বাঙালির “অ্যালিস”, কঙ্কাবতী। তাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি রচেন পুরুষ লেখকই কেবল। কল্পনার পাখায় সওয়ার হয়ে মেয়েরা কি তবে কোনওদিন নিজেদের বাস্তবতাকে কল্পনার বাস্তবতায় রূপ দিতে পারবে না? পারেনি? কঙ্কাবতীরা কোনওদিন কল্পবিজ্ঞান লিখবে না? লিখেছেন তো তাঁরা। সেই বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (১৯০৫) দিয়ে শুরু। সেই থেকে লীলা মজুমদার, এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের কলম বেয়ে আজকের মেয়েরাও কল্পবিজ্ঞানের গল্প, ফ্যান্টাসির গল্প লিখে চলেছেন। তারই সংকলন এটি। ১৮টি গল্পের এক অনবদ্য গুচ্ছ।
যশোধরা রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৫-তে, কলকাতায়। কল্পবিজ্ঞানলেখক দিলীপ রায়চৌধুরী ও শিল্পী অরুন্ধতীর কন্যা যশোধরা দর্শনের ছাত্রী। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত। ১৯৯২ থেকে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। জ্বরপরবর্তী, অমল ধবলে গরল লেগেছে ছাড়াও রচনা করেছেন বহু কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ ও নিবন্ধগ্রন্থ। ফরাসি ভাষাচর্চা করেন। মূল ফরাসি ভাষা থেকে, তাঁর অনূদিত বই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (আনন্দ)। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার (১৯৯৮), বাংলা আকাদেমির অনিতা-সুনীলকুমার বসু পুরস্কার (২০০৬), বিনয় মজুমদার স্মৃতি সম্মান (২০১৬), সৃষ্টিসুখ সম্মান (২০১৯), ২০২৩ সালের দ্য টেলিগ্রাফ-এর ‘শি অ্যাওয়ার্ডস’। পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্মান’-এ সম্মানিত (২০২৪)।
এই বই যে কঙ্কাবতীদের জন্যেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ১৮ খানা নানা স্বাদের কল্পবিজ্ঞান গল্প। কয়েকটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখা, আবার কয়েকটা লাভক্রাফটিয়ান হরর, ইত্যাদি, ইত্যাদি। প্রতিটাই এসেছে লেখিকাদের কলম বেয়ে। সেই বেগম রোকেয়ার "সুলতানার স্বপ্ন" থেকে অঙ্কিতার " ঋক্থ", মেয়েদের হাতে বাংলা কল্পবিজ্ঞান বেঁচে থেকেছে, এগিয়ে গেছে নতুন নতুন দিগন্তে। বইটা সেই যাত্রারই প্রমাণ। শুধুমাত্র মেয়েদের লেখা এইরকম কল্পবিজ্ঞানের সংকলন বোধহয় এই প্রথম বেরুলো।
আচ্ছা বইয়ের মালমশলা নিয়ে কথা বলি। সংকলনের সব গল্প একই ভাবে মনে দাগ কাটে না। এখানেও সেটার ব্যতিক্রম হয় নি। সব মানুষের রুচিবোধ আর ভালো লাগা তো একরকম হয় না। কিন্তু এই বইয়ে এমন কিছু গল্প খুঁজে পেয়েছি, যেগুলো ব্লেডের মত ধারালো কিছু দিয়ে আমার মনে দাগ কেটে ফেলেছে। আর ভুলতে পারব না এই গল্পগুলোকে। তিনটের কথায় নিচে লিখলাম।
"কাঁটাচুয়া" - বাণী বসু লোকগুলো খুন হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে একটা দুটো কেস। তারপর বাইপাস, ময়দান থেকে পুরো কলকাতা জুড়ে। কেউ জানে না কে বা কী খুন করছে, কোন মোটিভ বা প্যাটার্ন নেই। শুধু ভিক্টিমের শরীরে অসংখ্য ছোট ছোট কিন্তু গভীর ছিদ্র। সেই ফুঁটোগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতে হতেই অক্কা। গল্পটা পড়ে জুঞ্জি ইতোর কথা ভাবছিলাম।
"যযাতীয় লালসায়..." - সুকন্যা দত্ত একজন বিখ্যাত নায়িকা পুড়ে গিয়ে বীভৎস ভাবে মারা গেছেন। গল্পের প্রথমেই পাঠক জেনে গিয়েছে সেই মৃত্যুর কারণ কে হতে পারে। গল্পের আসল উদ্দেশ্য হল বের করা ঠিক কী ভাবে নায়িকা মারা গেছেন। সেই "কী"-এর র্যাবিট হোল এতই গভীর আর এতই প্যাঁচালো, যে গল্পটা শেষ করে মনে হচ্ছিল আমার জীবনে আরও বাংলা হার্ড সাইফাই দরকার।
"পালটা" - অনুরাধা কুন্ডা পুরুষদের পৃথিবী। মেয়েদের কোনও স্থান সেখানে আর নেই। শুধু পুরুষেরাই থাকে। কৃত্রিম ডিম্বাণু বানিয়ে বংশবিস্তার করে। সেক্সবটকে ব্যবহার করে নিজেদের যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটায়। নিখুঁত রান্না করার জন্যও রয়েছে রোবট আর অ্যান্ড্রয়েড। ইনসেকিউরিটি তে ভুগছেন? তার জন্যেও রয়েছে বাহবা দেওয়ার একটা রোবট। নিজের শত্রুর উপর রাগ জমেছে? আইনগত ভাবে খুন করতে পারবেন। আর কী চায়? এইরকম ইউটোপিয়াতে কোনওরকম ঝামেলা হওয়ার তো কথা নয়, তাই না? গল্পের শেষটুকু হাড় হিম করে দিয়েছে।
যাই হোক, সবকটা গল্পের কথা আমি আর বলব না। আমি চাই এই বইটা যেন সময়ের স্রোতে হারিয়ে না যায়। শুধু কঙ্কাবতীরাই নয়, আমার মত হনুরাও একটু পড়ুক, জানুক আর শ্রদ্ধা করতে শিখুক।
বাংলায় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য রচয়িতার সংখ্যা খুব কম নয়। তবু প্রশ্ন জাগে, বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য ঘরানায় নারীদের উপস্থিতি লক্ষণীয় হলেও কল্পবিজ্ঞানে তা দেখা যায় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সরল নয়। তা লুকিয়ে আছে বাংলায় নারীদের শিক্ষা ও স্বাধীনতা বিকাশের দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য বিবর্তনের মধ্যে। তবে আলোচ্য সংকলন সেই উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করেনি। বরং "হাত থাকতে মুখ কেন" নীতি মেনে তা বাঙালি নারীদের কল্পবিজ্ঞান রচনাকেই তুলে ধরেছে দুই মলাটের মাঝে। মোট আঠেরোটি ছোটো ও বড়ো গল্প আছে এই বইয়ে। এদের শুরুতে পেয়েছি বেগম রোকেয়া'র "সুলতানার স্বপ্ন।" শেষে এসেছে 'কল্পবিশ্ব' পত্রিকার একেবারে প্রথম পর্যায়েই পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেওয়া "ঋকথ"— যা লিখেছিলেন অঙ্কিতা। তার মাঝে যে গল্পগুলো আমার কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় মনে হল, সেগুলোর পরিচয় এইরকম~ ১. এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের "লুব্ধক: ১৮"; ২. সুকন্যা দত্ত'র "যযাতীয় লালদায়..."; ৩. দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়ের "শ্যাওলা"; ৪. অমৃতা কোনারের "সময়চক্র"; ৫. অনুরাধা কুন্ডার "পালটা"— 'দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল'-এর আয়নাছবি তথা আমার মতে এই বইয়ের সেরা লেখা; ৬. সংযুক্তা চ্যাটার্জি'র "সমুদ্রের গুপ্তকথা"। একাধিক লেখা কল্পবিজ্ঞানের বদলে ফ্যান্টাসি হওয়া সত্বেও এই বইয়ে স্থান পেয়েছে দেখে একটু অবাক হলাম। বইটি সুমুদ্রিত। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে থাকা মিনিমালিস্ট হেডপিস তাদের এক নীরব আভিজাত্য দিয়েছে। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অনুরাগীরা এই বইটিকে পড়ে দেখবেন— এমন আশা রাখি।
এই সংকলন লেখিকাদের। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই, পত্রিকাতে প্রকাশিত গল্পগুলো একত্রিত করা হয়েছে। কল্পবিজ্ঞানের সাথে রূপকথার গল্প রয়েছে।
কল্পবিজ্ঞান সমগ্র, সংকলন আগে পড়েছি। এই সংকলনটির বাছাই করা গল্পগুলো আমার কাছে বেশ rich লেগেছে। গল্পগুলো বেশ উন্নতমানের। কিছু primitive কাহিনী, কনসেপ্ট থাকলেও উৎসাহ আর কৌতূহল বজায় থেকেছে।
যেসব গল্পগুলো বেশি করে মন কেড়েছে -
সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫ সালে প্রকাশিত অভাবনীয় রূপকথার গল্প)
লুব্ধক : ১৮ (কল্পবিজ্ঞান গল্প হলেও অচিরেই হয়ত এরকম কিছু দেখতে পাবো)
কাঁটাচুয়া (এই রকম গল্প প্রথম পড়লাম)
ভিত্তি (এই গল্পটি আমি প্রথম থেকে শেষ অবধি পড়ে কিছু বুঝতে পারিনি। তারপর অনুমান করলাম। আমি যদি ভুল না হয় Horton hears a who movie দেখেছিলাম বলেই হয়ত এই গল্পটি বুঝতে পেরেছি)
নতুন মানুষ (শেষের চমক ভালো)
পাল্টা (এই গল্পটি বোঝায় সভ্যতা যতই উন্নত হোক না কেনো, আসলে আমরা primitive)