বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে জনপ্রিয় যোদ্ধা কারা? শুধু নাম নয়, অন্তত একটি যুদ্ধের কথা ষোলো কোটি মানুষের সবাই জানেন? এই প্রশ্নটি করা হলে উত্তর নিঃসন্দেহে আসবে, “সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এবং ঢাকার গেরিলারা, যাদের আনঅফিশিয়াল নাম পরে হয়ে যায় ‘ক্র্যাক প্ল্যাটুন’।” এই বইয়ের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল ক্র্যাক প্ল্যাটুনের বীরত্বগাঁথার রচনাবলি। একাধিক সাহিত্যিক তরুণ, স্মার্ট, শিক্ষিত গেরিলাদের নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস। তবে দুঃখজনকভাবে সত্য সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে আলাদা করে সাহিত্য লেখার চেষ্টাটি খুব বেশি দেখা যায়নি। নন-ফিকশন লেখা হয়েছে প্রচুর, তবে ‘নন-ফিকশন, ফিকশন’ লেখার জন্য আগ্রহের অভাব দেখা যায়। এই বইটিতে ইতিহাসের প্রথমবারের মতো সেই চেষ্টাটিই করা হয়েছে। সামনের মলাট ওলটালেই সরাসরি পাঠককে নামিয়ে দেওয়া হবে জাতির সূর্যসন্তানদের পাশে। তাঁদের সাথে হাঁটার সুযোগ পাবেন আপনি। বসতে পারবেন তাঁদের সাথে। ছুটবেন আপনি, শত্রুর দিকে ছুড়বেন তপ্ত সিসা, এবং অনুভব করবেন আপনার দিকে ছুটে আসা প্রতিটি বুলেট। সাত বীরশ্রেষ্ঠকে খুব কাছ থেকে দেখার, বোঝার ও অনুভব করার এমন সুযোগ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এর আগে কখনো আসেনি। কিশোর রিক্রুট হামিদুর রহমানের উত্থান আপনি যদি তাঁর পায়ে হেঁটে দেখতে চান, অনুভব করতে চান হাসিখুশি তরুণ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বদলে যাওয়া এক পাষাণ হৃদয় যোদ্ধায়, কিংবা একই ককপিটে বসে দেখতে চান ধীর-স্থির মতিউর রহমানের চারশো নট গতিতে উড়ে যাওয়া-- এই বইটি আপনার জন্য।
Kishor Pasha Imon is a famous Bangladeshi crime writer.
Musa Ibne Mannan, known by the pen name KP Imon, is an accomplished writer who initially gained recognition through his short stories on social media. Over the course of his career, he has written over 220 short stories, captivating his online audience with his vivid imagination and storytelling skills. Building on his success in the digital realm, Imon went on to establish himself as a prominent novelist, with his works being published in both Bangladesh and India.
His regular publishers are Batighar publications, Abosar Prokashona Songstha, and Nalonda in Bangladesh. Abhijan Publishers solely publish his books in India. He is the author of 13 novels and translated 9 books to Bengali till date (5/10/23).
He graduated from the Department of Mechanical Engineering at Rajshahi University of Engineering & Technology. Presently, he resides in Dallas, TX, focusing on his PhD studies in Mechanical Engineering at UT Dallas after completing his MS at Texas State University.
His other addictions are PC gaming, watching cricket, and trekking.
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কম বই পড়িনি জীবনে। বাজারে আছে ভুরি ভুরি। কিন্তু তার অধিকাংশই অতিরঞ্জিত কিংবা অতিনাটকিয়তায় মোড়া। কেপির প্রতি আলাদা আস্থা থেকে আঁচ করছিলাম, এবার হয়তো মোক্ষম কিছু পেতে যাচ্ছি। বিশেষ করে স্রেফ সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাক প্লাটুনকে নিয়ে আস্ত একটা নন-ফিকশন এই বৈশিষ্ট্যটুকুই বইপ্রেমীকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য।
সম্পূর্ণ বইটির সাথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা : বইটির প্রথমেই লেখকের মুখবন্ধ পাবেন। যেখানে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, 'তিনি প্রত্যেক বীরশ্রেষ্ঠকে মানবীয় রুপেই চিনিয়েছেন। অতিরঞ্জিত কিংবা অতি ভক্তির স্থান শুন্য। দেখিয়েছেন মানবরুপে' । শুধুমাত্র দায়িত্ববোধ থেকে, দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে, বৃহত্তর স্বার্থে দলের জন্যে যেটুকু করেছেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, সেটুকুই ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীর নিখুঁত তুলিতে।
পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, আমি এসব সূর্যসন্তানদের সাথে সাথেই হাঁটছি। তাদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ অবলোকন করছি। তাদের বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা, সাহস আর নির্ভীকতার সাক্ষী থাকছি। কখনো অবাক হচ্ছি। যেন শিরদাড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে। কখনো বিষাদের কালো ছায়ায় নিমজ্জিত হচ্ছি। চোখের কোণে জমা হচ্ছে বিন্দু বিন্দু বাষ্প। এটা হবে আমি জানতাম, কেননা এই ৭১ জিনিসটা আমার কাছে চিরকালের আবেগের বস্তু। আর এই আবেগটাকে আরো শতগুন বাড়িয়ে দিয়েছে লেখকের লেখার মুন্সিয়ানা।
বইটির ঘটনাপ্রবাহ মুক্তিযুদ্ধের টাইমলাইন ধরেই এগিয়েছে। ন্যারেটিভ স্টাইলে। তাই বোরিং হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এবং ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের পেছনের গল্প, যুদ্ধের মোটিভেশন, যুদ্ধকালীন ট্রমা এসব থেকে একজন অকুতোভয় সাহসী যোদ্ধা হয়ে উঠার গল্প সবকিছুই ছিল মারাত্মক রকমের সুন্দর ও নিখুঁত। লেখক তার সবকিছুই ঢেলে দিয়েছেন বলতে গেলে। যুদ্ধের প্রতিটা লোকেশনের ডিটেইলিং, অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং যুদ্ধবিমানের খুঁটিনাটিসহ ছোট খাট সবকিছুই আপনাকে পড়ার সুখটা বাড়িয়ে দেবে বহুগুন।
বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্রাক প্লাটুনের প্রত্যেকটা সদস্য নিয়েই একটা করে অনুচ্ছেদ লেখা যায়। কিন্তু আমি সেদিকে যাব না। আমরা প্রত্যেকেই জানি তাদের জীবনে কি ঘটেছিল। কিন্তু কিভাবে ঘটেছিল তার নিখুঁত বিবরণটুকু জানতে হলেও আপনাকে হাতে তুলে নিতে হবে এই বইটি।
আমন্ত্রণ : সাত বীরশ্রেষ্ঠকে খুব কাছ থেকে দেখার, বোঝার ও অনুভব করার এমন সুযোগ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এর আগে কখনো আসেনি। কিশোর রিক্রুট হামিদুর রহমানের উত্থান আপনি যদি তাঁর পায়ে হেঁটে দেখতে চান, অনুভব করতে চান হাসিখুশি তরুণ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বদলে যাওয়া এক পাষাণ হৃদয় যোদ্ধায়, কিংবা একই ককপিটে বসে দেখতে চান ধীর-স্থির মতিউর রহমানের চারশো নট গতিতে উড়ে যাওয়া তাহলে -- এই বইটি একান্তই আপনার জন্য।
মোট কথা: লেখক সফল। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা এই অসামান্য বইটি লেখককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ও হ্যাঁ, বইটির শেষ আপনাকে চরমভাবে আঘাত করতে পারে, কিছু তিক্ত সত্যতার মুখোমুখির মাধ্যমে। মোটকথা, স্বাধীনতার মাসে এমন একটা বই পড়া টা ভীষণ আনন্দের ছিল।
কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে উপন্যাস লেখার সময় লেখকের দায়িত্ব হচ্ছে তার সেজদায় না পড়ে যাওয়া - কেপির এ বক্তব্যের সাথে আমি একমত। ইতিহাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলে তো কথাই নেই; তার ব্যাপারে নির্মোহ থাকতে পারাটা খুব দরকার (যেটা বাংলাদেশের অনেক লেখকই পারেন না।) এই উপন্যাসে মূল চরিত্র হিসেবে আছেন আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও ক্র্যাকপ্লাটুনের সদস্যরা। লেখক চারশো পাতার মধ্যে অনেক বেশি চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন এটা সত্য, প্রতিনিয়ত অনেক নতুন চরিত্র আসায় কিছুক্ষেত্রে কিছু চরিত্রের প্রতি সুবিচার করা যায়নি, ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় চরিত্রদের মুখে গালিগালাজ শুনতে একটু বিচিত্র লাগে এটাও সত্যি -কিন্তু কেপি সফলতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন।মনে হয়েছে আসল ঘটনা ঠিক এভাবেই ঘটেছে, লেখক শুধু লিপিবদ্ধ করে রাখছেন সেসব। সবার মুখের স্বাভাবিক ভাষা (যেখানে প্রচুর খিস্তি রয়েছে) চরিত্রদের আরো বেশি বাস্তবসম্মত ও জীবন্ত করেছে। কেপি চিত্রনাট্যের কথা মাথায় রেখে গল্প লিখেছেন সম্ভবত, সবকিছু চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। এ বইটা আমার খুব প্রিয় হয়ে থাকবে।
গ্রীক মিথলজির গল্পগুলো সবারই কমবেশি জানা৷ ছোটবেলা থেকেই কোথাও না কোথাও পড়া হয়েছে বা শোনা হয়েছে এগুলো। হারকিউলিসকে চেনে না বা ট্রোজান হর্সের নাম শুনেনি বা একিলিস হিল কোথাও পড়েননি; এমন মানুষ বিরল। গ্রীক মিথলজির দুটো প্রধান মহাকাব্য ইলিয়াড আর ওডিসি রচনা করেছিলেন মহাকবি হোমার। আর এগুলোর নির্যাস একত্র করে "মিথলজি" নামের জগদ্বিখ্যাত এক বই লিখেছিলেন এডিথ হ্যামিল্টন। বহুল পঠিত এই বইটির আলোচ্য বিষয় কারো অজানা নেই। গ্রীক মিথলজির বীরদের অমর বীরত্ব গাঁথা তিনি লিখেছেন সংক্ষেপে, গদ্যরূপে। তুলে এনেছেন বীরদের দুঃসাহসিক অভিযানসমূহ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ট্রয় কিংবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতোই একটা বৃহৎ, প্রভাববিস্তারকারী গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ঘটনা। আট মাস বিশ দিনে বিষয়টার সুরাহা হয়েছে বলে "তাড়াহুড়ার কাম, শয়তানের কাম" ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তাড়াহুড়োয় হয়েছে বটে, তবে বিশাল ভূরাজনৈতিক খেলা হয়েছে এখানে। বিস্তর কূটনীতিক লড়াই, বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর অন্তর্দ্বন্দ, গানবোট ডিপ্লোম্যাসি, সর্বোপরি বাংলার মানুষের মরণপণ লড়াই; একটা মহাকাব্য লেখার মতো রসদ এখানে বিদ্যমান।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহাকাব্য লেখা হয়েছে কি? হ্যাঁ হয়েছে। আমি দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলমের লেখা প্রায় হাজার খানেক পৃষ্ঠার দুই খণ্ডের "গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে" আমার কাছে মহাকাব্যই মনে হয়।
এডিথ হ্যামিল্টনের মতো কিশোর পাশা ইমন তুলে আনলেন মুক্তিযুদ্ধের বীরদের। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে ড্যাশিং গ্রুপ "ক্রাক প্লাটুন" এর বিচ্ছুদেরকে পোট্রে করলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক নগরীর এবড়োখেবড়ো ক্যানভাসে। ক্যানভাসের রুগ্ন পৃষ্ঠতলে তাদের শতচ্ছিন্ন উপস্থিতি সাক্ষ্য দিচ্ছে দেশের তরে তাদের সর্বস্ব ত্যাগের দলিল।
রণাঙ্গনে কিংবা ট্রেনিং সেশনে রাইফেল হাতে ক্রল বা রোল করা মুক্তিযোদ্ধার পাশে হেঁটে বেরিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করানো এই বইটাকে ডকু-ফিকশন বলা যেতে পারে কি?
হয়তো যায়, হয়তো যায় না৷ কিশোর পাশা ইমনের "আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে" বইটির রিভিউতে আপনাদেরকে স্বাগতম পাঠক।
সরাসরি ফ্ল্যাপ থেকে: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে জনপ্রিয় যোদ্ধা কারা? শুধু নাম নয়, অন্তত একটি যুদ্ধের কথা ষোলো কোটি মানুষের সবাই জানেন? এই প্রশ্নটি করা হলে উত্তর নিঃসন্দেহে আসবে, “সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এবং ঢাকার গেরিলারা, যাদের আনঅফিশিয়াল নাম পরে হয়ে যায় ‘ক্র্যাক প্ল্যাটুন’।” এই বইয়ের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল ক্র্যাক প্ল্যাটুনের বীরত্বগাঁথার রচনাবলি। একাধিক সাহিত্যিক তরুণ, স্মার্ট, শিক্ষিত গেরিলাদের নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস। তবে দুঃখজনকভাবে সত্য সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে আলাদা করে সাহিত্য লেখার চেষ্টাটি খুব বেশি দেখা যায়নি। নন-ফিকশন লেখা হয়েছে প্রচুর, তবে ‘নন-ফিকশন, ফিকশন’ লেখার জন্য আগ্রহের অভাব দেখা যায়। এই বইটিতে ইতিহাসের প্রথমবারের মতো সেই চেষ্টাটিই করা হয়েছে। সামনের মলাট ওলটালেই সরাসরি পাঠককে নামিয়ে দেওয়া হবে জাতির সূর্যসন্তানদের পাশে। তাঁদের সাথে হাঁটার সুযোগ পাবেন আপনি। বসতে পারবেন তাঁদের সাথে। ছুটবেন আপনি, শত্রুর দিকে ছুড়বেন তপ্ত সিসা, এবং অনুভব করবেন আপনার দিকে ছুটে আসা প্রতিটি বুলেট। সাত বীরশ্রেষ্ঠকে খুব কাছ থেকে দেখার, বোঝার ও অনুভব করার এমন সুযোগ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এর আগে কখনো আসেনি। কিশোর রিক্রুট হামিদুর রহমানের উত্থান আপনি যদি তাঁর পায়ে হেঁটে দেখতে চান, অনুভব করতে চান হাসিখুশি তরুণ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বদলে যাওয়া এক পাষাণ হৃদয় যোদ্ধায়, কিংবা একই ককপিটে বসে দেখতে চান ধীর-স্থির মতিউর রহমানের চারশো নট গতিতে উড়ে যাওয়া-- এই বইটি আপনার জন্য।
পাঠপ্রতিক্রিয়া: থ্রিলার বইগুলোর রিভিউ আমি লিখে থাকি কয়েকটা পয়েন্টে বিশ্লেষণ করে, ভালো খারাপ লাগা। এই বইটা ঠিক থ্রিলার নয়, তাই সবগুলো পয়েন্ট লেখা যৌক্তিক নয়।
-স্টোরিটেলিং -ক্যারেক্টার বিল্ডআপ
এই দুটো পয়েন্টেই রিভিউটা শেষ করা যায়।
স্টোরিটেলিং: যেই কারণে কিশোর পাশা ইমনের বই আমি চোখ বন্ধ করে কিনি, সুন্দর গদ্যশৈলী তার প্রধান কারণ। সমসাময়িক থ্রিলার লেখকদের মধ্যে তার লেখা আমার সবচাইতে ভালো লাগে। চার পাঁচশ পেজের বই লিখলেও গল্পের মাধুর্যের জন্য বিরক্তি আসে না। কেপির লেখা আমার কাছে তুলনামূলক ফাস্টপেসড মনে হয়।
লেখকের প্রথম বই মিথস্ক্রিয়াতে লিখনশৈলী মনে হয়েছিলো রুক্ষ-সুন্দর। যদিও পরের বইগুলোতো লেখা আরও পরিশীলিত হয়েছে৷ পড়তে আরাম লাগে, পাতার পর পাতা পরে যাওয়া যায় নিমিষেই।
লেখকের লিখনশৈলী ভালো লাগার আরেকটা কারণ সংলাপে স্ল্যাং এবং স্যাটায়ারের ব্যবহার। এই বইটাতে দুটোই পরিমিত পরিমাণে আছে। যদিও কেপীয় স্ল্যাং শুরু দিকে একেবারেই কম ছিল, তবে ১৮০ পৃষ্ঠার পরে সম্ভবত বেশি হয়েছে।
বইটার প্লট মাল্টিলিনিয়ার বলা উচিত নাকি নন-লিনিয়ার বলা উচিত সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ’র পাশাপাশি ক্রাক প্লাটুনকে তুলে এনেছেন লেখক৷ একেকটা অধ্যায় পরপর একেকজন বীরশ্রেষ্ঠ হাজির হচ্ছিলেন, পাশাপাশি কখনো দেখা দেখা গেছে ক্রাক প্লাটুনের বিচ্ছুরা ছাদে ক্রিকেট খেলছে অথবা স্টে-ন-গা-ন হাতে খানসেনা কতল করছে৷
লেখকের গদ্যশৈলী প্রতি অধ্যায়ে আলঙ্কারিক চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলছিলো খুব সুন্দরভাবেই। বইয়ের শেষে লেখক বেশ কিছু রেফারেন্স বইয়ের নাম দিয়েছেন। যেগুলো থেকে তিনি তুলে এনেছেন বীরশ্রেষ্ঠদের চালচলন, কথা বলার স্টাইল, তাদের ন্যারেটিভ৷ সংলাপ কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের প্রতিটা নড়াচড়ায় প্রকাশ পাচ্ছিলো লেখক যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই তাদের ইনকারনেশন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণের ৫৪ বছর পরেও বইয়ের পাতায় তাদের উপস্থিতি রক্তমাংসের মানুষের মতোই প্রভাববিস্তারকারী।
বইটার ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে "জাতির সূর্য সন্তানদের সাথে রণাঙ্গনে হাঁটার সুযোগ পাবেন আপনি। বসতে পারবেন তাঁদের সাথে। ছুটবেন আপনি, শত্রুর দিকে ছুড়বেন তপ্ত সিসা, এবং অনুভব করবেন আপনার দিকে ছুটে আসা প্রতিটি বুলেট। সাত বীরশ্রেষ্ঠকে খুব কাছ থেকে দেখার, বোঝার ও অনুভব করার এমন সুযোগ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এর আগে কখনো আসেনি।" লেখক এক্ষেত্রে অনেকটাই সফল। একটু আগেই লিখেছি "আলঙ্কারিক চিত্রকল্প" লেখকের যথাযথ হোমওয়ার্ক করে লেখার ফলে বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতিটি নড়াচড়া স্পষ্ট কল্পনা করা যাচ্ছিলো। বুঝতে পারছিলাম বন্দুকের ঠিক সামনের মাটিতে একটা বুলেট বিঁধলো, একদলা মাটি ছিটকে এলো চোখের উপরে, পরক্ষণেই ট্রিগার টেনে দুটো তপ্ত সীসা পাঠিয়ে দিলাম ওইপারের কোনো খানসেনার বিচি বরাবর।
এই বইটিতে লেখক সফলতার সাথে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও চরিত্রগুলোকে। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে দেবতা না বানিয়ে পক্ষপাতহীনভাবে তাদের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা বইটির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। চরিত্রগুলোর মুখনিঃসৃত খিস্তি নিরপেক্ষতার প্রামাণ্য দলিলও বলা যায়।
ক্যারেক্টার বিল্ডআপ: প্রায় চারশো পৃষ্ঠার বইটাতে লেখক বেশুমার চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবাই যথাযথ "স্ক্রিনটাইম" পাননি। এমনকি সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ’র মধ্যেও সবাই সমান সুযোগ পাননি। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তুলনামূলক বেশি পাতায় অবস্থান করেছেন। এক্ষেত্রে লেখকের পক্ষ নিয়ে বলা যায়, জাহাঙ্গীর মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ। স্বাধীনতার মাত্র দু'দিন আগে শাহাদাত বরণ করেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই দুর্ধর্ষ সেনানায়ক।
একেবারে শেষের দিকে হঠাৎ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের আগমন ঘটার পরে হঠাৎ মনে পড়লো এই নামেও একজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন! লেখক রুহুল আমিনের প্রতি একেবারেই সদয় আচরণ করেননি। খুবই অল্প স্পেস পেয়েছেন ভারতীয় এয়ারফোর্সের ভুলে প্রাণ হারানো এই বীরশ্রেষ্ঠ।
সেনাবাহিনীর স্কুলে পড়েছি বলেই কি না ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আমার শৈশবের হিরো। বাকি ছয়জন বীরশ্রেষ্ঠ’র থেকে তার প্রতি আমার একটু পক্ষপাত ছিল।
সেই তুলনায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে ঠিক অতটাও সম্মানের সহিত দেখতাম না! "পাকিস্তান থেকে প্লেন নিয়ে দেশেই আসতে পারলেন না, ব্যর্থ হলেন মাঝপথে, তার জন্য আবার বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি কেন?" শৈশবে এমনটাই ভাবতাম। কেপি এই ভাবাভাবিতে বেয়নেটের খোচা দিলেন। মতিউর রহমান পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমে গিয়ে একটা প্লেন নিয়ে আবার ফেরত আসবেন- এই সিদ্ধান্তটার জন্যই তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়া যায়।
বাকি পাঁচজন বীরশ্রেষ্ঠকেও সমান চোখে দেখা উচিত ছিল আমার- বইটার দুই-তৃতীয়াংশ অবধি এটাই ভাবছিলাম পড়তে পড়তে। তবে শেষ পর্যন্ত আমার শৈশবের হিরোকেই বেশি স্ক্রিনটাইম দিয়ে তাকে আবারও আমার হিরো হিসেবেই স্থাপন করলেন লেখক।
সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত বীরশ্রেষ্ঠগণ যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা ট্রেনিং সেশনে বার বার প্রমাণ করছিলেন তারা আসলেই দুনিয়ার অন্যতম মশহুর সামরিক বাহিনীর সদস্য।
অকুতোভয় বীরশ্রেষ্ঠদের পাশাপাশি বইটিতে আরও কিছু মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র ছিলেন। যারা স্রেফ সাহসের বশে যুদ্ধে যোগ দিতে এসেছিলেন। এরপর ট্রেনিং দেখে ভেবেছেন "জান বেরিয়ে গেলো", এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করার আগে রোমাঞ্চ অনুভব করেছেন, বুলেট বৃষ্টিতে সহযোদ্ধাকে বুলেটবিদ্ধ হতে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেছেন, আবেগে কেঁদে ফেলেছেন, কিন্তু রণাঙ্গন ত্যাগ করেননি; লেখক চরিত্রগুলোর মধ্যে যেই অ্যান্টিথিসিস ন্যারেটিভ স্টাব্লিশ করেছেন, সেটাই চরিত্রগুলোকে দিয়েছে জীবন্ত রূপ। তাদের স্ট্রিম অব কনশাসনেসের পাল্লা বারবার এদিক সেদিক দুললেও, ঠিকই দোলাচলের সমাপ্তি ঘটিয়ে তারা দুটো তপ্ত সীসা পাঠিয়ে দিয়েছেন কোনো খানসেনার বিচি বরাবর।
ক্রাক প্লাটুনের বিচ্ছুগুলোর ক্যারেক্টারাইজেশন সম্ভবত সেরা হয়েছে। পড়তে পড়তে খানিকটা "একাত্তরের দিনগুলি" ভাইব পাচ্ছিলাম। এখানেও তাদের স্ট্রিম অব কনশাসনেসের পাল্লা এদিক সেদিক দুললেও তাঁরা ইকন্টিনেন্টাল গ্রাউন্ডে বাজি-পটকা ফাটাফাটি করতে ভোলেননি!
কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্রাক প্লাটুন নিয়ে আগেও আমার আগ্রহ ছিল না, বইটা পড়েও আগ্রহ আসেনি। তাদের কীর্তিকলাপ কিছুটা অতিমানবীয় মনে হয়।
সবশেষে বলব, কেপির অন্য বইগুলোর মতো এই বইটাও আমার খুব ভালো লেগেছে। লেখক যেহেতু আমার আগে থেকেই প্রিয় তাই হতে পারে যে আমার স্ট্রিম অব কনশাসনেসের পাল্লা লেখকের দিকে পক্ষপাত করেছে। তবে সজ্ঞানে চেষ্টা করেছি বইটার নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে হবে। অন্যান্য ফিকশন কিংবা নন-ফিকশন বইয়ের মতো এই বইটাও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা দলিল হয়ে থাকবে বলেই মনে করি।
১৯৭১ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে বহু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, গান, উপন্যাস। নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। তবে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ এবং ক্র্যাক প্লাটুন নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। যে নভেলের মূল উপজীব্য বিষয় হলো একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠ, শহীদ রুমীর নেতৃত্বে ক্র্যাক প্লাটুন এবং তাদের সহযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন সময়ের আত্মত্যাগের গল্প।
এ বইয়ের যে বিষয়টা আমার অন্যতম পছন্দের সেটি হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরদের লেখক ফেরেশতা কিংবা দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যান নি। কোন কিছুর অতি মহিমান্বিত রূপ দেয়া হলে সেই বিষয়ের প্রকৃত মহিমা লোপ পেয়ে যায়। বীর হলেও তাঁরা তো দিনশেষে মানুষই ছিলেন। 'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে' পড়লে সচেতন পাঠক ঐ সকল বীরদের জুতোয় পা রেখে হাঁটতে শিখার পথে যেতে পারেন।
২৫ শে মার্চের নির্মম, নিষ্ঠুর, নির্মানবিক ক্র্যাকডাউনের পর পাকিস্থান মিলিটারিকে রুখে দিতে এবং উচিৎ জবাব দেয়ার আকাঙ্ক্ষায় এক একজন বীর যারা পরবর্তিতে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধী পান, এবং শহীদ রুমীর ক্র্যাক প্লাটুন যার যার যাত্রায় নেমে পড়েন। অল্পবয়সী হামিদুর রহমানের অসম সাহসিকতার আখ্যান, ঠান্ডা মাথায় মুন্সী আব্দুর রউফের অন্যদের বাঁচাতে আত্মত্যাগ, নূর মোহাম্মদের ক্রমাগত লেগে থাকার প্রবণতা, মতিউর রহমানের প্লেন হাইজ্যাকের পরিকল্পধা থেকে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বের গুনাবলী এবং স্ট্র্যাটেজিক দক্ষতা যে তৎকালীন পাকিস্থান সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলো সেসবের ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং তৎসংশ্লিষ্ঠ প্রতিটি চরিত্রের ফ্ল্যাশব্যাক মেমোরি থেকে আবার যুদ্ধ ময়দানে ফিরে আসাটা দারুন হয়েছে।
রুমীর ক্র্যাক প্লাটুনের বিচ্ছুপনা দিয়ে তৎকালীন জালিমদের হতভম্ব করে দেয়ার ডিটেইলও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিশোর পাশা ইমন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো স্পর্শকাতর এবং বাঙালী জাতির এই বিষয়ে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকার মাঝেও কেপি ইমন যথাসাধ্য পরিশ্রম করে লিখেছেন এ উপন্যাস। নন-ফিকশনের বিষয় ফিকশনে দুর্দান্তভাবে রূপান্তর করাটা সহজসাধ্য কাজ নয়। দীর্ঘ চার বছরের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে কেপি ইমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিভিন্ন রেফারেন্স গ্রন্থের সহায়তায় নিজের কল্পনাশক্তির ব্যবহারে ফিকশনে জায়গা করে দিয়েছেন।
যেমন :
১) সেই সময় পাকিস্থানী হানাদার মিলিটারির কাছে ইসলাম ধর্মের যেরূপ, বাংলাদেশের অনেক বীরদের কাছে, যারা মজলুমের পক্ষে লড়েছেন, ইসলাম ধর্মের রূপ এক ছিলো না। মজলুমের পক্ষে জালিমের বিপক্ষে ইসলামের যে চেতনা একাত্তরে অনেক বীরের মধ্যে ছিলো তার প্রতি হালকা নড দিয়েছেন লেখক। স্পয়লার দিচ্ছি না। দেশে ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধের সেই যড়যন্ত্রমূলক চিরাচরিত বয়ানের ফাঁদে লেখকের না থাকাটা প্রশংসনীয় এবং তাঁর এ বই লিখার ক্ষেত্রে ক্লিয়ার থিঙ্কিং এর পরিচয় বহন করে।
২) তৎকালীন পরিস্থিতিতে যার যা প্রাপ্য সম্মান ইতিহাসে আছে সেই বিষয়ের প্রতিও হালকা নড আছে লেখকের। নডগুলো হালকা বলেই চোখে পড়বে বেশি। হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ।
৩) মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রিটিকালী দেখার একটা প্রয়াস লেখকের মাঝে ছিলো, তাদের বীরত্বকে এতটুকু খাটো না করে।
৪) যুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজি, অস্ত্রের ব্যবহারের কৌশলের বাস্তবভিত্তিক বর্ণনা দেয়ার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা দেখা যায় এ বইয়ে। যুদ্ধ শুধুমাত্র আবেগে নয় বরঞ্চ কৌশলে জিততে হয় সেই বাস্তবতা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এই আখ্যানে।
৫) ইতিহাস অতীতের বিষয়। ঐতিহাসিকতা সেই ইতিহাসের সাথে বর্তমানের সংযোগের সমান্তরালে ভবিষ্যতের সাথেও কানেক্টেড করার বিষয়। নভেলে ঐতিহাসিকতার উপাদান আছে। অবশ্য লেখক হিস্টোরিসিটি তাঁর লেখায় আরো আনতে পারতেন তবে মূল বিষয় থেকে খুব দুরে সরতে হতে চান নি মনে হয় তিনি।
কিশোর পাশা ইমন যেভাবে ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট করেছেন, একশনের চিত্রায়ণ করেছেন, মনুষ্য আবেগের বিভিন্ন দিক সেই যুদ্ধের মাঝেও ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তা প্রশংসনীয়।
এক একজন বীরের মৃত্যু অনেক পাঠককে হয়তো আবেগপ্রবণ করে তুলতে পারে। শান্তিপ্রিয় মানুষ যেভাবে অস্ত্র হাতে সমস্ত বাঁধা-বিপত্তির বিপরীতে দাড়িয়ে গিয়েছিলো, করেছিলো প্রতিবাদ, এনেছিলো স্বাধীনতা তাদের প্রতি স্যালুট।
বই রিভিউ
নাম : আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে লেখক : কিশোর পাশা ইমন প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৩ প্রকাশনা : নালন্দা প্রচ্ছদ : সজল চৌধুরী জনরা : ঐতিহাসিক উপন্যাস রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
কিশোর পাশা ইমন আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধনির্ভর উপন্যাসিকা দিয়ে, 'আগুনের দিন শেষ হয় নি'। আর সব গল্পের থেকে আলাদা ছিল যে জায়গায় : গল্পটা তৈরী হয়েছিল চলচ্চিত্রপরিচালক জহির রায়হান, আর লেফটেন্যান্ট সেলিমকে ঘিরে। মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় অস্ত্র আর ক্যামেরা হাতে দুইজনের আলাদা ভূমিকা ছিল। যুদ্ধের পর দুজনেই বুদ্ধিজীবী-হত্যার তদন্তে নামেন, সেলিম সরকারীভাবে, জহির রায়হান নিজ উদ্যোগে। কেপি ইমন এভাবেই প্রচলিত গল্পগুলোর বাইরের একটা গল্প রচনা করেন তাঁর প্রথম বইয়ে।
পরপর থ্রিলার-সাসপেন্স জঁরায় লেখালেখি করলেও, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ধরে রেখেছিলেন ছোটগল্পে, ২০২১ সালে এসেছিল তেমন কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পের সংকলন, 'যে রাতে কাক ডেকেছিল'। ওখানেও, প্রচন্ড বাস্তবনির্ভর চিন্তা পদ্ধতি আর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত হয়েছিল গল্পগুলোতে।
এই ক্ষেত্রটায়, লেখকের মাস্টারপিস হয়ে এসেছে এই বইটা, 'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে'। ৭ বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাক প্লাটুনকে অনুসরণ করেছে এবার গল্প। আমাদের জানা গল্প, নতুন করে প্রাণ পেয়েছে এই তরুণ লেখকের হাতে। আর সেটা যারপরনাই উপভোগ্য। যেমনটা আমার বরাবরই মনে হয়েছে, বাংলাদেশী বর্তমান লেখকদের মাঝে দৃশ্য বর্ণনা অথবা একশন ডিজাইনে কেপি ইমন বেস্ট।
পটভূমি অথবা কাহিনীর গতিপথে যাব না, কাহিনী সবার জানা। যুদ্ধকৌশলকে নিপুণভাবে পড়ে, যেভাবে যুদ্ধ এঁকেছেন, তা সিনেমায় দেখার মতো। এর বাইরে একটা বিষয় খুব নতুন এবং চমকপ্রদ মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধনির্ভর উপন্যাসের ক্ষেত্রে : আপনি মরে গেলেন মানে মরে গেলেন। একেকজন যোদ্ধা যে স্পৃহা নিয়ে লড়াই করেছেন, তা যেমন অনুপ্রেরণাদায়ক, কেপির লেখায়, তেমনিভাবে কোনো হিরোকে 'লার্জার দ্যান লাইফ' করে দেখানো হয়নি। যুদ্ধকে অযথা গ্লোরিফাই করা হয়নি। এবং যে মুহুর্তে মাথায় গুলি খেয়ে একজন বীরশ্রেষ্ঠ'র জীবনাবসান হয়েছে, সেখানে সে বীরের গল্প থেমে গেছে। কোনো দেবদূত নেমে আসেনি তাকে স্বর্গে তুলে নিতে (আমি মূলত Valkyrie লিখতে চেয়েছিলাম), এবং মরে-যাওয়াটা মৃত্যুর চেয়ে মহান কিছু হয়ে যায়নি।
বরং প্রচন্ড জ্যান্ত ছিল প্রত্যেকের বেঁচে-থাকাটা, এবং দেশের জন্য নিবেদিত হওয়ার উদ্দেশ্য।
সত্যি বলতে বাংলাদেশি হয়ে ৭১ নিয়ে লেখা পড়ার সময় আবেগ দূরে রাখা আমার কাছে এক প্রকার অসম্ভব একটা কাজ। কাজটা লেখক ��রেছেন। প্রথমত, আমার মতে, এইখানেই তার লেখালেখির স্বার্থকতা। সাধুবাদ জানাই। ছোটবেলা থেকে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ নিয়ে পড়েছি। তাদেরকে জানিনি। আমার পার্সোনাল ফেভারিট সবসময় ছিলো মতিউর রহমান, জানিনা কেন। অতটুকু বয়সে ক্র্যাক প্লাটুন নিয়ে আসলে জানা হয়নি। তবে ২০২০ বা ২০২১ সালে আমার মামার থেকে জেনেছিলাম (৭১ দেখেছেন) যে খালেদ মোশাররফ নিজে এবং উনার কমান্ডে যারাই যুদ্ধ করেছিলেন, সবাই ক্র্যাক ছিলেন। ডেয়ারিং সব মিশনের কারণে বিখ্যাত। এর মাঝে আমার নানুর ছোট ভাই (১৬-১৭ বছর ৭১ এ) ছিলেন যিনি কি না গ্রেনেডসহ পাকিস্তানি ক্যাম্পে ঢুকেছিলেন ক্যাম্প উড়িয়ে দিতে; ক্যাম্প উড়িয়েছিলেন এবং সাথে নিজেকেও। আমার সেই নানা শুনেছি ছিলেন খালেদ মোশাররফের কমান্ডিং টিমে। কতটা সত্য আমি জানিনা। তবে আমার মামা বলেছিলেন যে, "মেজর মোশাররফ এবং উনার কমান্ডে যারা যুদ্ধ করেছিলেন সবার মাথা ছিলো 'আউলা'। ঐসব মিশন যদি উনি না করতেন, দেশ স্বাধীন হতে খবর হয়ে যেত।" এরপর বইটা পড়ে জানলাম "ক্র্যাক প্লাটুন" দের। আমার চোখে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ এ্যাকশন সিনেমার হিরো থেকে কম কিছু ছিলেন না, বরং হয়তো তার চেয়েও বেশি ছিলেন। বই পড়ার পরে মনে হয়েছে, এরা সবাই তো সাধারণ মানুষ, আর্মি -সিভিলিয়ান, সবাই দেশকে ভালবেসেছেন নি:স্বার্থভাবে! হামিদুর রহমানের, "আমাকে একটা রাইফেল দিয়েন, আমি রাইফেলের মর্যাদা রাখবো।" আমি যেন নিজের কানে বারবার শুনতে পাচ্ছিলাম আর আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো প্রতিবার! দেশের প্রতি তাদের এই শর্থহীন ভালবাসা আমাকে কিছুক্ষণ পরপর কাঁদিয়েছে। বই পড়ার সময় এমন হয়েছে যে, আমি জানি উনারা মারা গিয়েছেন, কাহিনী প্রায় শেষ - তবুও চেয়েছি কোনভাবে বেঁচে যাক! সবচেয়ে বেশি কেঁদেছি রুমীর জন্য। এতটা স্পষ্ট ছিলো প্রতিটি ডিটেইল, দারুণভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আমার এখন পার্সোনাল ফেভারিট। নাকি মোহাম্মদ মোস্তফা বা মোস্তফা কামাল? নাকি হামিদুর রহমান? মতিউর রহমান? নাকি সবাই? কাউকে ঠিক আলাদা করতে পারছি না আর। ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ এবং গেরিলারা সবাই এখন সমান কাতারে আমার কাছে। আমার মতোই মানুষ যারা দেশকে নি:স্বার্থভাবে ভালবেসেছিলেন। দেশের জন্য মরে যেতে ভয় করেননি। শহীদ। শত্রুকে গালি দিয়েছিলেন সবার মতো, বুলেট দিয়েছেন - এরপর বুলেট বুকে নিয়েছেন খুব সরলভাবে, হাসতে হাসতে। আজকের দিনে যদি উনারা বেঁচে থাকতেন, লেখকের কথাটা হয়তো সত্য হতো। গ্যালন গ্যালন রক্ত দিয়ে আজকের বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি স্বাধীন করা হয়েছে এবং কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। ৭১ নিয়ে এতদিন গল্পই পড়েছি, যেখানে কিছু সত্যি ছিলো। যখন গেরিলাদের এবং মুক্তিদের সাথে এই বইয়ের পাতায় পাতায় কিছুটা হলেও হেঁটেছি - ৭১ কে মনে হয় অল্প হলেও জেনেছি। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ এতটা খেটে -ত্যাগ স্বীকার করে, প্রচুর রিসার্চের পরে - পাঠক পর্যন্ত পৌঁছাতে, প্রতিটি ঘটনা এতটা সাবলীলভাবে লেখার জন্য।
বই পড়া শুরু করার আগে ব্রেইনকে ফর্মেট দিয়েছিলাম এমনভাবে যেন ৭১ নিয়ে নতুন করে পড়ছি, আগে যা পড়েছি সব ভুলেছি। বইটি পড়ে জেনেছি অনেক যা অজানা ছিলো, যা ঘটেছিলো! বিশেষ ধন্যবাদ, ৭১ এ ধর্ষণ কাহিনী নিয়ে পাতা না ভরে ফেলার জন্য। এটা করা হলে সত্যি যতটা সাবলীলভাবে ৭১ কে জেনেছি, আর জেনেছি যোদ্ধাদের - সেভাবে জানতে পারতাম না। জীবনে ৭১ নিয়ে যত পড়েছি সব সময় এই বিষয়টি এতটা হাইলাইটেড ছিলো যে অন্য কোন তথ্য সেভাবে পাইনি। জানি বিষয়টি সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তবে আমার মনে হয়েছে, এইটা হাইলাইট না করাটা ঠিক সিদ্ধান্ত। লেখনী নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। আমি বরাবরই লেখকের লেখনীর ভক্ত। আমার ধারণা, ৭১ নিয়ে এরচেয়ে অসাধারণ লেখা হয়তো কেপি ছাড়া (আজকের তারিখে) অন্য কোন বাংলাদেশি লেখক লিখতে পারতেন না। তবে এইটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। শুভকামনা রইলো লেখকের জন্য।
This entire review has been hidden because of spoilers.
সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাক প্লাটুন নিয়ে লেখা দুর্দান্ত এক উপন্যাস। খুব সাবলিল ভাবে কেপি ইমন প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বকে পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। অ্যাকশনগুলো চমৎকারভাবে পরিবেশন করেছে। মনের পর্দায় যেন একটা সিনেমা চলছিল এমন মনে হয়েছে বইটা পড়ার সময়।
"মা গো, ভাবনা কেন... আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি তোমার ভয় নেই মা আমরা, প্রতিবাদ করতে জানি।"
শান্ত, নিশ্চুপ, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষগুলোও একদিন অশান্ত হয়ে ওঠে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জীবন বাজি রাখতে পারে। দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণপ্রিয় আত্মা উৎসর্গ করতে পারে। ওরা ভয় পায় না। ওরা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে হাসতে হাসতে মৃত্যুর মুখে লড়াই করে। কখনো কখনো মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করে যায়। এই মৃত্যুতে কোনো কষ্ট নেই। আছে এক অদ্ভুত আনন্দ। যেন কোনো অপার্থিব সত্তা জেগে ওঠে। বিজয়ের মঞ্চ প্রস্তুত। মৃত্যু তো কেবল জীবনের সমাপ্তি হয়। কখনো কখনো মৃত্যু নতুন জীবনের শুরু। যারা হারিয়ে গিয়েও হেরে যায় না, তারা বেঁচে থাকে মৃত্যুর পরও।
ক্র্যাক প্লাটুন নামটার সাথে আমার পরিচয় ঘটে দুটি বইয়ের মাধ্যমে। আনিসুল হকের "মা" আর জাহানারা ইমামের "একাত্তরের দিনগুলি" বই দুটো আমার কাছে বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু। দুই মহীয়সী নারীর জীবনের গল্প ছাড়াও ঢাকার বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা একদল তরুণের গল্প। যাদের মনোবল, অপার সাহসে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পর্যন্ত তটস্থ হয়ে ওঠে। রুমি, জুয়েল, বদি, কাজী কামাল, আজাদদের কেবল আমার যোদ্ধা মনে হয় না। ওরা তার চেয়েও অনেক উপরে। কোনো এক অদৃশ্য সুতোর টানে এ বন্ধন দৃঢ়। বাহান্ন বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেসব তরুণের গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। আগস্টের ২৯ তারিখের সেই রাত কোনোদিন ভোলা যাবে না। যাদের সামনে ছিল সম্ভাবনাময় এক জীবন, তারা বেছে নিয়েছিল অস্ত্র। সেই অস্ত্রের স্রোতেই কী না হারিয়ে গেল! এতগুলো বছর পরেও যেন তারা জীবন্ত। এখনো তারা সেই যুবক বয়সেই থেকে গেছে। তাদের বয়স বাড়েনি। বাড়বেও না। জুয়েল হয়তো ব্যাট হাতে বোলারদের ছাতু করতে পারেনি, রুমী হয়তো আমেরিকায় গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারেনি। কিংবা আজাদ হয়ে উঠতে পারেনি মায়ের শেষ সম্বল। তারপরও তারা বেঁচে আছে। আমাদের মাঝে, জীবনের অংশ হয়ে।
ক্র্যাক প্লাটুনের যেকোনো উপাখ্যান আমি মন দিয়ে পড়ি। যখন শুনেছি "আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে" বইটিতে তাদেরকে আবার জীবন্ত করার প্রয়াস চলছে, দেরি করার কারণ ছিল না। কিশোর পাশা ইমনের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বইটিতে কেবল ক্র্যাক প্লাটুন জীবন্ত হয়ে ওঠেনি। একই সাথে যে সাতজন যোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল, তারাও প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে। এ এক অন্যরকম যাত্রা। যে যাত্রায় শামিল হয়ে যেন ফিরে যাওয়া একাত্তরের সেই রণাঙ্গনে।
"আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে" বইটিতে আমার দুটি বিষয় ভালো লেগেছে। প্রথমটি হলো, পঁচিশে মার্চ এড়িয়ে যাওয়া। যেকোনো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ফিকশন জাতীয় বইয়ে পঁচিশে মার্চ এক অবধারিত বিষয়। সেই বিভৎস রাতের বর্ণনাগুলো এতবার পড়েছি, মাঝেমাঝে আর সহ্য হয় না। সেক্ষেত্রে এই ���ইয়ে সেই অংশ না দেখে ভালো লেগেছে। আর দ্বিতীয় অংশ হলো সামরিক যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হলেই, প্রথম যে আলোচনা সামনে আসে- সাধারণ মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণ। তাদের ত্যাগ স্বীকার। তাদের কথা বলতে গিয়ে আড়ালেই থেকে যায় সেই সব যোদ্ধারা, যারা নিজ দেশের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহ করেছিল। অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছিল। তারা না থাকলে হয়তো যুদ্ধটাই হতো না। যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে, সমস্ত কিছুতেই তাদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ ফিকশন জাতীয় বইগুলোতে খুব কমই তারা জায়গা করে নিয়েছে।
এখানে ব্যতিক্রম "আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে"। এই দেশের সামরিক বাহিনী কতটা সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছে তারই চিত্র উঠে এসেছে বইটিতে। যেমন হামিদুর রহমানের কথা বলা যায়। কিশোর বয়স এখনও পর হয়নি। সদ্য আর্মি ট্রেনিংয়ে গিয়ে যে বিভীষিকার সম্মুখীন হয়েছিল, তার থেকে ফিরে আসা হয়তো খুব একটা সহজ বিষয় না। তবুও অপার সাহস নিয়ে সে লড়েছে। নিজের জীবন বাজি রেখেছে। কিশোর বয়সের উচ্ছ্বাস যেন পুরোটা সময় যুদ্ধক্ষেত্রে বিলিয়ে দিয়েছে। এমন সাহসে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়? অবশ্য শেষ বেলায় কতটা পেরেছিলেন? তার জন্যই হয়তো একাংশের যুদ্ধ জয়ী হওয়া গেছে। বইটি সিপাহী হামিদুর রহমানের জীবনের অংশও বটে। যেখানে রান্নাঘর থেকে সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা, হামিদুর রহমানরাই যে পারেন!
অথবা বলা যায় মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের কথা। বক্সিং রিং থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্র, সবখানেই সমান পারদর্শী। সহযোদ্ধাদের জন্য জীবন বাজি রাখতে এক মুহুর্ত ভাবেননি তিনি। তিনি বেঁচে ফিরবেন কি না, তাও জানেন না। শুধু জানেন তার চেষ্টা বাঁচিয়ে দিতে পারে পুরো দলকে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের যুদ্ধের বর্ণনা লেখক যেভাবে দিয়েছেন, এক কথায় গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়! দারুণ, অনবদ্য। লেখকের লেখার মুন্সিয়ানার তারিফ করতেই হয়।
একই কথা খাটে মুন্সী আবদুর রউফের ক্ষেত্রেও। তার প্রচেষ্টায় বিভীষিকা থেকে বাঁচে একদল ইপিআর যোদ্ধা। একই সাথে তার সাথে পেরে উঠতে হিমশিম খায় পাকিস্তানি স্পীডবোট, লঞ্চ। সবকিছু হারিয়ে শেষ পর্যন্ত হার না মানা লড়াই করে সে। এরপর?
যুদ্ধের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার উপায় নেই। সহযোদ্ধা আহত হোক, বা মৃত; তাদের ছেড়ে আসা যায় না। যুদ্ধ কেবল এক যুদ্ধ না, একটি বন্ধন। একসাথে লড়াই করার মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী নূর মোহাম্মদ শেখ। নিজের পাশে থাকা আহত সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা এই বীর সেনানী জানে তার জন্য ওৎ পেতে আছে পাকিস্তান বাহিনী। তবুও সে ছুটছে। পারবে তো?
যুদ্ধ শুধু স্থলে হয় না। জলেও লড়াই করতে হয়। রুহুল আমিন তার সন্তানতুল্য দুটি গানবোট নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এতটা কি সহজ? আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে বিমান, একটি গোলার আঘাতে হয়তো জীবনের ইতি ঘটবে। তবুও কি ভয় পেলে চলে? জল পথের মতো আকাশ পথেও যে লড়াই করতে হবে। শত্রুর ডেরায় ঢুকে মতিউর রহমান তাই বিমান উদ্ধারে ব্যস্ত। কিন্তু চারিদিকে এত শত্রুপক্ষ। একা কী করবে সে? যুদ্ধটা তার একার না। যুদ্ধটা সবার। তবুও এই শত্রুর রাজ্যে বসে একাকী চেষ্টা করে যাওয়ার মতো দুঃসাহস আর কী হতে পারে?
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কোমল হৃদয়ের মানুষ যেন হুট করেই বদলে গেল। যুদ্ধই যেন তাকে পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী করে তুলেছে। প্রতিপক্ষের সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করতে হয় না বলেই হয়তো আজ তার আচার চালচলনে হিংস্র ভাব। উত্তরাঞ্চলের ত্রাস হয়ে ওঠা মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে একের পর এক জায়গা দখল করে নিচ্ছে গণবাহিনী। এই ক্যাপ্টেনকে যে করেই হোক থামাতে হবে। সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে শত্রুসেনা। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। পায়ে আঘাত লাগার পরও উঠে দাঁড়িয়েছে। তারই ছত্র ছায়ায় এগিয়ে চলেছে তার দল। কিন্তু ঘাপটি মেরে বসে থাকা পাকিস্তান বাহিনীকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হবে? এত এত মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরি করা জাহাঙ্গীরের শেষ পরিণতি কী হবে?
এত গুলো যোদ্ধা, বাংলার বীর সেনাদের নিয়ে কিশোর পাশা ইমন দারুণ খেল দেখিয়েছেন। টুকরো কিছু ঘটনা। যেগুলোর একটির সাথে আরেকটির যোগসাজস নেই। কেননা ক্র্যাক প্লাটুন যেখানে যুদ্ধ করেছে সেখানে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কিংবা মোস্তফা কামাল সেখানে ছিলেন না। আবার মতিউর রহমান কিংবা হামিদুর রহমান ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছে। এমন টুকরো ঘটনা একত্রিত করেছেন। লেখক এখানে একটি যাত্রায় পাঠকদের শামিল করেছেন। যেই যাত্রায় কেবল বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাক প্লাটুনদের গল্প।
"আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে" বইটি লিখতে লেখক যে পরিশ্রম করেছেন, তার ছাপ পুরো বই জুড়ে স্পষ্ট ছিল। যুদ্ধ তো কেবল মুখোমুখি লড়াই নয়, অনেক বুদ্ধির খেলা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের পদ্ধতি, অস্ত্র নিয়ে জানাশোনা, কিংবা পরিস্থিতি আয়ত্বকরণ জানা না থাকলে এ জাতীয় বই লেখা কঠিন। ফিকশনের ক্ষেত্রে আরো কঠিন। কেননা বাস্তব ঘটনাকে গল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হয়।
কিশোর পাশা ইমনের লেখা সহজ ও সাবলীল। বর্ণনাগুলোও মুগ্ধ করে। তবে যুদ্ধের বেশ কিছু দৃশ্য এত দ্রুত সংগঠিত হচ্ছিল, যে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল আসলে কী ঘটছে। আবার অনেক জায়গায় বর্ণনা দিয়েই বাজিমাত করেছেন লেখক। যেন না থেকেও যুদ্ধের সে অংশের অংশীদার হয়ে গিয়েছিলাম।
সাতজন বীরের মাধ্যমে যে গল্পের শুরু, তাদের মধ্য দিয়েই সে গল্পের শেষ। তবে কিছু প্রশ্ন আসলে থেকে যায়। নিজেদের উৎসর্গ করার এতগুলো বছর কী মূল্যায়ন পেল তারা? বাস্তবিক কোনো মূল্যায়ন তাদের করা হয়েছে? প্রশ্নটা তোলা থাকল।
পরিশেষে, ক্র্যাক প্লাটুন কিংবা বীরশ্রেষ্ঠ; মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি গল্পে বিশাল যোদ্ধা বা বীর হিসেবে দেখানো অবধারিত বিষয়। লেখক চেয়েছিলেন তাদের সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখাতে। কতটা পেরেছেন? কিছু কিছু মানুষের বীরত্ব এতটাই বিশাল, চাইলেও তাদের সাধারণ হিসেবে দেখানো যায় না। তাদের সেই বীরত্বগাঁথা অচিরেই সামনে আসে। জানান দিয়ে যায় সেইসব গল্প। যে গল্পের স্রোতে চির অমর হয়ে ওঠে ওরা...
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বইপত্র পড়েছি জীবনে। এগুলোর মধ্যে যেমন ফিকশন আছে, তেমনই আছে নন ফিকশন। দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক মুভি ও ডকুমেন্টারি। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে ডেডিকেটেড কোন বই বা ডকুমেন্টারির সন্ধান এর আগে আমি পাইনি। 'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে' পুরোপুরি ভাবে সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও ক্র্যাক প্লাটুনকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাস।
জাতির এই সূর্যসন্তানদের নিয়ে একটা আস্ত উপন্যাস লেখার আগে লেখক কিশোর পাশা ইমন চেষ্টা করেছেন ব্যক্তিপূজা আর পক্ষপাতের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সাদাচোখে তাঁদের সংগ্রামটাকে দেখতে। সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদেরকে তিনি অতিমানব হিসেবে না দেখিয়ে দেখিয়েছেন আমার-আপনার মতো সাধারণ দোষ-গুণে ভরা মানুষ হিসেবে। যেখানে দেখা যায় রুমী, আজাদ, কাজী কামাল, বদি, জুয়েলের মতো তরুণরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় খিস্তি করছে। দেখানো হয়েছে, ক্র্যাক প্লাটুন যখন পুরো ঢাকার বুকে গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে, তখনকার সময়ে এই তরুণরাও অনুভব করেছে ভয় ও উত্তেজনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘৃণ্য ও নারকীয় অপারেশন সার্চলাইটের পর বাংলার মুক্তিকামী মানুষগুলো কিভাবে একেকজন যোদ্ধায় পরিণত হয়, তা দেখার সুযোগ হয়েছে আমার এই বইটা পড়তে গিয়ে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের চমৎকার রণকৌশল, কিশোর সিপাহী হামিদুর রহমানের শুধু একটা রাইফেল পেয়ে সম্মুখ সমরে যোগ দেয়ার তীব্র স্পৃহা, ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের ত্যাগ, টাগবোটকে রীতিমতো যুদ্ধজাহাজে পরিণত করা ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার মোহাম্মদ রুহুল আমিনের জেদ, ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের সাহসী অগ্রযাত্রা আর বক্সার সিপাহী মোস্তফা কামালের নির্ভীক আত্মত্যাগ - সবটাই কিশোর পাশা ইমন তুলে এনেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে।
��েশের বিভিন্ন প্রান্তে যখন পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিলো ঠিক তখন অবরুদ্ধ ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনও বসে নেই। চোরাগুপ্তা গেরিলা হামলায় পাকি 'মাউড়া'-এর দলকে একদম ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলো গুটিকয়েক তরুণ। ঢাকার রাস্তাঘাটে ওয়েল ট্রেইন্ড পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মুড়ি-মুড়কির মতো জাস্ট উড়িয়ে দিয়েছিলো এই তরুণরা। স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে চাওয়া জুয়েল, বাস্কেটবল প্লেয়ার কাজী কামাল, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র রুমী, নিজের বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাইড আউট বানানো তরুণ আজাদ, ইউনিভার্সিটি কাঁপানো ছেলে বদি সহ আরো অনেকের রুদ্ধশ্বাস সব অপারেশন নিয়ে পড়তে গিয়ে বারংবার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ঠিকই বলেছিলেন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল অপারেশনের পর, "দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে।"
'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে'-এর ফ্ল্যাপে কিশোর পাশা ইমন লিখেছেন পাঠক সুযোগ পাবেন জাতির এই সূর্যসন্তানদের পাশে হাঁটার। সুযোগটা আসলেই পেয়েছি বলে মনে হয়েছে আমার। ৭১-এর সেই আগুনঝরা দিনগুলোতে অসংখ্য নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যেন সামান্য সময়ের জন্য হলেও পাশাপাশি চলার সুযোগ হয়েছে। তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যেকার আলাপ শোনার সুযোগ হয়েছে। তপ্ত সীসার ছুটে যাওয়া, মাথার ওপর শেলের বিস্ফোরণ, মেশিনগানারদের শিখণ্ডীর ন্যায় ধৈর্য্য - সবই বোধহয় কিছুটা হলেও অনুভব করার চেষ্টা করেছি নিজের ভেতরে। আর বারবার নিশ্চিত হয়েছি যে মানুষগুলোর ত্যাগ আমাদেরকে এই স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তাঁরা কখন যেন সাধারণ মানুষ থেকে হঠাৎ করেই মহান একেকজন যোদ্ধায় পরিণত হয়েছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা। সেই জায়গা থেকে 'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে' পড়ার জার্নিটা আমার আবেগকে নাড়া দিয়ে গেছে বারবার। কিশোর পাশা ইমনের গল্প বলার ধরণ বরাবরের মতোই চমৎকার লেগেছে৷ বইটা লিখতে গিয়ে তাঁকে প্রচুর স্টাডি করতে হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। বইয়ের শেষে তিনি নির্ঘন্ট যুক্ত করে দিয়েছেন ফার্দার রিডিংয়ের জন্য। ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। সাধারণ মানুষের কাতার থেকে সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও ক্র্যাক প্লাটুনের বিচ্ছুদেরকে দেখানোর যে প্রয়াস লেখকের ছিলো, আমার মতে সেটা সফল হয়েছে।
পরিশেষে বলবো, 'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে' আমার পড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সেরা উপন্যাসের তালিকায় একদম প্রথমের দিকেই থাকবে। সজল চৌধুরীর করা প্রচ্ছদটা ভালো লেগেছে। তবে বইটার বাঁধাই নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। অতিরিক্ত শক্ত মনে হয়েছে বাঁধাইটা বক্স শেপের কারণে। বেশি ভাঁজ করতে গেলে খুলে যাবে এই ভয় নিয়ে পুরো বইটা শেষ করতে হয়েছে। সেই তুলনায় পাইসটাও ওভার প্রাইসড মনে হয়েছে।
শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলেরা দেশরক্ষার টানে অশান্ত হয়ে উঠলে কি হয় তা আরেকবার জানার জন্য পড়ে ফেলতে পারেন এই চমৎকার উপন্যাসটা।
ব্যক্তিগত রেটিং: ৪/৫
বই: আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে - ক্র্যাকস অফ সেভেন্টিওয়ান
এই বইটা যতক্ষণই পড়ছি বুক ভারি হয়ে ছিলো। বই পড়ার মাঝখানে কোনো চরিত্র আসলে গুগল করে, এক নজর তাঁর ছবি খুঁজতাম দেখার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এত সুন্দর করে উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই। আমার এখনও কষ্ট হচ্ছে কানতেছি। আমি কি রিভিউ লিখবো জানি না বলার মতো ভাষা নাই। শুধু এতটুকু বলবো বাংলাদেশের প্রতিটা বই পড়ুয়ার এই বইটা পড়া উচিত। বীরশ্রেষ্ঠ এবং ক্র্যাক প্লাটুনদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবেন।
বইটা পড়তে গিয়ে আমি শুধু কাঁদছি। সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাকপ্লাটুনের পরিণতি জানা থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত পরিণতি ঘটার সময় পড়ে আর ইমাজিন করে শুধু কাঁদছি। 😢
তাদের প্রতিটা পদক্ষেপে মনে হয় যেনো আমি তাদের সাথেই ছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের একটা অংশ। ছোটবেলা থেকে আমরা এই নিয়া এত কথা শুনি যে মনে করি সম্ভবত প্রায় সবকিছুই জেনে বসে আছি যে একাত্তরে কী হয়েছিল আর কেমন করেই বা হয়েছিল। বিষয়টা কিন্তু আসলে এত সহজ না। নয় মাস এর চাইতে কিছুদিন কম যুদ্ধ হলেও এই সময়ের মাঝে এত ঘটনা ঘটেছে যে সবকিছু জানাটা প্রায় অসম্ভব।
বীরশ্রেষ্ঠদের কথা আমরা ছোটবেলায় সবাই-ই পড়সি। এখনও মনে আছে ক্লাস ওয়ানের বইয়ে মতিউর রহমানরে নিয়া একটা অংশ ছিল বাংলা বইয়ের শেষের দিকে। এরপর রচনা লেখার জন্য পড়তে হতো, সাথে অনেক ক্লাসে বইয়ের মাঝেই যুক্ত করা থাকতো বীরশ্রেষ্ঠদের বীরত্বের কাহিনি। তবে এই বিষয়ে আমাদের বেশিরভাগের জানাটা সেই প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলোর মতোই রয়ে গেছে এখনও।
সাত বীরশ্রেষ্ঠ আমাদের ভূমির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মাঝে ছিলেন। স্বাধীনতার জন্য ও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হওয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অনেক বীর বাঙালি মৃত্যুবরণ করলেও সবার কথা আমরা জানি না। কিছুটা জানি এই সাতজনরে নিয়ে। কেন সকল বীরশ্রেষ্ঠ কোনো না কোনো বাহিনির সদস্য ছিলেন সেসব আলাপ বাদ দিয়ে তাদের বিষয়ে একটু হলেও বিশদে জানার জন্য এই বইটা অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।
ক্র্যাক প্লাটুন এর গেরিলারা একাত্তরে আমাদের দেশের আরেক গর্বিত সন্তানদের দল। এইসব যুবকরা কী দারুণ ফাইটটাই না করসেন নিজেদের জীবন হাতে নিয়া। এদের মাঝে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি এর কারণে মেধাবী রুমী, আনিসুল হক এর উপন্যাস মা এর কারণে আজাদ আর খেলাধুলা নিয়ে হালকা ধারণা থাকায় জুয়েল এর কথা আমরা জানি। তবে কিছুটা। ���দের বিষয়ে আরও কিছু জানার জন্য হলেও হাতে তুলে নেওয়া উচিত বেশ ভাল রকম সাইজের এই বইটা।
প্রতিভাবান লেখক কিশোর পাশা ইমন অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করলেও এইটাকে সেই শ্রেণিতে ফেলার কোনো যুক্তি আমি দেখিনা। মুক্তিযুদ্ধ নিযয়ে, আমাদের বীর ছেলেদের নিয়ে লেখা এই বইটা একখানা গদ্যে লেখা মহাকাব্য। অবশ্যই নিজের কথায় লেখক বলেই দিয়েছেন এই বইয়ের শতভাগ কথা সত্য না। কারণ একাত্তরের সবকিছু নিয়া একশ ভাগ সত্য কাহিনি জানাটা স্বাধীনতার অর্ধ শতক হয়ে যাওয়ার পর সম্ভব না। এর বাইরে গিয়ে আপনাকে মনে রাখতে হবে এইটা একটা উপন্যাস। ফিকশন। এখানে লেখক অনেক জায়গায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন সেইটাও বলে দেওয়া আছে। এরপর যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাইলে পড়াটা ভাল সিদ্ধান্ত হবে।
লেখক হিসাবে কেপি প্রথম শ্রেনির অন্তর্ভুক্ত বলে আমার বিশ্বাস৷ এই বইয়েও এর প্রতিফলন আপনি পাবেন। প্রতি পেজের মাঝে নিজের লেখাটা উনি এমন করে লেখেন যাতে আপনার মন আপনাকে পরের পেজে যেতে বাধ্য করে। কেপির বর্ণনা ভাল। গতিময়। আরামদায়ক। শব্দচয়ন প্রশংসনীয়। বিরক্ত হবেন না এইটা বলা যায়। হিউমারের ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবে অনেক জায়গার মাঝে।
কেপির লেখার মাঝে একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। যেইটা আমাদের অন্য সকল লেখকদের মাঝে খোঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। সেইটা হলো অ্যাকশন সিনে ওর হাতের জাদু৷ আর্মড কিংবা হ্যান্ড টু হ্যান্ড, দুই জায়গাতেই ওর ডিটেইলিং থাকে ভয়ানক রকমের ভাল৷ অস্ত্রের বিষয়ে ওর জ্ঞান আছে অনেক পরিমাণে। তাই এসবের বর্ণনা পড়ে আরাম পাওয়া যায়। নিছক কল্পনা বলে মনে হবে না।
এই লেখাটা এত নিখুঁতভাবে লেখা যে আপনার চোখের সামনে দেখতে পাবেন যে কী ঘটতেছে। সাথে আবেগ আছে। বর্ণনা পড়ার ফাঁকে আপনি কখন যে ইমোশনাল হয়ে যাবেন এইটা বুঝতে পারবেন না।
এই বইয়ের আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো এর ফ্লো পুরো সময়ই ঠিক ছিল। ৪০০ পাতার বই আমরা হরহামেশা পড়ি। কিন্তু এত হিউজ সাইজের প্লট থাকে খুব কম বইয়ে। এই ক্ষেত্রে এসে সম্ভাবনা জন্মায় যে বিভিন্ন জায়গায় গিয়া বই ফ্লো হারাবে। তবে কেপি জাদু দেখাতে পেরেছেন এই জায়গায়।
যারা মনে করেন বাংলায় নাকি নতুন কেউ ভাল লিখে না তারাও পড়ে দেখতে পারেন। বহু মিলিয়ন কপি বিক্রি হওয়া লেখকের চাইতে অনেক ভাল লেখা এইটা। টাকা এবং সময় এই দুইটার কোনোটারই অপচয় হবে না এই গ্যারান্টি দেওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল নিয়া হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে এখনতক। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আলোচনা, সমালোচনা অনেক কিছু। সময়ের স্রোতে এর মাঝে থেকে টিকে থাকবে খুব কম। এর মাঝে ভাল বইয়ের সংখ্যা হবে আরও কম। কাবজাব জিনিসপাতির সংখ্যার প্রাধান্য দেখা যাবে। আবার বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে এইরকম লেখা আর হয়েছে কিনা বা হলেও এইটার মত ভাল কাজ আর হয়েছে কিনা এটা আমার জানা নাই। সম্ভবত হয় নাই। আর সামনের দিনগুলোতে কেউ এমন কিছু আমাদের উপহার দিতে পারবেন এমন সম্ভাবনা বেশি নাই। তাই আমি মন থেকে চাই এই বইটা যেন টিকে থাকে। যতদিন বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ টিকে থাকবে ততদিন আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে এর মতো বই থাকার দরকার অনেক বেশি।
“রোজা কোন্দিয়া শ্যাষ হই গেল বুঝলামই না!”,রোজা না তরমুজের কাটাকাটির হিসেবে ব্যস্ত সে হিসেবে আর আমরা গেলাম না। গুনে গুনে আজকে চলে গেছে ছাব্বিশটা রোজা। আজকে প্রায় সব অফিস আদালতের দরজা লেগে গেছে ঈদের ছুটি উপলক্ষে। আজকের ইফতারও বলা যায় শেষ ইফতার এইবারের মতো। সামনের বার কে কোন চুলোয় থাকি কে জানে!
“ম্যাডাম , বই টই চেঞ্জ করা লাগছিল তো, আপনার কয়টা রয়ে গেছে আমার কাছে”, বাসা থেকে আনা কাচা আমের শরবতের টেম্পরেচার চেক করতেছি গালে বোতল ঠেকিয়ে। বাল! জিনিস গরম হয়ে গেছে! খামু কেমনে এই জিনিস। “ আমার অফিস তো বন্ধ মিয়া! Chill, ঈদের পরে পালটে নিও।“, আইস্ক্রিমের স্কুপের শেপের চামচ ধুচ্ছেন পানিতে উনি। “আর থান ইটের মতো সাইজের বই ঘাড়ে করে নেয়ার মতো বলদামি আর করবো না বুঝলা, হুদাই পড়িনা কিছু না শুধু শুধু বোঝা বাড়ানোর মানে নাই।“, চামচ ধুয়ে মুছে হালিমের বাটির উপর রেখে দিলেন। এদিকে পাকা হাতে পেয়ারা আপেল কেটে সাজিয়ে পলিথিনের উপর সাজিয়ে রেখেছেন বায়োজিদ ভাই। হালিমের স্পনসরও আজকে ভদ্রলোক।
সাইরেন দিয়েছে খানিক আগেই। দিনের শেষ আলোটাও নিভে গেছে। ইফতার প্রায় শেষের পথে। হালিমটাই বাকি রয়ে গেছে। শেষ হবে কিনা কে জানে। তরমুজ, শরবত আর পানিতে তিনজনের পেটই ডিগডিগা হয়ে আছে। পকেট থেকে ভাইয়ের আনা ব্রির প্যাকেট থেকে একটা ব্রি ধরিয়ে ফেললাম চট করে। গলগল করে ধোঁয়া পাঠিয়ে দিচ্ছি ডিসিলেকের আকাশে। ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ছুয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণচুড়া গাছের ডাল পাতাকে। “কেপির নতুন বইটা একবার পড়লে হবে না ম্যাডাম বুঝলেন”, ব্রির অর্ধেক ঝুলে থাকা ছাইটুকুকে খুব মনোযোগের সাথেই দেখতেছি আমি।“ এই জিনিস ধীরে লয়ে কয়েকবার পড়ার মতো বই”,যোগ করলাম আমি।“কেন?, বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন আর সেক্টর দুইয়ের ক্রাক প্লাটুনের কাহিনিই তো থাকবে! আর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই তো!”, পানির বোতল দুই হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করছেন ঠিকই তবে বোতলের থেকে মনোযোগ এখন আমার দিকেই বেশী। “কারণ এখানে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ আমাদের মতই সাধারণ মানুষ, ব্যাটম্যানের মতোই দ্যা ডার্ক নাইট, ক্রিপ্টোন থেকে আসা কার্ক ক্লেন্ট নয়।“, শরবতের বোতল টেনে নিলাম। অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে শরবতের পরিমাণ। খেতে টপক্লাস শরবত না হলেও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো হয়নি এই জিনিস। দুই ঢোক চালান করে দিলাম পেটের ভেতর। “কেপির এই গুন অবশ্য অনেক আগেই চোখে পরেছে আমার। যে হীরকখন্ডের কাহিনী তো একেবারে হাত থেকে নামানোর মতো নয়। শুরু করলে শেষ না কইরা উপায় নাই।“, হাতে থাকা ছোট্ট লাইটারটাকে একটু পর পর জ্বালাচ্ছেন। যেন বড় এক জোনাক পোকার পাছা জ্বলছে নিভছে একটু পর পর। “পুরো বইয়ের কাহিনী তো আমাদের ১৬ কোটি মানুষেরই জানা! কিন্তু তবুও এভাবে কেউ কানেক্ট করতে পারে নাই কেউ। সাত জন বীরশ্রেষ্ঠকে এক টাইমলাইনে সাজিয়ে ঘটনা প্রবাহকে এক নদীর স্রোতে প্রবাহিত করা!”, সিগারেটের যেটুকু বাকি ছিল সেটুকুও ছাইয়ে পরিনত হয়েছে। ফেলে দিলাম ফিল্টারটুকু। বায়োজিদ ভাই চুপচাপ আরেক পিস তরমুজে হামলে পরেছেন। “ এরপর ধরেন ক্র্যাক প্ল্যাটুনের রুমিদের পাগলামি কিন্তু কারোরই অজানা নয়! কিন্তু এইখানেই লেখক গেমটা খেলে দিয়েছেন। স্পেশালি ইন্টারোগেশনের রুমের যে পরিস্থিতি , আহ পুরাই মাক্ষি!“, পিঠটা ভার হয়ে আসছে। হাফ লিটার কাচা আমের শরবত, এক ফালি তরমুজ, আপেল আর ব্রি। গতর চলবে ক্যামনে! “এইখানে গেম খেলার কী আছে মিয়া?”, তরমুজের ফালি থেকে নাকি উঠাইলেন অবশেষে বায়োজিদ ভাই। মুখ চোপা একেবারে রসে টুইটম্বুর। এই লোক জাত তরমুজ খোর যে সে নিয়ে আর কারো সংশয় নাই! “ভাই ক্রাক প্লাটুনের সেই কন্টিনেন্টালের ভেতরে ঢুকে গ্রেনেড ফাটানোর মতো পাগলামি এসব আজকের ফেসবুকের বাজারে সবাই চোখে চোখে কয়েক বার পড়ে খতম দিসে কয়েকবার। কিন্তু সে সময় রুমীদের মানসিক অবস্থা, আজাদ , বদিদের ইস্পাতসম নার্ভের কথা কিন্তু কোথাও পাবেন না! এইটা সুন্দর করে তুলে আনছে লেখক। ওদের চালচলন, পছন্দ অপছন্দ এসব খাপ খাইয়ে বসাতে পারে নাই কেউ।“, উঠে গিয়ে একটু নাড়াচাড়া দিলাম মাঞ্জাডারে। হালিম খাওয়া বাকি। এক খালু ছিল মুক্তিযোদ্ধা। বেডায় কইতো মোচড় মারলে নাকি প্যাট খালি হয়। আইজ ট্রাই কইরা দেখি আসলেও খালি হয় কিন��। খিদেটাকে চাগিয়ে উঠানোর জন্য আরেকটা সিগ্রেটে অগ্নি সংযোগ করলাম। “হামিদুর রহমানের হাইশাল ঘর থেকে রাইফেল হাতে নেয়ার যে আকুতি সেটা আপনি মনে হয়না কোনো বইতে পাবেন, এরপর ধরেন আপনার সবচেয়ে পছন্দের বীরশ্রেষ্ঠ কে এই প্রশ্ন কখনো করেছেন ভাই নিজেরে? আমিও জানিনা কার চেয়ে কারে এগিয়ে রাখবো! তবে বয়সের তুলনায় সবচেয়ে ছোট্ট হামিদুর যে কলজে দেখাইছে সেটা বোধহয় আর কেউ দেখাইতে পারতো না! ওর বোনের শাড়ির জন্য আকুতি! শেফালীরে বিয়ে করার আগ্রহ এসব কিন্তু অন্য বইতে পাবেন না ভাই!”, সিগারেট বিস্বাদ লাগছে কেন যেন। আচ্ছা আমার পছন্দের বীরশ্রেষ্ঠ কে? হামিদুর? রুহুল আমিন? মুন্সি আব্দুর রউফ ? মতিউর রহমান? নাকি উত্তরের ত্রাশ জাহাঙ্গীর? যারে মারতে স্নাইপার পাঠানো হইছিল? হুর বাল মাথাও ঠিকমতো কাজ করতেছে না। “সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে এই বইয়ের অনুচ্ছেদ গুলোর নাম করণ! এর চাইতে জোশ আইডিয়া আর হয়তো হইতো না। পুরা বইয়ের স্বার্থকতা এই অধ্যায়ের নাম করণেই।“, সিগারেটের শেষ অংশকে ফিক্কে ভাসিয়ে দিলাম ডিসি লেকের জলে।
“হইসে হইসে,আইজ হালিম না খাইলে স্যাডা ভাইঙ্গা হাড্ডি গুড়া গুড়া কইরা জনসেবা চত্ত্বরে থুইয়া আমু কইলাম”, হালিমের বাটির ঢাকনা খুলে ফেলছেন ইতিমধ্যে। আমি আগ বাড়িয়েই সাথে থাকা পলিথিন থেকে কয়েক খন্ড লেবু বের করে ফেলছি। চিপে রস ফেলছি হালিমে। পুরো ৩০০ টেকার হালিম। শেষ করতে খবর হয়ে যাবে আজকে। রাতের খাবার তো চাঙ্গে উঠছেই। শেষ রাত অব্দি পেট খালি হবে কিনা সন্দেহ! “গেদি ফুন থুইয়া এমমুহি আয় ছে, হালিম খা”, চামচ এগিয়ে দিলেন ম্যাডামের দিকে। এইদকে আমি আর ম্যাডাম হাসতে হাসতে শেষ। ভাষার এমন সুমধুর প্রয়োগ মেলা ভার। “ঐ মিয়া তোমারে কী মুখে তুইলা খিলাইয়া দেওন লাগবে?”, কৃত্তিম রাগে ফেটে পরার দশা বায়োজিদ ভাইয়ের। “ আপনেরা শুরু করুইন আমি লেবু চিপ্পা শেষ করি, নইলে হালিম খাইয়া জুত পাইবাইন না।“, আস্তে আস্তে চিপে চিপে রস বের করছি আমি। নিরালার হালিমের অনেক প্রশংসা শুনেছি শেষ কবে খেয়েছিলাম মনে নেই। তবে গন্ধ শুকে মনে হচ্ছে হালিম ভালো হবে। “ বই কিন্তু এখানেই শেষ নয় ম্যাডাম আরেকটু বাকি রয়ে গেছে, যদিও শেষটায় তিক্ততা বেশি, অনেকটা বাস্তবতায় ঘেরা। যুদ্ধের কাহিনী এসে যোগ হয়েছে আমাদের জীবনস্রোতে।“, হালিমে মজে গেছি অলরেডি। স্বাদে আসলেও মারাত্বক তো নিরালার এই হালিম। তিনজনের আক্রমনে এরমাঝেই হালিমের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাকিটা শেষ হতেও বেশীক্ষন লাগবে বলে মনে হয় না!
“ভালো কথা বইয়ের রিভিউ লেখবা না? তোমার বন্ধুর কাছে শুনছি এককালে সেই লেখতা হাজার হাজার শব্দের রিভিউ!”, হালিমের খানা পর্ব শেষ অন্তত আমার আর ম্যাডামের জন্য। বায়োজিদ ভাই আন্ধাগুন্দা এখনো চামচ দিয়ে চেটে যাচ্ছে হালিমের বাটি। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়ে গেল নিরালা হোটেলের সাদা হালিমের বাটি। “দু এক লাইন লিখবো হয়তো গুডরিডসে, তবে ছবি তুলেছি বইয়ের ম্যাডাম, এক্কেবারে জায়গা মতো।“, পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে আনলাম। গ্যালারি ঘেটে বের করলাম আমার এবারের তোলা সবচেয়ে পছন্দের ছবি। ফোন বাড়িয়ে দিলাম ম্যাডামের দিকে। “ওরে শালা!, এত্ত কারেন্ট! এই জায়গায় গেছো? বইয়ের ছবি তুলতে?”, চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। “দেহি গেদি এমফি দে ছে, আমিও দেহি!”, ম্যাডামের কাছ থেকে টেনে নিলেন আমার ফোনটা! “নাহ আসলেও তোমার কারেন্ট আছে পোলা!”, ছবি দেখছেন বায়োজিদ ভাই। যদিও বইটা বেশ আউট ফোকাসড। কিন্তু এই বইয়ের ছবি আর অন্য কোথাও তুলতে মনে সায় দিলো না। আর বইয়ের কাহিনী আর পটভুমির জন্য এর চেয়ে সুন্দর জায়গা হয়না।
খাওয়াদাওয়ার পাট সেড়ে উঠে পরলাম আমরা তিনজন। এবারের গন্তব্য শহরের প্রাণ কেন্দ্র। পরে রইল পেছনে গল্পগুলো। সময়ের সাথে সাথে ওরা আটকে থাকে ঠিক এভাবেই। যেভাবে শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলেরা জীবন্ত রয়ে গেছে বইয়ের অক্ষরের মাঝে……
"আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে" (ক্র্যাক্স অফ সেভেন্টিওয়ান)
মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা ফিকশন এর সংখ্যা কম না। কিন্তু মজার ব্যাপার কিংবা দু:খের ব্যাপার এই যে এই বইটিই প্রথম বই যা সাত জন বীরশ্রেষ্ঠকে একত্রে এনেছে এক মলাটের নীচে। তাদের সাথে স্থান পেয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে জনপ্রিয় যোদ্ধার দল - ক্র্যাক প্লাটুন। তাদের নিয়ে কিন্তু অনেক ভাল ভাল কাজ হয়েছে।
বীরদের আখ্যান দু'ভাবে লেখা যায়। এক তাদেরকে অতিমানবীয় রুপে দেখানো কিংবা তাদের অতি সাধারণ এর চেয়েও নিম্ন রূপে দেখানো। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা অধিকাংশ সাহিত্যে এক নম্বর ধরণই প্রাধান্য বেশী পায়। তারা তো আমাদের মতো মানুষ ছিলেন। এ দিকটা অধিকাংশ লেখক ভুলে যান। আর তাদের এই ভুলে যাওয়াটা আমাদের ও ভুলতে শিখিয়েছে যে আমরাও তাদের মত হতে পারব। তাদের গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে পারব। কিন্তু না! আমরা ধরেই নিয়েছি ওরা মুক্তিযোদ্ধা, ওদের কাজ ওইটাই! তারাও তো আমার আপনার মত পরিবারের মানুষ, কারো বাবা, কারো ভাই কিংবা কারও স্বামী! লেখককে আমি বাহবা দিতে চাই আর কিছু না হোক, অন্তত তাদের "বাংলার সাধারণ মানুষের " মত চিত্রিত করার জন্য! কোন গ্রীক বীর কিংবা মিথলজির নায়ক হিসেবে নয়, সোজাসাপ্টা একজন মানুষ রূপে দেখানোর জন্য।
গল্প শুরু হয় এক ১৮ বছরের বালকের রান্না করতে গিয়ে ভাত পুড়িয়ে ফেলা দিয়ে। বালকটি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। ইচ্ছা তার যুদ্ধ করবে। রাইফেল ধরবে। খানসেনাদের মারবে। কিন্তু রান্নাঘরেই তাকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন কমান্ডার। গল্প এগোতে থাকে আসে একদিন, যেদিন ছেলেটি রাইফেল পায় আর যুদ্ধে নামে। কি তার সাহস! কি তার তেজ! তাকে দেখে অবাক হোন আরেক বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ। ভাবেন এত অল্প বয়সে যেখানে তিনি গান বাজনা, যাত্রাপালা করতেন। সেখানে এ ছেলে যুদ্ধ করছে! তার মনে হয়, হয়ত দেশটা স্বাধীন হবেই তাহলে এবার!
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের পাকিস্তান থেকে সা্হসী পলায়ন পিলে চমকে যাবে। দেশে যিনিএসে সাব কমান্ডার হয়ে সাহসী ভূমিকা রাখেন। তরুণদের প্রশিক্ষিত করবেন। কাছাকাছি সময়ে আরেক বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। পাকিস্তান আর্মির ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। প্রশিক্ষিত করতে থাকেন নিজ এলাকার তরুনদের। স্বপ্ন দেখেন বাংলার নিজস্ব এয়ারফোর্সের। উড়িয়ে আনতে চান টি-৩৩।
মুষ্টিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল। রিংয়ে দুর্ধর্ষ। ঠিক তেমনি মেশিনগানে। পাঠক বইয়ে বিস্ময় নিয়ে পড়বেন তার করা অপারেশন গুলো। আর ভাববেন 'মুক্তিযুদ্ধ করতে অস্ত্র লাগে না, ট্রেনিং লাগে না, লাগে বিচি' কি অপরিসীম সাহস! নিজে কাভারে থেকে সতীর্থদের পালানোর পথ করে দিয়েছিলেন। একা মেশিনগানে হানাদারদের আত্মায় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছেন। আর বলে গিয়েছেন - "খালেদ মোশাররফ কে বলবা এই এলাকার আর্টলারিদের তামাতামা করে দিতে "
"leaders take decision quickly and when you are a fighter decision already taken "
খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর আশে পাশে গ্রেনেড ফাটাতে। কিন্তু একদল পাগল যোদ্ধা, যাদের বয়স কুড়ি পচিশ, এক্কেবারে হোটেলের ভেতরে ফাটিয়ে আসে! শত বিদেশী কর্মী, সাংবাদিক, প্রতিনিধিদের মনে লিখ্র দেয় - yes we are fighting! যা শুনে খালেদের মত বীর ও হতবাক হোন। আর বলেন এরা তো সব 'ক্র্যাকস' সেখান থেকে ক্র্যাক প্লাটুন। বলছি আজাদ, কাজী কামাল, জুয়েল, রুমীদের কথা। সেই জুয়েল, যার স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্��ান হবে।সেই রূমী, যে স্কলারশিপ নিয়েও আমেরিকায় যান না, একেবারে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। আহা কত রক্তের বিনিময়ে এই পাসপোর্ট।
এমনি ভাবে গল্পে আপনি আমাদের সূর্যসন্তানদের সাথে হাটবেন। তাদের গল্প শুনবেন।আর তাদের কাছ থেকে দেখে বলবেন আরে ও তো আমাদের মতনই। ওরা পারলে আমরাও তো পারব।
তবে বইয়ের শেষে লেখক খুব বাস্তব সত্য কিছু কথা লিখেছেন।যা আগ্রহী পাঠকদের জন্য তোলা থাকলো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া-
কেপির সাবলীল লেখনী যেকোন পাঠককে কাছে টানবে। তার পাঠকের মনযোগ ধরে রাখার টেকনিকগুলো অন্য বইয়ের মতন আকর্ষণ সৃষ্টি করবে। ভাষা সুন্দর। কাহিনী বিন্যাস সুন্দর। তবে আরও আকর্ষণ পেতে পারতেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এবং বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। কিছু অধ্যায়ের বিন্যাসে একটু সমস্যা লেগেছে। তবে সম্পূর্ণ কাজের কাছে এসব নস্যি। যে ক্যানভাস কেপি ইমন ধরত্র চেয়েছেন, আমি বলব শতভাগ সফল।
বইটি বাংলাদেশে জন্ম নেয়ে প্রতিটি মানুষের পড়া উচিত। এক মলাটে দেশের সূর্যসন্তানদের জানার সুযোগ করে দেয়ায় লেখকে সাধুবাদ।
বই পরিচিতি- আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে লেখক - কিশোর পাশা ইমন প্রকাশনা- নালন্দা মূল্য ৮৫০ (মুদ্রিত) পৃষ্ঠা -৩৮৮
কেপির লেখনশৈলী বরাবর ই পাঠক আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট। তার উপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ যেন আর ও প্রাণ দিয়েছে।
ব্যক্তি কেপি আর লেখক কেপিকে আমি কখন ও একত্রিত করিনা, কারণ লেখক সত্তা আর ব্যক্তি সত্তাকে আমি আলাদা নজরেই দেখি। তবে উনি বোধয় উনার ব্যক্তি সত্তা আর লেখক সত্তা কে এক হিসেবেই দেখেন। এইটা ও উনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। উনি উনার চিন্তা ধারণা বাকিদের মাঝেও ছড়াতে চাইবেন এইটায় স্বাভাবিক।
যাইহোক বই এর প্রবাহে আসি।
বই টপ নচ। ৯/১০!!
পুরো বই এর ফ্লো টা নষ্ট হয়ছে শেখ মুজিবুর রহমান কে ওরশিপের মাধ্যমে। উনারে মহামানব না বানাইলে বোধয় চলতো!!
আর পুরো মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ বাঙালী দের টেনে আনার জন্য ধর্মীয় ভাবেও প্রচারণা চলেছিলো।
মজার ব্যাপার হল পাকিস্তানি হানাদার দে কে উনি হামাসের সাথে তুলনা করেছেন 😂 একটা ভাল পরিচ্ছন্ন প্লটকেও ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত করা যায়, এইটা না দেখলে বুঝতাম না।
যাইহোক,
একটা দেশের উন্নতির জন্য অবশ্যই অবশ্যই সাম্প্রদায়িক মিল মহব্বত থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন ধর্মালম্বী রা যদি বিদ্বেষ নিয়ে বসে থাকে তবে তা দেশের উন্নতির পথে ব্যাঘাত ঘটাবেই।
সেখানে ক্রমাগত ভাবে একটা সম্প্রদায়কে নিয়ে অনবরত খোচাখোচি তাদের ঈমান আকিদাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি নষ্ট করা একজন, কিভাবে দেশ প্রেমিক হতে পারে এইটা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। দেশ প্রেমিক শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য হয়না, যে দেশ প্রেমিক সে দেশের সকল হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবার জন্যই সমান ভাবে ভালবাসা রাখে। এইটা ভিন্ন ব্যাপার লেখক এই ধারণা বোধয় পোষণ করেন না।
বইয়ের নাম : আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে লেখক : কিশোর পাশা ইমন পৃষ্টা সংখ্যা: ৩৯০ প্রকাশনা : নালন্দা জাদুঘর সিরিজ দিয়ে মূলত লেখকের লেখা পড়া শুরু। একে একে সব ই পড়া। প্রতিটি বই একটা অন্যটার চেয়ে আলাদা। আমাকে কোনটা বেস্ট বলতে বললে আমি বলতে পারবো না। এই বই টা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় কিন্তু যার মাধ্যমে আমরা আজকে একটা স্বাধীন দেশে বসবাস করি সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা। কিন্তু কাদের নিয়ে। যাদের কে বীরশ্রেষ্ঠ বলে জানি। কিন্তু আসলে তাদের সেই সময়ের সাথে পরিচিত আমরা কখনো ই ছিলাম না। এই বই আমরা দেখবো তাদের সাথে যুদ্ধে সামিল হবো, তাদের চিন্তার সাথে একাত্ম হবো, তাদের কৌশল গুলো দেখবো, কিশোর সিপাহি এর মুক্তিযোদ্ধা হোওয়ার পিছনে এবং পরের ঘটনা ভিতর দিয়ে যাবো। ঢাকায় তান্ডব চালানো গেরিলা বাহিনীর অনেক অংশ ই জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিন গুলোতে পড়া ছিল্য। এই বই আমাদের ব্রেণের নিউরনে ধাক্কা দিবে। একই সাথে বর্তমানের অসংগতি গুলো ও দেখবো। আমি ও লেখকের মতো আশাবাদী আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলেদের হাত ধরেই আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ এবং ক্রেক প্লাটুনকে এক মলাটে কোনো গ্লোরিফাই না করে সম্ভবত এটাই একমাত্র বই। পড়ার সময় যুদ্ধের রনকৌশল, যুদ্ধের বিবরণ কোনো কিছু বোরিং করে নাই। তো দেরী না করে পড়ে ফেলুন লেখকের আরও একটি মাস্টারপিস বই।
আমাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাক প্লাটুন কে নিয়ে লেখা ডকু ফিকশন! আমরা সবাই কমবেশি তাদের নিয়ে জানি। লেখক সেই বিষয়টুকু মাথায় রেখেই নির্ভেজাল ভাবেই সাত বীরশ্রেষ্ঠকে তুলে ধরেছেন আমাদের মাঝে।
আপনি পড়ার সময় তাঁদের সাথেই হাঁটবেন, তাঁদের কষ্ট বুঝবেন,দেশের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা গুলোও উপলব্দি করবেন। যখন এক জন একজন করে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্তিম সময় গুলোতে যাবেন আপনার ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে যাবে,দুচোখ ভরে যাবে পানিতে। এত ত্যাগ,এত রক্ত,এত কিছুর পর আমাদের আজকের এই বাংলাদেশ! স্বাধীন বাংলাদেশ!
ব্যাক্তিগত ভাবে আমি সবাইকেই জীবনে একবার হলেও এটা পড়তে বলবো! মাস্ট রিড বিফোর ইউ ডাই!! একবার হলেও!
লেখক আরেকটি কথা বলেছেন,এই দেশ আমাদের,এটা বাইরে থেকে কেউ ঠিক করতে আসবে না। আমাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে নিজেদের সমস্যা। যাবতীয় সকল অনিয়ম দূর করতেই হবে! এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া মাটি কিছু খারাপ মানুষের জন্য নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। এটাই
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মত একটা বিশাল ক্যানভাসকে কভার করতে হলে এন্থলজি ফরম্যাট সবচেয়ে কার্যকর। এই জায়গায় লেখক উতরে গেছেন বলেই আমি ৪ স্টার দিয়েছি। 'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে'র প্রথম অর্ধ যতটা উত্তেজনাপূর্ণ, দ্বিতীয়ার্ধে ততটাই ঝুলে গেছে। শেষদিকে কাহিনীর গাঁথুনি হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। যেসময় মুক্তিযুদ্ধ একটা গেরিলা ইন্সার্জেন্সি থেকে কনভেনশনাল যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, সে সময়ের বর্ণনা আশানুরূপ না। তবে প্রথমার্ধ অত্যন্ত টাইট। অসম্ভব রোমাঞ্চকর ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মে-জুন মাস পর্যন্ত। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রব, মোস্তফা কামাল, আর হামিদুর রহমান উঠে এসেছেন দৃপ্তভাবে, সাথে এসেছেন আমাদের সবচেয়ে বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা - বীরবিক্রম শাফী ইমাম রুমী। যুদ্ধকালীন অস্ত্রশস্ত্র বা ট্যাকটিক্স নিয়ে লেখক বেশ পড়াশুনা করেছেন বোঝা যায়।
এমন এক সময়ে বইটা হাতে নিয়েছিলাম, যখন এর অনেক কথাই মনে হয়েছে এই ২০২৪ এ এসেও প্রাসঙ্গিক। কিছু কাহিনী খটকা তৈরি করলেও লেখক তো শুরুতেই বলে দিয়েছে এমন হতে পারে সে কথা।
টাইপো আছে কিছু কিছু হুট করে সেসব চোখে লাগে বিশ্রীভাবে। এছাড়াও কিছু কিছু বাক্য কেমন যেন পড়ে ঠিক শান্তি পাওয়া যায় না, উদাহরণ হিসেবে বলে যেতে পারে - অন্ধকারে যায় না দেখা ভালো
এদিকের মিডিয়াতে দেখানো হয় পেশোয়ারে পিচের বাম্পার ফলন হচ্ছে এ লাইন পড়ে হেসে দিয়েছিলাম।
আরেকটা কথা, হিউম্যান শিল্ড হিসেবে দেয়া উদাহরণটাও চোখে লেগেছে।
সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ আর ক্র্যাক প্লাটুনকে নিয়ে লেখা এ এক অসাধারণ বই! প্রতিটি অধ্যায় যেন একেকটি জীবন্ত সময় হয়ে ধরা দিচ্ছিল। প্রতিটি মৃত্যু নামিয়ে আনছিলো এক অবর্ণনীয় বিষন্নতা!
বইটি লেখার পেছনে লেখক কিশোর পাশা ইমনের শ্রম আর গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধা রইলো। তাঁর কলম আরও ক্ষুরধার হোক, বেরিয়ে আসুক আরও অনেক আড়ালে থেকে যাওয়া নক্ষত্ররা!
কোনরকম ওভারগ্লোরিফিকেশন ছাড়া ঝরঝরে একটা লেখা পড়লাম যার বেজ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে উপন্যাস গুলো লেখা হয়েছে, কয়েকটা বাদে আসলে বেশিরভাগই ফোকাস করে ওই সময়টায়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে মানুষের জীবন, মনস্তত্ত্বে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে নয়।
প্রায় চার শো পৃষ্ঠার বড়সর বই হলেও লেখক যতগুলো চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন এই কলেবরের মধ্যে সেই অনুপাতে বইয়ের সাইজ বড় তো নয়ই একটু ছোটই হয়েছে বলতে হবে। এতো ছোট পরিসরে এত ঘটনা, চরিত্রের সার্থক সমাপতন ঘটানো সহজ কথা নয়। অবশ্য এর ফলে লেখা একদম প্রিসাইজ, টু দ্যা পয়েন্ট হয়েছে। সাথে কেপি ইমনের সাবলীল লেখনী তো আছেই, পড়া শুরু করলে তরতর করে এগোনো যায়। অত্যন্ত ফাস্ট রিড!
বইয়ের ঘটনাবলী মোটামুটি সবই জ্ঞাত, হয়তো বইয়ে বা পত্রপত্রিকায় পড়েছি নাহলে টিভি অনুষ্ঠানে দেখেছি। তবে সেগুলোর সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো হয়ে থাকে ছোটখাট দেবতা হিসেবে যেটা কোন সময়েই খুব বেশি অথেনটিক লাগে না, হিউম্যান টাচ থাকে না আরকি। এই হিউম্যান টাচ নিয়ে আসার ব্যাপারটাই কেপি করেছেন খুব ভালোভাবে। সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ক্র্যাক প্লাটুনের বীরত্ব সম্পূর্ন অক্ষুণ্ণ রেখেই তাদের সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে বইয়ের অ্যাকশন দৃশ্যের বর্ণনা। সবগুলো অ্যাকশন দৃশ্য এত ডিটেইলড, সুচারুভাবে বর্ণিত যে মনে হবে একদম চোখের সামনেই ঘটছে সবকিছু।
বইয়ের শেষ অংশটাও দারুণ লেগেছে, বিশেষ করে পরিশিষ্ট। স্বাধীনতার আলোর নিচে যে থকথকে অন্ধকার বিরাজমান সেটার অবতারণা না করলে বইটা সম্ভবত অসম্পূর্ণই থেকে যেত।
বইটা এই বছরেই প্রকাশিত হয়েছে, বইমেলার মাঝামাঝিতে। ইতোমধ্যেই গুড রিডস এ ২৯ জনের মধ্যে ২৮ জন এটাকে পাঁচ তারা দিয়েছেন। অসাধারণ এই বইটি প্রাপ্য রিকগনিশন পাচ্ছে দেখে খুব ভালো লেগেছে।