কিছু বই নিঃশব্দে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে। একবার সেই দরজা খুলে ফেললে, তারা শুধু গল্প বলে না—বরং এক নতুন জগতে পা রাখতে বাধ্য করে। ঋজু গাঙ্গুলীর ‘দশে দিক’ ঠিক তেমনই এক অনন্য সংকলন, যেখানে কল্পনা, পুরাণ, ইতিহাস এবং রহস্য এক অভিনব মিশেলে সন্নিবেশিত হয়েছে। দশটি গল্প, দশটি দিক, এবং প্রতিটি দিক নতুন এক আলোর প্রতিফলন।
প্রথম গল্প ‘ভয়’—এক সাংবাদিকের নিখোঁজ হওয়া দিয়ে শুরু, যা ধীরে ধীরে একটি পুরানো কিংবদন্তির গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে উঠে। ঘটনাগুলো এমনভাবে এগোয়, যেন এক অজানা আতঙ্ক অরণ্যের নিঃস্তব্ধতার মধ্যে চাপা পড়ে ছিল, আর সেই আতঙ্কের ছোঁয়া আস্তে আস্তে পাঠকের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। শেষে, গল্পটি পাঠককে এমন এক রহস্যময় দ্বারে নিয়ে যায়, যেখানে বিস্ময়ের সাথে ভয়ের মিলন ঘটে।
‘হনন’ হল যুক্তির ধারালো অস্ত্র দিয়ে অন্ধকারকে চিরে ফেলার কাহিনি। মৃত্যুর ছায়ার আড়ালে চাপা পড়ে থাকা সত্য যখন উন্মোচিত হয়, তখন তার গতি ট্রেনের জানালার বাইরে ছুটে চলা দৃশ্যের মতো—চোখ ফেরাবার সময় মেলে না।
‘দাঁত’ ও ‘পোকা’—দুটি গল্পই যেন অতীতের কোনো জার্নাল, যা খুললেই বেরিয়ে আসে ধুলোমাখা অভিযানের নোট, রহস্যে মোড়া কিছু দৃষ্টান্ত, আর এমন কিছু ঘটনা যা মনে প্রশ্ন তোলে: ‘ঘটনাগুলো কি সত্যিই ঘটেছিল? নাকি কেবলই কল্পনা?’
‘গ্রহণ’ গল্পটি যেন গ্রামবাংলার নিস্তরঙ্গ জলতলের নিচে ঘুমিয়ে থাকা অশান্তির এক আচমকা বিস্ফোরণ। যেখানে নীরবতা আর অপরাধ একে অন্যকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে।
‘খোলস’, ‘খাঁচা’ ও ‘পাশ’—এই তিনটি গল্পের অলৌকিক আবহ যেন পাঠককে বাস্তবের গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায়। এখানে আতঙ্ক কেবল ভূতপ্রেত নয়, বরং মানুষ, স্মৃতি এবং বিশ্বাস—যা সময়ের অতল থেকে উঠে এসে আধুনিকতার দেয়ালে ছায়া ফেলে।
‘আয়ুধ’ গল্পটি পুরাণ ও আধুনিকতার মাঝে এক সূক্ষ্ম, অথচ গভীর সংযোগ। অতীতের এক প্রাচীন অস্ত্র, বর্তমানের এক অনুসন্ধান, এবং সেই সঙ্গে ইতিহাসের ছায়া মিলে তৈরি হয়েছে এমন এক ক্যানভাস, যা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে।
সবশেষে ‘জল’—যা নিছক একটি অভিযান নয়, বরং এক দর্শন। বিজ্ঞানের পর্দার আড়াল থেকে হঠাৎ উঁকি দিয়ে প্রকাশ পায় রহস্য, যা শেষে যুক্তির সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বাসের অগাধ সাগরে ভেসে চলে।
লেখকের পড়াশোনার গভীরতা ও অন্তর্দৃষ্টি লেখায় প্রতিধ্বনিত হলেও সেই তথ্য কখনোই বাহুল্য বা দৃষ্টিকটু হয়ে উপস্থিত হয় না, বরং গল্পের প্রয়োজনে সেগুলি নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়। পাঠক কখন যে পুরাণের প্রাচীন গাঁথা পাঠ করতে শুরু করেন, কিংবা কখন যে ইতিহাসের অজানা অধ্যায়ে ডুবে যান—নিজেও টের পান না। সম্ভব হলে অবশ্যই পড়ুন। নমস্কার!