সৌরভ মুখোপাধ্যায় যখন ছোটদের জন্য কলম ধরেন, তখন ছোটদের সঙ্গে তাদের বাবা-কাকা-ঠাম্মা-জেঠিমারাও হামলে পড়েন। হাসি-মজা-রহস্য-কল্পবিজ্ঞান-ভূত-অ্যাডভেঞ্চার কিংবা অশ্রুসজল অনুভূতির গল্প -সর্বত্র তাঁর অবাধ ও মসৃন বিচরণ। মধ্য-উনিশ শতকের পেরু ও কোকোস দ্বীপকে কেন্দ্র করে সৌরভ লিখেছেন এক হাড় হিম-করা দীর্ঘ কাহিনি –‘ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন’। ইতিহাস, কিংবদন্তী ও কল্পনার সীমা একাকার হয়ে গেছে এই গল্পে। পাঠকের শিরদাঁড়া টানটান রাখার যাবতীয় উপাদান এখানে মজুদ – সমুদ্র অভিযান, ষড়যন্ত্র, খুন, জলদস্যু, গুপ্তধন... ! তবু, আর পাঁচটা গড়পড়তা রোমাঞ্চ কাহিনির সঙ্গে এ আখ্যানের অনেক ফারাক। এ গল্প শেষ করার পর স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় করুণায়, আবেগে। সৌরভের তুরুপের তাস তাঁর বেগবান ঝলমলে ভাষার চৌম্বক শক্তি। তাঁর কলমের জাদু পাঠককে হাসাতে ও কাঁদাতে পারে লহমার মধ্যে। এই সংকলনে রয়েছে আরও নয়টি গল্প – লেখক ঘটিরাম, আবিষ্কারক ভেলকুনমামা, তান্ত্রিক করালী, পাখি-বিদ্বেষী খগেশচন্দ্র ও আরও নানান স্বাদের চরিত্র, বিচিত্র সব ঘটনার ঘনঘটা। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মায়াবি ক্যালাইডোস্কোপ
বছর চারেক আগে মিরচি বাংলার উপস্থাপনায় 'ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন' শুনে একরকম অভিভূত হয়ে গেছিলাম। সত্যি বলতে গুপ্তধন আর এরকম টানটান উত্তেজনায় ঠাসা অ্যাডভেঞ্চারই চিরকাল আগ্রহের কেন্দ্র দখল করে থাকে প্রত্যেকটা পাঠকের। আর তাই কিশোরকাল পেরিয়ে এলেও সৌরভ মুখোপাধ্যায় আমাকে কল্পনার সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল প্রায় দু দুটো ঘন্টা।
বইটিতে এই উপন্যাসিকাটা বাদেও আরো ৯টি গল্প আছে। প্রত্যেকটা গল্পই ভিন্ন স্বাদের। ভিন্ন মাত্রার। সৌরভ মুখোপাধ্যায় যে কিশোর সাহিত্যে অত্যন্ত শক্তিশালী একজন লেখক তার প্রমাণ এই ছোট্ট গল্পগুলো। ভেলকুনমামাকে নিয়ে যে ছোট্ট গল্পটা আছে ওটা পড়ে ভেলকুনমামার প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কিছুটা টেনিদা ধাঁচের মনে হলো। পুজোবার্ষিকীতে চোখে পড়লেও কখনো পড়ে দেখা হয়নি। এবার পড়তে হবে। মোটকথা সংগ্রহে রাখার মতো অসম্ভব সুন্দর এই বইটা প্রত্যেকটা পাঠকের যে ভীষণ ভালো লাগবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাহ! বাহ! বেশ লিখেছেন তো মুখার্জি মশাই। নিয়তি কি খণ্ডন করা যায়? যতই বুদ্ধি থাকুক কপালে যা আছে তা থেকে কি পালিয়ে বাঁচা যায়? মৃত্যু সামনে এসে দাড়ালে কি প্রচুর ধনসম্পদ কোনো আদৌ কোনো কাজে লাগে? কেউ সামান্য ভিখারি থেকে রাজা বনে যায় ভাগ্যের ফেরে। আবার কেউ এক রাজ্য ধনসম্পদ নিয়েও জীবনযাপন করে ভিখারির মত। কারন মানুষ সাময়িক ভাবে নিয়তির চাকা ঘোরাতে পারলেও বদলাতে পারেনা। পেরুর গির্জার অনন্য ধনরত্ন নিয়ে একটি সুরক্ষিত ও গোপন জায়গায় পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পায় ক্যাপ্টেন টমসন। যাত্রা শুরুর পর শুরু হয়ে যায় তার সুকৌশলে একে একে সব পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়ে ঐ বিশাল ধনভাণ্ডার এর মালিক হওয়ার খেলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভোগ করতে পারেন সেই সম্পদ? নাকি এত বুদ্ধিমান ক্যাপ্টেনকেও হার মানতে হয় নিয়তির কাছে?
বাংলায় এই সময়ের শক্তিশালী গদ্যকার-দের মধ্যে সৌরভ মুখোপাধ্যায় অন্যতম| তাঁর কলমে “দেশ”-এ ধারাবহিক ভাবে প্রকাশিত উপন্যাস ‘ধুলোখেলা’ (ও বেশ কিছু ছোটগল্প) পড়া, এবং তাঁর পরবর্তী লেখার জন্যে অপেক্ষায় থাকা পাঠকদের মধ্যে আমিও একজন| তবে আলোচ্য বইটি নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল দুটি কারণে: - ১. প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে লেখায় সিদ্ধিলাভ করা লেখক শিশু-কিশোরদের জন্যে গল্প লিখতে গিয়ে স্বখাত সলিলে মজেছেন, এমন নিদর্শন বাংলা সাহিত্যে অজস্র| সৌরভ সেই ফাঁদ এড়িয়ে উঠতে পারেন কি না, সেটা নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল| ২. ২০১৩-র পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ ছিল সৌরভ-এর লেখা উপন্যাস “মেঘ-ছেঁড়া রোদ”| ওই লেখাটির গুণমাণ এতটাই উঁচু ছিল যে ছোটগল্পে সেই মাণ ধারাবাহিকভাবে লেখক বজায় রাখতে পারলেন কি না, সেটাও আমি জানতে চেয়েছিলাম|
প্রথমে আসি বইটির উপস্থাপনার বিষয়ে| এই সুমুদ্রিত, সু-অলংকৃত সংকলনে কয়েকটি মুদ্রণ-প্রমাদ বড়ই দৃষ্টিকটু হয়ে দেখা দিয়েছে| আশা করা যায় যে পরবর্তী সংস্করণে এই সামান্য ত্রুটিটুকু সামলে নেওয়া যাবে|
এবার আসি গল্পের কথায়| প্রত্যেকটি গল্পের সার-সংক্ষেপ দিলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে| তাই আমি স্রেফ প্রত্যেক গল্পের প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছি| (১) ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন: পাক্ষিক আনন্দমেলায় প্রকাশিত এই বড়গল্পটি অনেক দিন আগে ‘দেব সাহিত্য কুটির’ থেকে প্রকাশিত লিজেন্ডারি সব পূজাবার্ষিকী-তে প্রকাশিত রোমাঞ্চকর গল্পদের মনে করিয়ে দিল| কিছু কিছু সমাপতন ও কষ্টকল্পনার ওপর নির্ভরশীল হলেও ‘নিয়তি’ আর “ক্রাইম ডাজ নট পে” প্রবাদের সার্থক গল্পরূপ একে বলা চলে| (২) খগেশচন্দ্রের খগাতঙ্ক: গল্পটি শুরু হয়েছিল চমৎকার ভাবে, কিন্তু কৌতুকরস-উৎপাদক উপাদানের প্রাচুর্য ঘটাতে গিয়ে লেখক গল্পের শেষটায় একটু “ছড়িয়ে” ফেলেছেন| তবুও, গল্পটি দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়েও মুচকি-মুচকি হাসতেই হবে| (৩) ভেলকুনমামার ভেলকি: টেনিদা-র গল্পের সার্থক উত্তরসূরী এই ‘টল টেল’-টি পড়তে দিব্যি লাগল| ভেলকুনমামা-র আরও অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষায় রইলাম| (৪) বিস্ফোরণের পরে: একটিও তথাকথিত প্রাপ্তবয়স্ক উপাদান না থাকলেও এই গল্পটিকে কোনমতেই প্রথাগত ‘ছোটদের’ গল্প বলা যায়না| কিন্তু আমি গল্পটিকে এই সংকলনে শামিল করার জন্যে লেখককে সাধুবাদ দেব, কারণ তিনি আজকের ছোটদের প্রাপ্তমনস্ক বাস্তব রূপটি ধরতে পেরেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে, আর তাই গল্পটি সংকলনে অসঙ্গত হয়নি| (৫) পরিতোষ মিত্তিরের ছুটি: এই গল্পটিও “বিস্ফোরণের পরে”-র মত এমন একটি বিষয় নিয়ে এগিয়েছে যা ছোটদের তুলনায় আমাদের মত ক্লান্ত চাকুরিজীবি-কেই বেশি আকৃষ্ট করবে| তাছাড়া গল্পটার শেষটাও প্রেডিক্টেবল-ই ছিল| এই গল্পটাকে পরের সংকলনে বাদ দেওয়া যায় কি না, লেখক ভেবে দেখতে পারেন| (৬) নগেন মল্লিকের দিব্যচক্ষু: পুরনো আইডিয়াকে একটা নতুন রূপে পরিবেশন করেছেন লেখক, কিছুটা অভিনবত্বও এসেছে তাতে| তবে আমার গল্পটা ভালো লাগল গল্পের গোড়ায় ভূতের গল্প লেখকের প্লটের অনটনের কথা পড়ে, কারণ মুখে-মুখে গল্প বানিয়ে লোকজনকে ভূতের গল্প শোনাতে গিয়ে আজকাল আমারও এই দুর্গতিই হয়! (৭) লাস্ট ট্রেনে রাত এগারোটায়: বেশ ভালো গল্প| যদিও এরও শেষটা আমাদের মত ভূত/অলৌকিক/ভয়/রোমাঞ্চ-বিষয়ক গল্প পড়ে বুড়িয়ে যাওয়া পাঠক ধরে ফেলবে আগে থেকেই, তবুও এই হালকা গা-ছমছমে গল্প পড়তে আজকের শিশু-কিশোরদের ভালোই লাগবে| (৮) সমঝদার: নির্মল হাসির এই গল্পটি ক্লাসিক শীর্ষেন্দু থেকে হালের উল্লাস মল্লিক, সবারই স্ট্যান্ডার্ড একটি ট্রোপ-কে অনুসরণ করলেও লেখকের পরিবেশনের গুণে সুপাঠ্য হয়েছে| (৯) অসুরারি-ডাক্তারের আসুরিক কাণ্ড: ছোট্টর মধ্যে বেশ ভালো গল্প| আর স্বীকার করেই ফেলা যাক, আমাদের গল্পের হিরোর মত এই রকম স্বপ্ন আমি আখ্ছার দেখি, তাই গল্পটার প্রতি একটু অন্যরকম অনুরাগ জন্মেই যাচ্ছে| (১০) মধুবাবুর পুজো: গল্প নয়, বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে দুর্গা পূজার আগে “স্মৃতির পুজো” বিষয়ক যে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়, এই লেখাটি সেই পর্যায়ের| মধুবাবু নাম নিয়ে লেখক তাঁর ফেলে আসা সময়টিকে আজকের ছোটদের চোখ দিয়ে আবার নতুন করে খুঁজে পেতে চেয়েছেন| তবে এই সংকলনে গল্প হিসেবে এটির উপস্থিতি অসঙ্গত ঠেকল|
সামগ্রিক বিচার: পরবর্তী সংকলনে (৫) আর (১০) নম্বর গল্পদুটোকে বাদ দিয়ে ভেলকুনমামার আরও দুটো “আবিষ্কারের” গল্প চাই| আর তার থেকেও বড় দাবি: আজকের ছোটদের জন্যে, এবং আমাদের মত মনের-দ��ক-থেকে পার্মানেন্ট অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে, আরও লিখুন সৌরভ|
আনন্দমেলাতে প্রথম পড়েছিলাম। ক্যাপ্টেন টমসনের ভয়ঙ্কর সমুদ্রযাত্রা। যেখানে শত্রু কোনো রাক্ষুসে হাঙর অথবা সামুদ্রিক ঝড় নয়। বরং এমন একটা জিনিস, যাকে আমরা প্রতিদিন মনের মধ্যে সযত্নে লালন পালন করি। এ এমনই মারাত্মক ভুল যা একবার বুমেরাং হয়ে উঠলে আর পালানোর পথ থাকেনা। লোভ এমনই একটা জিনিস। টমসন তার ফাঁদে পড়েছিল বলা যায়। একটা সময় তাকেই ভীষন ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। আবার সেই গল্পের শেষে টমসনের পরিণতি দুঃখ জোগাতে বাধ্য। সমুদ্র যাত্রার গল্প হিসেবে বেশ উপভোগ্যই বলা যায়। গুপ্তধন, জলদস্যু সব নিয়ে জমাটি কাহিনী। আর কিছু বললে স্পয়লার হয়ে যাবে তাই লেখনীতে নজর দেওয়া যাক। সৌরভ মুখোপাধ্যায় আমার অন্যতম প্রিয় লেখক। যার কারণ বোধহয়, সামান্য প্লটকেও তিনি শুধুমাত্র শব্দচয়ন, বাক্যগঠন আর লেখনীর গুণে বিরাট আকার দিতে পারেন। কিশোরদের জন্যে লেখা গল্পতেও থাকে তাঁর অসাধারণ বোধের পরিচয়। অনেক মানবিক গুণাবলী শেখা যায় তাঁর লেখার মাধ্যমে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভীষন উপভোগ্য এই পাঠ্য। সেইসঙ্গে প্রচ্ছদ শিল্পী প্রণব হাজরা মহাশয়ের নাম আনা জরুরী। বড্ড ভালো আঁকেন তিনি। তাঁর তুলির রেখায় টমসনের ভাগ্যলিপি ফুটে উঠেছে সুচারুভাবে।
অসাধারণ ট্র্যাজিক স্টোরি। আর সাথেই এক অনন্য উদাহরণ কর্ম ফলের প্রথম দিকে কাপটেন এর প্রতি ঘৃণা ভরে উঠে ছিল। কিন্তু শেষ ভাগে চোখের কোণে জল চলে আসলো। সাত রাজার ধন এর মালিক হয়েও কি কষ্টের মৃত্যু ভোগ করতে হলো। যেমন কর্ম তেমন ফল। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু ' এই গল্পটা এক সেরা উদাহরণ।
"লোভ" এমন এক অনুভূতি যার তাড়নায় মুহুর্তের মধ্যেই ভেঙে যায় মনুষ্যত্ব এর সকল বৈশিষ্ট্য। এর প্রতারণার বেড়াজালে আত্মা হয় যায় দূষিত। যার রেশ ছাড়েনা পিছু। "লোভ"এর তাড়নায় অনাচারের যে দরজা খুলে যায়, তা থেকে ধেয়ে আসা সেইসব অভিশাপের মরণ ছোবল মৃত্যুর আগ অবধি ভোগ করে যেতে হয়। অসাধারণ সুন্দর একটি গল্প। এই গল্প এক নাবিকের, যে হতে পারত সাহসী, দায়িত্বশীল একজন নাগরিক। কিন্তু তার "লোভ" তাকে নিয়ে যায় হিংস্রতার চরম মূর্তিতে। আর তার শেষ???????......
এই সংকলনে আছে কিশোরপাঠ্য দশটি গল্প । গল্পগুলি বেশীরভাগই সুন্দর, পড়তে বেশ ভালো লাগে । ‛ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন’ গল্পটি এই সংকলনের সবচেয়ে বড়ো এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সেরা গল্প । এছাড়াও ‛ভেলকুনমামার ভেলকি’, ‛লাস্ট ট্রেনে রাত এগারোটায়’, ‛সমঝদার’, ‛নগেন মল্লিকের দিব্যচক্ষু’ গল্পগুলিও বেশ ভালো ।
কিন্তু, এই সংকলনের ২/৩ টি গল্প আদৌ কিশোরপাঠ্য নয়, এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকে দেখলেও এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযোগী নয়... তবুও এই সংকলনে স্থান পেয়েছে এবং সুন্দর কিশোরপাঠ্য সংকলনটির মান একটু নিম্নমানের করেছে । ‛বিস্ফোরণের পরে’, ‛পরিতোষ মিত্তিরের ছুটি’ এবং ‛মধুবাবুর পুজো’ - এই গল্পগুলি কিশোরপাঠ্য বলে অন্তত আমার মনে হয় না ।
সৌরভ মুখোপাধ্যায় যখন ছোটদের জন্য কলম ধরেন, তখন ছোটদের সঙ্গে তাদের বাবা-কাকা-ঠাম্মা-জেঠিমারাও হামলে পড়েন। হাসি-মজা-রহস্য-কল্পবিজ্ঞান-ভূত-অ্যাডভেঞ্চার কিংবা অশ্রুসজল অনুভূতির গল্প -সর্বত্র তাঁর অবাধ ও মসৃন বিচরণ। মধ্য-উনিশ শতকের পেরু ও কোকোস দ্বীপকে কেন্দ্র করে সৌরভ লিখেছেন এক হাড় হিম-করা দীর্ঘ কাহিনি –‘ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন’। ইতিহাস, কিংবদন্তী ও কল্পনার সীমা একাকার হয়ে গেছে এই গল্পে। পাঠকের শিরদাঁড়া টানটান রাখার যাবতীয় উপাদান এখানে মজুদ – সমুদ্র অভিযান, ষড়যন্ত্র, খুন, জলদস্যু, গুপ্তধন... ! তবু, আর পাঁচটা গড়পড়তা রোমাঞ্চ কাহিনির সঙ্গে এ আখ্যানের অনেক ফারাক। এ গল্প শেষ করার পর স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় করুণায়, আবেগে। লেখকের উল্লেখযোগ্য রচনা, লেখক ঘটিরাম, আবিষ্কারক ভেলকুনমামা, তান্ত্রিক করালী, পাখি-বিদ্বেষী খগেশচন্দ্র বিস্ফোরণের পরে, পরিতোষ মিত্তিরের ছুটি, নগেন মল্লিকের দিব্যচক্ষু, লাস্ট ট্রেনে রাত এগারোটায়, সমঝদারইত্যাদি। সৌরভ মুখপাধ্যায়ের সহজ ও সরল ভঙ্গিতে লেখেন। তাঁর বই বারো থেকে আশি সব বয়সী পাঠক বুঝতে পারবে। ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করেন। প্রতিটি বাক্য যেন রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর। ওনার লেখা পড়ে আমার হতাশ হতে হয়নি। লেখক তাঁর লেখনির মাধ্যমে পাঠকে হাসাতেও জানেন আবার প্রোয়জনে কাঁদাতেও পারেন। এবার মূল গল্পে যাওয়া যাক। ১৮৮০ সালের এক সকালে গ্রীন অলিভ জাহাজ এসে ভিরেছে পেরুর লীমা শহরে। জাহাজের ক্যাপ্টেন টমসন। ক্যাপটেন টমসন জাহাজ নিয়ে অনেকদিন শহরের বাইরে ছিলেন। শহরে ফিরে এসেই ক্যাপ্টেন মদের নেশায় বুদ হয়ে রইলেন। দিনরাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা এবং পানীয় গ্রহণ ছাড়া আর কোন কাজ নেই। এভাবে অনেক দিন কাটিয়ে দিবেন লীমা শহরে। খাবেন, ঘুমাবেন, ফূর্তি করবেন এই যখন ক্যাপ্টেনের মনের ইচ্ছা, তখন ওপর মহল থেকে তাঁর ডাক পড়ল। হঠাৎ লীমা শহরের প্রধানদের থেকে ডাক আসাতে ক্যাপ্টেনের মনে কু ডাক ডাকতে লাগল। ক্যাপ্টেন পৌছালেন প্রধানদের কক্ষে। এবার তাঁর মনের ভয় দুম করে দিগুন হয়ে গেল। কারন সেখানে অপেক্ষা করছেন পেরুর প্রধান শাষক স্বয়ং পাকো ডায়োস এবং আরো চারজন শাষক। ক্যাপ্টেনকে বসতে বলে একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার গ্রীন অলিভ ঠিকঠাক আছে? ক্যাপ্টেন ভঁয়ে ভঁয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লেন। এবার অন্যজন বলে উঠলেন, আগামীকাল সকালেই আপনাকে দূরের যাত্রায় বের হতে হলে পারবেনতো? এবার ক্যাপ্টেন থতমত খেয়ে গেলেন। মাত্র দু সপ্তাহ হলো লীমায় এসেছেন। এক্ষনি তাকে বের হতে হবে? কিন্তু তারপরেই ক্যাপ্টেনের চোখে মুখে আনন্দের ছাপ দেখা গেল। এটা হয়তো কোন রাজকীয় কাজ। সুতারং এই কাজ করলে ভবিষ্যতে রাজ দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া এই কাজে কতখানি বিপদ আছে সে প্রশ্ন করেই বা লাভ কি। নাবিকের জীবনতো ঝড়ঝঞ্জার সাথেই মিশে একাকার হয়ে আছে। আর বেশি চিন্তা না করে ক্যাপ্টেন দূর পাল্লার যাত্রায় সম্মতি দিলেন। শুধু একটি প্রশ্ন কর��েন। কি যাচ্ছে তাঁর জাহাজে? এবার পাকো ডায়োস মুখ খুললেন। তিনি বললেন, আমাদের লিমা শহরের গির্জায় যত ধন সম্পদ আছে তা অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। আর এই গুরু দায়িত্ব তোমাকে পালন করতে হবে। এখানে একটু বলে নেই, লিমা শহরের গির্জায় যে সম্পদ আছে তা দিয়ে নাকি পুরো পৃথিবী কেনা যায়। এই শহরের আদিবাসীরা এগুলো সংগ্রহ করেছিল। সেখানে ছিল স্বর্নের বিশাল বিশাল মূর্তি। একদিন হঠাৎ এই শহরের শাষকেরা আদিবাসিদের সকল সম্পদ লিমার গির্জায় রাখার আদেশ দিলেন। আদিবাসিরা জানত বাধা দিলে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত। তাই কেউ বাধা দেয়নি। ধীরেধীরে আদিবাসিরা দল ভা��়ি করতে লাগলো। তাঁরা হামলা করবে লিমার গির্জায়। ফিরিয়ে নেবে তাঁদের সকল ঐশর্য্য। এ কথা জানতে পারে লিমা শহরের প্রধানেরা। তাই ক্যাপ্টেন টমসনকে দিয়ে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছে সকল সম্পদ। ক্যাপ্টেন টমসনকে গোপন রাস্তা দিয়ে জাহাজে পৌছে দেওয়া হলো খুব সতর্কতার সাথে। ক্যাপ্টেনকে হুশিয়ার করলেন, যদি এই যাত্রায় কোন রকম বিপদ হয় তাহলে তোমার শিরশ্ছেদ করা হবে। ক্যাপ্টেন জাহাজে পৌঁছালেন। সারারাত ধরে স্বর্ন দিয়ে জাহাজ বোঝাই করা হলো। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হলো লোক-লস্কর। সাথে আরো দুজন বিশেষ মন্ত্রী। তারাই পরিচলনা করবেন এই যাত্রা। ১৮ এপ্রিল ১৮২০। জাহাজ চলতে শুরু করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদ নিয়ে। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জাহাজ গ্রীন অলিভ। সারাদিন জাহাজ চলল। রাতে ক্যাপ্টেন মন্ত্রীদের কক্ষে প্রবেশ করলেন গল্প করার জন্য। সুযোগ বুঝে দুজনকেই হত্যা করলেন। এরপর নিখুত অভিনয় করে সবাইকে বোঝালেন তাঁরা নেশা করে একে অপরকে হত্যা করেছে। এভাবে একের পর এক মাঝীমাল্লাকে খুন করতে শুরু করলেন টমসন। কেউ বুঝতেও পারলো না কে কিভাবে এই খুন করে যাচ্ছে নিয়মিত। সমুদ্রের মাঝখানে কারো কিছুই করার রইল না। সবাইকে হত্যা করে টমসন জাহাজ নিয়ে একটি দ্বিপে পৌঁছালেন। এমন দ্বিপ বাছাই করলেন যেখানে কারো যাওয়ার সম্ভবনা নেই। টানা সাত দিন ধরে কাজ করে জাহাজ থেকে সকল সম্পদ দ্বিপে নামলেন। দ্বিপে একটি গর্ত আবিষ্কার করে সেখানেই সকল স্বর্ন লুকিয়ে রাখলেন। এবার জাহাজ মাঝ সমুদ্রে নিয়ে ডুবিয়ে দিলেন। নিজের জন্য একটি লাইফবোট ও কিছু খাবার ছাড়া আর কিছু নেই তাঁর কাছে। লাইফবোট নিয়ে সামনে এগোতেই পূর্ব ও পশ্চিম থেকে দুটি জাহাজের মাস্তুল দেখতে পেলেন টমসন। কোনটায় উটবেন তিনি? পূর্ব দিকের জাহাজের দিকে এগিয়ে গেলেন। এবার ভাগ্য সহায় হলোনা টমসনের। কারণ পূর্ব দিকের জাহাজটা জলদস্যুদের। টমসন নিখুত অভিনয় করে জলদস্যুদের গল্প শোনালেন। কিভাবে তাঁর জাহাজ ডুবি হলো। টমসন বললেন, আমি লিমা থেকে জাহাজ নিয়ে আসছিলাম। আমার জাহাজের নাম গ্রীন অলিভ। মাঝপথে ঝড় নামলে জাহাজ ডুবে যায়। আমার সকল লোকজন ঝড়ে মারা যায়। আমি এই লাইফবোটে করে কোন রকম বেঁচে আছি। জলদস্যুরা টমসনের সব কথা শোনার পরেও তাকে বিশ্বাস করলো না। অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রাখলো। টানা কয়েকদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন টমসন। তাই অন্ধকারেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙ্গলে জাহাজে গোলাগুলির আওয়াজ পেল। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অফিসার। জলদস্যুদের জম। সকল জলদস্যুর লাশ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। একজন অফিসার টমসনকে জলদস্যু ভেবে ধরে আনলো। টমসন কান্নাকাটি করে আবারো একই গল্প শোনালেন ব্রিটিশ সৈনিকদের। কিন্তু এবারো ভাগ্য সহায় হলোনা। তাঁরা টমসনকে বিশ্বাস করলো না। মেরে ফেলার আদেশ দিল। এবার টমসন কেঁদেকেটে সত্যি কথা বললো। সেই সাথে গুপ্ত ধনের সন্ধানের কথাও জানালো। গুপ্তধনের কথা শুনে টমসনকে বাচিয়ে রাখা হলো। সিধ্যান্ত হলো, গুপ্তধন পাওয়ার পরে তাকে মেরে ফেলা হবে। টমসনের হাত বেধে দ্বিপে নিয়ে যাওয়া হলো। এক্ষনই টমসনের সকল কষ্ট বৃথা হয়ে যাবে। এতগুলো হত্যা, এত কষ্ট, এত চালাকি, কিছুই কাজে লাগবে না? এত মুল্যবান সম্পদের মালিক হবে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিসরা? কিন্তু উপাও তো কিছু নেই। লুকিয়ে রাখা সম্পদের কাছে যেতেই বুদ্ধি খেলে গেল টমসনের মাথায়। পালিয়ে গেলেন ব্রিটিশদের হাত থেকে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে টমসনকে পাওয়া গেল না। সৈনিকরা চলে গেলেন। টমসন প্রাণে বেঁচে গেল। প্রাণে বাচলেও এখনো বড় সমস্যা রয়ে গেছে। এই দ্বিপ ছেড়ে সে যাবে কিভাবে? এখানে কস্মিনকালেও কোন জাহাজের টিকিটিরও দেখা মিলবে না। তাহলে কি এই সম্পদঘেরা গুহার স্বর্ণপুরিতেই টমসনের জীবন শেষ হয়ে যাবে? টমসন কি মুক্ত হতে পারবে এই জনশূন্য দ্বিপ থেকে? নিজের পুরনো দিনগুলো ফিরে পাবে? কেউ পাবে এই বিপুল সম্পদের খোঁজ? আরো কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। শেষ হইয়াও যেন হইলো না শেষ। ক্যাপ্টেন টমসন একা কিভাবে দুই মন্ত্রীকে বোকা বানিয়ে হত্যা করলেন? কিভাবে কোন সারা শব্দ না করে একে একে জাহাজের সবাইকে হত্যা করলেন? আদিবাসিদের কাছে এত সম্পদ এল কিভাবে? ক্যাপ্টেন টমসন কি শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ফিরতে পেরেছিলেন নিজের দেশে? এই সব জানতে হলে পড়তে হবে ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন বইটি। বইটি পড়ে আমি বুঝতে পারলাম- কার নিয়তিতে কি আছে তা কারো জানা নেই। মানুষের নিয়তি মানুষ নিজে তৈরি করতে পারেনা। সব কিছুর একটা সাম্যাবস্থা আছে। কেন আমি এই কথা বলছি তা বইটি পড়ার পরে পাঠক নিশ্চই বুঝতে পারবেন। ইতিহাস ঘেটে অনেক গুপধনের রহস্য উদঘাটন হয়েছে। সেখানে কেউ কেউ গুপ্তধনের হদিস পেয়েছে, কেউ পায়নি। আবার কেউবা চাঁদের পাহাড়ের সংকরের মতো পেয়েও চিনতে পারে নি। ক্যাপ্টেন টমসনের গুপ্তধন গল্পে জানতে পারবেন তাঁর নিয়তিতে কি লেখা ছিল।
কাহিনীর শুরু হয় একটি জাহাজে করে একটি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ অন্য কোনো সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে। সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন টমসন। এই নিয়েই মূলত কাহিনী সামনের দিকে এগোতে থাকে আর গল্পের শেষ হয় একটা ট্রাজেডি দিয়ে।
আপনি গল্পটি পড়তে পারেন যদি আপনি অ্যাডভেঞ্চার লাভার হয়ে থাকেন। অসাধারণ একটি গল্প।
অসাধারণ একটি গল্প.. শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রহস্য ভরপুর.. ★পেরুর লিমা গীর্জার বিশাল স্বর্ণভান্ডার ★Green Olive জাহাজের দুঃসহ স্মৃতি ★লোভী নাবিকের করুন পরিস্থিতি ★পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায় এল.ডো.রাডোর সন্ধান..
বাংলা সাহিত্যে যে এরকম এডভেঞ্চারও লেখা হয়েছে তা এই গল্প না পড়লে হয়তো জানতেই পারতাম না। এরকম গুপ্তধন, জাহাজ নিয়ে গল্প বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা দেখাও যায় না। সত্যিই সৌরভ মুখার্জির জবাব নেই। এরকম সুন্দর একটা গল্প উপহার দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ। ক্যাপ্টেন টমসনের শেষ পরিণতিটাও ছিল শোচনীয় একদম।