বাংলায় অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের সূত্রপাত কোন লেখার মাধ্যমে? গবেষক ও সাহিত্যসেবী শ্রী সৌরভ দত্তের থেকে আহৃত তথ্যের ভিত্তিতে বলা চলে যে “মৌচাক” পত্রিকায় ১৩৩০-১৩৩১ জুড়ে প্রকাশিত হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা “যখের ধন”-এর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে রোমাঞ্চকর অভিযানের পথচলা শুরু হয়। এরপর “মৌচাক”-এই ১৩৩৮-৩৯-এ প্রকাশিত হয় “আবার যখের ধন”, এবং বাংলার শ্যামলিমা থেকে পাঠক উৎক্ষিপ্ত হন আফ্রিকার গহনতম অরণ্যের মাঝে! বিমল ও কুমার জুটির সঙ্গে দেশে-বিদেশে, মায় অন্য গ্রহেও এরপর পাড়ি দিয়েছেন বাঙালি পাঠক। কিন্তু “মৌচাক” পত্রিকার পাতাতেই ১৩৪২-৪৩-এ প্রকাশিত যে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে রোমাঞ্চ আর রোমান্সের এক অনন্য মেলবন্ধন উপহার দেয়, তা হল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর “চাঁদের পাহাড়”! শুধু কাহিনির টানেই নয়, বইটি আপামর পাঠকের কাছে জনপ্রিয় তার মুখ্য চরিত্র শঙ্করের জন্যও, যার মতো সরল, সাহসী, সৎ, সহানুভূতিশীল, অথচ ঘরোয়া চরিত্র নক্ষত্রখচিত সাহিত্যাকাশেও নিতান্ত বিরল। সত্যি করে বলুন তো, “চাঁদের পাহাড়” পড়ার পর একটি বারের জন্যেও কি আপনার এই ভেবে আক্ষেপ হয়নি যে, শঙ্করের মতো এক অদ্বিতীয় চরিত্রকে নিয়ে বিভূতিভূষণ আর কোনো কাহিনি লেখেননি কেন?
২০১৫-র মে মাসে ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকা তাদের পূজাবার্ষিকী ‘শারদাঞ্জলি ১৪২২’-এর জন্য “চাঁদের পাহাড়”-এর সিকুয়েল অণু উপন্যাস আহ্বান করে। সুলেখক পার্থ দে-র লেখা “চাঁদের উপত্যকা” লেখা ও উক্ত শারদীয়ায় প্রকাশিত হয় সেই ডাকে সাড়া দিয়েই। শঙ্করের মতো চরিত্রকে নিয়ে নতুন লেখার সাহস বা দুঃসাহস দেখানো কতটা যৌক্তিক এই নিয়ে বিবাদ চলবেই, তবে আমাদের সৌভাগ্য যে সেই দশচক্রে লেখাটি ভূতায়িত হয়নি। বরং লেখাটি বই হিসেবে দু’মলাটের মধ্যে আসার সময় লেখক আরো একটি অণু উপন্যাস সংযোজন করেন, তাই আলোচ্য বইয়ে আমরা পড়তে পাই ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত “রাজহংসীর সরোবর”-টিও।
কেমন লাগল বইটা?
মূল উপন্যাসে রামেশ্বর মুখুজ্জের জামাই প্রসাদদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি এবং পরিচয় শঙ্করের জীবনের গতিপথ আমূল বদলে দিয়েছিল। সুদীপ্ত দত্ত-র প্রচ্ছদ, এবং প্রতিভাস-এর সযত্ন মুদ্রণে শোভিত এই বইয়ে থাকা দুটি কাহিনিতেই নিয়ামকের ভূমিকা নিয়েছেন প্রসাদদাস।
“চাঁদের উপত্যকা” উপন্যাসে শঙ্কর ব্রাজিলে রবার চাষের ব্যবসায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগ দিতে রওনা দেয়। পথে বেশ কিছু বিপদের সম্মুখীন হয়ে, এবং রহস্যময় কিছু চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সে শেষ অবধি মানাউস শহরে নিজের কাজে যোগ দেয়। কিন্তু খুব শিগগিরি শঙ্কর বুঝতে পারে যে তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে অন্য একটি কারণে। তারপর কী হল? রাজা আতাহুয়ালপাকে ফ্রান্সিসকো পিৎজারোর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে ইনকাদের জমানো বিপুল সম্পদ যে চাঁদের উপত্যকায় লুকোনো আছে, সেখানে কি পৌঁছতে পারল শঙ্কর? এই নাতিদীর্ঘ এবং দ্রুতগতি উপন্যাসটি পড়তে ভালোই লাগে, তবে মূল উপন্যাসে শঙ্কর চরিত্রটি যত সরল অথচ সজীব হয়ে ফুটে উঠেছিল, এখানে তা হয়নি। তাছাড়া পর্তুগিজ শব্দ ও তার বাংলা অর্থের ঘন-ঘন অনুপ্রবেশ গল্পটিতে স্থানীয় স্বাদ ও গন্ধ আনার বদলে গতিরোধক হিসেবেই কাজ করেছে। সর্বোপরি, গল্পের মূল প্রস্তাব, অর্থাৎ রহস্যময় ম্যাপের পাঠোদ্ধারে শঙ্করের দক্ষতার জন্য তার ওপর নির্ভর করার ব্যাপারটা পুরো আজগুবি, কারণ “চাঁদের পাহাড়”-এই স্পষ্ট যে রেইন ফরেস্টে ঘোরার জন্য অত্যাবশ্যক বুশ-ক্র্যাফট কিছুটা জানলেও কার্টোগ্রাফি বা দুর্বোধ্য সঙ্কেতবাহী ম্যাপের বিশ্লেষণ কোনোকালেই তার করায়ত্ত ছিলনা। তবে এটুকু ‘চোনা’ বাদ দিলে লেখাটা ভালো হয়েছে।
এরপর এল “রাজহংসীর সরোবর”। এতে ব্যাপার আরো সাংঘাতিক, কারণ শঙ্কর নামের একটি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ, যে আবার প্রায় জেমস বন্ডের বাঙালি সংস্করণ, -কে দিয়ে এখানে জারের রাশিয়ায় দস্তুরমতো অভিযান চালানো হয়েছে, যাতে মিশেছে পলিটিক্যাল থ্রিলার, বিজ্ঞান, ইতিহাস, এবং (সম্ভবত) রোমান্স। সম্পূর্ণ গাঁজাখুরি, “চাঁদের পাহাড়”-এর শঙ্করের শ্রাদ্ধ করা, অথচ হাল-ফ্যাশনের থ্রিলারের ব্যাকরণ মেনে বিনোদনের ভরপুর প্যাকেজ হিসেবে নির্মিত এই লেখাটি পড়লে বিভূতিভূষণ অপার বিস্ময়ে কোথায় হারিয়ে যেতেন তা জানিনা, তবে লেখাটা পড়তে বেশ লেগেছে। হ্যাঁ, সরস্বতী পুজোর ভোগের খিচুড়ি আশা করেছিলাম বলে মাথা গরম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঝালনুন দেওয়া জলপাই হিসেবে লেখাটা খাসা হয়েছে।
তাই সুধী পাঠকবৃন্দ, এই বইটি হাতে নিয়ে দয়া করে আরেকটি “চাঁদের পাহাড়” আশা করবেন না। বরং খোলা মনে বইটা পড়ুন দুটি দ্রুতগতি অ্যাডভেঞ্চার তথা অ্যাকশন থ্রিলার (অণু) পড়ার জন্য। কথা দিচ্ছি, হতাশ হবেন না। শঙ্কর বা প্রসাদদাস-কে বাদ দিয়ে লেখক তাঁর মতো করে এরপর যে গতিময় থ্রিলারটি পেশ করবেন, এখন থেকেই তার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম।
বাংলা অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের সূর্যসন্তান শঙ্কর যখন আবার ফিরে আসে, এক শতাব্দীর বেশি সময় পর, তখন শুধু তার নতুন অভিযানের কাহিনী নয়, ফিরে আসে পাঠকের বিস্মিত চাহনি, ছেলেবেলার রোমাঞ্চ, এবং বিভূতিভূষণের রচিত ‘আত্ম-অনুসন্ধান’ নামক পর্বতটির এক অনুলিপি—স্মৃতিমেদুর এবং পুনরায় পথচিহ্ন আঁকা এক নতুন মানচিত্র।
পার্থ দে-র চাঁদের উপত্যকা এই পুনরাবৃত্তিরই এক চেষ্টাকৃত এবং চ্যালেঞ্জিং সংস্করণ। বইটিতে রয়েছে শঙ্করের দু’টি অভিযান: “চাঁদের উপত্যকা” এবং “রাজহংসীর সরোবর”—দুটি নাতিদীর্ঘ নভেলা। প্রথমটি অ্যাডভেঞ্চারের, দ্বিতীয়টি অনেকটাই থ্রিলারের।
চাঁদের উপত্যকা: স্মৃতির ছায়ায় রচিত এক পুনরাবৃত্তি: শঙ্কর এখানে রাবারের ব্যবসার সূত্রে ব্রাজিলে পৌঁছোয় এবং সেখান থেকে ঘটনাচক্রে পেরুতে গিয়ে পৌঁছে যায় এক ইনকা উপকথার মধ্যে। পেরুর শেষ ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপার গুপ্তধনের সন্ধান, ছদ্মনামের মানচিত্র, আর একরাশ স্থানীয় বিপদের মধ্যে শঙ্করের অভিযান পরিণতি পায়।
গল্পটি পড়তে ভালো লাগলেও, এটিকে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর প্রাণস্পন্দনের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে ফাঁক থেকে যায়। চাঁদের পাহাড়ে শঙ্কর তার ভিতরের ভয় ও সম্ভ্রম পেরিয়ে যে আত্ম-উন্মোচনের পথে পা দেয়, চাঁদের উপত্যকায় সেই গভীরতা তৈরি হয় না। সেখানে যেমন রিখটার্সভেল্ডের প্রাকৃতিক ভয়াবহতা শঙ্করের ভিতরকার একটি পরিবর্তনের বাহক হয়ে দাঁড়ায়, এখানে তা অনেকটাই বাইরের কাহিনির বাঁকে আটকে থাকে।
তাছাড়া, বারবার পর্তুগিজ শব্দ, ইতিহাসগত রেফারেন্স, এবং কম্প্যাক্ট লেখনির মধ্যে স্থানীয় গন্ধ আনার চেষ্টায় কিছুটা কৃত্রিমতাও এসে পড়ে। শঙ্করের চরিত্রে সেই পাণ্ডিত্য বা কার্টোগ্রাফি-বোধ আমরা দেখিনি চাঁদের পাহাড়-এ। তাই রহস্যময় মানচিত্র পড়ে গুপ্তধনের সন্ধান করার তার ‘অভ্যেস’ খানিক বেখাপ্পা ঠেকে।
রাজহংসীর সরোবর: অ্যাডভেঞ্চার নাকি রাজনৈতিক থ্রিলার: এই গল্পে আমরা দেখতে পাই এক ‘অন্য’ শঙ্করকে—জার-শাসিত রাশিয়ার তুষারাবৃত সাইবেরিয়ায়, একজন ভারতীয় বিপ্লবী প্রসাদদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্ধার করতে গিয়ে সে জড়িয়ে পড়ে গুপ্তপুলিশ, ষড়যন্ত্র, স্নো ট্রেন, দাঙ্গা ও মৃত্যুর এক রুদ্ধশ্বাস অভিযানে।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে—এই শঙ্কর কি সত্যিই সেই বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত���র? নাকি সে কোনো নতুন পোস্ট-কলোনিয়াল, বাঙালি জেমস বন্ড? ‘রাজহংসীর সরোবর’ গল্পটি পড়তে যতই মজার হোক না কেন, তা মূল চরিত্রের সাহিত্যমূল্য বা তার অন্তর্গত জার্নির একধরনের বিকৃতি ঘটায়। বিভূতিভূষণ যেখানে শঙ্করের মাঝে প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক, ভাষাহীন ভালোবাসা আর মৃত্যুচেতনার আভাস রেখেছিলেন, সেখানে এই শঙ্কর অনেক বেশি হিরো-নির্ভর, আর কাহিনিভিত্তিক।
পুনরাবৃত্তি বনাম পুনর্পাঠ: পাঠকের মনস্তত্ত্বে শঙ্করের প্রত্যাবর্তন : ‘চাঁদের পাহাড়’-এর পাঠ এক পর্বতারোহণ নয়, বরং এক আত্মিক, সভ্যতা-সন্দিহান, কবি-চোখের মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ অন্বেষণের নামান্তর। সেই শঙ্কর যখন ফিরে আসে, তখন পাঠকের প্রত্যাশা স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র—সে ফিরে আসুক, কিন্তু তার সেই মেঘ, সেই শীতলতার সঙ্গে, সেই নির্জনতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার যন্ত্রণায়। পার্থ দে সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারেননি, তবে এক নতুন কল্পনা ও থ্রিলারের মেজাজে ভর করে নতুন পাঠের সূচনা করেছেন।
শেষ কথাঃ পাঠ ও প্রতিপাঠের সীমান্তে দাঁড়িয়ে : পার্থ দে-র ‘চাঁদের উপত্যকা’ পড়ার অভিজ্ঞতা এক দ্বৈতসত্তার মধ্য দিয়ে যায়—একদিকে বিভূতিভূষণের সাহিত্যে অভ্যস্ত, প্রকৃতি-ভেজা পাঠক মন একে খণ্ডিত বা অতিচাপানো বলে প্রতিক্রিয়া দেয়, অপরদিকে রোমাঞ্চের নতুন খোলা দরজা হিসেবে একে গ্রহণও করে। পাঠকের কাজ—উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধনের পথ খুঁজে বের করা।
এই বইটি কখনোই চাঁদের পাহাড় নয়—তবে সেই পাহাড়ের এক আধুনিক প্রতিচ্ছবি, যেখানে ছায়া ভিন্ন, আলো অন্যরকম, কিন্তু ভূমি সেই পুরোনো শঙ্করের স্মৃতি-ভেজা মাটি।