উত্তম পুরুষের বয়ানে লেখা এই স্মৃতি-আলেখ্যটি শৈশব কৈশোর এবং সদ্য যৌবন প্রাপ্তির সময়গুলিকে অবলম্বন করে উপনীত হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। ঠিক নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনযাপনের স্মৃতিকথা বা প্রথাসিদ্ধ কাহিনি কথন নয়, পাঠক এই জীবন-প্রব্রজ্যার কথকতায় পাবেন দেশভাগ-উত্তর পুব বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রান্তিকতম জনজীবনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং সাম্প্রদায়িক জীবনযাপনের তথা পারস্পরিক সম্পর্কের এক বস্তুনিষ্ঠ দলিল-যা হিন্দু মুসলমানের স্বাভাবিক জীবনযাপনের মানবিক দিকটিকে প্রোজ্জ্বলভাবে ব্যক্ত করেছে। রচনার ভরকেন্দ্রের আশ্রয় হিসাবে রয়েছে পল্লিজীবনের কৌমপরম্পরার একদার লোক-সাংস্কৃতিক বিচিত্র কর্মকা-ের ব্যাপক স্মৃতিমেদুরতার বিবরণ। আর আছে ছিন্নমূল জীবনের বিষন্নতা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের এবং পুনরায় স্বপ্ন নির্মাণের সংগ্রামের তথা বিজয় অর্জনের প্রত্যয়ের কথা।
Mihir Sengupta is an Indian writer of Bengali origin, best known for his 2005 autobiography Bishaad Brikkho (Tree of Sorrow). It describes the 1947 partition as seen by the author, who was uprooted from his native Barisal in present-day Bangladesh and ended up in Calcutta as a refugee. Bishaad Brikkho is regarded as an important literary document of the 1947 partition and won the Ananda Puroshkar literary prize. His current residence is in the West Bengal state of India.
লেখার হাত অসম্ভব সুন্দর এজন্য দুই তারকা দিলাম। তিন তারকা কেটে নিলাম কারণ -
১. এই বই পড়লে মনে হবে দেশভাগ হওয়ার জন্য, বাংলা বিভক্ত হওয়ার দায় একমাত্র বাঙালি মুসলমানের। শুধু সাম্প্রদায়িক মনোভাব বুঝি বাঙালি মুসলমানই পোষণ করে। মিহির বাবু পড়াশোনা জানা লোক। তবুও জয়া চ্যাটার্জির 'বাঙলা ভাগ হলো ', বিমলানন্দ শাসমলের 'ভারত কী করে ভাগ হলো ' পড়তে ভালো করতেন। তাহলে অন্তত বাংলাভাগের দায় একমাত্র বাঙালি মুসলমানের ঘাড়ে চাপাতেন না। তিনি তো ১৯৬৩ তে এদেশে টিকতে না পেরে ভারতবাসী হন, ভারতের মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে তো টুঁ শব্দটি করলেন না। এখানে দেশভাগপরবর্তী সময়ে যেমন সংখ্যালঘু হিন্দুরা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছিল তেমনি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা খুব কী সুখে ছিল? কিংবা আছে? রামচন্দ্র গুহর 'India After Gandhi' পড়লেই বোঝা যায় ওপারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা হয়েছিল কেমন।
সাম্প্রদায়িকতার রোগে পুরো সম্প্রদায় কখনো আক্রান্ত হয় না। এই বিষ সম্প্রদায়ের কতিপয় পশুর দেহে থাকে। তা দুইদেশেই বিরাজমান। মিহির বাবুর স্মৃতিকথা পড়লে মনে হবে অপরপক্ষ 'দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা'।
এই বইটা পড়ার পর বদরুদ্দীন উমরের আত্মজীবনী 'আমার জীবন' এর পয়লা খন্ড পড়ুন। বুঝবেন মিহির বাবু বাঙালি মুসলমানদের যেসব আচরণের কারণে সাম্প্রদায়িকতায় দুষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন, বদরুদ্দীন উমরের পরিবার দেশভাগের পর ভারতে থাকার সময় একই আচরণের শিকার হয়েছেন সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দ্বারা, রাষ্ট্রের দ্বারা। একপর্যায়ে তাঁর পরিবার বাধ্য হয়েছিল তাঁদের বর্ধমানের পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে এদেশে পাড়ি দিতে।
২. লেখক বোঝাতে চেয়েছেন তিনি ইসলাম নিয়ে অল্প-বিস্তর জ্ঞানার্জন করেছেন। ইসলাম নিয়ে তাঁর জ্ঞানের বহরের পরিচয় ২১৬ পাতায় পাবেন। সেখানে তিনি ইবলিস কে লিখেছেন ইবলিস আলায়েসালাম লিখেছেন! অভিশপ্ত ইবলিসকে মুসলমানরা সম্মানসূচক আলায়েসালাম ( এটা ভুল) আলাইহিসসালাম কখনোই বলে না। এই হলো মিহির বাবুর ইসলাম নিয়ে জ্ঞান।
৩. স্মৃতিকথায় সন,তারিখ গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু সময়কে সুনির্দিষ্টভাবে ধারণ করছেন। অথচ সেই সময়ে যা আদৌ ঘটেইনি তাও ঘটেছে বলে চালিয়ে দিচ্ছেন এ তো মশাই রীতিমতো ধাপ্পাবাজি। তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন ১৯৬৩ সালে। অথচ আইয়ুব শাসনামলের কথা লিখতে গিয়ে লিখলেন তখন নাকী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়! এতো একেবারে ভুল তথ্য। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ১৯৬৮ সালে দায়ের হয়। সরকার বাধ্য হয়ে মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেন ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। অথচ মিহির বাবু লিখছেন ১৯৬২ সালে তিনি বিএম কলেজে পড়াকালেই নাকী এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। অদ্ভুত কল্পনা শক্তি দাদার! ইতিহাস পালটে দেওয়ার মতো কম্ম অনায়াসে করে ফেললেন।
এই গ্রন্থ আনন্দ গোষ্ঠীর পুরস্কার পেয়েছে। অসংখ্য ভুল তথ্য, বিভ্রান্তকর বর্ণনায় ভরা এই বইতে বাংলাদেশ এবং বাঙালি মুসলমানকে একপেশেভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই আনন্দ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্যই আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন অসম্ভব শক্তিশালী গদ্য লেখার ক্ষমতার অধিকারী মিহির সেনগুপ্ত। তসলিমা নাসরিনের বিতর্কিত 'লজ্জা' উপন্যাসকেও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল আনন্দ গোষ্ঠী। বিস্তারিত জানতে আহমদ ছফার 'সাক্ষাৎকার সমগ্র ' পড়তে পারেন। আনন্দ গোষ্ঠীর কার্যকলাপ সম্পর্কেও সম্যক একটি ধারণা পাবেন।
দেশভাগের স্মৃতি মুসলমান কিংবা হিন্দু বা শিখ কারোই সুখকর নয়। এরজন্য এককভাবে কোনো সম্প্রদায়কে দায়ী করার আগে পড়াশোনা করা উচিত। দেশভাগ নিয়ে একপেশেভাবে লিখলে শুধু নিজেই অসম্মানিত হওয়ার ভয় থাকে না, আপন আপন সম্প্রদায়কেও দায়ী করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।
ক্ষমতা লিপ্সু রাজনৈতিক নেতাদের মসনদে আসীন হবার তাড়াহুড়োয় রেডক্লিফের কলমের ধারালো অংশে কাটা পড়ে দু'টুকরো হয় বিশাল ভারতবর্ষ। রাতারাতি পালটে যায় কোটি মানুষের ভাগ্যরেখা। দেশের স্বাধীনতার নামে পরাধীন মানবিকতার এমন নজির মানব ইতিহাসে খুবই বিরল! এই বিপন্ন পরিস্থিতির ফাঁদে আটকে পড়া মানুষের হতাশা, ক্ষোভ কিংবা ভেসে যাওয়ার কাহিনীর প্রতি ক্ষমতার রাজনীতিতে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকার কথা নয়। ধর্ম আর মানুষই যাদের ক্ষমতা হাসিলের দাবার ঘুটি তাদের কাছে এমন পরিস্থিতির সম্ভাবনার কথা উপেক্ষিত থাকারই কথা। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। ১৭ আগস্ট ১৯৪৭, ভারত-পাকিস্তান বাউণ্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান সিরিল রেডক্লিফ(Cyril Radcliffe ) সীমানা নির্ধারণ রেখা(রেডক্লিফ লাইন) প্রকাশের আগেই তড়িঘড়ি ভারত ছাড়েন। যাবার আগে তার সৎ ছেলের উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে বলেন, "আট কোটি অসন্তুষ্ট মানুষ আমার সন্ধান করবে। আমি চাইনা তারা আমাকে খুজে পাক”(সূত্রঃ তের মাসের সূর্যকিরণ/লেখকঃ আজিজুল জলিল)। রেডক্লিফের নকশা অনুযায়ী দেশ ভাগ হলেও তাঁকে কতটা দায়ী করা যৌক্তিক আমরা নিশ্চিত নই। কেননা ১৭৫,০০০ বর্গমাইলের বিশাল একটা দেশকে ভাগ করার জন্য যথেষ্ট উপকরণ সরবরাহ না করে, তাকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল মাত্র ৫ সপ্তাহ। ভূমিকে দু'টুকরো করে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয় নেহেরু ও জিন্নাহর নেতৃত্বে। যে নেতৃত্ব ক্ষমতায় গিয়ে রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে পড়া এসব সাধারণ মানুষের কথা মনে রাখার বিষয়ে না দেখিয়েছেন সততা, না সহমর্মিতা।
'পাকিস্তান কায়েম করার সময় ..নিম্নবিত্ত নিম্নবর্গ তথা নিম্নবর্ণের মানুষদের সমর্থনের জন্য মুসলিমলীগ এক অভিন্ন স্বার্থের কথা বলেছিল। লাঙ্গল যার জমি তার এমন 'নারা' লাগিয়েছিল' যা পরবর্তীতে বিস্মৃতির খপ্পরে চলে যায়। কোনো পক্ষের নেতারা বিশেষত মুসলিগপন্থীরা " This land is your land/This land is my land/ This land was made for you and me/You got to believe that." এমন উক্তিকে কাজে প্রতিষ্ঠা করে দেখাতে পারেননি। বলাই বাহুল্য দেশভাগের কুফল ভোগ করতে হয় অন্তত কোটিখানেক সাধারণ মানুষকে।
নিজের সাতপুরুষের ভিটেবাড়ি আর জন্মস্থানচ্যুতির সেই নির্মম ইতিহাস নিয়ে যেসব কাহিনী লেখা হয়েছে তার মধ্যে মিহির সেনগুপ্তের "বিষাদবৃক্ষ" যেন কিছুটা আলাদা। 'আমাদের সাহিত্য এবং সমাজবিজ্ঞান এমন একখানা গ্রন্থের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিল'- বইয়ের ফ্ল্যাপে উদ্ধৃত এই কথাগুলোকে শুরুতে অত্যুক্তি মনে হবে হয়ত। কিন্তু বইটি পড়া শেষে পাঠক অনুভব করবেন কথাটা মর্মে মর্মে কতটাই সত্যি। যদিও ছক মেনে গুছিয়ে লেখক তাঁর চিন্তাভাবনা গুলোকে ধারাবাহিকভাবে হয়ত লিখেননি। পরের কথা আগে, আগের কথা পরে এসে গেছে। তবে এতে করে লেখার সাবলীলতা খুব একটা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে হয়নি। অবশ্য লেখক নিজেও সেকথা স্বীকার করেছেন অকপটে। "পুরোনো কথা বলার এই মুশকিল, কথা ক্রমবিন্যাসে আসে না।"
'বিষাদবৃক্ষ' মূলতঃ আত্মজৈবনিক লেখা। মিহির সেনগুপ্ত যাকে 'কালচারাল এনথ্রোপলজি বলার চেষ্টা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বইটার পরিসর ১৯৫১/৫২ থেকে ১৯৬১/৬২ দশ বছর সময়কালে বিস্তৃত। শুরুতেই লেখক তাঁর জন্মস্হান বরিশালের ঝালকাঠির কেওড়া গ্রামের প্রান্ত বেয়ে বয়ে চলা খালটির সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন। যাকে সেসময় স্হানীয় ভাষায় 'পিছারার খাল' নামে অভিহিত করা হতো। সেই পিছারার খাল দিয়ে দক্ষিণের মহাল থেকে আগত নৌকা এবং তার মাধ্যমে আনা সামগ্রীর বর্ণনায় জানা যায় মিহির ছিলেন সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী পরিবারের সন্তান। যে পরিবারের আভিজাত্য ছিল তৎকালীন আর দশটা ভূস্বামী পরিবারের আদল মাফিক আড়ম্বরপূর্ণ । লেখকের ভাষায়, "বাড়ির আভিজাত্য তখন তিনতলার ছাদ ছাড়িয়েও প্রায় বারো হাত উঁচু্।"
পিছারার খালের উপর দিয়ে সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে চারপাশে ঘটে যেতে থাকে নানান সামাজিক উত্থান পতনের ঘটনা। যার নীরব সাক্ষী খালপাড়ের জোড়া রেইনট্রি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের জটিলতা আজীবন পাশাপাশি বসবাস করা মানুষগুলোর বুকে কুটিলতার জন্ম দেয়। যার পরিণতিতে নগেন মশাইয়ের অবাধ উঠানে শৈশবের হাডুডু খেলার লোনতা ১, লোনতা ২ এর ডাকে সাড়া দেবার মুখগুলো ক্রমশঃ কমে যেতে থাকে। বলা হতে থাকে পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ, হিন্দুদের জন্য হিন্দস্তান!
৫০ এর দাঙ্গা বরিশালে খুব বেশী প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও পরবর্তীতে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হিন্দু সম্পত্তি দখল, সরাসরি হত্যায় না গিয়ে মেয়েদের সম্মানহানি সহ নানান বিভীষিকা ছড়িয়ে হিন্দুদের সম্পত্তি সস্তায় কিনে তাদের দেশ ছাড়া করার যে পরোক্ষ অজাচার শুরু হয় তার ভয়ে সম্পদের ভার মুসলমান তালুকদারদের হাতে গচ্ছিত রেখে রাতারাতি ভারত পাড়ি দেয়া বক্সিবাবুদের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকার মুখেও মিহিরের পরিবার সহ আরো কিছু পরিবার জন্মভূমির মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। মিহিরের বুড়ি পিসিমায়ের দেখা স্বপ্ন যেন তাদের তখনো আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিল, "...হিন্দুস্তান পাকিস্তান বেয়াক ভাগাভাগি মিডইয়া গেছে। বেয়াক কিছুই আবার আগের ল্যাহান। গোলায় ধান, পুহইরে মাছ, গাছে ফলফলাদি..."
এদিকে কোনো রকম পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিয়ে মধ্যস্বত্ব প্রথার বিলোপ, পরিবারের কর্তাদের বিশেষতঃ মিহিরের বাবার সংসার বিষয়ে নিদারুণ উদাসীনতা, জ্যাঠামশাইয়ের শঠতা ইত্যাদির সম্মিলিত আঘাতে মিহিরের পরিবারে নেমে আসে অশেষ দুর্গতি। যার বর্ণনা দিচ্ছেন লেখক এভাবে, " সামন্ত বিক্রমের নাভিশ্বাসের কারণে তাঁদের(পরিবারের কর্তাগণ) রুচিরও বিকৃতি ঘটতে শুরু করেছে। বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোনও ব্যাপারেই তাঁদের চিন্তা ভাবনা নেই। শিক্ষা তো দূরস্থান। তাঁদের দুটো জিনিসই তখন আছে। একটি অতি প্রাচীন ধ্বংসোন্মুখ অট্টালিকা এবং সেই অট্টালিকার প্রতিটি ইটের খাঁজে সাজানো এক কিংবদন্তির আভিজাত্য। কত কঠিনভাবেই না সেই সময় আমরা এই মিথ্যে আভিজাত্যের মূল্য দিয়েছি, সে ইতিহাস বর্ণনা দুরুহ।"
দুরূহ সে ইতিহাস বর্ণনার চেষ্টায় মিহির যেন জোড়া রেইনট্রিতে বসে থাকা রূপকথার ব্যাঙমার মত এক বিষাদ পাখি। পরম মমতায় যিনি হৃদয় খুঁড়ে বেদনাময় অতীতকে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। সে অতীত কথনে ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের পাশাপাশি উঠে এসেছে ক্রমশঃ পরিবর্তিত সমাজ, তার আচার আচরণ। রাজনৈতিক নেতাদের গোপন কলকাঠির যোগসাজশে সমাজে ঘটতে থাকা বিশৃঙ্খলতার উৎকট স্বরূপ। বাংলা ভাষা তথা সাহিত্যকে হিন্দুয়ানি মুক্ত করার একরোখামি যা থেকে খোদ কবি নজরুলও রক্ষা পাননি। নজরুলের কিছু কবিতার হিন্দুয়ানী শব্দও পাল্টে দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া গ্রামীণ নানান পালা পার্বণ, আচার অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি। ধর্মভিক্তিক নানান আনন্দ অনুষ্ঠানে অন্যধর্মের মানুষের অবাধ অংশগ্রহনের পথে বাধা দেবার প্রথা চালু ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে একজন সংবেদনশীল দর্শকের মতই মিহির বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছেন। যা বইটাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বইটির সূচনাকালে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্কের যে সৌহার্দ্যরূপ দেখে মুগ্ধ হতে হয়, শেষের দিকে পৌঁছালে সম্পর্কটা এমন কুৎসিত অমানবিকতায় রূপ পায় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য কী কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তখন। এই যে সম্পর্কের অধঃপতন বা পরিবর্তন তার পেছনে কাজ করেছে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। কেননা বইয়ের সূচনাকাল ১৯৫২ দেশ ভাগের বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা হলেও তখনো সংখ্যালঘু হিন্দুদের বৃহৎ অংশ দেশত্যাগের কথা ভাবেনি, যেমন মিহিরের নিজের পরিবার। অতঃপর ‘পাকিস্তান শুধু মুসলমানের দেশ, হিন্দুদের হিন্দুস্থান’ – এই মানসিকতা একটা রাজনৈতিক মহল থেকে সুকৌশলে প্রবেশ করানো হয়েছিল মুসলমানদের একটা অংশে। সেই সময় সুযোগসন্ধানী মুসলমানদের একটা অংশ নানানভাবে হিন্দুসম্পত্তি গ্রাস করার মানসিকতায় প্রতিবেশীদের সাথেও ঝামেলা পাকাতে থাকে। যেটাকে শুধু ঝামেলা বললে ঠিক বোঝানো যায় না। একটা পরিবারের সম্পদ গ্রাস প্রক্রিয়া শুরু হয় সম্ভ্রম লুণ্ঠনের মাধ্যমে। যে অঞ্চলের মানুষ শত বছর ধরে জমিজমার দাঙ্গা হাঙ্গামা কিংবা ডাকাতি রাহাজানিকে ভয় পায়নি, সেই এলাকার মানুষ সম্ভ্রম লুণ্ঠনের ভয়ে সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে পাড়ি দিতে শুরু করে অচেনা এক দেশে। যে দেশের সাথে ধর্ম ছাড়া আর কিছুর সাথে তার পরিচয় নেই।
বিষাদবৃক্ষ বিষয়ে, স্পষ্ট করে বলতে গেলে লেখক বিষয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয়। একজন লেখককে ধর্মের উর্ধ্বে রেখেই সব সময় তাঁর সৃষ্টিকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। সেখানে কে হিন্দু, কে মুসলিম বা খ্রিস্টান বাছবিচারের প্রশ্ন আসে না। তবুও এর আগে এ বিষয়ে যে দু'একটা বই পড়বার সুযোগ হয়েছে, সেখানে লেখককে কোন একটা পক্ষের বক্তার ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। ‘বিষাদবৃক্ষ’ যেন এ থেকে অনেকটাই মুক্ত। এখানে লেখক অকপটে দুই ধর্মের মানুষ, তাদের আচার বিধি কর্মপদ্ধতির আলোচনা/ সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। ইসলাম ধর্মের আচার বিধি সম্পর্কে লেখকের জ্ঞান, আন্তরিকতা যেমন পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না, একইভাবে হিন্দু ধর্মের নানান দেখানেপনা, নিজ পরিবারের অন্তঃসারশূন্য বাগাড়ম্বর ইত্যাদি নিয়ে বলতে দ্বিধাগ্রস্থ হতে দেখা যায়না। দ্বিধাহীনভাবেই মিহির তাই লিখতে পারেন " ..দোষে গুণে আমরা উভয় সম্প্রদায়ই তুল্যমূল্য। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, বরাবর আমরা একে অন্যকে দুষে আসছি। কেউই কখনও নিজেদের দোষের পসরা নিয়ে বলিনি, দেখ ভাই এই আমাদের দোষ, এগুলোকে তুচ্ছ করে এসো আমরা ভালোয় মন্দে বাঁচি, এবং এই দোষগুলোর সংশোধন করি। না, আমরা কদাপি এরকম সুবুদ্ধিতে পরিচালিত হইনি। না হিন্দুরা, না মুসলমানেরা।"
"বিষাদবৃক্ষ" ৪৭ পরবর্তী বরিশাল অঞ্চলের একটি খণ্ডিত স্মৃতিচিত্র হলেও এটি মূলত সেই সময়কার সমগ্র পূর্ববাংলার সামাজিক চিত্রের এক অসামান্য দলিল। পিছারার খাল, আর সেই খাল পাড়ের জোড়া রেইনট্রি বিষাদবৃক্ষে মিহিরের স্মৃতির হাত ধরে বার বার ফিরে এসেছে। প্রত্যেক মানুষই হয়ত আজীবন তার শৈশবকে খুঁজে ফিরে নানান ছুঁতোয়। মিহির সেনগুপ্ত একই সাথে তাঁর শৈশব এবং জন্মস্হানকে খুঁজে ফিরেছেন। যে দেশের আলো হাওয়ায় একজন মানুষের বেড়ে ওঠা, চাইলে তাকে হয়ত স্বভূমি ত্যাগে বাধ্য করা যায়। কিন্তু একজন জীবন্ত মানুষের বুকের ভেতর নিরন্তর বয়ে বেড়ানো স্মৃতির ভাণ্ডারে হাত দেবার সাধ্য পৃথিবীর কোন ক্ষমতাশালী শাসকই রাখেন না। মিহির তাই বার বার পিছারার খাল বেয়ে চলে আসতে চান তাঁর নাড়ীপোতা গ্রামে। রেইনট্রির শাখায় শাখায় আটকে থাকে তাঁর শৈশব কৈশোরের দুঃখ জাগানিয়া দিনরাত্রির গল্পগুলো। সেই পিছারার খাল কিংবা জোড়া রেইনট্রি হয়ত বা আজ আর নেই। কিন্তু লেখক মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষে তাদের অক্ষয় তুমুল সহবাস।
জীবনানন্দের কবিতার মতো বিশুদ্ধ স্বাদ পেলাম মিহির সেনগুপ্তের গদ্যে। হয়তো একই প্রকৃতির রূপ দুজনেই ধারন করেছিলেন তাই। বইটির নাম 'বিষাদবৃক্ষ', প্রতিটি বাক্য তাই যেন বিষাদে মাখা।
দেশভাগ নিয়ে সুনীল একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সবসময় মনে পড়ে। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এত বছ��� পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।”
দেশভাগ নিয়ে লেখা সকল সাহিত্যেই টের পাওয়া যায় এই বিপন্নতা। মান্টো, খুশবন্ত শিং কিংবা হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সিকান্দার আবু জাফর'দের লেখায় সিগ্নিফিকেন্টভাবে এসেছে দেশভাগ। ঋত্বিক ঘটক তো গোটা জীবন দেশভাগের বেদনা নিয়েই পার করে দিয়েছেন।
ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া উদ্বাস্তু মানুষের জীবনের যে শোকগাঁথা তার থেকে মিহির সেনগুপ্তের 'বিষাদবৃক্ষ' হয়তো কিছুটা আলাদা। শুধু দেশভাগ, দাঙ্গা নয়, মিহির যেন আত্মজৈবনিক এই লেখায় বারবার আঙুল তুলতে চেয়েছেন ধর্মের নামে নোংরা রাজনীতির দিকে। ৪৭ এ অনেকের মতো মিহির কিংবা তাঁর পরিবার দেশ ছেড়ে যাননি কিন্তু ঠিকই তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল নোংরা রাজনীতির কাছে পরাস্ত হয়ে। ধর্ম এই বইয়ে প্রোটাগনিস্টের ভূমিকা পালন করেছে, বইয়ের শুরুতে ঝালকাঠির কেওড়া গ্রামের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে থাকা ভ্রাতৃত্ব ক্রমেই কীভাবে শত্রু শত্রু খেলায় পরিণত হয় এবং এই পরিণতি কীভাবে ভাগ্য বদলে দেয় একদল মানুষের তাই যেন এই বইয়ের সারসংক্ষেপ।
এই বইয়ে বারবার ফিরে এসেছে দুর্বলের প্রতি সবলের হিংস্রতার মানচিত্র এবং এই মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে পড়ে বহুকাল থেকে শিখে আসা সহজ রাজনীতির পাঠ। ধর্ম যেখানে শিল্ড হয়ে দাঁড়ায় আর ধর্মের আড়ালে চলে মূলত জায়গা দখলের খেলা। দুরূহ এইসব বর্ণনা মিহির এঁকেছেন ভ্যানঘগের মতো কোমলভাবে, যদিও তাঁর এই বর্ণনা কখনও মনে হয়েছে একপেশে, তাই শেষ পর্যন্ত 'বিষাদবৃক্ষ'কে আমার কাছে দলিল মনে হয় না, বরং মনে হয় এক ভয়ঙ্কর বিষাদের আখ্যান।
তবে এই বইকে ব্যক্তিগত নোটবুক হিসেবে পড়লেও ভুল হবে, কেনোনা গল্পটা বরিশাল অঞ্চলের হলেও মোটামুটি এটাই ছিল তখনকার গোটা ভারতবর্ষের চিত্র। মিহির এখানে স্রেফ একজন অবজারভার, যে পিছারার খালে ডুবসাঁতার দিতে দিতে বারবার ফিরে যেতে চান তাঁর শৈশবে, যার কাছে ধর্ম খুব গৌণ কিছু, যার কাছে দেশ একটি মানচিত্র নয়, বরং শেকড়ের চেয়েও মূল্যবান কোন সম্পদ। শৈশবে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি, কিন্তু সেখানে যখন যোগ হয় দেশভাগের বেদনা, দেশ ছেড়ে যাওয়ার হাহাকার তখন রেইনট্রি গাছের দিকে তাকিয়েও মিহিরের মনে হতেই পারে, এ যেন 'বিষাদবৃক্ষ'।
এলোমেলো, খাপছাড়া লেখা। সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার একটা স্মেল পাওয়া যায়। এতো কিছুর পরে size matters, এক-দেড়শো পেইজে এই জিনিস শেষ হইলে তাও এক তারা বাড়াতাম। এতো বড় বই করার দরকার ছিলো না।
'বিষাদবৃক্ষ ' হলো টানটান গদ্যে লেখা এক অসামান্য স্মৃতিকথা। দেশভাগের পরেও যে সকল সংখ্যালঘু পরিবার পূর্ববঙ্গে রয়ে যায়, লেখক ছিলেন তেমনই এক পরিবারের সন্তান। নানা অভিজ্ঞতার মিশেলে এই স্মৃতিকথা পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয় এক বিষাদবৃক্ষের সাথে। সেই বৃক্ষের অবস্থান বর্তমান বরিশালের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে পিছারার খাল সামনে এগিয়ে মিশেছে বড় খালের সাথে, সেই খালপারে। লেখকের নিকট তাঁর শৈশব কৈশরের পরিচিত মানুষজন, চেনা এলাকা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলেও অক্ষত থেকে যায় শতবর্ষজীবী সেই প্রাচীন বৃক্ষ যেটি কিনা অনেক বিষাদের সাক্ষীস্বরূপ দণ্ডায়মান। একদিকে মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা লোপ পাওয়ায় বহু উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের টানা পারিবারিক ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে। অন্যদিকে কুখ্যাত পঞ্চাশ-একান্ন'র ভয়াবহ দাঙ্গার হাওয়া সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চলে যায়। সুতরাং, দেশত্যাগ যারা তখনও অবলম্বন করে নি, তাদের নিরাপত্তাই প্রধান প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালেই হিন্দু পরিবারের ভূ সম্পত্তি দখলের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের লোকায়ত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মেলা, পূজা পার্বণ প্রভৃতির উপরেও এসে যায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ। সেই সাথে গ্রামীণ কুটিল রাজনীতির মারপ্যাঁচ তো আছেই। মিহির সেনগুপ্ত লিখেছেন নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে নানা ঘটনা এবং সামাজিক -রাজনৈতিক অবস্থার পট পরিবর্তন। শহুরে রাজনীতির প্রেক্ষাপট তখন আলাদা হলেও, পূর্ববঙ্গীয় বিপুল প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে এই স্মৃতিকথা, একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। রিফিউজি পরিচয় নিয়ে যেসকল হিন্দু পরিবার দেশান্তরিত হয়েছিল তাদের থেকে পূর্ববঙ্গে মাটি কামড়ে রয়ে যাওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের সংগ্রাম ছিল অনেকটাই আলাদা। সেখানে এক সময়কার আত্মীয়, নিকটজনেরাও হয়ে ওঠে বিশ্বাসঘাতক, স্বার্থান্বেষী। ভূমিপুত্রদের চিরাচরিত জমির ক্ষুধা সেই সময় যেন চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। লুণ্ঠন, ডাকাতি, ধর্ষণের এক অলিখিত অধিকার পেয়ে যায় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র আর তার পোষা বাহিনী। এক সময় তলানিতে এসে ঠেকে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা। শিক্ষিত সমাজের একটা বিরাট অংশ নিজেদের মাটি ছেড়ে যাওয়ায় ধ্বস নামে বৌদ্ধিক ক্ষেত্রেও। একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যেহেতু ভূমি, ভিটা দখলকারীরা ছিল মূলত ভোগবাদী এবং সামন্তদের কূটবুদ্ধি কিংবা পারিবারিক উন্নত রুচির ধারাবাহিক ঐতিহ্যও তাদের কিছুমাত্র ছিল না, সুতরাং এক সময়ে সম্ভোগ শেষ হলে ভিটা, বাড়িগুলো পড়ে থাকে ফসিলের মতো কিছু চিহ্ন হিসেবে। আর উৎসব পার্বণেও ঢুকে পড়ে নিয়ন্ত্রণ এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। গ্রামীণ, লোকজ আঙ্গিকে রচিত ভাটিয়ালি, জারি সারি গান যার রচয়িতা কবিরা ছিল প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক, পরবর্তীকালের সংকলিত অবস্থায় দেখা যায় সেইসব গানের লাইনে লাইনে ঢুকে পড়েছে বিষবাষ্প, ভিন্ন সম্প্রদায়কে পৃথকীকরণ এবং বিদ্বেষ। বইটিতে খাঁটি চন্দ্রদ্বীপিয়, অর্থাৎ বরিশালের ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে লেখকের পরিবারের এবং গ্রামের নানা মানুষদের এবং পূর্বসূরিদের গল্প, সেই সাথে প্রভূত পার্বণের ব্রতকথা। সংবেদনশীল পাঠকমাত্রই তাতে আপ্লুত হবেন, কখনো বা গভীর বিষাদ তাকেও গ্রাস করবে। কীর্তিপাশা, নৈকাঠি, তারুলি ইত্যাদি গ্রামের মানুষজন, তাদের লোকজ স্থিতাবস্থা, দুর্বৃত্তদের আবির্ভাব, আস্ফালন, সাংস্কৃতিক বিদীর্ণতা, এক সময় সবকিছুকে ছাপিয়ে শুধুই সেই দণ্ডায়মান বিষাদবৃক্ষের বাস্তববতা, সব মিলিয়ে স্মৃতির কুয়াশা ডিঙিয়ে এক সকরুণ জনপদের দিকে পিছু নেওয়া।
স্মৃতিকাতরতা বড্ড গোলমেলে একটা জিনিস। মানুষ চাক আর না চাক, শৈশবের স্মৃতির বোঝা তাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হয়। শেকড়ছাড়া মানুষ তাই বারে বারে সেই স্মৃতির কাছেই আশ্রয় খোঁজে। বিষাদবৃক্ষে যেমন মিহির সেন বার বারই ফিরে গেছেন পিছরার খালের সেই আধা-ইউটোপিয়ান, আধা পরাবাস্তব জগতে। দেশভাগের পর বরিশালের কেওড়া গ্রামের সেই খাল সাক্ষী কত বাঁকবদলের, কত হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনার। কখনো হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক অবিশ্বাস, আবার কখনো তাদের প্রীতি, গভীর হৃদয়াবেগ সেই খাল দিয়ে বয়ে গেছে নির্লিপ্ত স্রোতের মতো। লেখক ছিলেন জমিদার বাড়ির ছেলে। সেই বড়বাড়ি অবশ্য কালের গর্���ে শ্রী হারিয়ে অনেক আগেই, লেখক শুধু দেখেছেন সেই প্রাসাদোপম দালানের একটু একটু করে চুন-সুরকির ক্ষয়। কিন্তু ধন না থাকলেও জাত্যাভিমান ছিল ষোলআনা, সেই হীনমন্যতার গুরুভার বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়েছে আকৈশোর।
দেশভাগের পরের সেই সর্পিল সময়ে বাংলার হঠাৎ করেই একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। কেউ কেউ হঠাৎ আবিষ্কার করে, এতোদিনের চেনা মাটিতে তারা একরকম পরবাসী। ধর্ম একই জমিতে তুলে দিয়েছে বিভেদের দেয়াল, ফাটল ধরিয়েছে বিশ্বাসের দেয়ালে। সংশয়, দ্বিধার সেই কুহেলিকাময় সসময়ে লেখক বার বার ফিরে গেছেন সময়-ভ্রমণে। সেই ফেরায় গ্লানি আছে, হতাশা আছে, সেসব লেখক স্বীকারও করেছেন অকুন্ঠে। নিজের পরিচয় নিয়েও একটা হীনমন্যতা কাজ করেছে সবসময়, সেটাও মেনেছেন অকপটে। ঠিক এজন্যই বিষাদবৃক্ষ বুকের কোথাও একটা তোলপাড় তোলে। হঠাৎ খেয়াল হয়, আমরা তো কমবেশি সবাই আসলে শেকড় ফেলেই এসেছি। কারও কারও সেখানে ফিরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়, কারও হয় না। কিন্তু লেখক নিম্ন মধ্যবিত্তের চোখে যেভাবে সমাজের ওপর ও নিচু তলাকে দেখেছেন, সেই চোখ তো সবার থাকে না। লেখকের ভাষায় সেটি আসলে স্মৃতিকথা নয় শুধু, কালচারাল অ্যানথ্রপলজি।
বেশ পৃথুল বইটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করার মতো নয়। এই বইতে অবগাহন করতে হয়, একটু একটু চোরাস্রোতে সাঁতরালেই পৌঁছে যাওয়া যায় বিষাদসিন্ধুর মধ্যখানে। তবে সুসম্পাদিত হলে বইটির কলেবর অনেক কমানো যেত। পুনরাবৃত্তি হয়েছে অনেক জায়গায়, সেসব এড়ানো যেত অনায়াসেই। বেশ কিছু অপ্রচলিত শব্দও পড়ার গতি অনেক সময় রুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু তারপরও বিষাদবৃক্ষের ছায়া আশ্রয় নেওয়ার জন্য সেসব কোনো বাধাই নয়। নিজেকে চেনার জন্য এটুকু তো করাই যায়!
This was a profoundly moving book. I am purposely reviewing in English because I am not at all proficient in writing good bengali and the ones I have read in bengali have done it justice. I just feel sad that this book is quite untranslateable because much of the dialogues, imparted wisdoms, folk fables and tales are all written in the dialect and accent of Barisal, the region of (now) Bangladesh, where the author 's family had lived for generations. There is a body of Partition Literature but this book (which won awards here in West Bengal) is the memoir of one whose family continued to live in East Pakistan till the 1960s in a land they had always considered to be their own, but were treated as minority, after Partition. The writer's deep love, longing for his roots lingers in him years later when his family was forced to move to India because of rising violence against Hindus, growing lawlessness and complete lack of opportunity or even hope of improvement in their condition. His description of the locality he grew up in, the different kinds of people, their way of life, the food they ate, the rituals they followed, has been narrated in living detail. He has looked at the social and political background too, giving a history of how this place was carved out of the Sunderbans and by whom. He is impartial about his landowning family, the reason for losing everything bit by bit, about his educated, drama-loving & play-acting father, who never did a day's work but was forced to become a teacher after the family had been reduced to starvation. The little educated but hard-working orphan mother with a nightingale 's voice held everything together. The father never bothered to send his sons to school and the writer spent years reading all the books & magazines he could find in the house and from his neighbour such was his yearning and hunger for knowledge . With unexpected help from others he managed to get himself admitted to school much later and do well. He and the family suffered gravely from the father's elder brother, who was in charge of the family land and business and seems to have been one of those cunning, selfish, smooth - talking individuals. But times were changing, and the middle class and professionals - the doctors teachers lawyers who were mostly hindus were terrorized into leaving everything behind & run away to Hindustan. This led to a complete vacuum in the social structure and the age old rural society with its own rhythms broke down. There are heartbreaking individual stories - an old Muslim woman who takes pity on the writer whose family had once been rich but was now starving and gave him food, which as a hindu he is not supposed to eat. But eat he did and realised that nothing indeed had happened, no one knew so he had not 'lost' his caste; the young hindu woman chased by a Muslim youth running 'like a deer runs from a lion' and the writer, a boy then of 10/11 trying to stop the man gets beaten but retaliates with a bamboo stick so that the girl has time to reach the safety of her house & locality. But it isn't all terrible. Beautiful picture of his mother sitting on the steps of their mansion on a moonlit night, singing song after song as others listened quietly or folk singers & play actors from nearby villages, after the harvest, coming to act out mythological stories in their finery, the language however being absolutely down to earth, scatological dialect. The writers language is lyrical, philosophical, meditative and sometimes repetitive. It has been my good fortune to read this book. I have not been able to convey the intricacy or sweetness of this book, nor have I been able to show how layered it is,what hidden depths it contains.
কিছু বিষাদ মানুষের আজন্মের, কিছু তাঁকে ঘিরে রাখে আমৃত্যু। কখনও সে বিষাদ কেবল ব্যক্তির একার। কিছু বিষাদ একজনের হলেও আলাদা আলাদাভাবে অনেকের। বাংলার পরিণত, মনষ্ক মানুষের কাছে একটি বিষাদের নাম দেশভাগ। যারা সেই সময়ে ঘটনাটির মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের অনেকের জন্য কিংবা প্রত্যেকের জন্য একটা জখম। সময়ের সাথে কারও জখম আরও গভীর হয়েছে, কারও শুকিয়ে গেছে, আর কেউ এক বিষাদ নিয়ে বেঁচে থাকে।
মিহির সেনগুপ্তের বেলায় সে এক জখম, এক বিষাদের গল্প। অবিভক্ত বাংলার বরিশালের কেওরা গ্রামের প্রভূত ভু-সম্পত্তির অধিকারী পরিবারে তার জন্ম। কিন্তু দেখেছেন সে পরিবারের ক্ষয়। যে বাড়িতে মানুষ পাত পাড়ত, একটা সময়ে সে বাড়ির মানুষদের হাত পাতার অবস্থা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে বেড়ে ওঠা মিহির সে সময়কে, মানুষকে দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। তার মাঝে গভীর ছাপ রেখে গিয়েছিল সে অভিজ্ঞতা।
‘বিষাদবৃক্ষ’ মিহির সেনগুপ্তের আত্মজীবনী। আত্মজীবনী বলতে একেকবারে নিজের কথা। লেখকদের জীবনীতে দেখা যায় তাদের সঙ্গে উঠে আসে আরও নানা পরিচিত, বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম তাদের কথা। কিন্তু ‘বিষাদবৃক্ষ’ কেবলই মিহির সেনগুপ্তের নিজ জীবন, তার দেখা সময়, স্থান আর মানুষের কথা বলে। কেবল বলেই না, খুব গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখা এবং মমতার সাথে ফুটিয়ে তোলা একেকটা শব্দ বাক্য আমাদের সে দৃশ্যগুলো দেখিয়ে দেয় খুব সহজে। নানা জটিল বিষয়ের বর্ণনা, বিশ্লেষণ থাকার পরও অসম্ভব সুখপাঠ্য এ বই।
‘বড়বাড়ি’, ‘পিছরার খাল’ আর ক্ষয়িষ্ণু সমাজের চিত্র দেখিয়েছেন লেখক কিন্তু সে লেখার মূল্য অন্য অনেক লেখার চেয়ে বেশি। দেশভাগ নিয়ে অনেকে লিখেছেন। তথ্য উপাত্ত, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, নিছক স্মৃতি সমৃদ্ধ অনেক লেখাই পড়ার সুযোগ হয়েছে কিন্তু মিহির বাবুর মতো এমন গভীর, সহজ করে কেউ কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। তার পিছরার খাল সংলগ্ন ছোট জগতের কথা লিখতে গিয়ে তিনি মানুষের মন, আর্থসামাজিক অবস্থা, সময়ের বদলে যাওয়া, রাজনীতি আর সমাজের সে অন্তর্ভেদী চিত্র এঁকেছেন তা বাংলার মানুষের সমাজ এবং চরিত্রের দর্পণ বললে অত্যুক্তি হয় না।
দেশভাগের আগে দাঙ্গা, তার আগে পরে আর্থসামাজিক নানা কারণে মানুষের বদলে যাওয়া। দেশভাগের সঙ্গে জড়িত নানা ঘটনার পেছনে এই জিনিসগুলো কতভাবে এবং কি কি ভাবে কাজ করেছিল, প্রভাব ফেলেছিল মিহির সেনগুপ্ত খুব সুন্দর করে সে কথা ব্যখ্যা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে তার পিছরার খালের চৌহদ্দি। এখানে যেমন পাওয়া যায় অসাম্প্রদায়িক প্রীতির চিত্র, তেমনি পাওয়া যায় ভেঙে পড়া হিন্দু মুসলিম সম্পর্কে উভয় ধর্মের মানুষের ভুল, দোষ। কিংবা সময়ের দাবি।
ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যেমন আছে, তেমন রয়েছে আত্মস্মৃতি। তার দামও কম নয়। পরিবার, বন্ধু, পত্নী, কারও কথা বাদ দেননি লেখক। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে নিজের জীবনের কোথাও লিখেছেন। সে সব আপন, ব্যক্তিগত স্মৃতিও পাঠকের মনে দোলা দেয়।
লেখকের জন্মের আগেই তার পরিবারের আর্থিক অবনতি হয়। জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যে। পড়াশোনায় বারবার বাঁধা এসেছে। কিন্তু বাধ্য হয়ে ভিটে ছাড়লেও কোনদিন ভুলে যাননি সে ভূমির কথা। এমনকি বইটার অনেক জায়গায় অনেক কথাই লিখেছেন ‘বরিশাইল্যা ভাষায়’। সে ভাষা, সে ভূমি আর ভূমির মানুষের প্রতি তার মমত্ব ফুটে ওঠে ছত্রে ছত্রে। আর ‘বিষাদবৃক্ষ’র পাঠকের কাছে মিহির সেনগুপ্তকে বড় আপন মনে হয়, মনে হতে বাধ্য। কেননা তিনি আসলেই আপন।
*১৯৮৬ থেকে নিয়মিত বাংলাদেশে আসতেন মিহির সেনগুপ্ত। শেষ এসেছিলেন ২০১০ সালে।
**মিহির সেনগুপ্ত ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিলেন কিন্তু যে মেয়েটির সঙ্গ�� তার ভাব ভালোবাসা ছিল সে মেয়েটি বাংলাদেশেই থাকতেন, এবং ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পরপরই ’৭২ সালে তাদের বিয়ে হয়। মিহিরবাবুর ভাষায়, ‘অদ্যবধি মহিলাটি আমাকে একটি প্রাচীন শিলা খণ্ডের মতো আঁকড়ে ধরে আছে’।
4/5 দিলাম, পূর্ণাঙ্গ নম্বর দিলাম না কারন লেখক সামনের ঘটনা পিছনে, পিছনের ঘটনা সামনে করে বলেছেন। ক্রমানুসারে বললে হয়তো এই বই হয়ে উঠতো 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে'র মত! তা যাইহোক আমার বাড়ি যেহেতু বরিশালের কোন এক প্রত্যন্ত গ্ৰামে আর এই উপন্যাসে অনেক বরিশালের ডায়ালেক্ট ব্যবহৃত হয়েছে তাই আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু যারা বরিশালের বাইরে থাকে তারা কি ঠিকমত বুঝতে পার��ো? আমার প্রতিবেশী দাদা ((বাবার (আপন নয়) কাকা)) বলতো যে ঘটনাগুলো তার সাথে অনেক মিল পেয়েছি এই গল্পে। তারা ৫১ এর দাঙ্গার পর স্কুলে পড়া বাদ দিয়ে দিয়েছিল ভয়ের কারণে। আবার লেখক হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনদের সমালোচনা করেছেন তাই হয়তো এই বই হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে হিন্দু বিদ্বেষী আবার মুসলমানদের কাছে মুসলিম বিদ্বেষী মনে হবে। তখন তারা অন্য দেশের তুলনা টানবে। তবে বিবেকবান পাঠকের এটা খেয়াল রাখতে হবে তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কীরূপ ছিল আর সেই আতঙ্কের মধ্যে সংখ্যালঘুদের কিরকম লাগে? লেখক যদি একতরফা লিখতেন তাহলে কি হত? আতঙ্কে যারা থাকে কেবল তারাই বুঝতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফ্যাসিজম। নিজে একজন সংখ্যাগুরু হয়ে সংখ্যাগুরুদের দোষ দেখা যায় না। They are blind to the mischief by their own community. So keep patience and read the book and feel that dismay if you have to flee from your motherland!
This was a difficult read for me as my Bangla isn't that refined and combine with that Barisal's own dialect, মনু রে! Despite that I kept on and I loved this book. He puts a microscope over his childhood in his tiny village between the independence of India to when the Bangladesh liberation was was brewing and from that microscosm you understand how the Hindu minorities fared then, how the communities changed and led to our minorities fleeing for India from the then East Pakistan. The book stops at a point where the idea of an independent Bangladesh just starts germinating and the Author faces the dilemma of leaving to find a life with dignity or staying in his own country.
These stories are the shades beneath the broad strokes of history that really help explain why things transpired that way. I would recommend to everyone and have been.
অনবদ্য, লেখকের বর্ণনার কৌশল। আচ্ছা বই নিয়ে বলতে গেলে বলা বাহুল্য এটা লেখকের আত্মজীবনী। তবে,এটা স্পষ্ট ছিল যে বইটি নিছক আত্মজীবনী নয়,এটি তার সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের গভীর ভাষ্য হিসেবে কাজ করেছে।যুদ্ধের সময় সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হওয়া সংগ্রামের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা খুব কমই পেয়েছি। যুদ্ধের সময় হিন্দুদের অবস্থা, কেন তাদের বেশিরভাগ চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন।
দেশের কথা মাটির কথা পূর্ববাংলার আত্মার সাথে কথকতা .. এক জীবনের প্রবজ্যা ও পরিনির্বাণের আকুতির কথা..বেদনায় দীর্ণ ভালোবাসায় আপ্লুত যাপনের কথায় শৈশব যৌবন ... সময়ের নদী বয়ে চলে