একটা শতাব্দী। গোটা বিশ্ব চরম অস্থির। একের পর এক ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ঘটনা। তারই মাঝে সে নজরদারি করে চলেছে গোটা বিশ্বে। খিদিরপুর থেকে চিনের ক্যান্টন, সুদূর আফ্রিকার সাভো নদীর তট থেকে ইম্ফল – কোনও স্থানই তার দৃষ্টিপথের বাইরে নয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পথ চলে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সে নির্দেশ অমোঘ, অলৌকিক। তা অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। সে জিচোলা তাতু।
রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, অলৌকিক, যুদ্ধ আর ইতিহাস দিয়ে গেঁথে তোলা দুর্ধর্ষ উপন্যাস ‘ত্রিকালচক্ষু’।
সুদীপের পড়াশোনা বেশ ভালো, ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতাও কম নয়। ইনফর্মেশন প্রচুর আছে বইটিতে। কিন্তু লেখার হাতটা এখনো ঠিক... মানে এরকম একটা বিষয় হ্যান্ডেল করার জন্য যেরকম লেখার উপর দখল থাকা দরকার, সেটা এখনো তৈরি হয়নি। তবে আমার মনে হয় - এটা তৈরি হয়ে যাবে। এবং আমরা দুর্দান্ত একজন লেখক কে পাবো।
পড়ে ফেললাম ত্রিকালচক্ষু। ভারত উপমহাদেশ, চীন, আফ্রিকা বিস্তৃত এই গল্প এক সূত্রে বেঁধেছে ইতিহাসের বহু অধ্যায়। ঔপনিবেশিক শাসনকালের সাথে জুড়ে গেছে স্বাধীনতার লড়াইয়ের কাহিনী, আফ্রিকার জনজাতির সাথে বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের সন্তানের মধ্যে তৈরী হয়েছে এক যোগসূত্র, চীনের এক 'বিপ্লবী' সংগঠনের সাথে মিশে গেছে ভারতের এক বাণিজ্য দলের কপাল লিখন।
এই গল্পের নানা অধ্যায় আছে, যা সময়সারণীর বিভিন্ন ভাগে ঘটে। কিন্তু কালক্রমে সেই অধ্যায়ের মূল চরিত্র জড়িয়ে পড়ে অলৌকিক কোনও ঘটনার সাথে। বেশ কিছু জায়গায় পড়তে পড়তে মনে হবে যেন বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের অভিযানে চলেছি (বিশেষ করে আফ্রিকার অধ্যায়টি)। যেভাবে গল্পে ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য। শুধু যেন মনে হল, রান্নায় নুনটা কম পড়েছে। খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল বইটা। কেমন একটা ছন্নছাড়া রয়ে গেল ন্যারেটিভ। সব অধ্যায়ের সব সুতোগুলো গুটিয়ে একটা উপযুক্ত উপসংহার হলে ভালো হত।
কিন্তু কী ঘটল চীনে যার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার এক সন্তানের অতীত? আফ্রিকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির কাজ করতে গিয়ে কেন এক জনগোষ্ঠীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ল এক বঙ্গসন্তান? আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রামেও বা কীভাবে জড়িয়ে সেই আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর আরাধ্যের বরদান? সবটাই ঘটছে কালের নিয়মে - এক অপার্থিব ভাগ্যনিয়ন্তার সৌজন্যে। কী সেই মহাজাগতিক রহস্য? জানতে হলে পড়ে ফেলুন এই বইটি।
তন্ত্র-মন্ত্র সহযোগে কাপালিকের ভূত খ্যাঁদানো গল্প তেমন একটা পছন্দ না হলেও দু-এক পিস অলৌকিক কাহিনী পড়েই ফেলি স্বাদবদলের তাগিদে। ত্রিকালচক্ষু সেই স্বাদবদলের ফলাফলস্বরূপ কোনপ্রকার পৈষ্টিক গোল বাধায়নি। (কারণ এতে ওসব কিছুই নেই)
গল্পে আছে তিনটে টাইম লাইন।চোদ্দ বছরের বালক শিবনাথ চীনের ক্যান্টন (বর্তমানে গুয়াংঝৌ) বন্দর পাড়ি দেওয়ার পথে মাঝসমুদ্রে উদ্ধার করে এক ডুবন্ত রহস্যময় আফ্রিকান ব্যক্তিকে যার শরীরে পরবর্তীকালে হঠাৎ করেই ফুটে ওঠে দুটো ত্রিভুজের মাঝে একটা চোখ আঁকা আশ্চর্য এক উল্কি। ঘটনাক্রমে শিবুর শরীরেও ছোঁয়াচে রোগের মতো এসে বসে উল্কিটা যা দেখে বৃদ্ধ লি জিউ ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন "সানজাও ইয়ান" বলে। কেন? এরপর কি ঘটলো সেখানে? পরবর্তী টাইমলাইনের গল্প আফ্রিকার জঙ্গলে সিংহের রাজত্বে। মোগো, বিশ্বনাথ, বাদলের জীবনে হঠাৎ করেই সেই উল্কির আগমন। নতুন একটা নাম উঠে এল মোগোর মুখে, "জিচোলা তাতু"। এরপর কি ঘটলো সেখানে? শেষ অধ্যায়ের পটভূমি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম। আজাদ হিন্দ বাহিনী তখন ইম্ফলে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। সেখানেও এসে হাজির এই উল্কি। তার আরেক নতুন নামকরণ হল "ত্রিকালচক্ষু"। তিন টাইমলাইনের মধ্যে কোন সংযোগ পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত?
এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বইয়ের ঝরঝরে লেখনীর মধ্যে। বানান ভুল অনেক। বাংলা ভাষায় রেকর্ড সংখ্যক "ব্যাবসা" বানান মনে হয় এই বইতেই পাওয়া যাবে। প্রচ্ছদটি মন্দ নয়। বইয়ের নাম লেখা ফন্টটিও বেশ। উপন্যাসটি গতিশীল হলেও লেখক ব্যাপারটা আরো ক্রিয়েটিভ কোন উপায়ে ফিনিশিং টাচ দিতে পারতেন।
কিছুদিন আগে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাঙালি অধ্যাপক নিজের কলামে লিখেছিলেন চিনে আফিম রফতানি নিয়ে বাংলায় কোনো বই নেই। সম্ভবত তিনি এই বইয়ের নাম জানতেন না। তিন শতাব্দী ধরে তিনটে পৃথিবী তোলপাড় করা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা অভিযানের কাহিনী। শুরু করলে শেষ করে থামতে পারবেন না।
একটাই আক্ষেপ বইটা দ্বিতীয় সংস্করণে অনেকটা বাড়ানো হয়েছে, ফলে যারা প্রথম সংস্করণের বই কিনেছেন তাদের সেই বাড়তি অংশটা পড়ার জন্য দ্বিতীয় সংস্করণের বইটা আবার কিনতে হয়েছে। বিষয়টা আমার কাছে পাঠক ঠকানো মনে হয়েছে। এটা না করে পরের অংশটা ত্রিকালচক্ষু দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে প্রকাশ করা যেত। এই ঘটনার পরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যত প্রিয় লেখকের বইই হোক প্রথম সংস্করণের বই আর কিনব না।