তাঁর জন্ম এবং বড় হওয়া হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জনের পরে তিনি রাজ্য সরকারের অধীনে আধিকারিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ দুই-দশকের লেখক-জীবনে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর-সাহিত্য, উভয় ধারাতেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তিনি যখন গল্প-উপন্যাস লেখেন, তখন ঘটনার বিবরণের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন মানব-মনের আলোছায়াকে তুলে আনার বিষয়ে। লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁর বহু কাহিনি রেডিও-স্টোরি হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে সমাদর পেয়েছে। সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন দীনেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার এবং নান্দনিক সাহিত্য সম্মান।
সৈকত বাবুকে আমরা অনেকে থ্রিলার লেখক হিসেবে চিনলেও এই বইয়ের লেখনীতে তার স্বাধীন লেখক সত্ত্বার প্রকাশ পেয়েছে। এখানে উনি ছিলেন অবাধ এবং লেখাতে ছিলো নিজস্বতার প্রকাশ.... এই বইয়ে উনি লেখার শৈল্পিকতা দেখিয়েছেন
সব গল্পই সমসাময়িক এবং সমকালীন..... প্রায় গল্পে পরাবাস্তব একটা ফিল তৈরী করেছেন উনি লেখার মাধ্যমে। কিছু গল্পে ভ্রম সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। একটা গল্পে ছিল spiritual একটা আবহ। আবার প্রায় গল্পে ছোট ছোট জিনিস নিয়ে উনি শব্দে-বাক্যে খেলা করেছেন(যেমন একটা পুকা, পিপড়া)... তবে লেখার মাধ্যমে একটা আর্ট তৈরী করতে চেয়েছেন বটে 🌻
সুতরাং গল্পগুলো হলো নিরীক্ষাধর্মী। গল্পের বিষয়বস্তু বেশ ছোট, কিন্তু লেখার সৌন্দর্যের কারণে এগিয়ে যাওয়া গেলো..... যারা শক্তপোক্ত লেখা পছন্দ করেন, লেখার সৌন্দর্য উপভোগ করা যাদের কাছে মূখ্য গল্পের চেয়ে, যারা লেখা পড়ে চিন্তা করতে পছন্দ করেন তাদের বেশ ভাল লাগবে সুতরাং গল্পগুলো "সবার জন্য না" টাইপের।।
বইটাতে অনেক অনেক সুন্দর বাক্য ছিল/অংশ ছিল। আমি ঐগুলো লিখে রাখিনি বলে আফসোস আছে বৈকি। লেখা ভাল লাগাতে পড়েই গিয়েছি মাত্র 😑 তবে দুর্ভাগ্যবশত একটা লেখা ভাল লাগাতে লিখে রেখেছিলাম, এটা পড়ে দেখতে পারেন------
"ফলে পেছনের জংলা বাগান থেকে সারাদিন শুকনো পাতা উড়ে এসে ঘুরে বেড়ায় সেই বারান্দার মেঝেতে, বিলেকের আলোয় নিয়তির মতন বিস্তারিত মাকড়সার জাল চিকমিক করে থামের গায়ে। সবকিছু এত নীরব, এত ব্যস্ততাহীন এখানে! একটা কেঁচো ধুলোর উপর আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে মেঝে পেরোয়। কিংবা পেরো না, তার আগেই তার আয়ু শেষ হয়ে যায়। আমার বাল্য-কৈশোরের সেই অসমাপ্ত আসনটার কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, আমার বাড়ির সামনের অংশে ভাড়াটি গাঙ্গুলিবাবুদের সংসার থেকে যে বর্ণিল আসন বোনা শুরু হয়েছে, লাল-সবুজ-সবুজ-লাল করে সেই নকশা অক্ষাংশে দ্রাঘিমাংশে চৌখুপি ভরতে ভরতে, নানান সংসদ, শ্মশান-কবরস্থান, টাওয়ার অফ সাইলেন্স, সিনেমা হল, অডিটোরিয়াম, ফ্লাইওভার, ব্রথেল, বন্দর পার হয়ে হঠাৎ এই বারান্দার ধূসর চৌখুপিতে এসে শেষ হয়ে গেছে। মনে হয়, সফল পৃথিবীর শেষ অনিষ্পন্নতা যেন এই জংলাবাগানের সংলগ্ন বারান্দা,আর বারান্দার মাঝখানে ভাঙা বেতের চেয়ারে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকা আঠাশ বছরের বিফল অস্তিত্ব"
নিরীক্ষাধর্মী লেখা কখনো সফল,কখনো শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবে এটাই স্বাভাবিক।এই গ্রন্থের বেশিরভাগ "নিরীক্ষা" সফল বলে মনে হয়েছে।লেখকের গদ্যশৈলী অসাধারণ। তরতর করে পড়া যায়।অন্ধজাতক,অর্ণার নামে চিঠি,খাঁচা,মায়াচিঠি গল্পগুলো দারুণ। অন্যান্য সব গল্পও সুখপাঠ্য। শুধু স্বাদু গদ্যের জন্য বইটা আরেকবার পড়া যায়।
ছোট্ট রিভিউ। সিম্পল। বইটা পড়ুন। সংগ্রহে রাখুন। অধুনা বাংলা ছোটগল্পের মাইলফলক এ বইয়ের প্রতিটি লেখা। সঙ্গে, ক্যাফে টেবিল থেকে প্রকাশিত কিসসাওয়ালার গল্পগুলিও।
আশ্চর্য সব ভাষায় ও চিন্তায় সজ্জিত এই সময়কার জনপ্রিয় কথাশিল্পী সৈকত মুখোপাধ্যায়ের গল্প সংকলন 'তেঁতুল পাতার গল্প'। যে সৈকত মুখোপাধ্যায় কে আমরা থ্রিলার এর পাতায় চিনি, তিনি চেনা ছকের বাইরে খেলেছেন এই বইটিতে। প্রত্যেকটি গল্প হাত খুলে লেখা এবং ভাষা,শব্দ ও বিষয়বস্তুর অনন্যতার এক অনন্য আশ্রয় হল লিটল ম্যাগাজিনে লেখা এই সকল গল্পগুলি। লিটল ম্যাগাজিন অনেকটা মেসবাড়ির মতো-পাঁচমিশেলী মানুষের বসবাস, আনাগোনা একইসঙ্গে, একই ছাদের তলায়। বইটির নামকরণের তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে লেখক বলেছেন "লিটল ম্যাগাজিনের টানাটানির সংসারে এরকম ভালোবাসার অভাব নেই।সেইজন্যেই দু-ফর্মার বই ভাগ করে নিতে হয় ন'জন গল্পকারকে।গল্পের আয়তন ছোট হওয়াটা সেখানে আবশ্যিক শর্ত।নিজেরটা দেখলেই তো শুধু হবে না, সবাই যাতে একসঙ্গে দু-মলাটের মধ্যে থাকতে পারি সেটাও তো দেখতে হবে।একেবারে জেনুইন 'তেঁতুলপাতা' যাকে বলে"।....
পটভূমি - মোট ১২ টি ছোট ও অনু গল্প রয়েছে গল্প সংকলনটিতে তার রাত্রি – পিতার রাত্রি ইয়ামন অন্ধজাতক অর্ণার নামে চিঠি বর্ণচোর খাঁচা হ্যামলিনের হারানো শিশুরা দ্বিরাগমন লেডিস সাইকেল মায়াচিঠি স্পর্শদোষ স্বপ্নক্ষতদুষ্ট মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো গল্প অন্তত আমার মতে- 'তার রাত্রি- পিতার রাত্রি', 'অন্ধজাতক', 'বর্ণচোর', 'মায়াচিঠি', 'স্পর্শদোষ', 'স্বপ্নক্ষতদুষ্ট', 'লেডিজ সাইকেল'।'ইয়ামন' গল্পটি বোধগম্য হয় নি আর 'খাঁচা' গল্পটি হয়তো বা মিলিয়াও মিলিল না। 'দ্বিরাগমন' গল্পটি সময়ের সাথে নিজেদের ভালো থাকার খুব সুন্দর আখ্যান।
পাঠ প্রতিক্রিয়া - সংকলনের একডজন গল্প বিভিন্ন ধরনের ।'দ্বিরাগমন', 'লেডিজ সাইকেল' এর মতো ছোটগল্প আছে যেমন, তেমনই রয়েছে 'অন্ধজাতক', 'অর্ণার নামে চিঠি'র মতো অপেক্ষাকৃত বড় গল্পও। গল্পগুলি ঠিক যে সুখ্কর তা কিন্তু না, প্রত্যেকটি চরিত্রও যে সুখী তাও না, কারো বিকৃত মানসিকতা, কেউ হ্যালুসিনেশন এ ভুগছে, কেউ কেউ নিজেদের পরিসরে সুখী। শব্দ ও বাক্যচয়ন এ এই বই তরতর করে পড়ে ফেলা যায়। যেহেতু প্রত্যেকটি লেখাই পরীক্ষামূলক তাই সবার ভালো লাগবে এই কথা আমি বলবো না, এই ধরনের লেখার জন্য আমি মুখিয়ে থাকলাম, কিসসাওয়ালা বইটিও আশা করি এই ধরনের গল্প সংকলন তাই ওই বইটিও আমি সংগ্রহে রেখেছি, কোনো একদিন সেই বইটি নিয়েও আলোচনা করবো।
শুধুমাত্র একজন গল্পকার হিসেবে মনে রেখে দেওয়া যায় সৈকত মুখোপাধ্যায়কে। প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপন থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের রোজনামচা এই গল্প সঙ্কলনটিতে পেয়েছি।