আশি সালেরও আগে (১৯৭৭ সালে) দুই ডাক্তার দম্পতি অক্সফোর্ডে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ঠিক করলেন, দেশে তো সবাই ফেরে, তারা ফিরবেন একটু ভিন্ন পথে। আর সে ভিন্ন পথই জন্ম দিল এই গল্পের। এমন একটি ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ি নিয়ে তারা রওনা দিলেন যা ইতিমধ্যেই চলেছে লক্ষাধিক কিলোমিটার। তাঁদের সাথে সঙ্গী হিসাবে জুটে গেল ভারতীয় বন্ধু, ভুপেন্দ্রজিৎ সিং আনন্দ।
নাম যেমন বলে তাই, এই কাহিনী সড়কপথে অধ্যাপক একে আজাদ খান, তার স্ত্রী কিশোয়ার আজাদ আর বন্ধু ভুপেন্দ্রজিৎ-এর সড়কপথে ঘরে ফেরার গল্প। প্রাকভ্রমণ প্রস্তুতি হিসাবে তারা লন্ডন থেকে শুরু করে একে একে পারি দেন স্টকহোম, উপসালা, লুন্ড (সুইডেন), কোপেনহেগেন (ডেনমার্ক), প্যারিস (ফ্রান্স) । মূল ভ্রমণ শুরু হয় যখন তারা ইংলিশ চ্যানেল পারি দিয়ে ক্যালে থেকে যাত্রা শুরু করেন যা আসলে কোথায় বুঝে উঠতে পারিনি। সেখান থেকে ফ্রান্সের বর্দু, সান সেবাস্তিয়ান সমুদ্র সৈকত হয়ে স্পেনের বার্সেলোনা। সেখান থেকে ইতালির পথে, দেখে নিলেন পিসা, ফ্লোরেন্স, রোম এবং ভ্যাটিকান সিটি। এরপর জুগোস্লাভিয়া হয়ে গ্রীস ছাড়িয়ে, ছুটলেন ইউরোপের সীমানার দিকে, গন্তব্য তুরস্কের ইস্তানবুল। তারা তখনও পাকিস্তানের ভিসা পাননি, এই কবছর আগে যে দেশকে বৃধাঙ্গুলি দেখিয়ে এদেশের জন্য, তারা ভিসা দেবে কী না তা নিয়ে আছে সন্দেহ। সেই সন্দেহকে সাথে নিয়েই এগিয়ে চললেন। তুরস্কের আংকারা, ক্যাপাদোকিয়া, বাজারগান হয়ে তাঁদের লক্ষ্য ছিল ইরান। ইরানে বেশ কিছুদিন ঘুরে টুরে আফগানিস্তানে প্রবেশ মাশাদ সীমান্ত দিয়ে। সেখান থেকে কাবুল তোহরাম ছাড়িয়ে পাকিস্তানে তারা ঢুকেছিলেন। চালিয়েছেন খাইবার পাস দিয়ে। মজার বিষয় হল, তারা পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে তারা পেশোয়ার, ইসলামাবাদ, লাহোর পাড়ি দিয়েছেন গাড়িতে করে। কিন্তু সেই গাড়ি ভারতে প্রবেশ করার অনুমতি পান নি! তাই ভারতের ওয়াগা সীমান্ত পর্যন্তই এসেছিল তাঁদের গাড়ি। এরপর অমৃতসর থেকে কোলকাতা এসেছেন ট্রেনে করে, তাও ছাড়েননি সড়কপথ। কী দুর্ভাগ্য, কোলকাতা থেকে সেসময় সরাসরি ট্রেন বা বাস কিছুই ছিল না, এত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শেষ পথটুকু তাঁদের আসতে হয়েছিল আকাশপথে!
এই বই পড়ার সময় মাথায় রাখা ভাল যে, এটি কোন সাহিত্যিকের বই নয়। বরং এর লেখক একজন প্রথিতযশা চিকিৎসাবিদ যিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এবং ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সদস্য। তাই সেই অর্থে এই বই "সুখপাঠ্য" নয়, থেকে থেকেই খেই হারিয়েছে কাহিনী, লেগেছে খটকা, কাহিনির ফ্লো মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়েছে অপ্রয়োজনীয় ইতিহাস ঢুকে পড়ায়।
তবে লেখকের নিজের সংগ্রহ থেকে যাত্রাপথে বিভিন্ন বিখ্যাত স্থানে তোলা ছবি বইটিকে দিয়েছে অন্য এক মাত্রা। প্রথমে মনে হয়েছিল সে ছবিগুলো রঙ্গিন হলে ভাল হত, পরে মনে হল ৭৭ সালে কি উনাদের কাছে আসলেই রঙ্গিন ক্যামেরা ছিল? আমার মনে হয় এ বই ভ্রমণপ্রেমীদের হিংসের খোরাক হবে অবশ্যই। চাইলেও যে আজকের বাস্তবতায় কেউ গাড়ি হাঁকিয়ে ইউরোপ, মিডল ইস্ট আর সাউথইস্ট এশিয়ার সেই রাস্তাগুলো তার স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে পার হতে পারবে না তা নিশ্চিত!