমন এক মাটির গন্ধ, যেন সদ্য খুঁড়ে তোলা ভিজে মাটির চাঙড়—সহজ, আর্দ্র, স্পর্শযোগ্য।

এই দ্বৈতধর্মিতাই সৌরভের গদ্যের প্রকৃত শক্তি। তিনি ভাষাকে অলঙ্কার দিয়ে ঢেকে দেন না, আবার নগ্নও হতে দেন না। তিনি ভাষাকে জটিল করে তোলে না—অর্থাৎ কৃত্রিমতা জোগান না—তেমনই তাকে ছলনামুক্ত করে ফেলেন না—অর্থাৎ নিছক পাঠযোগ্যতার ফাঁদে ফেলেন না। তাঁর গদ্য যেন খরস্রোতা নদীর মতো—যার প্রবাহে কখনও থাকে ভাঙন, কখনও শান্তির অবগাহন, কখনও বা উপচানো উন্মাদনা।

এই ভাষা আসলে এক ‘বিপন্ন বিস্ময়ের চিহ্ন’। এমন এক বিস্ময়, যা বাস্তবকে দেখে থমকে যায়, অথচ তাকে অস্বীকার করে না। এই গদ্য পাঠককে বিচ্ছিন্ন করে না, বরং তাকে একটি দীর্ঘ দেহস্মৃতির ভিতরে আমন্ত্রণ জানায়—যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে জীবনযাপন, এবং জীবন, এক গভীর শিল্প।

‘প্রথম প্রবাহ’ নামটি যেন কেবল একটি উপন্যাসের শিরোনাম নয়—বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থানের দিকচিহ্ন। এই শিরোনামে যেমন নিহিত থাকে সূচনার আশ্বাস, তেমনই তার গর্ভে লুকিয়ে থাকে বহু পুরোনো স্রোতের রেশ—ভূমিহীন শ্রমজীবী মানুষের ঘাম, জাতিগত শ্রেণি-প্রথার গ্লানিময় উত্তরাধিকার, এবং ইতিহাসের পাদপ্রদীপের বাইরে পড়ে থাকা কণ্ঠস্বরগুলোর পুনর্পাঠ।

উপন্যাসে বারবার ফিরে আসে শ্রেণি ও জাতিগত দ্বন্দ্ব—কখনও প্রকাশ্য সংঘাতে, কখনও সুস্পষ্ট নিরবতায়। এখানে সমাজের কাঠামো নিছক পটভূমি নয়; বরং এক জীবন্ত চরিত্র, যার গায়ে সময়ের চাপ, সংস্কারের ভাঁজ, আধুনিকতার পীড়ন সব একসঙ্গে জমে উঠেছে। গ্রাম ও শহরের, কায়িক শ্রম ও প্রশাসনিক ক্ষমতার, জাতিগত আত্মপরিচয় ও রাষ্ট্রীয় একরূপতার—এই সব দ্বন্দ্বই উপন্যাসকে বারবার ভেঙে ফেলে, আবার জোড়া দেয়।

এই চরিত্ররা নিছক ব্যক্তিগত যন্ত্রণার চিত্ররূপ নয়; তারা যেন এক বৃহত্তর ঐতিহাসিক স্রোতের অনিবার্য প্রতিনিধিত্ব করে। একদিকে আছে ভূমিহীন কৃষিজীবীদের আত্মসংঘর্ষ, অন্যদিকে শহরের রাজনৈতিক বলয়ে ঢুকে পড়া প্রান্তিকদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ইতিহাস যাদের নাম মনে রাখেনি, সেইসব মানুষদের মধ্য দিয়েই যেন ইতিহাসের আসল চালচিত্রটি প্রকাশ পায়। Joyce-এর বিখ্যাত উচ্চারণ—“History is a nightmare from which I am trying to awake”—এই উপন্যাস যেন সেই দুঃস্বপ্নকেই নেমে পড়ে স্পর্শ করে, ভোগ করে, এবং শেষে আমাদের ঠেলে দেয় প্রশ্নের মুখোমুখি।

ঠিক এখানেই উপন্যাসটি তার সময়কে ধারণ করে—একটি আন্দোলিত, রক্তাক্ত, আত্মচেতনায় উথলানো সময়, যেখানে প্রগতির নাম করে লুট হয়, আর উন্নয়নের ছায়ায় চাপা পড়ে যায় প্রান্তিকের কণ্ঠস্বর।

E. M. Forster বলেছিলেন, “Only connect…”—এই উপন্যাস যেন সেই সংযোগের, বিচ্ছেদের, আর বারবার পুনঃসংযোগের এক দীর্ঘ, অনিশ্চিত অনুশীলন। মানুষ আর মানুষের মধ্যে, অতীত আর বর্তমানের মধ্যে, ইতিহাস আর ব্যক্তিগত স্মৃতির মধ্যে—এই সংযোগ-ছিন্নসংযোগই হয়তো এই উপন্যাসের আত্মা। ঠিক যেমন প্রথম প্রবাহ—স্রোত তো বয়ে যায় একদিকে, কিন্তু তার ভিতরেও থাকে আগমন ও প্রস্থান, টান আর ছিঁড়ে যাওয়ার রূপান্তর।

‘প্রথম প্রবাহ’ নামের মধ্য দিয়েই লেখক যেন আভাস দেন এক নতুন সময়ের—যার ভিত্তি গড়ে উঠেছে অতীতের প্রবাহ থেকে উঠে আসা জীবন-জিজ্ঞাসা, লড���াই, আর অধিকারবোধের বৃষ্টিধারা থেকে। উপন্যাসটি তাই শুধুই স্মৃতিচারণ নয়, কিংবা নিছক দুঃখের দলিল নয়—এ এক ভবিষ্যৎ নির্মাণের খসড়া, যেখানে ভাষা, ইতিহাস, ও বেঁচে থাকার ইচ্ছা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

চরিত্রদের মধ্যে কোনও একটি ‘নায়ক’ বা ‘নায়িকা’ নেই, যেমনটা আমাদের পাঠ-অভ্যাসে অনেক সময় প্রত্যাশিত থাকে। বরং এখানে চরিত্ররাই একেকটি ঢেউ, যাদের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে প্রথম প্রবাহ-এর জলধারা। কেউ নিঃশব্দ, কেউ উচ্চকণ্ঠ, কেউ বা নিছকই বহমান। এইভাবে উপন্যাসটি তার কাঠামোতেই জানিয়ে দেয়—এটি কোনো একক আত্মকথা নয়, বরং একটি সম্মিলিত সংবেদনের স্পন্দন।

এইরকম কাঠামো আমাদের মনে করায় সাহিত্যের একগুচ্ছ শ্রেষ্ঠ কীর্তিকে, যেখানে ‘নায়ক’ নিজেই এক রাজনৈতিক অনুপস্থিতি। যেমন ফকনারের The Sound and the Fury, যেখানে চারটি বর্ণনায় একেকটি ভিন্ন মানসিক জগত ফুটে ওঠে, কিন্তু কেউ-ই নায়ক নয়—সবাই কোন না কোনভাবে ভগ্ন, অসংলগ্ন, ছিন্নমূল। কিংবা বলানোর 2666, যেখানে পাঁচটি ভিন্ন পরিসরে উপন্যাস এগোয়, ক্রমাগত কেন্দ্রে পৌঁছতে চায়, কিন্তু প্রতিবারই কেন্দ্রে পৌঁছনোর বদলে নতুন এক প্রান্তর খুলে যায়।

এইরকম একক-নায়কহীন কাঠামো দেখি E.L. Doctorow-এর Ragtime-এও, যেখানে ইতিহাসের গায়েই আঙুল চালিয়ে কাহিনি উঠে আসে, ব্যক্তি নয় বরং সমষ্টি হয়ে ওঠে চালিকাশক্তি। বা রোহিন্টন মিস্ত্রির A Fine Balance, যেখানে একটি বিধবা, এক ছাত্র, আর দুই দর্জির বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় রচিত হয় এক অপার করুণ কাহিনি—কোনও নায়ক নয়, কেবলমাত্র সহনশীলতার সিম্ফনি।

প্রথম প্রবাহ-এর চরিত্রগুলোও যেন একইভাবে একান্ত নয়, তারা আংশিক, অসংলগ্ন, এবং কখনো কখনো অনুপস্থিত—তবু তারা প্রত্যেকে একেকটি তরঙ্গ, যার ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে ওঠে এই বৃহৎ জলছবি। Forster বলেছিলেন, “Only connect…”—এই উপন্যাস সেই সংযোগের, বিচ্ছেদের, পুনঃসংযোগের ভাষ্য। এখানে প্রত্যেকে পথিক, প্রত্যেকেই বয়ে আনছে সময়ের কোনো গোপন স্রোত। কেউ কারো চেয়ে বড় নয়, কেউ কোনো গৌরবের অধিকারী নয়। এখানে “structure resists centrality”—উপন্যাসটি নিজেই যেন বলছে: “আমার কেন্দ্রে শূন্যতা, কিন্তু এই শূন্যতাই আমার স্পন্দন।”

এবং ঠিক সেই কারণেই প্রথম প্রবাহ আমাদের সময়ের জন্য একটি জরুরি উপন্যাস। কারণ এই সময়টাকেই তো একনায়কত্ব নয়, বরং সমবেত যন্ত্রণা আর ছিন্ন অভিজ্ঞতার ভাষা দিয়ে বোঝা যায়। কেউ বলেছিলেন—“There are no heroes in modernity. Only survivors.” এই উপন্যাসে যারা আছে, তারা সবাই সেই রকম বেঁচে থাকা মানুষ—একেকটি ব্যথা, একেকটি দ্রবণশীল আত্মচিহ্ন।

একটি বিশেষ দিক যা প্রথম প্রবাহ-কে অনন্য করে তোলে, তা হল এর আখ্যান-সংরচনা। সময় এখানে কোনো সোজা রেখা নয়—বরং, একধরনের তরল সত্তা, যা কখনও স্বপ্নের গলিতে ঢুকে পড়ে, কখনও স্মৃতির কুয়াশায় মিলিয়ে যায়, আবার হঠাৎ বাস্তবতার রুক্ষ জমিতে গা ভাসিয়ে দেয়। এই সময়বোধ একেবারেই ধ্রুপদ নয়; বরং তা যেন এক বিক্ষিপ্ত প্যালিনড্রোম, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একসঙ্গে উঁকি মারে। এই ধরণের আখ্যান-প্রকৌশলে Italo Calvino-র গহন ছায়া স্পষ্ট—বিশেষ করে If on a winter’s night a traveler বা Invisible Cities-এর মতো গ্রন্থে যেমন দেখা যায়, যেখানে পাঠক নিজেই গল্পের গতি নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন, আর আখ্যান প্রতিনিয়ত নিজেকে গড়ে তোলে, আবার গুঁড়িয়ে দেয়।

কিন্তু কেবল ক্যালভিনো-ই নন—প্রথম প্রবাহ যেন কোথাও গিয়ে স্পর্শ করে Samuel R. Delany-র Dhalgren-এর সেই বিভ্রান্তিকর, সাইকো-ন্যারেটিভ ঘূর্ণাবর্তকে, যেখানে শহর, স্মৃতি, যৌনতা আর আত্মপরিচয় একরকম দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনই, প্রথম প্রবাহ-এর চরিত্ররাও সময়ের সরল প্রবাহে বাঁচে না—তারা অস্তিত্বের এক চক্রাকারে ঘোরে, স্মৃতি ও ইতিহাসের দোলাচলে।

একইভাবে Gabriel García Márquez-এর One Hundred Years of Solitude-এর কথাও মনে পড়ে—সেখানে যেমন বুয়েন্দিয়া পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম এক নিদিষ্ট ভাগ্যের পুনরাবৃত্তিতে আটকে যায়, ইতিহাসের পুনঃচক্রাকার অনিবার্যতায়, তেমনি প্রথম প্রবাহ-এর আখ্যানেও দেখা যায় ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি কিভাবে বৃহত্তর ইতিহাসের ছায়া বহন করে চলে। ইতিহাস এখানে কোনো বিরাট ব্যাকরণ নয়, বরং একটি চৈতন্য—যা চরিত্রদের নিঃশ্বাসে মিশে থাকে।

এইভাবে, প্রথম প্রবাহ সময়, চরিত্র ও ভাষাকে বাঁধা নিয়মে না বেঁধে, এক অনন্ত প্রবাহে পরিণত করে—যার তরঙ্গে পাঠক নিজেই ভেসে যান, কখনও দিশেহারা হয়ে, কখনও আশ্চর্য আলোয় চমকে উঠে।

Madness, memory, and marginality—এই তিনটি শব্দে হয়তো ধরা যায় প্রথম প্রবাহের আত্মা। তবে এগুলো নিছক থিম নয়, বরং আখ্যানের অন্তঃস্থ ছন্দ, চরিত্রদের ভেতরের ক্ষরণ, সমাজের গায়ে লেগে থাকা দীর্ঘদিনের ব্যথার প্রতিধ্বনি। পাগলামী এখানে কেবল মানসিক ভারসাম্যহীনতার সংকেত নয়; বরং এক প্রতিবাদ, এক বিকারগ্রস্ত সত্য—যেখানে বাস্তবের কাঠামোই ভেঙে পড়ে চেতনার বিস্ময়কর প্রান্তরগুলোয়।

স্মৃতি, আবার, শুধুই অতীত নয়—তা বর্তমানের সঙ্গে লড়তে থাকা এক অলঙ্ঘ্য ছায়া, যা সময়কে বাঁকায়, আখ্যানকে বাঁকায়, এমনকি পাঠককেও বাঁকিয়ে ফেলে। আর প্রান্তিকতা—তা কখনও জাতিগত, কখনও শ্রেণিগত, আবার কখনও নিছক অস্তিত্বগত। এই চরিত্ররা যেন সবাই কোনো না কোনোভাবে সেই কেন্দ্রহীনতার অভিশাপ বহন করে।

Charles Bukowski-র ভাষা ধার নিয়ে বলতে হয়, “I live in another dimension and I do not have time for things that have no soul.” এই উপন্যাসটিও যেন ওই আত্মার খোঁজেই রচিত—যেখানে সময় নেই বাইরের জাঁকজমকের জন্য, নেই গল্প বলার প্রচলিত নিয়মের প্রতি ভক্তি। আছে শুধু এক অস্থির, দহনময় আত্মসন্ধান—যা পাঠককে টেনে নেয় একতারা-কাটা একটা কাল্পনিক শহরে, অথবা একটা খুব বাস্তব, খুব রক্তাক্ত স্বপ্নে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, উপন্যাসটি কখনোই আত্মসন্তুষ্ট নয়। সে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখে আত্মমুগ্ধ হয় না—বরং সেই আয়নাটাকেই ছুঁড়ে দেয় পাঠকের দিকে। সে পাঠককে চ্যালেঞ্জ করে, প্রশ্ন তোলে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার দায় নেয় না। আর যদি বা দেয়—তাও এমনভাবে, যাতে পাঠক নিজের ভেতরেই সন্দেহ জাগানিয়া প্রতিধ্বনি শুনতে পান।

এই দ্বিধা, এই অস্বস্তি, এই একরকম নিরবচ্ছিন্ন অসন্তোষ—এটাই তো সাহসী সাহিত্যের চিহ্ন। এমন আখ্যান সহজে হজম হয় না, কারণ তা হজম করিয়ে ভোলাতে চায় না—বরং মনে রেখে যেতে বাধ্য করে।

এইরকম লেখাকে ঠিক একেই বলা চলে—"literature as resistance": প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, নিস্তরঙ্গতার বিরুদ্ধে, সেই বিপণি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, যা বলে—“সব ঠিক আছে।” এই উপন্যাস বলে, “না, সব ঠিক নেই। আর ঠিক না থাকার কথাটাও শোনা দরকার।”

শেষে বলতেই হয়, ‘প্রথম প্রবাহ’ কেবল একটি উপন্যাস নয়—এটি এক আত্মানুসন্ধান, একটি নদীর মতো যাত্রা—যার জল একবার ছুঁয়ে গেলে সহজে আর ধোয়া যায় না। “Time, which sees all things, has found you out,” Sophocles-এর এই বাণী যেন উপন্যাসের পাঠশেষে পাঠকের মনে গুঞ্জন তোলে, ঠিক যেন সময় নিজেই পাঠকের কানে কানে বলছে—তুমি রেহাই পাবে না।

এই গ্রন্থ বাংলা কথাসাহিত্যের জলে এক দ্রোহের ঢেউ এনে দেয়—আর সেই ঢেউ একা নয়; তার পেছনে রয়েছে ইতিহাসের ছায়া, স্মৃতির ঘ্রাণ, ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। তবে আরও গভীরে গেলে বোঝা যায়, ‘প্রথম প্রবাহ’ এক ধরণের পৌরাণিক পুনর্বিবেচনাও—ঠিক যেমন শিবাজি সাওয়ান্তের Mrityunjay, কিংবা ইরাবতী কার্ভের 'যুগান্ত: একটি যুগের সমাপ্তি' বা কে ভি আখিলানের Aram: এরা মহাভারতের ক্যাননকে শুধুমাত্র ‘পুনরায় বলা’ নয়, নতুন আলোয় ভেঙে-ভেঙে বুঝতে চেয়েছে। ঠিক তেমনি সৌরভ মুখোপাধ্যায় ‘ধর্ম’ আর ‘অধর্ম’-এর বিভাজনরেখায় পা রেখে হাঁটেন, কিন্তু সেই রেখাকে অপরিহার্য মানেন না—বরং প্রশ্ন তোলেন: এই রेखার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা আসলে কাদের গল্প শুনি, আর কাদের গল্প চেপে যাই?

এই আখ্যানও তাই মহাভারতের ���তোই বহুবর্ণ, বহুস্বরে বলা—তবে তা ঈশ্বরের মুখ নয়, মানুষের মুখে শোনা যায়। আর এই শোনাটাই আমাদের বাধ্য করে নিজেকে প্রশ্ন করতে—আমরাও কি এই যাত্রাপথের কোনো এক প্রবাহে ভেসে যাচ্ছি না?

“कालो हि दुरतिक्रमः”—কাল অনতিক্রম্য। মহাভারতের এই চিরন্তন স্মরণ যেন এই উপন্যাসেও প্রতিধ্বনিত হয়, যেখানে সময় কেবল কাঁটা ঘোরায় না, সে নদীর মতো বয়, মনোরাজ্যের ভেতর দিয়ে, স্মৃতির গুহায় ঢুকে, আত্মপরিচয়ের ভাঙন ধরে।

নদী যেমন কখনো একই জলে দ্বিতীয়বার স্নান করতে দেয় না, তেমনই সময়ও নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে না। উপন্যাসের ভাষা, তার ছন্দ, তার দ্বিধা—সব মিলিয়ে যেন এক প্রবাহ, যেখানে পাঠক শুধু দেখে না, ভেসেও যায়। আর সেই ভেসে যাওয়াটা আমাদের বাধ্য করে ভাবতে—এই যে কালের স্রোত, এই যে কথার তরঙ্গ—আমরাও কি এরই অদৃশ্য টানে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছি না?

শেষে একটাই কথা বলা যায়—এই উপন্যাসকে ‘অন্যরকম’ বলা কম বলা হবে। বরং বলা উচিৎ, এটা এমন এক পাঠ—যা পাঠককে বদলে দেয়।

আর এখানে ব্যক্তিগত কথাও বলা দরকার—সৌরভ মুখোপাধায়কে আমি চিনি, এবং সেই পরিচয় আমার এই পাঠ-অভিজ্ঞতাকে আরও এক স্তরে পৌঁছে দেয়। একমাত্র সেই লেখকেরাই এমন সাহস দেখাতে পারেন, যাঁরা simultaneously অভিজ্ঞ যাত্রী ও অন্বেষী নাবিক—সৌরভ দা তেমনই একজন।

একজন লেখক হিসেবে তিনি যেমন সাহসী, তেমনই সংবেদনশীল; যেমন ভাষার কারিগর, তেমনই চিন্তার একনিষ্ঠ সাধক। শব্দ দিয়ে জগত গড়ে তোলা তো সহজ নয়—কিন্তু তিনি সেই কঠিন কাজটিই বারবার করেন, স্থির হাতে, সজীব হৃদয়ে। প্রথম প্রবাহ তাই কেবল একটি উপন্যাস নয়, তাঁর লেখকসত্তার একটি দীপ্ত, পরিণত স্বাক্ষর।

পাঠক হিসেবে আমি কৃতজ্ঞ—এই অভিজ্ঞতায় শরিক হতে পেরে। আর একজন বন্ধু হিসেবে—অপরিসীম গর্বিত।

অলমতি বিস্তরেণ।
Profile Image for Trina Sengupta.
53 reviews
November 2, 2021
মহাভারত,সে যত খন্ড চিত্রেই তাকে ধরা হোক না আমায় বিস্মিত করে,ভাবায়৷এই অদ্ভুত মহাকাব্য নিয়ে পৃথিবীতে যত সহস্র ব্যাখ্যা আছে,মনে হয় পড়ে শেষ করি এ জন্মে (অসম্ভব যদিও)৷
শুরু থেকে মাঝ বরাবর অবধি বিষয় পুনরাবৃত্তি,শ্লথ গতি প্রায় তিন (মোটামুটি) স্টারে এনে ফেলছিল উপন্যাসটিকে৷তবু শেষ অবধি "মহাভারত" এর অনুবীক্ষণ বলেই চার দিয়ে ফেলা গেল৷
Profile Image for Sankar Nath Bhadra.
18 reviews4 followers
July 22, 2020
সবচেয়ে অদ্ভুত উপলদ্ধি হলো গোটাকথনে সবচেয়ে বেশি মানুষ একজন দেব, তাও তিনি গজমস্তক। বাকি যে চরিত্ররা নিজনিজ ফিকশন আঁকড়ে প্রায় অতিমানব হওয়ার চেষ্টায়। স্বয়ং কথক ব্যাসও। এ যেন আমার চেনা ক্রিপ্টনপুত্র আর বাকি লীগের গল্প। এক ডেমিগডই সবচেয়ে বেশি মানুষ। আর মানুষরা তাদের গল্প নিয়ে, ধারণা নিয়ে, ভয় নিয়ে হয়ে ওঠে ন্যায়, তেজ বা আলোর একএকটি আইকন।
তবে আমার জ্ঞান আর বোধ নিয়ে মহাভারতের ব্যাখ্যা বা সমান্তরালে নাই বা গেলুম। যা পেলুম তার কথা হোক:

ভাষা; শুধু অপ্রচলিত শব্দ নয়, প্রথমে ডিকশনারিইন্সটল ও পরে ধুত্তোরি হয়ে পড়ে যাওয়া তো আছেই কিন্তু তা পেরোতে পারলে আছে হাল্কামাটনঝোলের গদ্য। নলীহাড়, পাঁজরচ্যাপ্টাহাড়, শক্তহতাশগ্রন্থীহাড় তো আছেই কিন্তু তুলতুলে আর চর্বি-পেঁয়াজের উম্মম টেনে নিয়ে আমায় একদিনে গোটাটা মস্তিষ্কোদরে চালান হয়েছে।

স্বাধীনতা; নিশ্চয়ই আমি মূল বা শাখামূল মহাভারত পড়িনিই বলা যায়, তাই কোনটি স্বাধীনতা কোনটি নয়, আমি বলতে পারিনা, তবে নদীতে ভাসমান ভুর্জপত্র দেখে যা যা মনে হয়েছে তা সবই গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত। সত্যবতী-ভীষ্মের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ বা শেষ সাক্ষাৎ, চিত্রাঙ্গদমৃত্যুরহস্য বা ভীষ্মের রাজী হওয়া। গঙ্গাপুত্রের যুক্তিশর যখন সিনে'মা' বর্ম ভেদ করে সত্যি বলছি মাথা আমিও নিচু করে ফেলেছিলুম।

প্রচ্ছদ; ইতিউতি বা লেখক নিজেও মনে পড়ে যেন দেখেছি প্রচ্ছদের ওপর খড়গহস্ত, কিন্তু আমার প্রচ্ছদটি দারুন লেগেছে। ভাষা আর বিষয়ের মতই, আনেপলোজেটিক। গাঢ় লালের মধ্য থেকে ক্ষীণসাদায় আঁকা দেহ, যেন প্রকট আর উচ্চকিত ভীষ্মচরিত্রের মধ্যে জেগে ওঠা সত্যবতী। পরিধান উদ্দেশ্যনিয়োজিত, গল্পের মূল চরিত্রের মতই। ভঙ্গী অমার্জিত আর আড়ষ্ট, সত্যবতীর বাহির আর ভেতরের মত।

এইবার ভাল না লাগা:
ফোরশ্যাডোইং; সত্যবতীর রাজঅলিন্দ কল্পনা।

প্রকৃতির সমাপতন; মন বিক্ষুব্ধ হলেই আকাশে ঝড় বা বৃষ্টি এরকম আবহ সৃষ্টিতে আমার ব্যক্তিগত এলার্জি আছে।

কুঁড়েমি; বইয়ের ইনসাইড ফ্ল্যাপে আর পশ্চাৎপ্রচ্ছদে একই লেখা দেখে কুঁড়েমির গন্ধ পেলুম।
---
আর কি, পেলে পড়ে ফেলুন, এমন বই ক্ষিদে বাড়িয়ে দেয়। বানান আর ব্যাকরণ ভুল ধরিয়ে দিলে আপনাদের রোববারের মাটনে নুন ঠিকঠাক হবে।
Profile Image for Mrinmoy Bhattacharya.
225 reviews32 followers
July 24, 2020
প্রথমেই বলি, এটি সম্পূর্ণভাবে একটি প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক উপন্যাস । মহাভারতের ‛আদি পর্ব’কে দারুণ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই উপন্যাসে ।

মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব‍্যাস এই মহান উপাখ‍্যানের শ্লোক রচনা করেছেন এবং পার্বতীনন্দন গণেশ তা লিপিবদ্ধ করেছেন । লিখতে লিখতে গণেশ বুঝতে পারেন অনেক অসহনীয় নির্মম সত‍্য লিপিবদ্ধ হয়েছে । তাই তিনি বেদব‍্যাসকে অনুরোধ করেন রচিত অংশের কিছু পাতা বর্জন করে সহনীয় রূপ দিতে । বেদব‍্যাস কিছু পাতা নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন এবং আবিষ্ট কন্ঠে বললেন - “...এই যে কয়েকটি পৃষ্ঠা বর্জিত হল, বহু যুগ পরে কোনো আখ‍্যাতা তার আশ্চর্য কল্পনায় ভর করে সেগুলিই আবার বিবৃত করে ফেলবেন ।”

অপ্সরা তনয়া সত‍্যবতী, পালিত হয় ধীবরের ঘরে । নদীর ধারে অস্ত্র‍্যাভ‍্যাস করতে আসা যুবরাজ দেবব্রতর প্রতি তিনি অনুরক্ত হয়ে পড়েন । কিন্তু আর্যরক্তজাত দেবব্রত অনার্য সত‍্যবতীকে প্রত‍্যাখ‍্যান করেন । এই প্রত‍্যাখ‍্যানই গোটা ভারত-কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয় । প্রতিহিংসাপরায়ণা সত‍্যবতী হস্তিনাপুরের রাজপরিবারে নিজের দাস‍রক্ত প্রবাহিত করার জন্য যা করেন, তা পড়তে পড়তে শিহরিত হয়ে উঠতে হয় ।

এই উপন্যাসে সত‍্যবতীর চরিত্রের যে দৃঢ়তা, জেদ এবং একাগ্রতা লেখক দেখিয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার । শেষে সত‍্যবতীর পরিণতির বর্ণণা পড়তে গিয়েও চোখ ভিজে আসে । “আর তিনি ভারত রাজনীতির নিয়ন্ত্রনকারিনী নন, জরাগ্রস্ত ন‍্যুব্জ শরীরে প্রাসাদের একটি কোণে দিন কাটে অবহেলায় । ‘যে প্রাসাদে গর্বোদ্ধত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যুবতী রাজ্ঞী একদা বহুযুগ আগে প্রবেশ করেছিলেন, সেই প্রাসাদ থেকে নতশির উপেক্ষিতা বৃদ্ধার ম্লান নিস্ক্রমণেই প্রকৃত সমাপ্তি ।’”

পিতার জন্য কাতর দেবব্রতকে আমরা সবাই দেখেছি, কিন্তু মায়ের জন্য কতটা আকুল ছিলেন তিনি?
এই উপন্যাসে দেবব্রত চরিত্রটিকে এক অনণ‍্য উচ্চতায় উপস্থাপিত করা হয়েছে ।

সুপরিকল্পিত শব্দচয়ন এবং সমাপ্তিহীন পরিসমাপ্তি এই দুটি বিষয়ের জোরেই তরতর করে এগিয়েছে এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাস । লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য লেখনী এবং নিজস্ব যুক্তির নির্মাণ এই মহাকাব‍্য-নির্ভর উপন‍্যাসটিকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে ।
Profile Image for Poulami Chakraborty.
29 reviews1 follower
May 14, 2024
নাম : প্রথম প্রবাহ
লেখক : সৌরভ মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনা : মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনী

সম্প্রতি পড়া শেষ করলাম সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস প্রথম প্রবাহ। বহুলচর্চিত এই উপন্যাসের ভাষার গঠনশৈলী খুবই মনোমুগ্ধকর এবং সুখপাঠ্য। এমন অসাধারণ লেখনীর পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা অতি কঠিন। সংক্ষেপে পাঠ অনুভূতি ব্যক্ত করার চেষ্টা করছি।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারত। মহাভারতে সাধারণ সুখ-দুঃখ, উচিত্য-অনৌচিত্য প্রভৃতি অনুভূতির মানদণ্ড অচল। এমনই বিচিত্র এই মহাকাব্য যে এখানে পাপপুণ্যের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই জন্যেই অনায়াসে দেবী গঙ্গার পুত্রঘাতী চরিত্রকেও অষ্টবসুর অভিশাপের অবসান হিসাবে মহিমান্বিত করা যায়। আবার রাজমাতা সত্যবতীর প্রথম পুত্র চিত্রাঙ্গদ যখন মারা গেল, তখন স্বয়ং রাজমাতা সত্যবতীই সেই পুত্রের প্রকৃত হত্যাকারী কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
গল্পের শুরু মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস এবং মহাভারতের লিপিকার পার্বতীনন্দন বিনায়ককে নিয়ে। বিনায়ক এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়নের কথোপকথন এই উপন্যাসের খুব আকর্ষণীয় বিষয়। বিশেষ করে সেই অংশে শিহরণ জাগে যখন বিনায়ক স্বগতোক্তি করেন দেবব্রতর আগে শান্তনুর বাকি সাতজন সন্তানের অকালমৃত্যু বিষয়ে। সেই মতামত এককথায় বিতর্কিত হলেও সেই বিশ্লেষণ অভুতপূর্ব এবং যৌক্তিক যা আমাদের মহাকাব্যটিকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার অবকাশ প্রদান করে।
প্রথম প্রবাহ গ্রন্থটির নায়ক এবং নায়িকা উভয়েই হল সত্যবতী। ধীবরকন্যা সত্যবতীর প্রকৃত জন্মরহস্য দিয়েই উপন্যাসটি শুরু হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে তার মনোজগতের বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত উন্মোচিত হয়েছে। যখন সত্যবতী জানতে পারলো যে সে ধীবরকন্যা নয়, উপরন্তু সে রাজবংশজাত, তখন সে আত্মসচেতন হল এবং এই আত্মসচেতনাকে কাজে লাগিয়েই কিভাবে সে তার স্বার্থসিদ্ধি করলো সেই নিয়েই এই উপখ্যান।
উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু ভীষণভাবে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। সত্যবতী, যাকে স্বয়ং পরাশর মুনি কামনা করেছিলেন তাকে যখন দেবব্রত প্রত্যাখ্যান করেন তখন তখন তার মানসিক অবস্থা, মৎস্যগন্ধা থেকে যোজনগন্ধা হয়ে ওঠার কাহিনী, এবং অতি সুকৌশলে কুরু রাজবংশে প্রবেশ করার কাহিনী প্রত্যেকটি কাহিনী বারবার পড়তে ইচ্ছা করে। আবার বিপরীত দিকে আমরা জানি দেবব্রত যে ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে ভীষ্ম নামে অভিহিত হন তা কি প্রকৃতপক্ষে ওনার ত্যাগস্বীকার, নাকি এই আপাত ত্যাগস্বীকারের উদ্দেশ্য ছিল আসলে আর্যসমাজে নিজের মহিমাকে ছড়িয়ে দেওয়া? দেবব্রতর সত্যবতীকে মাতা হিসাবে সম্বোধন করার মধ্যেও কি ছিল কি গভীর প্রতিহিংসাবোধ যে প্রতিহিংসাবোধ দিনের পর দিন আসলে কুরে কুরে আহত করেছিল সত্যবতীর অহংবোধকে ? হয়তো দেবব্রতর আপাত ক্ষুদ্র কোনও স্বার্থত্যাগই সৃষ্টি করেছিল এই বিশাল মহাকাব্যিক ইতিহাস...
উপন্যাসটির মধ্যে যে আখ্যানগুলি রয়েছে, সেই প্রত্যেকটি আখ্যান নবচেতনার উন্মেষ ঘটায়, কিছু কিছু ধারণা বিতর্কের সৃষ্টি করে, তেমনই উন্মেষ ঘটায় প্রাচীন মহাকাব্যিক চেতনার উন্নত নবনির্মাণের। ধরে নিতে পারি মহাকাব্য রচনার সময় বিশেষ কয়েকটি ভুর্জপত্র নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল। এই ভেসে যাওয়া ভুর্জপত্রগুলিকে যখন পাওয়া গেল তখন সেগুলিকে একত্রিত করে চেষ্টা করা হল মহাকাব্যের পরিচিত কাহিনীর নবনির্মাণকরণের। অথবা এমনও হতে পারে যে হারিয়ে যাওয়া ভুর্জপত্রগুলিতে যে কাহিনী লেখা ছিল তা এতটাই নির্মম, এতটাই করুণ ছিল যে বাধ্য হয়ে সেই কাহিনীকে পরিমার্জিত করা হয়েছিল, যে পরিমার্জিত কাহিনীকে আমরা মূল মহাভারত হিসাবে গণ্য করি। প্রথম প্রবাহের কাহিনী নির্মাণে এরকম অনেক সম্ভাবনা থেকে যায়।
এককথায় বলতে পারি এই গ্রন্থ বারবার পড়া যায়, এই গ্রন্থকে সংগ্রহ করা যায় এবং এই গ্রন্থের প্রতিটি চেতনাকে আত্মস্থ করা যায়। এই গ্রন্থ যুগান্তকারী এবং বাংলা সাহিত্যের জগতে একটি বিশেষ মাইলফলক হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধারণ করে। সর্বোপরি এই উপন্যাসটি পাঠ করার পরে পাঠক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার দিক থেকেও সমৃদ্ধতর হবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পরিশেষে লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায়কে আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং প্রণাম জানিয়ে এই পাঠ অনুভূতি লেখা শেষ করলাম।
Profile Image for Pratik Kumar Dutta.
85 reviews1 follower
July 24, 2025
মহাভারত' শব্দটি বাংলা সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে হীরের খনির মত। কত কি যে অজানা, অদেখা রয়ে গেছে এর মধ্যে তা সত্যি আমাদের ধারণা নেই। মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লেখক-লেখিকার কলমে জন্ম হয়েছে বিভিন্ন উপন্যাসের। পাঠক মহলে সেই সব উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছে 'মহাভারত আশ্রিত উপন্যাস' হিসাবে। লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'প্রথম প্রবাহ' সেই ঘরানারই এক অনবদ্য পরিবেশন। বেদব্যাস ও বিনায়কের কথোকপথন দিয়ে শুরু এই উপন্যাস ধীরে ধীরে এগিয়েছে মূল কাহিনীর দিকে। আবির্ভাব হয়েছে বেশ কিছু নতুন চরিত্রের। শান্তনু, অম্বা, দেবব্রত ও সত্যবতীর সাথে সাথে কাহিনীতে দেখা গেছে নতুন কিছু মোড়, যা একঝটকায় বদলে দিয়েছে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ধ্যানধারণাকে। সময়ের সাথে সাথে কাহিনী যত এগিয়েছে, সম্পর্কের জটিলতা আর কূটনীতি ততই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে কাহিনীকে। আবির্ভাব হয়েছে নতুন নতুন চরিত্রের, অপেক্ষা করে থেকেছে নতুন কোনও চমক। পৃথিবীর প্রাচীন মহাকাব্যকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠা এই উপন্যাস পরিপুষ্ট হয়েছে লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের ভাবনা ও কল্পনার মাধ্যমে। মহাভারতের একটি অনধিক চর্চিত অধ্যায়কে লেখক তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে পাঠকের সামনে নিবেদন করেছেন নতুন এক মোড়কে। তাই মহাকাব্য আশ্রিত উপন্যাসের পাঠককুল এই 'প্রথম প্রবাহ' উপন্যাসকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে আপন করে নিতে কোনও কার্পণ্য করেননি।
Profile Image for Arijit Ganguly.
Author 2 books30 followers
May 15, 2023
অবশেষে পড়লাম বহুল আলোচিত ও কিছুটা বিতর্কিত এই প্রাপ্তমনস্ক উপন্যাস। একে ঘিরে অসংখ্য পাঠপ্রতিক্রিয়া আর সমালোচনার ভিড়ে নিজের নাম আর যোগ করতে চাই না। শুধু বলব এখনো পড়া না থাকলে শুরু করে দিন। সৌরভবাবুর কলমের যাদুতে কখন শেষপাতায় পৌঁছে যাবেন, টের পাবেন না। পড়ার সময় গল্পের সত্যতা বা ঘটনাপ্রবাহের ন্যায্যতা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে আমার মতো। কিন্তু লেখক এক অসাধারণ কৌশলে যবনিকা পতন করেছেন শেষে, সব প্রশ্নের উত্তর সেখানেই পেয়ে যাবেন।

বই ~ প্রথম প্রবাহ
লেখক ~ সৌরভ মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক ~ মিত্র ও ঘোষ
ফর্ম্যাট ~ হার্ডকভার
প্রচ্ছদ ~ ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
পাতার সংখ্যা ~ ১৭৫
মুদ্রিত মূল্য ~ ২০০ টাকা
Profile Image for SOUROV DUTTA.
69 reviews2 followers
March 26, 2023
মহাভারতে যে প্রবাহ চলেছিল অষ্টাদশ পর্ব ধরে, বা আজও চলছে, তার প্রথম প্রবাহ আজ প্রত্যক্ষ করলাম। দেবব্রত শেষ পর্যন্ত যে সত্যবতী মধ্যেই তার হারানো মাকে খুঁজে পেল সেটাও প্রত্যক্ষ করা গেল। আর দেখা গেল ইতিহাসের চাকাকে জোর করে ঘোরাতে গেলে, চাকাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কাল নয়। কাল তার নিজের অমোঘ নিয়মেই ঘুরে চলে। মহান কুরু বংশ যার শুরুও একটা ভুল থেকেই। সেটা আস্তে আস্তে একটা সমরাঙ্গন তৈরি হয়ে গেল।
Profile Image for Sudip Das.
4 reviews
November 21, 2023
এই লেখক বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হিসেবে এই বই টিকে ধরাই যেতে পারে। মহাভারতের প্রারম্ভিক ঘটনাকে যে দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যে মুন্সিয়ানার সঙ্গে উনি লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তা অনবদ্য। উচ্চমানের সাহিত্য যারা পছন্দ করেন তাদের জন্য অত্যন্ত সুখপাঠ্য।
Profile Image for Bornik C.
103 reviews
January 5, 2021
প্রথম প্রবাহ উপন্যাসটি সৌরভ বাবুর দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। এটিতে মহাভারতের আদি পর্বের গল্পটিকে নতুন প্রাপ্তমনস্ক রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
এই উপন্যাসের সূত্রধর গজানন ও বেদব্যাসের কথোপকথন। এটিতে প্রধানত বর্ণিত হয়েছে সত্যবতী ও দেবব্রতের মনস্তাত্বিক ক্রীড়া বা দ্বন্ধ যা মহাভারতের মূলগতি পথ বারবার পরিবর্তন করে গিয়েছিলো।
আমার পড়ে বেশ ভাল লেগেছিলো।
Profile Image for Swarnil.
63 reviews
September 22, 2019
এই উপন্যাস পড়লে সর্বপ্রথম যে কথাটা মাথায় আসে তা হলো "মহাভারতের" ব্যাপ্তি ... এত বছর পরও মানুষকে ভাবাচ্ছে এবং লেখার উপাদান যুগিয়ে যাচ্ছে.. ভীষ্মকে এখানে নায়কের চরিত্র দেওয়া হয়েছে...তিনি মানুষ থেকে মানুষ-উত্তর চরিত্রে উন্নীত হয়েছেন তার ত্যাগ ও তিতিক্ষার জন্য...কিন্তু মূল কাহিনীর গতি নির্ধারণ করছেন একজন নারী চরিত্র-সত্যবতী..নিয়তির বাধা ভেঙে যিনি ইতিহাসকে নিজের খুশি মতো চালিত করছেন এই উপন্যাসে..তার প্রতিশোধের আগুনে ছারখার হয়ে যাচ্ছেন ভীষ্মের মতো মহামতি

উপন্যাসটি লেখকের কল্পনার ও তার লেখার কায়দায় অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে...
তবু দুটি কথা বলতেই হয় একটি তারা কেটে নেওয়ার কৈফেয়ৎ স্বরূপ
1>বিষয়বস্তু ভীষণ সম্ভাবনাময় ছিল তাই আমি আরেকটু বেশি আশা করেছিলাম..কাহিনীর যেনো মাঝখানেই ছেদ পড়েগেলো..সত্যবতী ও ভীষ্ম এক ছাদের তলায় ছিলেন বহু বছর সে ক্ষেত্রে তাদের কথোপকথনে আরেকটু কল্পনার রং কি লাগানো যেত না...কারণ প্রত্যাশা অনুযায়ী খুব একটা বেশি কিছু পেলাম না...
2>যৌনতা এর এক অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ তাই তাকে বাদ দেবার প্রশ্নই উঠতেপারে না...কিন্তু এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ কি প্রয়োজন ছিল

শেষে অবশই বলবো যারা এখনও পড়েন নি, তারা অবিলম্বে ত্রুটি-সংশোধন করুন...
Profile Image for Rajib Majumder.
135 reviews6 followers
November 10, 2024
প্রায় বছর খানেক ধরেই পড়ার ইচ্ছে ছিল। তারও আগে বই আউট অফ প্রিন্ট থাকায় বইই জোগাড় হচ্ছিল না। নতুন বই হতে পেয়েও ধুলো খেল কত দিন। অবশেষে শুরু করেই শেষ করে ফেললাম অসাধারণ এই উপন্যাস।
কথক কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, লিপিকার লম্বোদর, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম আর এই উপন্যাসের নায়িকা সত্যবতীর কী অদ্ভুত চরিত্রচিত্রণ। রেশ থেকে যাবে বহুদিন।
Displaying 1 - 18 of 18 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.