১৯৭১। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কালো ছায়ায় দুই সম্পর্কহীন পথিক এক বিপন্ন যাত্রায় এগিয়ে চলে। একজন মাঝবয়সি, যার অভিজ্ঞ কাঁধে ইতিহাসের ভার, আর এক কিশোর, যে ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। দখলদার বাহিনীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে, অচেনা পথের ধুলো জড়াল দু’জনের পায়ে। সফরই গড়ে তুলল এক অনিশ্চিত সঙ্গ, সহযাত্রার টানে শুরু হলো পথচলা—নদী, বন, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে—অন্যের ঘর থেকে পরের শিবিরে। “সফরনামা” শুধু দুঃসময়ের দলিল নয়, বরং এমন এক সময়ের সাক্ষ্য যেখানে মানুষের সম্পর্ক, প্রতীক্ষা আর আশার মধ্যে বোনা হয় বেঁচে থাকার নতুন সংলাপ।
মুক্তিযুদ্ধের কঠিন এবং টালমাটাল সময়টায় রইস চুরি করতে ঢুকল এলাকার সবচেয়ে খতরনাক রাজাকারের বাড়িতে। তাকে বন্দী করা হলেও, জানে মেরে ফেলল না গ্যাদা রাজাকার। জানের বিনিময়ে একটা কাজ করে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো তাকে। বন্দিশালায় পরিচয় হওয়া পিচ্চি কিশোর লাবুকে নিয়ে সেই কাজ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল রইস। তাদের যাত্রাপথের বিভিন্ন ঘটনার মাঝেই সেই যুদ্ধের সময়টাকে এই বইতে তুলে এনেছেন লেখক সিদ্দিক আহমেদ।
চব্বিশের জুলাইয়ের আন্দোলন আমার কাছে স্বাধীন হবার আন্দোলন। তবে এর মানে এই নয় যে একাত্তরের ভূমিকা মোটেও কমে যাবে। ৭১ এ আমাদেরকে মেরেছে ভীন দেশের শাসক আর ২৪ এ এসে মেরেছে নিজ দেশের শাসক। ৭১ আমাদেরকে দিয়েছে স্বাধীন একটা ভূখণ্ড। ২৪ দিয়েছে সেই ভূখন্ডকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার উপলক্ষ্য। আমি জানি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপারটাকে রীতিমতো পঁচিয়ে ফেলেছে আওয়ামীলীগ। তবে এর মানে এই নয় যে ৭১ কে বাদ দিতে হবে বা অস্বীকার করতে হবে। ৭১ এর মহিমা সবসময়েই সবকিছুর উর্ধে থাকবে। আর এই বইটার ভূমিকায় লেখকও ঠিক একই কথা বলেছেন। যে বা যারা ২৪কে মহিমান্বিত করতে গিয়ে ৭১কে ছোট করার চেষ্টা করছেন তাদেরকে ৭১ এর ভয়াবহতা নতুন করে মনে করিয়ে দিতেই এই বই লেখা।
মোটাদাগে বইটাকে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতিতে দুই অসম বয়সীর অ্যাডভেঞ্চার বলা যেতে পারে। এক ক্যাম্পের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে, পদে পদে বিভিন্ন রকমের বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে তারা তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে। তাদের এই চলার পথেই ধীরে ধীরে লেখক এই দুই চরিত্রকে ভালোভাবে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। দুজনের সম্পর্কের রসায়নটাকেও আস্তে আস্তে জমিয়ে তুলেন।
যাত্রা পথের শুরুতে এক নৌকার ভ্রমণ, এরপর আবার রাজাকারের বাড়িতে ফেরা, সেখান থেকে মুরগী চুরি করা কিংবা ধানকৈতরের মাংস খাওয়া, বিহারীদের হাতে ধরা পড়া, কোনোমতে বেঁচে ফেরা, ক্যাম্পে ঢুকা, এবং সেখান থেকে ফিরেও আসা; এরকম বেশকিছু ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এগিয়ে চলে বইয়ের গল্প। যে কারনে একটানা পড়ে যাওয়া যায়, কোথাও স্লো বা বোরিং লাগে না। মানে ক্রমাগত কিছু না কিছু ঘটছেই গল্পে। এই যে এতগুলা সিকুয়েন্সের কথা বললাম এর প্রতিটার সাথেই মিশে আছে পাকিস্তানি বা রাজাকারদের নিষ্ঠুর বর্বরতার বর্ণনা। যদিও আগে থেকেই জানি ওই সময়ের নৃশংসতা সম্পর্কে, তবুও প্রতিটা বর্ণনা পড়ার সময় নতুন করে শিউরে উঠেছি। বিশেষ করে সীমান্তের জায়গাটার অংশটুকু প্রচণ্ড রকমের মন খারাপ করে দিয়েছিল।
তবে লেখক একটা ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন বইটাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশ হালকা চালের কথোপকথন এবং রসিকতা রেখেছেন। যে কারনে এ ধরণের বই পড়তে গেলে যে দমবন্ধ করা অনুভূতি হয় সেটা হয়নি। যুদ্ধ কিংবা শত মৃত্যুর মাঝেও মানুষকে খেতে হয়, হাসতে হয় এই সত্যটা তুলে এনেছেন লেখক।
বইয়ের শেষের দিকের যে টুইস্ট তা কিছুটা অনুমানযোগ্য হলেও 'পরিচয়' দিয়ে ঠিকই ঘোল খাইয়েছেন লেখক। আর একদম শেষে আছে ক্যাম্পের যুদ্ধের বর্ণনা। আমি সবসময়েই সিদ্দিক ভাইয়ের গল্পের একশন দৃশ্যের ভক্ত। এই বইটাতেও উনি সেই দক্ষতাটা দেখিয়েছেন চমৎকারভাবে। আর বরবরের মতোই লেখকের গদ্যশৈলী ছিল দূর্দান্ত। গ্রাম্য ভাষার কথোপকথন একদম পারফেক্টলি উপস্থাপন করেছেন এখানে।
ব্যক্তিগত রেটিং: ০৭/১০ (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখা যারা পড়তে পছন্দ করেন তাদের ভালো লাগবে। খুব সিরিয়াস টোনের গল্প না, আবার একেবারে হালকা ধাঁচেরও না।)
প্রোডাকশন: প্রথমেই বলতে এর প্রচ্ছদের কথা। এক কথায় চমৎকার একটা প্রচ্ছদ। বাঁধাই বা অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঠিকঠাক আছে। প্রুফ রিডিং এ আরেকটু সময় দিলে ভালো হতো। বেশ অনেক টাইপো চোখে পড়েছে। দু এক জায়গায় পড়তে কিছুটা অসুবিধাও হয়েছে যে কারনে।
নদীর পাড়ে বাবার লাশ খুঁজতে গিয়ে রাজকারের হাতে ধরা পড়ে লাবু। বারো বছরের বালক সে। রাজাকারের টর্চার সেলে দেখা হয় রইসের সাথে। নিজেকে চোর বলে পরিচয় দেয় রইস। আর তারপরই রাজকার কমান্ডার গ্যাদা তাকে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে গরু চুরি করতে বলে। রইস সাথে নেয় লাবুকে।
সিদ্দিক আহমেদের এই উপন্যাসের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের খুলনা। নানা বাধা বিপত্তি পার করে লাবু আর রইস কেমন করে টিকে থাকে সেই গল্প। সঙ্গে আছে পাক আর্মি, রাজাকারদের অত্যাচারের চিত্র। শেষের দিকে দীর্ঘ একটা সম্মুখ সমরের বর্ণনাম চিত্রনাট্যকার বলেই হয়ত খুবই স্পষ্ট একেকটা দৃশ্য।
সফরনামা। যে সফরে উঠে এসেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য চিত্র। দুই মেরুর দুইজন মানুষ; লাবু নামক এক কিশোর যে তার প্রিয়জনের লা*শ খুঁজতে এসে ধরা পড়ে রাজাকারের হাতে, রইস চোরা যে রাজাকাদের দলনেতা গ্যাদা রাজাকারের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা খায়। দুজনকে একই সূত্রে এনে গেঁথে দেয় গ্যাদা রাজাকারের দল। রইস চোরা মায়ের শেষ চিহ্ন আংটিটা পেতে গ্যাদা রাজাকারের দেওয়া শর্ত মেনে নেয় সাথে বাঁচিয়ে ফেলে লাবুকেও। শর্ত হচ্ছে গ্যাদা রাজাকারের মেয়ের বিয়ের জন্য ক্যাম্প থেকে গরু চুরি করে আনতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের জন্য শুরু হয় দুইজনের এক অভূতপূর্ব যাত্রা। সম্পর্কহীন দুই পথিক যাত্রা করে গ্রাম থেকে গ্রামে, নদী ধরে যাওয়া, কোনো কোনো সময় থেমে পেটের ক্ষিদা নামক দানবকে কিভাবে শান্ত করবে তা নিয়ে করে পরিকল্পনা। যাত্রায় দেখা হয় মাঝি, শতচ্ছিন্ন হওয়া লা*শ, শরণার্থী, পাকিস্থানি মিলিটারি, মুক্তিযোদ্ধা সহ আরো অনেকের কাছে। একেকজনের সাথে একেক অভিজ্ঞতায় দুজনই যেন দেখিয়ে চলেছে সবাইকে যুদ্ধের সেইসব দৃশ্য। পাক সেনা আর রাজকারের উৎপাতে দুজনের নাকানিচুবানি খাওয়ার মত অবস্থা হলেও তারা এগিয়ে চলে।
এইতো গেল বইটার গল্প কী তা নিয়ে আলাপ। এবার আসি গল্পের দুই প্রধান চরিত্র নিয়ে কিছু বলতে। রইস মিয়া আর লাবুর এই যাত্রায় রইসের কাণ্ডকারখানা দেখে হেসেছি অনেক। সহজ সরল এই খানদানী চোরের সাথে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলা লাবুর মত কিশোরের সম্পর্কের টানাটানি, খুনসুটি সবকিছু মুগ্ধ করেছে আমাকে। লাবু সুযোগ পেলেই রইস মিয়াকে খোঁচা মেরে তার খানদানী টাইটেলকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। রইস মিয়াও লাবুকে স্নেহ করে আগলে রাখে এই দুর্গম যাত্রায় মজার ছলে।হাসি তামশা করলেও যখন প্রয়োজন হতো তখন সে পরে নিত তার কাঠিন্যের মুখোশ। লাবুর সবকিছু পাঠকের সামনে তুলে দিলেও রইসের লেয়ারড চরিত্রটাকে ধোঁয়াশার মাঝে রাখেন লেখক। তাদের কার্যক্রমে কখনও উত্তেজনার পারদ শিখরে থাকে, কখনও মেলে দেয় দুঃখের ডানা আবার কখনও ফুঁসিয়ে তুলেছে পাক সেনার বিরুদ্ধে ঘৃণা। শেষের দিকে এতো ব���় একটা ধুন্দুমার ক্লাইমেক্স বইটাকে নিয়ে গেছে আরো উচ্চ পর্যায়ে। বাড়তি কিছু না এনে অনবদ্য এক যুদ্ধ দেখিয়েছেন লেখক। দুপক্ষ সমান তালে লড়ে গিয়েছে সেখানে।
যারা যুদ্ধে অংশ নেয় নি তাদেরও আখ্যান এই গল্পে উঠে এসেছে। পেটের দায়ে ডাকাতি থেকে শুরু করে পাক সেনার ভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া মানু্ষের অবস্থা,বৃদ্ধার সামনে ভেসে উঠা তার পরিবারের পরিণতি সবই উঠে এসেছে এই যাত্রায়। বইটাতে যুদ্ধ নিয়ে অনেক মতাদর্শ ফুটে উঠেছে রইস আর লাবুর কথা দিয়ে। যা আপনাকে ভাবাতে পারে কিছু সময়। মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পে একটা জায়গায় স্থান পেয়েছে বিহারিরাও। বাঙালি বিহারী দাঙ্গার প্রভাব সেসময় কেমন ছিল তাও দেখা যায় বইয়ে। কিছু কিছু জায়গায় রইস আর লাবুর বেচে যাওয়াটা কাকতালীয়। হয়তো সেটা অতিরঞ্জিত লাগতে পারে। বইয়ে কিছু উর্দু সংলাপও আছে। তবে যাদের বুঝতে অসুবিধা তারা রইস আর লাবুর মাধ্যমেই তা বুঝে নিতে পারবেন অনায়াসে।
' ছায়ামানব' ছাড়া সিদ্দিক আহমেদের সকল বই আমার পড়া। এই বইটা যখন ঘোষণা আসে তখন চোখ বন্ধ করে নিয়ে ফেলেছি। সিদ্দিক আহমেদ যা লিখে যান তা সবই চোখের সামনে ভেসে উঠে। প্রকৃতির বর্ণনা গুলো বেশি জীবন্ত মনে হয়েছে। সাবলিল লেখায় পাতার পর পাতা পড়ে গিয়েছি অনায়াসে। বইয়ে কিছু শব্দগুলো ভেঙে গিয়েছে সেটাপের সময়। আশা করি সামনের এডিশনে তা ঠিক হয়ে যাবে। সবশেষে বললে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা এই বইটার রেশ অনেক দিন থেকে যাবে। রইস আর লাবুকে মনে পড়বে সফরনামার নাম যতদিন দেখা হবে।
১৯৭১ সাল! সময়টা বাংলাদেশের মাটিতে নানান ঘটনার সাক্ষী। শুধু যে যুদ্ধের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিল, এমন তো নাও হতে পারে। টুকরো টুকরো ইতিহাসের পাশাপাশি কিছু মানুষের জীবনের গল্পও হয়তো বলতে চায়। কত ঘটনার সাক্ষী হতে চায় সময়টা! যা ইতিহাসের পাতায় জায়গা পায় না, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো মানুষের জীবনে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।
এই যেমন রইসের কথাই ধরা যাক। একাত্তরের সেই সময়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। বাঁচার তাগিদে চুরি, ডাকাতির মতো ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকে। পেটকে শান্ত করতে না পারলে জীবনের মূল্য আর কীসে থাকবে?
রইস জাতে চোর। তিনদিন না খাওয়া রইস তাই চুরি করতে একটি বাড়িতে ঢুকে। চুরি করবি তো কর, একেবারে সিংহের গুহায়! গ্যাদা রাজাকারের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বাঁচার উপায় কি আসলে আছে? ধরা পড়লে তাই নির্যাতন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় রইসকে।
ধরা পড়ে লাবু নামের ছেলেটাও। তার ধরা পড়ার কারণ অবশ্য ভিন্ন। চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দিশেহারা পাকিস্তান আর্মি। কিছুটা ভয় তো আছেই। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইলিয়াস আর তার ডান হাত মোসলেমের ভয়ে রাজাকাররাও তঠস্থ। এই অবস্থায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানুষজন ধরে এনে গণহ ত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে পাকিস্তান আর্মি।
এখানে ছিল লাবুও পরিচিত কেউ। যাকে খুঁজতে বা যার লাশ খুঁজতে নদী পেরিয়ে ছুটে আসে। সারি সারি লাশের মধ্য থেকে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে গিয়েই রাজাকার বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। এবং জায়গা হয়, সেই রাজাকারদের নির্যাতন কক্ষে। যেখানে পরিচয় হয় রইস নামের অদ্ভুত এক মানুষের সাথে, যার মানসিকতা বোঝার সাধ্য লাবুর থাকে না। একবার মনে হয় স্বার্থপর, আবার কখনও মানবিক! কখনও সহজ বিষয়টি না বোঝা কোনো জটিল চরিত্র। কে এই রইস? আসলেই কি চোর?
তখন ডিসেম্বর মাস। যুদ্ধের দামামার অন্তিম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় বিমান লিফলেট বিলি করার মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের বার্তা দিচ্ছে। তারই মধ্যে রইস আর লাবু ছুটছে বিশেষ এক কাজে। যেখানে রইসের পেশার এক গুরুত্বপুর্ণ অবদান আছে। পাকিস্তান আর্মির যে মেজর সাহেব অত্র এলাকার দায়িত্বে, তার অদ্ভুত একটা গুণ আছে। সে গরুর মাংস আহার করলেই তার জাত, রান্নার সময় বা প্রক্রিয়া বলে দিতে পারে। গরুর প্রতি এই প্রেমের কারণে সে নির্দেশ দিয়েছে এই অঞ্চলের যত গরু আছে, সব তার ক্যাম্পে দিয়ে আসতে হবে। কোনো গরু গ্রামে গ্রামে থাকা যাবে না। কথার অমান্য হলে, কঠিন শাস্তি।
কিন্তু এই সময়টাতেই গ্যাদা রাজাকারের মেয়ের বিয়ে। পাত্র আলবদর কমান্ডার। মেয়ের বিয়েতে গরু না রান্না করলে হয়? তাই রইসকে তার পেশার মাধ্যমেই গরু চুরি করে আনতে হবে। তাও সেই ক্যাম্প থেকে। নাহলে যে বিশেষ আংটি তার কাছে পাওয়া গিয়েছে, সেটা ফেরত পাওয়া যাবে না। এই আংটি একটা দায়িত্ব, এই দায়িত্বে অবহেলা রইস করতে পারে না।
বেঁচে থাকার একটা সুযোগ। সেই সুযোগ লুফে নিতে দ্বিধা করেনি রইস। সঙ্গী করে নিয়েছে লাবুকেও। গ্রামের পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে কত কিছুর সাক্ষী হতে হচ্ছে, কত বিভৎসতা দেখতে হচ্ছে! ইতিহাস সেসব ভয়ংকর সময়কে ধরে রাখতে পারে, আবার না-ও রাখতে পারে। তাই বলে ইতিহাসের এহেন বর্বরতা কি মুছে যায়?
শেষে একটা প্রশ্ন, কতটা সফল হবে রইস? কী আছে সেই আংটিতে, যার জন্য রাজাকারদের কথা শুনতে হচ্ছে? এতকিছুর সাক্ষী হওয়ার পরও রাজাকারকে সাহায্য করার মতো অমানবিক কেউ হতে পারে? লাবু তো সহ্য করতে পারে না। রইস পারছে কীভাবে?
◾পাঠ প্রতিক্রিয়া :
“সফরনামা” একটি যাত্রা, যে যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত সাক্ষ্য দিবে একাত্তরের। যেখানে গভীর আবেগ মিশে আছে, আছে প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতার নিদর্শন হয়ে ওঠা সময়টা জানান দেয় রাজাকারদের ভয়ংকর রূপের। তবে “সফরনামা” উপন্যাসকে মোটা দাগে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলা যায় না। কেননা এই গল্পে মুক্তিযুদ্ধ আছে ঠিকই, কিন্তু এর বাইরেও আছে মানুষের জীবনের এক যাত্রা।
মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টায় কেবল মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। অনেক মানুষের জীবন বদলে গিয়েছে। পেটের দায়ে ডাকাতির পথ বেছে নিতে হয়েছে অনেককে। শত্রু মনে করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী একগ্রাম পুরুষ নিধনের মতন ঘটনা ঘটিয়েছে। তখন সেই গ্রামের নারীদের কী হয়েছে? হয়তো যুবতী কাউকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। তারপর কী হতে পারে, বলার প্রয়োজন নেই বোধহয়। বাকিরা? তাদের তো বেঁচে থাকতে হবে।
রইস আর লাবুর এই যাত্রায় সেই চিত্রটি উঠে এসে। প্রতিটি পথ ছিল উৎকণ্ঠার। কারণ এই সময়টা শত্রু-মিত্র বোঝা খুব দায়। রাজাকার বাহিনী যেমন সবাইকে মুক্তিবাহিনী মনে করে, তেমন করে মুক্তিবাহিনীর কাছেও অনেকে রাজাকারের চর হতে পারে। এই সময়টাই এমন কঠিন। তার মধ্যে দিয়ে এক অসম্ভব প্রায় মিশনে যাত্রা, যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়।
আপাত দৃষ্টিতে এই মিশন মনে হতে পারে খুবই সিলি একটা বিষয়। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে যে ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, পরবর্তীতে যে পরিণতি ও কর্মপন্থা; তাতে মনে হয়েছে সব কাজেরই একটা লক্ষ্য থাকে। আর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যখন কেউ এগিয়ে যায়, তখন ভাগ্য তার সাথে সঙ্গ দেয়।
রইস ও লাবুর ভাগ্য অনেক ক্ষেত্রেই ভালো। অনেকবার ওরা কাকতালীয়ভাবে বেঁচে গিয়েছে। এটা হয়তো কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু কথায় আছে, “Fortune favours the braves”। আর যারা সাহসী, কোনো কিছুকে ভয় করে না; তাদের ভাগ্যই তো তাদের পাশে থাকবে। এখানে মানুষের অনুভূতি ও দর্শনের কথাও কিছু এসেছে। ঠিক দর্শন না, যুদ্ধ মানুষকে বদলে দেয়। তখন এক মনে একাধিক অনুভূতি খেলা করে। এই অনুভূতিগুলো হয়তো দর্শনের মতো করে বেড়িয়ে আসে। যা নিরেট বাস্তব, সত্যটা হিসেবে ধরা দেয়।
রাজাকার, মুক্তিবাহিনী, পাকিস্তান আর্মির পাশাপাশি বিহারীদের কথাও এখানে বলা হয়েছে। বাঙালি, বিহারী দাঙ্গা তো প্রকাশ্য। এতে একে অপরের শত্রুতা জ্ঞান করা দুই পক্ষ যখন মুখোমুখি হয়, তখন কি ছেড়ে কথা বলার সুযোগ থাকে। তবুও নির্মমতার মাঝে কেউ কেউ মনুষ্যত্বের বীজ বোনে। যুদ্ধের সে সময়টায় বিপদে পড়া সকল মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভাতৃতবোধের সম্পর্ক স্থাপন হয়। সবাই তো নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। সবার মধ্যেই এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে। এমন অবস্থায় এক অপরের পাশে থাকতে পারলে সাহসও সঞ্চয় হয়। কিন্তু এই আপন ভেবে নেওয়া, কিছু সময়ের সম্পর্ক পরে হাহাকারের জন্ম দেয়।
সিদ্দিক আহমেদের লেখার ক্ষেত্রে একটা কথাই বলব, তিনি যা লিখেন সেটা চোখের সামনে ফুটে উঠে। হয়তো তিনি চিত্রনাট্যকার বলেই সবকিছু সেই আদলে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। পড়তে গেলে মনে হয়, চোখের সামনে সবকিছু দেখছি। অনুভূতিগুলো যেন মনের সাথে মিশে যায়। সিদ্দিক আহমেদের লেখা এমনিতেই সাবলীল। গতির ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে লাগাম ধরতে পারেন। যখন গতির স্রোত বেড়ে যায়, তখন সেই গতিশীলতা কমিয়ে দেন। পাঠক এখানে কাহিনির সাথে নিজেকে অনুভব করে, একটু হলেও শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
লেখক এখানে খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকে বর্ণনা করেছেন। সংলাপের ক্ষেত্রে খুলনার আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এই বিষয়টা ভালো লেগেছে। পড়তে মজা পেয়েছে। আর খুব সচেতনভাবে যে সংলাপকে লেখক চরিত্রগুলোর মধ্যে অনুভব করার সুযোগ দিয়েছেন, এক জায়গায়ও তা ছেড়ে যায়নি। বেশ ভালো অনুভূতি হয়েছে। আবার গণহত্যার যে ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে শিউরে না উঠেও উপায় নেই। যুদ্ধ এলেই মানুষের জীবন ঠুনকো হয়ে পড়ে।
আমি সময়কাল নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম। কেননা লেখক বারবার বলছিলেন সময়টা শীতকাল। তাহলে সময়টা অবশ্যই ডিসেম্বর হবে। কিন্তু কোথাও সেই বিষয় লেখা নেই। তবে পরবর্তীতে ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে সেই সময়কাল বুঝিয়ে দিয়েছেন বেশ ভালোভাবেই।
তবে দুর্দান্ত লেগেছে শেষ সময়ের মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা। এত জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ঘটনাবলী। মনে হচ্ছিল আমিও শামিল হয়ে পড়েছি সেই সময়ে। এখানে লেখক যুদ্ধের কৌশলগত যে পরিস্থিতি বয়ান করেছেন, এখানে লেখকের তারিফ করতেই হয়। অন্যবদ্য! কোথাও অতিরঞ্জিত বিষয় নেই। দুইপক্ষ সমানে সমানে পড়ছে যাদের বুদ্ধি দিয়ে। কোণঠাসা করে ফেলছে সবকিছু। আবার পরক্ষণেই বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। এমন এক অবস্থা, যেখানে এক মুহূর্তের অমনোযোগ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
◾চরিত্র :
গল্পের প্রধান চরিত্র রইস ও লাবু। এই দুইজনের যাত্রা আমার ভালো লেগেছে। দুই অসম বয়সী মানুষের ভিন্ন অভিজ্ঞতা। তাদের এই যাত্রাপথে খুনসুঁটি, কিছু হাসি তামাশা যেন সিরিয়াস মুহূর্তে গল্পে প্রাণ দিয়েছিল।
রইস চরিত্রটি এমনিতে হাসি তামাশা করা যুবক। তবে যখন প্রয়োজন হয়, তখন অবয়বে কাঠিন্য ভর করে। তাকে আমার বেশ মনে ধরেছে। এক ধরনের দৃঢ়তা আছে চরিত্রের মধ্যে। সাথে লাবুর সংযুক্ত রইস চরিত্রটিকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। লাবুর একটু পরপর রইসকে খোঁচা দেওয়া, সেই সাথে রইসের প্রত্যুত্তর বইটির আকর্ষণীয় দিক। সিরিয়াস সময়কালে হাসি আনন্দ না থাকলে বেঁচে থাকার যে ইচ্ছা সেটাই থাকবে না।
লাবুর চরিত্রকে লেখক আগেই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তার অতীত, পরিণতি, কেন সে এখানে; সেই বিষয়ে আগেই জানান দিয়েছেন। কিন্তু রইস যেন শুরু থেকেই আড়ালে। তার বিষয়ে লেখক ধোঁয়াশা রাখতেই বোধহয় পছন্দ করেছেন। তবে সেই ধোঁয়াশা না রাখলে শেষ সময়ে রইসের প্রকৃত পরিচয় পাওয়ার যে বিস্ময়, সেটা অনুভূত হতো না।
এখানে রাজাকার ছিল, বিহারী ছিল, মুক্তিযোদ্ধা ছিল, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ছিল। প্রত্যেকে যেন তাদের যোগ্যতায় উজ্জ্বল। যেমন, রাজাকার বাহিনীর কর্মকাণ্ড, তাদের ভয়ংকর রূপ লেখক খুব অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্ষেত্রে মেজর গুলকে যে কাঠিন্যের আবরণে লেখক জড়িয়েছেন, ভয়াবহতা এখানে মাত্রা অতিক্রম করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে কমান্ডার ইলিয়াস, একজন নেতা বা লিডার যেমন হওয়া উচিত তারই চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এমন যোগ্য নেতা থাকলে আর কী লাগে! মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ, তাদের প্রত্যেকে যতক্ষণ ছিল, সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজের কাজটি করে গিয়েছেন। তবে মোসলেম যেন সাহসের অন্যরূপ। যে কখনও হার মানে না।
যেকোনো উপন্যাসে নারী চরিত্র না থাকলে চলে না, তাই নুড়িকে লেখক এনেছেন বলেই মনে হয়েছে। যদিও ভূমিকা কম, তবুও তার অনুভূতি পাঠক অনুভব করবে। কয়েকজন নিপীড়িত নারী এখানে ছিল। কিন্তু শেষে তাদের কথা লেখক তেমন উল্লেখ করেননি। তাদের পরিণতি, অনুভূতি নিয়ে আরেকটু আলোচনা করা যেত বলে আমার মত।
◾বানান, সম্পাদনা ও অন্যান্য :
বইটার প্রচ্ছদ আমার এত পছন্দ হয়েছে! সাদামাটা, তারপরও গল্পের যে যাত্রা, তাকেই ফুটিয়ে তুলেছে।
শুরুর দিকে বানান ভুল বা ছাপার ভুল না থাকলেও শেষের দিকে ছাপার ভুলের পরিমাণ বেড়েছিল। কিছু যুক্তবর্ণ সেটআপের পর ভেঙে গিয়েছিল। দুয়েকটা বানানে অক্ষরের এদিক ওদিক এমনভাবে হয়েছিল যে বুঝতেই অসুবিধা হচ্ছিল। ধারণা করে নিতে হয়েছে।
এই দিকে আরেকটু নজর দেওয়া যেত মনে হয়।
◾পরিশেষে, “সফরনামা” — যে যাত্রা আবেগের, ভালোবাসার। এখানে মিশে আছে বীভৎসতা। আছে তীব্র আর্তনাদে জর্জরিত কিছু প্রহর। কিছু সময়ের এই যাত্রা যেন দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা এনে দেয়। বয়স হয়তো বাড়ে না, তবুও কিশোর বয়সের ছোট্ট দেহ অভিজ্ঞতায় বড় হয়ে ওঠে। যার সাথে কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
সিদ্দিক আহমেদের 'ধনুর্ধর' আর 'দশগ্রীব' পড়ার পর থেকেই তাকে প্রমিসিং একজন লেখক বলে মনে হয়েছে। এইবারের বইমেলায় তাই যখন শুনলাম তার দু-দুটো মৌলিক আসতে চলেছে তখন এক্সপেক্টেশন ছিল তুঙ্গে। বিশাল কলেবরের 'নটরাজ' এখনও পড়া হয়ে না উঠলেও পড়ে ফেললাম ৩২০ পৃষ্ঠার উপন্যাস 'সফরনামা'।
সফরনামা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। গল্পের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় এক গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয় পাঠক আর গল্পের অন্যতম মূখ্য চরিত্র লাবুর। লাবুর বয়স ১২। অবশ্য তাতে কী-ই বা আসে যায়? যুদ্ধ তো আর বয়স মানে না। তাই তো পিতার লা*শ হাতড়ে খুঁজে বেড়ানোর মাঝেও তার মনে দেখা দেয় ঘাতকের উপস্থিতির ভয়। রাজাকারদের হাতে ধরাও পড়ে লাবু। রাজাকারদের ডেরায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। আর সেখানেই আমাদের পরিচয় হয় গল্পের দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় চরিত্র রইসের সাথে। জানা যায় ক্ষুধার জ্বালায় রাজাকারদের কমান্ডার গোলাম রসুলের বাড়িতে খাবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে রইস। জানে মেরে ফেলার প্ল্যান থাকলেও গোলাম রসুল তাকে মেরে না ফেলার বিনিময়ে দেয় অদ্ভুত এক অ্যাসাইনমেন্ট। সে অ্যাসাইনমেন্ট সফল করতে হলে রইসকে চুরি করতে যেতে হবে বাঘের খাঁচায়, অর্থাৎ খোদ পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে।
রাজাকার হয়েও মিলিটারি ক্যাম্প থেকে কী চুরি করাতে চায় গোলাম রসুল? এক বুক দম নিয়ে রইস নেমে পড়ে মিশনে, চেয়ে চিন্তে সাথে নেয় লাবুকে৷ শুরু হয় অনিশ্চিত এর দিকে এক যাত্রার। সে যাত্রায় যেমন আছে প্রাণ বাঁচানোর দায়, তেমনি আছে ১২ বছর বয়সী ছেলের ভীষণ ক্রোধ। তবে খালি চোখে দেখা হিসেবের বাইরেও রয়েছে অতি গোপন একটা কিছু।
সফরনামা গল্পের সাথে নামটা একদম পুরোপুরি মানানসই। গল্পের ৭০-৮০% ই লাবু আর রইসের যাত্রার গল্প। তবে তাতে করে বিরক্ত হওয়ার সুযোগ মিলবে না পাঠকের৷ এই যাত্রার মধ্যে দিয়ে বেশ স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে যুদ্ধের সময়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, কোনোরকমে বেঁচে থেকেও দৃঢ় মনোবলের ব্যাপার। আবার বেশ কিছু দর্শনও উঠে এসেছে এ যাত্রাপথে। আর পাঠক যদি যাত্রার গল্পে কখনো ক্লান্ত হয়েও যান (আমি অবশ্য হইনি), তখন হয়তো স্ট্রেস রিলিফ করার জন্য রইসের কমিক রিলিফ কথাবার্তা কাজে দেবে (৩ দিন ধরে না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা)।
তবে এটুকু শুনে বইটাকে বড্ড সিম্পল মনে হলেও একদম সিম্পল কিন্তু না। একটা টুইস্ট আছে যেটা হয়তো মেইনস্ট্রিম থ্রিলারের মত মাইন্ডব্লোয়িং না। আবার সে টুইস্ট সচেতন পাঠকমাত্রই হয়তো ধরে ফেলতে পারবেন। এই সহজ-সাধারণ টুইস্টটাই বরং বেশি বাস্তবিক এবং রিলেটেবল।
তবে এ টুইস্ট বইয়ের সেরা অংশ বলে মনে হয়নি। আমার কাছে সেরা লেগেছে গল্পের শেষের অ্যাকশান সিকোয়েন্স। জানি না লেখক একজন চিত্রনাট্যকার বলেই কিনা, তার অতি যত্নে গড়া প্রতিটা শব্দ যেন আমার সামনে একটা সিনেমার দৃশ্যের মত ধরা দিয়েছে। যেন চোখের সামনে ইন ডিটেইলে দেখতে পাচ্ছিলাম। ঢিমেতালে চলা বইটা এখানে এসে একদম ১০০/১০০ সাসপেন্স থ্রিলার হয়ে গেছে। প্রতি পাতায় অ্যাড্রেনালিন রাশ। শেষটা অনুমেয় তবে বিরক্তিকর না। এসব ছাপিয়ে পুরো বইয়ের যে জিনিসটা ভালো লেগেছে সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নরকম একটা গল্প পড়তে পারা। আর সিদ্দিক আহমেদের সহজ সাবলীল সুন্দর লিখনশৈলী বইটাকে খুবই সহজপাঠ্য একটা উপন্যাসে রূপান্তরিত করেছে।
সিদ্দিক আহমেদের সেরা লেখা হয়তো এটা না তবে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ক্যাটাগরীতে এটা নিঃসন্দেহে অনন্য সংযোজন।
১৯৭১ সাল। সারাদেশে যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অ'স্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে দেশের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। হয়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি মিলিটারিরাও নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের হ'ত্যা করে চলেছে৷ এরকমই এক সময়ে রাজাকার সলীম ও মনুর হাতে ধরা পড়লো কিশোর লাবু। তাকে প্রচণ্ড মা'র'ধো'র করলো পিশাচগুলো৷ তারপর ব'ন্দি করে রাখলো রাজাকারদের ক্যাম্পে। আর এই ক্যাম্পেই লাবুর সাথে পরিচয় হলো রইসের সাথে।
রইস পেশায় একজন চোর। যে-সে চোর না, রীতিমতো খানদানি চোর। চুরি তার বংশীয় পেশা। আর এই নিন্দিত পেশাই যেন এবার রইসের জীবন বাঁচাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রাখলো। ঝুনঝুনিয়া গ্রামের রাজাকারদের প্রধান গ্যাদা রাজাকার রইসকে একটা অদ্ভুত কাজের ভার দিলো। কাজটা করে দিতে পারলে রইসের জান বখশ দেবে, এমনটাই ওয়াদা করলো সে। এই কাজ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনই বিচিত্র। এই মিশনে রইস চোরার সাথে লাবুও জুটে গেলো।
সামনেই গ্যাদা রাজাকারের একমাত্র মেয়ে নুড়ির বিয়ে। দেশের এই অস্থির সময়েও গ্যাদা রাজাকার মেয়ের বিয়ে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবে। এদিকে নুড়ির সাথে তার সম্পর্ক খুবই খারাপ। মেয়েটা কোনমতেই বাবার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করতে চায় না। গ্যাদা রাজাকারও নাছোড়বান্দা। নুড়িকে সে বিয়ে দিয়ে ছাড়বেই। শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী নুড়ি নিজের বিয়ে আটকাতে পারবে কি-না সেটাই হয়ে যায় দেখার ব্যাপার।
ঝুনঝুনিয়া ও এর আশেপাশের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম এক আতঙ্কের নাম। ছোটখাটো আতঙ্ক না, রীতিমতো মূর্তিমান আতঙ্ক এই মোসলেম। রাজাকাররা তার নাম শুনলে কাপড় নিজেদের কাপড় খারাপ করে ফেলে এমন অবস্থা। কারণ, মোসলেম নাকি ক্ষমা করে না। ধরতে পারলে ডাইরেক্ট ওপরের টিকেট ধরিয়ে দেয় হাতে। ইলিয়াস বাহিনীর এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা নাকি ইদানীং ঝুনঝুনিয়ার আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছে। রাজাকার সলীম আর মনু তো বটেই, খোদ রাজাকার কমান্ডার গ্যাদাও তাকে নিয়ে খুব চিন্তিত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর গুল মোহাম্মদ জিলানী। এই লোকটা একইসাথে অত্যন্ত চতুর ও নিষ্ঠুর৷ মেজর গুলের গরুর প্রতি একটা আলাদা ফ্যাসিনেশন আছে৷ আর আমাদের রইস আর লাবুর এই সফরনামাতেও এর একটা বড় ভূমিকা আছে৷ যুদ্ধের এই অস্থির সময়ের এই সফরনামার শেষ হয় কোথায়?
সুলেখক সিদ্দিক আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'সফরনামা' প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সংগ্রহ করেছিলাম। অবশেষে পড়েও ফেললাম। এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প ও উপন্যাস আমাকে আলাদাভাবে টানে। আর উপন্যাসটা যখন নিজের অন্যতম প্রিয় লেখক সিদ্দিক আহমেদের কাছ থেকে আসে, আর কোন কথাই থাকে না। 'সফরনামা'-এর শুরুটাই বেশ ইন্টারেস্টিং। বইটা পড়া শুরু করার আগে আমার চিন্তাভাবনার ধারেকাছেও ছিলো না যে একটা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস এমন অদ্ভুত আর হিউমারে পরিপূর্ণ হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ও রাজাকারদের নৃ'শং'স'তা আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সিদ্দিক আহমেদ 'সফরনামা'-তে তুলে এনেছেন রইস আর লাবুর অদ্ভুত এক জার্নি। যে জার্নির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অজানা সব বিপদ আর এই দুই চরিত্রের হাস্যরসাত্মক সব কর্মকাণ্ড। এসব বিচিত্র সব কারণে বইটা আমি একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব উপভোগ করেছি। সিদ্দিক আহমেদ রইস ও লাবুর জন্য এমন কিছু বিচিত্র আর অভাবনীয় সিচুয়েশন ক্রিয়েট করেছেন যে একটার পর একটা অধ্যায় উল্টে সামনে এগিয়ে গেছি প্রবল আগ্রহের সাথে।
'সফরনামা' উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হলো এর হিউমার। পড়তে পড়তে কিছু জায়গায় রীতিমতো শব্দ করে হেসে উঠেছি। কিছু জায়গায় ঠোঁটের কোণে সবসময়ই লেগে ছিলো মুচকি হাসির চিহ্ন। বিশেষ করে 'ধান কৈতর' বিষয়ক অধ্যায়টা পড়তে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছি। রইসের হিউমার, লাবুর একগুঁয়েমি, গ্যাদা রাজাকারের স্বার্থান্ধ আচরণ, নুড়ির জেদ, জেরিনের মহত্ত্ব আর মেজর গুলের পাশবিকতা সব মিলিয়ে 'সফরনামা' হয়ে উঠেছে অনবদ্য। আমার মতে এটা সিদ্দিক আহমেদের অন্যতম সেরা কাজ। এই সময়ের অন্যতম সেরা উপন্যাসও বটে।
'সফরনামা' ভালো লেগেছে। তবে বইয়ে প্রচুর টাইপিং মিস্টেক ছিলো। বইমেলাকে টার্গেট করে স্বল্প সময়ে সমস্ত কাজ শেষ করার তাগিদে এই ভুলগুলো হয়েছে ও থেকে গেছে। যদিও আমি বড়সড় কোন সমস্যায় পড়িনি 'সফরনামা' পড়তে গিয়ে, তবে টাইপিং মিস্টেকগুলো না থাকলে বইটা আমার কাছে শতভাগ উপভোগ্য হতে পারতো। ঋদ্ধ প্রকাশ টিমের কাছে আমার সাজেশন থাকবে পরবর্তী এডিশনে এই ভুলগুলো শুধরে নেয়ার। এমন চমৎকার একটা উপন্যাস যতো নির্ভুল হবে ততোই ভালো।
ফরিদুর রহমান রাজীবের করা প্রচ্ছদটা চমৎকার লেগেছে। বইয়ের প্রোডাকশন আর কাগজের মান ভালো ছিলো। আর দামটাও নাগালের মধ্যে রেখেছে ঋদ্ধ প্রকাশ। চাইলে পড়ে ফেলতে পারেন 'সফরনামা'। রিকমেন্ডেড।
মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে এক মাঝবয়েসী চোর আর এক প্রতিশোধের স্বপ্নে বিভোর কিশোরের গরু চুরির অভিযানের গল্প সফরনামা। শুনতে খুব খেলো লাগলেও লেখক এই তুচ্ছ প্লটকে প্রতিটা পাতায় গভীর করে��েন, যুদ্ধের সময় মানুষের উপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। শুরুর দিকে কৃষণ চন্দরের গাদ্দারের কথা মনে পড়ছিলো। যুদ্ধের সময় মানুষের ভেতরের পশুর উপর লাগাম থাকে না, সে বেরিয়ে আসে আরেকজনের উপর হামলে পড়তে। হিউমরের মধ্যে দিয়ে সেসব লাগামহীন পশুর আচরণের ব্যাখ্যা এই বইকে এক অনন্য ডার্ক কমেডিতে রূপ দিয়েছে। সেই সাথে চোর রইসের মধ্যে দিয়ে লেখক অনেকগুলো জীবনদর্শনের কথাও বলেছেন। বইয়ের মধ্যে জুলাই আন্দোলনের কিছু প্রভাব পেয়েছি, যখন নুড়ি আর তার বাবা গ্যাদা রাজাকারের মধ্যে একান্তে কথা হয়। আবার ইলিয়াস কমান্ডার শেষ যুদ্ধের সময়ে স্বগতোক্তি করেন যে মানুষ ব্যক্তিপ্রশংসা থেকে ব্যক্তিপূজার দিকে এগিয়ে যায়, যেটা মুজিবপূজার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এই বইয়ের সবচেয়ে বড় দিক, যুদ্ধকে সাদা কালো হিসেবে না দেখে তার মাঝের ধূসর এলাকাটায় লেখক এক্সপ্লোর করতে চেয়েছেন। সব মিলিয়ে গুড রিড।
যুদ্ধ সবার থেকেই কিছু না কিছু কেড়ে নেয়, কাউকেই ছাড় দেয় না। ঠিক যেমনটা বাংলাদেশ নামক দেশটার স্বাধীনতার স্বাদ পেতে কেড়ে নিয়েছিলো অনেকের অনেক কিছু। গল্পের লাবু নামক কিশোর ছেলেটার আপনজনকে কেড়ে নিয়েছে। রইস চোরার চুরি কারবারে ধস নামিয়েছে, তাইতো রইস মাইলের পর মাইল হেঁটেও খাবারের সন্ধান পায় না। বরং চুরি করতে গিয়ে এবার জান নিয়ে টানাটানিতে পড়ে যায়।
স্কুলঘরের এক রুমে ঝুলিয়ে রাখা চোর রইস বেচারা এবার চুরি করতে গিয়ে জব্বর ফাঁসা ফেঁসেছে। রাজাকারদের লিডার গ্যাদা হুজুরের বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলো রইস, আর চুরি করতে গিয়েই ধরা খেয়ে বসে আছে। সাথে হাতছাড়া হয়ে গেছে রইস চোরার মায়ের শেষ চিহ্ন আংটিটা।
গ্যাদা হুজুর যখন তাকে চুরির কথা জিজ্ঞেস করলো রইস বেচারা এমন অপবাদ শুনে আরো খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে কোনোমতে বলে উঠলো, "হুজুর, বিশ্বাস করেন চুরি কত্তি আপনের বাড়ি ঢুহি নাই। তিনদিন ধইরা না খাওয়া, তার উপ্রে খাওনের সন্ধানে মাইলকে মাইল হাঁটছি। শরীরে নেই এক ছিদেম তাকত..." বলতে বলতেই থুতনির নিচে হাত দিয়ে নিজের চেহারাটা খানিকটা উঁচিয়ে এবং এগিয়ে ধরে যোগ করে, "...বিশ্বাস না হইলে দেহেন চেহারায় কেমুন ছাপ পইড়ে গেছে।”
পাশ থেকে লাবু তখন চেয়ে আছে রইস চোরার দিকে, কিছুক্ষণ আগে নদীর পাড়ে হারানো আপনজনকে খুঁজতে গিয়ে রাজাকারের হাতে ধরা পড়া বিহ্বলিত হয়ে পড়া লাবু এই চোরা রইসের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে শোক ভুলে।
গ্যাদা রাজাকারের মেয়ে নুড়ি বিয়ে উপযুক্ত হয়েছে, তাকে বিয়ে দেওয়ার সময় গ্যাদা রাজাকারের ইচ্ছে একটা গরু জবাই করার, কিন্তু এই গরু নিয়ে সমস্যা ব্যাপাক। পাক মিলিটারি মেজর গুল এলাকার সব গরু নিয়ে গেছে গঞ্জের ক্যাম্পে। গ্যাদা রাজাকার রইস চোরাকে দায়িত্ব দিয়েছে গঞ্জের মিলিটারি ক্যাম্প থেকে গরু চুরি করে আনার, তবেই মিলবে মায়ের সেই আংটি। রইস বেড়িয়ে পরে ক্যাম্প থেকে গরু চুরি করতে সাথে সঙ্গী হয় রাস্তাঘাট চিনিয়ে দেওয়ার জন্য আছে সদ্য আপনজন হারানো কিশোর লেবু।
১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কালো ছায়ায় মাঝেই দুই সম্পর্কহীন পথিক এক বিপন্ন যাত্রায় এগিয়ে চলে। একজন মাঝবয়সি, যার অভিজ্ঞ কাঁধে এক দায়িত্ব এসে ভার করেছে, যার সঙ্গ দেয় আর এক কিশোর, যে ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। দখলদার বাহিনীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে, অচেনা পথের ধুলো জড়াল দু'জনের পায়ে। সফরই গড়ে তুলল এক অনিশ্চিত সঙ্গ, সহযাত্রার টানে শুরু হলো পথচলা-নদী, বন, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে-অন্যের ঘর থেকে পরের শিবির পেরিয়ে দুই পথিকের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সফরনামা।
গল্পটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মাঝবয়সি রইস চোরা আর কিশোর লাবুর গঞ্জের গরু চুরির যাত্রার, যাত্রা যতটা সহজ মনে হয় আসলে ঠিক তা নয়। একে তো ক্যাম্প থেকে গরু চুরি করে আনতে হবে, তারউপর আছে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধা মোসলেমের ঘুরেবেড়ানোর খবর। যার কানে রাজাকারের কাজে গঞ্জে যাচ্ছে শুনলেই গুলিতে ঝাঁঝরা হতে হবে দুইজনকেই। তারউপর বিহারী, পাক আর্মি আর রাজাকারদের উৎপাত তো রয়েছেই।
তবুও তারা এগিয়ে চলে, তাদের এই এগিয়ে চলার সফরনামার সঙ্গী হয়ে রইস মিয়ার কান্ডকারখানা দেখে আমার হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়ছিলো। লাবুর মতো কিশোরের ব্যক্তিত্ববোধ কখনো কখনো যেমন মুগ্ধ করছিলো আবার কখনো কখনো যুদ্ধের ডামাডোলে অতিরিক্ত মানবিকতার জন্য তার বিরক্তিরও উদ্রেক করছিলো।রইস চোরার আঞ্চলিক সংলাপ, লাবুর সাথে তার সম্পর্কের মান-অভিমান, খুনসুটি আর দুই মেরুর মানসিকতার মেলবন্ধন আমাকে মুগ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব করার মতোই একটা ঘটনা, যা আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আমি প্রায়ই ভাবি এমন একটা ঘটনা নিয়ে আমাদের দেশে ফিকশনের জায়গায় কেন এতো কম লেখালেখি হয়। অথচ অনন্য দেশের এমন ঘটনা নিয়ে অহরহ ফিকশন দেখতে পাবেন।
সফরনামা বইটা যখন নিয়েছিলাম, তখন জানতামও না বইটার কাহিনি কী নিয়ে। বইটা কেবল নিয়েছিলাম লেখক সিদ্দিক আহমেদের ভরসায়। লেখকের আগের লেখা পড়ার পর মনে হয়েছিলো লেখক তার গল্পে আমাকে হতাশ করবেন না। বইটা যখন পড়া শুরু করলাম, দেখলাম এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এক যাত্রার গল্প, তখন ভালো লাগাটা আরো একগুন বেড়ে গিয়েছিলো।
আর বইটা শেষ করার পর আমার বইটা প্রচন্ডরকম ভালো লেগেছে। গল্পের শুরুটা দেখে শেষটার চমকের কিছুটা ধারনা করতে পারলেও লেখক শেষে যে খেলা দেখিয়েছেন তা একেবারেই চমকে দিয়েছে আমাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বইয়ের শেষ দিকে এমন টানটান উত্তেজনাকর গল্প হবে এমনটা আশাও করিনি। আর এই আশা না করার কারণেই হয়তো বইটা হৃদয়ে দাগ কেটে বসে গেছে। এই শেষটা নিয়ে এখানে একদমই আলোচনা না করাই ভালো, বইটা কেউ পড়লে তার জন্যেও শেষ অংশটা চমক হিসেবেই থাকুক।
এই গল্পের মূল চরিত্রের রইস চোরা আর লাবু চরিত্র দুইজনকেই আমি বিশ্বাস করি বইটা যেই পড়বে তারই ভালো লাগবে, অনেকদিন মনে দাগ কেটে রয়ে যাবে। অনেকদিন পর এমন চমৎকার মন ভালো করে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসের জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
বই পড়তে বসলেই আমি মাঝে মাঝে গল্পের সাথে গল্পের দেওয়া নাম আর প্রচ্ছদের কোনো যোগসূত্র আছে কি না তা খোঁজার চেষ্টা করি। বইটা পড়তে গিয়েই খেয়াল করলাম এই দুটো ব্যাপারের সাথে গল্পের দারুণ মিলে গেছে। বিশেষ করে প্রচ্ছদটা প্রথম দেখাতে আমার সাদামাটাই লেগেছিলো, কিন্তু বই শেষ করার পর প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে প্রচ্ছদ গল্পের সাথে দারুণভাবে মিলে গেছে।
ঋদ্ধ প্রকাশের প্রোডাকশন, সম্পাদনা দুটোই চমৎকার হয়েছে, গল্পে বানান ভুল চোখেই পড়েনি। আরো একটা বিষয় ভালো লেগেছে বইটার, লেখার চারদিকের মার্জিন খুবই কম রাখা হয়েছে, এই বিষয়টা উল্লেক করার কারণ বর্তমানে বেশ কয়েকটা প্রকাশনী মার্জিন বেশি রেখে পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়িয়েছে।
এক কথায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা সিদ্দিক আহমেদের এই সফরনামা বইটা আমার প্রচন্ড ভালো লেগেছে। শূন্য প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করে গল্পটা আমার এতলটা ভালো লাগবে তা কল্পনাতেও ছিলো না, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্পের এই বইটা আমি সবাইকেই রিকমেন্�� করছি, আশাকরি আমার মতো সবারই ভালো লাগবে।
বইয়ের নাম: সফরনামা লেখক:সিদ্দিক আহমেদ পৃষ্ঠাসংখ্যা:৩২০ প্রকাশনী:ঋদ্ধ প্রকাশ প্রকাশকাল:বইমেলা ২০২৫ রেটিং:৩.৯/৫
"কিন্ত দুই দিন যাতি না যাতিই বুঝলাম দেশ হইছে,কিন্ত আমাগো ভাগ্য বদলায়নি। আসলে রাজা আসে রাজা যায়,কিন্ত আমাগো ভাগ্য বদলায় না।' স্বাধীনতা এক টুকরা জমি দিয়ে হয় না। স্বাধীনতা হয় জনগণের স্বপ্নরে বাস্তব বানায়ে। যদি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা না যায় ,জনগণের স্বপ্ন পূরণ না হয়,তাইলে শুধু এট্টা দেশ পাবো।মুক্তি পাবো না।শুধু জমিন পালিও তাই স্বাধীনতা আসবে না। আর আমি নতুন দেশের স্বপ্ন দেখি। যেখানে কারো কোনো ভেদভেদ থাকবি না। -সেইডা বেহেস্ত ছাড়া দুনিয়ায় সম্ভব না।"
ফ্ল্যাপ: ১৯৭১। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কালো ছায়ায় দুই সম্পর্কহীন পথিক এক বিপন্ন যাত্রায় এগিয়ে চলে। একজন মাঝবয়সি, যার অভিজ্ঞ কাঁধে ইতিহাসের ভার, আর এক কিশোর, যে ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। দখলদার বাহিনীর আঘাতে ছিন্ন��িন্ন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে, অচেনা পথের ধুলো জড়াল দু’জনের পায়ে। সফরই গড়ে তুলল এক অনিশ্চিত সঙ্গ, সহযাত্রার টানে শুরু হলো পথচলা—নদী, বন, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে—অন্যের ঘর থেকে পরের শিবিরে। “সফরনামা” শুধু দুঃসময়ের দলিল নয়, বরং এমন এক সময়ের সাক্ষ্য যেখানে মানুষের সম্পর্ক, প্রতীক্ষা আর আশার মধ্যে বোনা হয় বেঁচে থাকার নতুন সংলাপ।
পাঠ প্রতিক্রিয়া: সফরনামা,এক মাঝবয়সী রইস আর এক কিশোর লাবু'র সফর। তাদের এই সফরে লেখক আস্তে আস্তে পাঠককে তাদের সাথে পরিচয় করান। পরিচয়ের মাঝে তুলে ধরেন যুদ্ধকালীন মানুষের জীবনযাত্রা, হানাদার বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতা, হত্যাযজ্ঞ চালানো গ্রামগুলোর অবস্থা।যদিও আগে থেকেই সেসব সর্ম্পর্কে জানি;তবে পড়ার সময় নতুন করে শিউরে উঠছিলাম,বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলটাতে চালানো হত্যাযজ্ঞের বৰ্ণনা পড়ে।গল্পে লেখক দেখিয়েছেন,যুদ্ধ মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে,যুদ্ধ কিভাবে স্কুলের ব্যাগ টানা বয়সী এক কিশোরকে দিয়ে লাশ টানায়।
এর সাথে লেখক লাবু আর রইসের সম্পর্কের রসায়নটাকেও জমিয়ে তোলেন।সফরে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের বিষয়টা রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিচ্ছিল।কারণ,ঐ সময় রাজাকার বা ওই দলের লোকেরা যেমন সামনের অপরিচিত ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা দলের মনে করতো,একই জিনিস ঘটতো রাজাকার দলের ক্ষেত্রেও।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন গল্প বিবেচনায় লেখক হালকা চালের কথাবার্তা আর রসিকতা রেখেছেন।সাথে ছিলো আঞ্চলিক ভাষার ভালোমতো ব্যবহার। যেকারণে এধরনের বই পড়ার সময় যে বিষণ্ণ ভাবটা থাকে,তা কিছুটা হলেও কম ছিল।লেখকের জন্ম যেহেতু খুলনায়,সেকারণে হয়তো ওই অঞ্চলের ভাষাই ব্যবহার করেছেন।
প্লট টুইস্ট এর পাশাপাশি ছোটখাটো টুইস্টগুলোও গল্পে আলাদা মাত্রা দিতে ভুমিকা রেখেছে।যদিও প্লট টুইস্টটা অনুমানযোগ্য ছিল।
এই প্রথম লেখকের বই পড়লাম ।তবে উনার দারুণ বর্ণনাশৈলী(বিশেষ করে শেষাংশের),গল্পকে দারুণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে কোথাও স্লো বা বোরিং লাগেনি।
এর আগেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কয়েকটা গল্প-উপন্যাস পড়েছি,সেগুলোর সাথে এই বইয়ের প্রায় সব মিল থাকলেও ব্যতিক্রম হচ্ছে বিহারিদের বর্ণনা। কোনো গল্প-উপন্যাসে বিহারীদের ব্যাপারে পড়িনি। লেখক সিদ্দিক আহমেদ বর্ণনা করেছেন,সে সময়কার বিহারীদের সম্পর্কে,তাদের সাথে বাংলাদেশিদের দ্বন্দ সম্পর্কে।
মুদ্রার অপর পিঠ : গল্পে কয়েক জায়গাই নিপীড়িত নারীদের সম্পর্কে লেখা ছিলো।বিশেষ করে,ক্যাম্পে বন্দি রাখা নারীদের ব্যাপারে।কিন্ত শেষে লেখক তাদের কথা তেমন উল্লেখ করেননি।বিশেষ করে, তাদের পরিণতি নিয়ে আলোচনা করলে ভালো হতো বলে আমি মনে করি।
আর শেষের দিকে একটা বিষয় অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়েছে।
বানান: বইয়ের শুরুর দিকে তেমন বানান ভুল বা টাইপিং মিসটেক ছিল না,কিন্ত পরে সেটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে মনে হলো আদৌ প্রুফ রিডিং হইছে তো !যদিও একটা সংস্থার নাম রেফারেন্স দেওয়া ছিল।আর এই টাইপিং মিসটেক এর ধারা শেষ পর্যন্ত চলমান ছিল।এছাড়াও অনেক জায়গাই যুক্তবর্ণ ভাঙা অবস্থায় ছিল।এই ২এর কারণে অনেক জায়গাই শব্দ বুঝতে অসুবিধা হয়েছে,কিছু জায়গাই শব্দ আন্দাজ করে পড়তে হয়েছে।
প্রোডাকশন,প্রচ্ছদ: বইয়ের বাঁধাই কিছুটা আটসাটো ছিলো,এধরনের বাঁধাই এর বই পড়ে আমি খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না।তবে,আমার সংগ্রহের বইটা বইমেলার সময়কার।এক ভিডিওতে দেখেছিলাম , প্রকাশনীর ওই লটের বইগুলোর বাঁধাই নাকি এমনই হয়েছে। পরের লট থেকে বইয়ের বাধাই নাকি ঠিকই ছিলো।এছাড়া প্রোডাকশন ভালই ছিল।
প্রচ্ছদটা 'সিম্পলের ভিতর গর্জিয়াস' ধরনের ছিলো।ফরিদুর রহমান রাজীব ভাই দারুণ কাজ দেখিয়েছেন ।
পরিশেষে,"যে যুদ্ধ চায়,সে যুদ্ধে যায় না। যে যুদ্ধে যায়,সে যুদ্ধ চায় না।"এটা গল্পেরই এক জায়গাই পড়েছিলাম।যুদ্ধে হার-জিত যারই হোক,এই যুদ্ধের কারণে যে মৃত্যু,ক্ষতি,ভোগান্তি হয় তা কখনোই কাম্য নয়।তাই যুদ্ধ ছাড়া যদি কোনো সমাধান হয়,তাহলে সেই সমাধানই ভালো।'মনে হলো,তাই বললাম আরকি!
🔴বইঃ সফরনামা 🟣লেখকঃ সিদ্দিক আহমেদ 🔵প্রকাশনীঃ ঋদ্ধ প্রকাশ
⭕ফ্ল্যাপ থেকেঃ ১৯৭১। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কালো ছায়ায় দুই সম্পর্কহীন পথিক এক বিপন্ন যাত্রায় এগিয়ে চলে। একজন মাঝবয়সী, যার অভিজ্ঞ কাঁধে ইতিহাসের ভার, আর এক কিশোর যে ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। দখলদার বাহিনীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে, অচেনা পথের ধুলো জড়াল দুজনের পায়ে।সফরই গড়ে তুলল এক অনিশ্চিত সংঙ্গ,সহযাত্রার টানে শুরু হল পথচলা- নদী,বন,গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে-অন্যের ঘর থেকে পরের শিবিরে। "সফরনামা" শুধু দুঃসময়ে দলিল নয়,বরং এমন এক সময়ের সাক্ষ্য যেখানে মানুষের সম্পর্ক, প্রতীক্ষা আর আশার মধ্যে বোনা হয় বেঁচে থাকার নতুন সংলাপ।
🎯মানুষের সাথে মানুষের মতের মিল না হওয়ার অর্থ তাকে মেরে ফেলা না।যেদিন আমি আপনি ভিন্ন মতের হয়েও পাশাপাশি বসে তর্ক করতে পারবো,সমালোচনা করতে পারবো কিন্তু কেউ কারো জনের পিছে রে রে করে তেড়ে ছুটে যেয়ে পড়বোনা,সেদিন দেশটা আসলেই স্বাধীন হবে।🎯
⭕পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প,উপন্যাস কিংবা ছবির প্রতি ছোটোবেলা থেকেই একটা ভালোলাগা বা আকর্ষণ কাজ করে আবার নৃশংস সেসব হত্যাকান্ডের দৃশ্যের কথা মনে পড়লে এক রাশ বিষন্নতায় ছুয়ে যায় মন। সম্প্রতি "সিদ্দিক আহমেদ" ভাইয়ের "সফরনামা" বইটি পড়েও তেমন মিশ্র অনুভূতিই হয়েছে আমার।
"লাবু" আর "রইসের" সাথে আমিও যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে। প্রথমদিকে রইস চোরার কাহিনী পড়তে পড়তে ওবায়েদ হকের তেইল্যা চোরা বইটির কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো,সেটাও একটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। যাই হোক,প্রথমদিকে এমন ভাবে এগুচ্ছিলো যে পড়তে মজাই লাগছিলো,তাছাড়া লেখকের হিউ���ার,হাস্যরসবোধ এর কারণে বইয়ের অনেক অংশ পড়তে পড়তে ফিক করে হেসে ফেলেছি নিজের অজান্তেই। তখন একটু মনে হচ্ছিলো মুক্তিযুদ্ধকালীন উপন্যাস হিসেবে যুদ্ধকালীন সময়ের ভিভিড বর্ননাগুলো লেখক ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলেছেন তো!! পরবর্তীতে শেষের প্রায় ৬০ পৃষ্ঠা জুড়ে যেই ফাইনাল ফাইট টা হয় পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করা নিয়ে,সেই বর্ননাগুলোর মাধ্যমে লেখক পুরোপুরি পুষিয়ে দিয়েছেন। বইয়ে দারুণ টুইস্টও রয়েছে কিছু যদিও সেটা আগে থেকেই কিছুটা অনুমেয় ছিলো।
সবমিলিয়ে স্বার্থক একটা উপন্যাস। এটা নিয়ে যে কোনো মুভি বা ওয়েভ ফিল্ম করলে কেমন হবে সেটা ভেবেও শিহরিত হচ্ছি! লেখকের লেখার ধরন দূর্দান্ত, যারা উনার থ্রিলার লেখা গুলো পড়েছেন তারা ইতিমধ্যেই এই সম্পর্কে অবগত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত সিদ্দিক আহমেদ এর রচিত “সফরনামা” বইটিকে অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীর থেকে আলাদা বলব এই কারণে যে- সিদ্দিক আহমেদ যেই এঙ্গেল এবং পার্সপেক্টিভ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন এবং দেখানোর চেষ্টা করেছেন তা অন্যান্যদের থেকে ভিন্ন। গল্প এগিয়ে গিয়েছে নানাবিধ হাস্যরস এবং চমকপ্রদ ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে। অন্যতম একটি চমকের নাম “ধান কইতর”। কাহিনী কোথাও ঝুলে যায় নাই, বরং দৌড়েছে প্রধান দুই চরিত্রের সাথে তাল মিলিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা 'সফরনামা' উপন্যাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ইমোশনাল ট্রাঞ্জিশন। রইস চোরের বোকাসুলভ রসিকতায় হাসতে গাসতে হঠাৎ খেয়াল হবে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের বিবরণ শুরু হয়েছে। কখনও উত্তেজনা, কখনও হাস্যরস, কখনও কান্না, কখনও ধুন্দুমার অ্যাকশন- আক্ষরিক অর্থের সফরনামা একটা বহুমাত্রিক আবেগময় সফর। ১৯৭১ নিয়ে বেশ ভিন্নধর্মী বই পড়ার অভিজ্ঞতা হলো।