Jump to ratings and reviews
Rate this book

সোহাগিনীর সঙ্গে একবছর

Rate this book
মৃত্যুর পর একগলা আগুনের ভিতর বাবাকে চলে যেতে দেখে সমস্ত মোহ, সব রোমান্টিকতা কেটে গিয়েছিল বিশ্বরূপের। কিন্তু সোহাগিনী নামের একটি মেয়ে, যাকে ‘গিনি’ বলে ডাকে সবাই, ওর জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসে রং। বাংলা কবিতার রাজনীতি আর ব্যক্তিগত সংকটের ঘূর্ণাবর্তে টালমাটাল বিশ্বরূপের চোখে গিনি হয়ে উঠল সেই রংমশাল, যা প্রত্যেকটা অন্ধকার রাত্রিকে হাজার ওয়াট আলোয় উজ্জ্বল করে তোলে। বিশ্বরূপ তাই ওকে আঁকড়ে ধরল প্রাণপণে। কিন্তু সমস্ত প্রাণময় শরীর যেমন ভিতরে বহন করে মৃত্যুর বীজ সমস্ত সম্পর্ক কি লালন করে বিচ্ছেদ? তা না হলে হঠাৎ করে কেন পালটে যায় গিনির ব্যবহার? নিজে এগিয়ে এসে যে-সম্পর্ক তৈরি করেছিল, সেই সম্পর্ক থেকে কেন নিজেকে সরিয়ে নিতে যায় সে? কিছু বুঝতে না পেরে বিশ্বরূপ যখন বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা আর আত্মহত্যার ইচ্ছের ভিতর লাট খেতে থাকে, তখন হঠাৎ ওর মনে পড়ে যায় গিনির মুখে শোনা রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা। সেই কবিতার স্পর্শে ওরা কি দু’জনেই খুঁজে পায় পথের শেষ কিংবা সম্পর্কের অন্যরকম আরম্ভ?

168 pages, Hardcover

Published January 1, 2012

10 people want to read

About the author

Binayak Bandopadhyay

29 books4 followers
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়। বাবা খ্যাতনামা সংস্কৃত পণ্ডিত, স্বর্গীয় পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়; মা গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতৃকুল নিঃসম্বল উদ্বাস্তু, মাতৃকুল মলুটির রাজপরিবার। প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় সাউথ পয়েন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে। প্রথম গল্প ‘উনিশ-কুড়ি’ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস, শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায়, ২০০৭ সালে। লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। কবিতার জন্য পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার, বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার, ভাষানগর পুরস্কার ইত্যাদি। গদ্যের জন্য পেয়েছেন শর্মিলা ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার। লিখতে ভালবাসেন এমন লেখা যা আমরা পড়তে চাইলেও লেখার সাহস পাই না। আইওয়া আন্তর্জাতিক লেখক শিবিরে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ২০১৪ সালে। ঠাকুর শ্রীশ্রী দুর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেবের শিষ্য। শখ: নতুন বই, পুরনো গান।

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
3 (30%)
4 stars
3 (30%)
3 stars
3 (30%)
2 stars
1 (10%)
1 star
0 (0%)
Displaying 1 of 1 review
Profile Image for Preetam Chatterjee.
6,833 reviews366 followers
July 21, 2025
বইয়ের নাম সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর — শুনলেই একরকম আবেগ, একরকম প্রতিশ্রুতিময় প্রেমের আভাস পাই। কিন্তু বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় সেই প্রেম কখনও সহজে ধরা দেয় না। ধরা দেয় না বললে ভুল হবে — প্রেম আসে, কিন্তু সে পাঠকের আত্মা টেনে নিয়ে যায় এমন এক ঘোরের মধ্যে, যেখানে বিচ্ছেদ, দেহ, স্মৃতি, ক্রোধ, আর্তি — সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

এই বই কোনও সাধারণ গদ্য উপন্যাসমাত্র নয়, এটি এক বছরের মধ্য দিয়ে ঘটে যাওয়া এক মানসিক deconstruction-এর কাব্য, যেখানে কথক আর সোহাগিনীর সম্পর্কের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে আমাদের মস্তিষ্কেও।

Jacques Derrida বলেছিলেন, "Deconstruction is not a method, but what happens." আর এই উপন্যাসেও ঠিক সেটাই ঘটে—প্রেম আর বিচ্ছেদের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট রেখা থাকে না, আত্মজৈবনিক গদ্যের শরীর ক্রমে নিজের ভেতরের কাঠামো ভেঙে ফেলে, আবার তৈরি করে। এখানে ডিকনস্ট্রাকশন কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োগ নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা — যা ভাষা, শরীর আর স্মৃতির দোলাচলে নিজে থেকেই ঘটে যায়।

এই কথক একেবারেই কোনো detached, omniscient narrator নন—তিনি রক্তমাংসের, পীড়িত, ঘোলাটে চোখে জগত দেখা এক বিষাদগ্রস্ত মানুষ। যেন ঘরে বসে, মেঝেতে শুয়ে, একমুঠো ঘৃণা আর একমুঠো স্মৃতিতে ভিজে থাকা চিঠি খুলে পড়ছেন আমাদের সামনে। তাঁর বয়ান clinical না, বরং অসংলগ্ন, স্ববিরোধিতায় ভর্তি, খোলা, কাতর—একটা অবসাদের stream-of-consciousness।

এই একাকীত্বের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না সহজে। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় কথককে দিয়ে এমনভাবে লিখিয়েছেন যে, মনে হয় — "আমি" যেন এক জীবন্ত ধ্বংসস্তূপ, যার ভিতর দিয়ে প্রেমের, শহরের, সমাজের সমস্ত অবাঞ্ছিত অংশ প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁর ভিতরটা জনারণ্যে নিক্ষিপ্ত এক শূন্যস্থান, যে কথা বললেও কেউ শুনছে না, আর না বললেও তীব্র শব্দ তৈরি হচ্ছে। এই নিঃসঙ্গতা একান্ত ব্যক্তিগতও বটে, আবার যেন নিখাদ রাজনৈতিক—এই সম্পর্কহীনতার ভিতরে লেখক টেনে এনেছেন সমাজের ক্লান্ত, স্থবির, অবসন্ন চেহারা।

এখানে কথকের দূরত্ব—দর্শকের মতো, আবার অভিনেতার মতোও। একদিকে তিনি সোহাগিনীর শরীর, অস্তিত্ব, আত্মার দিকে এত কাছাকাছি চলে যান যে পাঠক যেন হাঁপিয়ে ওঠে—আর অন্যদিকে, তাঁর স্বর এতটাই ফাটলধরা, পিছু হটা, অথচ হঠাৎ হঠাৎ চিৎকারে ফেটে পড়া—যে মনে হয় তিনি নিজেকেই দেখতে পারছেন না ভালো করে। এই দূরত্বটাই “deconstruction” শব্দটাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে।

Derrida বলেছিলেন, “Deconstruction is not destruction. It’s a questioning of structures from within.” কথকের আত্মপাঠ সেই কাঠামো ভাঙে—প্রেমের, নৈতিকতার, ভাষার কাঠামো। এক নিঃসঙ্গ পুরুষ এক জীবনের ভেতর দাঁড়িয়ে নিজেকেই বারবার ভাঙছেন, নিজের ভিতরের প্রেমকে, স্মৃতিকে, আর তীব্র একঘেয়েমিকে প্রশ্ন করছেন।

এ উপন্যাসে নিঃসঙ্গতা একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। শহরের অন্ধকার অলিগলির মতোই, এই নিঃসঙ্গতা ঘুরে বেড়ায় প্রতিটি অনুচ্ছেদের কোণে। “আমি” বলতে গিয়ে, কথা বলতে গিয়ে, নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে, কথক যত না কিছু বলেন, তার চেয়ে বেশি কিছু না বলার মধ্যে রেখেই ফেলে দেন — যেন আমাদের হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করার আশায়।

সোহাগিনী কে? এই প্রশ্নটাই উপন্যাসের এক ধরণের ontological trigger, যেখান থেকে শুরু হয় এক জটিল পাঠ-অভিজ্ঞতা। সোহাগিনী কি সত্যিই এক ব্যক্তি? না কি সে এক বহুমাত্রিক গাঁঠছড়া, এক প্রতীকী entity—যার মধ্যে গেঁথে আছে প্রেমিকা, মা, পরিত্যক্তা, আত্মার সত্তা, এবং একই সঙ্গে, এক নৈঃসঙ্গ্যের অবসেশন?

এই নারী চরিত্র postmodern সাহিত্যের সেই archetypal woman-figure-এর মতোই — যিনি simultaneous ভাবে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত, যাঁকে এক দিকে স্পর্শ করা যায় (শরীরের মধ্য দিয়ে), আবার অন্য দিকে যিনি এক অলীক প্রক্ষেপ (projection), এক প্রতিচ্ছবি। একে Roland Barthes-এর text as a tissue of quotations বলেও ভাবা যায় — সোহাগিনী যেন পাঠকের এবং কথকের এক যৌথ কল্পনাশক্তির ফসল।

এই উপন্যাসে নারী—অন্তত সোহাগিনী—একটি floating signifier। সে বাস্তব নয়, বরং বাস্তবতার এক গহ্বর, এক absence, যেখানে পুরুষ কথকের অস্তিত্ব নিজেকেই খুঁজে ফেরে। কথকের কাছে সোহাগিনী শুধু প্রেমিকা নন, বরং এক ধরণের চিন্তনের interface—যাঁর শরীর, মুখ, চাহনি দিয়ে সে নিজের গভীর শূন্যতাকে চিনে নিতে চায়। কখনও তিনি তার কামনা, কখনও তার আতঙ্ক, কখনও এক অপরাধবোধের বিমূর্ত রূপ।

এখানে নারীর শরীর হয়ে ওঠে এক ভাষ্য, এক palimpsest, যা প্রতিবারই নতুন করে লেখা হচ্ছে, মুছে যাচ্ছে, আবার লেখা হচ্ছে। এটা postmodernism-এর একটা গভীর বৈশিষ্ট্য—the instability of identity—যা এই উপন্যাসে নারীর চরিত্র নির্মাণে দুর্দান্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাঠকের কাছে সোহাগিনী কখনও এক মৃতব্যক্তির স্মৃতি, কখনও এক বর্তমান অনুপস্থিতির তীব্রতা, আবার কখনও এক ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার শূন্যতা।

অন্যদিকে, কথক নিজেই ক্রমে এক দূরবর্তী পর্যবেক্ষকে পরিণত হন, যিনি intimate অথচ estranged—একজন simultaneously প্রেমিক ও পর্যবেক্ষক। এই “দূরত্ব” শুধু কথকের সোহাগিনীর থেকে নয়, বরং নিজের সত্তার ভেতরেও এক ভৌতিক দূরত্ব। সে যেন নিজের জীবনের এক দর্শক, এক পাঠক, এক ব্যর্থ সম্পাদনাকারী।

তাই বলা যায়, এই উপন্যাসের প্রেম narrative নয়, বরং এক ধরণের semiotic field, যেখানে সোহাগিনী ও কথক একে অপরের প্রতি ছায়া ফেলছে। তারা কেউই পূর্ণ নয়, কেউই ধরতে আসেন না—তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বই এই উপন্যাসের ট্র্যাজেডি, এবং সেইসঙ্গে তার কবিতা।

নাট্যধর্মিতা এখানে শুধু অলংকার নয়, বরং গদ্যের এক অন্তর্গত কাঠামো—একটা পরিসর যেখানে কথকের কণ্ঠস্বর দ্বিধাগ্রস্ত, আত্মবিভাজিত, প্রায়শই অবচেতনের অন্তরাল থেকে উঠে আসে। এই উপন্যাসের বহু জায়গা পড়তে পড়তে মনে হয় যেন মঞ্চের কোনও মেঘে ঢাকা একক নাটক (monodrama) চলছে—যেখানে আলো ঠিকঠাক পড়ছে না, দর্শক নেই, কিন্তু কণ্ঠ রয়েছে, এবং সেই কণ্ঠ একা। এই স্বগতোক্তি পাঠকের কানে নয়, যেন কথক নিজেকেই শুনছে, নিজের ভিতরেই ফেরে। এবং সেই "শোনা"র মধ্যে এক ধ্বস্ত-আত্মার অসহায় আর্তনাদ জেগে থাকে—যেটা নিছক ব্যক্তিগত নয়, বরং এক বিপন্ন সময়ের ইতিহাস-বিহীন আত্মপাঠ।

এই কণ্ঠস্বরটি মূলত একটি পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেদনাবোধের প্রতীক—যেখানে শ্রম নেই, উৎপাদন নেই, কেবল ব্যর্থতা, বর্জ্য আর ইচ্ছার মৃতদেহ পড়ে থাকে চারপাশে। এমন বাস্তবতায় শরীরই হয়ে ওঠে শেষ আশ্রয়—শরীর, তার বিকার, তার ক্ষত, তার ঘ্রাণহীনতা। এবং এই শরীর যখন উপন্যাসের ক্যানভাসে উঠে আসে, তখন তা পরিণত হয় এক কুৎসিত অথচ অবধারিত সত্যে। যেমন কথক যখন নারীর শরীর, তার অভ্যন্তর, তার বর্জ্য নিয়ে কথা বলে—তখন পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এটি নিছক পর্নোগ্রাফি নয়, এটি একটি ডিসকোর্সের টানাপোড়েন।

পোস্টমডার্নতায় শরীর একটি ভাষা—যা অভব্য, গ্রাহ্যহীন, কিন্তু দমন করা যায় না। এই টেক্সটে সেই শরীর-মাধ্যম একদিকে Desire-এর, অন্যদিকে Disgust-এর বহির্গমনপথ। কথকের এই ভাষ্য আর পাঠকের অস্বস্তি—দুটোই Dialectical ভাবে জড়ানো। পাঠক যেমন বিব্রত হন, তেমনি ভাবেন—কে এই বলছে? কেন বলছে? এই নোংরা কেন এত অনিবার্য? এই প্রশ্ন পাঠককে টেনে আনে পাঠ-অভিজ্ঞতার বাইরে, নিজের নৈতিকতা, সৌন্দর্যবোধ, ও আত্ম-ধারণার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

এই ডিসকোর্স আসলে Foucauldian power-knowledge এর মতোই—যেখানে জ্ঞান মানেই ক্ষমতা, আর শরীর মানেই সেই ক্ষমতার রাজনীতি। এই উপন্যাস নারীর শরীরকে objectify করে না, বরং সেই objectification-এর চরম পর্যায়ে পাঠককে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেয়—আমরা কতখানি সহ্য করতে পারি, আর কোথায় গিয়ে ভেঙে পড়ি।

এখানে নাটকীয়তা মানে কেবল theatricality নয়, বরং একটা existential dramaturgy—যেখানে মানুষের অস্তিত্বই যেন তার performativity দিয়ে নির্মিত। উপন্যাসের চরিত্ররা যেন একেকটা posthuman মুখোশ পরে, অভিন��় করছে—অথচ জানে না তারা চরিত্র, জানে না তারা পাঠকের দেখা হচ্ছে। এই self-awareness-এর অভাব, এবং কথকের সীমাহীন ভাষ্যচর্চা—দুটো মিলে একটা গোলকধাঁধার জন্ম দেয়, যেটা পাঠককে একা করে দেয়, ন্যাংটো করে দেয়।

শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসের ভাষ্য নিজেই এক মঞ্চ, এবং সেই মঞ্চে পাঠক যেমন দর্শক, তেমনি অভিনেতা—কারণ পাঠকের চেতনা না থাকলে এই স্বগতোক্তি কখনও পূর্ণতা পায় না। একে বলা যেতে পারে একরকম reader-response dramaturgy, যেখানে প্রতিক্রিয়াই প্রকৃত নাটক।

উপন্যাসটি ছোট ছোট অধ্যায়ে বিন্যস্ত হলেও তার গঠনগত প্রকৃতি রৈখিকতার গন্ডি ছাড়িয়ে বহুবিধ স্তর আর ছায়ার জটিল জ্যামিতিতে গাঁথা। সময় এখানে আর কোনো ধারাবাহিক প্রগতি নয়, বরং একটি গোলকধাঁধার মতো, যেখানে স্মৃতি আর বর্তমান, ঘুম আর জাগরণ, প্রেম আর বিতৃষ্ণা—সবই পরস্পরকে প্রতিস্থাপন করে, আয়নার ঘরে হারিয়ে যায়। এই বিন্যাস একপ্রকার anti-structure—যার মধ্যে post-industrial temporality-র এক গভীর অভিঘাত রয়েছে। সময় আর ব্যক্তি, প্রেম আর ভাষা—সব কিছুই এক অলক্ষ্য পলিমর্ফিকতায় মিশে যেতে থাকে।

এই উপন্যাসের ভাষা যেন এক poetic witness—একজন মানুষের গভীরতম সংকটের আত্মকাব্য। অনেক জায়গায় ভাষা গভীর, ছেদহীন, ধ্যানমগ্ন; আবার কখনও তা ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙা, কাঁচা, এমনকি অস্বস্তিকর। এই দ্বৈত স্বর, এই ভাষার কন্ট্রাস্ট—তা কোনো ত্রুটি নয়, বরং আত্মজিজ্ঞাসার শরীর। উপন্যাসটি যেন এক raw testimony—যেখানে কথক নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে তুলে ধরছে, নির্জন ঘরে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে নিজেরই ছায়াকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।

আর এই কথক যখন মঞ্চস্থ করে নিজের অভ্যন্তর, তখন তা শুধুই সাহিত্য নয়—তাতে theatre of existential discourse তৈরি হয়। অনেক জায়গায় তার স্বগতোক্তি মনে হয় একান্ত নাট্যপ্রয়াস—নিজেকেই যেন উচ্চারণ করছে কথক, পাঠক এখানে voyeur মাত্র। কিন্তু এই voyeurism আবার আরামে থাকার জায়গা নয়—এই উপন্যাস পাঠককে জোর করে ঠেলে দেয় এক গর্হিত দর্শনে, যেখানে নারীর শরীর, তার অন্তঃস্থলের অনাবৃত বাস্তবতা, এমনকি তার bodily waste—এইসবকিছু আলোচনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই নগ্নতা কোনও ভোগের উদ্দেশ্যে নয়—এইটিই abject realism—যার মাধ্যমে সমাজবদ্ধ পাঠককে নিজের ideological hygiene-এর মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়।

সোহাগিনী এখানে কেবল একজন নারী নয়, বরং একাধিক নারীপ্রতিভূর ছায়া, এক postmodern signifier, যার অর্থ নিরন্তর স্খলিত হয়। সে শরীরী প্রেমিকা, আবার এক maternal void, আবার এক আত্মিক longing-এর বিমূর্ত রূপ। তাঁর অস্তিত্ব এক unstable sign—যার শরীর কখনও করুণ, কখনও কামনাতুর, আবার কখনও শুধুই এক ধোঁয়া। এই fluid ontology-র মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি প্রশ্ন তোলে—কে ভালোবাসে? কে কামনা করে? কাকে? আদৌ কেউ থাকে কি? নাকি প্রেম নিজেই এক discourse, যাকে আমরা চিহ্নিত করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হই?

এইভাবে উপন্যাসটি প্রবেশ করে psychoanalytic dialectics-এর ভিতরে—যেখানে কথক নিজেই নিজের ইদ আর সুপার-ইগোর যুদ্ধক্ষেত্র। এই আত্মদ্বন্দ্ব, এই বোধ এবং অবচেতনের খেলা—তা কেবল সাহিত্যিক কৌশল নয়, বরং এক গভীর দর্শনচর্চা, যেখানে desire itself becomes the central antagonist।

এ উপন্যাস তাই প্রেমের নয়—বরং প্রেম-বিয়োগ-ভয়-ঘৃণা-মাতৃত্ব-লজ্জা—এইসব অনুভূতির একটি জটিল কোলাজ, যেখানে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি দৃশ্য একেকটা displaced myth, একেকটা collapsed narrative। এর closest literary cousins হতে পারে Jeanette Winterson-এর Written on the Body, Elena Ferrante-র Days of Abandonment, বা Toni Morrison-এর Beloved—সবকটিই এমন এক নারীবিষয়ক বয়ান, যেখানে শরীর আর আত্মা, প্রেম আর ক্ষয়, ভাষা আর নিরবতা একই কাঠামোয় ধাক্কা খায়।

শেষমেশ, এই উপন্যাস কেবল পাঠ নয়—এ এক performative wound—যেখানে পাঠককে শুধু ভাবায় না, জড়িয়ে ফেলে তার নিজের অন্ধকারের ভেতরে। এবং তখনই বোঝা যায়, এই বইয়ের আসল নায়ক আসলে তার পাঠক নিজেই।

উপন্যাসের গভীরে ঢুকলে আমরা দেখি, এখানে শরীর আর চেতনার দ্বন্দ্ব চলছে এক নির্মম সুরে। সেই দ্বন্দ্ব কখনও রূপ নেয় মরমি পর্যবেক্ষণে, কখনও তা হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক, অবমাননাকর, প্রায় নৃশংস। কথকের বলা—“সোহাগিনীর শরীরের সঙ্গে একটা অদ্ভুত রোগ বাস করে আমার”—এই বাক্যটি যেন পাঠকের সামনে খুলে দেয় এক জটিল ডিসকোর্সের দরজা। এই 'রোগ' কি শরীরের প্রতি আকর্ষণ? না কি সেই আকর্ষণ থেকে জন্ম নেওয়া অপরাধবোধ? নাকি কোনো বৃহত্তর বিচ্ছিন্নতা—post-industrial আত্মচেতনার একাকীত্ব যেখানে কাম, ভালোবাসা, ত্যাগ, হিংসা সব মিলেমিশে আছে এক অপরিণামদর্শী স্যাঁতসেঁতে ঘরে?

এই উপন্যাসে শরীর কোনো পবিত্র মন্দির নয়, আবার কোনো বিকৃত দর্শনের বস্তুও নয়। এটি এক contested site, যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি, যৌনতা, ক্ষমতার রাজনীতি আর আত্মপীড়নের বিভিন্ন স্তর এসে ধাক্কা খায়। শরীর যেন এখানে চেতনার মলিন ব্যাকরণে রচিত এক অসম্পূর্ণ গদ্য, যা পাঠককে বারবার প্রশ্ন করতে বাধ্য করে—কে দখলে রাখে শরীর? সমাজ? পুরুষ? নিজস্বতা? নাকি ক্ষত?

এই “রিমেক”-এর ভেতরেই আছে পোস্টমডার্ন কনফেশনালিজমের ছায়া—যেখানে কথক নিজেকে স্বীকার করে, উন্মোচন করে, আবার সেই স্বীকারোক্তির মধ্যেই থাকে প্রতারণা, অথবা ফাঁক। এই ধরনের পাঠ intertextual ভাবনাকেও আমন্ত্রণ জানায়—যেমন Michel Foucault-র History of Sexuality, যেখানে বলা হয় যৌনতা যতই গোপন হোক না কেন, তাকে প্রকাশ করবার জন্য এক ধরনের ‘আধুনিক বাধ্যবাধকতা’ তৈরি হয়েছে। ঠিক তেমনই, ‘সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর’ উপন্যাসটিতে যৌনতা আর শরীর—দুইই simultaneously শিকার এবং সাক্ষ্যদাতা।

এই উপন্যাসের ভাষা এক জায়গায় এসে হয়ে পড়ে প্রায় হিউম্যান ওয়েস্টের ন্যারেটিভ, যেখানে কাঁচা, অগোছালো, এমনকি কদর্য শব্দচয়নই হয়ে ওঠে সত্য বলার একমাত্র উপায়। এই র‍্য ‘raw testimony’—চকচকে নয়, প্রক্রিয়াজাত নয়, বরং একরকম বিচ্ছিন্ন আত্মার বায়োপিক, যা বারবার পাঠককে মনে করিয়ে দেয় Baudrillard-এর সেই ধোঁয়াশা—are we consuming the real, or the simulation of the real?

নারীর শরীরের বর্ণনায় লেখক একদম আপসহীন। না সেখানে পুরুষ দৃষ্টির traditional voyeurism আছে, না কোনো অনাবশ্যক স্তোত্র। এখানে শরীর, তার অভ্যন্তর, তার গন্ধ, তার বর্জ্য—সবকিছুই প্রকাশিত এক ধরনের confrontational ethics-এর মাধ্যমে। এটা যেন Julia Kristeva-র abjection ধারণার এক সাহিত্যময় প্রয়োগ—যেখানে 'অপর' হওয়া মানেই শুধু নিপীড়িত হওয়া নয়, বরং চেতনার সীমান্তে অবস্থান করা।

উপন্যাসটি তাই পাঠকের কাছে হয়ে দাঁড়ায় এক দ্বান্দ্বিক অভিজ্ঞতা—কীভাবে আমরা ভালোবাসি, ঘৃণা করি, ত্যাগ করি, অথচ সেইসব অনুভবের অভ্যন্তরীণ মেথডোলজি বুঝি না। এই অনবধানী প্রেম, অপূর্ণ শরীর, বিক্ষিপ্ত সময়, আর বেহিসেবি মনস্তত্ত্ব—সব মিলিয়ে ‘সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর’ এক পোস্টমডার্ন মিথস্ক্রিয়া, যেখানে linear causality নেই, বরং আছে fragmented identity, memory loops আর discourse-এর আত্মঘাতী প্রবাহ।

শেষ পর্যন্ত, উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে থাকে এক আত্মবীক্ষার কাঠগড়ায়। পাঠককে এখানে voyeur বানায় না, complicitor বানায়—তাকে টেনে নিয়ে যায় সেই গুহার ভেতর, যেখানে প্রেম নয়, শরীর নয়, ভাষা নয়—বাস করে কেবল এক পলায়নপর সত্য।

আপনি যদি Derrida বা Kristeva-কে পড়েন, কিংবা Elena Ferrante বা Samuel Beckett-এর জগতে ডুবে থাকেন, তবে এই উপন্যাসটির মধ্যে আপনি খুঁজে পাবেন সেইসব প্রশ্নের একটি সম্ভাব্য, অপরিণত অথচ ঝলমলে উত্তর হিসেবে — যেখানে নিজেকে রক্ষা নয়, উন্মোচনই একমাত্র মুক্তি।

এই উপন্যাসকে যদি একটি বহুস্তরীয়, বহু-অভিজ্ঞতার মানচিত্র ধরে নিই, তবে তার প্রান্তর ছুঁয়ে যায় একাধিক সাহিত্যিক ও দার্শনিক ধারাকে। William Faulkner–এর মতো এখানে সময় এক ব্যাধিগ্রস্ত স্পাইরাল, যা স্মৃতি ও বাস্তবতার পার্থক্যকে অবলীলায় মুছে দেয়। Jeanette Winterson যেমন শরীর ও ভাষার ভেতর একটি labyrinthine eroticism তৈরি করেন, তেমনই এখানেও নারী-পুরুষ সম্পর্ক এক ভাষাহীন সংলাপে রূপ নেয়। Kobo Abe–এর The Woman in the Dunes–এর মতোই, এই উপন্যাসেও ‘নারী’ হয়ে ওঠে এক অস্তিত্বগত সংকটের কূপ—যেখানে কাম, গ্লানি, বন্���িত্ব ও মুক্তির ইচ্ছা একসঙ্গে মিশে থাকে। আবার Clarice Lispector–এর poetic fragmentation এখানে প্রভাব ফেলে ভাষার ছন্দে, যেমন Bret Easton Ellis–এর সাহিত্যে দেখা যায় নগর-উত্তর বিষণ্ণতা ও নৈতিক শূন্যতার বিষণ্ণ বহিঃপ্রকাশ। আর সবচেয়ে গভীরে, Elfriede Jelinek–এর মতো, লেখক নারী-পুরুষ সম্পর্ককে ছেদন করেন নির্মম, বীভৎস ও শরীর-সত্যান্বেষী এক ভাষায়—যা যতটা গ্লানি তৈরি করে, ঠিক ততটাই পাঠককে টেনে নিয়ে যায় অস্তিত্বের এক অনিবার্য দ্বন্দ্বে।

বিশেষভাবে চোখে পড়ে, কীভাবে লেখক শহরকে শুধু পটভূমি হিসেবে আনেন না—বরং একে পরিণত করেন চরিত্রে। এই শহর ফ্ল্যাটবাড়ির অন্তঃসারশূন্য��া, অফিসের মেট্রোনোমিক ক্লান্তি, মোবাইলের নীল আলো, ডিপ্রেশনের রিমাইন্ডার, আর থেরাপির সফট বালিশে মুখ গুঁজে রাখা আত্মচিৎকারের কোলাজ। নাগরিকতা এখানে আর কোনও ‘উন্নয়নের’ বারোমাস্যা নয়; বরং এক গভীর ঘূর্ণিপাক, যেখানে সম্পর্ক শুধু গড়ে না—ভাঙে, পচে, ঝরে পড়ে ক্যালেন্ডারের পেছনে। সোহাগিনীর শরীর যেন সেই শহরেরই গোপন মানচিত্র—যেখানে বাসস্টপের মতো থামে স্নেহ, গলির মতো হারিয়ে যায় কাম, আর কখনও সখনও শ্মশানের মতো নীরব হয়ে থাকে ভালোবাসার অপচয়।

এই উপন্যাসের পাঠে একাধিক সাহিত্যিক স্তর ভেদ করে যেতে হয়—যেন কোনো খনিজ-সমৃদ্ধ ভূগর্ভে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, যার প্রতিটি স্তর থেকে উঠে আসে নতুন অভিঘাত। হ্যানিয়া ইয়ানাগিহারার A Little Life মনে পড়ে—সেখানে যেমন জুডের শরীর ও মনের ক্ষত জুড়ে গড়ে ওঠে এক জটিল অথচ গভীর সহানুভূতির ন্যারেটিভ, এখানেও তেমনই, সোহাগিনীর শরীর ও সম্পর্কের ভেতর দিয়ে লেখক যেন পাঠককে প্রবেশ করান এক রক্তাক্ত, অন্ধকার অথচ অস্বীকার করা যায় না এমন বাস্তবতায়।

তবে, A Little Life-এর তুলনায় এই উপন্যাসে আত্মবিসর্জনের বদলে রয়েছে এক অন্তর্গত অস্ফুট অভিশাপ—একটা slow poison যা সম্পর্ককে, শরীরকে, স্মৃতিকে ধরে রাখে অথচ পচিয়ে দেয়। এটা redemption-এর গল্প নয়, therapy-এর ফিকশনও নয়, বরং একটা "জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট"।

জেমস জয়েসের Ulysses এর কথাও স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে—এই উপন্যাসেও প্রতিদিনকার নাগরিক মুহূর্ত, ট্র্যাজেডি, ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা, আদি অভ্যাস এবং বেহায়া বাস্তবতার মধ্য দিয়ে কথক নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে ফিরছে, ঠিক যেমন ব্লুম খুঁজছিলেন। তবে এখানে সেই খোঁজা হয়ে দাঁড়ায় একরকম অ্যালেনিয়েশন-এর শৈল্পিক ডকুমেন্টেশন।

নারী শরীর ও প্রেমের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, অনুভূতির ‘লিরিক্যাল ডিসেকশন’-এ বইটি যে এলেন সিক্সু-র feminist écriture féminine ট্র্যাডিশনে পড়তে পারে, তা স্পষ্ট। সোহাগিনী হয়ে ওঠেন এক flesh-text—যার প্রতিটি আঁচড়, গন্ধ, প্রতিক্রিয়া একটা larger narrative ধারণ করে। এলেন সিক্সু যেমন লিখেছিলেন “Write yourself. Your body must be heard,” এই উপন্যাসেও আমরা শুনি এক নারীর শরীরকে—not as a sexed object, but as a site of memory, trauma, power, decay, resistance.

মার্গারেট ডুরাসের The Lover বা The Ravishing of Lol Stein এর দিকেও বইটি চেয়ে থাকে—সেখানে যেমন নৈঃশব্দ্য, ইঙ্গিত, অনুভব, প্রেম ও অবসাদের ঘন মিলনে তৈরি হয় এক প্রতিমা, এই উপন্যাসেও আমরা একইভাবে পাই ছিন্নভিন্ন সম্পর্ক ও আত্মশক্তির মিশ্রণে গড়ে ওঠা এক কাব্যিক ধ্বংসস্তূপ।

এছাড়াও হরুকি মুরাকামির Norwegian Wood বা এলেন ফিন্ডারম্যান-এর Love's Executioner-এর মতো থেরাপিউটিক কনফেশনাল ঘরানার লেখাগুলোর ছায়াও এখানে দ্যুতিময়। তবে ‘সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর’ তাদের মতো এত সহজে নিরাময়ের গল্প বলে না, বরং এখানে চিকিৎসার চাইতে রুগ্নতার সৌন্দর্যই বড় হয়ে ওঠে।

এইসব তুলনার ভেতর দিয়েও এ উপন্যাস শেষমেশ দাঁড়িয়ে থাকে নিজের শরীরের ভেতরেই। সোহাগিনীর শরীর হয়ে ওঠে এক শহরের মানচিত্র, এক অচেনা যুদ্ধক্ষেত্র, এক আশ্চর্য বেদনার অভিধান। আর কথকের যাত্রা হয়ে ওঠে এক perpetual dérive—নির্দেশহীনভাবে হেঁটে চলা, চেনা রাস্তায় অচেনা হয়ে ওঠা। এই বই পড়ে শেষ করলে মনে হয়, যেন একেবারে নিজের ভেতরের কোনো স্থানে বসে আছি—আলোর বাইরে, শব্দের নিচে।

ঠিক এভাবেই বলা যায়, “সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর” সেই বিরল উপন্যাসগুলির মধ্যে পড়ে, যা পড়ার পর পাঠক নিজেকেও খানিকটা খুলে ফেলতে বাধ্য হয়। যেন আয়নায় তাকানো, যেখানে নিজের গোপন ক্ষতগুলো আচমকা ধরা পড়ে—না চাইলেও।

এই উপন্যাসের সঙ্গে আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া যায় হ্যানিয়া ইয়ানাগিহারার A Little Life-এর মতো ট্রমার দীর্ঘশ্বাসভরা গদ্যে—যেখানে সম্পর্ক, নির্যাতন, বন্ধুত্ব, প্রেম—সবকিছু এক ভয়াবহ মানসিক নিঃসঙ্গতায় মিশে যায়। আবার Ulysses-এ যেমন লিওপোল্ড ব্লুম প্রতিদিনের ক্লান্তিকর, সুনির্দিষ্ট, আপাত অর্থহীনতা থেকে এক অন্তর্জগতে প্রবেশ করেন, এখানেও কথকের দিনযাপন একইভাবে রূপ নেয় এক অভ্যন্তরীণ ও চেতনা-ভ্রমণে।

আর এক্ষেত্রে নারীর শরীর, তার প্রেম ও অবসেশন যেমন ঘনীভূত হয়, তা আমাদের ঠেলে দেয় এলেন সিক্সু বা মার্গারেট ডুরাস-এর লেখার দিকে, যেখানে নারী দেহ এক দেহরাজনীতি, এক অন্যতর আত্মজীবনী, এক স্মৃতি-মোচন ও উন্মোচনের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। সোহাগিনীকে কখনও পাঠ করা যায় শরীরের অনুপুঙ্খে লেখা এক ম্যাপ হিসেবে, কখনও সে নিছকই শরীর নয়—এক হেলাফেলা করা অস্তিত্ব, এক মহিলার চোখে আত্মানুসন্ধানরত পুরুষের ছায়াচিত্রও।

এই আত্মানুসন্ধান আবার নিয়ে যায় মিশেল ওয়েলবেক বা ক্লারা ডুপন্ট-মোনো-র দুঃখে-ভেজা পুরুষ চরিত্রদের দিকে, যারা প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতা এবং যৌনতাকে এক existential অভিজ্ঞতায় পরিণত করে। এই উপন্যাসের কথকও ঠিক সেভাবেই ধ্বংসের ভিতর প্রেম খোঁজে, কিন্তু প্রেম তাকে উদ্ধার করে না, বরং কেটে দিয়ে যায়।

বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে, উপন্যাসটি অনুরণন তোলে জয় গোস্বামীর হিংস্র প্রেমিক কণ্ঠস্বর-এর মতো, যেখানে কাম ও ক্রোধ হাত ধরাধরি করে চলে। আবার সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের “Epical বোধের ভাইরাস”—যেখানে প্রেম এক আন্তঃশরীরগত ভাষা, অস্থির ও ক্লান্ত, তবুও প্রগাঢ়—তার সঙ্গেও এ উপন্যাসের রক্তসম্পর্ক আছে।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও, “সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর” নিজেই এক singular ঘটনা। এক নিঃসঙ্গ, বেসুরো চিৎকার—যেখানে নির্দোষ বা দোষী বলে কিছু নেই, আছে কেবল মানুষ—তাদের ভাঙন, কাম, আর ক্রমাগত নিজের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার একটি মন্থন। কেউ কাউকে উদ্ধার করে না, কেউ কাউকে ছাড়ে না, শুধু এক বছর ধরে দুটো আত্মা একে অপরের ক্ষত ঘেঁটে ঘেঁটে ভালোবাসে—অথচ সেই ভালোবাসা একরকম অসুস্থ, একরকম ক্লান্তিকর, একরকম তীব্র... এবং অস্বস্তিকরভাবে বাস্তব।

এই বাস্তবতা—এই মেলানকলি, এই স্পষ্টতা—এইটুকুই যেন উপন্যাসটির প্রকৃত প্রেমপত্র। এক অর্ধেক লেখা চিঠি, যেটা কখনও শেষ হবে না।

শেষমেশ এই উপন্যাস একধরনের catharsis, একরকম psychic exfoliation—নিজেকে ছেঁচে তুলে ফেলা যতক্ষণ না ভেতরের শেষ শূন্যতাটা বেরিয়ে আসে।

বাংলা সাহিত্যে এমন অপ্রতিহত, নগ্ন, yet lyrical আত্মজিজ্ঞাসার জায়গা বিরল। এটি একটি কঠিন পাঠ—অসুখের মতো সংক্রামক—কিন্তু এর central core-এ একবার ঢুকে পড়লে বেরিয়ে আসা মুশকিল।

ঠিক যেন সেই সোহাগিনীর মতো, যাকে ভুলতে চাইলেও সে থেকেই যায়—এক বছর, বহু বছর, একজীবন।

লেখক
Displaying 1 of 1 review

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.