আজ থেকে বারো বছর আগে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনের প্রথম গল্প থেকেই নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন তরুণ গল্পকার বিনোদ।প্রচলিত গদ্যের ধারা বা ভাবনায় তার গল্প হাঁটেনি কোন দিন। শজ অথচ শানিত গদ্যে এবং অভিনব প্লটে অতি সহজেই পাঠকের ভেতরে ঢুকে পড়ে তার লেখা তারপর ইচ্ছেমত ফালাফালা করে দেয় পাঠকের গতানুগতিক বোধ, ভাবনাকে। বিনোদের গল্প সুখের নয়, বরং যন্ত্রনার। আলোর নয়, কালোর। মানুষের মনের অন্ধকারে যেসব ভূত বসে থাকে তাদেরকেই সটান রাস্তায় দিনের আলোতে বার করে আনেন তিনি। পাঠক আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ভাবতে বসেন। এই সংকলনের গল্পগুলিতে সেই অচেনা অন্ধকারের আব্রুহীন কথা
একটা বেশ্যা, শ্মশান আর দিদি ছায়াপথ মা, মেয়ে আর বাবার গল্প পিস্তল আর লোকটা কোনো ভয় নেই মাঝে মধ্যে হয় সাত নম্বর গেট সলমন খানের পরিবার 'সবিতা ভাবি' ও একটি ভিখিরি দেব আর কার্তিক নিরুদ্দেশ সম্পর্কে রামবাবুর আত্মহত্যা রহস্য প্রাণের খেলা শুভ, একটি মেয়েছেলে ও কয়েকটি মুক্তো কথোপকথন তর্পণ
বিনোদ ঘোষাল-এর জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ হুগলি জেলার কোন্নগরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যে স্নাতক। মফস্সলের মাঠঘাট, পুকুর জঙ্গল আর বন্ধুদের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা আর অভিনয়ের দিকে ঝোঁক। গ্রুপ থিয়েটারের কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। কর্মজীবন বিচিত্র। কখনও চায়ের গোডাউনের সুপারভাইজার, শিল্পপতির বাড়ির বাজারসরকার, কেয়ারটেকার বা বড়বাজারের গদিতে বসে হিসাবরক্ষক। কখনও প্রাইভেট টিউটর। বর্তমানে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ২০০৩ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্প। বৃহত্তর পাঠকের নজর কেড়েছিল। বাংলা ভাষায় প্রথম সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কার প্রাপক। ২০১৪ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার। তাঁর একাধিক ছোটগল্পের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়েছে।
" কালো মানে অন্ধকার আর অন্ধকার মানেই ভূত। মানুষের মনের অন্ধকারে অনেকরকম ভূত থাকে। সেই অন্যরকম ভূতেদের কালো কালো চেহারাগুলো পাঠক দেখতে পাবেন কালো গল্প। "
ব্লার্ব এ লেখা এই কয়েকটা কথাকে সার্থকভেবে প্রমান করেছেন লেখক। এক একটি গল্প পড়ার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে হয়েছে, একটানা পড়তে পারিনি। বিভিন্ন অনূভুতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। খারাপ লেগেছে, লজ্জা পেয়েছি, কান্না পেয়েছে, অসহায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। তবে সর্বোপরি এইসব গল্প এক আশ্চর্য সত্যের সামনে দাঁড় করিয়েছে, ভাবতে হয়েছে, বারবার ভাবতে বাধ্য করেছে।
"Darkness cannot drive out darkness; only light can do that." — Martin Luther King Jr.
কালো গল্প: অন্ধকারের অনুপলব্ধ আখ্যান:
বিনোদ ঘোষাল বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করেছেন তাঁর ব্যতিক্রমী লেখনশৈলী এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বিষয়বস্তুর জন্য। ‘কালো গল্প’ তাঁর এমনই একটি সংকলন যেখানে অন্ধকার, দ্বন্দ্ব ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মূল উপজীব্য। এই বই শুধুমাত্র গল্পের ধারায় আটকে নেই; এটি একধরনের আত্মবিশ্লেষণের ক্ষেত্র তৈরি করে পাঠকের জন্য।
এই অসামান্য সংকলনে স্থান পেয়েছে এই গল্পগুলি :
১. একটা বেশ্যা, শ্মশান আর দিদি ২. ছায়াপথ ৩. মা, মেয়ে আর বাবার গল্প ৪. পিস্তল আর লোকটা ৫. কোনো ভয় নেই ৬. মাঝে মধ্যে হয় ৭. সাত নম্বর গেট ৮. সলমন খানের পরিবার ৯. 'সবিতা ভাবি' ও একটি ভিখিরি ১০. দেব আর কার্তিক ১১. নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ১২.রামবাবুর আত্মহত্যা রহস্য ১৩. প্রাণের খেলা ১৪. শুভ, একটি মেয়েছেলে ও কয়েকটি মুক্তো ১৫. কথোপকথন ১৬. তর্পণ
"Every man is born as many men and dies as a single one." — Martin Heidegger
বিনোদ ঘোষালের ভাষার ব্যবহার কাব্যিক, কখনও বিমূর্ত, আবার কখনও বাস্তবতার কঠোর রূপ তুলে ধরে। ‘কালো গল্প’-এর প্রতিটি গল্পই মনে হয় যেন এক-একটি চিত্রকল্প, যেখানে ভাষার সংযম ও ব্যঞ্জনাবোধের মাধ্যমে গভীর মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা ধরা পড়ে। বিশেষ করে গল্পগুলোর বর্ণনা-ভঙ্গি পাঠককে চমৎকৃত করে।
"Hell is empty and all the devils are here." — William Shakespeare
‘কালো গল্প’-এর প্রতিটি গল্প অন্ধকারের বিভিন্ন স্তর নিয়ে গঠিত। এখানে অন্ধকার কেবল বাইরের নয়, বরং অন্তর্লীন এক সত্তা যা মানুষের গভীরে লুকিয়ে থাকে। গল্পগুলিতে পরাবাস্তবতা ও বাস্তবতার মিশ্রণ এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে পাঠক নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হন— আসল সত্য কী?
"We are each our own devil, and we make this world our hell." — Oscar Wilde
বিনোদ ঘোষালের গল্পের চরিত্ররা জটিল, বহুমাত্রিক। তারা কখনো আত্মদংশনের শিকার, কখনো সমাজের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানুষ। প্রতিটি চরিত্রই এক-একটি মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি, যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে।
"Fear is the mother of foresight." — Thomas Hardy
আলাদা করে ব;তে হবে প্রথম গল্পটি নিয়ে। গল্পের শিরোনাম 'একটা বেশ্যা, শ্মশান আর দিদি'! এটি একটি আখ্যান নয়, বরং সমাজের প্রান্তিক, অবহেলিত, এবং তথাকথিত ‘অশুচি’ চরিত্রদের এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিবেদন। গল্পের মূল কাঠামো সহজ, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত অর্থ ও ব্যঞ্জনা তীব্র, দগদগে। এটি এমন এক বাস্তবতার কথা বলে, যেখানে সভ্য সমাজের নিষ্ঠুরতা, শবসাধনার গোপন রূপ, এবং নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এক নির্মম চিত্র ফুটে ওঠে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক যৌনকর্মী, যার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে শ্মশান এবং এক অদ্ভুত সম্পর্কযুক্ত ‘দিদি’। যৌনকর্মীর জীবন যেমন সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, শ্মশানও তেমনই এক প্রান্তিক, পরিত্যক্ত স্থান—যেখানে শুধুমাত্র দাহকার্য সম্পন্ন হয়, জীবনের অস্তিত্ব সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। আর দিদির চরিত্র? তিনি কী সমাজের এক করুণ অথচ নিগূঢ় প্রতিচ্ছবি, নাকি অন্য কিছু? গল্পটি পাঠকের মনে এমন অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দেয়।
গল্পটি নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির গভীর অসঙ্গতি তুলে ধরে। একদিকে নারীর দেহ ভোগ্যপণ্য, অন্যদিকে সে ত্যাজ্য, ঘৃণার পাত্র। যৌনকর্মী ও শ্মশানের মধ্যে যে অদ্ভুত যোগসূত্র গল্পে তৈরি হয়, তা যেন সমাজের দ্বিচারিতার প্রতীক। আমরা শ্মশানে গিয়ে শবদেহের প্রতি যত্নশীল হই, কিন্তু জীবিত নারীর প্রতি ততটাই নির্মম আচরণ করি।
বিনোদ ঘোষালের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার নির্মোহ অথচ শৈল্পিক ভাষা। তিনি গল্পটিকে অতিরিক্ত সংবেদনশীল করে তোলার চেষ্টা করেন না, বরং কাঁচা বাস্তবতাকে সৎভাবে তুলে ধরেন। ভাষার সরলতা ও ক্ষুরধার রসবোধ গল্পকে আরও বেশি জীবন্ত করে তোলে।
গল্পের শ্মশান-বিবরণ নিছক বর্ণনা নয়; তা এক গভীর দার্শনিক প্রতীক। শ্মশান এখানে শুধুমাত্র মৃতদেহের গন্তব্যস্থল নয়, বরং সমাজের সেই অন্ধকার জায়গা, যেখানে অচ্ছুত, উপেক্ষিত, ও অস্বস্তিকর সত্য লুকিয়ে রাখা হয়। শ্মশানকে কেন্দ্র করে গল্পের নায়িকার যাপন-সংগ্রাম এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
এই গল্প শুধু একক চরিত্রের যন্ত্রণা নয়, এটি আমাদের সমাজের অবদমিত বাস্তবতার কথা বলে। যৌনকর্মী, শ্মশানকর্মী, এবং তথাকথিত ‘অচ্ছুত’ পেশার মানুষদের নিয়ে সমাজের যে নীরব নিষ্ঠুরতা, সেটিই গল্পের অন্তর্নিহিত বার্তা। সমাজের চোখে তারা অশুচি, কিন্তু মৃত্যুর মতো চূড়ান্ত সত্যের সঙ্গে তারাই সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
‘দিদি’ চরিত্রটি এই গল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে—কীভাবে সমাজ কিছু মানুষকে নিয়তির দোহাই দিয়ে বেঁধে ফেলে, অথচ তাদের অস্তিত্বকেই স্বীকার করতে চায় না? দিদির ভূমিকা যেন সমাজের সেই নির্লজ্জ স্ববিরোধিতার প্রকাশ, যেখানে একদিকে মানুষ ধর্মীয় বা সামাজিক বিশ্বাস নিয়ে চলে, অন্যদিকে একই বিশ্বাসের নামে কিছু মানুষকে নির্বাসিত করে।
গল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি এর অনবদ্য প্রতীকী কাঠামো। যৌনকর্মী, শ্মশান, এবং দিদির এই ত্রয়ী চরিত্র এমন এক জটিল সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা সমাজের প্রকৃত স্বরূপকে উন্মোচন করে। বিনোদ ঘোষাল এখানে কোনো চটকদার উপসংহার দেন না, বরং বাস্তবতার দরজা খুলে দেন, যেখানে পাঠক নিজেই তার অর্থ খুঁজে নেবে।
'একটা বেশ্যা, শ্মশান আর দিদি' গল্পটি সমাজের সেইসব চরিত্রের প্রতি আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করে, যাদের আমরা অস্বীকার করি, এড়িয়ে যাই, কিংবা কেবল প্রয়োজন ফুরোলে মনে করি। বিনোদ ঘোষালের লেখনী একদিকে বাস্তব, অন্যদিকে গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ, যা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী রেশ ফেলে। এটি কেবল একটি গল্প নয়, বরং আমাদের সমাজের এক নির্মম আয়না, যেখানে প্রতিফলিত হয় মানুষের দ্বিচারিতা, অবহেলা, এবং নির্দয় বাস্তবতা।
‘কালো গল্প’ পাঠের অভিজ্ঞতা এক অনন্য মনস্তাত্ত্বিক অভিযাত্রা। এটি শুধু বিনোদ ঘোষালের লেখনীর গভীরতা নয়, বরং পাঠকের চিন্তাভাবনার গতিপথও বদলে দিতে পারে।
‘কালো গল্প’ নিছক গল্প সংকলন নয়, এটি অন্ধকারের বিভিন্ন রূপের এক অন্তর্দৃষ্টি, যা পাঠককে নিজের ভিতরের দ্বন্দ্ব ও সমাজের অন্ধকার দিকগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করায়। এটি পাঠ করে মনে হবে, আলো আর অন্ধকারের মধ্যবর্তী সেই অস্পষ্ট রেখাটিই হয়তো আসল সত্য।
লেখকের যতগুলো গল্পের বই আজ পর্যন্ত পড়েছি ,উনার লেখনীর দ্বারা মুগ্ধ হয়েছি। "কালো গল্প" তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বিনোদবাবুর অন্যান্য ছোটগল্পের সংকলনের চেয়ে এটি যথেষ্ট স্বতন্ত্র। হরর , সাইকোলজিকাল থ্রিলারের যুগে মানুষের মনের আলো-অন্ধকার দিক নিয়ে নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে এমন একটি সংকলন গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।