রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের জন্ম ১৯৮৭ সালে কলকাতায়। সাত বছর বয়েসে যৌথপরিবার থেকে আলাদা হয়ে বাবামায়ের সঙ্গে মফস্বল শহর বারাসাতে চলে আসা। বাবা-মা সরকারী কর্মচারি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন বারাসাত মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। কবিতা লেখার শুরু ক্লাস এইট থেকে, প্রথম কবিতার বই সতেরো বছর বয়েসে। এঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন শিবপুর বিই কলেজ থেকে, পরবর্তীতে আই আই টি কানপুরে। পিএইচডি নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। গবেষণার বিষয় জলসম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থানে অধ্যাপনা করছেন। প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সঙ্গে পাঁচ; একটি বাদে সব কবিতাবই স্বউদ্যোগে প্রকাশিত। গল্প-উপন্যাসের বই এযাবত আটটি; তিন প্রকাশক সৃষ্টিসুখ, বৈভাষিক এবং একতারা। গোয়েন্দা কানাইচরণ চরিত্রটির স্রষ্টা। কানাইচরণের উপন্যাসিকা 'চড়াই হত্যা রহস্য' অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ওয়েবসিরিজ 'ব্যাধ'। সম্প্রতি কয়েকটি বইয়ের ইংরিজি অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে।
গোয়েন্দাসুলভ ভাবমূর্তি বলতে আমরা যা বুঝি তা কানাইচরণ এর একেবারেই নেই। সে সরকারি গোয়েন্দা। ঘোরতর গৃহী মানুষ। কাজেকর্মে ঢিল দ্যায়। নিয়মিত মদ্যপান করে। সবাই তার গুণমুগ্ধ নয়। তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয়ও সে অহরহ দিতে পারে না। ছোট্ট একটা ক্লু ধরে অপরাধী শনাক্ত করে সে জাদু দেখাতে পারে না। তাকে কাজ করতে হয় ধাপে ধাপে, বড়কর্তাদের ধমক শুনে,রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, মানুষের কাছে অপদস্থ হওয়ার ভয় নিয়ে। অপরাধীকে খুঁজে বের করতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয় কানাইচরণ আর সৌভিকদের। ঠিক একারণেই মনে হয় কানাইচরণ বাস্তবের পৃথিবীতে আছে। তার পুরো যাত্রাপথটিকে সত্য বলে ভ্রম হয়। এমন যে হতেই পারে! "অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার" কানাইচরণকে নিয়ে লিখিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। লেখক এবার সযতনে যে কাহিনি দাঁড় করিয়েছেন তাতে আবারো মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। শেষ অনুচ্ছেদের স্বগতকথন পুরো গল্পটিকে ভিন্নমাত্রা দান করেছে। এ বইয়ের মাধ্যমে গোয়েন্দাপ্রবরের সাথে সাথে লেখকও "প্রিয়"র তালিকায় স্থান করে নিলেন।
রোজ কত মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। হারিয়ে যায়। রেলস্টেশনের দেয়ালে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। বালক, যুবক, মাঝবয়েসি, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, মহিলা, পুরুষ, মানসিক ভারসাম্যহীন। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ওয়েবসাইটের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান দেখলাম, ২০১৯ সালে বেপাত্তা হয়ে গেছে চার লক্ষেরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আজ আর জীবিত নেই। এদের মধ্যে অনেকেই এখনও নিরুদ্দেশ, কারণ তাদের খুন করে ফেলা হয়েছে।
খুন করার পরে কারো দেহ পুঁতে দেওয়া হয়েছে মাটির গভীরে। শহরের ভেতর লাশ পোঁতার উপায় নেই। সেখানে তো জায়গাই নেই। তাই পোঁতা হয়েছে শহরের উপকণ্ঠে। শহরের মানুষ বাড়ছে। জায়গা কমছে। শহরের উপকণ্ঠে গড়ে উঠছে উপনগরী। উপনগরীতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গগনচুম্বী অট্টালিকা। নতুন অট্টালিকা বানানোর জন্য ভিত খনন করা হচ্ছে। ভিত খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গ্যালো আস্ত নরকঙ্কাল। রেলস্টেশনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিজ্ঞাপনে তো মুখের ছবি দেওয়া থাকে। তবুও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। নরকঙ্কালের মুখ কই?
হালফিলের পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা রহস্যকাহিনি/থ্রিলার আমি পড়ি না। পড়লে আমার একইসঙ্গে হাসি পায় এবং বিরক্ত লাগে। একমাত্র ব্যতিক্রম রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের গোয়েন্দা কানাইচরণ সিরিজ। এর আগে এই সিরিজের প্রথম বই কলকাতা নুয়া পড়ে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-সৃষ্ট শবর দাশগুপ্ত চরিত্রটির কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে যথার্থ পুলিশ-প্রোসিজুরাল গোত্রের রহস্যকাহিনি আজপর্যন্ত একটাও লেখা হয়নি। কানাইচরণ হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপযুক্ত পুলিশি-গোয়েন্দা। এই সিরিজের নতুন বইটি পড়ে আমার মুগ্ধতা আগের বইটিকেও ছাপিয়ে গেছে।
লেখকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, কানাইচরণ চরিত্রটিকে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে সৃষ্টি করেছেন। সকল চরিত্রদের চলাফেরা-কথাবার্তা, কাহিনির পটভূমিকা, অপরাধ ও অপরাধীর গতিপ্রকৃতি, সাসপেক্ট, মোটিভ ও অ্যালিবাইয়ের গোলকধাঁধা, এবং সবশেষে রহস্যসমাধানের প্রক্রিয়া, প্রতিটি ক্ষেত্রে রহস্যগল্পসুলভ টিপিক্যাল অতিনাটকীয়তাকে সচেতনভাবে বর্জন করেছেন লেখক। অথচ তার ফলে কাহিনির বাঁধুনি আলগা, কিংবা রহস্যের উপভোগ্যতায় ঘাটতি হয়নি। পুলিশের প্রকৃত কর্মপদ্ধতি ও তদন্তের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যেরকম নিখুঁত ডিটেইলে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, তা এককথায় বিস্ময়কর!
উপন্যাসটা পড়া শেষ করে আমার মনে হয়েছে, রহস্যকাহিনির ছদ্মবেশে আসলে লেখক একটি সমসাময়িক বাস্তবসম্মত সামাজিক ভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন। পাঠশেষের মুগ্ধতা একটু ঝিমিয়ে এলে মনে একটা প্রশ্ন জাগে। পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর-এর মতো ব্যতিক্রমী ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন যে-লেখক, সেই একই লেখক, পাশাপাশি অবলীলায়, কানাইচরণের মতো অভিনব গোয়েন্দাচরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন কীভাবে? এমন একটি দুর্দান্ত চরিত্র উপহার দেওয়ার জন্যে লেখককে আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই! অত্যন্ত সুলিখিত এই উপন্যাসটি নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হওয়া জরুরি।
"আমি ভাবি, ভবিষ্যতে কোনোদিন, আমাদের ধ্বংসও কি আমাদের মতোই ছাপোষা হবে?"
গোয়েন্দা কানাইচরণ চরিত্রের স্রষ্টা রাজর্ষি দাষ ভৌমিক ডিটেকটিভ ফিকশন সম্পর্কে নিজের মত ব্যক্ত করেছেন এভাবে:
"গোয়েন্দা কাহিনির একটি বিশেষ সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য তার রহস্যের সৌন্দর্য। কবিতার ধারণা না-থাকলে অনুমান করি এই সৌন্দর্যকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। তাই, যিনি 'মাইকা ক্লার্ক' লেখেন, তাকেও গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করতে হয়। তিনি যে একদিন ‘দা হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস' এর মতো কাব্যিক উপন্যাস লিখবেন, তা যেন তাঁর কলমের নিয়তিতেই ছিল। এই বিশেষ সৌন্দর্যের টানে খবরের কাগজের দুদে সাহিত্য-সমালোচক এক রোম্যান ক্যাথলিক যাজককে গোয়েন্দা বানিয়ে দেন। এ তো শুধু বইয়ের কাটতি আর লেখকের খ্যাতির কথা ভেবে নয়! নির্দিষ্ট ভাবে এই সৌন্দর্যের স্বরূপ বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে মাত্র। এই মহূর্তে মনে পড়ছে ‘লন্ডনে ফেলুদা' ও 'এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার'-এর কথা। দুটি উপন্যাসেই মানুষের স্মৃতি রহস্যের নিউক্লিয়াসটিকে আগলে রেখেছে। বর্তমান কাহিনিকারও গোয়েন্দা গল্পের সেই নিহিত সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট। ইদানীংকালের, থ্রিলার-ভিত্তিক গোয়েন্দা গল্পের ভিড়ে যে সৌন্দর্য জাস্ট উবে গেছে।"
বহুকাল যাবত গোয়েন্দা কাহিনি পড়তে পড়তে যে জিনিসটা মাথায় শক্তপোক্তভাবে গেঁথে গেছে, তা হচ্ছে প্রত্যেক গোয়েন্দারই স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো তার ক্যারেক্টারকে গ্ল্যামারাইজ করে, অনেকাংশে তাকে সুপার হিউম্যান হিসেবে তুলে ধরে পাঠকের চোখের সামনে। শার্লক হোমসের তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, এরকুল পোয়ারোর অহংকারী বিশ্লেষণশক্তি কিংবা ফেলুদার বুদ্ধিদীপ্ত তদন্ত, ব্যোমকেশ বক্সীর মগজের ধার- প্রতিক্ষেত্রেই একেকজন ফিকশনাল ডিটেকটিভের আবির্ভাব আমাদের কাছে সুপারহিরো হিসেবেই। পেশাগত গোয়েন্দা চরিত্রের বাইরে যখন চার্চের যাজক ফাদার ব্রাউন, কবি গোয়েন্দা পরাশর অথবা জাদুকর কিকিরাকে রহস্যভেদ করতে দেখি, তাতে স্বাতন্ত্র্যের স্বাদ পাওয়া সত্যি; তবুও যে তাতে 'লার্জার দ্যান লাইফ' গোয়েন্দা চরিত্রের গ্ল্যামার উপস্থিত!
গোয়েন্দা কাহিনি পড়তে গিয়ে রহস্যের মারপ্যাঁচে শিহরিত হতে হয়। কোথাও টানটান উত্তেজনা, কোথাও ধুন্দুমার একশন; একের পর এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিয়ে মাথা খাটিয়ে, নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ক্লাইম্যাক্সে শ্বাস আটকে রেখে সবশেষে যখন পর্দা উন্মোচন হয়- তখনই একটা আত্মতৃপ্তির অনুভূতি পাওয়া যায়। যাক! গোয়েন্দা কাহিনি সার্থক। কিন্তু এই ছ���ে বাধা আত্মতৃপ্তির বাইরেও যে আলাদা 'কিছু একটা' থাকতে পারে, যার কারণে বরং চিরাচরিত ফর্মুলেটেড ডিটেকটিভ ফিকশনকেই খেলো মনে হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, সেই তথ্য জানাতেই যেন গোয়েন্দা কানাইচরণের আবির্ভাব!
এখানেই উত্তর মেলে: এত এত ডিটেকটিভ ফিকশনের মাঝে তাহলে আলাদা করে গোয়েন্দা কানাইচরণকে নিয়ে কেন আলাপের অবকাশ হলো? বিশেষত বাঙ্গালী গোয়েন্দা চরিত্রের ভিড়ে কোন বৈশিষ্ট্যটা আলাদা করলো রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের এই গোয়েন্দা চরিত্রটিকে?
গোয়েন্দা কানাইচরণ কলকাতার লালবাজার (পুলিশের সদর কার্যালয়) গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল সেলের সিনিয়র ইন্সপেক্টর। বয়স আটান্ন, কোকড়ানো চুলে পাক ধরেছে। রিটায়ারমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সুযোগ পেলে থানার টেবিলে পা তুলে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়েন। গোয়েন্দা হিসেবে দক্ষ হলেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনিময়ের কারণে তার রেকর্ডবুকে রেড ক্রস পড়ে, এমনকি সাময়িকভাবে ক্লোজডও থাকেন। ফোর্সের জুনিয়র ইন্সপেক্টর সৌভিককে তার সহকারী হিসেবে দেখা যায়। ডেকার্সে জলখাবার, কাজের ফাঁকে-ফোকরে নাস্তায় চাওমিন কিংবা ডিমের অমলেট, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট আর ফুসরত পেলে সেসিল বারে মদ্যপান। দাম্পত্যজীবন রসকষহীন, প্রায়ই রাত-বিরেতে ডিউটির জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। থানায় ক্রিমিনাল রেকর্ডস সেকশনের রেজিস্ট্রার, গোল চশমা আর কাঁধে সেফটিপিন আটকানো শাড়ি পরা গোলগাল চেহারার দিদিমণির প্রতি কিছুটা "ইয়ে" বোধ করেন।
মোটামুটি এই হচ্ছে গোয়েন্দা কানাইচরণের পরিচয়। কায়দা করে সিগারেট ফোঁকা, দক্ষ হাতে পিস্তল চালিয়ে শত্রুকে ধরাশায়ী করা, কথার মারপ্যাচে কাউকে বশ করে ফেলা কিংবা গন্ধ শুঁকে/আওয়াজ শুনেই রহস্যের গিট ছাঁড়ানো- এসবের কোনটাই তার স্বভাবে নেই। কানাইচরণের কাহিনি পড়তে গেলে বারবার মনে হবে- বাস্তবের গোয়েন্দা/রহস্যভেদী তো এমনই হয়! সূক্ষ্ম হিসেব কষে নীতিবান, সফেদ চরিত্রের যে গোয়েন্দাদেরকে হরহামেশাই বইয়ের পাতায় দেখে আমরা মুগ্ধ হই- তার সাথে এর বিস্তর পার্থক্য। এমনকি হার্ডবয়েলড ডিটেকটিভ/নোয়ার ক্রাইম ফিকশনের গ্রে ডিটেকটিভদের রাফ এন্ড টাফ, ব্যাডবয় ইমেজের সাথেও মেলানো যায় না। গোয়েন্দা কানাইচরণ স্বভাব-চরিত্র, কথাবার্তা এমনকি তদন্তের ধারাবাহিকতায়ও রক্ত-মাংসের মানুষ। রহস্যের সমাধান খুঁজতে তাকে হিমশিম খেতে হয়, না খেয়ে দৌড়ে বেড়াতে হয় এজায়গা থেকে ও জায়গায়। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চোখ রাঙানি কিংবা ক্লান্ত শরীরে মাঝরাতে প্রভাবশালী কারোর বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গিয়ে অপদস্থ হওয়া- এসব লেগেই আছে। কানাইচরণের তদন্তে আপনা-আপনি সুতো মিলে যায় না। বরং গায়ে-গতরে পরিশ্রম করে, এদিক-সেদিক ধর্ণা দিয়ে, একের পর এক ধাপ পার করে সমাধানের দিকে এগোতে হয়। এই রহস্যকাহিনিতে টানটান উত্তেজনার অভাব, তবে সত্যিকারের প্রসিডিওর বেজড ইনভেস্টিগেশনের স্বাদ পাওয়া যায় শতভাগ। পুরো সময়জুড়ে পাঠক কানাইচরণের সাথে ঘুরে বেড়ায়, মাথা খাটিয়ে চিন্তা করে। পুলিশ প্রসিডিওরাল ফরম্যাটে লেখা বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিতে বোর হবার সুযোগ নেই- লেখকের এখানেই মূল সার্থকতা।
গোয়েন্দা কানাইচরণের প্রথম বই ছিল ২০১৯ সালে প্রকাশিত "কলকাতা নুয়া"। সেই বইয়ের তিনটি গল্প (কালাপানির দিশা, পাইস হোটেলে হত্যা, চড়াই হত্যা রহস্য) ছিল বৈঠকি আলাপ গোছের। তাতে প্রসিডিওরাল ফরম্যাট ছিল নি:সন্দেহে। গোয়েন্দা কানাইচরণ সফলভাবেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার' নামের এই পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস কানাইচরণের পাঠকদের জন্য একটি বিশেষ উপহার। এবারে উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিতে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক অসঙ্গতি যেমন স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, ঠিক ততটাই জোরালোভাবে দেখানো হয়েছে একজন গোয়েন্দার হতাশা, ক্লান্তি অথবা পরিশ্রমকে। রহস্যের সমাধানে গোয়েন্দা যে একাকীত্বে ভোগেন, চায়ের পিপাসায় বারবার তার গলা শুকিয়ে যায়, শারীরিক অসুস্থতা তার স্বাভাবিক যাত্রাকে দুর্গম করে তোলে- বাস্তব জীবনের এই সামান্য বিষয়গুলো জোরালোভাবে ফিকশনে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
"অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার" নামেই বোঝা যায় বইয়ের বিষয়বস্তু। কবীরগঞ্জ নামের এক মফস্বল অঞ্চলে একটা বাড়ির কনস্ট্রাকশন সাইটে, মাটি খোঁড়ার সময় একটি নরকঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। সাম্প্রতিককালে কবীরগঞ্জ লালবাজার থানার অন্তর্গত হয়েছে বিধায় সেই কেসের দায়িত্ব অর্পণ করা হউ লালবাজারের সিনিয়র ইন্সপেক্টর গোয়েন্দা কানাইচরণের কাঁধে। সহকারী সৌরভকে নিয়ে তিনি শুরু করেন যথাযথ তদন্ত।
আগেই বলেছি, কানাইচরণের কাহিনিতে সাসপেন্স থ্রিলারের উত্তেজনা খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হবে। তড়িঘড়ি করে গল্প এগোয়নি। ক্রাইম স্পট থেকে স্যাম্পল কালেকশন, সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করতে দ্বারে দ্বারে ঘোরা, ফরেনসিকের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, গুপ্তচর (খোঁচড়) লাগিয়ে তথ্য অনুসন্ধান, এগোতে এগোতে আবার পিছিয়ে পড়া - বাস্তবসম্মত তদন্তের ধারা উপভোগ করতে চাইলে কানাইচরণের কাহিনির জুড়ি মেলা ভার।
রাজর্ষি দাষ ভৌমিক যথাযথ অর্থেই 'গোয়েন্দা কাহিনির বিশেষ সৌন্দর্যকে' উপস্থাপন করেছেন দক্ষ হাতে। কানাইচরণের পরবর্তী কেসের অপেক্ষায় রইলাম।
রাজর্ষি দাস ভৌমিকের লেখা 'গোয়েন্দা কানাইচরনের কাহিনি' প্রথমে নেটের মাধ্যমে, পরে "কলকাতা নুয়া"-র আকারে পাঠকদের কাছে আসামাত্র আলোড়ন উঠেছিল। তার তিনটি কারণ ছিল। সেগুলো হল~ ১) এগুলোতে শখের গোয়েন্দা একেবারেই ছিলেন না। এমনকি পেশাদার প্রাইভেট ডিটেকটিভও ছিলেন না। অথচ ছিল হত্যা এবং হত্যাকারীর অনুসন্ধান। ২) সেই গল্পগুলোর নায়ক লালবাজারের এমন এক পুলিশ অফিসার— যাঁর চেহারা থেকে কথাবার্তা, সবই খুব সাধারণ। কিন্তু তা বলে তিনি ব্যক্তিত্বহীন নন। সহানুভূতিশীল মানুষ হয়েও প্রয়োজনে তিনি কতটা ক্রূর হতে পারেন— তা আমরা সবাই দেখেছিলাম। গাঁজাখুরি স্টিরিওটাইপের বাইরে বাস্তবের পুলিশ চরিত্ররা যে আদতে এমনই হন— সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছিল ওই লেখাগুলো। ৩) সত্যিকারের পুলিশি তদন্তের পদ্ধতি, প্রকরণ, সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্য— এই সবটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল লেখাগুলোতে। ফেসবুকে লাইক আর আদরবাসা-কুড়োনো লেখকেরা 'সি.আই.ডি' সিরিয়াল দেখে তদন্তের উপায় শেখেন। ফলে তাঁরা কথায়-কথায় পারলে পুকুরে সাবমেরিন নামিয়ে দেন। সেইসব ধুস্তরী মায়ার বাইরে সত্যিকারের ইনভেস্টিগেশনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওই লেখাগুলো। এবার, প্রায় দু'বছরের অপেক্ষার পর আবার আমাদের কাছে এলেন কানাইচরণ। তাঁর এবারের কাজটি আরও জটিল ছিল নানা কারণে। সেগুলো হল~ প্রথমত, এবারের তদন্তের স্থান শহরের উপকণ্ঠে এক জমি ও সিন্ডিকেটের চক্করে ফাঁসা এলাকা— যা সদ্য রাজ্য পুলিশের বদলে কলকাতা পুলিশের আওতায় এসেছে। ফলে এখানে আছে অনেক রাজনীতি, অনেক খুচরো লোভ আর দ্বন্দ্ব, অনেক সমীকরণ। দ্বিতীয়ত, কে খুন হয়েছে— সেটা বোঝাই কঠিন ছিল। তারপর এসেছিল তাকে খুনের মোটিভ বের করা। তারপর এসেছিল খুনিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা। তৃতীয়ত, মাঝের এই ক'বছরে পুলিশের গায়েও লেগেছে নানা পালিশ; তার কাজটাও হয়ে গেছে সরল 'দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন' ছাপিয়ে আরেকটু অন্যরকম। তবু, সবকিছুর মধ্যেই কানাইচরণের ওপরে চাপা ডেডলাইন সরেনি। তারপর কী হল? সেই নিয়েই এই নিতান্ত কাগুজে নামের ঘোরালো উপন্যাসটি রচিত হয়েছে।
বইটির ভালো এবং খারাপ দিক কী-কী? বাস্তবে যেমন হয়, ঠিক তেমন করেই এগিয়েছে, ছড়িয়েছে এবং গুটিয়েছে এই তদন্ত। ফলে এতে মন বা চোখ-ধাঁধানো অ্যাকশনের বদলে আছে ঘষটে-ঘষটে "যেখানে দেখিবে ছাই" পদ্ধতিতে এগোনো। এতে গুলি বা ছুরির বদলে আছে রাতবিরেতে লোকের বাড়িতে হাজির হয়ে চা খেতে চাওয়ার সঙ্কোচ। আছে অফিসারের বকুনি আর এ.সি গাড়িতে বসে ঘেমো জামা শুকোনোর সুখ। আছে শেষে অংকটা মিলে গেলে খুনি ও গোয়েন্দার মুখোমুখি বসিবার দু'দণ্ড অবসর। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই নিতান্ত স্বাভাব��ক হওয়াটাই এই বইয়ের, একইসঙ্গে ভালো এবং খারাপ দিক। আর একটা কথাও বলা প্রয়োজন। হয়তো বাস্তবিকতার খাতিরেই লেখার যতটা অংশ পুলিশের অন্তর্মহলের আলো-আঁধারির প্রতি নিবেদিত, তার তুলনায় অপরাধের সংঘটন কম গুরুত্ব পেয়েছে। এর ফলে লেখার গতি হ্রাস পাওয়া নিঃসন্দেহে এই বইয়ের একটি দুর্বলতা।
তবু বলব, শেষ বিচারে বইটি 'ক্রাইম' ঘরানায় সাম্প্রতিক লেখালেখির মধ্যে একটি মাইলফলক। গাঁজাখুরি জিনিসপত্র না পড়ে খাঁটি বাংলায় খাঁটি বাঙালি পুলিশের সত্যিকারের পোলিস প্রসিডিওরাল পড়তে চাইলে এই বইটি আপনাকে পড়তেই হবে!
গোয়েন্দা কানাইচরণের ব্যাপারটাই অন্যরকম। আলাদা গ্ল্যামার নেই, ঠাঁট নেই, বয়ষ্ক করে একজন গোয়েন্দা। কানাইচরণের কাহিনিতে শার্লক হোমস্ টাইপের কোন বুদ্ধির ঝিলিক মার্কা মোমেন্টও নেই। নিতান্তই প্রোসিডিউরাল ইনভেস্টিগেশনের গল্প বলা যায় এদেরকে। আর এজন্যই কানাইচরণের গল্পগুলো আলাদা। এর আগের বই “কলকাতা নুয়া” আমার খুব ভালো লেগেছিল আর কত মানুষকে যে পড়তে বলেছি! তবে এই বইটা (অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার) ভালো মন্দ মিলিয়ে একরকম লাগল আর কী।
বেশ স্লো বিল্ডাপের বই – শুরু থেকে অনেকখানি পড়েও তেমন কাহিনি আগাবে না। শহরের উপকন্ঠে কবীরগঞ্জ হঠাৎই বিশেষ মনযোগ কাড়ে ভূমিদস্যুদের যখন এ অঞ্চলটা উপনগরী হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। পরে নানান কারনে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এর কয়েক বছর পরে নির্মাণকার্যে জমি খোঁড়াখুঁড়ির সময় মেলে একটা লাশ। লাশের চেয়ে দেহাবশেষ বলাই ভালো কারন তিন চার বছর আগের এই লাশের আসলে সনাক্ত করার মতো তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই ঘটনার পর ডাক পড়ে লালবাজারের কানাইচরণের। একে একে কাহিনি নানান মোড় ঘুরে এই রহস্যের সমাধান করবে। যা শুরুতেই বললাম, কানাইয়ের গল্প বাস্তবের সাথে যতটা সম্ভব হাত মিলিয়ে চলে। এ কারনে কোন নির্মাণাধীন জমিতে লাশ পাওয়া গেলে জমির মালিক বা ডেভেলপাররা বাস্তবে যেরকম আচরণ করতে পারে, কিংবা বড়লোক বাড়ির কাজের মানুষ বাড়ির মালিকের খোঁজে পুলিশ এলে যেমনটা করবে, এখানেও তাই করে। পুরো বইতে বলা যায় এই ব্যাপারটা খুব সুন্দর ভাবে এসেছে – মানব চরিত্রের খুব কাছাকাছি ধরনের পোর্ট্রেয়াল। এসব দিক থেকে বলব লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক মানুষের মনস্তত্বের ব্যাপারে ভালই দখল রাখেন।
কানাইচরণ দাস। নাম শুনলেই একজন অকিঞ্চিৎকর গোবেচারা মানুষের কথা মাথায় আসে। এই নামটির সাথে পরিচয় ঘটে লেখক অন্বয় গুপ্ত'র লেখা একটি review পড়ে। লেখাটিতেই প্রথম রাজর্ষি দাশ ভৌমিক এর 'কলকাতা নুয়া' ও 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার' বই ২টির উল্লেখ পাই। সেই review পড়েই মনস্থির করেছিলাম এই ২টি বই সংগ্রহ করে পড়তেই হবে। কাকতালীয় ভাবেই এই ঘটনার কয়েক মাস পরে হইচই তে 'ব্যাধ' নামের একটি series আসে। জানতে পারি, যে গল্পটির ওপর নির্ভর করে ওটা বানানো হয়েছে সেটার নাম 'চড়াই হত্যা রহস্য'; এবং যা 'কলকাতা নুয়া'র অন্তর্গত। অনেক দোটানার পর, পড়ার আগে দেখেই ফেলি সিরিজটা। গোয়েন্দা গল্প কিন্তু আদ্যন্ত নতুন স্বাদের। নিখাদ পুলিশি তদন্ত তাও যেনো বিনোদন জগতে অভিনব। ভালো লাগলো দেখে। মাসখানেকের মধ্যেই কিনে ফেলি বইগুলো এবং পড়ে শেষ করি। আমার মন থেকে একটা তীব্র তাগাদা পেয়ে যাবতীয় ল্যাদ কাটিয়ে ফেলে এই পাঠ প্রতিক্রিয়া টা লিখতে বসেছি। গৌরচন্দ্রিকা টি আর দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই। লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক এর লেখার সাথে আমার পরিচয় কলকাতা নুয়ার মধ্য দিয়েই। লেখক, গোয়েন্দা গল্পের যে স্বতন্ত্র মাধুর্য্য; তাকে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। আজকের দিনে থ্রিলার প্লট, মারাত্মক টুইস্ট কিংবা সিনেম্যাটিক ক্লাইম্যাক্স এর অনুপ্রবেশ ঘটায় গোয়েন্দা গল্পের যে একটা নিজস্ব স্বভাবসুলভ সৌন্দর্য আছে, তা হারাতে বসেছে। লেখক তাঁকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন এবং আমার মতে সফলও হয়েছেন। গোয়েন্দা কানাইচরন কোনো larger than life চরিত্র নন। তিনি লালবাজারের একজন পুলিশ গোয়েন্দা, যাঁর চাকরিজীবন প্রায় শেষের পথে অর্থাৎ retirement এ খুব বেশি দেরি নেই। সাগরেদ, জুনিয়র ইন্সপেক্টর সৌভিক যিনি স্বভাবতই কানাই এর থেকে অনেক বেশি চটপটে। তবে কানাই এর আছে দীর্ঘ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা, জটিল রহস্য অনুধাবনের উপযোগী অধ্যবসায় আর সূক্ষ বিশ্লেষনী ক্ষমতা। তিনি আর পাঁচটা পরিচিত সরকারী চাকুরীজীবির একজন, যিনি অফিসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে দিব্যি ঘুম দিতে পারেন, যিনি প্রায়শই সন্ধ্যায় সেসিল বারে এ গিয়ে মদ্যপান করেন, বাড়িতে গিন্নিকে একটু সমঝে চলেন এবং যাঁর রেকর্ড সেকশন এর দিদিমণির প্রতি একটু 'ইয়ে' আছে। কানাইচরণের প্রতিটি কাহিনীর যে বৈশিষ্ট্যটি আমার সবথেকে ভালো লেগেছে তা হলো, তদন্ত পদ্ধতির প্রবহমানতা। খুবই সাধারণ আর প্রয়োজনীয় ছোটো ছোটো পদক্ষেপ, রুটিন তদন্তের প্রতিটি ধাপ অতি যত্নে বুনেছেন লেখক। পুলিশি তদন্ত পদ্ধতির একটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবচিত্র পাঠক তথা সাধারণ নাগরিকের তুলে ধরেছেন তাঁর সাবলীল লেখনীর দ্বারা। এবার একে একে কাহিনী গুলোর ব্যাপারে একটু বলি-
'কলকাতা নুয়া' র প্রথম কাহিনী; 'কালাপানির দিশা'~ নানা কারণে বড়োকর্তাদের বিরাগভাজন হয়ে department এ ক্লোজড হয়ে যান কনাইচরণ। লালবাজারে আসা যাওয়া করতে পারলেও তাঁকে কোনো casefile দেওয়া হচ্ছে না। এমতাবস্থায় নিতান্ত সবেতন ছুটি কাটানোর মেজাজে কানাইচরন অপেক্ষা করছেন কবে কোনো গুরুতর জটিল case আসে এবং তাঁর ছুটি শেষ হয়। তাই সময় কাটানোর তাগিদে রেকর্ড সেকশন এর দিদিমণির থ���কে নানা পুরাতন unsolved কেসফাইল নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেরকমই একটি casefile কানাই এর হাতে তুলে দিয়ে দিদিমণি চ্যালেঞ্জ করেন একটি বিশেষ unsolved কেস সলভ করে দিতে। ১৯১১ সালের ঘটনা। একজন স্বদেশী বিপ্লবীর দ্বীপান্তর এর সাজা হওয়ায় তাকে নিয়ে 'জর্জ দ্য স্যভিওর' নামক একটি জাহাজ আন্দামানের উদ্যেশে রওনা দেয়। নিরাপত্তার তাগিদে, জাহাজে যে একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই তথ্যটি বাইরে কোথাও প্রকাশ করা হয়না। বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ে এবং তার পরে জাহাজটি বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কোথাও আর সেই কয়েদী কি সেই জাহাজ কারো খোঁজ মেলে না। ব্রিটিশ নৌ-বাহিনী তথা তৎকালীন পুলিশ বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। না কোনো জাহাজডুবির চিহ্ন, না কোনো জলদস্যু আক্রমনের সংবাদ, না কোনো ঝড় ঝঞ্ঝা। কোনোভাবেই মীমাংসিত হয়না, বঙ্গোপসাগরের এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের। প্রায় একশ বছরেরও বেশি সময় পরে কানাইচরন কিভাবে এই রহস্যের সমাধান করবেন সেটাই এই গল্পের বিষয়। আমার খুব আকর্ষণীয় লেগেছে গল্পের এই পটভূমিটা। দ্বিতীয় কাহিনী; 'পাইস হোটেলে হত্যা'~ কলকাতার এক পাইস হোটেলে নৈশভোজ সারতে এসে হঠাৎ করে খাবার টেবিলেই মৃত্যু হয় দুই কলেজ ছাত্রের। কানাই কে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই কেস এর। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু কিন্তু খাওয়ার এ কোথাও বিষ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন বাদেই আবার একটি অন্য হোটেলে খেতে বসে মারা যান আরেক ব্যক্তি। একই বিষ এ বিষক্রিয়া। হত্যাকারী কে! এটা কী কোনো সিরিয়াল কিলিং এর কেস? এই গল্পে তদন্ত পদ্ধতি খুব সুন্দর সাবলীলভাবে রচিত হয়েছে, গল্পের পটভূমিকাও নতুনত্বের ছাপ লাগানো তবে শেষে এসে কেমন যেনো হয়ে গেলো। আমার ব্যক্তিগত ভাবে এই গল্পের শেষটা ভালো লাগেনি। তবে পড়ে দেখলে হতাশ হবেন না খুব একটা। তৃতীয় কাহিনী; 'চড়াই হত্যা রহস্য'~ ব্যাধ সিরিজে দেখানো কাহিনীটা আসলে যে 'Tip of the iceberg' সেটা নভেলেট টা পড়েই উপলব্ধি করি। শুটিং এর তাগিদে মূল কাহিনীর বেশ কিছু মূল্যবান জায়গার রদবদল ঘটানো হয়েছে যা আমার মনে হয়, মূল কাহিনী বজায় থাকলে আরও আকর্ষণীয় হতে পারতো। এইটি আমার মতে এই সংকলনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী। একজন কিংবা একদল লোক বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে শয়ে শয়ে চড়াই পাখির গলা কেটে হত্যা করছে। একটি অদ্ভুত রকমের সিরিয়াল কিলিং এর case, কানাই যার সম্মুখীন হয়েছিল তাঁর চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে, যেখানে ভিক্টিম মানুষ নয়, চড়াই। সেশিল বারে বসে রেকর্ড সেকশনের দিদিমণি আর সৌভিক কে সেই কাহিনী শোনাচ্ছিলেন কানাইচরণ। বিভিন্ন লেয়ার আছে এই কেস এর তদন্ত পদ্ধতিতে; যায় অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে খোঁচড়দের অবদান। হ্যাঁ, লালবাজার গোয়েন্দাদের থেকে তাঁদের খোঁচড়দের নেটওয়ার্ক কিছু কম নয় বরং অনেকাংশেই বেশি। এর আগে কোনো ফিকশনে, পুলিশ এর খোঁচড়দের উল্লেখ আমি অন্তত পাইনি। খুব আকর্ষণীয়, নিখুঁত তদন্তের মাধ্যমে, নানান প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তরুণ গোয়েন্দা কানাইচরণ দাস কিভাবে এই চড়াই হত্যা রহস্যের সমাধান করেছেন, সেই বিবরণ না পড়লে সতি খুব মূল্যবান কিছু মিস করে যাবেন গোয়েন্দা গল্পপিয়াসী পাঠক-পাঠিকাগণ। অবশ্যপাঠ্য এই কাহিনী। আমি বলবো ভুলেও সিরিজ দেখে এই কাহিনীটা কে বিচার করবেন না। পড়ে ফেলুন।
এরপর আসি লেখকের কানাইচরণ কে লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার' এর বিষয়ে। এক কথায়, এটিই কানাইচরণ কে নিয়ে লেখা লেখকের সাম্প্রতিক কাহিনী হওয়ায় এর প্রতি আমার প্রচুর প্রত্যাশা ছিল; এবং লেখক সেই প্রত্যাশার মান রেখেছেন শুধু নয়, হয়তো আমার প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। কবীরগঞ্জে একটি নির্মীয়মান আবাসন এর ভিতজমি তে খননকার্য করার সময় শ্রমিকরা খুঁজে পান একটা নরকঙ্কাল। কিছুদিন আগেই কবীরগঞ্জ কলকাতা পুলিশের আওতায় এসে পড়ায় তদন্তের দায়িত্ব এসে পড়ে লালবাজারের সিনিয়র গোয়েন্দা কানাইচরণ এর ওপর। তদন্তে নেমে প্রথম কাজ ছিল, কে খুন হয়েছে সেটা খুঁজে বার করা এবং তারপর সেই সূত্র ধরে কেনো খুন হয়েছে এবং কে খুন করেছে তাকে খুঁজে বের করা। No doubt বেশ জটিল কেস। যেখানে ডেডবডি তে হাড় ছাড়া আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই সেখানে কে খুন হয়েছে খুঁজে বের করা মোটেও সহজ কাজ নয়, পশ্চিমবঙ্গের মতো স্থানে। তবুও সেই অসাধ্যসাধন করেছেন আমাদের অতি পরিচিত 'সাধারণ' গোয়েন্দা কানাইচরণ। লেখকের মতে কানাই নাকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাতি-কেস নিয়ে কাজ করে থাকেন, তবে আমার মতে এরকম 'পাতি কেস' এ কানাই নিজের বুদ্ধিমত্তা আর প্রতিভার যে নমুনা প্রতিষ্ঠা করেছেন, আত্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে বারংবার নিজের গোয়েন্দা স্বত্তাকে যেভাবে প্রশ্ন করেছেন যে তিনি যা ভাবছেন তাতে কোনো খুঁত আছে কিনা, তা সত্যি প্রশংসনীয়। এই নির্মাণকার্যের জন্য লেখককে সহস্র কুর্নিশ। হ্যাঁ, এই কাহিনীর শেষে একটি চমক রয়েছে তবে তা মারাত্মক প্লট টুইস্ট গোছের কিছু নয় বরং বলা যেতে পারে সমাপ্তির চমক। যেভাবে সমাপ্তি রচনা হয়েছে তাতে এই কাহিনী আর পাঁচটা গোয়েন্দা কাহিনীর থেকে ভীষণ স্বতন্ত্র হয়ে এক উচ্চ আসন লাভ করবে নিঃসন্দেহে। অত্যন্ত জমজমাট একটা লেখা, সুখপাঠ্যও বটে। রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের কানাইচরণ সিরিজ বাংলা গোয়েন্দা জগৎ কে একটা নতুন দিশা দেখাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এ লেখা চলতে থাকুক, আমি মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছি কানাইচরন কে, সৌভিক কে, লালবাজার কে। অতি সাধারণ এক সরকারী গোয়েন্দা যাঁর গল্পে কোনো অত্যাশ্চর্য বা অতিপ্রাকৃত মোচড় নেই, কিন্তু যুক্তির সাবলীল তীক্ষ্ণতা, ধৈর্য্য আর বিশ্লেষণ আছে। যেখানে কাহিনীর শেষে গোয়েন্দা সবাই কে নিয়ে একটা হলঘরে জমায়েত হয়ে বাক্যবাণ আর নাটকীয়তার আতিশয্যে যবনিকাপাত ঘটান না। যেখানে গোয়েন্দা বলেন, "কোনো খুনই সুপারন্যাচারাল নয়"। যেখানে গোয়েন্দা ভিড়ের মাঝে মিশে থাকা আর পাঁচজন মানুষের একজন প্রতিনিধি যাঁকে দেখলে লোকে রিপোর্টার ভেবে ভুল করেন। (Highly recommended) পুনশ্চ - '৩৩ নং আসামি' নামের কানাইচরণ এর একটি কাহিনী আছে যা এই ২টি বইয়ে নেই, আপাতত সেটার হদিশ চাইলাম।
লালবাজারের সিনিয়র ইন্সপেক্টর কানাইচরণের সাথে শীর্ষেন্দুর লালবাজারি গোয়েন্দা শবরের বেশ খানিকটা মিল পেয়েছি। দু'জনেই যাকে বলে ঠিক ড্যাশিং হিরো নন; চেহারা-সুরত ভাবভঙ্গিতে ফেলুদা-ব্যোমকেশ ভাব নেই। তারা পুলিশই, কাজকর্মের ধরণও পুলিশি। ঘরে বসে তীক্ষ্ণবুদ্ধি দিয়ে রহস্যের সমাধানের বদলে পুলিশ প্রসিডিউর আর জেরার মাধ্যমেই তারা অপরাধী ধরে থাকেন। সেসব রহস্যও দুনিয়া কাঁপানো কিছু নয়, দৈনন্দিন অপরাধই বলা যায়। অতিমানবীয় গোয়েন্দার বদলে স্বাভাবিক গোয়েন্দার আইডিয়া বিশ্বসাহিত্যে অনেকদিন হলেও বাংলায় শীর্ষেন্দুর পর সেরকম আর কাউকে পাচ্ছিলাম না; এই ভদ্রলোকের লেখায় আশাবাদী হচ্ছি। লেখা খানিকটা ধীরগতির, রহস্য বা তার সমাধানও খুব জমজমাট মনে হয়নি, কিন্তু এধরণের লেখায় পাঠককে ধরে রাখতে হলে যে কলমের জোর আর বর্ণনার মুন্সিয়ানা দরকার, রাজর্ষীর মাঝে সেটা পুরোপুরি আছে। কাজেই রহস্যের বদলে আমি তার প্রেক্ষাপট নির্মাণটাই বেশি উপভোগ করেছি। যারা একঘেয়ে গোয়েন্দাকাহিনী পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেছেন, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। আর যারা বিদেশি হার্ডবয়েল্ড ডিটেকটিভের গপ্পো পড়ে পেকে গেছেন বলে মনে করেন, তারাও বাংলার পুলিশি প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে পুনরাবিষ্কার করলে ���শা করা যায় ঠকবেন না।
আমার মতো খুঁতখুঁতে গোয়েন্দাগল্পের পাঠকের কাছে বাংলায় লেখা ভালো গোয়েন্দাকাহিনী একেবারে সোনার পাথরবাটির মতো আলীক না হলেও খানিক অধরা তো বটেই। এখানে ভালো বলতে আমি বোঝাতে চাইছি এমন একধরণের তৃপ্তি যা প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের কাছে কাঙ্খিত। বাংলায় রচিত ও প্রকাশিত যাবতীয় সব গোয়েন্দাকাহিনী পড়ে ফেলার দাবি আদৌ করছিনা, কিন্তু যেটুকু পড়েছি তার মধ্যে অধিকাংশই কিশোর সাহিত্য হিসাবেই বিবেচিত হওয়া উচিৎ। আর বাকি যেসকল সাহিত্যিকরা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের কথা মাথায় রেখে লিখেছেন, সেগুলো হয় গদ্যের দিক থেকে অপাঠ্য, আর নয়তো সেসব গল্পের ভাবনার গতিমুখ এতটাই কনজারভেটিভ এবং রিগ্রেসিভ, যে আজকে (বা যেকোনও সময়ে) দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র প্লটের আকর্ষণে বা লেখনীর গুণে সেগুলো হজম করে যাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার।
এর মাঝেও উৎসাহিত হই যখন কোনও কোনও বই মনের ও মস্তিষ্কের ঠিকঠাক স্থানে অ্যাপিল করে। বিগত দুই বছরে কৌশিক মজুমদারের লেখা 'সূর্যতামসী' ও 'নীবারসপ্তক' ধু ধু মরুভূমিতে পথ হারানো জুয়ারির সামনে লাস ভেগাসের আকর্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে। ঠিক যখন এই দুটি বইকে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের অনুর্বর জগতের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবতে শুরু করেছি, তখনই হাতে পেলাম রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার'। সদ্য বলতে, বইটি বেরিয়েছে গত বছর শেষের দিকে, তবে আমার হাতে এসেছে এই সম্প্রতিকালে। এত ভণিতা করে যখন একটি বইয়ের ব্যাপারে লিখছি, বলাই বাহুল্য বইটি আমাকে যারপরনাই পরিতৃপ্ত করেছে।
রাজর্ষিবাবুর উপন্যাসটি ভালো লাগার একদম প্রাথমিক ও প্রতীয়মান কিছু কারণের কথা যদি ভাবি, তার মধ্যে অবশ্যই গোয়েন্দা কানাইচরণের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি এবং তার কীর্তিকলাপ ঘিরে পুলিশ প্রসিডিউরাল ফরম্যাটে আখ্যানের উপস্থাপনা। বাংলায় গোয়েন্দাসাহিত্যের ডিটেকটিভরা সকলেই বেশ নিষ্কলঙ্ক যা পাঠককে খুব সহজেই কাহিনীর অন্ধকার জগতের মধ্যেও একটি সুরক্ষিত নৈতিক অবস্থানের সন্ধান দিয়ে দেয়। সেইখানে, রিটায়ারমেন্টের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অনাকর্ষণীয় এক প্রৌঢ় ব্যক্তি যার সার্ভিস বুক জুড়ে আছে অসংখ্য লাল কালির দাগ এবং যার মদ্যপানের আসক্তি ক্রমেই অসুস্থতার দিকে এগোচ্ছে, এহেন চরিত্র নিঃসন্দেহে বাংলা গোয়েন্দার ক্যাননে একটি অভিপ্রেত ও জরুরি সংযোজন। এই চরিত্র বর্ণনায় হয়তো একগুচ্ছ বিদেশী গোয়েন্দার ছায়া সুস্পষ্ট, যেমন ফিলিপ মার্লো, জন রিবাস, কার্ট ওয়্যালান্ডার, বা মন্টালবানো। কিন্তু লেখকের কলমের গুণে চরিত্রটি নিখাদ মধ্যবিত্ত বাঙালি, এবং আরও বিশেষত আজকের কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি। ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশের মতো তার মাথার পিছনে মোটেই আর উনিশ শতক বা নবজাগরণের আলোর ছটা খেলেনা। কানাইচরণের বর্তমান পরিস্থিতি বা ভবিষ্যতের আশা, আকাঙ্খা, বা উদ্দেশ্য সবই অধুনা আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই নির্দিষ্ট।
এই উপন্যাসের আরেকটি জোরের জায়াগা অবশ্যই পুলিশ প্রসিডিউরাল ফরম্যাটের সফল পরিবেশনা। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য বা গোয়েন্দাকাহিনীচর্চার অধিকাংশই জুড়ে আছে শখের গোয়েন্দা বা প্রাইভেট ডিটেকটিভরা। বৌদ্ধিক সুপারহিরোর মতো অতি মামুলি সুত্র থেকে তারা ঘোরতর সব সমস্যার কিনারা করে ফেলে, প্রায় ম্যাজিকের মতো। সেসব গল্পে মোটিভ, সুযোগ, সন্দেহতালিকা, ইত্যাদি ঘিরে ঘটনার ঘনঘটায় কাহিনী এগোতে থাকে রুদ্ধশ্বাস গতিতে। অন্যদিকে পুলিশ প্রসিডিউরালে তদন্ত হয় সরকারি নিয়মমাফিক, সরকারি গতিতে। তদন্ত ও তদন্তকারী উভয়কেই যেন গ্রাস করে থাকে একরাশ ক্লান্তি ও একঘেয়েমি। ফলে, এই ধরণের আখ্যানেরও একঘেয়ে ও শ্লথ হয়ে পড়ার একটি সম্ভাবনা অনেক সময়েই থেকে যায়। সেই ব্যাপারে এই উপন্যাসে রাজর্ষিবাবু নিঃসন্দেহে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যগুণে পুলিশি তদন্তের দৈনন্দিনতা ও গতানুগতিক কার্যকলাপও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু সর্বোপরি এই উপন্যাসের কাহিনী আমাকে আকৃষ্ট করেছে তার সৌন্দর্যে। লেখক নিজে খুব সম্ভবত তাঁর পূর্বপ্রকাশিত একটি বইয়ের ('কলকাতা নুয়া') মুখবন্ধে গোয়েন্দাকাহিনীর একধরণের সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে আমার কাছে গোয়েন্দাকাহিনীর অন্যতম সৌন্দর্য তার সত্যের সন্ধানে। পৃথিবীর সকল শিল্পকর্মই নিশ্চয় তাদের নিজেদের মতো করে সত্যের সন্ধানে লিপ্ত ও সত্যের উন্মোচণে আগ্রহী, কিন্তু গোয়েন্দাগল্পের ক্ষেত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, গোয়েন্দাকাহিনীতে এই সত্যের সন্ধান ও উন্মোচণ আখ্যানের মূল উপজীব্য হয় ওঠে। দ্বিতীয়ত, গোয়েন্দাকাহিনী একটি আধুনিক ফর্ম; এই কাহিনীর মূল দ্বন্দ্ব কোনও চিরাচরিত ভালো-মন্দ বা শুভ-অশুভের সংঘর্ষ নয়, বরং আধুনিক সামাজিক বিন্যাসের ফাটল বা অসঙ্গতিই এই নাটকের মূল উপাদান। ফলে, উপরোক্ত সৌন্দর্য কোনও চিরন্তন, শাশ্বত, বা নান্দনিক সত্যের উপসর্গ নয়। এই সৌন্দর্য কাহিনীর পটভূমিকা, চরিত্র, ঘটনা, নিষ্পত্তি, ইত্যাদি ছাপিয়ে সমকালের অনুচ্চারিত ও অপ্রিয় এক বৃহত্তর সত্যের পথপ্রদর্শন। আধুনিক (বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী) গোয়েন্দাগল্পের শ্রেষ্ঠ লেখকেরা সকলেই এই কনটেম্পোরারির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। রাজর্ষিবাবুর 'অজ্ঞাতপরিচয়...' উপন্যাসটিও এই একই গুণে গুণান্বিত। তুলনামূলক নতুন কাহিনী, তাই বিশদ আলোচনায় গিয়ে অযথা স্পয়লার দেবোনা। কিন্তু সামগ্রিক উপন্যাসের প্রেক্ষিতে এবং লেখনীতে একটি Haunted Quality আছে। মূল অপরাধের ঘটনার পটভূমিকাতে এবং সমাধানের পর বোঝা যায় অপরাধের মোটিভেও, স্পষ্টতই অতীতের ভূত (একে অপরের সমার্থক শব্দ যা মোটেই সমাপতন নয়) ঘাড়ে চেপে আছে। এবং এটি এমন এক অতীত, যেই অতীত প্রতিশ্রুতিময়, সম্ভাবনাময়। এবং যেই সম্ভাবনা চিরতরে লুপ্ত হয়েছে, যেই প্রতিশ্রুতি মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, খুব নিবিড় পাঠ ছাড়াও হয়তো বোঝা যায় যে এই কাহিনী কোথাও গিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষের আধুনিকতা প্রোজেক্টের অবক্ষয় ও অকৃতকার্যতারও কাহিনী।
এই লেখাটি পড়ে মনে হতেই পারে যে আমি হয়তো উপন্যাসটিকে একেবারে নিখুঁত এবং ত্রুটিবিহীন হিসাবে আখ্যা দিচ্ছি। সেরকম কিন্তু একেবারেই নয়; কিছু কিছু জায়গা আছে, প্লট এবং লেখনী উভয়েই, যেখানে আমার মনে হয়েছে আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বাংলার হামবড়া সর্বস্ব, সুর্যের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো বৌদ্ধিক সংস্কৃতির পরিসরে এই উপন্যাসটি হাতে পেয়ে এই মুহুর্তে আমি এতটাই সন্তুষ্ট, যে সেসব আলোচনা পরের জন্যই তোলা থাক। আপাতত চাই আরও মানুষ এই উপন্যাসটি পড়ুন এবং আমি অপেক্ষায় রইলাম কানাইচরণের পরবর্তী কেসের জন্য।
অনেক জায়গায় গল্পটা অকারণে বেশ টেনেছে, যেসব সূত্র ধরে কেস সলভ হয়েছে, সেই লজিকের লেজ বড্ড বেশি লম্বা - যে কারণে উপন্যাসের মধ্যবর্তী অংশ পড়তে একটু একঘেয়ে লাগছিল। এটা শারদীয়া উপন্যাসের থেকে স্রেফ আরেকটু বড় সাইজের কাহিনী হলেই বেশি জমত, যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। যদিও শুধু কলমের নৈপুণ্যের কারণেই এটি একটি অসাধারণ মানবিক গোয়েন্দা কাহিনী হয়ে উঠেছে, এবং গল্পের নীচে একটা রাজনীতির চোরাস্রোত আছে, যেটা ন্যারেটিভকে অনে���াংশেই চালিত করেছে, আমার ব্যক্তিগত রেটিং 3.5। কানাইচরণের আরো গল্প উপন্যাস পড়ার ইচ্ছে রয়েই গেল।
আমার মতো খুঁতখুঁতে গোয়েন্দাগল্পের পাঠকের কাছে বাংলায় লেখা ভালো গোয়েন্দাকাহিনী একেবারে সোনার পাথরবাটির মতো আলীক না হলেও খানিক অধরা তো বটেই। এখানে ভালো বলতে আমি বোঝাতে চাইছি এমন একধরণের তৃপ্তি যা প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের কাছে কাঙ্খিত। বাংলায় রচিত ও প্রকাশিত যাবতীয় সব গোয়েন্দাকাহিনী পড়ে ফেলার দাবি আদৌ করছিনা, কিন্তু যেটুকু পড়েছি তার মধ্যে অধিকাংশই কিশোর সাহিত্য হিসাবেই বিবেচিত হওয়া উচিৎ। আর বাকি যেসকল সাহিত্যিকরা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের কথা মাথায় রেখে লিখেছেন, সেগুলো হয় গদ্যের দিক থেকে অপাঠ্য, আর নয়তো সেসব গল্পের ভাবনার গতিমুখ এতটাই কনজারভেটিভ এবং রিগ্রেসিভ, যে আজকে (বা যেকোনও সময়ে) দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র প্লটের আকর্ষণে বা লেখনীর গুণে সেগুলো হজম করে যাওয়া বেশ ক���িন ব্যাপার।
এর মাঝেও উৎসাহিত হই যখন কোনও কোনও বই মনের ও মস্তিষ্কের ঠিকঠাক স্থানে অ্যাপিল করে। বিগত দুই বছরে কৌশিক মজুমদারের লেখা 'সূর্যতামসী' ও 'নীবারসপ্তক' ধু ধু মরুভূমিতে পথ হারানো জুয়ারির সামনে লাস ভেগাসের আকর্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে। ঠিক যখন এই দুটি বইকে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের অনুর্বর জগতের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবতে শুরু করেছি, তখনই হাতে পেলাম রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার'। সদ্য বলতে, বইটি বেরিয়েছে গত বছর শেষের দিকে, তবে আমার হাতে এসেছে এই সম্প্রতিকালে। এত ভণিতা করে যখন একটি বইয়ের ব্যাপারে লিখছি, বলাই বাহুল্য বইটি আমাকে যারপরনাই পরিতৃপ্ত করেছে।
রাজর্ষিবাবুর উপন্যাসটি ভালো লাগার একদম প্রাথমিক ও প্রতীয়মান কিছু কারণের কথা যদি ভাবি, তার মধ্যে অবশ্যই গোয়েন্দা কানাইচরণের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি এবং তার কীর্তিকলাপ ঘিরে পুলিশ প্রসিডিউরাল ফরম্যাটে আখ্যানের উপস্থাপনা। বাংলায় গোয়েন্দাসাহিত্যের ডিটেকটিভরা সকলেই বেশ নিষ্কলঙ্ক যা পাঠককে খুব সহজেই কাহিনীর অন্ধকার জগতের মধ্যেও একটি সুরক্ষিত নৈতিক অবস্থানের সন্ধান দিয়ে দেয়। সেইখানে, রিটায়ারমেন্টের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অনাকর্ষণীয় এক প্রৌঢ় ব্যক্তি যার সার্ভিস বুক জুড়ে আছে অসংখ্য লাল কালির দাগ এবং যার মদ্যপানের আসক্তি ক্রমেই অসুস্থতার দিকে এগোচ্ছে, এহেন চরিত্র নিঃসন্দেহে বাংলা গোয়েন্দার ক্যাননে একটি অভিপ্রেত ও জরুরি সংযোজন। এই চরিত্র বর্ণনায় হয়তো একগুচ্ছ বিদেশী গোয়েন্দার ছায়া সুস্পষ্ট, যেমন ফিলিপ মার্লো, জন রিবাস, কার্ট ওয়্যালান্ডার, বা মন্টালবানো। কিন্তু লেখকের কলমের গুণে চরিত্রটি নিখাদ মধ্যবিত্ত বাঙালি, এবং আরও বিশেষত আজকের কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি। ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশের মতো তার মাথার পিছনে মোটেই আর উনিশ শতক বা নবজাগরণের আলোর ছটা খেলেনা। কানাইচরণের বর্তমান পরিস্থিতি বা ভবিষ্যতের আশা, আকাঙ্খা, বা উদ্দেশ্য সবই অধুনা আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই নির্দিষ্ট।
এই উপন্যাসের আরেকটি জোরের জায়াগা অবশ্যই পুলিশ প্রসিডিউরাল ফরম্যাটের সফল পরিবেশনা। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য বা গোয়েন্দাকাহিনীচর্চার অধিকাংশই জুড়ে আছে শখের গোয়েন্দা বা প্রাইভেট ডিটেকটিভরা। বৌদ্ধিক সুপারহিরোর মতো অতি মামুলি সুত্র থেকে তারা ঘোরতর সব সমস্যার কিনারা করে ফেলে, প্রায় ম্যাজিকের মতো। সেসব গল্পে মোটিভ, সুযোগ, সন্দেহতালিকা, ইত্যাদি ঘিরে ঘটনার ঘনঘটায় কাহিনী এগোতে থাকে রুদ্ধশ্বাস গতিতে। অন্যদিকে পুলিশ প্রসিডিউরালে তদন্ত হয় সরকারি নিয়মমাফিক, সরকারি গতিতে। তদন্ত ও তদন্তকারী উভয়কেই যেন গ্রাস করে থাকে একরাশ ক্লান্তি ও একঘেয়েমি। ফলে, এই ধরণের আখ্যানেরও একঘেয়ে ও শ্লথ হয়ে পড়ার একটি সম্ভাবনা অনেক সময়েই থেকে যায়। সেই ব্যাপারে এই উপন্যাসে রাজর্ষিবাবু নিঃসন্দেহে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যগুণে পুলিশি তদন্তের দৈনন্দিনতা ও গতানুগতিক কার্যকলাপও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু সর্বোপরি এই উপন্যাসের কাহিনী আমাকে আকৃষ্ট করেছে তার সৌন্দর্যে। লেখক নিজে খুব সম্ভবত তাঁর পূর্বপ্রকাশিত একটি বইয়ের ('কলকাতা নুয়া') মুখবন্ধে গোয়েন্দাকাহিনীর একধরণের সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে আমার কাছে গোয়েন্দাকাহিনীর অন্যতম সৌন্দর্য তার সত্যের সন্ধানে। পৃথিবীর সকল শিল্পকর্মই নিশ্চয় তাদের নিজেদের মতো করে সত্যের সন্ধানে লিপ্ত ও সত্যের উন্মোচণে আগ্রহী, কিন্তু গোয়েন্দাগল্পের ক্ষেত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, গোয়েন্দাকাহিনীতে এই সত্যের সন্ধান ও উন্মোচণ আখ্যানের মূল উপজীব্য হয় ওঠে। দ্বিতীয়ত, গোয়েন্দাকাহিনী একটি আধুনিক ফর্ম; এই কাহিনীর মূল দ্বন্দ্ব কোনও চিরাচরিত ভালো-মন্দ বা শুভ-অশুভের সংঘর্ষ নয়, বরং আধুনিক সামাজিক বিন্যাসের ফাটল বা অসঙ্গতিই এই নাটকের মূল উপাদান। ফলে, উপরোক্ত সৌন্দর্য কোনও চিরন্তন, শাশ্বত, বা নান্দনিক সত্যের উপসর্গ নয়। এই সৌন্দর্য কাহিনীর পটভূমিকা, চরিত্র, ঘটনা, নিষ্পত্তি, ইত্যাদি ছাপিয়ে সমকালের অনুচ্চারিত ও অপ্রিয় এক বৃহত্তর সত্যের পথপ্রদর্শন। আধুনিক (বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী) গোয়েন্দাগল্পের শ্রেষ্ঠ লেখকেরা সকলেই এই কনটেম্পোরারির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। রাজর্ষিবাবুর 'অজ্ঞাতপরিচয়...' উপন্যাসটিও এই একই গুণে গুণান্বিত। তুলনামূলক নতুন কাহিনী, তাই বিশদ আলোচনায় গিয়ে অযথা স্পয়লার দেবোনা। কিন্তু সামগ্রিক উপন্যাসের প্রেক্ষিতে এবং লেখনীতে একটি Haunted Quality আছে। মূল অপরাধের ঘটনার পটভূমিকাতে এবং সমাধানের পর বোঝা যায় অপরাধের মোটিভেও, স্পষ্টতই অতীতের ভূত (একে অপরের সমার্থক শব্দ যা মোটেই সমাপতন নয়) ঘাড়ে চেপে আছে। এবং এটি এমন এক অতীত, যেই অতীত প্রতিশ্রুতিময়, সম্ভাবনাময়। এবং যেই সম্ভাবনা চিরতরে লুপ্ত হয়েছে, যেই প্রতিশ্রুতি মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, খুব নিবিড় পাঠ ছাড়াও হয়তো বোঝা যায় যে এই কাহিনী কোথাও গিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষের আধুনিকতা প্রোজেক্টের অবক্ষয় ও অকৃতকার্যতারও কাহিনী।
এই লেখাটি পড়ে মনে হতেই পারে যে আমি হয়তো উপন্যাসটিকে একেবারে নিখুঁত এবং ত্রুটিবিহীন হিসাবে আখ্যা দিচ্ছি। সেরকম কিন্তু একেবারেই নয়; কিছু কিছু জায়গা আছে, প্লট এবং লেখনী উভয়েই, যেখানে আমার মনে হয়েছে আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বাংলার হামবড়া সর্বস্ব, সুর্যের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো বৌদ্ধিক সংস্কৃতির পরিসরে এই উপন্যাসটি হাতে পেয়ে এই মুহুর্তে আমি এতটাই সন্তুষ্ট, যে সেসব আলোচনা পরের জন্যই তোলা থাক। আপাতত চাই আরও মানুষ এই উপন্যাসটি পড়ুন এবং আমি অপেক্ষায় রইলাম কানাইচরণের পরবর্তী কেসের জন্য।
অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার: ছাপোষা গোয়েন্দার অচেনা এক জগৎ
সত্যি বলতে কী, ‘অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার’ ��ড়া শুরু করার সময় আমার ভেতরে খানিকটা দ্বিধা কাজ করছিল—গোয়েন্দা গল্প মানেই কি এখন অতিমানবিক ক্লাইম্যাক্স, মারাত্মক চেজ সিকোয়েন্স, দুরন্ত প্লট টুইস্টের ঝাঁঝালো মশলা? রাজর্ষি দাশ ভৌমিক একেবারে অন্য পথে হাঁটলেন। তিনি গল্প বলেন ধীরে, আত্মবিশ্বাসে, সূক্ষ্ণ রসদে। আর সেই ধীরতা—সে যেন এক আলফ্রেড হিচককের মতো স্লো বার্ন, একটা মনস্তাত্ত্বিক জমাটের দ্যোতনা, যা শেষ অবধি পাঠককে পড়ে রাখতে বাধ্য করে।
লালবাজারের গোয়েন্দা কানাইচরণ—চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ঝাঁকড়া চুল, একেবারে সাধারণ এক লোক, যাঁকে আপনি হয়তো বাসে উঠতে দেখবেন, বাজারে হাঁটতে দেখবেন—রিপোর্টার ভেবে ভুল করবেন। কিন্তু সেই সাধারণত্বের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক নিবিড় পর্যবেক্ষণশীল মন, জীবন ও মৃত্যুর প্রতি এক গভীর দৃষ্টিভঙ্গি। এই গল্পে, কবীরগঞ্জ নামের এক নবউন্নয়নশীল অঞ্চল—যেখানে কনস্ট্রাকশনের খোঁড়াখুঁড়িতে বেরিয়ে আসে একটি অজ্ঞাত নরকঙ্কাল—কানাইচরণের তদন্ত ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়।
এখানে ‘কীভাবে খুন হল?’ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়—‘কার খুন হল?’ এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল গোটা গোয়েন্দা ঘরানার ভেতরে এক অভিনব সংযোজন, যেখানে অপরাধের চেয়ে মানবিকতার প্রশ্নটাই বড় হয়ে ওঠে।
গল্পটি অদ্ভুতভাবে আমাদের পরিচিত গোয়েন্দা সাহিত্যের কাঠামো ভেঙে নতুন একটা জায়গা তৈরি করে। কানাইচরণকে আপনি ফেলুদার মতো রূপবান ও শাণিত, ব্যোমকেশের মতো যুক্তিনির্ভর, না শার্লক হোমসের মতো উন্মাদ প্রতিভা—এই সবগুলো থেকেও আলাদা এক ছায়াচরিত্র রূপে পাবেন। অফিসে ঢপ মেরে ঘুমোতে পারে, সেসিল বারে গিয়ে চুপচাপ পেগ চুমুক দিতে পারে, কিন্তু তদন্তে তার ধৈর্য্য আর কৌশল—সে অনন্য।
এত বড় কেস, অথচ ক্লাইম্যাক্সে কোনো বিস্ফোরণ নেই, ধোঁয়া নেই, বন্দুক নেই—আছে শুধু সত্য উন্মোচনের এক নিঃশব্দ মর্মস্পর্শী মুহূর্ত। লেখক খুব সচেতনভাবে পুলিশি তদন্তকে জাদুবাস্তবতা বা নাটকীয়তার ধাঁচে না সাজিয়ে, যতটা সম্ভব বাস্তবিক রেখেছেন। ফলে এই বই পড়তে পড়তে পাঠক বুঝতে পারেন—‘সব রহস্য জিলিপির মতো পাকানো হয় না, সব গোয়েন্দা স্পাইডারম্যান হয় না, কিন্তু সব সত্যও নাটক ছাড়া বেরিয়ে আসে না।’
‘অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার’ আসলে একটা social procedural, একটা moral commentary—যেখানে পুলিশ বিভাগ, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল, লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, এবং সামান্য মানুষদের অসামান্য বেঁচে থাকার লড়াই—সব কিছুই এসে যায় পটভূমিতে। ফলত, বইটি হয়ে ওঠে একাধারে রহস্য উপন্যাস এবং নাগরিক ইতিহাসের দলিল।
লেখক স্বচ্ছন্দে চালিয়ে গেছেন জটিল বাস্তবিক ডিটেলিং, কিন্তু কখনও ক্লান্তিকর হয়ে ওঠেননি। বইয়ের অলংকরণে কিছু ঘাটতি থাকলেও, ঝকঝকে পেজ সেটআপ, প্রচ্ছদের চিত্রভাষা এবং নিখুঁত সম্পাদনা বইটিকে একেবারে প্রিমিয়াম লুকে পৌঁছে দেয়।
সবচেয়ে বড় কথা, এই বইটি পড়া মানে একধরনের রেজোন্যান্স খুঁজে পাওয়া—যে রকম একজন পাঠক হিসেবে আপনার ইচ্ছা করে বলার, “আমি কানাইচরণকে চিনি, আমি এই গোয়েন্দাকে বিশ্বাস করি।”
শেষে বলি, শার্লক যদি চায়নাটাউনের অন্ধকার গলিতে চলতে শেখে, ব্যোমকেশ যদি পয়লা বৈশাখের ভিড়ে হেরে যায়, ফেলুদা যদি ছাপোষা চাকরি করে রেকর্ড সেকশনে—তবে সে যে হবে কানাইচরণ, সেটা একশো শতাংশ নিশ্চিত।
পড়ুন, ভাবুন, কানাইচরণের চোখ দিয়ে আবার চিনে নিন রহস্যকে—যেখানে অতিনাটকীয়তা নয়, বরং “প্রতিটি মৃত মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে”—এই নীতির উপর দাঁড়ানো গোয়েন্দা গল্প জন্ম নেয়।
Highly, unapologetically recommended.
(P.S: রাজর্ষি বাবু, কানাইচরণের পরের ফাইল কবে আসছে? পাঠক কিন্তু লাইন দিয়ে বসে আছে।)
একটা পুলিশ প্রসেডিউরাল উপন্যাসে কলকাতা শহর আর তার সংলগ্ন টাউনের একাকীত্বের বেদনা এইভাবে ফুটে উঠবে, সেটা "অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার" যখন শুরু করেছিলাম, তখন আশা করি নি। ভেবেছিলাম রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের লেখা অন্য বই "কলকাতা নুয়া"-এর মত হবে। বৈঠকী গোয়েন্দা গল্প। অল্প হাসি-মজাক। একটা অদ্ভুত কেস। সেসিল বারে গলা ভেজানো।
কিন্তু "অজ্ঞাতপরিচয়" উপন্যাস একটা পেটি ক্রাইমের আখ্যানের থেকেও বড় কিছু হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাসঙ্গিক কিছু সমস্যার সাথে সাথে শহুরে চাকরি জীবনে জমে থাকা বিষাদের কথা একটা ডিটেকটিভ উপন্যাসে দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি, কিন্তু সাথে সাথে পুলকিতও হয়েছি।
কারণ আমাদের জনপ্রিয় গোয়েন্দা গল্পে এইসব জটিলতাকে যে ঝেড়ে ফেলা হয়! ফেলুদা, কাকাবাবু, ব্যোমকেশ, এমনকি কর্নেলের গল্পেও সামাজিক আর রাজনৈতিক সমস্যার একটু আভাস থাকলেও, চরিত্রগত সমস্যার কথা সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফেলুদা কাকাবাবুরা হল আর্কেটাইপ, তাদের চারিত্রিক গুণের মাধ্যমে নৈতিকতার মাপকাঠি তৈরি হয়ে থাকে। সেখানে গ্রে মোরালিটি বা অ্যান্টিহিরোর কোনও স্থান নেই। স্থান নেই ব্যক্তিগত সমস্যার। তাই ফেলুদারা কোনওরকম অনৈতিক কাজ করে না। ফেলুদাদের ডিপ্রেশন হয় না, হলেও সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয় না।
কিন্তু কানাইচরণ তো লালবাজারের গোয়েন্দা মাত্র, সুপারহিরো ডিটেকটিভ নন। পুলিশ জীবনে সাদাকালো জীবনযাপন করা যে অসম্ভব। ফলাফল পেতে মাঝেমধ্যে আঙুল ব্যাঁকাতে হয়। এর সাথেও কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা কানাইচরণের জীবনকে আরও বিষাদময় করে তুলেছে। অ্যালকোহলিজম, শুষ্ক দাম্পত্যজীবন, আসন্ন বার্ধক্য, একাকীত্ব...
বর্তমানে, আমার একটা প্রিয় জনরা হল নর্ডিক নোয়ার। "বর্ডারটাউন", " দ্য চেস্টনাট ম্যান", "দ্য ভালহালা মার্ডার্স", প্রভৃতি সিরিজের সাথে এই হাল আমলে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। সত্যি বলতে, নর্ডিক নোয়ার ঘরানার লেখা তেমন পড়া হয় নি। সিরিজ দেখে যা বুঝেছি, তা হল, এই ঘরানার গল্প স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে দেখানো হয়। আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, বৈশিষ্ট্যহীন টাউনের গভীরে যে অপরাধের চোরাস্রোত বয়ে যায়, সেটাকে আলোচনার কেন্দ্রে আনা হয়। প্রতিটা গল্পের গোয়েন্দারই ব্যক্তিগত সমস্যা রয়েছে, যেগুলো সামলে গোয়েন্দাকে তদন্তের কাজ চালাতে হয়।
এই বৈশিষ্ট্যগত গুণগুলো "অজ্ঞাতপরিচয়" উপন্যাসে দেখতে পেয়েছি। একটাই পার্থক্য : ইউরোপের জমে যাওয়া কোন টাউনে খুনটা হয় নি, হয়েছে কলকাতার পাশে একটা অজ পাড়াগাঁয়ে।
উপন্যাসের নামেই কিন্তু মূল কেসের সব ব্যক্ত করা হয়ে গেছে। কবীরগঞ্জ নামের এক আধা মফস্বলি এলাকায়, একটা বাড়ির কনস্ট্রাকশন সাইটে, মাটি খোঁড়াখুঁড়ির সময় এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার হয়েছে। যেহেতু কবীরগঞ্জ অতি সম্প্রতি লালবাজার থানার অন্তর্গত হয়েছে, তাই গা জোয়ারি দেখানোর জন্য লালবাজারের সব থেকে ভাল গোয়েন্দা কানাইচরণকে পাঠান হচ্ছে। বাকি কী হয়েছিল, তা পড়ে জানবেন।
এই গল্পে কিন্তু সুপারহিরোগিরি নেই, মাটিতে একটা চকোলেট র্যাপার পেয়ে কেস ক্র্যাক করার মত ঘটনা নেই, বন্দুক নিয়ে ঠাঁইঠাঁই নেই। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে কানাইচরণ দাঁতে দাঁত চেপে খুনির দিকে তাঁর বন্দুক তাগ করে বলেন নি, "ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখ নি।" কারণ সেইসব বাস্তব জীবনে হয় না৷ বাস্তবে, পুলিশ প্রসেডিউরালের অনেকাংশ বেশ একঘেয়েমির কাজ৷ থানা ঘেটে ঘেটে অসংখ্য লোকের নাম বার করো, স্টেটমেন্টের পর স্টেটমেন্ট নাও, ফরেন্সিক দলকে ডাকো, ছয় ঘন্টার ভিডিও ফুটেজ দেখো, সাসপেক্টের পেছনে খোঁচড় লাগাও, আরও কত কি। এক জায়গায় তো কানাইচরণ বলেই ফেললেন, তার তো নিজেকে পুলিশের থেকে কেরানি বেশি মনে হয়।
তবু মাঝেমাঝে, অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায়। নতুন তথ্য হাতে পেয়ে ইনভেস্টিগেশনের মোড় ঘুরে যায়। আর এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে পিউর লজিকাল থিংকিং। এই লজিকের লেজ ধরেই আমি ২৮৬ পাতার বইটা দেড় দিনে শেষ করেছি। রাজর্ষিবাবু নিজেই যে বলেছেন, "গোয়েন্দা কাহিনির একটি বিশেষ সৌন্দর্য আছে।" সেই সৌন্দর্য আমাকে অভিভূত করে রেখেছে, এই এখনও।
আশা করি ভবিষ্যতে কানাইচরণকে নিয়ে এইরকম আরও পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকবে।
অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার রহস্য কাহিনীটি মূলত পুলিশি তদন্ত প্রক্রিয়ার একটি রহস্য উপন্যাস। কাহিনীটি তে পুলিশি তদন্ত পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে অতীতে কিছু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি খুনের রহস্য সমাধানের দিকে এগিয়েছে। লেখক রাজর্ষি দাস ভৌমিক এর লেখা প্রথমবার পড়লাম, বইটির প্রচ্ছদও লেখক নিজেই করেছেন এবং বেশ ভালই করেছেন। লেখকের প্রথম বই কলকাতা নুয়া তেও আমরা দেখতে পাই লালবাজার এর গোয়েন্দা কানাইচরণ দাস এর। সেখানে তিনটি ছোট গল্প আমরা দেখেছিলাম, আর অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। বইটির গোয়েন্দা কানাইচরন দাস, বয়স ৫৮ বছর, লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল সেল এর সিনিয়র ইন্সপেক্টর। রিটায়ারমেন্ট এর আর বেশিদিন বাকি নেই, কোকড়ানো চুলে পাক ধরেছে। সুযোগ পেলেই তিনি নিজের কেবিন এ টেবিলের উপর পা তুলে একটু ঘুমিয়ে নেন। রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলে বউয়ের ভয়ে তটস্থ থাকেন। গোয়েন্দা হিসেবে দক্ষ হলেও মাঝে মাঝেই নানা কারণে তার সার্ভিস বুকে লাল কালির দাগ দেখতে পাওয়া যায়। আসলে এত কিছু বলার কারণ, গোয়েন্দা কানাইচরন এর স্রষ্টা রাজর্ষি দাস ভৌমিক যে চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন তা আমার আপনার মতই সাধারন, এদেরকেই রাস্তা ঘাটে দেখতে পাওয়া যায়, এরা আমার আপনার মতোই সাধারণ লোক। গোয়েন্দা শুধুমাত্র তাদের পেশা, তাদের দেখতে, চলাফেরা, জীবন যাপন সবকিছুই খুবই সাধারণ। তাই এই উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে, যেখানে মুল চরিত্র খুবই সাধারণ একজন মানুষ যে লালবাজার এ গোয়েন্দা পদে কাজ করেন।
পটভূমি -
কলকাতা পার্শ্ববর্তী কবিরগঞ্জ এলাকায় একটি ফাঁকা জমিতে বাড়ি তৈরীর জন্য নির্মান কাজ চলার সময় মাটি কাটতে গিয়ে মাটির তলায় আবিস্কৃত হয় একজন অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের নগ্ন নরকঙ্কাল। লালবাজার থেকে এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য কবীরগঞ্জে পাঠানো হয় ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সেরা অফিসার কানাইচরণ কে। কানাইয়ের সহকারি হিসাবে সঙ্গে থাকে লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার অফিসার সৌভিক । দুই পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়ে বেনামী লাশের দেহাবশেষ পরীক্ষা করে দেখতে গেলে কানাইচরণের মনে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। এরপর ফরেনসিক এর প্রাথমিক রিপোর্ট এও একই প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয় গোয়েন্দাদের। রহস্য উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে নরকঙ্কাল কে ঘিরে কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক তদন্ত বিভাগের কাজকর্মের একটা সহজ সরল ডিটেল বিবরণ। এই রহস্য উপন্যাসটির সবচে বড় বিশেষ দিক হলো এখানে কানাইচরণ কে একদিকে যেমন খুনী কে খুঁজতে হয়েছে , খুনের মোটিভ কে খুঁজতে হয়েছে , মার্ডারওয়েপন কে খুঁজতে হয়েছে । তেমনি পাশাপাশি চলেছে ভিক্টিমের প্রকৃত পরিচয় খোঁজার অনুসন্ধান । একটি অচেনা নরকঙ্কাল আবিস্কার হওয়া দিয়ে যে রহস্য উপন্যাসের শুরু তা বিভিন্ন পুলিশি তদন্তের বাঁক ঘুরে ক্লাইম্যাক্সে একটা অজানা দিকে টার্ণ নিয়েছে। এছাড়াও গোয়েন্দা কানাইচরন এর ব্যক্তিগত সমস্যা, শারীরিক সমস্যা এবং লালবাজার এর অভ্যন্তরীণ অনেক রাজনীতিই তুলে ধরেছেন লেখক এই বইটিতে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া -
তরীঘড়ি করে গল্প এগোয়নি। পুলিশি তদন্ত প্রক্রিয়া যেমন সময় নিয়ে হয় উপন্যাস ও সেই তালেই এগিয়েছে, ক্রাইম স্পট থেকে স্যাম্পল কালেকশন, রাত বিরেতে সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড়, খোঁচর লাগিয়ে তথ্য উদ্ধার, কিছুদূর একটা সূত্র নিয়ে এগিয়ে আবার পিছিয়ে আশা বাস্তব সম্মত তদন্তের ধারা অনুভব করতে হলে এই বই অবশ্যই পাঠ্য। রহস্য উপন্যাসটির প্লট প্রথম থেকেই জমজমাট ও গতিময় । প্লটে অচেনা নরকঙ্কাল উদ্ধার , মৃত ব্যক্তির পরিচয় ঘিরে রহস্য , খুনের হাতিয়ার সংক্রান্ত রহস্য , খুনের সময় নিয়ে রহস্যের গোলকধাঁধা , খুনের মোটিভ ঘিরে ধোঁয়াশা , কঙ্কালের ডি এন এ পরীক্ষার ঘিরে রহস্যের এর মতো বিষয় গুলো একে একে উঠে এসেছে । এই গল্পে কোনো সুপারহিরোগিরি নেই, নেই বন্দুকের আওয়াজ, নেই কোনো অতিঅলৌকিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা, কারণ সেগুলো বাস্তব জীবনে হয়না। বাস্তবে তদন্তকারী অফিসার কে খুঁজে বের করতে হয় সন্দিগ্ধ ব্যক্তির নামের লিস্ট, তারপর তাদের ডিএনএ স্যাম্পল কালেক্ট করানো, স্টেটমেন্ট নেওয়া, ছয় ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজ দেখতে হয়। এরই মধ্যে নুতুন কোনো সূত্র নুতুন কোনো তথ্য মোড় ঘুরিয়ে দেয় পুরো ইনভেস্টিগেশন এর। আর এইসব এর পিছনে থাকে শুধুমাত্র তীক্ষ্ণ যুক্তি, বাস্তব সম্মত চিন্তাভাবনা, এখানেই এই রহস্য গল্পটি অন্যান্য রহস্য গল্প থেকে আলাদা এবং সুন্দর। গোয়েন্দা কানাইচরন আবার ফিরে আসুক এবং আমাদের এই ধরনের গোয়েন্দা গল্পের আমেজে মূখরিত করে রাখুক এই আশা রাখি লেখকের কাছ থেকে।
গোয়েন্দা গল্প একরকম হয়, যেমন ব্যোমকেশ ফেলুদা যেখানে বুদ্ধিমত্তা টাই প্রধান আবার Dan Brown এর থ্রিলার ও হয় যেখানে সূত্রের পর সূত্র, ইতিহাস গণিতের মিশেল। এই দুরকমের জিনিসই বেশ খানিক আছে বাংলা সাহিত্যে, তাদের মধ্যে বেশ কিছু সাহিত্য গুণে যথেষ্ট সমৃদ্ধও। যেটার অভাব সমসাময়িক সাহিত্যে বোধ হতো - সেটা হলো ভালো কাঁচা থ্রিলার - মানে ঐ David Baldacci বা Lee Child ধরণের - Good old police investigation work আর তার সাথে সাবলীল ভাষা যাতে অযথা তথ্য heroism নেই।
এক বন্ধুর সাজেশানে পড়লাম "অজ্ঞাত পরিচয় ব্যাক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার"। লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক। গোয়েন্দা কানাইচরণ কোনও অসাধারণ গোয়েন্দা নন - পুলিশকর্মী, নানান বদভ্যাসে দুষ্ট, বেশ আনফিট মোটের ওপর কল্পনার সিংঘম ঠিক নন, যাদের খালি সিনেমা তেই দেখা যায়।কিন্তু কিছুটা manipulation আর বাকিটা পুলিশি কায়দায় করা তদন্ত বিশেষ উপভোগ্য। আর তদন্তও করেন কোনও অসাধারণ অপরাধের নয়, রোজকার খুন, মাটির নীচে পাওয়া কঙ্কাল বা ফেরার আসামীর। রাজর্ষি বাবুর লেখার ভাষা, দরকারের বেশি তথ্যে ভরিয়ে না ফেলা ইত্যাদি বই টিকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। কিছু, কিছু জায়গায় স্বগতোক্তি বা ঘটনার বর্ণনায় উপন্যাসের চেয়ে চিত্রনাট্য মনে হয় বেশি কিন্তু সেই স্টাইল টাও বেশ অন্যরকম। অনেকদিন বাদে একটা ভালো পুলিশ গোয়েন্দার গল্প পড়লাম যেখানে কাব্য নেই, অযথা heroism নেই, গাদা তথ্য নেই, অসাধারণ অপরাধ নেই, charismatic চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া অপরাধী নেই, আছে শু���ু নিপুণ পুলিশি গোয়েন্দাগিরি। আরেক টা বড়গল্পের সংকলন আছে ওটাও পড়ার ইচ্ছে আছে। কানাইচরণের গল্প everyday thriller প্রেমীদের কাছে উপভোগ্য হবেই নিঃসন্দেহে
অসাধারণ। এই মুহূর্তে বাংলার থ্রিলার লেখকদের মধ্যে সম্ভবত সবথেকে শক্তিশালী কলম। অত্যন্ত ভালো লেখা। বাস্তবের কাছাকাছি। একটানে পড়বার উপন্যাস। লেখার ধরনটা খুব পাল্পেবল, সহজেই গ্রাস করে নেয়। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্য প্রায় প্রতিটা প্যারা দুবার করে পড়েছি। গোয়েন্দা কানাইচরণের সর্বোত্তম অভিযান নিঃসন্দেহে। বাস্তব জীবনের ক্লান্তি আর ক্লেদের সমান্তরালে এক অ্যাবসার্ডিস্ট হিউমর ছুঁয়ে যায়। বেশ কয়েকবার হেসে ফেলেছি, এবং প্রতিটা ক্ষেত্রেই একটা সূক্ষ্ম হিউমর আর তীব্র রাজনৈতিক বা সামাজিক শ্লেষ তার কারণ থেকেছে। একটা দুটো প্রিন্টিং মিসটেক দেখলাম। আর রিফিউজিরা চিরাগ, কাঁহাতক এসব নিশ্চয়ই বলেন, কিন্তু ঐখানে একটু ডাইভার্সিটি আনা যেত হয়তো, সবটাই শহুরে বাংলা না হলেও চলে, বিশেষত একটা অন্তর্ভাষণে। এইটুকুই।