নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ (জানুয়ারি ৩, ১৯৩৬- জানুয়ারি ১৯, ১৯৭১)
মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের জীবন পেয়েছেন কবি। দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করেছে সারাজীবন। শৈশবে মায়ের মৃত্যু ও পিতার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁর স্থান হয় শিশু আশ্রমে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই জীবিকার তাগিদে তাকে খনিতে, জাহাজে কাজ করতে হয়। সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ “তরঙ্গ ও শিলা”, আর এর পরপরই তিনি মস্কোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এর মাঝে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু কবি নিকোলাই রুবৎসভ মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। সাংসারিক জীবনের টানাটানি, কর্জ - এসব কিছু মিলিয়ে তিনি সাইবেরিয়াতে পাড়ি জমান৷ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় “মাঠ-জ্বলা তারা।” এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে উঠতি নারী কবি লুদমিলা দারবিনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের দিনই নব বধূ লুদমিলা দারবিনা তাঁকে হত্যা করে। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেই তিনি যেন ভবিষ্যৎ বাণী করে লিখেছেন, “I will die in Epiphany Frosts. I will die when the birches crack.” তাঁর মৃত্যুর পরে বিশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সারাবিশ্বে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মূলত তাঁর মৃত্যুর পরে। অসম্ভব সুন্দর আর ছন্দময় কবিতার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
Nikolay Mikhaylovich Rubtsov (Russian: Николай Михайлович Рубцов; 3 January 1936, Yemetsk, Northern Krai – 19 January 1971, Vologda) was a Russian poet.
Rubtsov was tragically killed in the night of January 19, 1971, at the 36th year of his life, in his apartment, the result of a domestic dispute with an aspiring poet Lyudmyla Derbina.
সিনেমার মতো নাটকীয় জীবন তার। জন্মের কয়েক বছর পরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু, বাবা যুদ্ধে গেছেন, মা মারা গেছেন, ভাইবোনদের ঠাঁই হয়েছে এতিমখানায়, অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বড় হয়েছেন এবং নিজের দ্বিতীয় বিয়ের দিন স্ত্রী কর্তৃক খুন হয়েছেন।ভাবা যায়!মাত্র ৩৫ বছরের জীবন রুবৎসভের। তাতেই এতো উত্থানপতন। আশ্চর্য ব্যাপার, তার কবিতায় এসব দ্বন্দ্বমুখরতার ছাপ নেই। রুবৎসভের কবিতা গীতিময়, স্মৃতিকাতর ও প্রশান্ত (সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে এটা বেশ অবাক করা কাণ্ড।কারণ ততোদিনে সারাবিশ্বেই কবিতায় আধুনিকতাবাদ প্রতিষ্ঠিত।)আধুনিক কবিতার যুগযন্ত্রণা, দ্ব্যর্থকতা, জটিলতা, অর্থহীনতার বোধ রুবৎসভের কবিতায় অনুপস্থিত। সম্ভবত এজন্যই তার কবিতা বাংলায় অনূদিত হতে এতো বছর সময় লাগলো। তিনি ক্লাসিক ধারার কবি ও গীতিকার। মনে হয়, জীবনের কাছে শান্ত আত্মসমর্পণ করেছেন কবি। গ্রামের প্রকৃতি আর তার নির্মল সৌন্দর্য রুবৎসভকে প্রাণিত করে। ছোট্ট কুটির, আকাশের তারা, জলের মিনার, স্বর্গ মন্দির, উইলো ঝোপের শিশিরের কথা মনে পড়ে তার, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে অতীতে, শুনতে ইচ্ছে করে প্রেতের গল্প। কিন্তু কবি জানেন " সত্যকে ছুঁয়ে ভেঙে গেছে বাসনা", সবই বদলে যায়, এমনকি তার প্রিয় রাশিয়াও বদলে গেছে। একাকী ঘরে ঘুমের জন্য কাতর হলেও লাভ নেই। এদিকে "বার্চের ঝরা পাতা যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে আসে" আর "বাতাস শিশুর মতো কাঁদে"। যেন সবকিছু ভেঙে পড়ছে, মাঠ জ্বলা তারাকে জ্বলে থাকার মিনতি করেও লাভ নেই। কিন্তু কবি তার স্মৃতিতে নিজের শৈশব আর সারল্য ধরে রাখতে চান। তিনি জানেন, " শব্দের মাঝেই আগুনের জন্ম।" শব্দই পারবে সময়কে ধরে রাখতে। রুবৎসভ বিশ্বাস করতেন, "প্রকৃতির দান ভুলে গেলে আর কবিতা লিখতে পারবেন না।" সরাসরি তার কবিতায় রাশিয়ার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের ছাপ না থাকলেও বোঝা যায় কেন তিনি নিজ দেশে এতো জনপ্রিয়। কারণ তার যে হারানোর বোধ ও কাতরতা তা খুব সহজেই পাঠককে আক্রান্ত করতে পেরেছিলো।
অনুবাদ আসলে কতোটা ভালো হয়েছে তা বলা কঠিন কিন্তু শামসুদ্দোহা তৌহীদের অনুবাদ বেশ সাবলীল ও সুললিত। যেমন -
"রাতের তারা জ্বলে আমার চিলেকোঠার ঘরে। বালতি হাতে জননী আমার জল নিয়ে আসে আহা। তার নিঝুম পদ-পাতে।"
পুরো বইতেই যত্নের ছাপ স্পষ্ট। শুধু এক কবিতায় "আম্মু" শব্দটার ব্যবহার পীড়াদায়ক লেগেছে। সব মিলিয়ে "রাশিয়া, তুমি বড় বাজিকর" চমৎকার একটি কাব্যগ্রন্থ।
কবি নিকোলাই রুবৎসভ (১৯৩৬-১৯৭১) যেন স্বয়ং গ্রীক ট্রাজেডির নায়ক। শেষদিন পর্যন্ত নানান ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত ছিল তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন। শৈশবে মা'কে হারান। বাবা'র সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন হয় শীঘ্রই। পাঁচ ভাইবোনসহ কবির জায়গা হয় এতিমখানায়। ভিন্ন ভিন্ন শহরের এতিমখানায় স্থানান্তরিত হওয়ায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চিরতরে ভাইবোনদের হারান। তাঁর কর্মজীবনও ছিল অস্থিতিশীল ও বৈচিত্র্যময়। নৌবাহিনীতে চাকরি করেছেন, মিস্ত্রির কাজ করেছেন, এমনকি কাজ করেছেন সামরিক পরীক্ষা কেন্দ্রে ও কারখানার শ্রমিক হিসেবে। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে দাম্পত্যকলহের জেরে বিয়ের দিনেই দ্বিতীয় স্ত্রী লুদমিলা দারবিনা কর্তৃক খুন হন। চরম নাটকীয়তায় চিরসমাপ্তি ঘটে কবি নিকোলাই রুবৎসভ-এর জীবনের।
কবি নিকোলাই রুবৎসভ-এর কবিতার প্রকাশ সহজ-সরল, গাম্ভীর্যহীন। অধিকাংশ কবিতায় স্বদেশপ্রেম, স্মৃতিচারণা, প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ লক্ষণীয়। তাঁর কবিতা আনন্দ দেয়, ভাবায়, আবার কখনও স্মৃতিকাতরতার পরশ বুলিয়ে মন কিছুটা বিষণ্ণ করে তোলে।
অনুবাদক, শামসুদ্দোহা তৌহীদ-এর অনুবাদ সুন্দর, সাবলীল। জড়তা, আড়ষ্টভাব নেই; কবিতার মূলভাব সহজে অনুধাবন করা যায়। কাব্যগ্রন্থটি পড়লে অনুবাদকের পরিশ্রম, নৈপুণ্য ও যত্নশীলতা প্রত্যক্ষ করা যাবে।
এই শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনে ফুটে উঠেছে নিসর্গপ্রীতি, স্মৃতিকাতরতা, সংবেদনশীলতা, অবলম্বনহীন কাকের অসহায়ত্ব, মা সোয়ালো পাখির সন্তান হারানোর হাহাকার, আহত ভালুকের যন্ত্রণা, ছায়ায় ঢাকা গ্রামের বাড়ির স্মৃতি, যুদ্ধের অমোঘ নির্মমতা, অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা ও সাধ, মৃত্যুর ক্রুর হিমশীতল অসহায়ত্ব এবং অবশ্যই রাশিয়ার প্রতি ভালোবাসা, আহ্বান ও স্মৃতিচারণা।
... ঝড় ওঠে কালো হয় নদী তীর ছুঁয়ে ফুটে আছে কতশত ফুলের কলি। সেই একই ফুল কিন্তু মেয়েরা ভিন, তাদেরকে বলো না তুমি কী ছিল আমাদের দিন! ...
বহুদূর পথ আমি সাইকেলে যাই দূরের এক ঘাসের বনে থমকে দাঁড়াই, ফুল তুলি, আর ভাবি, আমার মুখে ফুটবে বুলি, যখন ফুলের তোড়া দেব, আমি যাকে ভালোবাসি, 'কারও সাথে বুঝি ছিলে আমাদের আলাপের কথা ভুলে? তুমি ধরো এই ফুল, হবে না গো আর ভুল। আমাকে মনে করিয়ে দেবে এই ফুল।' ...
বসলো কাক বেড়ার ওপর তালাবদ্ধ সমস্ত গোলাঘর, চলে গেল সব মালগাড়ির বহর কাটে না এই আকালের প্রহর। আজ বহুদিন ধরে। কাকটি দিনমান উশখুশ করে নেই শীতের আশ্রয়; নেই কোনো দানা! বেচারা!
সোয়ালো পাখি করে রা- বাসা থেকে পড়ল ছা, চারপাশে হৈচৈ বাচ্চারা বলে, 'পাখির ছা পড়ল কই?' শাবলটি হাতে তুলি, ছানার জন্য কবর খুড়ি। মা পাখিটি উড়ে বেড়ায় সুরে তার বিলাপ ছড়ায়। সোয়ালো পাখি ভেসে চলে বুকেতে তার দুঃখ চেপে, 'ও পাখি, তুই করলি কী? ছানাটি দেখে রাখতে পারিসনি!'
আমার কবিতা যদি খাঁটি হয় একদিন ছড়াবে জ্যোতি আমার সুনাম হবে সেদিন কবিতা পাবে খ্যাতি। আমার নামে গড়বে ভাস্কর্য কঠিন পাথর কেটে, কী আশ্চর্য! তবুও সেই পাথুরে শরীরে আমি রইব চিরকাল মাতাল!
গৃহকর্ত্রী শুধালেন, “বাছা, যুদ্ধ কি শেষ?” আমি জবাব দিয়েছি, “হয়তো হবে না।” "ঈশ্বর মাফ করুন, ঈশ্বর মাফ করুন।" কারণ যুদ্ধ ন্যায্য হিস্যা করতে পারে না কোনোদিন কেউ জয়ী হয়নি এই শত্রু-শত্রু খেলায়! তিনি আবারও শুধালেন, "যুদ্ধের শেষ হবে না বলছ?" "না, বলেছি হয়তো হবে না।” "ঈশ্বর মাফ করুন, ঈশ্বর মাফ করুন।”
আমি মারা যাব এপিফানি শীতে আমি মারা যাব যখন বার্চ গাছে ধরবে চিড় বসন্ত এলেই বীভৎসতা করবে ভিড় গোরস্থান ডুবে যাবে নদীর স্রোতে আমার শবাধার ভেসে যাবে জোয়ারে পচা কাঠ ধ্বসে যাবে জলে কোথায় হারিয়ে যাবো সবার চোখের আড়ালে! আমি জানি না এসব... করি না বিশ্বাস অপার শান্তিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রুবৎসভের বাবা যুদ্ধে যোগ দেন আর তার মা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তাদের ছয় ভাই বোনকে বিভিন্ন এতিমখানায় পাঠানো হয়। এই ঘটনার পর তারা একে অপরকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। নিকোলাই রুবৎসভ খুব আশা করতেন তার বাবা হয়তো একদিন তাকে নিয়ে যাবে এতিমখানা থেকে। কবির স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, এতিমখানাতেই তার প্রথম কবিতা লিখেছিলেন। জীবনের সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তার একান্ত আশ্রয় হয়ে উঠছিল কবিতা। শুধু কবিতার জন্যই বেঁচে ছিলেন আমাদের সুপরিচিত এক বাঙালি কবি। কবি আবুল হাসানের নিঃসঙ্গতার সাথে অনেকাংশেই রুবৎসভের জীবনের মি�� পাওয়া যায়। রুবৎসভের কবিতা আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হয়, কিন্তু তাকে জানার পর তার কবিতার প্রকৃত অর্থ কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়। তার কবিতার বিষন্নতার ছাপ দেখলে মনে হয় আমাদের জীবনানন্দ দাসের আরেক রূপ।
প্রথম কবিতা ‘আমার চিলেকোঠার ঘরে’ এর কয়েক লাইন পড়লে মায়ের বিষয়টা খেয়াল করা যায়_ রাতের তারা জলে আমার চিলকোঠার ঘরে বালতি হাতে জননী আমার জল নিয়ে আসে আহা তার নিঝুম পদ-পাতে
‘বিদায়ের গান’ কবিতায় হয়তো বাবার কথা মেলে_ তুমি আর আমি হলাম ভিন্ন ডেরার পাখি তবে কেন অপেক্ষা পরস্পরের প্রতি হয়তো ফিরবো কোনো একদিন হয়তোবা কখনো ফিরবো না আমি।
ছন্দ মিলের সাথে অনুবাদকের শব্দের ব্যবহার যথার্থই বলতে হয়। ’বিদায়ের গান’ কবিতায় নিচের দুই লাইনে একই রকম শব্দের (হয়তো/হয়তোবা,ফিরবো) ব্যবহার করে ছন্দ মিল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ পুনরাবৃত্তি করার পর ও শব্দগুলোর মাধুর্য নষ্ট হয়নি। শামসুদ্দোহা তৌহিদের অনুবাদে প্রত্যেকটা কবিতাই বাংলা পাঠকদের জন্য বেশ সুপাঠ্য হয়ে উঠেছে। রুবৎসভকে জানার জন্য অনুবাদকের ভূমিকাটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। অনুবাদক সে বিষয়টা বুঝতে পেরেই ভূমিকায় খুব সংক্ষিপ্ত আকারে রুবৎসভ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কবির জীবন সম্পর্কে নূন্যতম ধারনা না থাকলে তার কাব্য অনুভব করা সম্ভব নয়। রুবৎসভ আজ আমাদের থেকে বহু দূরে, তবুও জ্বলে আছেন মিটিমিটি তারার মতো।
বহু দূরে আমার আমার অজো পাড়াগাঁয়ে এই শীত আর কুয়াশায় তুমি এত পূর্ণ! এত আলো! আমার মাঠ-জ্বলা তারা এই শ্বেতশুভ্র চরাচরে তোমায় বাসি ভাল তুমি জ্বলো! জ্বলো!