তেল। এনার্জি মার্কেটে যার আর এক নাম ব্ল্যাক গোল্ড। পৃথিবীর একমাত্র পার্থিব পণ্য বা ‘কমোডিটি’ যার অধিকার নিতে একের পর এক যুদ্ধ হয়েছে। কখনও সামনে, কখনও বা আড়ালে। অর্থনীতিতে তেলের গুরুত্ব যত বেড়েছে, ততোই তীক্ষ্ণ হয়েছে এই প্রতিস্পর্ধা। অয়েল সুপ্রিমেসির এই দৌড়ে যুক্ত হয়েছে একের পর এক শক্তিশালী দেশ। একদিকে কূটনীতিক কৌশল, অন্যদিকে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির গোপন পরিকল্পনা। একদিকে অয়েল ডিপ্লোম্যাসির সাহায্য নিয়ে তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করা, অন্যদিকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য চালানো গুপ্তচরবৃত্তি। ভূরাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে পেট্রোলিয়াম মার্কেটে হুলুস্থুলু পড়ে যায়, আবার অয়েল ট্রেডিংয়ের দুনিয়ায় অস্থিরতা তৈরি হলে পাল্টে যায় বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ। এরই মধ্যে চলতে থাকে অদৃশ্য কিছু লড়াই, বাস্তবায়িত হয় কিছু চক্রান্ত, বদলে যায় শত শত মানুষের জীবন। সাধারণ মানুষ জানতেও পারে না তাদের চোখের আড়ালে কী ঘটে চলেছে? কালো সোনার সঙ্গে যুক্ত এই অন্ধকার জগতের সঙ্গে পাঠকদের কিছুটা পরিচয় করানোর জন্যই এই বইয়ের সূচনা।
তেল! এই কালো সোনা-র দখল নিয়ে বিশ্বজুড়ে কত মারামারি-কাটাকাটি যে হয়েছে, হয় এবং হবে— তার ইয়ত্তা নেই। সেইসব প্রকাশ্য ও গোপন যুদ্ধেরই একটি বিশেষ পর্যায় নিয়ে লেখা হয়েছে কঠোরভাবে গবেষণামূলক এই বইটি। তাতে জড়িয়ে গেছে কিছু সাদা, কিছু কালো, এবং অনেকগুলো ধূসর চরিত্র। তারই সঙ্গে প্রবলভাবে এসেছে বিশ্ব-রাজনীতি, অর্থনীতি এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের নানা ভাবনা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে প্রযুক্তির বিভিন্ন ডার্ক মিরর— যারা মুখে আমাদের ভালো করার কথা বলে, আর অন্তরে আমাদের বন্দি করতে চায় নিজের নাগপাশে। সর্বোপরি এই কাহিনি মানুষের অন্তহীন লোভের কথা বলেছে— যার বিনাশ নেই। ফলে মনগড়া ভাবনায় যতই আমরা 'দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন' দেখিয়ে গল্প শেষ করি, আসলে এই গল্প শেষ হয় না। এক সিসিফীয় সংগ্রামের মতো করেই চলতে থাকে এই লড়াই— যার হয়তো একটি খণ্ডচিত্রই শুধু ধরা রইল এই উপন্যাসে। যাঁরা বাস্তবানুগ, সংলাপ ও চিন্তন-প্রধান বিশ্বরাজনীতি-কেন্দ্রিক উপন্যাস পড়তে চান, তাঁদের এই বইটি ভালো লাগবে বলেই আমার ধারণা।
বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ব্যবহারের লিস্টে মানুষ যেদিন থেকে খনিজ তেলের নামটা জুড়লো, সেদিন থেকেই পৃথিবীর ইতিহাস যেন নতুন করে লেখা হতে থাকলো। সময় যত গড়িয়েছে ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে "অয়েল সুপ্রিমেসি" শব্দবন্ধটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুনিয়া জুড়ে ঘটে চলা কতগুলো আসল তৈল কূটনীতির ঘটনাকে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের পটভূমিকায় রেখে দুর্ধর্ষ এক থ্রিলার লিখেছেন লেখক। লা জবাব লেখা !! তৃপ্তিদায়ক !
গল্পের শুরু স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিন থেকে। নরওয়ের অসবার্গ অয়েল ফিল্ডে খুন হয়ে যাওয়া এক ইঞ্জিনিয়ার লিউক বার্নেটের রুমমেট রিজওয়ান আমির পাশার থেকে চমকে দেওয়ার মতো কিছু তথ্য পান ডিটেকটিভ ক্লিন্টন ফোর্ড। সেই তথ্য যাচাই করতে গিয়ে পাওয়া যায় আরো অনেক চমক। ওদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কূটনৈতিকভাবে বিশ্বমঞ্চে ইরানকে কোণঠাসা করতে উঠেপড়ে লাগেন। নরওয়ের সমুদ্রে তৈলখনিতেও আবার কীসব বিস্ফোরণ-টোন হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আফ্রিকায় তেলবাহী জাহাজে আক্রমণ হয়। এসবের মধ্যে আবার নরওয়ে ও আরবের বিভিন্ন তেল কোম্পানির তেল পরিশোধনের কম্পিউটার প্রোগ্রামে হ্যাকার হানা সমস্ত পরিস্থিতি ঘেঁটে দেয়। এরকম টালমাটাল প্লটে এন্ট্রি নেয় মৈত্রেয়ী, আশিক, চার্বাক, ডেজান সহ আরো জনা বিশেক (নাকি চল্লিশ?) চরিত্র! ঘটনাপ্রবাহ মুজরিম হিসেবে শুরুতে ঠাওর করে ইরানকে, কিন্তু গল্প দুরন্তগতিতে নরওয়ে, ইউকে, ইউএসএ, ভারত, আরব, কেনিয়াসহ প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমন করে খুঁজে নেয় আসলি মুজরিমকে। এই ইকোনমি এস্পিওনাজ গল্পের নায়ক হয়ে উঠতে পারলো কি চার্বাক?
পাঠক এই বইতে যা যা পাবেন -
১) দুর্ধর্ষ এক এস্পিওনাজ থ্রিলার যেখানে বিভিন্ন দেশের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র ঠেকাচ্ছে (অ্যাভেঞ্জার বা জাস্টিস লীগ-ফিগ নয়, কারণ লেখক এসব ব্যাপারে বেজায় কাঠখোট্টা)। ২) খনিজ তেল সংক্রান্ত ফাটাফাটি একটা ক্র্যাশকোর্স (তথ্য যারা ভালোবাসে তাদের কাছে সমাদর পাবেই; প্রচুর তথ্য থাকলেও ইনফোডাম্প-ফাম্পের বালাই নেই) ৩) বইয়ের শেষে বিভিন্ন সত্যি ঘটনার ব্রিফ এবং প্রয়োজনীয় তথ্যনির্দেশ।
যা যা পাবেন না -
১) মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে থাকা কোনপ্রকার দুষ্টু-মিষ্টি প্রেমকাহিনী বা ইন্টুবিন্টু (জেমস বন্ডীয় ব্যাপার-স্যাপার আর কি!) ২) বইটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি।
বইটার ভাষা প্রাঞ্জল। ঘটনাপ্রবাহ লিনিয়ারিটির বাইরে এক-দুবারের বেশি ঝাঁপ দেয়নি। বানান ও বাক্যগঠনের ভুল বইয়ের সাইজের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। প্রচুর তথ্যবহুল ঘটনার সমাহারে গল্পের গতিতে স্পিডব্রেকার না বসলেও একটু-আধটু ধৈর্য্যের বাঁধ রিপেয়ারিংয়ের প্রয়োজন হতে পারে (যদিও না হওয়ারই কথা)। প্রচ্ছদের রঙের মধ্যে বেশ একটা তেল তেল ব্যাপার আছে। অরণ্যমনের বইয়ের ফিনিশিং ভালো হলেও লেখকের আগের বইয়ে ক্যাফে টেবিলের ফিনিশিং সামান্য এগিয়ে বলেই মনে হয়েছে (যদিও ছাপার কালি ও হরফ অরণ্যমনের ভালো)।
বাংলা ভাষায় (সম্ভবত) প্রথম অয়েল এস্পিওনাজ বই। লেখনীগুণে চোখ বুজে কালেকশনে রাখার মতো। এখন প্রশ্ন একটাই। নেটফ্লিক্সের লোকজন কি বাংলা পড়তে পারে?
অপারেশন ব্ল্যাক অ্যারোর পরে আরেকটা ফাটাফাটি থ্রিলার লিখেছেন সুদীপ। এখন পৃথিবীর সব থেকে দামী জিনিস তেল আর তথ্য নিয়ে লেখা থ্রিলার। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনার পর শেষটায় আমি একটু হতাশ হয়েছি। তবে সেটা কেন বলতে গেলে স্পয়লার দিতে হবে।
একবারে পড়ার জন্য বইটা বেশ ভারী। তাছাড়া এত মোটা বই পেপারব্যাক হলে পড়তে বেশ অসুবিধাই হয়। সবথেকে ভালো হত এই বইটা দুটো খণ্ডে প্রকাশ পেলে। প্রথম খণ্ড একটা ক্লিফহ্যাঙ্গারে শেষ হত, তারপর পাঠককে অপেক্ষায় থাকতে হত পরের খণ্ডের জন্য। যাই হোক লেখকের থেকে একটা ম্যাগনাম ওপাসের অপেক্ষায় রইলাম