ভূমিকা আমি আমার গ্রন্থের নামকরণে অনেকবার কবিদের কাছে হাত পেতেছি। এবার হাত পাতবার আগেই নাম পেয়ে গেলাম। কবি নির্মলেন্দু গুন পান্ডুলিপি পড়ে নাম দিলেন- গৌরীপুর জংশন। তাঁকে ধন্যবাদ।
হুমায়ূন আহমেদ ৭-৫-৯০ শহীদুল্লাহ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Humayun Ahmed (Bengali: হুমায়ূন আহমেদ; 13 November 1948 – 19 July 2012) was a Bangladeshi author, dramatist, screenwriter, playwright and filmmaker. He was the most famous and popular author, dramatist and filmmaker ever to grace the cultural world of Bangladesh since its independence in 1971. Dawn referred to him as the cultural legend of Bangladesh. Humayun started his journey to reach fame with the publication of his novel Nondito Noroke (In Blissful Hell) in 1972, which remains one of his most famous works. He wrote over 250 fiction and non-fiction books, all of which were bestsellers in Bangladesh, most of them were number one bestsellers of their respective years by a wide margin. In recognition to the works of Humayun, Times of India wrote, "Humayun was a custodian of the Bangladeshi literary culture whose contribution single-handedly shifted the capital of Bengali literature from Kolkata to Dhaka without any war or revolution." Ahmed's writing style was characterized as "Magic Realism." Sunil Gangopadhyay described him as the most popular writer in the Bengali language for a century and according to him, Ahmed was even more popular than Sarat Chandra Chattopadhyay. Ahmed's books have been the top sellers at the Ekushey Book Fair during every years of the 1990s and 2000s.
Early life: Humayun Ahmed was born in Mohongonj, Netrokona, but his village home is Kutubpur, Mymensingh, Bangladesh (then East Pakistan). His father, Faizur Rahman Ahmed, a police officer and writer, was killed by Pakistani military during the liberation war of Bangladesh in 1971, and his mother is Ayesha Foyez. Humayun's younger brother, Muhammed Zafar Iqbal, a university professor, is also a very popular author of mostly science fiction genre and Children's Literature. Another brother, Ahsan Habib, the editor of Unmad, a cartoon magazine, and one of the most famous Cartoonist in the country.
Education and Early Career: Ahmed went to schools in Sylhet, Comilla, Chittagong, Dinajpur and Bogra as his father lived in different places upon official assignment. Ahmed passed SSC exam from Bogra Zilla School in 1965. He stood second in the merit list in Rajshahi Education Board. He passed HSC exam from Dhaka College in 1967. He studied Chemistry in Dhaka University and earned BSc (Honors) and MSc with First Class distinction.
Upon graduation Ahmed joined Bangladesh Agricultural University as a lecturer. After six months he joined Dhaka University as a faculty of the Department of Chemistry. Later he attended North Dakota State University for his PhD studies. He grew his interest in Polymer Chemistry and earned his PhD in that subject. He returned to Bangladesh and resumed his teaching career in Dhaka University. In mid 1990s he left the faculty job to devote all his time to writing, playwright and film production.
Marriages and Personal Life: In 1973, Humayun Ahmed married Gultekin. They had three daughters — Nova, Sheela, Bipasha and one son — Nuhash. In 2003 Humayun divorced Gultekin and married Meher Afroj Shaon in 2005. From the second marriage he had two sons — Nishad and Ninit.
Death: In 2011 Ahmed had been diagnosed with colorectal cancer. He died on 19 July 2012 at 11.20 PM BST at Bellevue Hospital in New York City. He was buried in Nuhash Palli, his farm house.
গল্পটি অন্যান্য গল্পের মত পরিষ্কার না। এন্টারটেইনিং ও না। গৌরীপুর জংশন লেখক হুমায়ুন আহমেদের অন্যতম পরিপক্ক লেখা। গল্পটি প্রথম প্রথম অনেকের কাছেই হয়ত সাদামাটা মনে হবে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় গল্পের গভীরতা অনেক বেশি। আমাদের চোখের সামনে নিয়মিত ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা যা আমরা কখনও দেখলেও লক্ষ্য করি না। অথচ লেখক সেই ছোট ছোট ঘটনাগুলোকেই নিয়ে এসেছেন তাঁর এই উপন্যাসে।
মূল চরিত্র চল্লিশ বছরের কুলি জয়নাল, যে এক দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গু হয়ে যায়।তার দিন চলে যাত্রীদের মালামাল চুরি করে।একদিন দশ বস্তা চিনি চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় জয়নালের কাছের মানুষ মালবাবু,ফেরারী হয়ে যায় কুলি সর্দার হাশেম,দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয় লাইনম্যান রমজান।ঠিক কি কারণে জয়নালের চেনা মানুষগুলোর এই বদল?জয়নালের জীবনে দেহপসারিনী অনুফার ভূমিকা কি?জয়নালকে ঘিরে পতঙ্গের ওড়াউড়ি বলতে লেখক কি বুঝিয়েছেন?
গল্প অসমাপ্ত রাখা হুমায়ূন আহমেদের পুরনো স্বভাব।তবে সেখানেও কিছু ইঙ্গিত বা পরিণতির আভাস থাকে। "গৌরীপুর জংশন" এর কাহিনি লেখক আক্ষরিক অর্থেই মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছেন।এতো চমৎকারভাবে এগোচ্ছিলো গল্পটা!!
গৌরীপুর জংশনের রক্ত মিশে আছে আমার রক্তে। আজ আবার তৃতীয়বারের মতো পড়লাম প্রিয় লভেলেট।
হুমায়ূনের সেরা লভেলেট আমার জন্মস্থান-আড্ডাস্থান 'গৌরীপুর জংশন' যার সাথে মিশে আছে আমার পাওয়া না পাওয়ার আশৈশব গল্প, বিরহ-বেদনার গল্প, যন্ত্রণা আর আনন্দের গল্প। আত্মহত্যার গল্প। তাহার গল্প।
আবার যখন আমার জন্মস্থান গৌরীপুর যাব তখন ১০ কপি নিয়ে যাব গৌরীপুরের স্কুলের বন্ধু আর স্যারদের জন্য।
বিঃদ্রঃ আমাদের গৌরীপুরের অন্য নাম 'রাজগৌরীপুর'
১৪ আগস্ট, ২০২৩ .
আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনকাল যে জংশনে আড্ডা দিয়ে কেটেছে সে জংশন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় বই। আমার জন্মস্থান গৌরীপুর নিয়ে আমার হাজারো স্মৃতি রয়েছে; গৌরীপুরের সেরা দুষ্টু ছেলে বলে কথা। আমার শহরের স্মৃতিগুলো আমায় হাসায়-কাঁদায়। আমার ভালোবাসার শুরু এবং শেষ গৌরীপুর জংশন।
উপন্যাসটি মূল চরিত্রের থাকা চল্লিশ বছরের কুলি জয়নাল, যার একটা দুর্ঘটনায় এক পা প্রায় পঙ্গু হয়ে যায়। যাত্রীদের মালামাল চুরি করেই তার দিন চলতে থাকে। জয়নাল কে একদিন দশ বস্তা চিনি চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হয়, হারিয়ে যায় কুলি সর্দার হাশেম, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে যায় লাইনম্যান রমজান। কেনই-বা জয়নালের চেনা মানুষগুলোর এই বদল? জয়নালের জীবনে দেহপসারিনী অনুফার ভূমিকা কি? জয়নালকে ঘিরে পতঙ্গের ওড়াউড়ি বলতে লেখক কি বুঝিয়েছেন?
জীবনে অনেক বই পড়েছি কিন্তু কোন বই এত গভীরভাবে অনুভব করি নাই। হয়তো আমার জন্মস্থান, শিকড়ের পটভূমিতে লেখা বলেই আমি এতটা অনুভব করতে পেরেছি। তবে যারা একেবারে বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে পারেন তাদের কাছে এই বইটা অসাধারণ অনেক অনুভূতি দেবে।
বইটির কাহিনী গড়ে উঠেছে এক রেলস্টেশন 'গৌরীপুর জংশন' কে কেন্দ্র করে। স্টেশনের নিঃস্ব অসহায় মানুষদের জীবন যাপন তাদের চিন্তা-চেতনা কে খুব গভীর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে হুমায়ূন আহমেদ 'গৌরীপুর জংশন' বইটিতে।
জয়নাল নামক কুলির আড়াইশো টাকা চুরি তারপর সেই টাকা দিয়ে তার ইচ্ছে পূরণ, কি অসাধারণ না ছিল সেই মুহূর্তগুলো। গৌরীপুর জংশনে কুলি জয়নাল, কুলি সরদার, স্টেশন মাস্টার, অসহায় শিশু বজলু, চা বিক্রেতা পরিমলদা, অনুফা, ওসি, ভিক্ষুক সর্বশ্রেণীর মানুষকে নিয়ে একটি স্টেশন কেন্দ্রীক যে অসাধারণ কাহিনীটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা আসলেই মনমুগ্ধকর ও গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়।
আমি নিজে গৌরীপুরের ছেলে হিসেবে পুরো বইটার মধ্যে মনে মনে জয়নালের চরিত্রে ডুবে গিয়েছিলাম। জীবনের প্রথম কোন বই এত গভীরভাবে অনুভব করেছি। সত্যিই আমি এই বইটার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন। গৌরীপুর জংশন এর অবস্থা ঠিক আগের মতো নেই, এখন অসহায় মানুষ, কুলি পাওয়াও ভার। বইটি যতক্ষণ পড়েছি ততক্ষণ আমি গৌরীপুর জংশনে জয়নালের সাথে ঘোরাঘুরি করেছি।
বইটি আমাকে অসাধারণ একটি মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। আমি চলে গিয়েছিলাম সেই শৈশবে যখন স্কুল ফাঁকি দিয়ে গৌরীপুর জংশনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতাম। আমি ফিরে গিয়েছিলাম সেই সময় যখন একটা মেয়ের জন্য গৌরীপুর স্টেশনে আমি রাত কাটাতাম, গৌরীপুর জংশনে সেই ভোর দেখতাম, ঠিক যেমন এই গল্পে ভোর দেখানো হয়েছে।
হয়তো কোন একদিন গৌরীপুর জংশন কে কেন্দ্র করে আরেকটি বই লেখা হবে। সেই বইটি হয়তো গৌরীপুরের কোন একটি ছেলে লিখবে, সে তার গৌরীপুরকে ভীষণ ভালোবাসে। সে বইটিও হয়তো অনেকগুলো ভাষায় অনূদিত হবে, মানুষের মনে ভীষণভাবে নাড়া দেবে।
গৌরীপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি রেলওয়ে স্টেশন।
নাম দেখে খুব সহজেই ধারণা করা যায় থিমটা কি। রেললাইনের আশে পাশেই কত মানুষের ঘর সংসার সাজানো, কত শত মানুষের জীবন আর জীবিকা নির্ভর করে আছে এই স্টেশন ঘিরে। এমন কিছু মানুষকে কেন্দ্র করেই গৌরীপুর জংশনের চলাফেরা। এই নিম্নবিত্ত মানুষগুলোও অন্তরে পুষে রাখে গভীর মায়া-মমতা, রাগ করতে গিয়েও রাগ পড়ে যায়। আবার এদের মধ্যেই রয়েছে কত নিষ্ঠুর মানুষ, কত্ত ঠগ আর প্রবঞ্চক।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস “গৌরীপুর জংশন” আশির দশকের একেবারে শেষ ভাগে রচিত। উপন্যাসের পটভূমি একটি ছোট রেল স্টেশন। স্টেশন-জীবনের প্রতিদিনকার বাস্তবতাই এ উপন্যাসের নায়ক। ছোট ছোট নানা ঘটনা উপন্যাসটির রচনাকালের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছে দারুণ। ভালোবাসা, মায়া, দুঃখ-কষ্টের সাথে শঠতা, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা মিলে গৌরীপুর স্টেশনের পাত্রপাত্রীরা এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে যা মধ্যবিত্ত বাঙালির বাস্তবতার সাথে মেলে না। গল্পগুলো চেনা মনে হতে পারে, কিন্তু পুরো পরিস্থিতি এবং পরিবেশ মিলেমিশে এর চরিত্রগুলো ভিন্ন এক জগত নির্মাণ করেছে যা তাদের জন্য স্বাভাবিক। “গৌরীপুর জংশন” মধ্যবিত্তের চোখের সামনে থাকা ভিন্ন এক জগত এবং অন্য এক বাস্তবতার পর্দা উন্মোচন করেছে।
হুমায়ূন আহমেদ বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া বিরল গোত্রের লেখকের একজন। তাঁর প্রায় সকল বই-ই বহুল পঠিত, তবু “গৌরীপুর জংশন” নিয়ে হুমায়ূন-প্রেমীদের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায় না। অনেকের কাছে এটি অপঠিতই থেকে গেছে। ব্যাপারটি বিস্ময়কর, কারণ হুমায়ূন আহমেদ রচিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর একটি “গৌরীপুর জংশন”। এ উপন্যাস নিয়ে পাঠকদের আপাত নীরবতা এটাই নির্দেশ করছে যে, এই উপন্যাসটি চিরায়ত হুমায়ূনীয় ফর্মুলায় রচিত হয় নি। এই উপন্যাসে নেই হিমুর মতো রহস্যময় চরিত্র, কিংবা মিসির আলী সিরিজের মতো আকর্ষণীয় রহস্য। এই উপন্যাসে কেবলই একটি নিভৃত স্টেশনের বসবাসরত নিম্নবিত্তের আটপৌরে জীবন উঠে এসেছে, যা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পাঠকের অচেনা।
“গৌরীপুর জংশন”এর প্রধান চরিত্র জয়নাল। সে গৌরীপুর স্টেশনে বসবাসরত মধ্যবয়সী কুলী, যার যৌবন বিগত এবং ‘এখন যার দশা কোমর-ভাঙা কুকুরের মতো’। চালের বস্তা কোমরে পড়ে কোমর চেঙে যাওয়ার পর কুলীর জীবন ত্যাগ করেছে, কিন্তু স্টেশন ত্যাগ করে নি; কারণ কোথায়ই বা যাবে সে। জয়নাল বর্ণিল একটি চরিত্র। স্টেশনের অন্য সব চরিত্রের মতোই স্বার্থপরতা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান, কিন্তু অনাথ শিশু বজলুর জন্য দয়াময় একটি মনের দেখা পাই আমরা। বজলুকে নিজের সাথে রাখে, খাওয়ায়, জীবনে চলার জন্য নানা উপদেশ দেয়। মালবাবু আর সিগনাল-ম্যান রমজানের সাথে তার বেশ খাতির। নানান সময়ে তারা জয়নালকে নানানভাবে সাহায্য করেছে, জয়নাল এ সত্যটা কখনো ভুলতে পারে না, তাদের জন্য কিছু করার চিন্তা সবসময় তাকে ঘিরে থাকে। জয়নালের চরিত্রে অসদগূণগুলো তার নানা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায়। স্টেশনের পুরনো সর্দার মোবারককে নিগৃহীত হতে দেখে আনন্দ পায়, পুলিশকে মোবারকের নাম বলে দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। কুলী-গিরি ছাড়ার পর মূলত চুরি করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছে সে। ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে চুরি করা ছাড়াও স্টেশনের মালবাবুর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ফেরত দেয় না সে। হুমায়ূন আহমেদ মূলত একজন নিম্নবিত্ত ছিঁচকে চোরের চরিত্র এঁকেছেন যার আছে এক আর্দ্র মন।
“গৌরীপুর জংশন” উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে তৃতীয় পুরুষে। যদিও পুরো গল্প এগিয়েছে জয়নালের দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা ইন্টারেস্টিং। কখনো কখনো তৃতীয় পুরুষ থেকে লাফ দিয়ে প্রথম পুরুষে চলে এসেছেন লেখক। এই রচনাকৌশল ছাড়াও উপন্যাসের ভাষার কাজ পর্যবেক্ষণ করার মতো। হুমায়ূন আহমেদের স্বভাবসুলভ হিউমারে পূর্ণ বর্ণনারীতি তো আছেই, সাথে আছে আঞ্চলিক ভাষার দারুণ সংমিশ্রণ।
নিম্নবিত্তের মনোজগৎ নিয়ে পর্যবেক্ষণের উল্লেখযোগ্য উপাদান আছে আলোচ্য উপন্যাসে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের চরিত্র নিয়ে জয়নালের দর্শন বেশ চমকপ্রদ। তার ভাষায় ওরা ‘ভদ্রলোক’। আমি মনে করি, ভদ্রলোকদের দয়ার উপরে সর্বদা নির্ভর করছে তার আর্থিক অবস্থা, এটা সে কখনো ভুলতে পারে বলেই মনে মনে তাদেরকে আক্রমণ করে আনন্দ খুঁজে পায়। কখনো কখনো সামনাসামনি অপমান করেও বেশ শ্লাঘা অনুভব করে জয়নাল। ভদ্রলোক বিপদে জয়নালের বড় ভালো লাগে। তার ভাষায়, ‘ভদ্রলোক বিপদের পড়ে চোখ বড়ো করে যখন এদিক ওদিক চায়,ফটাফট ইংরেজিতে কথা বলে তখন মজাই লাগে’। হুমায়ূন আহমদের প্রায় সকল পাঠকই মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের কাতারে পড়বে, জয়নালের ভাষায় যারা ‘ভদ্রলোক’। নিম্নবিত্ত এক কুলী তার শ্রেণী সম্পর্কে কী ভাবছে তা জেনে একজন মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের মনে কেমন অনুরণন সৃষ্টি হয় তা চিন্তাভাবনার বিষয় বটে।
“গৌরীপুর জংশন” উপন্যাস হিসেবে মুদ্রিত হলেও এটি মূলত একটি বড় গল্পের চরিত্র ধারণ করে। কারণ এই রচনায় উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমির উপস্থিতি নেই। “গৌরীপুর জংশন” লেখা হয়েছে মাত্র ৪২ পৃষ্ঠায়। এতো ছোট পরিসরে উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমি এবং চরিত্রের উপস্থিতি কোনোভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব না। এর মধ্যে গল্পের প্রথম বারো পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে পটভূমি ও পরিবেশের বর্ণনা এবং চরিত্র উপস্থাপনে। তাছাড়া একটি আদর্শ উপন্যাসে বিভিন্ন ঘটনা ও পরিপার্শ্বের চাপে চরিত্রের যে বিবর্তন ঘটে, তাও “গৌরীপুর জংশন”এ উপস্থিত। তাই আমার মতানুসারে, “গৌরীপুর জংশন” উপন্যাসের মোড়কে একটি সফল বড় গল্প। সার্থক বড় গল্পের অসম্পূর্ণতা, হাহাকারকে ধারণ করেই এর সমাপ্তি ঘটেছে।
গল্পটা কুলি জয়নালকে নিয়ে। জয়নাল আমাকে নচিকেতার জগাইয়ের কথা মনে করিয়ে দিলো। এ পৃথিবীতে জয়নাল বা জগাইদের কষ্ট অনেক কিন্তু সুখগুলো কৃত্রিম না। এরা জীবনের জটিলতাকে সহজভাবে মেনে নিয়েছে নির্লিপ্তভাবে। জীবনের অনিশ্চয়তাকে তারা গ্রহণ করেছে দ্বিধাহীন স্পষ্টতা দিয়ে। নচিকেতার পাগলা জগাই গানের কিছু লাইন শেয়ার না করে পারছি না।
সস্তার মদ খেয়ে ট্রাকের ছাদেতে শুয়ে তারা গুণে ভবঘুরে হেল্পার পাগলা জগাই রাত বলে যাই যাই ডাক দিয়ে যাই …………………. হয়ত মনের কোনে জীবনের সুদ গোনে বেহিসাবী জীবনের হাতে গোনা টাকা আনা পাই রাত বলে যাই যাই ডাক দিয়ে যাই ………………… ফেলা আসা তার গ্রাম আরো কত শত নাম ধূসর পথের ধূলো মেখে তবে কি সেখানে কেউ পথ চেয়ে বসে আজো আখি জলে আলপনা এঁকে জগাই নির্বিকার, আকাশটা চোখে তার পিছু ফিরে দেখা বা ভাবনার নেই কো বালাই রাত বলে যাই যাই ডাক দিয়ে যাই ……………………. কখনো হিংসে হয় অবকাশে অসময় আমিও কি জগাই হতে পারি? আমিও তো তারা গুনি আকাশকে কাছে টানি আমিও কি দিতে পারি পাড়ি?
আসলে তো আমি লোভী, মন ধনে থাকা কবি পারব না হতে আমি হেল্পার মুক্ত জগাই রাত বলে যাই যাই ডাক দিয়ে যাই
ঢাকায় আমার বাসা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের পাশে। ছোটবেলা থেকে রেলস্টেশন দেখে বড় হয়েছি, ট্রেনের শব্দ, স্টেশনের ব্যস্ততা, অবিরাম ছুটেচলা সবকিছু ছোটবেলা থেকে আমার স্মৃতিতে মিশে আছে। গৌরীপুর জংশন আমি দেখিনি। কিন্তু বইটা পড়ার সময় কিশোরগঞ্জের সরারচর স্টেশন কল্পনায় ভাসতেছিলো। আহা! কতো স্মৃতির সেই স্টেশন।
স্টেশনের কুলিদের জীবন ছোটবেলা থেকেই দেখে বড় হয়েছি। ক্লাস সেভেনে থাকার সময় স্টেশন পার হয়ে স্কুলে যাওয়া লাগত, দেখতাম আমার বয়েসী ছেলেরা বিশাল বড়ো বড়ো ব্যাগ, বস্তা, লাগেজ নিয়ে মানুষের পেছনে পেছনে ছুটছে। দেখে কতই না খারাপ লাগতো। কতদিন হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি বোঝার ভারে বাকা হয়ে যাচ্ছে একেকটা ছেলে। আর এজন্যই হয়তো আমার প্রথম লেখা ছিলো একটি স্টেশনের কুলিকে নিয়ে, প্রথম সেই লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো কলেজ ম্যাগাজিনে।
এই গল্পটিও স্টেশনের একজন কুলিকে নিয়ে লেখা। কুলি জয়নাল। তার এ স্টেশনে বড় হয়ে উঠা, জীবনের ক্ষুদ্র চাওয়া ও পাওয়া, হারানোর বেদনা, এক টুকরো ভালোবাসা, জীবনের কিছু মৌলিক এবং দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে নিজেকে একটু বিচলিত রাখা, নিজের অন্যায়ের প্রতি সেলফ জাস্টিফিকেশন করা আবার একইসাথে অন্যের অন্যায়কে তীব্রভাবে বিচার করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে ওঠার পর হলের রুমমেট বড় ভাই সাকিব সালাম ভাইয়ের সাথে প্রথম যেদিন কথা হয় সেদিন উনি বলেছিলেন, বুঝলি পরাণ, আমরা সবাই সুযোগের অভাবে ভালো। এই কথাটা অনেক পুরনো কিন্তু আমি সেদিন প্রথম শুনি এবং ধাক্কা খাই। আমি নিজেও কি সুযোগের অভাবে ভালো? এ প্রশ্ন নিজেকে বারবার করতেছিলাম। কিন্তু বুঝতেছিলাম, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে না হোক, কিছু ক্ষেত্রে আমি সুযোগের অভাবে ভালো। বেশিরভাগ মানুষই জীবনের কিছু না কিছু ক্ষেত্রে সুযোগের অভাবে ভালো। উক্ত গল্পের জয়নাল কুলি কিংবা পাগলা জগাইয়েরা জীবনের কিছু ক্ষেত্রে সুযোগের অভাবে ভালো না, তারা সব সময় সুযোগের অভাবে ভালো। তাদের মাঝে হিপোক্রেসি নেই। আমার মাঝে আছে। হয়তো কিছুটা আপনার মাঝেও আছে।
এরকম অনেক কিছুকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন জয়নালের চরিত্রে। কিন্তু কিসে যেনো একটা অ���ূর্ণতা থেকে গেলো। গল্পটা আরেকটু বড়ো করা যেতো। গল্পের প্লটটা এতো সুন্দর ছিলো! রাশিয়ান কোন লেখক হলে হয়তো ১০০০ পৃষ্টার একটা বই পেয়ে যেতাম। হুমায়ূন আহমেদ বলেই এতো সুন্দর একটা প্লট নষ্ট করতে পারলেন।
দিব্যি আরো বিশ-ত্রিশ পৃষ্ঠা বিস্তার করা যেত উপন্যাসটি। কেন যে এত কার্পণ্য করে লিখতেন বুঝি না। ভালোই তো এগোচ্ছিল, জমে উঠতে উঠতেই ফুরিয়ে গেল। বইটি আমার বইমেলা থেকে কেনা হুমায়ূন আহমেদের প্রথম খোলা উপন্যাস হয়ে থেকে যাবে। সেটাতেই সান্তনা।
" ভদ্রলোকেরা খারাপ কিছুই মুখ দিয়ে বলে না।সব জমা হয়ে থাকে। তাদের জামা কাপড় পরিষ্কার, কথাবার্তা পরিষ্কার,চাল চলন পরিষ্কার আর মনটা অপরিষ্কার।এমনই অপরিষ্কার যে সোডা দিয়ে জ্বাল দিলেও পরিষ্কার হবার উপায় নেই।"
'গৌরীপুর জংশন' উপন্যাসটি লেখা হয়েছে তৃতীয় পুরুষের জবানিতে । যদিও পুরো গল্প এগিয়েছে জয়নালের দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে লেখক কখনো কখনো তৃতীয় পুরুষ থেকে লাফ দিয়ে প্রথম পুরুষে চলে এসেছেন।
'গৌরীপুর জংশন' রেল স্টেশনের অতি সাধারণ গল্প নিয়ে লেখা, নিম্ন আয়ের মানুষের যাপিত জীবন যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখেও এড়িয়ে চলি বা জড়াতে চাই না।
এখানে উঠে এসেছে স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিশ্বস্ততা , কপটতা কিংবা একে অপরের প্রতি ভালোবাসা।
আমি মাঝে মাঝে হুমায়ূন আহমেদের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করি। বই লেখার সময় তিনি কী ভাবতেন, জানতে ইচ্ছে করে। লিখতে লিখতে হুট করেই মনে হয় তার লেখার আগ্রহ শেষ হয়ে যেত। নাহলে এমন দারুণ গল্পের প্রবাহমান যাত্রায় তিনি কেন এভাবে থেমে যেতেন? অসমাপ্ত এই গল্পগুলোর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কেমন হতে পারে, তার চিন্তা পাঠকের মনে যেভাবে চাপ সৃষ্টি করে, তিনিও কি তেমন ভাবতেন? না-কি পাঠকের মনে গল্প শেষ না হওয়ায় জন্য যে আক্ষেপ জন্ম নিত, তাতে আমোদ পেতেন?
সম্প্রতি শেষ করা “গৌরীপুর জংশন” বইয়ের শেষে এসে আক্ষেপ, বিষাদ, রাগ, হতাশা সব যেন একসাথে ঘিরে ধরে। এত দারুণ একটা গল্পের কোনো শেষ নেই! মনে হয়, লেখক হুট করেই লেখা থামিয়ে দিয়েছেন। একজন মানুষের জীবন, রেল স্টেশন ঘিরে মানুষের জীবনের গতিপথে তিনি হয়তো আরো কিছু লিখতে পারতেন।
এই গল্পের প্রধান চরিত্র জয়নাল। তার প্রায় পুরো জীবনটা এই রেল স্টেশনেই কেটে গেল। সেই ছোটবেলায় বাপ ও বোনের সাথে এখানে পা রাখে। একজন টিকে আছে কেবল সে। বাপ গত হয়েছে অনেক আগেই। আর বোন যে এখন কোথায় আছে, সে জানে না। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই জীবন কাটছিল তার। কুলিগিরি করে ভালোই চলছিল তার। ঘরে বউও ছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা, বদলে দিল জীবনের পরবর্তী সময়। ভারী বস্তা কোমড়ে পড়ার কারণে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হলো।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! কোমড়ে আঘাত লাগল, কিন্তু ক্ষতি হলো পায়ে। এ যেন একজনের শাস্তি আরেকজনের। এরপর আর স্বাভাবিক জীবন পায়নি জয়নাল। ভারী মালামাল তোলা এখন আর তার কম্য নয়। লাত্থি-ঝাটা খেয়ে, চুরি করে বাকিটা সময় পার হচ্ছে তার। এখন শুধু শেষ সময়ের অপেক্ষা!
জয়নালের জীবনের মধ্য দিয়ে রেল স্টেশনকে ঘরে মানুষের জীবনযাত্রার রূপ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এ যেন গন্তব্যে যাত্রার গন্তব্যহীন পথ। এখানে কত মানুষ এসে থামে! কত মানুষের নতুনের খোঁজে পথ ছাড়ে! বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এখানে মিলিত হয়। কেউ কাউকে চেনে না। কারো সাথে কারো কথা হয় না। তবুও কোথাও যেন একটা মিল থেকে যায়। ওরা সবাই খুঁজে নিজস্ব পথ।
একটি রেল স্টেশন কর্মব্যস্ত থাকে সবসময়। কত মানুষের আনাগোনা থাকে এখানে। যাত্রী, স্টেশন মাস্টার, কুলি, হকারদের শোরগোল লেগে থাকে প্রতিনিয়ত। এই যে একটি ছোট্ট জায়গা, তবুও এখানে কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষের দেখা মেলে; হুমায়ূন আহমেদ তাকেই যেন ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার বড় গুণ ছিল লেখকের। আর সেই হিসেবেই একেকটা চরিত্র গড়ে তুলতেন।
আমি বইটির প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই লেখকের মনস্তত্ত্বের এই খেলায় আরও একবার মুগ্ধ হয়েছি। শ্রেণী বৈষম্য, ধনী দারিদ্রের পার্থক্য কত দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়! যাত্রাপথে ধনী মানুষেরা দরিদ্রদের সম্মান দেয় না, তুই তুকারি করে। যেন তারা রাজা, আর বাকিরা তাদের পদতলে। অথচ যখন নিতান্তই ভদ্রভাবে ধনী শ্রেণীর দম্ভে আঘাত দেওয়া যায়, তখনই তাদের আতে ঘা লাগে। এই যে দারুণভাবে এই অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, এখানে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
আমার মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ যখন কোথাও যেতেন, তখন তিনি পরিবেশ, পরিস্থিতি, মানুষদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। নাহলে এত নিখুঁতভাবে প্রতিটি মানুষকে তুলে ধরা খুব সহজ নয়। একটা রেল স্টেশন ঘিরে, তাকে মানুষগুলোকে নিয়ে এভাবে একটা ছোট বই দাঁড় করিয়ে ফেলা হুমায়ূন আহমেদকে দিয়েও সম্ভব। তিনি যে দৃষ্টিতে সমাজকে দেখতেন, তা বাস্তবতাকে তুলে আনে। সহজ সাবলীল ঢঙে সমাজের খুঁটিনাটি তার লেখায় প্রাধান্য পায়। হয়তো পড়তে গেলে গুরুত্বপুর্ণ মনে না, কিন্তু তবুও এই দেখার দৃষ্টি ভীষণ গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ধরা দেয়।
একটা স্টেশনে পাগল থাকে, ভবঘুরে কিশোর থাকে, আবার কিছু মানুষ থাকে যারা অন্যকে সাহায্য করার নামে হাত সাফাইয়ের কাজে মগ্ন হয়। আবার একজন ছোটলোক শ্রেণীর হাতে টাকা এলে, মুক্ত হস্তে উড়িয়ে দেওয়া খুব বেশি বাস্তব। কুলিদের মধ্যেই শ্রেণী বৈষম্য থাকে। নেতা গোছের কেউ নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করে। কিন্তু দিন শেষে অনেক কিছুই ঘটে, যার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে থাকে না।
ভালো মানুষ সবসময় ভুক্তভুগী হয়। আর যে হাত সাফাই, চুরি করে; তার সময়টা খারাপ কাটে না।
“গৌরীপুর জংশন”-এ আমার সময়টা ভালোই কাটছিল। কিন্তু হুট করেই ঘটনার সমাপ্তি মেনে নিতে পারছি না। কী হলো জয়নালের, তা জানার আগ্রহ জাগা স্বাভাবিক। দিন শেষে পুলিশের আগমনের পরবর্তীতে কী সাজা পেল, তাও জানার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ বোধহয় পন করেছেন, তিনি কিছুই জানাবেন না। পাঠক কেবল নিজেই তার ভাবনায় পরবর্তী ঘটনাবলীতে স্থান দিক। যাকে ভালো লেগেছে, তার ভালো কল্পনা করুক। আর খারাপ মানুষের শাস্তি প্রত্যাশা করুক! এই তো, না-কি?
রেলের শব্দ, শোরগোল, চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ, মানুষের হট্টগোলে থাকা গৌরীপুর জংশন যেন এক টুকরো পৃথিবী। যেখানে অসংখ���য মানুষ আসে। আবার ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। কেউ কেউ এখানেই থিতু হয়। তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না।
"গৌরীপুর জংশন" হুমায়ূন আহমেদের একটা ভিন্নধর্মী উপন্যাস। উপন্যাসের পটভূমি একটি ছোট রেলস্টেশন ছোট ছোট নানা ঘটনা রচনা কালের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। গৌরীপুর জংশনে আমাদের খুব কাছে থাকা ভিন্ন এক জগত এবং অন্য এক বাস্তবতার পর্দা উন্মোচন করেছেন লেখক।
গৌরীপুর জংশন এর প্রধান চরিত্র জয়নাল। গৌরীপুর স্টেশনে বসবাসরত প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী কুলী। চালের বস্তা কোমরে পরে কোমর ভেঙ্গে পা অচল হওয়ায় কুলী জীবন ত্যাগ করেছে, কিন্তু স্টেশন ত্যাগ করেনি।জয়নাল বর্ণিল একটি চরিত্র। স্টেশনের অন্য সব চরিত্রের মতোই স্বার্থপরতা তার মধ্যে বিদ্যমান, কিন্তু অনাথ শিশু বজলুর জন্য দয়াময় একটি মনের দেখা পাই। বজলুকে নিজের সাথে রাখে, খাওয়ায়, জীবনে চলার জন্য নানা উপদেশ দেয়। মালবাবু আর সিগনাল-ম্যান রমজানের সাথে তার বেশ খাতির। নানান সময়ে তারা জয়নালকে নানানভাবে সাহায্য করেছে। জয়নাল তা কখনো ভুলতে পারে না, তাদের জন্য কিছু করার চিন্তা সবসময় তাকে ঘিরে থাকে। জয়নালের কর্মকান্ড তার অসৎগুন গুলা প্রকাশ পায়।কুলী গিরি ছাড়ার পর মূলত চুরি করে বেঁচে থাকার পথ বেছে নেয়। ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে চুরি ছাড়াও মাল বাবুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া। ভদ্রলোকে বিপদে ফেলে সে আনন্দ খুঁজে পায়। জয়নাল চরিত্র সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে তার কোনো অভিযোগ নেই। সবকিছু সহজভাবেই মেনে নিতে পারে। জয়নালের কোমর ভাঙ্গার পর তার স্ত্রী অনুফা তাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করে। এতে তার কোনো অভিযোগ নেই বরং তার জন্য দোয়া করে নিজেকে সান্তনা দেয়। কিন্তু অনুফার দ্বিতীয় বিয়ে টিকে না। সে আবার বিয়ে করে সেই বিয়েও টিকে না। অবশেষে তার জায়গা হয় পাড়ায়। সেইখানে মাঝে মাঝে খোঁজখবর নিতো। সে একবার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে অনুফা সেখানে আর নেই অন্য আরেকজন। কে সে আর অনুফা কোথায় গেছে জানতে হলে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।
সাধারণত হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এই বইটি ব্যতিক্রম।গল্পটি অন্যান্য গল্পের মত পরিষ্কার না।যার গম্ভীর টাইপের বই পড়তে পছন্দ করেন তাদের কাছে দারুণ লাগবে বইটা।পুরো বই'ই ভালো লেগেছে ৷ তবুও কিছু পছন্দের লাইন:
* চিৎকার করে কাঁদলে ফুসফুস পরিষ্কার থাকে। * সব মন্দ জিনিসের একটা ভালো দিকও আছে। * আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিন্তা করার যে ক্ষমতা দিয়েছে সেই ক্ষমতা কয়জন আর কাজে লাগায়। * শরীরের ব্যথা-বেদনা,পেটের ক্ষিধা এইসব জিনিসকে আমল দিলেই এরা পেয়ে বসে। এদের সব সময় তুচ্ছ জ্ঞান করতে হয়। * কষ্ট পাওয়া ভালো। কষ্ট হইল আগুন। আর মানুষ হইল খাদ মিশানো সোনা।আগুনে পুড়লে খাদটা চলে যায়। থাকে সোনা। *কিচ্ছা যত, মিচ্ছা তত। * আল্লাহ তায়ালার বড় একটা গুণ হচ্ছে কাউকে দুঃখ দিলে সমপরিমাণ সুখ দিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন। * মিথ্যা কথা বেশিক্ষণ বলা যায় না। একের পর এক মিথ্যা বলতে থাকলে জিহ্বা ভারী হয়ে যায়।
বইঃ গৌরিপুর জংশন লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ গৌরিপুর জংশন উপন্যাস নাকি বড়গল্প সেই আলোচনায় না গিয়ে বইয়ের মূল ঘটনার দিকে যাওয়া যাক। গৌরিপুর জংশনে থাকা এক কুলি জয়নাল। মাল বহন করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়ে আর কাজ করতে পারে না। স্টেশনেই থাকে। স্টেশনে আসা লোকদের জিনিসপত্র চুরি করে কোনভাবে কেটে যায়। স্টেশনে থাকা সবার মতই সে নিজেও স্বার্থপর কিন্তু অসহায় শিশু বজলুর জন্য তার মায়া হয়। সে তাকে সাথে রাখে। স্টেশন এর মালবাবু আর সিগন্যাল ম্যান রমজানের সাথে তার খাতির। সে মালবাবুর কাছ থেকেও টাকা মেরে দেয় আর যেহেতু এক সপ্তাহ পর মালবাবু ভূলে যায় তাই এমন ভাব ধরে থাকে যেন কিছুই হয়নি। মোবারককে তার অপছন্দ তাই চিনি চুরির কথায় তাকে জেরা করলে পুলিশকে মিথ্যা বলে মোবারকের নামে। পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ হুমায়ুন আহমেদ নিম্নবিত্তদের জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। তাদের মনোভব কর্মকান্ড এমনভাবে তুলে ধরেছেন যা আমরা সাধারনত দেখিও না আবার পুরোপুরিভাবে না দেখাও না। তবে প্রায় দুইবছরের মত রেলওয়ে স্টেশনের পাশে থাকার ফলে নস্টালজিক একটা অনুভূতি পেলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যার একটু আগে আগে স্টেশনে আড্ডা দিতে যেতাম; বিচিত্র সব কান্ড কারখানা দেখতাম। মধ্যরাতেও ক্ষুধা লাগলে স্টেশনে গিয়ে বিভিন্ন লোকেদের দেখতাম যেন স্টেশনই তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র স্থান।
বইয়ের নামঃ গৌরীপুর জংশন লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ জনরাঃ সমকালীন উপন্যাস প্রকাশনীঃ কাকলী প্রকাশনী প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি-১৯৯৫ মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০ টাকা
নামকরণঃ একটি বইয়ের প্রতি পাঠকদের আকর্ষণ করার জন্য বইয়ের নাম একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। লেখক হুমায়ুন আহমেদ এ বইটিতে একটি স্টেশনের বিভিন্ন গল্প তুলে ধরেছেন। স্টেশনটির নাম গৌরীপুর জংশন। গৌরীপুর জংশন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার একটি জংশন। এটির পশ্চিম দিকে রেললাইনে ময়মনসিংহ জংশন, উত্তর-পূর্ব দিকে মোহনগঞ্জ ও দক্ষিণ-পূ্র্ব দিকে ভৈরব বাজার জংশন হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাওয়া যায়।
চরিত্র বিশ্লেষণঃ গল্পটির মূল চরিত্র হলো জয়নাল। গল্পে দেখা যায় সে একজন কুলি। আগে একটা ঘর ছিল, ছিল সংসার। কিন্তু এখন কিছুই নেই। কিছুদিন আগে তিন মণ ওজনের চালের বস্তা পিঠ�� পড়ে তার পায়ের অসুখ হয়। তাই সে এখন রেলস্টেশনেই দিনাতিপাত করে। গল্পের শুরুতেই তার সাথে দেখা যায় একটি ছেলেকে। ছেলেটির পিতা নেই। মা আবার বিয়ে করেছে। এতদিন চাচার কাছে ছিল। চাচাও তাকে আর রাখতে পারবেনা বিধায় তাকে স্টেশনে ফেলে চলে গেছে। ছেলেটির নাম বজলু। বজলুর বাসা চাইলতাপুর। বজলু হয়ে উঠে জয়নালের সাগরেদ। এ গল্পে আরও অনেক পার্শ্বচরিত্র রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মালবাবু, ইয়াদ আলি, মোবাবরক, হাশেম, সিগন্যাল বাবু জয়নালের প্রক্তন স্ত্রী অনুফা।
কাহিনীঃ মাত্র ৫০ পৃষ্ঠার এ বইটিতে লেখক হুমায়ূন আহমেদ জয়নালের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, রেলস্টেশনের নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন। তবে অন্য গল্প ও হুমায়ূন আহমেদ এর গল্পের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই। লেখকের অন্য গল্পের মতোই কাহিনী হঠাৎ শুরু আবার কোনো পরিণতি না পেয়েই কাহিনী শেষ। হুমায়ূন আহমেদ এর গল্পই এরকম পড়ে মনে হবে গল্প এখনো শেষ হয়নি।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ গল্পটি পড়ে আমরা রেলস্টেশনের চিরাচরিত ঘটনাগুলো উপলব্ধি করতে পারি। গল্পটি দিনমজুর, কুলি, শ্রমিক সমাজের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সাথে পাঠককে পরিচিত করায়।
বইটার কাহিনী গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একটি রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে।স্টেশনে বসবাসরত অসহায় মানুষের জীবনী নিয়ে লেখক হাজির হয়েছেন এই উপন্যাসে।খুব সুন্দর ভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন উপন্যাসের ছোট্ট চরিত্রগুলো যেমন-বজলু,রমজান, হাশিম,মালবাবু ইত্যাদি।
উপন্যাসের মূল চরিত্র জয়নাল।সে গৌরীপুর স্টেশনে বসবাস করে।সে এক মধ্যবয়সী। কুলির জীবন তাকে ত্যাগ করতে হয়।কারন চালের বস্তা কোমরে পড়ে তার কোমর ভেঙে যায়।কিন্তু স্টেশন সে ত্যাগ করেনি।অন্যান্য চরিত্রের মতো স্বার্থপরতা তার একটা গুণ। কিন্তু বজলু বলে অনাথ ছোট্ট ছেলের প্রতি তার নিদারুণ মায়া।মাঝেমধ্যে জয়নাল টাকা চুরি করে। সেই টাকা দিয়ে নিজের ইচ্ছা পূরণ করে।সময়ের স্রোতে জয়নালের একটি বিয়েও হয়। স্ত্রীর নাম ছিল অনুফা।শেষ পযর্ন্ত অনুফাকে তাকে ছেড়ে দিয়ে পরপর তিনটি বিয়ের পর কি হবে তার শেষ পরিণতি?এছাড়াও স্টেশনের নানান চৌরবৃত্তির কথা এখানে পাওয়া যায়। কি করে সেই কর্মকাণ্ডের সর্দার পাল্টায়? কি করে খুন হয়?সে সব জানতে পড়তে হবে বইটি।
গৌরীপুর জংশন লেখক হুমায়ুন আহমেদের অন্যতম পরিপক্ক লেখা। গল্পটি প্রথম দিকে অনেকের কাছেই হয়ত সাদামাটা মনে হবে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় গল্পের গভীরতা অনেক বেশি। আমাদের চোখের সামনে নিয়মিত ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা যা আমরা কখনও দেখলেও লক্ষ্য করি না। অথচ লেখক সেই ছোট ছোট ঘটনাগুলোকেই নিয়ে এসেছেন তাঁর এই উপন্যাসে।
এই উপন্যাস পড়লে তিনবেলা পরিবারের সাথে বসে খাওয়ার আনন্দ, রাত্রে ছাদের নিচে ঘুমানোর শান্তি সম্পূর্ণভাবে অনুভব করা যায়।
কিছু প্রিয় বাক্য --
"দুনিয়া খুবই কঠিন।দুই সুতা জায়গাও কেউ কাউকে ছাড়ে না।"
"শরীরের ব্যথা-বেদনা, পেটের 'ক্ষিদা' এইসব জিনিসকে আমল দিলেই এরা পেয়ে বসে।এদের সব সময় তুচ্ছ জ্ঞান করতে হয়।"
এক বসায় পড়ে ফেলার মতো বই। আমার ধারনা হুমায়ূন আহমেদের অসমাপ্ত উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তে একসময় পাঠকরাও অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন আর হতাশ বা বিরক্ত লাগে না। এটা এমনি এক গল্প।
পড়তে পড়তে গল্পে ঢুকে পড়ার পর হঠাৎ খেয়াল হবে গল্প শেষ। জানি না কেন শেষ দিকে প্রতিটা চরিত্রের জন্য আমার কষ্ট লাগতে শুরু হলো, বিশেষ করে জয়নাল, অনুফাকে নিয়ে গৌরীপুর জংশনে যার একটা সুখী জীবন হতেও পারতো।
গৌরিপুর জংশনে লেখক ছোট পরিসরে একজন রেলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন, চাল-চলন ফুটিয়ে তুলেছেন। মোটামুটি ভালোই ছিল বইটা। লেখকের লেখনী নিয়ে বলার মত কিছু নাই। বরাবরই অসাধারণ!
বই : গৌরীপুর জংশন লেখক : হুমায়ূন আহমেদ প্রকাশনী : কাকলী প্রকাশনী প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯১ পৃষ্টা : ৫১ মুদ্রিত মূল্য : ৮০ টাকা।
গৌরীপুর জংশন হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম একটা মাস্টারপিস। মাস্টারপিস বলার কারণ গল্পটি মূলত একটি রেল স্টেশনের ছোট ছোট সাধারণ গল্প নিয়ে লেখা যা হয়তো আমরা প্রতিনিয়তই কমবেশি দেখেও এড়িয়ে যাই ৷ লেখক সেই সাধারণ জিনিষগুলোকেই লিখেছেন অসাধারণ ভঙ্গিমায়। বলা যায় সাধারণত হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এই বইটি একেবারে ব্যতিক্রম।
লেখক স্টেশনকে ঘিরে সমাজের নিচুতলার মানুষদের কথা তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে। উপন্যাস বলাটা আসলে ঠিক হচ্ছে কিনা জানিনা। কারণ বইটি একদম ছোট একটি বই। উপন্যাসের মতো বিস্তৃত পটভূমি বা চরিত্রের বর্ণনা নেই বইটিতে। তবে উপন্যাস বা বড় গল্প যাই বলি না কেন স্বার্থক একটি বই বলতেই হবে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া বলতে বইটি শেষ করে ভালো লাগা বা মন্দ লাগার অনুভূতি হয়তো হবে না। তবে কিছু বই আছে একদমে পড়া যায় এবং পড়া শেষে বইয়ের চরিত্রগুলোর জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস আসে। ঠিক সেইরকম একটি বই।
পুরো বইই ভালো লেগেছে ৷ তবুও কিছু পছন্দের লাইন:
* ভদ্রলোকেরা বিপদে পড়লে মজাদার কাণ্ডকারখানা করে। * বাত হচ্ছে একমাত্র অসুখ যার যোগাযোগ আকাশের চাঁদের সাথে। * চিৎকার করে কাঁদলে ফুসফুস পরিষ্কার থাকে। * সব মন্দ জিনিসের একটা ভালো দিকও আছে। * আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিন্তা করার যে ক্ষমতা দিয়েছে সেই ক্ষমতা কয়জন আর কাজে লাগায়। * শরীরের ব্যথা-বেদনা,পেটের ক্ষিধা এইসব জিনিসকে আমল দিলেই এরা পেয়ে বসে। এদের সব সময় তুচ্ছ জ্ঞান করতে হয়। * কষ্ট পাওয়া ভালো। কষ্ট হইল আগুন। আর মানুষ হইল খাদ মিশানো সোনা।আগুনে পুড়লে খাদটা চলে যায়। থাকে সোনা। * মাঝেমাঝে কিছু টাকা হাতে আসে যেগুলি খুব বরকত দেয়। ফুরায় না। *কিচ্ছা যত, মিচ্ছা তত। * আল্লাহ তায়ালার ���ড় একটা গুণ হচ্ছে কাউকে দুঃখ দিলে সমপরিমাণ সুখ দিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন। * মিথ্যা কথা বেশিক্ষণ বলা যায় না। একের পর এক মিথ্যা বলতে থাকলে জিহ্বা ভারী হয়ে যায়। * সব জাতির লেজ আছে, মানব জাতির লেজ নাই কেন?
হুমায়ুন আহমেদের বই আমার খুব বেশি পড়া হয় নি। এই বইটির নামও আমার জানা ছিল না, তবে বইটা যখন চোখে পড়ল কিনে ফেললাম। গৌরীপুর জংশন আমার খুব পরিচিত এক জায়গা। বহুবার আমি এই স্টেশনে অপেক্ষা করেছি, সময় কেটেছে তাই অনেকখানি। পড়তে পড়তে প্রায়ই কল্পনায় চলে আসছিল গৌরীপুর স্টেশন এবং তার আশপাশ। আর ভাবছিলাম কখনো কোনো জয়নালকে কি আমার চোখে পড়েছে? নিয়মিত রেলভ্রমণ যারা করেন তারাই জানেন কত আজব জাতের মানুষের দেখা পাওয়া যায় রেল স্টেশনে। লেখক তারই একটুকরো ছবি দিতে চেয়েছেন। জয়নালের চোখ দিয়ে আমরা স্টেশনকে কেন্দ্র করে চলা কিছু মানুষের নিত্য জীবনের এক ঝলক দেখতে পাই।স্টেশনের কুলি, ভিক্ষুক বা চাওয়ালার গল্প উঠে এসেছে এই বইয়ে, যাদের ছাড়া রেল স্টেশন একেবারে কল্পনাও করা যায় না, অথচ তাদেরও যে কিছু গল্প থাকে সে কথা আমরা হয়তো ভাবি না, অথবা লেখালেখিতে দেখি না। খুব ছোট্ট একটা বই। উপন্যাস বলাটাও ঠিক কতটা উচিত হবে সে ব্যাপারে আমি দ্বিধান্বিত, কাহিনী বা চরিত্ত্রের ব্যপ্তি অতি সল্প।হয়তো আরো অনেক কিছু যোগ করার এবং চরিত্রগুলোর আরও গভীরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। এক বসায় পড়ে ফেলা যায় এমন একটা বই। শুরুর আগে তাই খুব বেশি প্রত্যাশা না রাখাই ভালো । বইটা শেষ করেও খুব বেশি ভালোলাগা-মন্দলাগা কিছুই হয়তো লাগবে না, তবে আমার মত গৌরীপুর স্টেশনের নিয়মিত ভ্রমণকারিদের খানিকটা নস্টালজিক করে তুলতে পারে এই বই।
হাসতে হাসতে একদিন লাইব্রেরিতে বইটা হাতে নিলাম। কিনব, কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানিব্যাগ নাই। বই কেনা হলো না। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলো, গৌরীপুর জংশনের কথা ভুলেই গেছিলাম। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ হওয়ায় রেল টেল তেমন দেখি নাই কখনো। এখন অন্য জায়গায় আসছি পড়ালেখার হেতু। এখন রেল দেখি, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলে সাড়ে ছয়টার টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস ঘড়ঘড় শব্দে এগোতে থাকে। সিটি বাজায়। গৌরীপুর জংশনের রিভিউ লিখছি না, কিছু মনের কথা লিখলাম।
এই উপন্যাসের সবচেয়ে ক্যাচিং সিনারিও সম্ভবত জয়নালের সুখের দিনগুলি। পূর্বেকার স্ত্রীর ঘরে, যে কিনা দেহপসারিনী হয়েছে ভাগ্যের মারপ্যাঁচে, সেখানের স্মৃতিচারণে জয়নাল দেখায় অন্য এক মনের আয়না। হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটা বই-ই মানব মনের কিছু না কিছু আবেগ নিয়ে খেলা করে। অনবদ্য হুমায়ূন।
স্কুলে সরকারকর্তৃক দেওয়া মনভুলো পণ্ডিত বা ছোটখাটো রূপকথার গল্পের কথা বাদ দিলে এটাই আমার পড়া প্রথম বই। আপুর পুরনো বইয়ের মাঝে মলাটবিহীন পেয়েছিলাম। ভীষণ ভালো লেগেছিল। আজ এতদিন বাদে এসে রেটিং দিচ্ছি।